দিলারা হাফিজ
দুই মাত্রার ছোট্ট একটি শব্দÑ দেশ! এই দেশ থাকে হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভেতরে! এই দেশ থাকে মানব প্রাণের গৌরবে-সৌরভে। দেহ ও মন-মননের সর্বস্ব জুড়ে থাকে স্বদেশ- স্বভূমি স্বজাতিÑ প্রেম ও প্রত্যয়ের নিখিল আধারে ও অরূপে! বৃহত্তর এক মানব-সম্প্রদায়ের অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংজ্ঞা নির্ণয়ে সমগ্রতার সন্ধান লিপিবদ্ধ থাকে যে একখ- পৃথক নিজস্ব ভূখ-েÑ তাকেই স্বদেশ বলে। এ কারণেই দেশের জন্যে অকাতরে মানুষ তার জীবন ও সংগ্রামকে একই সমতলে একীভূত করে আত্মোৎসর্গ করে যেতে পারে মহত্তর দেশপ্রেম-ভাবনা থেকে। দেশপ্রেমের চেয়ে বড় কোনো প্রেম নেই এই ইহজগতেÑ পরিণত এই বয়সে দাঁড়িয়ে আমিও আজ টের পাই গভীরভাবে। মনে হয় দেশ যখন সংকটাপন্ন অবস্থায় ভাসমান থাকে তখন ব্যক্তিপ্রেম তুচ্ছ মনে হয়। এমনকি পরম মাতৃত্বরসও বুঝি ফিকে হয়ে দেখা দেয় কখনো কখনো। স্বদেশ প্রেমের চেয়ে বড় কোনো প্রেম নেই পৃথিবীতে।
আজ-কালÑ একথাই অনুধাবন করি মরমে মরমে! হৃদয়ের অনুতন্ত্রীতে বাজে সে মহা ভৈরবী সুরÑ সময়ে অসময়েÑ ভীষণ গভীরভাবে। প্রসঙ্গত কবি আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন, “ব্যক্তি জন্ম নেয় এক মুষ্টি ধূলি থেকে সরল দীন, ব্যক্তির অন্তর থেকে জন্ম নেয় এক জাতি।”
সাহসী ও প্রতিভাময় এই জাতির নাম বাঙালি। চিরকালের ভালোবাসার কাঙাল এই বীর বাঙালি জাতি!
যারা বুকের সাহস আর দেশপ্রেমময় অস্ত্র হাতে নয় মাস যুদ্ধ করে একটি দেশ স্বাধীন করতে পেরেছে।
অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবার মতো জাদুকরি এক মহৎ ভালোবাসার শক্তি নিহিত আছে বলেই বাঙালি মাত্রই শৈশবে শব্দ ও কবিতায় রচনা করে তাদের প্রথম ভালোবাসার নৈবেদ্য। দেশমা-ই যে এক্ষেত্রে আবেগপ্রবণ জাতির সমুখে প্রথম প্রেমিকা রূপে উদ্ভাসিত হয়Ñ তা বলাই বাহুল্য। জীবনের সন্ধিলগ্নে কণ্ঠে তুলে নেয় সেই অবিনাশী সুর। “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি/মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসিÑ এমতাবস্থায়, দেশমাতৃকার সূর্যসন্তানেরা নিজ নিজ মা-ভূমিকে রক্ষা করতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে তবে ঘরে ফেরে মা-প্রেমিক অদম্য এই দুরন্ত সন্তানেরা। হতে পারি যদি, এমন একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকÑ এর চাইতে বড় গৌরব আর কিসে হতে পারে আমার?
২.
আমাদের হাজার বছরের বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয়ে যেমন গর্বিত হই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্যে। তেমনি ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনটি অনন্য এক মর্যাদায় আমাদের অভিষিক্ত করেছে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের তিরিশ লক্ষ সূর্যসন্তান দুই লক্ষ মা-বোনের যে আত্মত্যাগÑ যাঁদের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকাÑ বিজয় দিবসের প্রাক্কালে তাদের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জানাই। স্বাধীন ভূখ-ে আমাদের এই যাত্রা খুব বেশি দিনের কথা নয়। মাত্র অর্ধ-শতাব্দীর পথ পার করেছি মাত্র। তবু তো বলতেই পারিÑ হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরা পেরিয়ে এসেছি সবে ৫৪টি বছর।
এই পথ-পরিক্রমাও খুব কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না। দুর্গম এই যাত্রাপথে বার বার আমাদের জীবনে এসেছে নানা রকম প্রতিরোধ, প্রতিবাদ। হোঁচট খেয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতার ঘোষক, ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক চলেছে বেশ কিছুকাল। বিভ্রান্ত হয়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। রাজপথে তাদের রক্ত ঝরেছে অবিরল ধারায়। প্রাণের পরে প্রাণ ঝরে গেছে অকাতরেÑ শত-সহ¯্র। আমাদের চোখের জল মুছতে না মুছতেই ঝরেছে পুনরায়। এর যেন কোনো শেষ নেই। মা-বোনেরা নতুন করে বৈধব্যের শাদা জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে। হঠাৎ করেই পিতা কিংবা ভাই-বন্ধুদের অনেকেই হারিয়ে গেছে পাশ থেকে। কত যে বাকরুদ্ধ সময় খসে গেছে জীবন থেকে তারও কি শেষ আছে শেষাবধি!
৩.
যে কোনো স্বাধীনতা অর্জনের পথে রক্তের দাগ লেগে থাকবেÑ তা বলাই বাহুল্য। স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালেই প্রথম রক্ত¯্রােত বয়ে গেলো স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতাত্তোর শিশু বাংলাদেশ ও তার জনগণ শোকে স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ হলো বিপন্নবোধে। এভাবে বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের হাত ধরাধরি করে চলেছে এদেশের সেনা শাসন-ব্যবস্থা। জনগণ পৃষ্ঠ হয়েছে যথানিয়মে। সেনা ছাউনি থেকে বেরিয়ে গণেশ উল্টে দিয়ে যে যার মতো ক্ষমতা দখল করেছে। স্বৈরসাশকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বলা বাহুল্য স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে শুধু পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের হত্যাকা-ই শেষ কথা নয়, এরপর জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের স্থলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৮ সালের পহেল সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চার বছর বাংলাদেশ শাসন করার পর ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নির্মমভাবে নিহত হন। এরপর ক্ষমতা গ্রহণ করেন সামরিক শাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে ক্ষমতা দখল করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার সরকার মূলত সামরিক একনায়কতন্ত্র। এজন্যে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার দেশ পরিচালনাকে অনেকেই সামরিক একনায়তন্ত্রের সাথে তুলনা করেন। তিনি জাতীয় পার্টি নামক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্রপন্থী গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৯০ সালে গণবিক্ষোভের চাপে এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনের অভাবে তিনি মূলত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই গণআন্দোলনে নূর হোসেন, ড. মিলনের মতো উদীয়মান প্রতিভাধর সন্তানদেরকে হারাতে হয়েছে আমাদের। ড. মিলনের মা ছিলেন আমার ইডেন কলেজের সহকর্মী। আজো তার চোখের জল দিশেহারা করে আমাকে। নূর হোসেন ও মিলনের মায়ের বুক খালি হলো বটে, কিন্তু এদেশের জনগণ তবু তাদের কাক্সিক্ষত ও ঈপ্সিত শাসন-ব্যবস্থা ফিরে পেলো না।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ক্ষমতায় ছিলো তিনবার। ২০০১ সালে ক্ষমতার মসনদে বসার পর ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট আওয়ামী লীগের এক জনসভায় নির্মম গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনা ঘটে। যে হামলায় ২৪ জন নিহত হয় এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হয়। এই হামলায় নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী মিসেস আইভি রহমান অন্যতম, যিনি বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩০টি আসন লাভ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। এ সময়ের মধ্যে তিনি দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নয়ন করে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের দিকে ধাবিত করেন। এই সময়ে মানুষের ভোটাধিকার হরণ ও ব্যাপক দুর্নীতির কারণে দলটি বিতর্কিত হতে থাকে। সর্বশেষ জুলাই আগস্টের কোটাবিরোধী তথা বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলনের ফলে ৫ আগস্টে ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে তিনি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনকে জুলাই বিপ্লব নামেও অভিহিত করা হয়। এই আন্দোলনে হাজারো প্রাণ ঝরে গেছে অকাতরে। জীবনপণ এই লড়াইয়ে প্রথম শহীদ হয় রংপুরের আবু সাঈদ। পরে মুগ্ধসহ সাহসী বহু তরুণ-প্রাণ অকাতরে রক্ত দিয়ে বৈষম্যবিরোধী এই আন্দোলনকে সফল করে তোলে। শহীদের রক্তে পুনরায় রাঙা হয়ে ওঠে এই বাংলার মাটি। নূর হোসেন, ডা. মিলন এবং সর্বশেষ জুলাই বিপ্লবে শহীদ আবু সাঈদ ও মুগ্ধসহ অনেকের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশ অর্ধ শতাব্দী পার করে এসেছে। তবু এই দেশ নিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা সমূলে দূর হয়নি কখনো। এ প্রসঙ্গে শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হকের একটি বক্তব্যের অংশ বিশেষ উল্লেখ করছি।
“নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে জাতির সহায়তায়। মহত্ত্ব নিয়ে অনাসক্ত হয়ে ব্যক্তিসত্তার স্বকীয়তা ভুলতে হবে; লুপ্ত করতে হবে। জাতির স্বার্থই হবে ব্যক্তির স্বার্থ। জাতির কল্যাণেই হবে ব্যক্তির কল্যাণ।”
প্রসঙ্গত মনে পড়ছে প্রথম বিজয় দিবসের কথা। কীভাবে শুরু হয়েছিলো এই বিজয় উৎযাপন আমাদের। যদি ধরে নিইÑ বাংলাদেশ নামক দেশটি পৃথিবীর দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে যখন থেকে স্বীকৃতি পেলোÑ সেটি তার জন্মলগ্ন। বলাবাহুল্য বিজয়ের মাসব্যাপী শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি সেবীরা নানাভাবে বর্ণাঢ্য উৎযাপনে স্মরণীয় করে তোলে আমাদের বিজয়ানন্দকে। ষোলই ডিসেম্বরে সকলেই প্রায় লাল-সবুজ রঙ্গের পোশাকে নিজেদের সাজিয়ে তোলে। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার দুপাশে লাল-সবুজের আলোকসজ্জা যেন এই উৎযাপন আনন্দে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করে দেয়। এছাড়া ১৯৭২ সালে যে নিয়মাবলি জারি হয়েছিলোÑ সেগুলো নিম্নরূপ।
১. ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিজয় দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়।
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এজন্যে চলচ্চিত্র, কবিতা, নিবন্ধ, গণমাধ্যম ইত্যাদিতে বিভিন্নভাবে এই বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়।
৩. এই দিন উপলক্ষেÑ বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের আয়োজন করে থাকে। এছাড়া, দেশের প্রতিটি উপজেলায় বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ, বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান, মতবিনিময় সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।
৪. দেশের প্রধান সড়কগুলো জাতীয় পতাকা দিয়ে সাজানো হয়। এই দিনে ঢাকার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
৫. ১৯৭১: স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
৬. ১৯৭২: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংবিধান প্রকাশিত হয়।
৭. ১৯৭২: ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গ্যাজেটের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় খেতাব ঘোষণা করা হয়।
৮. ১৯৯৬: ২৫ বছর পূর্তি উৎসব করা হয়।
৯. ২০১৩: জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ২৭, ১১৭ জন স্বেচ্ছাসেবী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার লাল এবং সবুজ ব্লক নিয়ে একত্রে জড়ো হয়ে বিশ্বের বৃহত্তম মানব পতাকার নতুন বিশ্ব রেকর্ড করে।
১০. ২০২১ ৫০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করা হয় মহা ধুমধামের সঙ্গে।
পরিশেষে দেশমায়ের বন্দনায় বলি, মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে! সেই দেশ-মায়ের স্পর্শে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের অপর একটি কবিতার কথাÑ তার কণ্ঠে কণ্ঠ দিয়ে আজ বলিÑ
“সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে,
সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে,
জানিনে তোর ধন রতন আছে কিনা রাণীর মতন,
শুধু জানি, আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে।”
দিলারা হাফিজ
সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
দুই মাত্রার ছোট্ট একটি শব্দÑ দেশ! এই দেশ থাকে হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভেতরে! এই দেশ থাকে মানব প্রাণের গৌরবে-সৌরভে। দেহ ও মন-মননের সর্বস্ব জুড়ে থাকে স্বদেশ- স্বভূমি স্বজাতিÑ প্রেম ও প্রত্যয়ের নিখিল আধারে ও অরূপে! বৃহত্তর এক মানব-সম্প্রদায়ের অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংজ্ঞা নির্ণয়ে সমগ্রতার সন্ধান লিপিবদ্ধ থাকে যে একখ- পৃথক নিজস্ব ভূখ-েÑ তাকেই স্বদেশ বলে। এ কারণেই দেশের জন্যে অকাতরে মানুষ তার জীবন ও সংগ্রামকে একই সমতলে একীভূত করে আত্মোৎসর্গ করে যেতে পারে মহত্তর দেশপ্রেম-ভাবনা থেকে। দেশপ্রেমের চেয়ে বড় কোনো প্রেম নেই এই ইহজগতেÑ পরিণত এই বয়সে দাঁড়িয়ে আমিও আজ টের পাই গভীরভাবে। মনে হয় দেশ যখন সংকটাপন্ন অবস্থায় ভাসমান থাকে তখন ব্যক্তিপ্রেম তুচ্ছ মনে হয়। এমনকি পরম মাতৃত্বরসও বুঝি ফিকে হয়ে দেখা দেয় কখনো কখনো। স্বদেশ প্রেমের চেয়ে বড় কোনো প্রেম নেই পৃথিবীতে।
আজ-কালÑ একথাই অনুধাবন করি মরমে মরমে! হৃদয়ের অনুতন্ত্রীতে বাজে সে মহা ভৈরবী সুরÑ সময়ে অসময়েÑ ভীষণ গভীরভাবে। প্রসঙ্গত কবি আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন, “ব্যক্তি জন্ম নেয় এক মুষ্টি ধূলি থেকে সরল দীন, ব্যক্তির অন্তর থেকে জন্ম নেয় এক জাতি।”
সাহসী ও প্রতিভাময় এই জাতির নাম বাঙালি। চিরকালের ভালোবাসার কাঙাল এই বীর বাঙালি জাতি!
যারা বুকের সাহস আর দেশপ্রেমময় অস্ত্র হাতে নয় মাস যুদ্ধ করে একটি দেশ স্বাধীন করতে পেরেছে।
অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবার মতো জাদুকরি এক মহৎ ভালোবাসার শক্তি নিহিত আছে বলেই বাঙালি মাত্রই শৈশবে শব্দ ও কবিতায় রচনা করে তাদের প্রথম ভালোবাসার নৈবেদ্য। দেশমা-ই যে এক্ষেত্রে আবেগপ্রবণ জাতির সমুখে প্রথম প্রেমিকা রূপে উদ্ভাসিত হয়Ñ তা বলাই বাহুল্য। জীবনের সন্ধিলগ্নে কণ্ঠে তুলে নেয় সেই অবিনাশী সুর। “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি/মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসিÑ এমতাবস্থায়, দেশমাতৃকার সূর্যসন্তানেরা নিজ নিজ মা-ভূমিকে রক্ষা করতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে তবে ঘরে ফেরে মা-প্রেমিক অদম্য এই দুরন্ত সন্তানেরা। হতে পারি যদি, এমন একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকÑ এর চাইতে বড় গৌরব আর কিসে হতে পারে আমার?
২.
আমাদের হাজার বছরের বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয়ে যেমন গর্বিত হই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্যে। তেমনি ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনটি অনন্য এক মর্যাদায় আমাদের অভিষিক্ত করেছে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের তিরিশ লক্ষ সূর্যসন্তান দুই লক্ষ মা-বোনের যে আত্মত্যাগÑ যাঁদের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকাÑ বিজয় দিবসের প্রাক্কালে তাদের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জানাই। স্বাধীন ভূখ-ে আমাদের এই যাত্রা খুব বেশি দিনের কথা নয়। মাত্র অর্ধ-শতাব্দীর পথ পার করেছি মাত্র। তবু তো বলতেই পারিÑ হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরা পেরিয়ে এসেছি সবে ৫৪টি বছর।
এই পথ-পরিক্রমাও খুব কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না। দুর্গম এই যাত্রাপথে বার বার আমাদের জীবনে এসেছে নানা রকম প্রতিরোধ, প্রতিবাদ। হোঁচট খেয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতার ঘোষক, ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক চলেছে বেশ কিছুকাল। বিভ্রান্ত হয়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। রাজপথে তাদের রক্ত ঝরেছে অবিরল ধারায়। প্রাণের পরে প্রাণ ঝরে গেছে অকাতরেÑ শত-সহ¯্র। আমাদের চোখের জল মুছতে না মুছতেই ঝরেছে পুনরায়। এর যেন কোনো শেষ নেই। মা-বোনেরা নতুন করে বৈধব্যের শাদা জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে। হঠাৎ করেই পিতা কিংবা ভাই-বন্ধুদের অনেকেই হারিয়ে গেছে পাশ থেকে। কত যে বাকরুদ্ধ সময় খসে গেছে জীবন থেকে তারও কি শেষ আছে শেষাবধি!
৩.
যে কোনো স্বাধীনতা অর্জনের পথে রক্তের দাগ লেগে থাকবেÑ তা বলাই বাহুল্য। স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালেই প্রথম রক্ত¯্রােত বয়ে গেলো স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতাত্তোর শিশু বাংলাদেশ ও তার জনগণ শোকে স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ হলো বিপন্নবোধে। এভাবে বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের হাত ধরাধরি করে চলেছে এদেশের সেনা শাসন-ব্যবস্থা। জনগণ পৃষ্ঠ হয়েছে যথানিয়মে। সেনা ছাউনি থেকে বেরিয়ে গণেশ উল্টে দিয়ে যে যার মতো ক্ষমতা দখল করেছে। স্বৈরসাশকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বলা বাহুল্য স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে শুধু পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের হত্যাকা-ই শেষ কথা নয়, এরপর জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের স্থলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৮ সালের পহেল সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চার বছর বাংলাদেশ শাসন করার পর ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নির্মমভাবে নিহত হন। এরপর ক্ষমতা গ্রহণ করেন সামরিক শাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে ক্ষমতা দখল করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার সরকার মূলত সামরিক একনায়কতন্ত্র। এজন্যে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার দেশ পরিচালনাকে অনেকেই সামরিক একনায়তন্ত্রের সাথে তুলনা করেন। তিনি জাতীয় পার্টি নামক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্রপন্থী গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৯০ সালে গণবিক্ষোভের চাপে এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনের অভাবে তিনি মূলত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই গণআন্দোলনে নূর হোসেন, ড. মিলনের মতো উদীয়মান প্রতিভাধর সন্তানদেরকে হারাতে হয়েছে আমাদের। ড. মিলনের মা ছিলেন আমার ইডেন কলেজের সহকর্মী। আজো তার চোখের জল দিশেহারা করে আমাকে। নূর হোসেন ও মিলনের মায়ের বুক খালি হলো বটে, কিন্তু এদেশের জনগণ তবু তাদের কাক্সিক্ষত ও ঈপ্সিত শাসন-ব্যবস্থা ফিরে পেলো না।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ক্ষমতায় ছিলো তিনবার। ২০০১ সালে ক্ষমতার মসনদে বসার পর ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট আওয়ামী লীগের এক জনসভায় নির্মম গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনা ঘটে। যে হামলায় ২৪ জন নিহত হয় এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হয়। এই হামলায় নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী মিসেস আইভি রহমান অন্যতম, যিনি বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩০টি আসন লাভ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। এ সময়ের মধ্যে তিনি দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নয়ন করে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের দিকে ধাবিত করেন। এই সময়ে মানুষের ভোটাধিকার হরণ ও ব্যাপক দুর্নীতির কারণে দলটি বিতর্কিত হতে থাকে। সর্বশেষ জুলাই আগস্টের কোটাবিরোধী তথা বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলনের ফলে ৫ আগস্টে ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে তিনি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনকে জুলাই বিপ্লব নামেও অভিহিত করা হয়। এই আন্দোলনে হাজারো প্রাণ ঝরে গেছে অকাতরে। জীবনপণ এই লড়াইয়ে প্রথম শহীদ হয় রংপুরের আবু সাঈদ। পরে মুগ্ধসহ সাহসী বহু তরুণ-প্রাণ অকাতরে রক্ত দিয়ে বৈষম্যবিরোধী এই আন্দোলনকে সফল করে তোলে। শহীদের রক্তে পুনরায় রাঙা হয়ে ওঠে এই বাংলার মাটি। নূর হোসেন, ডা. মিলন এবং সর্বশেষ জুলাই বিপ্লবে শহীদ আবু সাঈদ ও মুগ্ধসহ অনেকের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশ অর্ধ শতাব্দী পার করে এসেছে। তবু এই দেশ নিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা সমূলে দূর হয়নি কখনো। এ প্রসঙ্গে শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হকের একটি বক্তব্যের অংশ বিশেষ উল্লেখ করছি।
“নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে জাতির সহায়তায়। মহত্ত্ব নিয়ে অনাসক্ত হয়ে ব্যক্তিসত্তার স্বকীয়তা ভুলতে হবে; লুপ্ত করতে হবে। জাতির স্বার্থই হবে ব্যক্তির স্বার্থ। জাতির কল্যাণেই হবে ব্যক্তির কল্যাণ।”
প্রসঙ্গত মনে পড়ছে প্রথম বিজয় দিবসের কথা। কীভাবে শুরু হয়েছিলো এই বিজয় উৎযাপন আমাদের। যদি ধরে নিইÑ বাংলাদেশ নামক দেশটি পৃথিবীর দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে যখন থেকে স্বীকৃতি পেলোÑ সেটি তার জন্মলগ্ন। বলাবাহুল্য বিজয়ের মাসব্যাপী শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি সেবীরা নানাভাবে বর্ণাঢ্য উৎযাপনে স্মরণীয় করে তোলে আমাদের বিজয়ানন্দকে। ষোলই ডিসেম্বরে সকলেই প্রায় লাল-সবুজ রঙ্গের পোশাকে নিজেদের সাজিয়ে তোলে। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার দুপাশে লাল-সবুজের আলোকসজ্জা যেন এই উৎযাপন আনন্দে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করে দেয়। এছাড়া ১৯৭২ সালে যে নিয়মাবলি জারি হয়েছিলোÑ সেগুলো নিম্নরূপ।
১. ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিজয় দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়।
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এজন্যে চলচ্চিত্র, কবিতা, নিবন্ধ, গণমাধ্যম ইত্যাদিতে বিভিন্নভাবে এই বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়।
৩. এই দিন উপলক্ষেÑ বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের আয়োজন করে থাকে। এছাড়া, দেশের প্রতিটি উপজেলায় বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ, বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান, মতবিনিময় সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।
৪. দেশের প্রধান সড়কগুলো জাতীয় পতাকা দিয়ে সাজানো হয়। এই দিনে ঢাকার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
৫. ১৯৭১: স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
৬. ১৯৭২: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংবিধান প্রকাশিত হয়।
৭. ১৯৭২: ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গ্যাজেটের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় খেতাব ঘোষণা করা হয়।
৮. ১৯৯৬: ২৫ বছর পূর্তি উৎসব করা হয়।
৯. ২০১৩: জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ২৭, ১১৭ জন স্বেচ্ছাসেবী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার লাল এবং সবুজ ব্লক নিয়ে একত্রে জড়ো হয়ে বিশ্বের বৃহত্তম মানব পতাকার নতুন বিশ্ব রেকর্ড করে।
১০. ২০২১ ৫০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করা হয় মহা ধুমধামের সঙ্গে।
পরিশেষে দেশমায়ের বন্দনায় বলি, মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে! সেই দেশ-মায়ের স্পর্শে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের অপর একটি কবিতার কথাÑ তার কণ্ঠে কণ্ঠ দিয়ে আজ বলিÑ
“সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে,
সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে,
জানিনে তোর ধন রতন আছে কিনা রাণীর মতন,
শুধু জানি, আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে।”