alt

বিজয় দিবস সংখ্যা ২০২৪

বিজয় দিবসের কবিতা

: সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

শহিদ
নির্মলেন্দু গুণ

তুমি এখন শুয়ে আছ মুষ্টিবদ্ধ দু’হাতে ঘুম।

পথের মধ্যে উবু হয়ে তুমি এখন স্বপ্নরত,

মধ্যরাতে আকাশভরা তারার মেলায় স্বপ্নবিভোর,

বুকে তোমার এফোঁড়-ওফোঁড়

অনেক ছিদ্র, স্বাধীনতার অনেক আলোর আসা যাওয়া।

তুমি এখন শুয়ে আছ ঘাসের মধ্যে টকটকে ফুল।

পৃথিবীকে বালিশ ভেবে বাংলাদেশের সবটা মাটি

আঁকড়ে আছÑ তোমার বিশাল বুকের নিচে

এতটুকু কাঁপছে না আর

এক বছরের শিশুর মতো থমকে আছে। তোমার বুকে

দুটো সূর্য, চোখের মধ্যে অনেক নদী, চুলের মধ্যে

আগুনরঙা শীত সকালে হু-হু বাতাস।

মাটির মধ্যে মাথা রেখে তুমি এখন শুয়ে আছ,

তোমাকে আর শহিদ ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই যায় না।

গেরিলাযুদ্ধের স্মৃতি
হাসান হাফিজ

রক্তপিছল পথ পেরিয়ে

তোমাকে ছুঁই স্বাধীনতা

তুমি আমার প্রাণের মর্ম

আত্মীয় সুখ বিয়োগ-ব্যথা।

শোষণ পীড়ন জেল জুলুমে

শৃঙ্খলিত বন্দি থেকে

রক্তরঙে তোমার ছবি

মানসপটে নিপুণ এঁকে

হই গেরিলা অস্ত্র ধরি

মাতৃভূমি স্বাধীন করি

লাল সবুজের এই পতাকা

রক্তদামে ছিনিয়ে আনি

স্বাধীনতার সত্য পথে

লাখ শহীদান অমর জানি ॥

ক্ষমতা
ফারুক মাহমুদ

ক্ষমতা বধির হলে সোজা পথ হয়ে যায় বাঁকা

শিশুরক্ত, নারীরক্ত, জ্যেষ্ঠদের সৌর্যবীর্যÑ সব একাকার

যেখানে বাগান ছিলÑ মাথা তোলে নরমু- হাড়ের পাহাড়

মুখোশই মুখ্য হয়, মুখের মাধুর্যছবি পড়ে যায় ঢাকা

ক্ষমতা প্রসন্ন হলে হেসে ওঠে ভোরবেলা, বাগানের হাসি

জলোচ্ছল নদী হয়Ñ যত ছিল দমবন্ধ ক্ষীণ জলাশয়

আলোগন্ধ। ছায়াগন্ধ। নিদাঘের বহুচীর মাঠের হৃদয়

প্রতিটি বৃক্ষের পাতা লিখে রাখেÑ ‘এসো প্রীতি, পুণ্য ভালোবাসি’

ঐক্যবদ্ধ হয় যদি বাস্তুচ্যুত মানুষের দীর্ঘ আর্তনাদ

অস্ত্রভাষা স্তব্ধ হয়, ঝরে পড়ে ক্ষমতার প্রবল প্রাসাদ

শব্দ
বিমল গুহ

শব্দ নিয়ে খেলা করি

দাঁড়ি কমা হাইফেন

মুচকি হাসে রোজ;

প্রতিশব্দ আড়ালে দাঁড়ায়Ñ যেন

প্রকৃত শব্দের

মহিমা শেখায় আমাদের।

যে শব্দ প্রকৃতিগতÑ জন্মের প্রথম প্রকাশ

সে তর্জমা মানুষের দীর্ঘশ্রম বোধ

লিখে যায় কালের কলম।

জাইজিসের জাদুর আংটি
জাহিদ হায়দার

ঝড় : লাফ দিয়ে পড়া বাতাসের নখ,

ভূমিকম্প : ঘুমন্ত অতলের উত্থান।

ছিলে তুমি মেষপালক রাজার বাড়ির,

দুর্যোগে জাদু-আংটি পেয়েছিলে।

স্পর্শে অদৃশ্য হতে পারো,

প্রয়োজনে দৃশ্যমান।

এড়াতে বৃত্তের জটিলতা

কার না ইচ্ছে করে

অশনির বাইরে সহজ পর্যটনে যেতে?

নারী রহস্য আর বীরের প্রেমিকা,

রাজাকে হত্যা করে আংটিতে দিলে চুম্বন।

বসেছ সিংহাসনে

রানি উৎকট গন্ধজাত বাহুর বন্ধনে।

বহু ছবি জাদুর বিলাস,

রূপক আলাপ করে মোহের ভূষণে।

সততা একদা ছিল, হয়তো এখনো আছে অশ্রুর সঙ্গী;

প্রতারণা আর অন্যায় : প্রতিদিন বজ্রপাতধারা;

দ্বন্দ্বগল্পগুলি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র শুনে গেছে।

আমরাও সচল কুরুক্ষেত্রে বাধ্যগত মেষ।

মাঠ রক্তভেজা। শস্যহীন।

শিকার সর্বদা।

*জাইজিসের জাদুর আংটি বিষয়ক রূপক গল্পটি নিয়ে প্লেটো, তাঁর ভাই এডিমেন্টাস ও সক্রেটিসের মধ্যে সংলাপ হয়েছিল। ‘অন্যায় ও প্রতারণা নাকি ন্যায় ও সততা?’ প্রশ্নের কিছু মীমাংসা তাঁরা করেছিলেন।

চুরি গেলো রাজ্য সিংহাসন
আবদুর রাজ্জাক

শিরিষের ডাল, আর তোমার লুক্কায়িত দুপুর বুক থেকে

বের করে বললাম, এই নাও স্বপ্নের রাজদ-।

নির্জনতায় রাখা এক টুকরো সন্ধ্যার চোখ, আবছাÑ

তাও তোমাকে দিলাম।

তোমার আর্দ্র চোখ একটি ধূসর শ্রাবণÑ

ঝরাপাতার আবাহন। একমুঠো কাশকুল হাতে বিমূর্ত

কোথাও ডেকে ওঠে দোয়েল, বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস থেকে থেকে

ধ্বনিত হলে শ্রাবণের পাখিগুলো কীভাবে যেন

গেয়ে যায় যেতে হবে বহুদূর।

তোমাকে হরণের ইচ্ছে হয়নি, ভালোবাসার কঙ্কাল বুকে

এই যে দাঁড়িয়ে রয়েছি, একটি পাথরের আঘাতে

আমাকে বিচূর্ণ করেছো।

মুহূর্ত মানুষ, ধু-ধু প্রান্তর দেখিনি, আকাশ দেখিনি, তোমাকে দেখেছি।

মেঘের আঙিনায় চাঁদ উঠেছে, বিভাবরী চাঁদে মৃত্যুর ঘ্রাণ,

অবর্ণ রক্তের দাগ। এতো মৃত্যুধারণ করে কীভাবে

বেঁচে আছি! ভেবেছো কী কখনো!

বিজয়ের পদাবলি
মঈনউদ্দিন মুনশী

বিজয় মানে মেঘ সরিয়ে হঠাৎ নীল শরত আকাশ

বিজয় মানে চির দুঃখিনীর কান্নাভেজা মুখের হাসি

বিজয় মানে শুকনো মাঠে ভোরের ঊষায় ফুলের সুবাস

বিজয় মানে হতাশ পিতার স্বপ্ন পূরণ মোমের বাঁশি

বিজয় মানে আপন করে প্রিয় একটা নিজের দেশ

বিজয় মানে যখন তখন কথার মালায় মায়ের ভাষা

বিজয় মানে হারানো প্রিয় পাখিদের ঘরে ফিরে আসা

বিজয় মানে সহদরের জন্য উতলা দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষ

বিজয় মানে বন্দি জীবন দিনের শেষে রক্তিম গোধূলি

বিজয় মানে উত্তাল ঝড়ের পরে শান্ত বাউল নদী

বিজয় মানে আমাদের ভূগোলে জেগে ওঠা নতুন সৈকত

বিজয় মানে সবার সাথে বন্ধু হবার দীপ্ত শপথ

বিজয় মানে অর্ধ-শতাব্দী পেরিয়ে নতুন চোখে ফিরে তাকানো

বিজয় মানে বিজয়ের ব্যবচ্ছেদ, অন্তঃপুরে দেখো আছে কি লাবণ্য

চিহ্নায়ন
শামীম আজাদ

সড়ক চিহ্নিত হয় কিলোমিটার ফলকে

বৃক্ষ, নিজ-পুষ্প এবং ফলে

নদী তার জলে আর

মানুষ চিহ্নিত হয় ব্যতিক্রমী আচারে।

এক দেশ থেকে অন্য দেশের ছায়া

ভিন্ন করা যায়

সে দেশের মানুষের অবদান ও অবজ্ঞার কারণে।

দেশের অবস্থান শনাক্ত করা যায় তার

শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীতে

তারই মানুষদের আচার আচরণের

প্রীতি ও ভীতিতে

এবং তারই আম-জনতার

চারিত্রিক স্খলন ও উল্লম্ফনে।

বিজয় স্মরণ
দুলাল সরকার

তব্ওু আকৃষ্ট করÑ

মুখর ভোরের পদাবলি

লাউডগা স্বপ্নের মাধুরি তুমি

আকাক্সক্ষার দীপাবলি,

গলগলে রক্তের অভিধানে লেখা

ধ্রুব ও সপ্তর্ষিÑ সঞ্চালক

শক্তির মেধায় তুমি নেপথ্যচারিণী

আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে

সূর্যোদয়ে সবুজ রাগিনী।

স্মৃতিভ্রষ্ট ডিসেম্বর
মাহফুজ আল-হোসেন

স্মৃতিভ্রষ্ট ডিসেম্বরের হিমশীতল রাত্রি দ্বিপ্রহরকে বলি, তোমার বিজয়ী সন্তানেরা রবিশস্যের সৌগন্ধময় সবুজে অকাতরে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে একদা যে গৌরবের ইতিহাস লিখে গেছেÑ সেটি কিন্তু কোনো অলীক উৎপ্রেক্ষা নয়।

অথচ, তোমার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগভীর টলটলে টালা জলে সিন্থেসিয়া-চর্চিত রঙিন মাছ কিলবিল করছে, আর গেমিং কনসোলের রানওয়েতে অনবরত ওঠানামা করছে বলিহারি বিদ্যার আত্মম্ভরি যুদ্ধবিমান।

অধিকন্তু, বাহবা কুড়াতে যুদ্ধফেরত অভুক্ত আইজদ্দির কষ্টের কাসিদা নিয়ে একের পর এক তৈরি করে যাচ্ছ আবেগ উপচানো উত্তরাধুনিক প্লেলিস্ট...

বিজয়
হাইকেল হাশমী

বিজয়ের আগমন

হয়নি ফেস্টুন, পোস্টার, ব্যানারের সমাগমে

বা ফাটানো হয়নি বাজি

জ্বালানো হয়নি আতশবাজি আর তারাবাতি

মুক্তি এসেছিল নিশ্বাসের শান্ত ছন্দে,

স্থির হাত রইলো না আর আবদ্ধ।

বিজয়ের আগমন, ত্বকের নিচে নাড়ির স্পন্দন,

প্রথমে চাপা কণ্ঠ, তারপর চিৎকার

তারপর সুর ও গান

সাত কোটি মানুষের কণ্ঠে একই গান।

বিজয় তো নয় শুধু একখ- জমি

পাহাড় প্রকাশ করে আমাদের শব্দের প্রতিধ্বনি

নদী মাটিতে এঁকে দেয় মুক্তির প্রবাহের পথ।

বিজয় হলো,

আমাদের মন ভয় থেকে থাকবে শৃঙ্খলমুক্ত

থাকবে সকল সন্দেহ থেকে শিকল মুক্ত।

স্বাধীনতাÑ উপহার নয়, একটি জন্মগত অধিকার

আমরা তা করেছি পুনরুদ্ধার,

স্বাধীনতা, শুধু স্মৃতিস্তম্ভ নয়,

এটি জীবন্ত, মুক্ত শ্বাস-প্রশ্বাসের শক্তি।

একাত্তর
খোরশেদ বাহার

কেউ বলে যুদ্ধ কেউ বলে সংগ্রাম

আমি বলি একাত্তর আমার মায়ের নাম।

ফুরিয়ে যায়
দিলারা মেসবাহ

জীবন ফুরিয়ে যায়

ন’য়ের নামতা শেখা হলো না।

জীবন ফুরিয়ে যায়

স্মৃতিজলে অনুপান েেবদনার বাটি

জীবন ফুরিয়ে যায়

চিঠিপত্র এলো না এলো না।

জীবন ফুরিয়ে যায়

বান্ধবের বাসনা ফুরায় না!

জীবন ফুরিয়ে যায়

হিমেল বিকেল নিশ্চুপ!

জীবন ফুরিয়ে যায়

কুশল জানি না অদ্যাবধি,

জীবন ফুরিয়ে যায়Ñ

নজরানা নিলো না!

জীবন ফুরিয়ে যায়Ñ

অব্যক্ত, অচেনা।

বিজয় দিবস
মুশাররাত

পাখিদের আঙিনা

আকাশ তো নয়

ঠিকানাও তার নীড়

তবুও ভাবি আকাশেই

তার শান্তি, সুনিবিড়

তবুও সে ফিরে ফিরে আসে

এমনই মাটির টান

সবুজের মাঝে লাল সূর্যের

পতাকায় যেমন প্রাণ

যেমন ছিলো সে একাত্তরে

রুমীর চৌকস আবরণে

চব্বিশে আবু সাঈদ হয়ে

উদাত্ত একই আহ্বানে

ইয়ামিনের লাশ পড়ে থাকে

যেমন রিকশার পা’দানিতে

মাথায় জড়িয়ে প্রিয় পতাকা

মুগ্ধরা জাগে রাত্রিতে

কয়টা বুলেট লাগতে পারে

একটি মৃত্যু ঘটাতে

বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়েও

পারেনি তাদের টলাতে

আবরার ফাহাদ আর কতকাল

রাতভর করে চিৎকার

আমাদের দেবে মুক্ত স্বাধীন

মতামত দেবার অধিকার

স্নিগ্ধরা আবার হাসবে কবে

ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে

পরাশক্তির নতজানু নীতি

এবার হবে ভাঙতে

একবার নয়, দুইবার নয়

যতবার হবে প্রয়োজন

স্বাধীন সূর্য ছিনিয়ে এনে

বিজয়ের হবে আয়োজন।

বিজয়কাব্য
রকিবুল হাসান

হাকিম উদ্দিনকে হত্যা করা হয়েছে মধ্যরাত্রিতেÑ তখন শিশিরে

ভিজে উঠেছে অন্ধকার ভূমিÑ কোথায় লুকানো হলো লাশ!

নাকি ভেসে গেলো প্রবল ¯্রােতের দিকহারা অজ¯্র নদীতে!

নাকি পুঁতে ফেলা হয়েছিল নিশ্চিহ্ন করতে নিজের মাটিতে!

বাড়ির রক্তাক্ত জবাফুল শুকানো কালচে

রঙ পেয়েছিলÑ বাড়ির উঠোনে সাদা শাড়িতে নিভেছে যৌবনা,

বুকের পশমে এঁেক গেলো যে নতুন মানচিত্র

সবুজ মাঠÑ লাল রঙÑ সেখানে তো কথা কয় রক্তের স্পন্দন।

দিগন্ত সবুজে যে আঁচলÑ নদীর বাউলে সুরেলা যে গান

কত প্রজাপতি কত পাখিÑ রামধনু মেঘÑ কবিতার বাংলাদেশ

মস্তকে উন্নত নায়কোচিত পতাকা বাঁধা দৃঢ়তার গল্প

এসবই একাত্তরের হাকিম উদ্দিনদের রক্তের বুনন বিজয়কাব্য।

দুরবিন
চয়ন শায়েরী

শনির বলয় দেখতে একটা দুরবিন দরকারÑ আটশ’ ডলার কম কথা নয়Ñ তবু গ্রহণের

গ্লোবাল ভিলেজে বসে

এক মিসকিন

আকাশের পথ খোঁজ করে;

আন্তঃনাক্ষত্রিক অন্ধকারে

ওম নেই মহাকাশেÑ নৈঃশব্দ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বল টানে, সেই টানে আকাশ দেখতে রাতে ঘুরঘুর করি;

বই পড়ি

মহাকাশ গ্রুপে ঢুঁ মারি

মঙ্গলগ্রহের গোলাপি আভার গালে

লোলুপ দৃষ্টির চাষাবাদ করি;

পায়ের দিকেতে নয়Ñ মঙ্গলে বসতি স্থাপনের সুলুক সন্ধান করি;

মার্সিয়ান ছবিটা দেখি,

দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাই!

নিজের একটা দুরবিন নেইÑ ভুলে যাই।

সন্ন্যাস
শাকিল রিয়াজ

বাইরে যতো রাত

তার অর্ধেক তোমার দেয়া

অর্ধেক সূর্যাস্তের।

তোমার এই নির্দয় দানে

অন্ধকার ফুলে ঠাসাঠাসি হয়ে এলে

জীবনকে সরু করে নেমে যাই পথে।

আমি তোমার কাছে মৃত্যুবরণ করে

আমার মায়ের শৈশবে ফের বেঁচে উঠি।

মাকে বলি, মা, সন্ন্যাস নাও।

আকাশের ওই তারাও

সংসার পাতেনি বলে চিরদিন

মিটিমিটি হাসতে পারে।

তারাদের সন্তান নেই।

অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার মতো

তাদের কেউ থাকে না।

বিজয়ের জন্ম
হাসানাত লোকমান

মৃত্যুর শিলালিপি খুঁজে পাওয়া যায় এখানে,

রক্তের স্তব্ধতায় গাঁথা এক পাষাণ ভাষা।

যেখানে মৃত্তিকার স্তরে স্তরে শুয়ে আছে

একটি জাতির মর্মস্পর্শী ইতিহাস।

পলাশের অগ্নি কী সহজে নিভেছিলো?

না, অন্ধকার গহ্বর চিরে জন্মেছিল আলো।

স্বপ্নেরা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল দহনযজ্ঞে,

তবু শিকড় চেয়েছিল আকাশের ঋণ।

বিজয় এখানে কেবল একটি দিন নয়,

এ এক অনন্তকাল ধরে গর্ভধারণ।

পৃথিবী জানে, এই ভূমির সন্তানেরা

মৃত্যুকেও শাসন করে জীবনের নামে।

আমি কমলাবীরা
যাকিয়া সুমি সেতু

আমি কমলাবীরা, জোছনায় ভিজে ভিজে

যেতে চেয়েছিলাম তোমার মেঘ পাতার বাড়ি

যেতে চেয়েছিলাম ঝমঝম বৃষ্টির নূপুর পরে

কাঁচামিঠে আম কুড়োতে তোমার খড়ের ঘরে

মনে পড়ে, একাত্তরের যুদ্ধে তুমি বলেছিলে

ভাঁটফুল হাতে দিয়ে, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি কমলা

তোমার আঁচল খোলা রেখো স্বাধীনতার জন্য

সেদিন আমিও যুদ্ধে যাই, অন্য এক কষ্ট যুদ্ধ

খানসেনারা সবুজ জীপে তুলে নেয় আমাকে

জোৎস্নাভরা গভীর রাতে বন্দুকের নল রেখে

কান্নায় হিমালয় বরফ গলে চিত্রাজলে মিশে

আমি কমলাবীরা, চিত্রা নদীর পাড়ের মেয়ে

সুখন মাঝির আমানত, নষ্ট করো না আমাকে

নষ্ট করো না আমার নীল ডুরে শাড়ি, মেঘচুল

আমার ঝুমকো চুড়ি, বুকের নবীন কাঁচুলি

রাতভর খানসেনাদের অত্যাচারে বলেছিলাম

আমি কমলাবীরা আর নষ্ট করো না আমাকে

আমার যতেœ রাখা নারীত্ব, নক্ষত্রবোনা সবস্বপ্ন

চিত্রা ঘাটের পাড়াপাড়ের সুখন মাঝির জন্য

জানতো জন্মভূমি! সুখন মাঝি আর ফেরেনি

ফেরেনি শাড়ির খোলা আঁচলে স্বাধীনতা নিয়ে

আমি কমলাবীরা, সুখনমাঝিই আমার বাংলাদেশ

আঁধি
আসিফ নূর

সোনাবিকেলেই হানা দিলো ভয়ঙ্কর কালাঘূর্ণি,

ধূলিঝড়ে অকস্মাৎ ছন্নছাড়া দৃষ্টিজোড়া সৃষ্টিসব;

অন্ধকারের তা-বে বন্ধ হলো দুচোখের পাতা।

অথচ এই বিকেল রাঙিয়েছিল ঘুড়ির আকাশ,

রঙিন জামাপরা শিশুকিশোরদের ফুটফুটে খুশি

জমেছিল স্কুলের খেলার মাঠে; একতারা হাতে

সেখানে লালনগীতিতে মজেছিল পরান বাউল।

আর মুলিবাঁশের ঊর্ধ্বাঙ্গে বাঁধা লাল-সবুজ ছোটবড়

অসংখ্য পতাকা নিয়ে এসেছিল সেই পতাকাওয়ালা,

যার বাবা শহিদ মুক্তিযোদ্ধা; মা-ও বীরাঙ্গনা।

ওরা এখন কোথায়? আমি তো কিছুই দেখছি না!

বিজয়ফুল
হাবিবা রোজী

পাহাড়িবালা কাজলকালো পটলচেরা আঁখি,

চলনবলনে চঞ্চলা যেনো এক খঞ্জনা পাখি।

অরণ্যচারী চায়ের কন্যা মনে আধুনিকা শহুরে রুচি,

আঁচলে লুকায় বাড়ন্ত বয়স, শাড়িতে ভাঁজে কুচি।

আচানক একাত্তরে পাহাড়ে এলো বুনো সেনাদল,

সরল মাহালীরা, বুঝতে পারিনি শত্রুসেনার কূট ছল।

মাহালী সেনানী বেড়া ভেঙে বাঁচাবেই করেছে দৃঢ়পণ,

আগুনের সেঁকে ঝলসানো থেকে বাঁচিয়েছে জ্ঞাতিস্বজন।

দুঃশাসনেরা পাহাড়ের দ্রৌপদীর লুটেছে সম্ভ্রমখানি।

গিরিনন্দিনী লুটায় গাছতলায় নরখাদকের খাঁচাতে।

রেবাতীর হাহাকারে দীর্ণ বনভূমি মাহালীরা পারেনি বাঁচাতে।

বিজয়ের জন্যে শত রেবাতিফুল জীবনমান দিয়েছে জলাঞ্জলি,

এমন সূর্যকন্যাদের তরে রচে যাই ভালোবাসার অঞ্জলি।

একটি রাষ্ট্র পেলে
তরুন ইউসুফ

ভিখিরি ও বুভুক্ষিত হয়ে

ঘুরছি জন্ম থেকেই

একটি রাষ্ট্র চাই

যে শিশুর শৈশব

রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছে

নিবারণ ক্ষুধার

তার থালার মানচিত্রে বাংলাদেশ

তার মুখে ও চোখে রহস্যময় হাসি

আমাদের বানর জীবনের ব্যঙ্গ

দৌড়ে পালাই শুনি তার আর্তি

রাষ্ট্র চাই

এইভাবে পথে পথে ঘুরি

মানুষের চোখে মুখে

পোস্টারে সাটা

রাষ্ট্র হয়ে গেছে চুরি,

যেমন বিপ্লবওÑ

সাতচল্লিশ আগে ও পরে

একাত্তর আগে ও পরে

নব্বই আগে ও পরে।

আমাদের বিজয়

সময় ও সাহসিকতা

চুরি হতে হতে

আবার দাঁড়ালো সাঈদ

কত কত যুবকের বুক

ঝাঁঝড়া হতে হতে

শিুশুর মায়াবি মাথার খুলি

উড়ে যেতে যেতে

মগজ আর রক্তে মাখামাখি

আবার মানচিত্র বাংলাদেশ।

যে পিতা হারিয়েছে শিশু

তার তো কিছু নাই

যে মায়ের বুক হলো খালি

তার তো কিছু নাই

তবু তাদের দোহাই

একটি রাষ্ট্র চাই সবার।

একটি রাষ্ট্র পেলে মিটে যাবে

সমস্ত হাহাকার

একটি রাষ্ট্র চাই

এই চব্বিশে দাবি রেখে যাচ্ছি

প্রিয়তম বিজয় ষোলই ডিসেম্বর।

বিজয়
মিলটন রহমান

আমাদের সেই ছোট্ট গ্রামে এখনো দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো বটবৃক্ষ

বাকল ওঠা শরীরে নাভীর মতো গর্তগুলোতে জমে থাকা জল

মাঝে মাঝে অশ্রুজল ভেবে ভ্রম হয়

এখনো সেই বটবৃক্ষের ছায়ায় জেগে আছে ফিনিক্স পাখিরা

বার বার ওড়ার পাখা পুড়ে, জেগে ওঠে প্রলেতারিয়েত

একটা জীবন জেগে উঠবে, গান গাইবে বক্ষ ফাটা গান

বাতাসে বাজবে গ্রামের দস্যি মেয়েটির নূপুরের তান

তার ঠোঁট জোড়ায় জমা মিহি ঘাম অবলীলায় মুছে দেবে বলে

সহ¯্র বুলেটে বুক ঝাঁঝরা করেও যে যুবক এখনো জেগে আছে

তার নামই কি বিজয় কিংবা স্বাধীনতা?

কপোতাক্ষ
টিপু সুলতান

মানুষের চিরায়ত রঙে আঁকা

আর ভোরের উচ্ছল মাছরাঙার চোখে নিত্যকার জেগে ওঠা কপোতাক্ষ

রোদমানুষের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি আর গভীর সন্তর্পণে চলা

লাভ-ক্ষতির হিসেবের খাতায় দুরভিসন্ধির কাছে

হেরে গিয়ে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ এলিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন

আজ কপোতাক্ষ

এ ঘুম আদৌও কখনো ভাঙবে কি না

এ পাড় ও পাড়ের কেউ তা জানে না

চাঁদনি রাত ও সংগোপিত মায়াচিহ্ন
অনিন্দিতা মিত্র

হৃদ-সরোবরের কাব্যশরীরে চাঁদনি রাত গাঁথে শিউলি ফুলের বিরহমালা। স্বপ্নের মুক্তহার জুড়ে গোধূলির লাল কমলা আলোর বিছিন্ন রেখাঙ্কন। নিজেকে মাঝে মাঝে পাতাঝরা বনস্পতির মতো নিঃসঙ্গ লাগে, বসন্তকাল মুঠো মুঠো আবীর ওড়ায় সবুজ অরণ্যের কুঞ্জবনে। একাকিত্বের সমুদ্রে জন্ম নেয় বিস্মৃত শব্দরাশির শত সহস্র ঢেউ। এ নারীজীবন ঠিক যেন পরিযায়ী পাখির মতো! আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে ভেসে চলি নৈঃশব্দ্যের দেশে। অন্ধকারের সংগোপিত তূণে পড়ে থাকে শুধু হুতাশের মায়াচিহ্ন।

জেগে থাকে প্রত্যয় রাইফেল

বিপাশা মন্ডল

প্রগাঢ় কুয়াশায় টিকে থাকা বিজয়ী মানচিত্রে

ডিসেম্বর ষোলো একটা সংখ্যামাত্র নয়

প্রবল মৃত্যু কলরোলে ¤্রয়িমাণ বিজিতের বিশ্বাস

আশায় জাগিয়ে রাখা সংগোপন আলোর ঝুঁকি

প্রত্যাখ্যানের দহন সয়ে কাঁধে তুলে নেয় প্রত্যয় রাইফেল

নিজস্ব স্বজ্ঞার সীমা তুলে নেয়া বিজয়ী লক্ষ্যস্থির

একলব্যের শাণিত ধনুক, পেঁচা চোখে অনপেক্ষ সংলাপ

দ্বিধার উত্তুঙ্গ নীরবতায় ফিরে পায় প্রেরণা রশ্মি

তমি¯্র আঁধারে নিষ্পাপ সম্ভাবনা জ্বেলে মৃদু হেসে

অপেক্ষারত বিজয়, দু’বাহু বাড়িয়ে রাখা শাশ্বত সত্য

৩১৯২ মাইল সীমানায় গুঞ্জরণ তোলে

নিরপরাধ রক্তমাখা সবুজ বদ্বীপ

বিজয়! বিজয়! স্ফুলিঙ্গ সন্তানেরা চকচকে বল্লম ফলা হয়ে

নেমে আসে প্রতিদুর্যোগে

তিপ্পান্ন ফোঁটা রক্ত
সুমন শামস

টুপটাপ টুপটাপ রক্ত ঝরছে। এক... দুই... তিন...

এভাবে তিপ্পান্ন ফোঁটা। ফুটফুটে এক সবুজ হরিণ।

রক্তে ভিজে ভিজে লাল সবুজ। অরণ্য তার একাত্তর।

জন্মস্থান ও প্রিয় আবাস। ষোলোই ডিসেম্বর ভূমিষ্ঠকাল।

দিগন্ত ছোঁবে বলে দীর্ঘ আর দুরন্ত পায়ে সে ছুটছিল।

পরাধীনতার আজন্ম শেকল ছিন্ন করে শুধুই ছুটছিল সে।

আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। বাঘের হিং¯্র দাঁত আর

ধারালো নখর থেকে সে কোনোদিনই স্বাধীন হতে পারেনি।

ক্ষমতার পালা বদলে বাঘেরা তাকে খেতে চায়।

বারবার তাকে খায়। তিলে তিলে খায়। পা থেকে ধীরে

ধীরে খায়। তৃণলতাগুল্মের মতো হরিণের পা আর

গজায় না। টুপটাপ টুপটাপ রক্ত ঝরে।

এক... দুই... তিন... এভাবে তিপ্পান্ন ফোঁটা।

হরিণের বুকের ভেতর একটা হৃৎপি- ধুঁকধুঁক করে।

জীবন্মৃত একটা হৃদয়। আমরা যার নাম দিয়েছি বিজয়।

স্মৃতিভ্রষ্ট
শামস হক

একটাও ছবি নেই তার

নেই কোন স্মৃতিও দেখাবার

কোন পটুয়াও আঁকেনি তার প্রতিকৃতি

বিশ্ব কি ভুলে যাবে তার স্মৃতি?

তার প্রশ্বাস আছে ইথারে

মাটি উষ্ণ হতো তার পদভারে

সৃষ্টির প্রবাহে রেখেছে ছাপ

তাকে ভুলে যাওয়া যে নিতান্তই পাপ!

তার গা এর গন্ধ আছে বাতাসে

দেহ-তাপ মিশে গেছে আকাশে

সময়কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম

তাকে ফিরিয়ে দেবে করবো একটু প্রণাম?

সময় বলেছিলো হেসে

তুমি যাবে সেই দেশে

তবে ঘড়ির কাটাটা উল্টো ঘুরাও

আর যাকে ইচ্ছে তাকে দেখে নাও

আমি চিৎকার দিয়ে বলি

আমরা কেউ কি সোজা পথে চলি

উল্টো পথেই তো চলছি

দাও ফিরিয়ে দাও আমার সেই গ?্যালাক্সি।

বেজে ওঠে
দিলীপ কির্ত্তুনিয়া

ধানক্ষেতে যখন পূর্ণ রূপে ফসলে

আবৃত থাকেÑ তখন আর

জমির আইল দেখা যায় না।

তখন মনে হয় আমরা কেউ আর

দলে বিভক্ত নই।

আবার যখন জমির মাঠটা ফসলবিহীন

শূন্য মাঠÑ চারিদিকে ধু ধু চরাচর

তখনও জমির আইল একে অপরের

গায়ে গায়ে মিশে থাকে।

আর মিশে থাকে বলেই

জমির আইল দেখা যায় না।

চিহ্নিত সীমানাগুলো বিলুপ্ত থাকে।

তখন মনে হয় আমরা কেউ আর

দলে বিভক্ত নই

আমরা একসাথে আছি

আমরা একাকার একাট্টা সবাই।

ফসল থাকার পূর্ণ আনন্দ সময়ে

ফসল না থাকার দুঃখের কালে

আমাদের একসাথে থাকা হয়ে যায়।

জমির খ- ছোট বড় হলেও

সবাই সমান।

বেজে উঠে প্রকৃতিজুড়ে সাম্যের গান।

মীরের কবিতা
মোহাম্মদ হোসাইন

হু হু করে কেঁদে নেব একদিন। মন কেমন করা কান্না।

মাঘী শীতের ভিতর কেঁপে কেঁপে উঠব আর ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালাব। সমস্ত শরীর সেঁকে নিয়ে কিছু তাপ কিছু যৌবন কৌটোয় রেখে দেব ছিপি এঁটে যেন কারণে অকারণে উঠে যেতে পারি অন্য কোনওখানে। অন্য কোনও মহলায়। তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস নেই, জরা ও ব্যাধি থেকে শিখে নিয়েছি গান, সুরের আলপনা। মীরের কবিতা পথ দেখায়। জ্যোতির মর্মার্থ থেকে আসে প্রেম। সেই প্রেম নদী ও নীরবতা দেয়। আমি তো পাগলই ছিলাম, তুমি শুধু তমসা পোড়ালে...!

tab

বিজয় দিবস সংখ্যা ২০২৪

বিজয় দিবসের কবিতা

সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

শহিদ
নির্মলেন্দু গুণ

তুমি এখন শুয়ে আছ মুষ্টিবদ্ধ দু’হাতে ঘুম।

পথের মধ্যে উবু হয়ে তুমি এখন স্বপ্নরত,

মধ্যরাতে আকাশভরা তারার মেলায় স্বপ্নবিভোর,

বুকে তোমার এফোঁড়-ওফোঁড়

অনেক ছিদ্র, স্বাধীনতার অনেক আলোর আসা যাওয়া।

তুমি এখন শুয়ে আছ ঘাসের মধ্যে টকটকে ফুল।

পৃথিবীকে বালিশ ভেবে বাংলাদেশের সবটা মাটি

আঁকড়ে আছÑ তোমার বিশাল বুকের নিচে

এতটুকু কাঁপছে না আর

এক বছরের শিশুর মতো থমকে আছে। তোমার বুকে

দুটো সূর্য, চোখের মধ্যে অনেক নদী, চুলের মধ্যে

আগুনরঙা শীত সকালে হু-হু বাতাস।

মাটির মধ্যে মাথা রেখে তুমি এখন শুয়ে আছ,

তোমাকে আর শহিদ ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই যায় না।

গেরিলাযুদ্ধের স্মৃতি
হাসান হাফিজ

রক্তপিছল পথ পেরিয়ে

তোমাকে ছুঁই স্বাধীনতা

তুমি আমার প্রাণের মর্ম

আত্মীয় সুখ বিয়োগ-ব্যথা।

শোষণ পীড়ন জেল জুলুমে

শৃঙ্খলিত বন্দি থেকে

রক্তরঙে তোমার ছবি

মানসপটে নিপুণ এঁকে

হই গেরিলা অস্ত্র ধরি

মাতৃভূমি স্বাধীন করি

লাল সবুজের এই পতাকা

রক্তদামে ছিনিয়ে আনি

স্বাধীনতার সত্য পথে

লাখ শহীদান অমর জানি ॥

ক্ষমতা
ফারুক মাহমুদ

ক্ষমতা বধির হলে সোজা পথ হয়ে যায় বাঁকা

শিশুরক্ত, নারীরক্ত, জ্যেষ্ঠদের সৌর্যবীর্যÑ সব একাকার

যেখানে বাগান ছিলÑ মাথা তোলে নরমু- হাড়ের পাহাড়

মুখোশই মুখ্য হয়, মুখের মাধুর্যছবি পড়ে যায় ঢাকা

ক্ষমতা প্রসন্ন হলে হেসে ওঠে ভোরবেলা, বাগানের হাসি

জলোচ্ছল নদী হয়Ñ যত ছিল দমবন্ধ ক্ষীণ জলাশয়

আলোগন্ধ। ছায়াগন্ধ। নিদাঘের বহুচীর মাঠের হৃদয়

প্রতিটি বৃক্ষের পাতা লিখে রাখেÑ ‘এসো প্রীতি, পুণ্য ভালোবাসি’

ঐক্যবদ্ধ হয় যদি বাস্তুচ্যুত মানুষের দীর্ঘ আর্তনাদ

অস্ত্রভাষা স্তব্ধ হয়, ঝরে পড়ে ক্ষমতার প্রবল প্রাসাদ

শব্দ
বিমল গুহ

শব্দ নিয়ে খেলা করি

দাঁড়ি কমা হাইফেন

মুচকি হাসে রোজ;

প্রতিশব্দ আড়ালে দাঁড়ায়Ñ যেন

প্রকৃত শব্দের

মহিমা শেখায় আমাদের।

যে শব্দ প্রকৃতিগতÑ জন্মের প্রথম প্রকাশ

সে তর্জমা মানুষের দীর্ঘশ্রম বোধ

লিখে যায় কালের কলম।

জাইজিসের জাদুর আংটি
জাহিদ হায়দার

ঝড় : লাফ দিয়ে পড়া বাতাসের নখ,

ভূমিকম্প : ঘুমন্ত অতলের উত্থান।

ছিলে তুমি মেষপালক রাজার বাড়ির,

দুর্যোগে জাদু-আংটি পেয়েছিলে।

স্পর্শে অদৃশ্য হতে পারো,

প্রয়োজনে দৃশ্যমান।

এড়াতে বৃত্তের জটিলতা

কার না ইচ্ছে করে

অশনির বাইরে সহজ পর্যটনে যেতে?

নারী রহস্য আর বীরের প্রেমিকা,

রাজাকে হত্যা করে আংটিতে দিলে চুম্বন।

বসেছ সিংহাসনে

রানি উৎকট গন্ধজাত বাহুর বন্ধনে।

বহু ছবি জাদুর বিলাস,

রূপক আলাপ করে মোহের ভূষণে।

সততা একদা ছিল, হয়তো এখনো আছে অশ্রুর সঙ্গী;

প্রতারণা আর অন্যায় : প্রতিদিন বজ্রপাতধারা;

দ্বন্দ্বগল্পগুলি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র শুনে গেছে।

আমরাও সচল কুরুক্ষেত্রে বাধ্যগত মেষ।

মাঠ রক্তভেজা। শস্যহীন।

শিকার সর্বদা।

*জাইজিসের জাদুর আংটি বিষয়ক রূপক গল্পটি নিয়ে প্লেটো, তাঁর ভাই এডিমেন্টাস ও সক্রেটিসের মধ্যে সংলাপ হয়েছিল। ‘অন্যায় ও প্রতারণা নাকি ন্যায় ও সততা?’ প্রশ্নের কিছু মীমাংসা তাঁরা করেছিলেন।

চুরি গেলো রাজ্য সিংহাসন
আবদুর রাজ্জাক

শিরিষের ডাল, আর তোমার লুক্কায়িত দুপুর বুক থেকে

বের করে বললাম, এই নাও স্বপ্নের রাজদ-।

নির্জনতায় রাখা এক টুকরো সন্ধ্যার চোখ, আবছাÑ

তাও তোমাকে দিলাম।

তোমার আর্দ্র চোখ একটি ধূসর শ্রাবণÑ

ঝরাপাতার আবাহন। একমুঠো কাশকুল হাতে বিমূর্ত

কোথাও ডেকে ওঠে দোয়েল, বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস থেকে থেকে

ধ্বনিত হলে শ্রাবণের পাখিগুলো কীভাবে যেন

গেয়ে যায় যেতে হবে বহুদূর।

তোমাকে হরণের ইচ্ছে হয়নি, ভালোবাসার কঙ্কাল বুকে

এই যে দাঁড়িয়ে রয়েছি, একটি পাথরের আঘাতে

আমাকে বিচূর্ণ করেছো।

মুহূর্ত মানুষ, ধু-ধু প্রান্তর দেখিনি, আকাশ দেখিনি, তোমাকে দেখেছি।

মেঘের আঙিনায় চাঁদ উঠেছে, বিভাবরী চাঁদে মৃত্যুর ঘ্রাণ,

অবর্ণ রক্তের দাগ। এতো মৃত্যুধারণ করে কীভাবে

বেঁচে আছি! ভেবেছো কী কখনো!

বিজয়ের পদাবলি
মঈনউদ্দিন মুনশী

বিজয় মানে মেঘ সরিয়ে হঠাৎ নীল শরত আকাশ

বিজয় মানে চির দুঃখিনীর কান্নাভেজা মুখের হাসি

বিজয় মানে শুকনো মাঠে ভোরের ঊষায় ফুলের সুবাস

বিজয় মানে হতাশ পিতার স্বপ্ন পূরণ মোমের বাঁশি

বিজয় মানে আপন করে প্রিয় একটা নিজের দেশ

বিজয় মানে যখন তখন কথার মালায় মায়ের ভাষা

বিজয় মানে হারানো প্রিয় পাখিদের ঘরে ফিরে আসা

বিজয় মানে সহদরের জন্য উতলা দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষ

বিজয় মানে বন্দি জীবন দিনের শেষে রক্তিম গোধূলি

বিজয় মানে উত্তাল ঝড়ের পরে শান্ত বাউল নদী

বিজয় মানে আমাদের ভূগোলে জেগে ওঠা নতুন সৈকত

বিজয় মানে সবার সাথে বন্ধু হবার দীপ্ত শপথ

বিজয় মানে অর্ধ-শতাব্দী পেরিয়ে নতুন চোখে ফিরে তাকানো

বিজয় মানে বিজয়ের ব্যবচ্ছেদ, অন্তঃপুরে দেখো আছে কি লাবণ্য

চিহ্নায়ন
শামীম আজাদ

সড়ক চিহ্নিত হয় কিলোমিটার ফলকে

বৃক্ষ, নিজ-পুষ্প এবং ফলে

নদী তার জলে আর

মানুষ চিহ্নিত হয় ব্যতিক্রমী আচারে।

এক দেশ থেকে অন্য দেশের ছায়া

ভিন্ন করা যায়

সে দেশের মানুষের অবদান ও অবজ্ঞার কারণে।

দেশের অবস্থান শনাক্ত করা যায় তার

শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীতে

তারই মানুষদের আচার আচরণের

প্রীতি ও ভীতিতে

এবং তারই আম-জনতার

চারিত্রিক স্খলন ও উল্লম্ফনে।

বিজয় স্মরণ
দুলাল সরকার

তব্ওু আকৃষ্ট করÑ

মুখর ভোরের পদাবলি

লাউডগা স্বপ্নের মাধুরি তুমি

আকাক্সক্ষার দীপাবলি,

গলগলে রক্তের অভিধানে লেখা

ধ্রুব ও সপ্তর্ষিÑ সঞ্চালক

শক্তির মেধায় তুমি নেপথ্যচারিণী

আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে

সূর্যোদয়ে সবুজ রাগিনী।

স্মৃতিভ্রষ্ট ডিসেম্বর
মাহফুজ আল-হোসেন

স্মৃতিভ্রষ্ট ডিসেম্বরের হিমশীতল রাত্রি দ্বিপ্রহরকে বলি, তোমার বিজয়ী সন্তানেরা রবিশস্যের সৌগন্ধময় সবুজে অকাতরে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে একদা যে গৌরবের ইতিহাস লিখে গেছেÑ সেটি কিন্তু কোনো অলীক উৎপ্রেক্ষা নয়।

অথচ, তোমার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগভীর টলটলে টালা জলে সিন্থেসিয়া-চর্চিত রঙিন মাছ কিলবিল করছে, আর গেমিং কনসোলের রানওয়েতে অনবরত ওঠানামা করছে বলিহারি বিদ্যার আত্মম্ভরি যুদ্ধবিমান।

অধিকন্তু, বাহবা কুড়াতে যুদ্ধফেরত অভুক্ত আইজদ্দির কষ্টের কাসিদা নিয়ে একের পর এক তৈরি করে যাচ্ছ আবেগ উপচানো উত্তরাধুনিক প্লেলিস্ট...

বিজয়
হাইকেল হাশমী

বিজয়ের আগমন

হয়নি ফেস্টুন, পোস্টার, ব্যানারের সমাগমে

বা ফাটানো হয়নি বাজি

জ্বালানো হয়নি আতশবাজি আর তারাবাতি

মুক্তি এসেছিল নিশ্বাসের শান্ত ছন্দে,

স্থির হাত রইলো না আর আবদ্ধ।

বিজয়ের আগমন, ত্বকের নিচে নাড়ির স্পন্দন,

প্রথমে চাপা কণ্ঠ, তারপর চিৎকার

তারপর সুর ও গান

সাত কোটি মানুষের কণ্ঠে একই গান।

বিজয় তো নয় শুধু একখ- জমি

পাহাড় প্রকাশ করে আমাদের শব্দের প্রতিধ্বনি

নদী মাটিতে এঁকে দেয় মুক্তির প্রবাহের পথ।

বিজয় হলো,

আমাদের মন ভয় থেকে থাকবে শৃঙ্খলমুক্ত

থাকবে সকল সন্দেহ থেকে শিকল মুক্ত।

স্বাধীনতাÑ উপহার নয়, একটি জন্মগত অধিকার

আমরা তা করেছি পুনরুদ্ধার,

স্বাধীনতা, শুধু স্মৃতিস্তম্ভ নয়,

এটি জীবন্ত, মুক্ত শ্বাস-প্রশ্বাসের শক্তি।

একাত্তর
খোরশেদ বাহার

কেউ বলে যুদ্ধ কেউ বলে সংগ্রাম

আমি বলি একাত্তর আমার মায়ের নাম।

ফুরিয়ে যায়
দিলারা মেসবাহ

জীবন ফুরিয়ে যায়

ন’য়ের নামতা শেখা হলো না।

জীবন ফুরিয়ে যায়

স্মৃতিজলে অনুপান েেবদনার বাটি

জীবন ফুরিয়ে যায়

চিঠিপত্র এলো না এলো না।

জীবন ফুরিয়ে যায়

বান্ধবের বাসনা ফুরায় না!

জীবন ফুরিয়ে যায়

হিমেল বিকেল নিশ্চুপ!

জীবন ফুরিয়ে যায়

কুশল জানি না অদ্যাবধি,

জীবন ফুরিয়ে যায়Ñ

নজরানা নিলো না!

জীবন ফুরিয়ে যায়Ñ

অব্যক্ত, অচেনা।

বিজয় দিবস
মুশাররাত

পাখিদের আঙিনা

আকাশ তো নয়

ঠিকানাও তার নীড়

তবুও ভাবি আকাশেই

তার শান্তি, সুনিবিড়

তবুও সে ফিরে ফিরে আসে

এমনই মাটির টান

সবুজের মাঝে লাল সূর্যের

পতাকায় যেমন প্রাণ

যেমন ছিলো সে একাত্তরে

রুমীর চৌকস আবরণে

চব্বিশে আবু সাঈদ হয়ে

উদাত্ত একই আহ্বানে

ইয়ামিনের লাশ পড়ে থাকে

যেমন রিকশার পা’দানিতে

মাথায় জড়িয়ে প্রিয় পতাকা

মুগ্ধরা জাগে রাত্রিতে

কয়টা বুলেট লাগতে পারে

একটি মৃত্যু ঘটাতে

বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়েও

পারেনি তাদের টলাতে

আবরার ফাহাদ আর কতকাল

রাতভর করে চিৎকার

আমাদের দেবে মুক্ত স্বাধীন

মতামত দেবার অধিকার

স্নিগ্ধরা আবার হাসবে কবে

ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে

পরাশক্তির নতজানু নীতি

এবার হবে ভাঙতে

একবার নয়, দুইবার নয়

যতবার হবে প্রয়োজন

স্বাধীন সূর্য ছিনিয়ে এনে

বিজয়ের হবে আয়োজন।

বিজয়কাব্য
রকিবুল হাসান

হাকিম উদ্দিনকে হত্যা করা হয়েছে মধ্যরাত্রিতেÑ তখন শিশিরে

ভিজে উঠেছে অন্ধকার ভূমিÑ কোথায় লুকানো হলো লাশ!

নাকি ভেসে গেলো প্রবল ¯্রােতের দিকহারা অজ¯্র নদীতে!

নাকি পুঁতে ফেলা হয়েছিল নিশ্চিহ্ন করতে নিজের মাটিতে!

বাড়ির রক্তাক্ত জবাফুল শুকানো কালচে

রঙ পেয়েছিলÑ বাড়ির উঠোনে সাদা শাড়িতে নিভেছে যৌবনা,

বুকের পশমে এঁেক গেলো যে নতুন মানচিত্র

সবুজ মাঠÑ লাল রঙÑ সেখানে তো কথা কয় রক্তের স্পন্দন।

দিগন্ত সবুজে যে আঁচলÑ নদীর বাউলে সুরেলা যে গান

কত প্রজাপতি কত পাখিÑ রামধনু মেঘÑ কবিতার বাংলাদেশ

মস্তকে উন্নত নায়কোচিত পতাকা বাঁধা দৃঢ়তার গল্প

এসবই একাত্তরের হাকিম উদ্দিনদের রক্তের বুনন বিজয়কাব্য।

দুরবিন
চয়ন শায়েরী

শনির বলয় দেখতে একটা দুরবিন দরকারÑ আটশ’ ডলার কম কথা নয়Ñ তবু গ্রহণের

গ্লোবাল ভিলেজে বসে

এক মিসকিন

আকাশের পথ খোঁজ করে;

আন্তঃনাক্ষত্রিক অন্ধকারে

ওম নেই মহাকাশেÑ নৈঃশব্দ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বল টানে, সেই টানে আকাশ দেখতে রাতে ঘুরঘুর করি;

বই পড়ি

মহাকাশ গ্রুপে ঢুঁ মারি

মঙ্গলগ্রহের গোলাপি আভার গালে

লোলুপ দৃষ্টির চাষাবাদ করি;

পায়ের দিকেতে নয়Ñ মঙ্গলে বসতি স্থাপনের সুলুক সন্ধান করি;

মার্সিয়ান ছবিটা দেখি,

দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাই!

নিজের একটা দুরবিন নেইÑ ভুলে যাই।

সন্ন্যাস
শাকিল রিয়াজ

বাইরে যতো রাত

তার অর্ধেক তোমার দেয়া

অর্ধেক সূর্যাস্তের।

তোমার এই নির্দয় দানে

অন্ধকার ফুলে ঠাসাঠাসি হয়ে এলে

জীবনকে সরু করে নেমে যাই পথে।

আমি তোমার কাছে মৃত্যুবরণ করে

আমার মায়ের শৈশবে ফের বেঁচে উঠি।

মাকে বলি, মা, সন্ন্যাস নাও।

আকাশের ওই তারাও

সংসার পাতেনি বলে চিরদিন

মিটিমিটি হাসতে পারে।

তারাদের সন্তান নেই।

অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার মতো

তাদের কেউ থাকে না।

বিজয়ের জন্ম
হাসানাত লোকমান

মৃত্যুর শিলালিপি খুঁজে পাওয়া যায় এখানে,

রক্তের স্তব্ধতায় গাঁথা এক পাষাণ ভাষা।

যেখানে মৃত্তিকার স্তরে স্তরে শুয়ে আছে

একটি জাতির মর্মস্পর্শী ইতিহাস।

পলাশের অগ্নি কী সহজে নিভেছিলো?

না, অন্ধকার গহ্বর চিরে জন্মেছিল আলো।

স্বপ্নেরা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল দহনযজ্ঞে,

তবু শিকড় চেয়েছিল আকাশের ঋণ।

বিজয় এখানে কেবল একটি দিন নয়,

এ এক অনন্তকাল ধরে গর্ভধারণ।

পৃথিবী জানে, এই ভূমির সন্তানেরা

মৃত্যুকেও শাসন করে জীবনের নামে।

আমি কমলাবীরা
যাকিয়া সুমি সেতু

আমি কমলাবীরা, জোছনায় ভিজে ভিজে

যেতে চেয়েছিলাম তোমার মেঘ পাতার বাড়ি

যেতে চেয়েছিলাম ঝমঝম বৃষ্টির নূপুর পরে

কাঁচামিঠে আম কুড়োতে তোমার খড়ের ঘরে

মনে পড়ে, একাত্তরের যুদ্ধে তুমি বলেছিলে

ভাঁটফুল হাতে দিয়ে, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি কমলা

তোমার আঁচল খোলা রেখো স্বাধীনতার জন্য

সেদিন আমিও যুদ্ধে যাই, অন্য এক কষ্ট যুদ্ধ

খানসেনারা সবুজ জীপে তুলে নেয় আমাকে

জোৎস্নাভরা গভীর রাতে বন্দুকের নল রেখে

কান্নায় হিমালয় বরফ গলে চিত্রাজলে মিশে

আমি কমলাবীরা, চিত্রা নদীর পাড়ের মেয়ে

সুখন মাঝির আমানত, নষ্ট করো না আমাকে

নষ্ট করো না আমার নীল ডুরে শাড়ি, মেঘচুল

আমার ঝুমকো চুড়ি, বুকের নবীন কাঁচুলি

রাতভর খানসেনাদের অত্যাচারে বলেছিলাম

আমি কমলাবীরা আর নষ্ট করো না আমাকে

আমার যতেœ রাখা নারীত্ব, নক্ষত্রবোনা সবস্বপ্ন

চিত্রা ঘাটের পাড়াপাড়ের সুখন মাঝির জন্য

জানতো জন্মভূমি! সুখন মাঝি আর ফেরেনি

ফেরেনি শাড়ির খোলা আঁচলে স্বাধীনতা নিয়ে

আমি কমলাবীরা, সুখনমাঝিই আমার বাংলাদেশ

আঁধি
আসিফ নূর

সোনাবিকেলেই হানা দিলো ভয়ঙ্কর কালাঘূর্ণি,

ধূলিঝড়ে অকস্মাৎ ছন্নছাড়া দৃষ্টিজোড়া সৃষ্টিসব;

অন্ধকারের তা-বে বন্ধ হলো দুচোখের পাতা।

অথচ এই বিকেল রাঙিয়েছিল ঘুড়ির আকাশ,

রঙিন জামাপরা শিশুকিশোরদের ফুটফুটে খুশি

জমেছিল স্কুলের খেলার মাঠে; একতারা হাতে

সেখানে লালনগীতিতে মজেছিল পরান বাউল।

আর মুলিবাঁশের ঊর্ধ্বাঙ্গে বাঁধা লাল-সবুজ ছোটবড়

অসংখ্য পতাকা নিয়ে এসেছিল সেই পতাকাওয়ালা,

যার বাবা শহিদ মুক্তিযোদ্ধা; মা-ও বীরাঙ্গনা।

ওরা এখন কোথায়? আমি তো কিছুই দেখছি না!

বিজয়ফুল
হাবিবা রোজী

পাহাড়িবালা কাজলকালো পটলচেরা আঁখি,

চলনবলনে চঞ্চলা যেনো এক খঞ্জনা পাখি।

অরণ্যচারী চায়ের কন্যা মনে আধুনিকা শহুরে রুচি,

আঁচলে লুকায় বাড়ন্ত বয়স, শাড়িতে ভাঁজে কুচি।

আচানক একাত্তরে পাহাড়ে এলো বুনো সেনাদল,

সরল মাহালীরা, বুঝতে পারিনি শত্রুসেনার কূট ছল।

মাহালী সেনানী বেড়া ভেঙে বাঁচাবেই করেছে দৃঢ়পণ,

আগুনের সেঁকে ঝলসানো থেকে বাঁচিয়েছে জ্ঞাতিস্বজন।

দুঃশাসনেরা পাহাড়ের দ্রৌপদীর লুটেছে সম্ভ্রমখানি।

গিরিনন্দিনী লুটায় গাছতলায় নরখাদকের খাঁচাতে।

রেবাতীর হাহাকারে দীর্ণ বনভূমি মাহালীরা পারেনি বাঁচাতে।

বিজয়ের জন্যে শত রেবাতিফুল জীবনমান দিয়েছে জলাঞ্জলি,

এমন সূর্যকন্যাদের তরে রচে যাই ভালোবাসার অঞ্জলি।

একটি রাষ্ট্র পেলে
তরুন ইউসুফ

ভিখিরি ও বুভুক্ষিত হয়ে

ঘুরছি জন্ম থেকেই

একটি রাষ্ট্র চাই

যে শিশুর শৈশব

রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছে

নিবারণ ক্ষুধার

তার থালার মানচিত্রে বাংলাদেশ

তার মুখে ও চোখে রহস্যময় হাসি

আমাদের বানর জীবনের ব্যঙ্গ

দৌড়ে পালাই শুনি তার আর্তি

রাষ্ট্র চাই

এইভাবে পথে পথে ঘুরি

মানুষের চোখে মুখে

পোস্টারে সাটা

রাষ্ট্র হয়ে গেছে চুরি,

যেমন বিপ্লবওÑ

সাতচল্লিশ আগে ও পরে

একাত্তর আগে ও পরে

নব্বই আগে ও পরে।

আমাদের বিজয়

সময় ও সাহসিকতা

চুরি হতে হতে

আবার দাঁড়ালো সাঈদ

কত কত যুবকের বুক

ঝাঁঝড়া হতে হতে

শিুশুর মায়াবি মাথার খুলি

উড়ে যেতে যেতে

মগজ আর রক্তে মাখামাখি

আবার মানচিত্র বাংলাদেশ।

যে পিতা হারিয়েছে শিশু

তার তো কিছু নাই

যে মায়ের বুক হলো খালি

তার তো কিছু নাই

তবু তাদের দোহাই

একটি রাষ্ট্র চাই সবার।

একটি রাষ্ট্র পেলে মিটে যাবে

সমস্ত হাহাকার

একটি রাষ্ট্র চাই

এই চব্বিশে দাবি রেখে যাচ্ছি

প্রিয়তম বিজয় ষোলই ডিসেম্বর।

বিজয়
মিলটন রহমান

আমাদের সেই ছোট্ট গ্রামে এখনো দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো বটবৃক্ষ

বাকল ওঠা শরীরে নাভীর মতো গর্তগুলোতে জমে থাকা জল

মাঝে মাঝে অশ্রুজল ভেবে ভ্রম হয়

এখনো সেই বটবৃক্ষের ছায়ায় জেগে আছে ফিনিক্স পাখিরা

বার বার ওড়ার পাখা পুড়ে, জেগে ওঠে প্রলেতারিয়েত

একটা জীবন জেগে উঠবে, গান গাইবে বক্ষ ফাটা গান

বাতাসে বাজবে গ্রামের দস্যি মেয়েটির নূপুরের তান

তার ঠোঁট জোড়ায় জমা মিহি ঘাম অবলীলায় মুছে দেবে বলে

সহ¯্র বুলেটে বুক ঝাঁঝরা করেও যে যুবক এখনো জেগে আছে

তার নামই কি বিজয় কিংবা স্বাধীনতা?

কপোতাক্ষ
টিপু সুলতান

মানুষের চিরায়ত রঙে আঁকা

আর ভোরের উচ্ছল মাছরাঙার চোখে নিত্যকার জেগে ওঠা কপোতাক্ষ

রোদমানুষের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি আর গভীর সন্তর্পণে চলা

লাভ-ক্ষতির হিসেবের খাতায় দুরভিসন্ধির কাছে

হেরে গিয়ে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ এলিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন

আজ কপোতাক্ষ

এ ঘুম আদৌও কখনো ভাঙবে কি না

এ পাড় ও পাড়ের কেউ তা জানে না

চাঁদনি রাত ও সংগোপিত মায়াচিহ্ন
অনিন্দিতা মিত্র

হৃদ-সরোবরের কাব্যশরীরে চাঁদনি রাত গাঁথে শিউলি ফুলের বিরহমালা। স্বপ্নের মুক্তহার জুড়ে গোধূলির লাল কমলা আলোর বিছিন্ন রেখাঙ্কন। নিজেকে মাঝে মাঝে পাতাঝরা বনস্পতির মতো নিঃসঙ্গ লাগে, বসন্তকাল মুঠো মুঠো আবীর ওড়ায় সবুজ অরণ্যের কুঞ্জবনে। একাকিত্বের সমুদ্রে জন্ম নেয় বিস্মৃত শব্দরাশির শত সহস্র ঢেউ। এ নারীজীবন ঠিক যেন পরিযায়ী পাখির মতো! আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে ভেসে চলি নৈঃশব্দ্যের দেশে। অন্ধকারের সংগোপিত তূণে পড়ে থাকে শুধু হুতাশের মায়াচিহ্ন।

জেগে থাকে প্রত্যয় রাইফেল

বিপাশা মন্ডল

প্রগাঢ় কুয়াশায় টিকে থাকা বিজয়ী মানচিত্রে

ডিসেম্বর ষোলো একটা সংখ্যামাত্র নয়

প্রবল মৃত্যু কলরোলে ¤্রয়িমাণ বিজিতের বিশ্বাস

আশায় জাগিয়ে রাখা সংগোপন আলোর ঝুঁকি

প্রত্যাখ্যানের দহন সয়ে কাঁধে তুলে নেয় প্রত্যয় রাইফেল

নিজস্ব স্বজ্ঞার সীমা তুলে নেয়া বিজয়ী লক্ষ্যস্থির

একলব্যের শাণিত ধনুক, পেঁচা চোখে অনপেক্ষ সংলাপ

দ্বিধার উত্তুঙ্গ নীরবতায় ফিরে পায় প্রেরণা রশ্মি

তমি¯্র আঁধারে নিষ্পাপ সম্ভাবনা জ্বেলে মৃদু হেসে

অপেক্ষারত বিজয়, দু’বাহু বাড়িয়ে রাখা শাশ্বত সত্য

৩১৯২ মাইল সীমানায় গুঞ্জরণ তোলে

নিরপরাধ রক্তমাখা সবুজ বদ্বীপ

বিজয়! বিজয়! স্ফুলিঙ্গ সন্তানেরা চকচকে বল্লম ফলা হয়ে

নেমে আসে প্রতিদুর্যোগে

তিপ্পান্ন ফোঁটা রক্ত
সুমন শামস

টুপটাপ টুপটাপ রক্ত ঝরছে। এক... দুই... তিন...

এভাবে তিপ্পান্ন ফোঁটা। ফুটফুটে এক সবুজ হরিণ।

রক্তে ভিজে ভিজে লাল সবুজ। অরণ্য তার একাত্তর।

জন্মস্থান ও প্রিয় আবাস। ষোলোই ডিসেম্বর ভূমিষ্ঠকাল।

দিগন্ত ছোঁবে বলে দীর্ঘ আর দুরন্ত পায়ে সে ছুটছিল।

পরাধীনতার আজন্ম শেকল ছিন্ন করে শুধুই ছুটছিল সে।

আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। বাঘের হিং¯্র দাঁত আর

ধারালো নখর থেকে সে কোনোদিনই স্বাধীন হতে পারেনি।

ক্ষমতার পালা বদলে বাঘেরা তাকে খেতে চায়।

বারবার তাকে খায়। তিলে তিলে খায়। পা থেকে ধীরে

ধীরে খায়। তৃণলতাগুল্মের মতো হরিণের পা আর

গজায় না। টুপটাপ টুপটাপ রক্ত ঝরে।

এক... দুই... তিন... এভাবে তিপ্পান্ন ফোঁটা।

হরিণের বুকের ভেতর একটা হৃৎপি- ধুঁকধুঁক করে।

জীবন্মৃত একটা হৃদয়। আমরা যার নাম দিয়েছি বিজয়।

স্মৃতিভ্রষ্ট
শামস হক

একটাও ছবি নেই তার

নেই কোন স্মৃতিও দেখাবার

কোন পটুয়াও আঁকেনি তার প্রতিকৃতি

বিশ্ব কি ভুলে যাবে তার স্মৃতি?

তার প্রশ্বাস আছে ইথারে

মাটি উষ্ণ হতো তার পদভারে

সৃষ্টির প্রবাহে রেখেছে ছাপ

তাকে ভুলে যাওয়া যে নিতান্তই পাপ!

তার গা এর গন্ধ আছে বাতাসে

দেহ-তাপ মিশে গেছে আকাশে

সময়কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম

তাকে ফিরিয়ে দেবে করবো একটু প্রণাম?

সময় বলেছিলো হেসে

তুমি যাবে সেই দেশে

তবে ঘড়ির কাটাটা উল্টো ঘুরাও

আর যাকে ইচ্ছে তাকে দেখে নাও

আমি চিৎকার দিয়ে বলি

আমরা কেউ কি সোজা পথে চলি

উল্টো পথেই তো চলছি

দাও ফিরিয়ে দাও আমার সেই গ?্যালাক্সি।

বেজে ওঠে
দিলীপ কির্ত্তুনিয়া

ধানক্ষেতে যখন পূর্ণ রূপে ফসলে

আবৃত থাকেÑ তখন আর

জমির আইল দেখা যায় না।

তখন মনে হয় আমরা কেউ আর

দলে বিভক্ত নই।

আবার যখন জমির মাঠটা ফসলবিহীন

শূন্য মাঠÑ চারিদিকে ধু ধু চরাচর

তখনও জমির আইল একে অপরের

গায়ে গায়ে মিশে থাকে।

আর মিশে থাকে বলেই

জমির আইল দেখা যায় না।

চিহ্নিত সীমানাগুলো বিলুপ্ত থাকে।

তখন মনে হয় আমরা কেউ আর

দলে বিভক্ত নই

আমরা একসাথে আছি

আমরা একাকার একাট্টা সবাই।

ফসল থাকার পূর্ণ আনন্দ সময়ে

ফসল না থাকার দুঃখের কালে

আমাদের একসাথে থাকা হয়ে যায়।

জমির খ- ছোট বড় হলেও

সবাই সমান।

বেজে উঠে প্রকৃতিজুড়ে সাম্যের গান।

মীরের কবিতা
মোহাম্মদ হোসাইন

হু হু করে কেঁদে নেব একদিন। মন কেমন করা কান্না।

মাঘী শীতের ভিতর কেঁপে কেঁপে উঠব আর ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালাব। সমস্ত শরীর সেঁকে নিয়ে কিছু তাপ কিছু যৌবন কৌটোয় রেখে দেব ছিপি এঁটে যেন কারণে অকারণে উঠে যেতে পারি অন্য কোনওখানে। অন্য কোনও মহলায়। তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস নেই, জরা ও ব্যাধি থেকে শিখে নিয়েছি গান, সুরের আলপনা। মীরের কবিতা পথ দেখায়। জ্যোতির মর্মার্থ থেকে আসে প্রেম। সেই প্রেম নদী ও নীরবতা দেয়। আমি তো পাগলই ছিলাম, তুমি শুধু তমসা পোড়ালে...!

back to top