মোহিত কামাল
‘ওরা মনে হয় পালিয়ে গেছে। কী বলিস, জসিম?’
প্রশ্ন করে উত্তর না পেয়েও হতাশ হলো না ওবায়েদ, বন্দুকের নল তাক করে রেখেছে হাইওয়ের দিকে। স্থির চোখও নিশানা বরাবর সেঁটে আছে।
হাইওয়ের অপর পাশে অ্যাম্বুশ নিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ট্রাক-লরি থেকে নেমে ওদের প্রায় ২০ জনের দলটা রাতভর গুলি ছুড়েছে ওবায়েদ আর জসিমের বাংকারের দিকে। ধানখেতের আলের উল্টো দিকে বাংকার ভালোভাবেই সুরক্ষিত। উঁচু আলের সরু পথটার মাটি বেশ শক্ত। এটাই তাদের রক্ষা করছে। শত্রুপক্ষ এগিয়ে আসতে সাহস পায়নি। কজন গেরিলাযোদ্ধা অ্যা¤ু^শে আছে তা বুঝতে পারেনি হায়েনারা। গেরিলাদের গুলির বিনিময়ে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসেছে শত্রুপক্ষ থেকে। মোটেই ভয় পায়নি ওবায়েদ। জসিমও।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আঁধার মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ আকাশে ছড়ানো লালিমার তলে।
জসিমের উত্তর না-পেয়ে দেহের সঙ্গে লাগানো দেহটায় হালকা ঠেস দিয়ে ওবায়েদ বলল, ‘জসিম, কথা বলছিস না কেন? সামনে দেখ। হাইওয়ে দেখা যাচ্ছে। ট্রাক-লরি তো দেখা যাচ্ছে না। হায়েনারা বোধ হয় হটে গেছে। পালিয়েছে?’
নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছে ওবায়েদ। শত্রু-সীমানার দিকে এখনও তাক করে রেখেছে কেবল বন্দুকের নল নয়, দুটো চোখও। ট্রেনিংয়ের সময় শিখেছিল অ্যাটাক করার সময় কিংবা আক্রান্ত হলে এদিক-ওদিক তাকানো যাবে না। নজর ধরে রাখতে হবে নিশানার দিকে। ফলো করতে হবে চেইন অব কমান্ড। এসব কথা এখন মনে পড়ছে। চোখ না ঘুরিয়ে আবার একটু ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘দেখ লাল-সূর্য কাঁচাসোনা আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাছগাছালির সবুজের ওপর লালিমা ছড়িয়ে যাচ্ছে। দেখিস একদিন আমরা লাল সূর্যটা ধরে ফেলব। সবুজে সবুজে ঢেকে দেব পুরো দেশ।’
সাড়া নেই জসিমের।
‘কী রে, ঘুম পেয়েছে তোর? ঘুমোচ্ছিস? আচ্ছা ঘুমা। শান্তিতে ঘুম দে। তুই উঠলে আমিও ঘুমাব। আমার চোখে ঘুম নেই। পুড়ো রাত জেগে থাকা কঠিন নয়। সহজ। যদি আক্রমণ না থাকে, তো কঠিন। এখন মনে হচ্ছে আক্রমণ আর আসবে না। বেটারা পালিয়েছে। কিন্তু কমান্ডারের হুকুম না পেলে তো আমরা অ্যাম্বুশ ছাড়তে পারব না। চোখ বন্ধ করতে পারলে ভালো হতো। রাতের ক্লান্তি কেটে যেত।’ বলতে বলতে একসময় নিজের চোখের দুটি পাতা লেগে আসতে থাকে। তা অনুভব করে জসিমের উদ্দেশে আবারও ওবায়েদ বলতে লাগল, ‘ওঠ। চোখ খোল। দেখ চারপাশে ধানক্ষেত্রের কী দৃশ্য। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা গুলির ছড়ায় দেখ কীভাবে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। কাঁচাসোনা ধানখেত পুড়ে পুড়ে আছে। তছনছ হয়ে আছে। আলের মাটিও উড়ে উড়ে গেছে। কী ভয়াবহ অবস্থা!’
শব্দ নেই। সাড়া নেই। সাড়া পাওয়ার তাড়াও নেই ওবায়েদের। নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে শত্রুরা পালিয়েছে। কচি রোদ ছড়িয়ে যাচ্ছে। উদোম দেহে রোদের পরশ পাচ্ছে। তার পরনে আছে স্যান্ডো গেঞ্জি। আর কোচামারা লুঙ্গি। উদোম বাহু গরম হয়ে উঠছে। জসিমের বাঁ বাহুর সঙ্গে লেগে আছে নিজের ডান বাহু।
আচমকা আকাশের দিকে তাকাল ওবায়েদ। আকাশে উড়ছে শকুনের দল। ওদের মাথার ওপর দিয়ে ওড়াউড়ি করছে। আকাশ পানে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সে। শকুনের চোখ তাক করে আছে ওদের ওপর। যেকোনো মুহূর্তে ওরা বোধহয় ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাজপাখি যেমন ছোট-বড় হরিণ, খরগোশ পায়ের নখরে গেঁথে নিয়ে উড়াল দেয়, কঠিন ঠোঁটের ঠোক্করে ছিন্নভিন্ন করে যেমন খায় জীবন্ত প্রাণি, শকুন দলও কি তাই করবে এখন! ভাবতে গিয়ে এবার আকাশের দিকে তাকাল সে। তারপর জসিমের উদোম বাহুর সঙ্গে নিজের বাহুর ঠেস লাগার পর কঠিন ঠা-া আর তরল অনুভব ছড়িয়ে গেল দেহে। ডানে তাকাল আচমকা। তখনই ঘটল মানবিক-বোমার বিস্ফোরণ। একদম শূন্য হয়ে গেল মাথা। দুচোখের চাউনির মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কে ঢুকে গেল কঠিন এক দৃশ্য। জসিমের মাথার খুলি নেই! খোলা মগজ অনড় বসে আছে মগজের আসনে। কেবল খুলি নেই। উড়ে গেছে। এদিক-ওদিক তাকাল খুলির ওপরের অংশটা পাওয়ার আশায়। না, নেই। জসিমের শীতল দেহটাই আছে এই বাংকারে। জসিম নেই। এক লাফে বাংকার থেকে উঠে এল সে। ক্রলিং করে আলের উঁচু মাটির আড়ালে থেকে এগোতে লাগল উত্তর পানে। প্রায় ২০ গজ অন্তর ওদের তিনটা বাংকার ছিল। প্রতিটাতে দুজন করে মোট ছয়জন হানাদারের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা। প্রথম বাংকারের দিকে তাকিয়ে আবারও ঘা খেল সে। গোলা এসে পড়েছে এই ব্যাংকারে, এখানকার দুজনের দেহ পুড়ে গেছে। পোড়া দেহ দুটো দেখেও থেমে গেল না। আবার এগোতে লাগল সামনে। এতক্ষণে আবেগশূন্য হয়ে গেছে সে। হতবিহ্বল হয়ে রোবোটের মতো সামনে এগিয়ে দেখল রক্তাক্ত দুটো দেহ। ওরা সবুজ ধান কেটে আলের ওপর বিছিয়ে রেখেছিল, মনে হলো ওবায়েদের। আর দেখল লাল রক্তে ভিজে আছে সবুজ ধানের গোছা। লাল-সবুজের মাখামাখি দেখে চোখ সরিয়ে তাকাল পুব আকাশের দিকে। আকাশে ততক্ষণ লাল-সূর্য শোভা পেতে শুরু করেছে। আর তার রোদ ছেয়ে যাচ্ছে সবুজ গাছগাছালির ঝাঁকড়া মাথার ওপর।
দুই.
এখন ওবায়েদের বয়স সত্তর বছর।
সত্তর বছরের ওবায়েদের দেহকাঠামোয় স্পটই দেখা যাচ্ছে ভাঙন আর ভাঙন। সাদা পাঞ্জাবি পরনে, মাথায় টুপি আর সাদা দাড়িতে অন্যরকম লাগছে তাঁকে। নিজের শোবারঘরে একাকী বসে আছেন তিনি। স্ত্রী প্রয়াত হয়েছেন বেশ আগে। একা থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
বিজয় দিবসের আগের রাতে কী যে হয় ওবায়েদের। প্রতি বছর ১৫ ডিসেম্বর রাতে তিনি দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন। বাইরের শব্দ যেন ভেতরে ঢুকতে না পারে তার জন্য এ ব্যবস্থা। কানেও গুঁজে দেন তুলার দলা। হঠাৎ বড় ছেলে জামশেদ ঢুকে বলল, ‘এ কী আব্বাজান, কানে তুলো দিচ্ছেন কেন? আর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছেন কেন?’
ছেলের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কথা ভুলে গেলেন তিনি। অবাক হয়ে ছেলের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে রইলেন।
‘কী দেখছেন এমন করে? আমাকে এভাবে দেখার কী আছে, আব্বাজান?’
দেখার কিছু নেই, তা নয়। প্রতিদিন যেভাবে দেখে থাকেন, আজ দেখছেন ভিন্নভাবে। ছেলে লাল পাঞ্জাবি পরেছে। পাঞ্জাবির ওপর শোভা পাচ্ছে গাঢ় সবুজের ওপর হালকা সবুজের সরু স্ট্রাইপকরা কটি। লাল-সবুজ মাখামাখি করে আছে। জড়িয়ে রেখেছে জামশেদকে। এ পোশাকে ছেলেকে দেখে তাঁর মনে পড়ে যেতে লাগল যুদ্ধের মাঠে দেখা লাল-সবুজের মাখামাখি। আর একই সঙ্গে দুম করে একশত ভাগ জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল জসিমের মাথার খুলিবিহীন মৃতদেহের দৃশ্যটা। সতীর্থদের পোড়া দেহের কয়লা ঘুমন্ত অগ্নিগিরির উত্তাপ নিয়ে জেগে উঠল। দুচোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। কপালে আড়াআড়ি ভাঁজ বসে গেল। উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এ পোশাক পরেছো কেন?’
‘আব্বাজান, কিছুক্ষণ পরই তো বিজয় দিবসের তোপধ্বনি হবে। টিএসসিতে আমাদের বন্ধুরা যাবে। আমিও। বিজয়ের উৎসবে শরিক হব। আপনি খুশি না?’
ছেলের কথা আর প্রশ্নে মনোযোগ দিতে পারলেন না ওবায়েদ। তাঁর চোখে কেবল জসিমের খুলিবিহীন মস্তকই ভাসতে লাগল।
বাবার দিকে খেয়াল করল না জামশেদ। এগিয়ে গিয়ে জানালার সøাডিং গ্লাস সরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘এভাবে সব বদ্ধ করে রাখতে হয়, আব্বাজান! তোপধ্বনি শুনবেন না, বিজয়বার্তা শুনবেন না।’
ওবায়েদের হঠাৎ মনে হতে লাগল ‘এ ছেলে তার জামশেদ নয়; ১৯৭১ সালের বাংকার থেকে উঠে এসে ছেলের ওপর আসন নিয়েছে সহযোদ্ধা, শহিদ জসিম। ওর মস্তিষ্কের খুলি নেই, পরনের লাল কটি আর লাল পাঞ্জাবির গলা থেকে বেরিয়ে এসেছে খুলিবিহীন দেহ। এ দেহের মধ্যে দেখছেন জসিমকেই। ভয়ে কুঁকড়ে গেলেন তিনি।
তিন.
রাত বারোটা মানে এগারোটা ষাট মিনিট এখন। মুহুর্মুহু তোপধ্বনি হতে লাগল। আর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে ওবায়েদ ঘরের জানালা বন্ধ করে দিতে লাগলেন। তোপধ্বনি বিজয়ের উল্লাস তাঁর মাথায় ঢুকচ্ছে না বরং মেমোরির শক্ত গাঁথুনি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে লাগল সেই দৃশ্যপট। সেই জসিম। সহযোদ্ধাদের ঝলসে যাওয়া সেই লাশ। একবার ওবায়েদ হাত রাখলেন নিজের মাথায়। হাতে সঞ্চারিত হয়ে মিশে যাচ্ছে বারুদের উত্তাপ। আর পোড়া ক্ষতের স্পর্শ পেয়ে তিনি আবার চমকে উঠলেন। বারবার চমকাতে লাগলেন। বারুদের গন্ধ ঢুকছে নাকে। খুলিবিহীন জসিম আর অন্য সহযোদ্ধাদের পোড়া লাশও ভাসতে লাগল চোখে।
২ জানুয়ারি, ২০২০
মোহিত কামাল
সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
‘ওরা মনে হয় পালিয়ে গেছে। কী বলিস, জসিম?’
প্রশ্ন করে উত্তর না পেয়েও হতাশ হলো না ওবায়েদ, বন্দুকের নল তাক করে রেখেছে হাইওয়ের দিকে। স্থির চোখও নিশানা বরাবর সেঁটে আছে।
হাইওয়ের অপর পাশে অ্যাম্বুশ নিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ট্রাক-লরি থেকে নেমে ওদের প্রায় ২০ জনের দলটা রাতভর গুলি ছুড়েছে ওবায়েদ আর জসিমের বাংকারের দিকে। ধানখেতের আলের উল্টো দিকে বাংকার ভালোভাবেই সুরক্ষিত। উঁচু আলের সরু পথটার মাটি বেশ শক্ত। এটাই তাদের রক্ষা করছে। শত্রুপক্ষ এগিয়ে আসতে সাহস পায়নি। কজন গেরিলাযোদ্ধা অ্যা¤ু^শে আছে তা বুঝতে পারেনি হায়েনারা। গেরিলাদের গুলির বিনিময়ে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসেছে শত্রুপক্ষ থেকে। মোটেই ভয় পায়নি ওবায়েদ। জসিমও।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আঁধার মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ আকাশে ছড়ানো লালিমার তলে।
জসিমের উত্তর না-পেয়ে দেহের সঙ্গে লাগানো দেহটায় হালকা ঠেস দিয়ে ওবায়েদ বলল, ‘জসিম, কথা বলছিস না কেন? সামনে দেখ। হাইওয়ে দেখা যাচ্ছে। ট্রাক-লরি তো দেখা যাচ্ছে না। হায়েনারা বোধ হয় হটে গেছে। পালিয়েছে?’
নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছে ওবায়েদ। শত্রু-সীমানার দিকে এখনও তাক করে রেখেছে কেবল বন্দুকের নল নয়, দুটো চোখও। ট্রেনিংয়ের সময় শিখেছিল অ্যাটাক করার সময় কিংবা আক্রান্ত হলে এদিক-ওদিক তাকানো যাবে না। নজর ধরে রাখতে হবে নিশানার দিকে। ফলো করতে হবে চেইন অব কমান্ড। এসব কথা এখন মনে পড়ছে। চোখ না ঘুরিয়ে আবার একটু ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘দেখ লাল-সূর্য কাঁচাসোনা আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাছগাছালির সবুজের ওপর লালিমা ছড়িয়ে যাচ্ছে। দেখিস একদিন আমরা লাল সূর্যটা ধরে ফেলব। সবুজে সবুজে ঢেকে দেব পুরো দেশ।’
সাড়া নেই জসিমের।
‘কী রে, ঘুম পেয়েছে তোর? ঘুমোচ্ছিস? আচ্ছা ঘুমা। শান্তিতে ঘুম দে। তুই উঠলে আমিও ঘুমাব। আমার চোখে ঘুম নেই। পুড়ো রাত জেগে থাকা কঠিন নয়। সহজ। যদি আক্রমণ না থাকে, তো কঠিন। এখন মনে হচ্ছে আক্রমণ আর আসবে না। বেটারা পালিয়েছে। কিন্তু কমান্ডারের হুকুম না পেলে তো আমরা অ্যাম্বুশ ছাড়তে পারব না। চোখ বন্ধ করতে পারলে ভালো হতো। রাতের ক্লান্তি কেটে যেত।’ বলতে বলতে একসময় নিজের চোখের দুটি পাতা লেগে আসতে থাকে। তা অনুভব করে জসিমের উদ্দেশে আবারও ওবায়েদ বলতে লাগল, ‘ওঠ। চোখ খোল। দেখ চারপাশে ধানক্ষেত্রের কী দৃশ্য। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা গুলির ছড়ায় দেখ কীভাবে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। কাঁচাসোনা ধানখেত পুড়ে পুড়ে আছে। তছনছ হয়ে আছে। আলের মাটিও উড়ে উড়ে গেছে। কী ভয়াবহ অবস্থা!’
শব্দ নেই। সাড়া নেই। সাড়া পাওয়ার তাড়াও নেই ওবায়েদের। নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে শত্রুরা পালিয়েছে। কচি রোদ ছড়িয়ে যাচ্ছে। উদোম দেহে রোদের পরশ পাচ্ছে। তার পরনে আছে স্যান্ডো গেঞ্জি। আর কোচামারা লুঙ্গি। উদোম বাহু গরম হয়ে উঠছে। জসিমের বাঁ বাহুর সঙ্গে লেগে আছে নিজের ডান বাহু।
আচমকা আকাশের দিকে তাকাল ওবায়েদ। আকাশে উড়ছে শকুনের দল। ওদের মাথার ওপর দিয়ে ওড়াউড়ি করছে। আকাশ পানে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সে। শকুনের চোখ তাক করে আছে ওদের ওপর। যেকোনো মুহূর্তে ওরা বোধহয় ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাজপাখি যেমন ছোট-বড় হরিণ, খরগোশ পায়ের নখরে গেঁথে নিয়ে উড়াল দেয়, কঠিন ঠোঁটের ঠোক্করে ছিন্নভিন্ন করে যেমন খায় জীবন্ত প্রাণি, শকুন দলও কি তাই করবে এখন! ভাবতে গিয়ে এবার আকাশের দিকে তাকাল সে। তারপর জসিমের উদোম বাহুর সঙ্গে নিজের বাহুর ঠেস লাগার পর কঠিন ঠা-া আর তরল অনুভব ছড়িয়ে গেল দেহে। ডানে তাকাল আচমকা। তখনই ঘটল মানবিক-বোমার বিস্ফোরণ। একদম শূন্য হয়ে গেল মাথা। দুচোখের চাউনির মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কে ঢুকে গেল কঠিন এক দৃশ্য। জসিমের মাথার খুলি নেই! খোলা মগজ অনড় বসে আছে মগজের আসনে। কেবল খুলি নেই। উড়ে গেছে। এদিক-ওদিক তাকাল খুলির ওপরের অংশটা পাওয়ার আশায়। না, নেই। জসিমের শীতল দেহটাই আছে এই বাংকারে। জসিম নেই। এক লাফে বাংকার থেকে উঠে এল সে। ক্রলিং করে আলের উঁচু মাটির আড়ালে থেকে এগোতে লাগল উত্তর পানে। প্রায় ২০ গজ অন্তর ওদের তিনটা বাংকার ছিল। প্রতিটাতে দুজন করে মোট ছয়জন হানাদারের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা। প্রথম বাংকারের দিকে তাকিয়ে আবারও ঘা খেল সে। গোলা এসে পড়েছে এই ব্যাংকারে, এখানকার দুজনের দেহ পুড়ে গেছে। পোড়া দেহ দুটো দেখেও থেমে গেল না। আবার এগোতে লাগল সামনে। এতক্ষণে আবেগশূন্য হয়ে গেছে সে। হতবিহ্বল হয়ে রোবোটের মতো সামনে এগিয়ে দেখল রক্তাক্ত দুটো দেহ। ওরা সবুজ ধান কেটে আলের ওপর বিছিয়ে রেখেছিল, মনে হলো ওবায়েদের। আর দেখল লাল রক্তে ভিজে আছে সবুজ ধানের গোছা। লাল-সবুজের মাখামাখি দেখে চোখ সরিয়ে তাকাল পুব আকাশের দিকে। আকাশে ততক্ষণ লাল-সূর্য শোভা পেতে শুরু করেছে। আর তার রোদ ছেয়ে যাচ্ছে সবুজ গাছগাছালির ঝাঁকড়া মাথার ওপর।
দুই.
এখন ওবায়েদের বয়স সত্তর বছর।
সত্তর বছরের ওবায়েদের দেহকাঠামোয় স্পটই দেখা যাচ্ছে ভাঙন আর ভাঙন। সাদা পাঞ্জাবি পরনে, মাথায় টুপি আর সাদা দাড়িতে অন্যরকম লাগছে তাঁকে। নিজের শোবারঘরে একাকী বসে আছেন তিনি। স্ত্রী প্রয়াত হয়েছেন বেশ আগে। একা থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
বিজয় দিবসের আগের রাতে কী যে হয় ওবায়েদের। প্রতি বছর ১৫ ডিসেম্বর রাতে তিনি দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন। বাইরের শব্দ যেন ভেতরে ঢুকতে না পারে তার জন্য এ ব্যবস্থা। কানেও গুঁজে দেন তুলার দলা। হঠাৎ বড় ছেলে জামশেদ ঢুকে বলল, ‘এ কী আব্বাজান, কানে তুলো দিচ্ছেন কেন? আর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছেন কেন?’
ছেলের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কথা ভুলে গেলেন তিনি। অবাক হয়ে ছেলের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে রইলেন।
‘কী দেখছেন এমন করে? আমাকে এভাবে দেখার কী আছে, আব্বাজান?’
দেখার কিছু নেই, তা নয়। প্রতিদিন যেভাবে দেখে থাকেন, আজ দেখছেন ভিন্নভাবে। ছেলে লাল পাঞ্জাবি পরেছে। পাঞ্জাবির ওপর শোভা পাচ্ছে গাঢ় সবুজের ওপর হালকা সবুজের সরু স্ট্রাইপকরা কটি। লাল-সবুজ মাখামাখি করে আছে। জড়িয়ে রেখেছে জামশেদকে। এ পোশাকে ছেলেকে দেখে তাঁর মনে পড়ে যেতে লাগল যুদ্ধের মাঠে দেখা লাল-সবুজের মাখামাখি। আর একই সঙ্গে দুম করে একশত ভাগ জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল জসিমের মাথার খুলিবিহীন মৃতদেহের দৃশ্যটা। সতীর্থদের পোড়া দেহের কয়লা ঘুমন্ত অগ্নিগিরির উত্তাপ নিয়ে জেগে উঠল। দুচোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। কপালে আড়াআড়ি ভাঁজ বসে গেল। উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এ পোশাক পরেছো কেন?’
‘আব্বাজান, কিছুক্ষণ পরই তো বিজয় দিবসের তোপধ্বনি হবে। টিএসসিতে আমাদের বন্ধুরা যাবে। আমিও। বিজয়ের উৎসবে শরিক হব। আপনি খুশি না?’
ছেলের কথা আর প্রশ্নে মনোযোগ দিতে পারলেন না ওবায়েদ। তাঁর চোখে কেবল জসিমের খুলিবিহীন মস্তকই ভাসতে লাগল।
বাবার দিকে খেয়াল করল না জামশেদ। এগিয়ে গিয়ে জানালার সøাডিং গ্লাস সরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘এভাবে সব বদ্ধ করে রাখতে হয়, আব্বাজান! তোপধ্বনি শুনবেন না, বিজয়বার্তা শুনবেন না।’
ওবায়েদের হঠাৎ মনে হতে লাগল ‘এ ছেলে তার জামশেদ নয়; ১৯৭১ সালের বাংকার থেকে উঠে এসে ছেলের ওপর আসন নিয়েছে সহযোদ্ধা, শহিদ জসিম। ওর মস্তিষ্কের খুলি নেই, পরনের লাল কটি আর লাল পাঞ্জাবির গলা থেকে বেরিয়ে এসেছে খুলিবিহীন দেহ। এ দেহের মধ্যে দেখছেন জসিমকেই। ভয়ে কুঁকড়ে গেলেন তিনি।
তিন.
রাত বারোটা মানে এগারোটা ষাট মিনিট এখন। মুহুর্মুহু তোপধ্বনি হতে লাগল। আর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে ওবায়েদ ঘরের জানালা বন্ধ করে দিতে লাগলেন। তোপধ্বনি বিজয়ের উল্লাস তাঁর মাথায় ঢুকচ্ছে না বরং মেমোরির শক্ত গাঁথুনি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে লাগল সেই দৃশ্যপট। সেই জসিম। সহযোদ্ধাদের ঝলসে যাওয়া সেই লাশ। একবার ওবায়েদ হাত রাখলেন নিজের মাথায়। হাতে সঞ্চারিত হয়ে মিশে যাচ্ছে বারুদের উত্তাপ। আর পোড়া ক্ষতের স্পর্শ পেয়ে তিনি আবার চমকে উঠলেন। বারবার চমকাতে লাগলেন। বারুদের গন্ধ ঢুকছে নাকে। খুলিবিহীন জসিম আর অন্য সহযোদ্ধাদের পোড়া লাশও ভাসতে লাগল চোখে।
২ জানুয়ারি, ২০২০