alt

ঈদ সংখ্যা ২০২১

ঈদ সংখ্যা ২০২১: কবিতা

: সোমবার, ১০ মে ২০২১

শিল্পী : সমর মজুমদার

হাওয়ার হাহাকার

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

মৃত্যুর ভয়ের মতো বুর্জোয়া আর কিছু না।

ঈশ্বর তো তার ছুটিরদিন কাটাতে প্যারিসে যান

ঈশ্বরের আনন্দ দরকার,

আমি তার হাত ধরে ছুটি কাটাই

মৃত্যুর দিকে রওয়ানা দিয়ে,

মৃত্যুর মতো বুর্জোয়া আর কিছু না

হাওয়ার হাহাকার আমার চারপাশে।

বয়স

হাবীবুল্লাহ সিরাজী

এক ফাঁকে হাওয়া সতেরো আঠারো

এক ছোঁয়াতে উনিশ

বেলা অবেলায় ভাঁপ-ওঠা মেঘে

চিল-চঞ্চুতে শিস্

এক সন্ধ্যার কুড়ি-ভাঙা ছাদে

এক আলস্যে ঢল

তারার আড়ালে ঘুমের গন্ধে

দুফোঁটা চোখের জল

এক ভালোবাসা ওষ্ঠে-কপালে

এক নামে ওড়ো খই

একুশে বাইশে আগুনের গুণে

না পাতানো জোড়া সই

পঁচিশের বাকি আরো দুই দাগ

তেইশের ভেজা তুলো

বসন্তবেলা ফাঁকি দেবে বলে

চব্বিশে মাখে ধুলো

মায়াজোনাকি

শিহাব সরকার

লণ্ঠন নিভুনিভু, চারিদিক নিকষ কালো

বাতিঘর ধসে যায়, সুনামি উত্তাল

ঝড়বৃষ্টির পর আকাশে হরর ছবি

পিশাচের ওড়াউড়ি দেখে বালিকা নীল।

ভেলা ডুবে গেলো গহীন দরিয়ায়

জলকেলির উৎসব থামে না,

নিঝুম সৈকতে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে আসে

মৃত শিশু, রঙিন টুপি, পুতুল।

ধূলিঝড়ে তছনছ বেদুঈন তাঁবু

মরুনারীর বিলাপে রক্তাক্ত হয় কুয়োতলা

সব মরূদ্যান একদিন বালুতলে যাবে?

দ্যাখো, পিছুপিছু কারা আসে

সাবধানে হাঁটো, সামনে ফাঁদ, মৃত্যুকূপ

দানবেরা ওঁৎ পেতে আছে, রক্ত খায়

পিপাসা মিটবে না কোনোদিন

কী অন্ধকার সমতলে, পাহাড়ে, সমুদ্রপারে

তমসার নাভিমূল থেকে অন্ধকার কুঠুরিতে

শিখা জ্বলে, তারপর আঙিনায়।

অচেনা তেপান্তরে রাত্রির মায়াজোনাকি

শরণার্থী জল খোঁজে হ্রদের মরীচিকায়।

হেমাঙ্গ বিশ্বাস

মুনীর সিরাজ

যদি কেউ আজীবন গেয়ে থাকে জীবনের গান

যদি কেউ শুনে থাকে মৃত্তিকায় অঙ্কুরিত উষ্ণ কলতান

যদি কেউ চেয়ে থাকে মানুষের সমূহ কল্যাণ

যদি কেউ ভেবে থাকে এ জীবনে মানুষই মহান

যদি কারো কথা-সুরে ডেকে থাকে জীবনের বান

যদি কারো বাণী জানি রয়ে যাবে চির অম্লান

যদি কেউ গেয়ে থাকে জীবনের উজ্জীবিত গান

যদি কেউ দেখে থাকে মানুষের উচ্চকিত প্রাণ

যদি কারো কণ্ঠস্বর ঝরনায় করা গেছে শুদ্ধচিতস্নান

যদি কারো বাণী শুনে পাওয়া গেছে যুদ্ধের নিদান

যদি কারো জীবনের স্বপ্নে ছিল আলো অনির্বাণ

যদি কারো ক্ষুব্ধ চিতে জীবনের ছিল আহ্বান

যদি কারো হৃদয়ের খরস্রোতা জলে ছিল প্রবাহ উজান

যদি কারো বিরুদ্ধ বাতাসে তবু ছিল বুক ধনুকের মতো টান টান

যদি কেউ অশনি সংকেত জেনেও নিয়েছিল ফুলের আঘ্রান

তেমনি সাহসী কেউ কণ্ঠে ছিল মানুষের জীবন-আখ্যান

তেমনি সাহসী কেউ দুই হাতে উড়িয়েছে বিজয় নিশান

আকাক্সক্ষার সমস্ত ফুল তাঁকে আমি আজ করি দান।

তার আগে জলে ডোবে সেতু

সরকার মাসুদ

ওপরে দাঁড়ালে নৌকা ভাসমান

ব্যস্ত বাতাস সংবাদ পৌঁছে দেবে

দূরের বাগানে, ঝাউবনে

যে শুয়ে আছে অন্ধকার সাথে নিয়ে তাকে!

ওপরে তাকালে পাখি পলাতক

মেঘের ইচ্ছে বুঝি নিঃসঙ্গ মানুষের মনে

রুয়ে দেবে শিলাবৃষ্টি, বনের বেদনা!

নূপুরের শব্দে ভাঙা ছলকুয়াশায়

কেন দেখি দ্বিধাপাত!

আশা ভেসে যায় জলে

আলো পায় ছায়ার আঘাত!

ওপরে দাঁড়ালে আর কোনো ছবি নেই

যে শুয়ে রয়েছে ফল বাগানের আশা-তমশায়

মন চায় তার কাছে চলে যাবে

এক্সপ্রেস বাতাসের মতো

কিন্তু তার আগে জলে ডোবে সেতু!

অজ্ঞাত দিন-রাত্রি

হাইকেল হাশমী

ইদানীং দিনগুলো যে কতো অজ্ঞাত

সূর্য দিগন্তের দেয়াল ধরে ধরে

খোঁড়া মানুষের মতো অন্য দিগন্তে চলে যায়

লোকজন কিছুই টের পায় না।

আলো অচেনা পথিকের মতো

আকাশের অপরিচিত পথ ধরে

মাটিতে নামে খুব নিঃশব্দে

কেউ টের পায় না।

ইদানীং এই অচেনা দিনগুলো

আসে আর যায়

কোনো কোলাহল নাই।

রাত নামবিহীন পর্যটকের মতো নামে

এখন তারাগুলো আকাশে কোনো ছবি আঁকে না

মৌসুম নীরবে বদলে যায়

কখন যে বসন্ত আসে আর কখন যে শীত যায়

কিছুই টের পাওয়া যায় না।

শুধু খবরের শিরোনাম দেখি

গতকাল আক্রান্ত এতো জন

মৃতের সংখ্যা এতো,

মানুষ এখন কেবলি সংখ্যা

অজ্ঞাত সংখ্যা প্রতিদিন।

কাক ও কবির কাজ

চয়ন শায়েরী

কাক নিয়ে কত গবেষণা-কাক আর কবি নাকি গুনে শেষ করা যায় নাই-কাকেরা কর্কশ কণ্ঠে কথা বলে, কাক কালো-আরও কত কী!

তোমরা যখন ম্যাজিক দেখাও-কালো টাকা সাদা করে ফেলো, আইনের মারপ্যাঁচে ফেলে-তখন তো মনে হয় কাকের কালো রং বেশ ভালো-

তোমাদের মতো করে রং পাল্টায় না ভোল পালটায় না কাক;

কী অবাক

কা- দেখো দেখি-মাতুয়াইলের ময়লার ভাগাড়টা কেন্দ্র করে কতগুলো কাক ঘুরঘুর করে, বলো দেখি গুনে? ওখানে ঘণ্টায় যে চার হাজার কেজি মিথেন গ্যাস আকাশে উঠছে আগ্রাসন চালাতে-উষ্ণায়ন আগ্রাসন-মিথেনের মেঘ কি আরও বাড়ত না কাকেরা ভাগাড়ে ভাগ না বসালে?

যত দোষ কাক আর কবিদের-অথচ অন্যরা দেশটাকে আস্ত একটা ভাগাড়ে পরিণত করেই ছাড়ল!

কাক ভাগাড়ের ময়লা কমায়-তাই মিথেনের মেঘ খানিকটা হলেও কমছে, আর কবি মনের ময়লা পরিষ্কার করে করে নান্দনিক বাগানের পরিচর্যা করছে তোমার মনের ঘিঞ্জি গলিপথে;

কাক ও কবি গুনে শেষ করতে পারো না-আগে তুমি কী পরিমাণ বর্জ্য তৈরি করছ-বাইরে ও হৃদয়ে-তা তা গুনে দেখো!

বোরো-কন্যা

হাসান কল্লোল

বৃষ্টিতে ভিজে গেল আজ এই রাত!

এই রাত ভেজা দেহে থাকবে শুয়ে হাওরের

বিশাল হলুদ ধানের উপর!

কিছু পোষাপ্রাণি শৃঙ্খল ছিঁড়ে সিক্ত

ঘাটে নদীর নীল নাবিকের কাছে তবু

যেতে চায়!

নাবিকের চোখ চঞ্চল গ্রামের পোড়োবাড়িতে অপেক্ষমাণ

প্রিয় বেড়ালের জন্য- ওর চিনামাটির পাত্রের

শাদা দুধ বুঝি ভেসে গেছে এই বিপুল বৃষ্টিতে!!

আমাদের হাওড়ের কতিপয় কৃষক সকালের

ঝকঝকে সূর্যের অপেক্ষায়:

বেশী বৃষ্টিতে- ঢলে যেন নষ্ট না হয়

পুরুষ্ট যৌবনা তার বোরো-কন্যা!

বৃষ্টি হোক, বৃষ্টি ভেজাক তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের উঠোন।

লাবণ্যময় নতচোখের প্রার্থনা:

অতিমারীর অতিবৃষ্টিতে কোনো শস্যের স্বপ্ন

যেন আমাদের ভেসে না যায়-

এবারে অনিশ্চিত জীবনের হাওর যে

বোরো ধানের সবুজ-সমুদ্রে ভাসছে!

এসো বৃষ্টি

এসো আউশের সখা

অল্প অল্প করে ভেজাও নারীর মতো

আমাদের সমৃদ্ধির বাসন।

ময়লার ঝুড়ি

গোলাম কিবরিয়া পিনু

তিন হাত দূরে ময়লার ঝুড়ি- থাকার পরও

হাতের ময়লা পায়ের কাছে ফেলে রেখে

-পা সরিয়ে হাঁটা শুরু!

গুরু তুমি কে? কী শিখাচ্ছো?

ইচ্ছেমত ময়লা যত্রতত্র ফেলতে হয়!

ময়লার ঝুড়িটা দেখার পরও-

ময়লাটুকু ফেললে না ময়লার ঝুড়িতে?

হাতের ময়লা হাতে নিয়ে

বাইরেও ফেলতে পারতে?

পরিষ্কার ঘরেই তোমার হাতের ময়লাটুকু-

ফেলে রেখে গেলে!

আশেপাশের লোকও দেখলো,

মনে করেছো- কেউ তাকিয়ে নেই!

কারও চোখ নেই তোমার ওপর?

সামান্য ময়লা ফেলার সামান্য কা-জ্ঞান নেই?

এ কারণে ময়লার স্তূপ আরও চতুর্দিক!

জানালা

জলিল আহমেদ

সে কথা এখন থাক

তুমি বলো আছোটি কেমন- এই করোনা কালে?

নারকেল গাছটি ঘেঁষে যে জানালা রয়েছে দাঁড়িয়ে

সেখানে চাঁদ ও রোদ অনায়াসে ভাসে

জীবনের পরিসরনামা জানালা জহানে না,

কষ্ট ও সুখ নিয়ে যে আকাশ প্রতিদিনই মাথা উঁচু করে

তাহারই পরনে শাড়ি বিধবার বেশ ধরে থাকে।

পাখি ওড়ে, পতাকাও পত্ পত্ করে

ঘুড়ি টেনে শিশুদের বাস-মেঘের আড়ালে যদি লুকোয় কখনও...

ভীষণ রোদ্দুর থেকে নেমে আসে নীলের পালক।

আমি জানি- জানালাটা বন্ধ হলে

আকাশটা লেগে থাকে দু’চোখের কাঁচে।

যে ঘাস মাঠটা

দিলীপ কির্ত্তুনিয়া

ছোটবেলায় যে ঘাস মাঠটা দেখেছিলাম

তা এখনো আছে।

অথচ উদ্ভিদ বিদ্যার হিসাব করলে

সেই ঘাসগুলি আর থাকার কথা নয়।

ছোটবেলা থেকে যে আকাশটা দেখেছি

কখনও মেঘের রঙ

কখনও শূন্য নীল

মেঘ ঝরে গিয়ে অঝোর ধারা বৃষ্টি

তা এখনো আছে।

অথচ আকাশ বিদ্যার অভিজ্ঞতা খুললে

বোঝা যায়-

সেই মেঘগুলি আর নেই।

আকাশের আর থাকা না থাকা

সে নিজেই যখন কিছু না।

এইসব থাকার ভেতর

বেজে ওঠে চিরন্তনী।

কোনো দিন ফুরোবে না

ঘাস কিংবা আকাশ।

বিস্মৃত

ইমাম হোসাইন

ছাব্বিশ বছর আমার ঈদ উদযাপন হয় না।

তারপরও প্রতীক্ষায় গুনেছি এতগুলি বছর।

কালামিয়ার আত্মনিধন, ইদ্রিছ মৌলভীর গৃহত্যাগ

কোনোটিই আমি ভুলিনি।

অবৈধ ফতোয়ার বলি রাবেয়া বিবি গেলেন কবরে,

অভিমান আর বার দোররার যাতনা নিয়ে,

খুঁড়লে পাওয়া যাবে তার হাড়, কঙ্কাল কিংবা সত্য সন্ধান

দৃষ্টিতে মিলবে তৈলমাখা মুখ কিংবা কৃষ্ণকায় চোখ।

পাশের বাড়ির পাকনা বশর?

না, কেউ আজ তাকে ঠাট্টা করে না।

এখন ন্যুজপীঠ দেহখানা নিয়ে বসে থাকে টং ঘরে।

সে এখন অন্ধ, বধির। যাকাত, ফেতরা যার সম্বল।

দাসের হাটের চড়কমেলা, বড় বাড়ির হরি কীর্ত্তন

সবই আমার কাছে বিস্মৃত।

সুরেশের চায়ের দোকান, ঘোষ বাড়ির দুধ-ঘি-দই

সবই আমার কাছে বিস্মৃত।

দক্ষিণের চর, তারপর নবিউল্লার দোকান। বর্ষায়

ঢেউয়ের খেলায় মিলত মাছ, শামুক-ঝিনুকের সন্ধান।

এক দৃষ্টিতে দেখা মিলত সাপ-মাছের আদিম যুদ্ধ।

সাদা ফেনিলের আয়োজনে নতুন সৈকত।

একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে রিং বাঁধের দেখা।

দেখলাম নতুন পৃথিবী, যোগ হলো দিদৃক্ষার মানচিত্র।

বাহিরের চর, ভেতরের চর কিংবা উত্তর চর।

সবই আজ উঁচু দালান যুদ্ধে হার মেনে উধাও।

শীতে, বসন্তে কিংবা গ্রীষ্মে কালা মিয়ার সন্ন্যাসী বৃত্তি,

দরবেশের চরের হক মাওলা- মর্মভেদী ডাক

মাঝ রাতে মৃদু বায়ের সনে নূরু মিয়ার বাঁশি।

বালু পাথরের চরে এখন ভাসে তাদের বিরহি সুর।

তোমরা সবই উড়িয়ে দিয়েছ, যেমনি মানচিত্র থেকে

বিস্মৃত করেছ বামনী আর সন্দ্বীপ নদী।

যাদের কল্যাণে তোমাদের আজ ইটের নগর,

পেছনে ফেলে এসেছ দরিয়া নগর- তালমন্ধের হাট।

সেসব বিস্মৃত। দালান আর দালান।

নতুন ইটালি মার্কেট, জিরো পয়েন্ট, হাজী পাড়া।

কোনো উদযাপন আজ আর কবির সয় না।

রিক্ত হস্তে বিদায় ছাব্বিশ চাঁদের ঈদ।

তুমি এসছো তোমাকে বলি

শ্যামল নাথ

আমায় ঘরে রেখে কার ঘর গড়ো আর ভাঙো তুমি

তুমি এসছো তোমাকে বলি

আমাকে তুলে নিয়ে তুমি ছুড়ে ফেলো সমাজের জঞ্জাল

আমি চাই তুমি ঘুম ভেঙে দাও

যাতে আর কোনোদিন ঘুমোতে না পারি,

হাত দু’খানি মেলে তুমি বাতাসের সঙ্গে হাসছো

তুমি এসেছো তোমাকে বলি

যে কথা বলিনি সেকথা এবার বলি

নেমেছে সন্ধ্যা, পৃথিবীর যত ভুল, আঙুলে এঁকেছি ফাল্গুন।

তুচ্ছ সবই এপার ওপার,

সকাল সাঁঝে তোমাকে ঘিরে জড়িয়ে রাখি

বেসুরো কথা কিবা দীর্ঘ নীবরতা

তুমি এসেছো তোমাকে বলি,

আমার ছিল মুখর শহর, তোমার সুবিশাল পরিপাটি গ্রাম

আজ কোথাও কেউ নেই,

আমার তুমুল ভুলগুলি, তোমার ভীষণ অসুখ

তুমি এসেছো তোমাকে বলি।

বিম্বিত ধোঁয়াশা- বুঝে যাচ্ছি

মাসুদ মুস্তাফিজ

কৃষ্ণচূড়োর তলায় চিন্তাবিশ্বাস চুরি করছি

পাতার মুহূর্ত ফাঁস হয়ে যায়-

সাপের চোখে জীবনের মুদ্রা নাচে রঙিন বসন্তবেলায়

যে স্বপন আর বর্ণমালার আত্মীয়তায় তোমাকে অনুভব করি এ্যাক

অলীক অনিবার্য ক্ষরণে, আকাশের অসীম হাওয়াঘরে

আমরা উদ্যাপন করি প্রগলভ অভিমানী উৎসব-

যখন তুমি বুঝে যাচ্ছো রোদ ও ফুলের ব্যাকুলতা কিংবা স্মৃতিচিহ্নের

জটিলতা সেই নতুন রোদবৃষ্টি সেই পুরাতন সময় আর বোধম্বিত

মেঘের আলাপনে বোধের ভ্রমণ চিন্তার যাপনসমূহ

সরে যাচ্ছে- দূরে যাচ্ছে আমাদের সত্তার মানবিক ধৃষ্টতা নিয়ে

অবশ্য-

এইসব নালায়েক চুরির ভাষা আর গড়চুমুর কথা কেউ

শুনতে পাবেন না- একান্তই নিজস্ব ব্যাপার

গাছেদের মাতৃভাষা জানা নেই

বীথি রহমান

গাছেদের সাথে কী ভাষায় কথা বলতে হয় জানি না

জানা থাকলে অন্তত এক ওয়াক্ত তাদের সাথে প্রার্থনায় দাঁড়াতাম

তারা কী ভাষায় এবাদতে মশগুল হয়

সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায় কী বলে

এক কাতারে দাঁড়িয়ে আমিও তাদের শরিক হতাম

অন্ধকার কানাগলির মানুষেরা- খুন করতে করতে

মরণ নেশা মাথায় চেপেছে

এই যে আজ বাতাসের কৌটা হাতে ছুটতে হচ্ছে

জীবন ঝুলে আছে মৃত্যুর শক লাগা তারে

তবু খুনের নেশা ছুটছে না

মারণাস্ত্র হাতে তাই নিজের পায়েই দিচ্ছে কুড়াল

যদি মাটির কোরকে আর নতুন প্রাণ না গজায়

যদি পৃথিবীর কোলে দাঁড়িয়ে আক্রোশে-প্রতিবাদে

সমবেতভাবে গাছেরা আত্মাহুতি দেয়

নির্লজ্জ দু’পায়া মানুষ, এমন দুর্দিনে কী করে বেঁচে থাকবে?

আমি আজ ভীষণ ভীষণ ভয়ার্ত

গাছেদের মাতৃভাষা জানা আছে কারও?

ওদের খেয়ে-পরে, ওদেরই কেটে দিচ্ছি গোড়া

এ কৃতঘ্নতার বিচার কী ভাষায় দিচ্ছে ওরা?

দুলের দোলন ইশতেহার

রিসতিয়াক আহমেদ

তোমার জন্য দুল বানাতে দিয়েই দেখলাম

দুলের সমস্ত দোলন ইশতেহার

খাঁটি সোনাকেও কীভাবে

সেকরার হাতে পড়ে

মিশে যেতে হয় খাদের সাথে

এমনকি দুলে যে মৎস্য-প্রতিকৃতি

সেখানে অবিকল মানুষের মতো

বত্রিশ দন্তবাহার

তার মানে কি মাছবাজারে সকল

মাছেরা সন্তরণ ভাষাহীন

আর গালসী বেয়ে চোখের কোণ ঘেঁষে

কানকো পর্যন্ত যে তির্যক রেখা

তা কি আজকের ট্যাটু ফ্যাশানের আদিমাতা

পিতার তাঁর কন্যার সতিচ্ছেদের সাথে

হাঁড়-মাংস বাঁচানোর সেই আত্মঘাতি পদ্ধতি

ফলত বীর্যবান হয়েও কাপুরুষের

খেতাব নিয়ে নির্বীজদের জলসায়

বীর্যের স্ফুরণ প্রদর্শন

কিন্তু এবার প্রকাশ্যে সগর্বে

তোমার কালাচান কপালের কাটা দাগে

চুমু খেয়ে চিৎকার করে বলি- ভালোবাসি

অভিঘাত

মাসুদ চয়ন

নির্জন রাতে নিঃসঙ্গ আঁধারে ভেসে ওঠে অপ্রাপ্তির অভিযোগগুলো,

মনে হচ্ছে ব্ল্যাকহোলের পথে সম্প্রসারিত হচ্ছি লীনের ক্ষয়িষ্ণু তত্ত্বে;

স্মৃতিরাও জ্বলে গেছে গ্লানিদাহ্যের অভিসারে-

সময় রহস্যে উজ্জ্বল রেণু হয়ে ফুটতে চায় হিমশীতল স্বপ্নগুলো;

সঙ্গমস্নিগ্ধ ছায়ার সান্নিধ্য পেতে চায় অনাথ পক্ষের অস্তমিত সূর্যশালু;

কালবোশেখীর বিনির্গত ঢেউ অঙ্কিত হচ্ছে স্পর্শে স্পন্দনে হৃদয় প্রান্তরে-

অনাদিকাল নিগৃহীত নক্ষত্রের পাঁজরে প্রতিকূল সাঁতরে না পেরোবার ব্যথা!

তবুও বেঁচে থাকা নীল অন্তরীক্ষের বিশালতায়-

এক চিলতে এ্যাটমিক অস্তিত্বের নিভৃতচারী পথ চলায়,

অবক্ষয়ের শৈত্যশীর্ণ কোলাজ বিস্তৃত হচ্ছে;

tab

ঈদ সংখ্যা ২০২১

ঈদ সংখ্যা ২০২১: কবিতা

শিল্পী : সমর মজুমদার

সোমবার, ১০ মে ২০২১

হাওয়ার হাহাকার

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

মৃত্যুর ভয়ের মতো বুর্জোয়া আর কিছু না।

ঈশ্বর তো তার ছুটিরদিন কাটাতে প্যারিসে যান

ঈশ্বরের আনন্দ দরকার,

আমি তার হাত ধরে ছুটি কাটাই

মৃত্যুর দিকে রওয়ানা দিয়ে,

মৃত্যুর মতো বুর্জোয়া আর কিছু না

হাওয়ার হাহাকার আমার চারপাশে।

বয়স

হাবীবুল্লাহ সিরাজী

এক ফাঁকে হাওয়া সতেরো আঠারো

এক ছোঁয়াতে উনিশ

বেলা অবেলায় ভাঁপ-ওঠা মেঘে

চিল-চঞ্চুতে শিস্

এক সন্ধ্যার কুড়ি-ভাঙা ছাদে

এক আলস্যে ঢল

তারার আড়ালে ঘুমের গন্ধে

দুফোঁটা চোখের জল

এক ভালোবাসা ওষ্ঠে-কপালে

এক নামে ওড়ো খই

একুশে বাইশে আগুনের গুণে

না পাতানো জোড়া সই

পঁচিশের বাকি আরো দুই দাগ

তেইশের ভেজা তুলো

বসন্তবেলা ফাঁকি দেবে বলে

চব্বিশে মাখে ধুলো

মায়াজোনাকি

শিহাব সরকার

লণ্ঠন নিভুনিভু, চারিদিক নিকষ কালো

বাতিঘর ধসে যায়, সুনামি উত্তাল

ঝড়বৃষ্টির পর আকাশে হরর ছবি

পিশাচের ওড়াউড়ি দেখে বালিকা নীল।

ভেলা ডুবে গেলো গহীন দরিয়ায়

জলকেলির উৎসব থামে না,

নিঝুম সৈকতে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে আসে

মৃত শিশু, রঙিন টুপি, পুতুল।

ধূলিঝড়ে তছনছ বেদুঈন তাঁবু

মরুনারীর বিলাপে রক্তাক্ত হয় কুয়োতলা

সব মরূদ্যান একদিন বালুতলে যাবে?

দ্যাখো, পিছুপিছু কারা আসে

সাবধানে হাঁটো, সামনে ফাঁদ, মৃত্যুকূপ

দানবেরা ওঁৎ পেতে আছে, রক্ত খায়

পিপাসা মিটবে না কোনোদিন

কী অন্ধকার সমতলে, পাহাড়ে, সমুদ্রপারে

তমসার নাভিমূল থেকে অন্ধকার কুঠুরিতে

শিখা জ্বলে, তারপর আঙিনায়।

অচেনা তেপান্তরে রাত্রির মায়াজোনাকি

শরণার্থী জল খোঁজে হ্রদের মরীচিকায়।

হেমাঙ্গ বিশ্বাস

মুনীর সিরাজ

যদি কেউ আজীবন গেয়ে থাকে জীবনের গান

যদি কেউ শুনে থাকে মৃত্তিকায় অঙ্কুরিত উষ্ণ কলতান

যদি কেউ চেয়ে থাকে মানুষের সমূহ কল্যাণ

যদি কেউ ভেবে থাকে এ জীবনে মানুষই মহান

যদি কারো কথা-সুরে ডেকে থাকে জীবনের বান

যদি কারো বাণী জানি রয়ে যাবে চির অম্লান

যদি কেউ গেয়ে থাকে জীবনের উজ্জীবিত গান

যদি কেউ দেখে থাকে মানুষের উচ্চকিত প্রাণ

যদি কারো কণ্ঠস্বর ঝরনায় করা গেছে শুদ্ধচিতস্নান

যদি কারো বাণী শুনে পাওয়া গেছে যুদ্ধের নিদান

যদি কারো জীবনের স্বপ্নে ছিল আলো অনির্বাণ

যদি কারো ক্ষুব্ধ চিতে জীবনের ছিল আহ্বান

যদি কারো হৃদয়ের খরস্রোতা জলে ছিল প্রবাহ উজান

যদি কারো বিরুদ্ধ বাতাসে তবু ছিল বুক ধনুকের মতো টান টান

যদি কেউ অশনি সংকেত জেনেও নিয়েছিল ফুলের আঘ্রান

তেমনি সাহসী কেউ কণ্ঠে ছিল মানুষের জীবন-আখ্যান

তেমনি সাহসী কেউ দুই হাতে উড়িয়েছে বিজয় নিশান

আকাক্সক্ষার সমস্ত ফুল তাঁকে আমি আজ করি দান।

তার আগে জলে ডোবে সেতু

সরকার মাসুদ

ওপরে দাঁড়ালে নৌকা ভাসমান

ব্যস্ত বাতাস সংবাদ পৌঁছে দেবে

দূরের বাগানে, ঝাউবনে

যে শুয়ে আছে অন্ধকার সাথে নিয়ে তাকে!

ওপরে তাকালে পাখি পলাতক

মেঘের ইচ্ছে বুঝি নিঃসঙ্গ মানুষের মনে

রুয়ে দেবে শিলাবৃষ্টি, বনের বেদনা!

নূপুরের শব্দে ভাঙা ছলকুয়াশায়

কেন দেখি দ্বিধাপাত!

আশা ভেসে যায় জলে

আলো পায় ছায়ার আঘাত!

ওপরে দাঁড়ালে আর কোনো ছবি নেই

যে শুয়ে রয়েছে ফল বাগানের আশা-তমশায়

মন চায় তার কাছে চলে যাবে

এক্সপ্রেস বাতাসের মতো

কিন্তু তার আগে জলে ডোবে সেতু!

অজ্ঞাত দিন-রাত্রি

হাইকেল হাশমী

ইদানীং দিনগুলো যে কতো অজ্ঞাত

সূর্য দিগন্তের দেয়াল ধরে ধরে

খোঁড়া মানুষের মতো অন্য দিগন্তে চলে যায়

লোকজন কিছুই টের পায় না।

আলো অচেনা পথিকের মতো

আকাশের অপরিচিত পথ ধরে

মাটিতে নামে খুব নিঃশব্দে

কেউ টের পায় না।

ইদানীং এই অচেনা দিনগুলো

আসে আর যায়

কোনো কোলাহল নাই।

রাত নামবিহীন পর্যটকের মতো নামে

এখন তারাগুলো আকাশে কোনো ছবি আঁকে না

মৌসুম নীরবে বদলে যায়

কখন যে বসন্ত আসে আর কখন যে শীত যায়

কিছুই টের পাওয়া যায় না।

শুধু খবরের শিরোনাম দেখি

গতকাল আক্রান্ত এতো জন

মৃতের সংখ্যা এতো,

মানুষ এখন কেবলি সংখ্যা

অজ্ঞাত সংখ্যা প্রতিদিন।

কাক ও কবির কাজ

চয়ন শায়েরী

কাক নিয়ে কত গবেষণা-কাক আর কবি নাকি গুনে শেষ করা যায় নাই-কাকেরা কর্কশ কণ্ঠে কথা বলে, কাক কালো-আরও কত কী!

তোমরা যখন ম্যাজিক দেখাও-কালো টাকা সাদা করে ফেলো, আইনের মারপ্যাঁচে ফেলে-তখন তো মনে হয় কাকের কালো রং বেশ ভালো-

তোমাদের মতো করে রং পাল্টায় না ভোল পালটায় না কাক;

কী অবাক

কা- দেখো দেখি-মাতুয়াইলের ময়লার ভাগাড়টা কেন্দ্র করে কতগুলো কাক ঘুরঘুর করে, বলো দেখি গুনে? ওখানে ঘণ্টায় যে চার হাজার কেজি মিথেন গ্যাস আকাশে উঠছে আগ্রাসন চালাতে-উষ্ণায়ন আগ্রাসন-মিথেনের মেঘ কি আরও বাড়ত না কাকেরা ভাগাড়ে ভাগ না বসালে?

যত দোষ কাক আর কবিদের-অথচ অন্যরা দেশটাকে আস্ত একটা ভাগাড়ে পরিণত করেই ছাড়ল!

কাক ভাগাড়ের ময়লা কমায়-তাই মিথেনের মেঘ খানিকটা হলেও কমছে, আর কবি মনের ময়লা পরিষ্কার করে করে নান্দনিক বাগানের পরিচর্যা করছে তোমার মনের ঘিঞ্জি গলিপথে;

কাক ও কবি গুনে শেষ করতে পারো না-আগে তুমি কী পরিমাণ বর্জ্য তৈরি করছ-বাইরে ও হৃদয়ে-তা তা গুনে দেখো!

বোরো-কন্যা

হাসান কল্লোল

বৃষ্টিতে ভিজে গেল আজ এই রাত!

এই রাত ভেজা দেহে থাকবে শুয়ে হাওরের

বিশাল হলুদ ধানের উপর!

কিছু পোষাপ্রাণি শৃঙ্খল ছিঁড়ে সিক্ত

ঘাটে নদীর নীল নাবিকের কাছে তবু

যেতে চায়!

নাবিকের চোখ চঞ্চল গ্রামের পোড়োবাড়িতে অপেক্ষমাণ

প্রিয় বেড়ালের জন্য- ওর চিনামাটির পাত্রের

শাদা দুধ বুঝি ভেসে গেছে এই বিপুল বৃষ্টিতে!!

আমাদের হাওড়ের কতিপয় কৃষক সকালের

ঝকঝকে সূর্যের অপেক্ষায়:

বেশী বৃষ্টিতে- ঢলে যেন নষ্ট না হয়

পুরুষ্ট যৌবনা তার বোরো-কন্যা!

বৃষ্টি হোক, বৃষ্টি ভেজাক তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের উঠোন।

লাবণ্যময় নতচোখের প্রার্থনা:

অতিমারীর অতিবৃষ্টিতে কোনো শস্যের স্বপ্ন

যেন আমাদের ভেসে না যায়-

এবারে অনিশ্চিত জীবনের হাওর যে

বোরো ধানের সবুজ-সমুদ্রে ভাসছে!

এসো বৃষ্টি

এসো আউশের সখা

অল্প অল্প করে ভেজাও নারীর মতো

আমাদের সমৃদ্ধির বাসন।

ময়লার ঝুড়ি

গোলাম কিবরিয়া পিনু

তিন হাত দূরে ময়লার ঝুড়ি- থাকার পরও

হাতের ময়লা পায়ের কাছে ফেলে রেখে

-পা সরিয়ে হাঁটা শুরু!

গুরু তুমি কে? কী শিখাচ্ছো?

ইচ্ছেমত ময়লা যত্রতত্র ফেলতে হয়!

ময়লার ঝুড়িটা দেখার পরও-

ময়লাটুকু ফেললে না ময়লার ঝুড়িতে?

হাতের ময়লা হাতে নিয়ে

বাইরেও ফেলতে পারতে?

পরিষ্কার ঘরেই তোমার হাতের ময়লাটুকু-

ফেলে রেখে গেলে!

আশেপাশের লোকও দেখলো,

মনে করেছো- কেউ তাকিয়ে নেই!

কারও চোখ নেই তোমার ওপর?

সামান্য ময়লা ফেলার সামান্য কা-জ্ঞান নেই?

এ কারণে ময়লার স্তূপ আরও চতুর্দিক!

জানালা

জলিল আহমেদ

সে কথা এখন থাক

তুমি বলো আছোটি কেমন- এই করোনা কালে?

নারকেল গাছটি ঘেঁষে যে জানালা রয়েছে দাঁড়িয়ে

সেখানে চাঁদ ও রোদ অনায়াসে ভাসে

জীবনের পরিসরনামা জানালা জহানে না,

কষ্ট ও সুখ নিয়ে যে আকাশ প্রতিদিনই মাথা উঁচু করে

তাহারই পরনে শাড়ি বিধবার বেশ ধরে থাকে।

পাখি ওড়ে, পতাকাও পত্ পত্ করে

ঘুড়ি টেনে শিশুদের বাস-মেঘের আড়ালে যদি লুকোয় কখনও...

ভীষণ রোদ্দুর থেকে নেমে আসে নীলের পালক।

আমি জানি- জানালাটা বন্ধ হলে

আকাশটা লেগে থাকে দু’চোখের কাঁচে।

যে ঘাস মাঠটা

দিলীপ কির্ত্তুনিয়া

ছোটবেলায় যে ঘাস মাঠটা দেখেছিলাম

তা এখনো আছে।

অথচ উদ্ভিদ বিদ্যার হিসাব করলে

সেই ঘাসগুলি আর থাকার কথা নয়।

ছোটবেলা থেকে যে আকাশটা দেখেছি

কখনও মেঘের রঙ

কখনও শূন্য নীল

মেঘ ঝরে গিয়ে অঝোর ধারা বৃষ্টি

তা এখনো আছে।

অথচ আকাশ বিদ্যার অভিজ্ঞতা খুললে

বোঝা যায়-

সেই মেঘগুলি আর নেই।

আকাশের আর থাকা না থাকা

সে নিজেই যখন কিছু না।

এইসব থাকার ভেতর

বেজে ওঠে চিরন্তনী।

কোনো দিন ফুরোবে না

ঘাস কিংবা আকাশ।

বিস্মৃত

ইমাম হোসাইন

ছাব্বিশ বছর আমার ঈদ উদযাপন হয় না।

তারপরও প্রতীক্ষায় গুনেছি এতগুলি বছর।

কালামিয়ার আত্মনিধন, ইদ্রিছ মৌলভীর গৃহত্যাগ

কোনোটিই আমি ভুলিনি।

অবৈধ ফতোয়ার বলি রাবেয়া বিবি গেলেন কবরে,

অভিমান আর বার দোররার যাতনা নিয়ে,

খুঁড়লে পাওয়া যাবে তার হাড়, কঙ্কাল কিংবা সত্য সন্ধান

দৃষ্টিতে মিলবে তৈলমাখা মুখ কিংবা কৃষ্ণকায় চোখ।

পাশের বাড়ির পাকনা বশর?

না, কেউ আজ তাকে ঠাট্টা করে না।

এখন ন্যুজপীঠ দেহখানা নিয়ে বসে থাকে টং ঘরে।

সে এখন অন্ধ, বধির। যাকাত, ফেতরা যার সম্বল।

দাসের হাটের চড়কমেলা, বড় বাড়ির হরি কীর্ত্তন

সবই আমার কাছে বিস্মৃত।

সুরেশের চায়ের দোকান, ঘোষ বাড়ির দুধ-ঘি-দই

সবই আমার কাছে বিস্মৃত।

দক্ষিণের চর, তারপর নবিউল্লার দোকান। বর্ষায়

ঢেউয়ের খেলায় মিলত মাছ, শামুক-ঝিনুকের সন্ধান।

এক দৃষ্টিতে দেখা মিলত সাপ-মাছের আদিম যুদ্ধ।

সাদা ফেনিলের আয়োজনে নতুন সৈকত।

একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে রিং বাঁধের দেখা।

দেখলাম নতুন পৃথিবী, যোগ হলো দিদৃক্ষার মানচিত্র।

বাহিরের চর, ভেতরের চর কিংবা উত্তর চর।

সবই আজ উঁচু দালান যুদ্ধে হার মেনে উধাও।

শীতে, বসন্তে কিংবা গ্রীষ্মে কালা মিয়ার সন্ন্যাসী বৃত্তি,

দরবেশের চরের হক মাওলা- মর্মভেদী ডাক

মাঝ রাতে মৃদু বায়ের সনে নূরু মিয়ার বাঁশি।

বালু পাথরের চরে এখন ভাসে তাদের বিরহি সুর।

তোমরা সবই উড়িয়ে দিয়েছ, যেমনি মানচিত্র থেকে

বিস্মৃত করেছ বামনী আর সন্দ্বীপ নদী।

যাদের কল্যাণে তোমাদের আজ ইটের নগর,

পেছনে ফেলে এসেছ দরিয়া নগর- তালমন্ধের হাট।

সেসব বিস্মৃত। দালান আর দালান।

নতুন ইটালি মার্কেট, জিরো পয়েন্ট, হাজী পাড়া।

কোনো উদযাপন আজ আর কবির সয় না।

রিক্ত হস্তে বিদায় ছাব্বিশ চাঁদের ঈদ।

তুমি এসছো তোমাকে বলি

শ্যামল নাথ

আমায় ঘরে রেখে কার ঘর গড়ো আর ভাঙো তুমি

তুমি এসছো তোমাকে বলি

আমাকে তুলে নিয়ে তুমি ছুড়ে ফেলো সমাজের জঞ্জাল

আমি চাই তুমি ঘুম ভেঙে দাও

যাতে আর কোনোদিন ঘুমোতে না পারি,

হাত দু’খানি মেলে তুমি বাতাসের সঙ্গে হাসছো

তুমি এসেছো তোমাকে বলি

যে কথা বলিনি সেকথা এবার বলি

নেমেছে সন্ধ্যা, পৃথিবীর যত ভুল, আঙুলে এঁকেছি ফাল্গুন।

তুচ্ছ সবই এপার ওপার,

সকাল সাঁঝে তোমাকে ঘিরে জড়িয়ে রাখি

বেসুরো কথা কিবা দীর্ঘ নীবরতা

তুমি এসেছো তোমাকে বলি,

আমার ছিল মুখর শহর, তোমার সুবিশাল পরিপাটি গ্রাম

আজ কোথাও কেউ নেই,

আমার তুমুল ভুলগুলি, তোমার ভীষণ অসুখ

তুমি এসেছো তোমাকে বলি।

বিম্বিত ধোঁয়াশা- বুঝে যাচ্ছি

মাসুদ মুস্তাফিজ

কৃষ্ণচূড়োর তলায় চিন্তাবিশ্বাস চুরি করছি

পাতার মুহূর্ত ফাঁস হয়ে যায়-

সাপের চোখে জীবনের মুদ্রা নাচে রঙিন বসন্তবেলায়

যে স্বপন আর বর্ণমালার আত্মীয়তায় তোমাকে অনুভব করি এ্যাক

অলীক অনিবার্য ক্ষরণে, আকাশের অসীম হাওয়াঘরে

আমরা উদ্যাপন করি প্রগলভ অভিমানী উৎসব-

যখন তুমি বুঝে যাচ্ছো রোদ ও ফুলের ব্যাকুলতা কিংবা স্মৃতিচিহ্নের

জটিলতা সেই নতুন রোদবৃষ্টি সেই পুরাতন সময় আর বোধম্বিত

মেঘের আলাপনে বোধের ভ্রমণ চিন্তার যাপনসমূহ

সরে যাচ্ছে- দূরে যাচ্ছে আমাদের সত্তার মানবিক ধৃষ্টতা নিয়ে

অবশ্য-

এইসব নালায়েক চুরির ভাষা আর গড়চুমুর কথা কেউ

শুনতে পাবেন না- একান্তই নিজস্ব ব্যাপার

গাছেদের মাতৃভাষা জানা নেই

বীথি রহমান

গাছেদের সাথে কী ভাষায় কথা বলতে হয় জানি না

জানা থাকলে অন্তত এক ওয়াক্ত তাদের সাথে প্রার্থনায় দাঁড়াতাম

তারা কী ভাষায় এবাদতে মশগুল হয়

সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায় কী বলে

এক কাতারে দাঁড়িয়ে আমিও তাদের শরিক হতাম

অন্ধকার কানাগলির মানুষেরা- খুন করতে করতে

মরণ নেশা মাথায় চেপেছে

এই যে আজ বাতাসের কৌটা হাতে ছুটতে হচ্ছে

জীবন ঝুলে আছে মৃত্যুর শক লাগা তারে

তবু খুনের নেশা ছুটছে না

মারণাস্ত্র হাতে তাই নিজের পায়েই দিচ্ছে কুড়াল

যদি মাটির কোরকে আর নতুন প্রাণ না গজায়

যদি পৃথিবীর কোলে দাঁড়িয়ে আক্রোশে-প্রতিবাদে

সমবেতভাবে গাছেরা আত্মাহুতি দেয়

নির্লজ্জ দু’পায়া মানুষ, এমন দুর্দিনে কী করে বেঁচে থাকবে?

আমি আজ ভীষণ ভীষণ ভয়ার্ত

গাছেদের মাতৃভাষা জানা আছে কারও?

ওদের খেয়ে-পরে, ওদেরই কেটে দিচ্ছি গোড়া

এ কৃতঘ্নতার বিচার কী ভাষায় দিচ্ছে ওরা?

দুলের দোলন ইশতেহার

রিসতিয়াক আহমেদ

তোমার জন্য দুল বানাতে দিয়েই দেখলাম

দুলের সমস্ত দোলন ইশতেহার

খাঁটি সোনাকেও কীভাবে

সেকরার হাতে পড়ে

মিশে যেতে হয় খাদের সাথে

এমনকি দুলে যে মৎস্য-প্রতিকৃতি

সেখানে অবিকল মানুষের মতো

বত্রিশ দন্তবাহার

তার মানে কি মাছবাজারে সকল

মাছেরা সন্তরণ ভাষাহীন

আর গালসী বেয়ে চোখের কোণ ঘেঁষে

কানকো পর্যন্ত যে তির্যক রেখা

তা কি আজকের ট্যাটু ফ্যাশানের আদিমাতা

পিতার তাঁর কন্যার সতিচ্ছেদের সাথে

হাঁড়-মাংস বাঁচানোর সেই আত্মঘাতি পদ্ধতি

ফলত বীর্যবান হয়েও কাপুরুষের

খেতাব নিয়ে নির্বীজদের জলসায়

বীর্যের স্ফুরণ প্রদর্শন

কিন্তু এবার প্রকাশ্যে সগর্বে

তোমার কালাচান কপালের কাটা দাগে

চুমু খেয়ে চিৎকার করে বলি- ভালোবাসি

অভিঘাত

মাসুদ চয়ন

নির্জন রাতে নিঃসঙ্গ আঁধারে ভেসে ওঠে অপ্রাপ্তির অভিযোগগুলো,

মনে হচ্ছে ব্ল্যাকহোলের পথে সম্প্রসারিত হচ্ছি লীনের ক্ষয়িষ্ণু তত্ত্বে;

স্মৃতিরাও জ্বলে গেছে গ্লানিদাহ্যের অভিসারে-

সময় রহস্যে উজ্জ্বল রেণু হয়ে ফুটতে চায় হিমশীতল স্বপ্নগুলো;

সঙ্গমস্নিগ্ধ ছায়ার সান্নিধ্য পেতে চায় অনাথ পক্ষের অস্তমিত সূর্যশালু;

কালবোশেখীর বিনির্গত ঢেউ অঙ্কিত হচ্ছে স্পর্শে স্পন্দনে হৃদয় প্রান্তরে-

অনাদিকাল নিগৃহীত নক্ষত্রের পাঁজরে প্রতিকূল সাঁতরে না পেরোবার ব্যথা!

তবুও বেঁচে থাকা নীল অন্তরীক্ষের বিশালতায়-

এক চিলতে এ্যাটমিক অস্তিত্বের নিভৃতচারী পথ চলায়,

অবক্ষয়ের শৈত্যশীর্ণ কোলাজ বিস্তৃত হচ্ছে;

back to top