alt

অমর একুশে সংখ্যা ২০২৫

পিচফুলের পরশ 

শাহাব আহমেদ

: শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বেনুবাঁশের বাঁশি সে, দক্ষ বাঁশুড়িয়ার ফুঁ পেলেই বেজে উঠবে সুরের কম্পনে।

মনে হতো।

চিকন সিলভার ফ্রেমের যে চশমাটি সে পরতো, তা ছিলো ঠিক ওরই চোখে মানানসই। ওদের দেশের মেয়েরা সচরাচর অত লম্বা হয় না, দেখতেও সুন্দর হয় কম এবং আগে-পরে দেখা অন্য মেয়েদের চেয়ে আমার মনে হয়েছে সে অনেক বেশি সৌষ্ঠবময়, কমনীয় ও মার্জিত।

জিজ্ঞেস করি, “জীবন কেমন?”

“স্বামীর শোকেসের মাছের মতো...” বলে নির্জন হাসে সে। আমার ভাসা ভাসা অগভীর বোধ, তা সত্ত্বেও মনে হলো সহজ প্রশ্নের উত্তরটি সে দিল জটিল করে। কথার প্রবাহ কোনদিকে নিই বুঝতে পারি না, বলি, “তোমার দেশে পিচফুল ফোটে?”

প্রশ্নটা তাৎক্ষণিক। আমি চেরিফুলের কথা বলতে পারতাম, হিজল বা কদমফুল হলেও ক্ষতি ছিলো না, এবং ফুল না হয়ে অন্য কোনো বিষয়ও প্রাসঙ্গিক হতে পারতো, এবং উত্তর ছিল নিতান্তই গৌণ।  

“ফোটে।”

“কখনও দেখিনি, শুনেছি খুব সুন্দর!”

“হ্যাঁ, খুবই।”

কথা এখানেই শেষ হতে পারতো, হলো না, প্রশ্ন করলাম (কেন, ঠিক জানি না, হয়তো ওকে একটা কমপ্লিমেন্ট দেবার ইচ্ছা জেগেছিল)

“তোমার মত, না তোমার চেয়ে?”

হাসে। 

শব্দ করে নয়। সকালে দাপনার বেড়ায় রোদ হাঁটতে হাঁটতে হাসে যেমন।

এপ্রনের নিচে, কাঁচলঢাকা আনন্দ বা দীর্ঘশ্বাসের কোমল পি- যেখানে, সেখান থেকে মধু পান করে তিন বছর বয়েস হয়েছে যে মেয়ের তার ছবি দেখায়। চমৎকার পুতুল, অথবা কে জানে হয়তো পুতুল নয়, সেও পিচ ফুল। 

“ওই বয়সে তুমি দেখতে ঠিক অমনটাই ছিলে, তাই না?”

মুখে হাসির রামধনু খেলে। ওর হাসিটা, বলতেই হয়, যতবার দেখি, মনে হয়, বৈশিষ্ট্যময়, শান্ত এবং অন্য মেয়েরা হাসে ওর থেকে একটু অন্যরকম। ঠিক কেন এমন মনে হয়, আমি জানি না।

মনোযোগ দিয়ে আমার মেয়ের ছবি দেখে, “অবিকল তোমার মতো কিন্তু!”

“হ্যাঁ, সবাই তাই বলে। আমার কিন্তু মনে হয় ওর মায়ের মতো।”

“না, তোমার মুখটাই তো দেখছি।”

“তুমি তো ওর মায়ের মুখ দেখোনি।”

“মেয়েদের সবকিছু দেখতে হয় না, বুঝেছো মিস্টার!”

আমি বুঝি নাই, আমি এমনিতেও বুঝি কম।

কবিতা পড়ি, ভালো লাগে।

“কেন ভালো লাগে?” কেউ প্রশ্ন করলে ভ্যাবাচ্যাকা খাই।

আজব তাই না? শব্দ সাজাতে পারি, সৈকতে শিশুর বালু-ক্যাসল তৈরি করার মতো করে, একটির পাশে আর একটি শব্দ বা ধ্বনি অথচ ভাষা আমার চিন্তার, আমার বোধ বা অনুভূতির কোনো অবয়ব আঁকতে পারে না।  

“তুমি সুখী?”

“হ্যাঁ।”

“সত্যি?”

এই “সত্যি” শব্দটা ওর মুখে আসলে কোনো প্রশ্ন, বিস্ময়, অবিশ্বাস, না দীর্ঘশ্বাস, আমার 

কাছে স্বচ্ছ হয় না।

হাসপাতালের রেসিডেন্সির অন-কলে একসাথে নাইট শিফট করি প্রতি তিনরাত পরপর, আর দিনে প্রতিদিন। রোগীর অভাব নেই, কাজেরও। যারা ভর্তি হয়, চিকিৎসা শুরু করতে হয় অবিলম্বে। রাত ছোট, সকাল হয়ে যায় দ্রুত। ভুল করার সুযোগ নেই, চিকিৎসা শুরু না করা বা প্রটোকল ভাঙার তো নয়ই। মর্নিং রাউন্ডে রিপোর্ট দিতে হয় কার কী চিকিৎসা হয়েছে। এটেন্ডিং ফিজিশিয়ান ও সিনিয়র রেসিডেন্টরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়েফুঁড়ে, অন্ত্র বের করে ধুয়েমুছে, নতুন করে জোরা লাগিয়ে ফ্লোরে পাঠায়।  

আমি স্পাইনাল ট্যাপ করি, ও ধরে। ও আইভি লাইন বসায়, আমি ফিক্স করি। তারপরে সে তার রোগির কেইস হিস্ট্রি লেখে, আমি আমার।

কখনও গুন গুন করি কবিতা। ও হাসে। 

“কী বলছো?”

অনুবাদ করে শুনাই।

“কবিতায় মানুষ কী আনন্দ পায় আমি বুঝি না।”

“আচ্ছা এটা শোনো” লি পো’র কবিতা পড়ি। 

“না, বুঝি না।” তুমি শুকনো রুটির মতো!”

ওর হাসিটা তরল ও ঘোলাটে।

“অনেকে অনেক কিছু পারে, কবিতার আনন্দ আহরণ ছাড়া আমি আর কিছু পারি না।”

“কিন্তু ডাক্তার তুমি ভালো এবং তা আমার প্রশংসা ছাড়াই।” 

ফ্লোরের নার্সগুলো পাতি পাতি হাতি, নড়তে-ফিরতে চায় না, গজ গজ করে, ইন্টার্ন রেসিডেন্টদের অহেতুক হয়রানি করে, এক মুহূর্তও বসতে দেয় না। গুটিসুটি থাকি, ওদের অখুশি করলে বিচার যাবে প্রোগ্রাম ডাইরেক্টরের কাছে এবং সমস্যার হাজার সুতা হাত পা নাড়াবে, নয় কদর্য জিভ দেখাবে।

“শোনো, ওদের ব্যবহারে কষ্ট পাবার কিছু নেই। এটা ওদের এক ধরনের প্রতিশোধ, অবচেতন মনের পিত্তক্ষরণ, মারিয়া চিরকাল মারিয়াই থাকবে, আর বেকি, চিরকাল বেকি। অথচ তুমি আজকের তুচ্ছ ইন্টার্ন ইব্রাহিম

আগামিকাল ডাঃ ইব্রাহিম হবে এবং তাকে তোমার আন্ডারে কাজ করতে হবে।”

আমার চিন্তার অবক্র আলপথ, কথাটা কখনও ওভাবে ভাবিনি, আসলে ভাবতে শিখিনি। কবিতার পাঠ কি আমাকে একটি অসম্পূর্ণ মানুষ বানিয়েছে? আধাচোখ দিয়ে দেখা, আধা মগজ দিয়ে ভাবা, আধা অনুভূতিতে ইতস্তত করা। এবং ভয়, ভয়ে ভয়ে থাকা আমার ব্যবহারে যেন কেউ কষ্ট না পায়, কেউ না ভাবে আমি একটি মন্দ মানুষ, স্যুট-কোট পরা আরজিনা-ইগুয়ানা কোনো।

অথবা আধা বলেই কি আমি এখনও কবিতা পড়ি এবং ভাবি এভাবেই পূর্ণাঙ্গ হবো, এক ও আস্ত, লেজহীন মহামানব কোনো?

দিন-রাতগুলো হাটে, নির্জনে নয়, ত্রস্ত-ব্যস্ত, সন্ত্রস্ত এবং দেয়ালে ঘড়ির লম্বা হাত খর্ব হাতকে তাড়া করে নিয়ে যায়। পাকা বটফলে পাখি ঠোকরায় দূরে কোথাও, গাছের শুকনো পাতা বাতাসে সওয়ার হয় কিন্তু আমাদের বিশ্রাম নেই, ক্লান্তি ও একঘেয়েমির মেঘাচ্ছন্ন নিচু আকাশ। ঘুমে মাথা নুয়ে আসে নেতানো লাউডগার মতো, অথচ ওর হাসিটি হারায় না।

“তুমি এত ঘুমকাতুরে! যাও আধঘণ্টা ঘুমিয়ে নাও, আমি ফ্লোর দেখবো।”

আমার কাজ তার নেয়ার প্রয়োজন নেই, নিজেরই অশেষ। কিন্তু একটু গা না এলালেই নয়। ভাবি এটা আমার প্রাপ্য, ঠিক ওর থেকে নয় কিন্তু আমি পুরুষমানুষ, স্বভাবতই নিস্তেজ ও দুর্বল, আর মেয়েরা, মেয়েরা আসলেই টেকসই। 

ওর যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন মাথা দুলে ওঠে, এবং উইলো লতার মত চুলে চুলে মুখ ঢেকে যায়, 

ও কিন্তু ঘুমাতে যায় না। 

“একটু বিশ্রাম করে আসো, আমি আছি।” -বলি।

“না, আমি ঠিক আছি, তাছাড়া...” হাই তুলতে তুলতে উঠে চোখে মুখে জল ঢেলে আসে। 

“তাছাড়া কী...”, আমি জানি না। প্রশ্ন করিনি, করলে হয়তো বলতো। অবশ্য এটাও আমি নিশ্চিত করে বলি কী করে? মানুষ তো বেফাঁসভাবেই কোনো একটা শব্দ বা বাক্যের ভগ্নাংশ বলে ফেলতে পারে, যার আসলে কোনো চলমানতা বা কন্টিনিউয়েশন নেই, সে হয়তো আসলেই কিছু বলতে চায়নি, অথবা কোনো একটা মুহূর্তে চেয়েছিল, এখন আর চায় না।

“আমার ঘুম আসে না” বলতো কি সে, যদি প্রশ্ন করতাম?

অথবা,

“ঘুমোবার মতো শান্তির ঘর আমার নেই”

অথবা 

“স্বামী আছে কিন্তু ঘুম পাড়িয়ে দেবার মতো সুজন সে নয়।”

ওর ফর্সা দাঁতে চিক চিক করে কর্ম হাসি, দেহে মনোহরণ খলসে মাছের বিজুলির চমক দেখি। কখনও তাকে শীতরাতের উষ্ণ নকশি কাঁথার মতো গায়ে জড়াতে ইচ্ছে হয়?

হয়।

হয় না। 

কনফিউজিং।

চীনে একটা বিশাল দেয়াল আছে এবং সে চীনদেশের নারী। আমার শহরের প্রাচীন কেল্লায়ও একটি দেয়াল আছে, পুরো ও শ্যাওলায় ঢাকা। ভাবি পেছনে ফেলে এসেছি, এসেছি কি?

ম্যামথ বিল্প্তু হয়ে গিয়েছিল কত আগে, ডাইনোসরও। কারণ ওরা নতুনের উঠোনে পুরোনোকে, অভ্যস্তকে, আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু প্রকৃতি তা পছন্দ করেনি। 

ওটা ছিল শনিবারের ভোর। ব্রুকলিন থেকে ৫টায় সাবওয়ে ধরেছি। ডিউটিতে যাবো। ম্যানহ্যাটান পার হয়ে ট্রেন ব্রঙ্কসে প্রবেশ করেছে। দরজার পাশেই সিটে বসে লোর্কার কবিতা পড়ছি, লোকজন খুব একটা নেই। দূরের সিটে বসা একটি লোক এসে দাঁড়ালো দরজার সামনে, বের হয়ে যাবে। যেই দরজাটি খুললো একটা প্রচ- ঘুসি এসে পড়লো আমার চোয়ালে। দিন কালো, রাত কালো, ঈশ্বর কালো ও কালা। কালোর কৃষ্ণগহ্বর! হাতে গাল চেপে, থিতু হয়ে ঘটনাটি আত্মস্থ করার আগেই লোকটি বের হয়ে গেল এবং বন্ধ হয়ে গেল ট্রেনের দরজাটি। ব্যথা পীড়িত স্ফীত মুখ নিয়ে ডিউটিতে এলাম।

“এই কী অবস্থা তোমার! দেখি দেখি, মারামারি করেছো?” -আমার গালে আইসপ্যাক বসাতে বসাতে ওর প্রশ্ন। ওর আঙ্গুলগুলো সরু ও কোমল এবং এতটাই যাদু ও যতেœর স্পর্শময়, সে কি পিয়ানো বাজায়?

“না।”

“কোনো কথা নেই, বার্তা নেই, এমনিতেই মেরে চলে গেল?”

“হ্যাঁ, এমনিতেই!” 

এবং লবণ যেমন দ্রবীভূত হয় জলে, বছরগুলো গলে গেল রেসিডেন্সির ধূসর কারাগারে। মনে হয়েছিল কষ্টের সুদীর্ঘ সময়, এখন বুঝি তা ছিল মাত্র তিন বছর। চশমার ফ্রেমে আলো চিক চিক করে সে আরও একবার প্রশ্নটি করেছিল, “তুমি সুখী?”

বলেছিলাম, “হ্যাঁ।”

উত্তরটি কনফার্ম করেছিল, “সত্যি?”

বাইরে রোদ ঝিঁ ঝিঁ করছে, হাওয়ার ডালে দোল খাচ্ছে দোয়েল পাখি, বুকের মাচার পাশে উইলো লতারা নড়ছে আলুথালু এবং চশমার কাচের আড়ালে দুটো চোখ চেয়ে আছে কার!

আমি লোর্কার কবিতা পড়ছি-

In the branches of the laurel tree

I saw two naked doves

One was the other

and both were none.

tab

অমর একুশে সংখ্যা ২০২৫

পিচফুলের পরশ 

শাহাব আহমেদ

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বেনুবাঁশের বাঁশি সে, দক্ষ বাঁশুড়িয়ার ফুঁ পেলেই বেজে উঠবে সুরের কম্পনে।

মনে হতো।

চিকন সিলভার ফ্রেমের যে চশমাটি সে পরতো, তা ছিলো ঠিক ওরই চোখে মানানসই। ওদের দেশের মেয়েরা সচরাচর অত লম্বা হয় না, দেখতেও সুন্দর হয় কম এবং আগে-পরে দেখা অন্য মেয়েদের চেয়ে আমার মনে হয়েছে সে অনেক বেশি সৌষ্ঠবময়, কমনীয় ও মার্জিত।

জিজ্ঞেস করি, “জীবন কেমন?”

“স্বামীর শোকেসের মাছের মতো...” বলে নির্জন হাসে সে। আমার ভাসা ভাসা অগভীর বোধ, তা সত্ত্বেও মনে হলো সহজ প্রশ্নের উত্তরটি সে দিল জটিল করে। কথার প্রবাহ কোনদিকে নিই বুঝতে পারি না, বলি, “তোমার দেশে পিচফুল ফোটে?”

প্রশ্নটা তাৎক্ষণিক। আমি চেরিফুলের কথা বলতে পারতাম, হিজল বা কদমফুল হলেও ক্ষতি ছিলো না, এবং ফুল না হয়ে অন্য কোনো বিষয়ও প্রাসঙ্গিক হতে পারতো, এবং উত্তর ছিল নিতান্তই গৌণ।  

“ফোটে।”

“কখনও দেখিনি, শুনেছি খুব সুন্দর!”

“হ্যাঁ, খুবই।”

কথা এখানেই শেষ হতে পারতো, হলো না, প্রশ্ন করলাম (কেন, ঠিক জানি না, হয়তো ওকে একটা কমপ্লিমেন্ট দেবার ইচ্ছা জেগেছিল)

“তোমার মত, না তোমার চেয়ে?”

হাসে। 

শব্দ করে নয়। সকালে দাপনার বেড়ায় রোদ হাঁটতে হাঁটতে হাসে যেমন।

এপ্রনের নিচে, কাঁচলঢাকা আনন্দ বা দীর্ঘশ্বাসের কোমল পি- যেখানে, সেখান থেকে মধু পান করে তিন বছর বয়েস হয়েছে যে মেয়ের তার ছবি দেখায়। চমৎকার পুতুল, অথবা কে জানে হয়তো পুতুল নয়, সেও পিচ ফুল। 

“ওই বয়সে তুমি দেখতে ঠিক অমনটাই ছিলে, তাই না?”

মুখে হাসির রামধনু খেলে। ওর হাসিটা, বলতেই হয়, যতবার দেখি, মনে হয়, বৈশিষ্ট্যময়, শান্ত এবং অন্য মেয়েরা হাসে ওর থেকে একটু অন্যরকম। ঠিক কেন এমন মনে হয়, আমি জানি না।

মনোযোগ দিয়ে আমার মেয়ের ছবি দেখে, “অবিকল তোমার মতো কিন্তু!”

“হ্যাঁ, সবাই তাই বলে। আমার কিন্তু মনে হয় ওর মায়ের মতো।”

“না, তোমার মুখটাই তো দেখছি।”

“তুমি তো ওর মায়ের মুখ দেখোনি।”

“মেয়েদের সবকিছু দেখতে হয় না, বুঝেছো মিস্টার!”

আমি বুঝি নাই, আমি এমনিতেও বুঝি কম।

কবিতা পড়ি, ভালো লাগে।

“কেন ভালো লাগে?” কেউ প্রশ্ন করলে ভ্যাবাচ্যাকা খাই।

আজব তাই না? শব্দ সাজাতে পারি, সৈকতে শিশুর বালু-ক্যাসল তৈরি করার মতো করে, একটির পাশে আর একটি শব্দ বা ধ্বনি অথচ ভাষা আমার চিন্তার, আমার বোধ বা অনুভূতির কোনো অবয়ব আঁকতে পারে না।  

“তুমি সুখী?”

“হ্যাঁ।”

“সত্যি?”

এই “সত্যি” শব্দটা ওর মুখে আসলে কোনো প্রশ্ন, বিস্ময়, অবিশ্বাস, না দীর্ঘশ্বাস, আমার 

কাছে স্বচ্ছ হয় না।

হাসপাতালের রেসিডেন্সির অন-কলে একসাথে নাইট শিফট করি প্রতি তিনরাত পরপর, আর দিনে প্রতিদিন। রোগীর অভাব নেই, কাজেরও। যারা ভর্তি হয়, চিকিৎসা শুরু করতে হয় অবিলম্বে। রাত ছোট, সকাল হয়ে যায় দ্রুত। ভুল করার সুযোগ নেই, চিকিৎসা শুরু না করা বা প্রটোকল ভাঙার তো নয়ই। মর্নিং রাউন্ডে রিপোর্ট দিতে হয় কার কী চিকিৎসা হয়েছে। এটেন্ডিং ফিজিশিয়ান ও সিনিয়র রেসিডেন্টরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়েফুঁড়ে, অন্ত্র বের করে ধুয়েমুছে, নতুন করে জোরা লাগিয়ে ফ্লোরে পাঠায়।  

আমি স্পাইনাল ট্যাপ করি, ও ধরে। ও আইভি লাইন বসায়, আমি ফিক্স করি। তারপরে সে তার রোগির কেইস হিস্ট্রি লেখে, আমি আমার।

কখনও গুন গুন করি কবিতা। ও হাসে। 

“কী বলছো?”

অনুবাদ করে শুনাই।

“কবিতায় মানুষ কী আনন্দ পায় আমি বুঝি না।”

“আচ্ছা এটা শোনো” লি পো’র কবিতা পড়ি। 

“না, বুঝি না।” তুমি শুকনো রুটির মতো!”

ওর হাসিটা তরল ও ঘোলাটে।

“অনেকে অনেক কিছু পারে, কবিতার আনন্দ আহরণ ছাড়া আমি আর কিছু পারি না।”

“কিন্তু ডাক্তার তুমি ভালো এবং তা আমার প্রশংসা ছাড়াই।” 

ফ্লোরের নার্সগুলো পাতি পাতি হাতি, নড়তে-ফিরতে চায় না, গজ গজ করে, ইন্টার্ন রেসিডেন্টদের অহেতুক হয়রানি করে, এক মুহূর্তও বসতে দেয় না। গুটিসুটি থাকি, ওদের অখুশি করলে বিচার যাবে প্রোগ্রাম ডাইরেক্টরের কাছে এবং সমস্যার হাজার সুতা হাত পা নাড়াবে, নয় কদর্য জিভ দেখাবে।

“শোনো, ওদের ব্যবহারে কষ্ট পাবার কিছু নেই। এটা ওদের এক ধরনের প্রতিশোধ, অবচেতন মনের পিত্তক্ষরণ, মারিয়া চিরকাল মারিয়াই থাকবে, আর বেকি, চিরকাল বেকি। অথচ তুমি আজকের তুচ্ছ ইন্টার্ন ইব্রাহিম

আগামিকাল ডাঃ ইব্রাহিম হবে এবং তাকে তোমার আন্ডারে কাজ করতে হবে।”

আমার চিন্তার অবক্র আলপথ, কথাটা কখনও ওভাবে ভাবিনি, আসলে ভাবতে শিখিনি। কবিতার পাঠ কি আমাকে একটি অসম্পূর্ণ মানুষ বানিয়েছে? আধাচোখ দিয়ে দেখা, আধা মগজ দিয়ে ভাবা, আধা অনুভূতিতে ইতস্তত করা। এবং ভয়, ভয়ে ভয়ে থাকা আমার ব্যবহারে যেন কেউ কষ্ট না পায়, কেউ না ভাবে আমি একটি মন্দ মানুষ, স্যুট-কোট পরা আরজিনা-ইগুয়ানা কোনো।

অথবা আধা বলেই কি আমি এখনও কবিতা পড়ি এবং ভাবি এভাবেই পূর্ণাঙ্গ হবো, এক ও আস্ত, লেজহীন মহামানব কোনো?

দিন-রাতগুলো হাটে, নির্জনে নয়, ত্রস্ত-ব্যস্ত, সন্ত্রস্ত এবং দেয়ালে ঘড়ির লম্বা হাত খর্ব হাতকে তাড়া করে নিয়ে যায়। পাকা বটফলে পাখি ঠোকরায় দূরে কোথাও, গাছের শুকনো পাতা বাতাসে সওয়ার হয় কিন্তু আমাদের বিশ্রাম নেই, ক্লান্তি ও একঘেয়েমির মেঘাচ্ছন্ন নিচু আকাশ। ঘুমে মাথা নুয়ে আসে নেতানো লাউডগার মতো, অথচ ওর হাসিটি হারায় না।

“তুমি এত ঘুমকাতুরে! যাও আধঘণ্টা ঘুমিয়ে নাও, আমি ফ্লোর দেখবো।”

আমার কাজ তার নেয়ার প্রয়োজন নেই, নিজেরই অশেষ। কিন্তু একটু গা না এলালেই নয়। ভাবি এটা আমার প্রাপ্য, ঠিক ওর থেকে নয় কিন্তু আমি পুরুষমানুষ, স্বভাবতই নিস্তেজ ও দুর্বল, আর মেয়েরা, মেয়েরা আসলেই টেকসই। 

ওর যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন মাথা দুলে ওঠে, এবং উইলো লতার মত চুলে চুলে মুখ ঢেকে যায়, 

ও কিন্তু ঘুমাতে যায় না। 

“একটু বিশ্রাম করে আসো, আমি আছি।” -বলি।

“না, আমি ঠিক আছি, তাছাড়া...” হাই তুলতে তুলতে উঠে চোখে মুখে জল ঢেলে আসে। 

“তাছাড়া কী...”, আমি জানি না। প্রশ্ন করিনি, করলে হয়তো বলতো। অবশ্য এটাও আমি নিশ্চিত করে বলি কী করে? মানুষ তো বেফাঁসভাবেই কোনো একটা শব্দ বা বাক্যের ভগ্নাংশ বলে ফেলতে পারে, যার আসলে কোনো চলমানতা বা কন্টিনিউয়েশন নেই, সে হয়তো আসলেই কিছু বলতে চায়নি, অথবা কোনো একটা মুহূর্তে চেয়েছিল, এখন আর চায় না।

“আমার ঘুম আসে না” বলতো কি সে, যদি প্রশ্ন করতাম?

অথবা,

“ঘুমোবার মতো শান্তির ঘর আমার নেই”

অথবা 

“স্বামী আছে কিন্তু ঘুম পাড়িয়ে দেবার মতো সুজন সে নয়।”

ওর ফর্সা দাঁতে চিক চিক করে কর্ম হাসি, দেহে মনোহরণ খলসে মাছের বিজুলির চমক দেখি। কখনও তাকে শীতরাতের উষ্ণ নকশি কাঁথার মতো গায়ে জড়াতে ইচ্ছে হয়?

হয়।

হয় না। 

কনফিউজিং।

চীনে একটা বিশাল দেয়াল আছে এবং সে চীনদেশের নারী। আমার শহরের প্রাচীন কেল্লায়ও একটি দেয়াল আছে, পুরো ও শ্যাওলায় ঢাকা। ভাবি পেছনে ফেলে এসেছি, এসেছি কি?

ম্যামথ বিল্প্তু হয়ে গিয়েছিল কত আগে, ডাইনোসরও। কারণ ওরা নতুনের উঠোনে পুরোনোকে, অভ্যস্তকে, আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু প্রকৃতি তা পছন্দ করেনি। 

ওটা ছিল শনিবারের ভোর। ব্রুকলিন থেকে ৫টায় সাবওয়ে ধরেছি। ডিউটিতে যাবো। ম্যানহ্যাটান পার হয়ে ট্রেন ব্রঙ্কসে প্রবেশ করেছে। দরজার পাশেই সিটে বসে লোর্কার কবিতা পড়ছি, লোকজন খুব একটা নেই। দূরের সিটে বসা একটি লোক এসে দাঁড়ালো দরজার সামনে, বের হয়ে যাবে। যেই দরজাটি খুললো একটা প্রচ- ঘুসি এসে পড়লো আমার চোয়ালে। দিন কালো, রাত কালো, ঈশ্বর কালো ও কালা। কালোর কৃষ্ণগহ্বর! হাতে গাল চেপে, থিতু হয়ে ঘটনাটি আত্মস্থ করার আগেই লোকটি বের হয়ে গেল এবং বন্ধ হয়ে গেল ট্রেনের দরজাটি। ব্যথা পীড়িত স্ফীত মুখ নিয়ে ডিউটিতে এলাম।

“এই কী অবস্থা তোমার! দেখি দেখি, মারামারি করেছো?” -আমার গালে আইসপ্যাক বসাতে বসাতে ওর প্রশ্ন। ওর আঙ্গুলগুলো সরু ও কোমল এবং এতটাই যাদু ও যতেœর স্পর্শময়, সে কি পিয়ানো বাজায়?

“না।”

“কোনো কথা নেই, বার্তা নেই, এমনিতেই মেরে চলে গেল?”

“হ্যাঁ, এমনিতেই!” 

এবং লবণ যেমন দ্রবীভূত হয় জলে, বছরগুলো গলে গেল রেসিডেন্সির ধূসর কারাগারে। মনে হয়েছিল কষ্টের সুদীর্ঘ সময়, এখন বুঝি তা ছিল মাত্র তিন বছর। চশমার ফ্রেমে আলো চিক চিক করে সে আরও একবার প্রশ্নটি করেছিল, “তুমি সুখী?”

বলেছিলাম, “হ্যাঁ।”

উত্তরটি কনফার্ম করেছিল, “সত্যি?”

বাইরে রোদ ঝিঁ ঝিঁ করছে, হাওয়ার ডালে দোল খাচ্ছে দোয়েল পাখি, বুকের মাচার পাশে উইলো লতারা নড়ছে আলুথালু এবং চশমার কাচের আড়ালে দুটো চোখ চেয়ে আছে কার!

আমি লোর্কার কবিতা পড়ছি-

In the branches of the laurel tree

I saw two naked doves

One was the other

and both were none.

back to top