মহিবুল আলম
খেয়াঘাট থেকে উঠে আমি আড়ঙের প্রান্তদেশে এসে দাঁড়ালাম। আমি দাঁড়ালাম একটা জামগাছের ছায়ায়। গাছটার সুশীতল আহ্বান তৎক্ষণাৎ আমার দেহ-প্রাঙ্গণে সজীবতার স্পর্শ দিলো ঠিকই, কিন্তু তা অন্তর্গত সম্বন্ধ স্থাপনে এক বৈরী ভাবের সৃষ্টি করলো।
আমি এক রাস্তা বায়ু ভেদ করে, পশ্চিম থেকে অনেকটা পুবে তাকালাম, যেখানে আড়ঙের শেষটা বাঁক খেয়েছে স্কুলকে সামনে রেখে সামান্য দক্ষিণে।
আমি হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে থাকলাম শরীরটাকে টান টান করে উদ্দেশ্যের তত্ত্বাবধানে ও ভিন্ন মাত্রার অভিলাষ গিলে। আজ প্রায় তেরো বছর পর রসুলপর আড়ঙ ধরে হাঁটছি। আড়ঙের প্রতিটা পদক্ষেপে এক ধরনের আনন্দবোধ ও এক ধরনের বেদনাবোধ সহমিশ্রণে আমাকে জড়িয়ে ধরছে। আর দৃষ্টিকে দিচ্ছে ভিন্নমাত্রিক রূপ। অতীতের সেই পনেরো-ষোলটা ঘরসমেত রসুলপুর আড়ঙটা আর নেই। এখন দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো সারি সারি দোকান। কোনো কোনো দোকান আবার ইটের গাঁথুনির।
আমি হাঁটতে হাঁটতে পুরানো ভাঙা ও শেওলার আস্তরপড়া একটা দালানের সামনে এসে থামলাম। দালানটা দীপংকর রায়ের। ভারত বিভাগের পূর্বে এখানে তার মোকাম ছিলো। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এটা পরিত্যক্ত দালান হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
একটু এগিয়েই সোনালী ব্যাংকটা খুঁজে পেলাম। সোনালী ব্যাংকটা এখন একটা দালানের ভেতর ঢুকে অভিজাত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি স্মৃতিমন্থন করলাম। অতীতকে কাছে টেনে আনলাম। বর্তমানকে করলাম গৌণ। আমার চোখে ভেসে উঠলো বাবার অতীতের সেই শ্মশ্রুবিহীন চেহারা। বাবা এই ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন। বাবা এখানে থাকাকালীন এই জায়গাটায় একটা চৌচালা ইটের গাঁথুনির লালি ধরা ঘরের অবস্থান ছিলো। বাবার চাকুরির কারণে আমরা পুরো পাঁচ বছর এই গ্রামে থেকে গেছি। রেখে গেছি অজ¯্র অযাচিত চিহ্ন।
আমি আবার হাঁটতে থাকলাম। আড়ঙটা মোটামুটি ফাঁকা। বেশিরভাগ দোকানেরই ঝাপ পড়ে আছে। যেগুলো খোলা আছে সেগুলোতেও তেমন লোকজনের সমাগম নেই। গ্রাম্য আড়ঙ, সকালেই বাজার ভেঙে যায় বলে হয়তো এমনটা হয়েছে।
নির্ধারিতভাবেই স্কুলের পেছন ঘেঁষে গাঙের ধারে অবস্থিত বটগাছের সামনে এসে দাঁড়ালাম। শূন্য কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে বটগাছটার দিকে তাকালাম। তৎক্ষণাৎ আশ্চর্য হলাম, এক যুগের হাওয়া পেরিয়ে বটগাছটায় উল্লেখযোগ্য কোনো ভাঙনের গন্ধ নেই, কিংবা যুগের উল্লাসে সময়ের পূর্ণতায় গাছটায় বিশাল বিশ্লেষণের মতো কোনো গড়ার চিহ্ন নেই। তবে এই চিহ্নহীনতায় মৃদু হাওয়ার একটা প্রশস্ততা এসে জড়িয়ে ধরলো। আমি স্বল্প আয়তনের প্রশান্তি বোধ করলাম।
আমি বটগাছটার পাদদেশ ও পাদদেশের এদিক-ওদিক তাকালাম। আমি একজন বীরাঙ্গনাকে খুঁজতে থাকলাম। যে আমার শূন্য প্রহরগুলো গিলছে। যে আমাকে টানছে অন্যরকম যন্ত্রণাদানে ও অন্যরকম জিজ্ঞাসায়।
আজ আমি তাকে অর্ঘ্য দেবো, ব্যবচ্ছেদ করবো শত প্রশ্ন ও শত জিজ্ঞাসায়। এই জিজ্ঞাসা কখনও মৌখিক, কখনও মনোগত। কিন্তু ভাবলাম, এত জিজ্ঞাসার উত্তর কি তার কাছে মিলবে? এত প্রশ্নের ভার কি সে সহ্য করতে পারবে? আমার মাঝে এক বিজাতীয় উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকলো।
কিন্তু উত্তেজনায় হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটলো। এর রূপ বিস্তারে বিপর্যয় ঘটিয়ে এক পর্যায়ে ভিন্ন আঙ্গিকের উত্তেজনার সৃষ্টি করলো। আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। মানবীটা কেন নেই? সে তো এই সময় এই স্থানেই থাকতো?
আমি এগিয়ে গেলাম বটগাছের অনতি উত্তরে। দৃষ্টির মাত্রা বাড়ালাম। আঁতিপাতি করে খুঁজলাম, কিন্তু আমার এতদিনের কল্পিত নারীটাকে পেলাম না। আমি দৃষ্টি ফেরালাম। আড়াআড়ি করে এগিয়ে গেলাম পশ্চিমে। এখানেও আমি নারীটাকে খুঁজে পেলাম না। আমি হতাশচিত্তে ফিরে এলাম গাছটার গোড়ায়।
কিছুক্ষণ থামলাম, উৎকণ্ঠিত হলাম আরও মাত্রা বাড়িয়ে। এগিয়ে গেলাম দক্ষিণে। এখানেও আমার দৃষ্টি ছিনিয়ে নেয়া সেই নারীটা নেই। আমি এবার সত্যিই আশাহতের সময় ভাঙলাম। উত্তরোত্তর প্রতিরোধের বান ভাঙতে থাকলাম। আর আমার পাশাপাশি ভাঙতে থাকলো নিজস্ব মন্থন চিন্তা ও নিজস্ব সমাজ চিন্তা। আমি তবুও মুখ ফেরালাম। আড়াআড়ি এগিয়ে গেলাম পুবে। নিরাশার পাথর ভেঙে আলোর আদিমতায় প্রচ- আগ্রহে তাকালাম। কিন্তু এখানেও তাকে পেলাম না। এখানেও যুগ ভাঙার নিস্তব্ধ পাগলিটাকে পেলাম না।
এবার আমি শূন্য দৃষ্টি মেলে আকাশমুখো হলাম। আমার সামনে থেকে উত্তর-পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ সব বিলীন হয়ে গেলো। আমি ভাবতে থাকলাম সেই পাগলিটার কথা, যে আমার প্রতিদিনকার চলমান গতি থামিয়ে দিতো কাড়া বা আকাড়া সদ্ভাব নিয়ে। আর গভীর মমতায় ডাকতো, ‘জাহিদ, এদিকে আয়। বাতাসা খাবি? এই নে পইসা’।
আমি জানি না, সে আমার নামটা কীভাবে জেনেছিলো। কিন্তু আমি তাকে ভয় পেতাম। দূর থেকে অযৌক্তিক ভেংচি কাটতাম। পালিয়ে যেতাম অকারণে ঢিল মেরে।
পাগলিটার নাম ছিলো বেগুনি।
দুই
আমি নির্মাণ কীÑ তখনও জানিনি। ভাঙন কীÑ তখনও শিখিনি। সমাজ কীÑ তখনও বুঝিনি। এমনি একসময় যখন সবে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। এমনই একদিন যেদিন আমি রৌদ্রের দুপুরে দাঁড়িয়েছিলাম। আর দৃষ্টিতে গিলছিলাম বেগুনি পাগলির চমৎকার ভঙ্গিতে খাওয়া। পাগলি খাচ্ছিল আর চমৎকার করে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আর থেমে থেমে হেসে উঠছিলো কখনও নিঃশব্দে, কখনও শব্দ করে। ঠিক তখনি একটা হাতের চাপ এসে আমার কাঁধে পড়ে। আমি চমকে তাকিয়ে দেখি, আমাদের স্কুলের বাংলার শিক্ষক, মতিন মাস্টার।
মতিন স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এমন করে কী দেখছিস, জাহিদ?’
আমি আঙুল উঁচিয়ে বলি, ‘জি, স্যার। ওই পাগলিটাকে দেখছি’।
মতিন স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বিমল চোখ আর পরিশুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ রে জাহিদ, বেগুনি কিসের পাগলি রে? সে তো বীরাঙ্গনা’।
‘বেগুনি পাগলি বীরাঙ্গনা?’
‘হ্যাঁ, তাই’।
আমি সেদিন মতিন স্যারের বলা বীরাঙ্গনা শব্দের মানে বুঝতে পারিনি। ভাবি, সেটা আবার কী? দ্রুতপঠন বইয়ে বীরাঙ্গনা সখিনার কাহিনী পড়েছিলাম। সেটা একটা ভিন্নতর কাহিনী, মনে উজ্জ্বল অনুভূতির সৃষ্টি করতো। কিন্তু বেগুনি পাগলি আবার কী রকম বীরাঙ্গনা? আমি বুঝতে না পেরে মতিন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করি, স্যার, বীরাঙ্গনা কী?
স্যার আমার মাথা থেকে হাত সরিয়ে বোঝানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলেন, ‘হ্যাঁ রে, বীরাঙ্গনা কী, জানিস না? বীরাঙ্গনা মানে বীরনারী। তুই তো শুনেছিস, একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো। সেই যুদ্ধে এই বেগুনি নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিলো।
আমি তবুও সেদিন ‘বীরনারী’ শব্দটার মানে বুঝিনি, কিংবা বিসর্জন দেওয়া কী তাও জানিনি। এমনকি এতটা বছর পরও এই শব্দ দুটোর সম্বন্ধে শৃঙ্খলাবদ্ধ জ্ঞান হয়নি। গড়ার আনন্দ ও ভাঙনের গান শোনার পর থেকে প্রতিনিয়ত রাজপথে সহ¯্র বীরনারী দেখি। এরা কেউ সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ গড়ে বীরনারী হচ্ছে। কেউ রাজনীতি ভেঙে নতুন রাজনীতির ধারক হয়ে বীরনারী হচ্ছে। কেউ আবার জনসমুদ্রের ঢল ভেঙে নতুন জনসমুদ্রের সেবায় বীরনারী হচ্ছে। এরা দেশ-জাতি-সমাজের লক্ষে নিজেকে, নিজের বাজার চড়া সময়কে, নিজের আকাশ ছোঁয়া প্রাঙ্গণকে সর্বদা বিসর্জন দিচ্ছে। আমি এদের প্রত্যেকের দিকে ভিক্ষার আকার দেওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছি। ঋণের প্রত্যাশায় হাত পেতেছি। চোখ ও দেহের ভাষাগুলো একত্র করে আর্তি ঢেলেছি। কিন্তু পাইনি এদের মাঝে মতিন স্যার বর্ণিত সেই বীর নারীর রূপ, কিংবা স্যার বর্ণিত সেই বিসর্জনের রূপ।
তিন
আমার শূন্য দৃষ্টি আবার প্রখর হলো। গিলে খেতে থাকলো উপস্থিত প্রকৃতি, প্রকৃতির প্রতিটি উপসর্গ ও প্রতিটি উপাদান। আমি মাটির দিকে তাকাতে তাকাতে আকাশের দিকে তাকালাম। সূর্য তখন পশ্চিমের দেহে। মেঘহীন আসমান, কিন্তু বর্ণের অপশাসনে নাবিকনীলে শুভ্রতার মিশ্রণ। আমি আবার আকাশ দেখতে দেখতে মাটিতে তাকালাম। দৃষ্টির পর্দায় দৃশ্যমান হলো এক প্রশস্ত ঠনঠনা মাটি। মাটির পর গাঙ। গাঙটার নাম বুড়িগাঙ। আক্রান্ত ঋতুর প্রভাবে বুড়িগাঙে শূন্যতার প্রভাব। এর শুকনো বুক উদোম হয়ে আছে বেলাজ হায়াহীন দৃষ্টি নিয়ে। প্রকৃতি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। পরিবেশটায় কেমন একটা অস্বস্তি ভাব।
আমি হাঁটতে থাকলাম। আমি হাঁটতে থাকলাম পূর্বের পথ অনুযায়ী স্কুল ঘেঁষে আড়ঙের হাঁ গহ্বরের দিকে। আড়ঙের গহ্বরে ঢুকেই উত্তর সারি ঘেঁষে হঠাৎ করেই থেমে গেলাম। যখন থামলাম তখন দৃষ্টি ছিলো শান্ত। কিন্তু থেমে সামনের ঘরটায় তাকাতেই আমার দৃষ্টিটা কঠিন হয়ে উঠলো। মনটায় ভিন্ন জ্ঞানের ক্রোধ এসে জড়ো হলো। আড়ঙের আর বাকি সবগুলো ঘরই যৌবনের শ্রী নিয়ে পার্বনী ঢঙে নিজেকে সাজালেও সম্মুখের ঘরটায় এখনও সেই আদিত্বের রূপ বর্তমান। মাঝখানে এতটা বছর পেরিয়ে গেছে, ঘরটায় সামান্য ভঙ্গুরতার চিহ্ন বাদে আর কিছুই অন্যরকম স্বকীয়তার জানান পরিলক্ষিত হলো না।
দরোজার উন্মুক্ত আহ্বান গলে ভেতরে দৃষ্টি মেললাম। একটা বয়স্ক লোক সারের ডিলারশিপ নিয়ে ক্যাশ বাক্সের সামনে কুঁজো হয়ে বসে আছে। কালচক্রের ভাটির টানে তার পাকা পাকা এক থুতনি দাড়ি ঝুলে আছে চেহারাকে বিদঘুটে রূপের আকার দিয়ে। আমি তাকে চিনতে পারলাম, নামটাও স্পষ্টভাবে মনে পড়লো। এ যে রহমান ভূঁইয়া! রাজাকার। যে তখনকার সময় এই আড়ঙের মাতব্বর ছিলেন।
রহমান ভূঁইয়ার দিকে পর্যবেক্ষণের দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই বেগুনি পাগলির কথা আবার মনে পড়লো। এবার মনে পড়লো বিধ্বস্ত আকারের রূপ নিয়ে।
তখন সবে আমি নির্মাণের কলাকৌশল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেছি। ভাঙনের প্রতিটা গানের প্রথম দু-একটা কলি অবিশুদ্ধ আন্দাজে বেসুরে গেয়ে ওঠার পাঁয়তারা করছি। তেমনি একসময় যখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তেমনি একদিন যখন সূর্যের ছিলো সকাল। স্কুলে যাওয়ার পথে রহমান ভূঁইয়ার দোকানঘরের সামনে লোকের জটলা দেখে থেমে যাই। কাছে গিয়ে লোকের ফাঁক গলে মানব গঠিত বিপন্ন বৃত্তের মাঝখানে দৃষ্টি দিয়েই আমি চমকে উঠি। রহমান ভূঁইয়া তার হাতের বাঁকা বেতটা দিয়ে বেগুনিকে বেধড়ক পিটাচ্ছে।
কেন পিটাচ্ছে? আমার মনে প্রশ্ন জাগে।
আমি উৎকণ্ঠা নিয়ে এদিক ওদিক তাকাই। খুঁজতে থাকি কাছের একটা মুখ, যাকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু পাইনি কিংবা পেতে গিয়ে থেমে যেতে হয়েছিলো একটা চিৎকারে। চিৎকারটা বেশ জোরের সাথে আমার কানে এসে বাজে। আমি জিজ্ঞাসা থেকে বিরত হয়ে, দৃষ্টিকে এক বিন্দুতে এনে চিৎকারের উৎসস্থল, বেগুনি পাগলির দিকে তাকাই। দেখি, বেগুনি পাগলি কী এক উত্তেজনায় হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করছে। আর রহমান ভূঁইয়া ভীত চোখে নিজ দেহটাকে পেছনের দিকে পিছিয়ে নিচ্ছে। এক পর্যায়ে রহমান ভূঁইয়া নিজেকে মানব বৃত্তের ভেতর ঠেলে দেয়।
কিন্তু বেগুনি পাগলি অভদ্র যন্ত্রণায় প্রবল নৃত্য করতে থাকে। তারপর নৃত্যের তাল কমিয়ে এনে সে নিজ দেহটায় দুঃশাসন চালায়। নিজেই নিজের বস্ত্র হরণ করতে থাকে। এক আড়ঙ মুখের সামনে বেগুনি পাগলি প্রথমে তার ব্লাউজটা দু’টানে ছিড়ে ফেলে, বায়ুর নিশান করে উড়িয়ে দেয় শূন্যে। ব্লাউজটা মাটির সংস্পর্শে আসতেই পরনের নীল শাড়িটা টেনে খুলে ফেলে। ঝাপটা মেরে ফেলে দেয় আড়ঙ মুখের একাংশের ওপর। তারপর ত্রস্ত হাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে নিজ সায়ার সংস্পর্শে। কিন্তু সায়ার ফিতায় হাতের বা দেহের পূর্ণতা পাওয়ার আগেই রহমান ভূঁইয়ার বাঁকা বেতের ক্ষিপ্রতা এসে বেগুনি পাগলির ঘাড় প্রাঙ্গণে পড়ে। বেগুনি পাগলি বেতের আঘাতে নিজ ভারসাম্য আর নিজ উত্তেজনায় আবদ্ধ রাখতে পারেনি। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রতিবাদের রোষ ঢালতে ঢালতে। মাটিতে পড়েও তার দৃষ্টির মাঝে দেখি প্রবল ক্রোধ ও প্রবল বিতৃষ্ণা...!
তখনই আমার মনে বেগুনি পাগলির সেই রূপ, সেই চেহারায় বিন্যস্ত আকার দিয়েছিলো। আমি বেগুনি পাগলির দেহকে উন্মোচন করার প্রবণতায় দেখেছিলাম নষ্ট সমাজের নষ্ট মুখগুলোর বিরুদ্ধে প্রচ- বিদ্বেষের এক নগ্ন আক্রমণ। আমি বেগুনি পাগলির দিগম্বর হওয়ার প্রবণতায় দেখেছিলাম সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রবল বিদ্রোহের স্পষ্টাস্পষ্টি জানান...।
চার
আমি আবার হাঁটতে থাকলাম। এবার এগিয়ে যেতে থাকলাম পূর্ব থেকে পশ্চিমে। উদ্দেশ্য দীপংকর রায়ের পরিত্যক্ত দালানটা, যেখানে বেগুনি পাগলি রাত কাটাতো দিনের ক্লান্তি ঢেলে।
কিন্তু সেখানেও বেগুনি পাগলিকে পেলাম না। এমনকি রাত কাটানোর যে সব উপাদান বর্তমান হওয়ার কথা ছিলো তারও কোনো হদিস মিললো না। এবার আমার আগমনের তীব্রতায় উদ্দেশ্যের ছন্দপতন উন্মুক্ত আসনে হতাশভাবে বাঁক ধরলো।
আমি অসহায় পদক্ষেপ ফেলে দীপংকর রায়ের দালানটা থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার গ্রহণের আকাক্সক্ষা অগ্রহণের যাঁতাকলে অযৌক্তিক জিজ্ঞাসার দিকে টেনে নিলো। আমি পর পর তিনটে দোকানে জিজ্ঞাসার উৎপাতে শামিল হলাম। প্রথম দোকানদার হাঁ দৃষ্টি মেললো। দ্বিতীয় দোকানদার আমার দিকে পাগল-সন্দেহের দৃষ্টি ফেললো। তৃতীয় দোকানদার আশার ঝিলিক দিলো, কিন্তু সমাধান টানতে পারলো না।
আমি বাইরে এসে এবার দাঁড়িয়ে রইলাম নিজেকে অসহায় বনে ভিন্ন প্রশ্রয়ে। আমার সামনে বৈকালিক মুখের আগমন, প্রত্যেকের চেহারায় ভাঁজ-অভাঁজের চিহ্ন। দোকানের উন্মুক্ততা এ মুহূর্তে কিঞ্চিৎ বেশি, বিশেষ করে চা-স্টলের হাঁ করা মুখ স্পষ্ট প্রতীয়মান। আমি যুগ উগলিয়ে অতীতের যে কোনো একটা চেনা মুখের অন্বেষায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলাম। কিন্তু পেলাম না। সব চেহারাই মনে হলো ধূসর বিভেদপন্থীর বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্যের নিঃসঙ্গতা বিরাজমান। এদের মাঝে ঐক্যের সমন্বয় মেলানো যেন প্রত্যেকের স্বাতন্ত্র্যবোধে অন্যায় দুঃশাসন চালানো।
আমি নিজেকে আবার নাড়িয়ে তুললাম। এগিয়ে যেতে থাকলাম আড়ঙের সীমান্ত ঘেঁষা প্রান্ত ছুঁই ছুঁই সেই স্কুলটার দিকে, যেখানে আমার উল্লেখযোগ্য পাঁচ বছর শিকলে আবদ্ধ রেখে গিয়েছি যুগের পাতা উল্টিয়ে। চতুর্থ শ্রেণির শেষ পর্যায় থেকে নবম শ্রেণির প্রথম পর্যায় পর্যন্ত এই নিরবচ্ছিন্ন সময়টা মঙ্গলের আশীর্বাদে দৈব নির্ধারণ করে গিয়েছি বিপন্ন সময়ের পাশে ঘেঁষে রক্ষণের প্রতিযোগিতায় ও প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বির মাঝে জাতে ওঠার সংগ্রামে। জাতে উঠেছি কি না, জানি না। তবে আজ আমি প্রস্তর গাঁথতে পারি মঙ্গল-অমঙ্গল পৃথিবীর মাঝে। সমাজ থেকে অফুরন্ত নিলেও সমাজকে দিচ্ছি কিছু। সমাজ সংস্কারের বিন্দু প্রত্যাশায় সাংবাদিকতা বেছে নিয়েছি। নিজের অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছি লেখনির মাঝে।
স্কুলের উন্মুক্ত আহ্বানে নিজেকে উপস্থাপন করতেই অপ্রত্যাশিতভাবে মতিন স্যারকে পেয়ে গেলাম। প্রথম দৃষ্টিতে চেহারাটা কাছে টানেনি। কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টিতেই ত্বরিত কাছে টেনে নিলো। বিশেষ করে স্যারের পিঠ অবধি কপাল আর জোড়া ভ্রুর বিশেষত্বের জন্য এই কাছে টানা।
স্যার প্রথমে আমাকে চিনতে পারেননি। আবহমান রোজনামচা তেমন বিশাল আয়তনে স্যারকে গ্রাস না করলেও আমি তো লিপিকার প্রহর গুণে, কাল নির্বাহের ক্রমাগত তালে ও কালসন্ধির পর যুগসন্ধির সত্যতা হজম করেছি। পৌনঃপুনিকতায় হয়ে উঠেছি আজকের জাহিদ। এতে নিরন্তরতায় ব্যাঘাত ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু অতি মন্থরতা আর দীর্ঘসূত্রতায় প্রতীক্ষিত নবীনত্বে তো পৌঁছেছি।
প্রান্তরহীন অকৃত্রিম উচ্ছ্বাসে যৌক্তিক অনেকগুলো জিজ্ঞাসার সমাপ্তি ঘটিয়ে আমি ও মতিন স্যার বটগাছটার পাদদেশে এসে দাঁড়ালাম। এতে পরিকল্পনাহীনতার দ্বন্দ্ব থাকলেও অমোঘতা বিরাজমান উভয়ের মাঝেই। হয়তোবা প্রতীক্ষণটা জীর্ণতা পরিহারের জন্য পুরাতন স্থানে অনির্দিষ্টভাবেই আমাদের দেহকে প্রদর্শন করলো।
আমি স্যারকে অনুরোধ জানালাম, ‘স্যার, চলুন গাছটার গোড়ায় বসি’।
স্যার আমার চোখে তাকিয়ে বটগাছের উঁচু একটা শিকড়ে বসলেন।
আমিও স্যারের পাশাপাশি বসলাম।
উভয়ই কিছুটা সময় চুপ রইলাম। বেলাশেষের আহ্বান প্রকৃতিতে তখন বর্ষীয়ানের শেষ প্রহরের দিকে টানছে। আর সূর্যকে জানিয়ে দিচ্ছে সাঁঝকন্যার মিলন আর্তনাদ।
আমি স্যারকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, বীরনারীর খবর কী? পুরো আড়ঙ ঘুরে তো তাকে খুঁজে পেলাম না’।
স্যার শিশুপ্রকৃতির আশ্চর্যভাব টেনে আমার দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীসের বীরনারী, জাহিদ?’
স্যারের ভুল সংস্করণ আমাকে কিছুটা আহত করলো। বললাম, ‘স্যার, সেই বীরনারী যাকে আপনি বীরাঙ্গনা আখ্যা দিয়েছিলেন। স্যার, সেই বীরাঙ্গনা যে সারাটা দিন এই গাছটার গোড়ায় থাকতো, আর রাত কাটাতো দীপংকর রায়ের পরিত্যক্ত দালানটায়?’
স্যার কিছুটা সময় চুপ থাকলেন। তারপর তাচ্ছিল্যের উচ্ছ্বাস ঢেলে হাসলেন। বললেন, ‘ও, সেই পাগলিটার কথা বলছিস? কী যে নাম? ওহো, মনে পড়ছে। বেগুনি। বেগুনি পাগলি। তুই বেগুনি পাগলির কথা জিজ্ঞেস করছিস?’
আমি এবার সত্যিই পুরোপুরি আহত হলাম। আহতের বিধ্বস্ত রূপ আমাকে কিছুটা সময় চুপ থাকতে বাধ্য করলো। তারপর শোকার্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, আপনি বেগুনিকে পাগলি বলছেন? আপনি না তাকে আমার কাছে বীরাঙ্গনা আখ্যা দিয়েছিলেন?
মতিন স্যার সরাসরি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু তাকানো মাত্রই আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। আমি তৎক্ষণাৎ দেখলাম, স্যারের চেহারায় কী এক অসহায়ত্ব ও উৎপীড়নের কালশিটে দাগ। তাঁর বিমর্ষতা যেন উৎপীড়নের দগ্ধতায় গলে গলে পড়ছে।
স্যার নির্বাণের অশ্রদ্ধায় বললেন, ‘জাহিদ, তখন ভুল বলেছিলাম। হ্যাঁ রে, বেগুনি পাগলি বীরাঙ্গনা হতে যাবে কেন? সে তো বারাঙ্গনা...!’
আমি চমকে উঠলাম। আশাহতের তীব্র যন্ত্রণায় প্রচ-ভাবে অবিন্যস্ত হয়ে উঠলাম। পরিত্রাণের আকুলতায় ত্রাণকর্তার শরণাপন্ন হলাম। কিন্তু প্রতিকূলতা ঠিকই ত্রাণকর্তার দৃষ্টির সামনে বিশাল আকৃতির ছায়া ফেলে রাখলো।
আমি বেসাতহীন অশোধিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, আপনি এসব কী বলছেন?’
স্যার আমার কথার উত্তর দিলেন না। ঘাড়টা আরও নুইয়ে ফেললেন নির্ভরতাহীন ভিন্ন তত্ত্বাবধানে।
আমি আর কোনো প্রশ্ন করলাম না, কিংবা প্রশ্ন করার প্রয়োজন বোধ করলাম না। কী প্রশ্ন করবো? আমি তো বীরাঙ্গনার তাৎপর্য জানতে এসেছি, বারাঙ্গনার নয়...।
পাঁচ
সূর্য অনায়াসে পশ্চিমের বিশাল বিবরে নিজেকে সঁপে দিলো। আর ঋণের বিলাসে মৃদু সান্ত¡নার চিহ্ন এঁকে ছড়িয়ে দিলো এক আকাশ গোধূলি। দিনান্তে ক্লান্ত, সাঁঝের নেশায় আসক্ত ও প্রকৃতির বিমর্ষ রূপ বেলা হনন উল্লাসে ক্রমশ আলোক বস্তুকে গিলতে থাকলো বিনয়হীনতায়। আর পরিবেশ থেকে বয়ে আসতে থাকলো দুষ্টচক্রে তাল হারানো নিশ্বাস। এই নিশ্বাস শান্ত আর্তনাদের। কিন্তু এক প্রশস্ত অমঙ্গল চিহ্নের ও এক প্রশস্ত অশুভ সংকেতের।
আমি মতিন স্যারকে পেছন ফেলে পশ্চিম থেকে আরও পশ্চিমে এগিয়ে যেতে থাকলাম সাঁঝ ভাঙার গান গেয়ে ও রাতের শরীর ভেঙে বীরনারীর সন্ধানে। জানি না এই সন্ধানের শেষ হবে কি না, নাকি একের পর এক প্রভুত্ব করে যাবে অনন্তের আহ্বান ও মহাকালের দৈর্ঘ্য...!
মহিবুল আলম
সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
খেয়াঘাট থেকে উঠে আমি আড়ঙের প্রান্তদেশে এসে দাঁড়ালাম। আমি দাঁড়ালাম একটা জামগাছের ছায়ায়। গাছটার সুশীতল আহ্বান তৎক্ষণাৎ আমার দেহ-প্রাঙ্গণে সজীবতার স্পর্শ দিলো ঠিকই, কিন্তু তা অন্তর্গত সম্বন্ধ স্থাপনে এক বৈরী ভাবের সৃষ্টি করলো।
আমি এক রাস্তা বায়ু ভেদ করে, পশ্চিম থেকে অনেকটা পুবে তাকালাম, যেখানে আড়ঙের শেষটা বাঁক খেয়েছে স্কুলকে সামনে রেখে সামান্য দক্ষিণে।
আমি হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে থাকলাম শরীরটাকে টান টান করে উদ্দেশ্যের তত্ত্বাবধানে ও ভিন্ন মাত্রার অভিলাষ গিলে। আজ প্রায় তেরো বছর পর রসুলপর আড়ঙ ধরে হাঁটছি। আড়ঙের প্রতিটা পদক্ষেপে এক ধরনের আনন্দবোধ ও এক ধরনের বেদনাবোধ সহমিশ্রণে আমাকে জড়িয়ে ধরছে। আর দৃষ্টিকে দিচ্ছে ভিন্নমাত্রিক রূপ। অতীতের সেই পনেরো-ষোলটা ঘরসমেত রসুলপুর আড়ঙটা আর নেই। এখন দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো সারি সারি দোকান। কোনো কোনো দোকান আবার ইটের গাঁথুনির।
আমি হাঁটতে হাঁটতে পুরানো ভাঙা ও শেওলার আস্তরপড়া একটা দালানের সামনে এসে থামলাম। দালানটা দীপংকর রায়ের। ভারত বিভাগের পূর্বে এখানে তার মোকাম ছিলো। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এটা পরিত্যক্ত দালান হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
একটু এগিয়েই সোনালী ব্যাংকটা খুঁজে পেলাম। সোনালী ব্যাংকটা এখন একটা দালানের ভেতর ঢুকে অভিজাত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি স্মৃতিমন্থন করলাম। অতীতকে কাছে টেনে আনলাম। বর্তমানকে করলাম গৌণ। আমার চোখে ভেসে উঠলো বাবার অতীতের সেই শ্মশ্রুবিহীন চেহারা। বাবা এই ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন। বাবা এখানে থাকাকালীন এই জায়গাটায় একটা চৌচালা ইটের গাঁথুনির লালি ধরা ঘরের অবস্থান ছিলো। বাবার চাকুরির কারণে আমরা পুরো পাঁচ বছর এই গ্রামে থেকে গেছি। রেখে গেছি অজ¯্র অযাচিত চিহ্ন।
আমি আবার হাঁটতে থাকলাম। আড়ঙটা মোটামুটি ফাঁকা। বেশিরভাগ দোকানেরই ঝাপ পড়ে আছে। যেগুলো খোলা আছে সেগুলোতেও তেমন লোকজনের সমাগম নেই। গ্রাম্য আড়ঙ, সকালেই বাজার ভেঙে যায় বলে হয়তো এমনটা হয়েছে।
নির্ধারিতভাবেই স্কুলের পেছন ঘেঁষে গাঙের ধারে অবস্থিত বটগাছের সামনে এসে দাঁড়ালাম। শূন্য কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে বটগাছটার দিকে তাকালাম। তৎক্ষণাৎ আশ্চর্য হলাম, এক যুগের হাওয়া পেরিয়ে বটগাছটায় উল্লেখযোগ্য কোনো ভাঙনের গন্ধ নেই, কিংবা যুগের উল্লাসে সময়ের পূর্ণতায় গাছটায় বিশাল বিশ্লেষণের মতো কোনো গড়ার চিহ্ন নেই। তবে এই চিহ্নহীনতায় মৃদু হাওয়ার একটা প্রশস্ততা এসে জড়িয়ে ধরলো। আমি স্বল্প আয়তনের প্রশান্তি বোধ করলাম।
আমি বটগাছটার পাদদেশ ও পাদদেশের এদিক-ওদিক তাকালাম। আমি একজন বীরাঙ্গনাকে খুঁজতে থাকলাম। যে আমার শূন্য প্রহরগুলো গিলছে। যে আমাকে টানছে অন্যরকম যন্ত্রণাদানে ও অন্যরকম জিজ্ঞাসায়।
আজ আমি তাকে অর্ঘ্য দেবো, ব্যবচ্ছেদ করবো শত প্রশ্ন ও শত জিজ্ঞাসায়। এই জিজ্ঞাসা কখনও মৌখিক, কখনও মনোগত। কিন্তু ভাবলাম, এত জিজ্ঞাসার উত্তর কি তার কাছে মিলবে? এত প্রশ্নের ভার কি সে সহ্য করতে পারবে? আমার মাঝে এক বিজাতীয় উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকলো।
কিন্তু উত্তেজনায় হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটলো। এর রূপ বিস্তারে বিপর্যয় ঘটিয়ে এক পর্যায়ে ভিন্ন আঙ্গিকের উত্তেজনার সৃষ্টি করলো। আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। মানবীটা কেন নেই? সে তো এই সময় এই স্থানেই থাকতো?
আমি এগিয়ে গেলাম বটগাছের অনতি উত্তরে। দৃষ্টির মাত্রা বাড়ালাম। আঁতিপাতি করে খুঁজলাম, কিন্তু আমার এতদিনের কল্পিত নারীটাকে পেলাম না। আমি দৃষ্টি ফেরালাম। আড়াআড়ি করে এগিয়ে গেলাম পশ্চিমে। এখানেও আমি নারীটাকে খুঁজে পেলাম না। আমি হতাশচিত্তে ফিরে এলাম গাছটার গোড়ায়।
কিছুক্ষণ থামলাম, উৎকণ্ঠিত হলাম আরও মাত্রা বাড়িয়ে। এগিয়ে গেলাম দক্ষিণে। এখানেও আমার দৃষ্টি ছিনিয়ে নেয়া সেই নারীটা নেই। আমি এবার সত্যিই আশাহতের সময় ভাঙলাম। উত্তরোত্তর প্রতিরোধের বান ভাঙতে থাকলাম। আর আমার পাশাপাশি ভাঙতে থাকলো নিজস্ব মন্থন চিন্তা ও নিজস্ব সমাজ চিন্তা। আমি তবুও মুখ ফেরালাম। আড়াআড়ি এগিয়ে গেলাম পুবে। নিরাশার পাথর ভেঙে আলোর আদিমতায় প্রচ- আগ্রহে তাকালাম। কিন্তু এখানেও তাকে পেলাম না। এখানেও যুগ ভাঙার নিস্তব্ধ পাগলিটাকে পেলাম না।
এবার আমি শূন্য দৃষ্টি মেলে আকাশমুখো হলাম। আমার সামনে থেকে উত্তর-পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ সব বিলীন হয়ে গেলো। আমি ভাবতে থাকলাম সেই পাগলিটার কথা, যে আমার প্রতিদিনকার চলমান গতি থামিয়ে দিতো কাড়া বা আকাড়া সদ্ভাব নিয়ে। আর গভীর মমতায় ডাকতো, ‘জাহিদ, এদিকে আয়। বাতাসা খাবি? এই নে পইসা’।
আমি জানি না, সে আমার নামটা কীভাবে জেনেছিলো। কিন্তু আমি তাকে ভয় পেতাম। দূর থেকে অযৌক্তিক ভেংচি কাটতাম। পালিয়ে যেতাম অকারণে ঢিল মেরে।
পাগলিটার নাম ছিলো বেগুনি।
দুই
আমি নির্মাণ কীÑ তখনও জানিনি। ভাঙন কীÑ তখনও শিখিনি। সমাজ কীÑ তখনও বুঝিনি। এমনি একসময় যখন সবে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। এমনই একদিন যেদিন আমি রৌদ্রের দুপুরে দাঁড়িয়েছিলাম। আর দৃষ্টিতে গিলছিলাম বেগুনি পাগলির চমৎকার ভঙ্গিতে খাওয়া। পাগলি খাচ্ছিল আর চমৎকার করে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আর থেমে থেমে হেসে উঠছিলো কখনও নিঃশব্দে, কখনও শব্দ করে। ঠিক তখনি একটা হাতের চাপ এসে আমার কাঁধে পড়ে। আমি চমকে তাকিয়ে দেখি, আমাদের স্কুলের বাংলার শিক্ষক, মতিন মাস্টার।
মতিন স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এমন করে কী দেখছিস, জাহিদ?’
আমি আঙুল উঁচিয়ে বলি, ‘জি, স্যার। ওই পাগলিটাকে দেখছি’।
মতিন স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বিমল চোখ আর পরিশুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ রে জাহিদ, বেগুনি কিসের পাগলি রে? সে তো বীরাঙ্গনা’।
‘বেগুনি পাগলি বীরাঙ্গনা?’
‘হ্যাঁ, তাই’।
আমি সেদিন মতিন স্যারের বলা বীরাঙ্গনা শব্দের মানে বুঝতে পারিনি। ভাবি, সেটা আবার কী? দ্রুতপঠন বইয়ে বীরাঙ্গনা সখিনার কাহিনী পড়েছিলাম। সেটা একটা ভিন্নতর কাহিনী, মনে উজ্জ্বল অনুভূতির সৃষ্টি করতো। কিন্তু বেগুনি পাগলি আবার কী রকম বীরাঙ্গনা? আমি বুঝতে না পেরে মতিন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করি, স্যার, বীরাঙ্গনা কী?
স্যার আমার মাথা থেকে হাত সরিয়ে বোঝানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলেন, ‘হ্যাঁ রে, বীরাঙ্গনা কী, জানিস না? বীরাঙ্গনা মানে বীরনারী। তুই তো শুনেছিস, একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো। সেই যুদ্ধে এই বেগুনি নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিলো।
আমি তবুও সেদিন ‘বীরনারী’ শব্দটার মানে বুঝিনি, কিংবা বিসর্জন দেওয়া কী তাও জানিনি। এমনকি এতটা বছর পরও এই শব্দ দুটোর সম্বন্ধে শৃঙ্খলাবদ্ধ জ্ঞান হয়নি। গড়ার আনন্দ ও ভাঙনের গান শোনার পর থেকে প্রতিনিয়ত রাজপথে সহ¯্র বীরনারী দেখি। এরা কেউ সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ গড়ে বীরনারী হচ্ছে। কেউ রাজনীতি ভেঙে নতুন রাজনীতির ধারক হয়ে বীরনারী হচ্ছে। কেউ আবার জনসমুদ্রের ঢল ভেঙে নতুন জনসমুদ্রের সেবায় বীরনারী হচ্ছে। এরা দেশ-জাতি-সমাজের লক্ষে নিজেকে, নিজের বাজার চড়া সময়কে, নিজের আকাশ ছোঁয়া প্রাঙ্গণকে সর্বদা বিসর্জন দিচ্ছে। আমি এদের প্রত্যেকের দিকে ভিক্ষার আকার দেওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছি। ঋণের প্রত্যাশায় হাত পেতেছি। চোখ ও দেহের ভাষাগুলো একত্র করে আর্তি ঢেলেছি। কিন্তু পাইনি এদের মাঝে মতিন স্যার বর্ণিত সেই বীর নারীর রূপ, কিংবা স্যার বর্ণিত সেই বিসর্জনের রূপ।
তিন
আমার শূন্য দৃষ্টি আবার প্রখর হলো। গিলে খেতে থাকলো উপস্থিত প্রকৃতি, প্রকৃতির প্রতিটি উপসর্গ ও প্রতিটি উপাদান। আমি মাটির দিকে তাকাতে তাকাতে আকাশের দিকে তাকালাম। সূর্য তখন পশ্চিমের দেহে। মেঘহীন আসমান, কিন্তু বর্ণের অপশাসনে নাবিকনীলে শুভ্রতার মিশ্রণ। আমি আবার আকাশ দেখতে দেখতে মাটিতে তাকালাম। দৃষ্টির পর্দায় দৃশ্যমান হলো এক প্রশস্ত ঠনঠনা মাটি। মাটির পর গাঙ। গাঙটার নাম বুড়িগাঙ। আক্রান্ত ঋতুর প্রভাবে বুড়িগাঙে শূন্যতার প্রভাব। এর শুকনো বুক উদোম হয়ে আছে বেলাজ হায়াহীন দৃষ্টি নিয়ে। প্রকৃতি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। পরিবেশটায় কেমন একটা অস্বস্তি ভাব।
আমি হাঁটতে থাকলাম। আমি হাঁটতে থাকলাম পূর্বের পথ অনুযায়ী স্কুল ঘেঁষে আড়ঙের হাঁ গহ্বরের দিকে। আড়ঙের গহ্বরে ঢুকেই উত্তর সারি ঘেঁষে হঠাৎ করেই থেমে গেলাম। যখন থামলাম তখন দৃষ্টি ছিলো শান্ত। কিন্তু থেমে সামনের ঘরটায় তাকাতেই আমার দৃষ্টিটা কঠিন হয়ে উঠলো। মনটায় ভিন্ন জ্ঞানের ক্রোধ এসে জড়ো হলো। আড়ঙের আর বাকি সবগুলো ঘরই যৌবনের শ্রী নিয়ে পার্বনী ঢঙে নিজেকে সাজালেও সম্মুখের ঘরটায় এখনও সেই আদিত্বের রূপ বর্তমান। মাঝখানে এতটা বছর পেরিয়ে গেছে, ঘরটায় সামান্য ভঙ্গুরতার চিহ্ন বাদে আর কিছুই অন্যরকম স্বকীয়তার জানান পরিলক্ষিত হলো না।
দরোজার উন্মুক্ত আহ্বান গলে ভেতরে দৃষ্টি মেললাম। একটা বয়স্ক লোক সারের ডিলারশিপ নিয়ে ক্যাশ বাক্সের সামনে কুঁজো হয়ে বসে আছে। কালচক্রের ভাটির টানে তার পাকা পাকা এক থুতনি দাড়ি ঝুলে আছে চেহারাকে বিদঘুটে রূপের আকার দিয়ে। আমি তাকে চিনতে পারলাম, নামটাও স্পষ্টভাবে মনে পড়লো। এ যে রহমান ভূঁইয়া! রাজাকার। যে তখনকার সময় এই আড়ঙের মাতব্বর ছিলেন।
রহমান ভূঁইয়ার দিকে পর্যবেক্ষণের দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই বেগুনি পাগলির কথা আবার মনে পড়লো। এবার মনে পড়লো বিধ্বস্ত আকারের রূপ নিয়ে।
তখন সবে আমি নির্মাণের কলাকৌশল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেছি। ভাঙনের প্রতিটা গানের প্রথম দু-একটা কলি অবিশুদ্ধ আন্দাজে বেসুরে গেয়ে ওঠার পাঁয়তারা করছি। তেমনি একসময় যখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তেমনি একদিন যখন সূর্যের ছিলো সকাল। স্কুলে যাওয়ার পথে রহমান ভূঁইয়ার দোকানঘরের সামনে লোকের জটলা দেখে থেমে যাই। কাছে গিয়ে লোকের ফাঁক গলে মানব গঠিত বিপন্ন বৃত্তের মাঝখানে দৃষ্টি দিয়েই আমি চমকে উঠি। রহমান ভূঁইয়া তার হাতের বাঁকা বেতটা দিয়ে বেগুনিকে বেধড়ক পিটাচ্ছে।
কেন পিটাচ্ছে? আমার মনে প্রশ্ন জাগে।
আমি উৎকণ্ঠা নিয়ে এদিক ওদিক তাকাই। খুঁজতে থাকি কাছের একটা মুখ, যাকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু পাইনি কিংবা পেতে গিয়ে থেমে যেতে হয়েছিলো একটা চিৎকারে। চিৎকারটা বেশ জোরের সাথে আমার কানে এসে বাজে। আমি জিজ্ঞাসা থেকে বিরত হয়ে, দৃষ্টিকে এক বিন্দুতে এনে চিৎকারের উৎসস্থল, বেগুনি পাগলির দিকে তাকাই। দেখি, বেগুনি পাগলি কী এক উত্তেজনায় হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করছে। আর রহমান ভূঁইয়া ভীত চোখে নিজ দেহটাকে পেছনের দিকে পিছিয়ে নিচ্ছে। এক পর্যায়ে রহমান ভূঁইয়া নিজেকে মানব বৃত্তের ভেতর ঠেলে দেয়।
কিন্তু বেগুনি পাগলি অভদ্র যন্ত্রণায় প্রবল নৃত্য করতে থাকে। তারপর নৃত্যের তাল কমিয়ে এনে সে নিজ দেহটায় দুঃশাসন চালায়। নিজেই নিজের বস্ত্র হরণ করতে থাকে। এক আড়ঙ মুখের সামনে বেগুনি পাগলি প্রথমে তার ব্লাউজটা দু’টানে ছিড়ে ফেলে, বায়ুর নিশান করে উড়িয়ে দেয় শূন্যে। ব্লাউজটা মাটির সংস্পর্শে আসতেই পরনের নীল শাড়িটা টেনে খুলে ফেলে। ঝাপটা মেরে ফেলে দেয় আড়ঙ মুখের একাংশের ওপর। তারপর ত্রস্ত হাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে নিজ সায়ার সংস্পর্শে। কিন্তু সায়ার ফিতায় হাতের বা দেহের পূর্ণতা পাওয়ার আগেই রহমান ভূঁইয়ার বাঁকা বেতের ক্ষিপ্রতা এসে বেগুনি পাগলির ঘাড় প্রাঙ্গণে পড়ে। বেগুনি পাগলি বেতের আঘাতে নিজ ভারসাম্য আর নিজ উত্তেজনায় আবদ্ধ রাখতে পারেনি। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রতিবাদের রোষ ঢালতে ঢালতে। মাটিতে পড়েও তার দৃষ্টির মাঝে দেখি প্রবল ক্রোধ ও প্রবল বিতৃষ্ণা...!
তখনই আমার মনে বেগুনি পাগলির সেই রূপ, সেই চেহারায় বিন্যস্ত আকার দিয়েছিলো। আমি বেগুনি পাগলির দেহকে উন্মোচন করার প্রবণতায় দেখেছিলাম নষ্ট সমাজের নষ্ট মুখগুলোর বিরুদ্ধে প্রচ- বিদ্বেষের এক নগ্ন আক্রমণ। আমি বেগুনি পাগলির দিগম্বর হওয়ার প্রবণতায় দেখেছিলাম সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রবল বিদ্রোহের স্পষ্টাস্পষ্টি জানান...।
চার
আমি আবার হাঁটতে থাকলাম। এবার এগিয়ে যেতে থাকলাম পূর্ব থেকে পশ্চিমে। উদ্দেশ্য দীপংকর রায়ের পরিত্যক্ত দালানটা, যেখানে বেগুনি পাগলি রাত কাটাতো দিনের ক্লান্তি ঢেলে।
কিন্তু সেখানেও বেগুনি পাগলিকে পেলাম না। এমনকি রাত কাটানোর যে সব উপাদান বর্তমান হওয়ার কথা ছিলো তারও কোনো হদিস মিললো না। এবার আমার আগমনের তীব্রতায় উদ্দেশ্যের ছন্দপতন উন্মুক্ত আসনে হতাশভাবে বাঁক ধরলো।
আমি অসহায় পদক্ষেপ ফেলে দীপংকর রায়ের দালানটা থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার গ্রহণের আকাক্সক্ষা অগ্রহণের যাঁতাকলে অযৌক্তিক জিজ্ঞাসার দিকে টেনে নিলো। আমি পর পর তিনটে দোকানে জিজ্ঞাসার উৎপাতে শামিল হলাম। প্রথম দোকানদার হাঁ দৃষ্টি মেললো। দ্বিতীয় দোকানদার আমার দিকে পাগল-সন্দেহের দৃষ্টি ফেললো। তৃতীয় দোকানদার আশার ঝিলিক দিলো, কিন্তু সমাধান টানতে পারলো না।
আমি বাইরে এসে এবার দাঁড়িয়ে রইলাম নিজেকে অসহায় বনে ভিন্ন প্রশ্রয়ে। আমার সামনে বৈকালিক মুখের আগমন, প্রত্যেকের চেহারায় ভাঁজ-অভাঁজের চিহ্ন। দোকানের উন্মুক্ততা এ মুহূর্তে কিঞ্চিৎ বেশি, বিশেষ করে চা-স্টলের হাঁ করা মুখ স্পষ্ট প্রতীয়মান। আমি যুগ উগলিয়ে অতীতের যে কোনো একটা চেনা মুখের অন্বেষায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলাম। কিন্তু পেলাম না। সব চেহারাই মনে হলো ধূসর বিভেদপন্থীর বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্যের নিঃসঙ্গতা বিরাজমান। এদের মাঝে ঐক্যের সমন্বয় মেলানো যেন প্রত্যেকের স্বাতন্ত্র্যবোধে অন্যায় দুঃশাসন চালানো।
আমি নিজেকে আবার নাড়িয়ে তুললাম। এগিয়ে যেতে থাকলাম আড়ঙের সীমান্ত ঘেঁষা প্রান্ত ছুঁই ছুঁই সেই স্কুলটার দিকে, যেখানে আমার উল্লেখযোগ্য পাঁচ বছর শিকলে আবদ্ধ রেখে গিয়েছি যুগের পাতা উল্টিয়ে। চতুর্থ শ্রেণির শেষ পর্যায় থেকে নবম শ্রেণির প্রথম পর্যায় পর্যন্ত এই নিরবচ্ছিন্ন সময়টা মঙ্গলের আশীর্বাদে দৈব নির্ধারণ করে গিয়েছি বিপন্ন সময়ের পাশে ঘেঁষে রক্ষণের প্রতিযোগিতায় ও প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বির মাঝে জাতে ওঠার সংগ্রামে। জাতে উঠেছি কি না, জানি না। তবে আজ আমি প্রস্তর গাঁথতে পারি মঙ্গল-অমঙ্গল পৃথিবীর মাঝে। সমাজ থেকে অফুরন্ত নিলেও সমাজকে দিচ্ছি কিছু। সমাজ সংস্কারের বিন্দু প্রত্যাশায় সাংবাদিকতা বেছে নিয়েছি। নিজের অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছি লেখনির মাঝে।
স্কুলের উন্মুক্ত আহ্বানে নিজেকে উপস্থাপন করতেই অপ্রত্যাশিতভাবে মতিন স্যারকে পেয়ে গেলাম। প্রথম দৃষ্টিতে চেহারাটা কাছে টানেনি। কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টিতেই ত্বরিত কাছে টেনে নিলো। বিশেষ করে স্যারের পিঠ অবধি কপাল আর জোড়া ভ্রুর বিশেষত্বের জন্য এই কাছে টানা।
স্যার প্রথমে আমাকে চিনতে পারেননি। আবহমান রোজনামচা তেমন বিশাল আয়তনে স্যারকে গ্রাস না করলেও আমি তো লিপিকার প্রহর গুণে, কাল নির্বাহের ক্রমাগত তালে ও কালসন্ধির পর যুগসন্ধির সত্যতা হজম করেছি। পৌনঃপুনিকতায় হয়ে উঠেছি আজকের জাহিদ। এতে নিরন্তরতায় ব্যাঘাত ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু অতি মন্থরতা আর দীর্ঘসূত্রতায় প্রতীক্ষিত নবীনত্বে তো পৌঁছেছি।
প্রান্তরহীন অকৃত্রিম উচ্ছ্বাসে যৌক্তিক অনেকগুলো জিজ্ঞাসার সমাপ্তি ঘটিয়ে আমি ও মতিন স্যার বটগাছটার পাদদেশে এসে দাঁড়ালাম। এতে পরিকল্পনাহীনতার দ্বন্দ্ব থাকলেও অমোঘতা বিরাজমান উভয়ের মাঝেই। হয়তোবা প্রতীক্ষণটা জীর্ণতা পরিহারের জন্য পুরাতন স্থানে অনির্দিষ্টভাবেই আমাদের দেহকে প্রদর্শন করলো।
আমি স্যারকে অনুরোধ জানালাম, ‘স্যার, চলুন গাছটার গোড়ায় বসি’।
স্যার আমার চোখে তাকিয়ে বটগাছের উঁচু একটা শিকড়ে বসলেন।
আমিও স্যারের পাশাপাশি বসলাম।
উভয়ই কিছুটা সময় চুপ রইলাম। বেলাশেষের আহ্বান প্রকৃতিতে তখন বর্ষীয়ানের শেষ প্রহরের দিকে টানছে। আর সূর্যকে জানিয়ে দিচ্ছে সাঁঝকন্যার মিলন আর্তনাদ।
আমি স্যারকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, বীরনারীর খবর কী? পুরো আড়ঙ ঘুরে তো তাকে খুঁজে পেলাম না’।
স্যার শিশুপ্রকৃতির আশ্চর্যভাব টেনে আমার দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীসের বীরনারী, জাহিদ?’
স্যারের ভুল সংস্করণ আমাকে কিছুটা আহত করলো। বললাম, ‘স্যার, সেই বীরনারী যাকে আপনি বীরাঙ্গনা আখ্যা দিয়েছিলেন। স্যার, সেই বীরাঙ্গনা যে সারাটা দিন এই গাছটার গোড়ায় থাকতো, আর রাত কাটাতো দীপংকর রায়ের পরিত্যক্ত দালানটায়?’
স্যার কিছুটা সময় চুপ থাকলেন। তারপর তাচ্ছিল্যের উচ্ছ্বাস ঢেলে হাসলেন। বললেন, ‘ও, সেই পাগলিটার কথা বলছিস? কী যে নাম? ওহো, মনে পড়ছে। বেগুনি। বেগুনি পাগলি। তুই বেগুনি পাগলির কথা জিজ্ঞেস করছিস?’
আমি এবার সত্যিই পুরোপুরি আহত হলাম। আহতের বিধ্বস্ত রূপ আমাকে কিছুটা সময় চুপ থাকতে বাধ্য করলো। তারপর শোকার্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, আপনি বেগুনিকে পাগলি বলছেন? আপনি না তাকে আমার কাছে বীরাঙ্গনা আখ্যা দিয়েছিলেন?
মতিন স্যার সরাসরি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু তাকানো মাত্রই আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। আমি তৎক্ষণাৎ দেখলাম, স্যারের চেহারায় কী এক অসহায়ত্ব ও উৎপীড়নের কালশিটে দাগ। তাঁর বিমর্ষতা যেন উৎপীড়নের দগ্ধতায় গলে গলে পড়ছে।
স্যার নির্বাণের অশ্রদ্ধায় বললেন, ‘জাহিদ, তখন ভুল বলেছিলাম। হ্যাঁ রে, বেগুনি পাগলি বীরাঙ্গনা হতে যাবে কেন? সে তো বারাঙ্গনা...!’
আমি চমকে উঠলাম। আশাহতের তীব্র যন্ত্রণায় প্রচ-ভাবে অবিন্যস্ত হয়ে উঠলাম। পরিত্রাণের আকুলতায় ত্রাণকর্তার শরণাপন্ন হলাম। কিন্তু প্রতিকূলতা ঠিকই ত্রাণকর্তার দৃষ্টির সামনে বিশাল আকৃতির ছায়া ফেলে রাখলো।
আমি বেসাতহীন অশোধিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, আপনি এসব কী বলছেন?’
স্যার আমার কথার উত্তর দিলেন না। ঘাড়টা আরও নুইয়ে ফেললেন নির্ভরতাহীন ভিন্ন তত্ত্বাবধানে।
আমি আর কোনো প্রশ্ন করলাম না, কিংবা প্রশ্ন করার প্রয়োজন বোধ করলাম না। কী প্রশ্ন করবো? আমি তো বীরাঙ্গনার তাৎপর্য জানতে এসেছি, বারাঙ্গনার নয়...।
পাঁচ
সূর্য অনায়াসে পশ্চিমের বিশাল বিবরে নিজেকে সঁপে দিলো। আর ঋণের বিলাসে মৃদু সান্ত¡নার চিহ্ন এঁকে ছড়িয়ে দিলো এক আকাশ গোধূলি। দিনান্তে ক্লান্ত, সাঁঝের নেশায় আসক্ত ও প্রকৃতির বিমর্ষ রূপ বেলা হনন উল্লাসে ক্রমশ আলোক বস্তুকে গিলতে থাকলো বিনয়হীনতায়। আর পরিবেশ থেকে বয়ে আসতে থাকলো দুষ্টচক্রে তাল হারানো নিশ্বাস। এই নিশ্বাস শান্ত আর্তনাদের। কিন্তু এক প্রশস্ত অমঙ্গল চিহ্নের ও এক প্রশস্ত অশুভ সংকেতের।
আমি মতিন স্যারকে পেছন ফেলে পশ্চিম থেকে আরও পশ্চিমে এগিয়ে যেতে থাকলাম সাঁঝ ভাঙার গান গেয়ে ও রাতের শরীর ভেঙে বীরনারীর সন্ধানে। জানি না এই সন্ধানের শেষ হবে কি না, নাকি একের পর এক প্রভুত্ব করে যাবে অনন্তের আহ্বান ও মহাকালের দৈর্ঘ্য...!