alt

সাময়িকী

রক্তে রাঙানো বিবাহ বাসর

সুরঞ্জন রায়

: শুক্রবার, ০২ এপ্রিল ২০২১

লোরকা-র (১৮৯৮) জন্ম স্পেনের গ্রানাদায়। উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্রটোলায় এসেই তিনি জড়িয়ে পড়লেন লুই বুনুয়েল ও সালভাদর দালির বন্ধুত্বের ফাঁদে। এই তিনজনের সৃষ্ট শিল্পের মধ্যেও কাজ করেছিল এক অনুচ্চারিত ভালবাসা। লোরকা লিখেছিলেন Ode to Selvadore Dali. লোরকার মৃত্যুও দালিকে আচ্ছন্ন করেছিল গভীর বিষণ্নতায়। কিন্তু সম্পর্কের জটিলতাকে বরণ করে নিয়েই এই শিল্পীরা উধাও হয়ে গিয়েছিলেন জীবনের যাত্রাপথে। গভীর বন্ধুত্বের মধ্যেও লোরকার কবিতায় স্পেনের লোকজীবনের প্রগাঢ় উচ্চারণ দালিকে করে তুলেছিল অসহিষ্ণু; যদিও সমাজের ধনী সম্প্রদায়কে তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন তিনি।

বছর চারেকের বড়ো বুনুয়েল শিল্পী দালিকে মাদ্রিদের নৈশজীবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতা ও নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি অবিচল থাকার জন্য বুনুয়েল বন্ধু দালির কাছ থেকে যথেষ্ট সম্মান ও প্রশংসা আদায় করে নিতেন। তবে দালি ও বুনয়েলের যে প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল লোরকার প্রতি, তা তাদের জীবনে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে। বুনুয়েল ও দালি নিজেদের জীবন ও স্মৃতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন। সেই যন্ত্রণাদগ্ধ এবং শিল্পময় অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ স্মরণীয় গ্রন্থে জীবন ও কালের ইতিহাস পাশপাশি হেঁটেছে। এখানে আপনাদের অনুমতি নিয়ে বুনুয়েলের স্বপ্ন থেকে একটা টুকরো চুরি করে পেশ করছি আপনাদের সামনে-

একটা শতকের চলে যাওয়া আর নতুন একটা শতকের আবির্ভাবের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটাই আমার আত্মার মধ্যে চিরদিন প্রতিফলিত হয়েছে। আমি জন্মেছিলাম ১৯০০ সালে। আমার চেয়ে চার বছরের ছোট প্রবল প্রতিভাবান দালির সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা সকলেই জানে। ওর সঙ্গে যেমনই গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল আমার, তেমনই ছিল ঝগড়াঝাটি। কিন্তু দালির চেয়েও আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছিল আমার চেয়ে দু-বছরের বড়ো ফেদোরিকো। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। সকলেই তাকে খুব ভালবাসত। তার গলার স্বরের মায়াবী পেলবতার মধ্যে লুকিয়েছিল এক বজ্রনির্ঘোষ। সকলেরই মনের দরজা তার জন্য ছিল অবারিত- সে বুদ্ধিজীবী তরুণ ছোকড়াই হোক, অথবা অশিক্ষিত গ্রামের কৃষকই হোক। আর সে কারণেই তার কবিতা আমাকে টানত এত বেশি করে। তার সমাজভাবনা আর যৌনচিন্তার অমলিন উচ্চারণ প্রথমদিকে স্পেনের সরকারকে ততটা বিব্রত করেনি। কিন্তু তার যন্ত্রণার প্রবল উচ্চারণ ছাপিয়ে গিয়েছিল ফ্যাসিস্ত বন্দুকের গর্জনকেও। আমি আজও দেখতে পাই ফ্র্যাঙ্কোর গুপ্তচরেরা যখন তার তরতাজা সুকোমল দেহটাকে বন্দুকের গুলিতে গুলিতে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, তখন, সেই মুহূর্তে তার হাত থেকে ছিটাকে পড়ছে সদ্যসমাপ্ত তার নাটক Bodas de Sangre, (যার বাংলা নাম হতে পারে, রক্তে রাঙানো বিবাহ-বাসর)-এর একটা কপি, ফিনকি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া সবুজ রঙের রক্ত ক্রমশই ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে তার রক্তলাল বইয়ের মলাটটা। ওকে নিয়ে যদি কোনোদিন আমি ছবি বানাই তবে, এটাই হবে প্রথম দৃশ্য।

১৯২৫ সালে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর মা’র অনুমতি মেলায় সে বছরই আমি এসে পৌঁছলাম প্যারিসে। একটু আগে-পরে দালি আর লোরকাও এসে যোগ দিল আমার সঙ্গে। একদিন আমরা তিনজনে মিলে একটা সিনেমা দেখলাম- ফ্রিজ ল্যাং-এর ‘মেট্রোপলিস। ছবিটা আমাদের তিনজনকেই নাড়া দিল গভীরভাবে। আর এর পর পরই আমি পা বাড়ালাম ছবির জগতের দিকে। জাঁ এপস্টাইন-এর সহকারী হিসেবে কয়েকটা ছবির কাজে জড়িয়ে পড়লাম আমি।

সে-সময় কবি হিসেবে লোরকার চারদিকে খুব নামডাক। লোরকা-দালি-র সম্পর্ক নিয়ে বন্ধুমহলে তখন ফিসফাস আর হাসাহাসি। অবশ্য দালি তখন শিল্পজগতে নিজের জায়গাটা বেশ পাকাপোক্ত করে নিচ্ছিল। একদিন সে পিকাসোর সঙ্গে দেখা করতে গেল। দালির প্রতিভার খবর অবশ্য আগাম পৌঁছে গিয়েছিল মহান শিল্পীর কাছে। গভীর আলোচনা চলল দুজনের মধ্যে নানান বিষয় নিয়ে। পিকাসো দালিকে পরামর্শ দিলেন, ইতিহাসকে স্যুরিয়ালিজমের দৃষ্টিতে অনুভব করে শিল্পে তার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে। সেদিন আমাদের সান্ধ্য মজলিশে দালির অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে আমরা ঠিক করে ফেললাম ছবি একটা আমাদের বানাতেই হবে! একই দিনে আমি ও দালি দুজনেই দুটো স্বপ্ন দেখি, দালির স্বপ্নে ভেসে আসে একটা কাটা হাত যাকে অসংখ্য পিঁপড়ে বয়ে নিয়ে চলেছে, আর আমার বীভৎস স্বপ্নে দেখতে পাই একটা পাতলা ছুরি দিয়ে দু-ফালা করে ফেলা হচ্ছে একটা চোখকে। এই স্বপ্ন দুটোর ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠল আমাদের প্রথম ছবির চিত্রনাট্য। পরিচালনার ভার থাকে আমারই ওপর। তিনজনে আলোচনা করে আমরা যে চিত্রনাট্যের খসড়া দাঁড় করালাম তার থেকে লোরকা সরে দাঁড়ানোয় এবং ছবিতে তাঁর নাম ব্যবহারে আপত্তি জানানোয় শেষ পর্যন্ত টাইটেল কার্ড থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।

এর অল্প দিনের মধ্যেই দালির জীবনে আসে ফরাসি কবি পল এল্যুয়ারের স্ত্রী গালা। দালির অনুরোধে এল্যুয়ার সস্ত্রীক এসে উপস্থিত হলেন সমুদ্রঘেরা নয়নাভিরাম ক্যাডাকে- বন্ধুর বাংলোতে, এবং তখনই দালি উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে গালাকে পাবার জন্য। শিল্প-মনস্ক গালার প্রেমও ঝরনার মতো ধাবিত হল দালির দিকে। এরপরও এল্যুয়ার কিন্তু সারা জীবন দালির সঙ্গে স্বাভাবিক সদ্ভাব বজায় রেখে যান। ১৯৩৪ সালে বিয়ে করে দশ বছরের বড়ো গালার প্রেমে অবগাহন করতে করতেই দালি তার সুদীর্ঘ জীবনটা কাটিয়ে দেন। বিষণœতায় আক্রান্ত লোরকা এই ঘটনার পরই আমেরিকায় গিয়ে গা ঢাকা দেয়।

উনিশ শো তিরিশের মাঝামাঝি সময় থেকেই স্পেনের রাজনীতির আকাশকে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ করে দেখা দেয় এক কালো রাত্রির যুগ। ফ্রাঙ্কো তার মরক্কোর সেনাবাহিনী নিয়ে পৌঁছে গেল স্পেনে, তার বাসনা ছিল ‘রিপাবলিক’-কে উচ্ছেদ করে তার নিজের ‘শৃঙ্খলা’ প্রতিষ্ঠা করবে। একদিন ভোরবেলা একঝাঁক বিস্ফোরণ আর কামানের আওয়াজে আমি আতঙ্কে জেগে উঠলাম। একটি রিপাকলিকান বিমান মোস্তানিয়ার ফৌজি ব্যারাকে বোমা ফেলছে। সে সময় স্পেনের সমস্ত ব্যারাকেই সৈন্যসামন্ত গিজগিজ করছে। একদল ফ্যালানজিস্ত মোস্তানিয়ায় গোপন আস্তানা গেড়েছিল, কয়েকদিন ধরেই ওরা জানালা থেকে গুলি চালাচ্ছিল, অনেক সাধারণ মানুষ তাতে জখমও হয়েছিল। আজ আঠারো জুলাইয়ে (১৯৩৪) সকালে আজানিয়ার রিপাবলিকানদের একদল শ্রমিক ব্যারাকগুলোতে গিয়ে চড়াও হয়। বেলা দশটার মধ্যেই সব শেষ বিদ্রোহী অফিসার ও ফ্যালানজিস্তরা খতম। যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে।

আমার ব্যালকনি থেকে দূরের মেসিনগানের আওয়াজ শুনতে শুনতে আমি দেখতে পেলাম নিচের রাস্তা দিয়ে জনা দুই শ্রমিক আর কয়েকজন জিপসি একটা স্লাইডার কামান টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যে বিপ্লব এত বছর ধরে ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করছিল বলে আমরা অনুভব করছিলাম, আমি নিজে যা ব্যক্তিগতভাবে এত উৎসাহভরে চাইছিলাম, আজ সে আমার চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করছে, চোখের সামনে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, আমি শুধু একটা জোর ঝাঁকুনি খেলাম।

একদিন এক রিপাবলিকানের কাছে খবর পেলাম ফেদারিকো গার্সিয়া লোরকা খুন হয়েছে। ‘আন্দালুশিয়ার কুকুর’ তৈরির কিছুদিন আগে লোরকা আর আমার মধ্যে একটু মন কষাকষি হয়েছিল। সে যেহেতু রোগাপটকা আন্দালুশীয়, তাই সে ভেবেছিল ছবিটা বুঝি তার উদ্দেশ্যেই আমার ব্যক্তিগত আক্রমণ। সে লোকজনকে বলতো, ‘বুনুয়েল একটা ছোট্ট ছবি বানিয়েছে, তার নাম ‘আন্দালুশিয়ার কুকুর’- আমার মনে হয় আমিই সেই কুকুর।’

১৯৩৪ সালের শেষের দিকে ও আমেরিকা থেকে ফিরে এলে আমাদের মধ্যে অবশ্য বন্ধুত্ব আবার ফিরে আসে। দালির সঙ্গে কিন্তু ওর সম্পর্কের ভাঙনটা আর তেমনভাবে জোড়া লাগেনি। যদিও লোরকার মৃত্যুর সামান্য কিছু আগে দালি আবার লোরকার সঙ্গে সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ফ্রাঙ্কোর খুনে বাহিনী রিপাবলিকান লোরকাকে বাঁচার সুযোগ দেয়নি। লোরকা যেহেতু রিপাবলিকানদের সমর্থন করত, আর দালি ফ্রাঙ্কোকে তাই ওদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দুস্তর ব্যবধান। লোরকা আর আমি অনেক সময় কাটাতাম একসঙ্গে। উগার্তকে নিয়ে আমরা এল পাউলারের পাহাড়ে গাড়ি চালিয়ে যেতাম, সেখানকার গথিক স্তব্ধতায় কয়েক ঘণ্টা নিরুপদ্রবে কাটাব বলে। এখানকার সবই ভাঙাচোরা, কিন্তু ভেতরে কয়েকটা স্পার্টান ঘর ছিল ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউটের লোকজনদের জন্য। যখন যুদ্ধ চারপাশে ক্রুদ্ধ ড্রাগনের মতো গজরাচ্ছে তখন কবিতা বা চিত্রকলা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। ফ্রাঙ্কের অন্তিম আক্রমণের চার দিন আগে আবেগতাড়িত লোরকা আচমকা ঠিক করল সে গ্রানাদা যাবে, নিজের শহরে।

আমি অনেক অনুনয় করেছিলাম, এই সংকল্প থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে- ফেদেরিকো, বীভৎস সব কাণ্ড হচ্ছে। এখন তুমি ওখানে যেতে পারবে না, বরং এখানেই তুমি অনেকটা নিরাপদে থাকবে। আমাদের কোনো কথাকেই সে কান দিল না, খানিকটা ভীত ও উৎকণ্ঠিতভাবেই সে পরদিন গ্রানাদা চলে গেল। তার এই খুন হবার খবর ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল আমাদের। সারাজীবন যত মানুষ আমি দেখেছি, ফেদেরিকো ছিল তাদের সকলের সেরা। শুধু তার নাটক বা কবিতার কথা আমি বলছি না, মানুষ হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবে তার কোনো তুলনা হয় না।

পিয়ানোতে বসে শপার নকলই করুক অথবা উদ্ভাবন করুক নতুন কোনো মূকাভিনয়, কিংবা নাটকের কোনো দৃশ্য একাই দাপটে অভিনয় করে দেখাক, সে ছিল অপ্রতিরোধ্য। কবিতা পড়ত চমৎকার, আর ছিল আবেগ, সংরাগ, যৌবন আর আনন্দ। ছাত্রটোলায় যখন প্রথম তার সঙ্গে দেখা হয়, আমি ছিলাম গেঁয়ো, অপরিশীলিত, শুধুই খেলাধুলার দিকে ঝোঁক। সেই আমাকে পুরোপুরি রূপান্তরিত করে সম্পূর্ণ নতুন একটা জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সে ছিল আগুনের শিখা। তার মৃতদেহ কোনোদিনই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, তার মৃত্যু সম্বন্ধে রং চড়ানো সব গুজব ছড়াচ্ছিল চারপাশে। কেউ কেউ ইঙ্গিত করছিল সমকামীদের কারও ঈর্ষাই বুঝি কারণ। আসল কথা হল লোরকা খুন হয়েছে কারণ সে ছিল বিপ্লবী কবি। ‘বুদ্ধিজীবীদের খতম করো’- যুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্তদের এটা ছিল একটা প্রিয় জিগির। গ্রানাদায় গিয়ে সে সম্ভবত ফ্যালানজিস্ত কবি রোসালেসের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কারণ সে ছিল লোরকার পরিবারের ঘনিষ্ঠ। আমার ধারণা লোরকা ভেবেছিল রোসালেসদের বাড়িতে সে নিরাপদে থাকবে। কিন্তু আচমকা একরাতে একদল লোক অ্যালোঞ্জো বলে একজনের নেতৃত্বে এসে তাকে গ্রেফতার করে। এবং কয়েকজন বন্দি মজুরের সঙ্গে নিয়ে ট্রাক চালিয়ে উধাও হয়ে যায়। ফেদেরিকো কষ্ট আর মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পেত। আমি অনুমান করতে পারি সে কী অনুভব করেছিল সেই নিশুতি রাতে, একটা ট্রাক ছুটে চলেছে জলপাই বনের দিকে, সেখানে তাকে গুলি করে মারা হবে। এই ছবিটা এখনও মাঝে মাঝে আমাকে উদভ্রান্ত করে তোলে।

কয়েকদিন সেখানে বোন-ভগ্নিপতি আর তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে সারা বছরের সম্পদ আহরণ করে ফিরে আসতাম আমার বউ-ছেলেমেয়েদের সান্নিধ্যে। মাদ্রিদে এসে মাঝে মাঝেই আমি সবার অগোচরে চলে আসতাম আমাদের ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত ছাত্রটোলায়। মাদ্রিদের সেইসব বিকেল-রাত্রি, সালভাদোরের সঙ্গে পথে-পথে হাঁটা, সবই মনে আছে। আর ছোটো বাগানটায় ঘুরকে ঘুরতে মনে পড়ত ফেদেরিকো তোমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রথম দিনটার কথা। তখন তুমি সদ্য গ্রানাদা থেকে ফুয়েস্তে ভ্যাকুয়েস হয়ে ফিরে এসেছ সঙ্গে নিয়ে তোমার বইয়ের প্রথম কবিতা,

সবুজ তোমাকে আমি যেভাবে চাই

সবুজ বাতাস। সবুজ ভালোবাসা...

তোমার গলায় প্রথম শোনা সেই কবিতা। তোমার লেখা সেরা কবিতা। বিনা দ্বিধায় বলা যায় স্পেনীয় কাব্যে শ্রেষ্ঠ। তোমার ‘সবুজ বাতাস’ আমাদের সকলকে স্পর্শ করেছিল, তার সুর এখনও লেগে আছে আমাদের কাছে। না, ভুল বললাম, কানে নয়, আমাদের হৃদয়ে। আমরা যারা শুনতে পাচ্ছি আমাদের শেষ নিঃশ্বাসের শব্দ (Mon Dernier Soupir- My Last Sigh) তারা কিন্তু তোমাকে ভোলেনি। ফেদেরিকো তোমাকে আমরা ভুলব না।

‘ব্লাড ওয়েডিং’ নামকরণেই রয়েছে রক্তপাতের ইশারা। আমাদের উৎসবের শাড়িতে (ঢাকাই/বেনারসী) যেমন জরির কাজ, সেই রকমই লোরকার নাটকে ও কবিতার সর্বাঙ্গে রক্তের ঘন বুনোন। কিন্তু বিশেষ করে ‘ব্লাড ওয়েডিং’-এ তা যেন বৃষ্টির ধারার মতোই ভিজিয়ে দিয়েছে ধরাতল। এখানে যেন কবির অনুভূতিতে জীবন ও মৃত্যু মিলেমিশে একাকার। নাটকের তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে গ্রিক নাটকের কোরাসের মতোই তিনজন কাঠুরিয়ার সংলাপে ধ্বনিত হয়েছে সেই সুর,-

পুর্ণেন্দু পত্রী-র একটা লেখা থেকে আমরা পাচ্ছি-

‘বিশ্ব বিশাল। প্রত্যেকেই বাস করতে পারে এখানে।

কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করবে।

তোমাকে কিন্তু হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে তোমার প্যাশন। পালিয়ে গিয়ে ঠিকই করেছে ওরা।

তারা প্রত্যেকে প্রত্যেককে প্রতারিত করতে চাইছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে রক্ত।

রক্ত!

তোমাকে তো অনুগমন করতেই হবে সেই পথ, যা গড়েছে তোমার রক্ত।

তাতে কী হয়েছে? রক্তকে পচিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে নিজেকে রক্তে ভাসিয়ে মরা ঢের ভাল।’

এই সংলাপের মধ্যে কান পাতলে আমরা শুনতে পাই সভ্যতা ও রক্তপাতের সঙ্গে নিরত যুযুধান লোরকারই কণ্ঠস্বর।

‘পোয়েট ইন ন্যু-ইয়র্ক’ কবিতার বইয়ের শুরুতেই নিজের সম্পর্কে তিনি লিখছেন,-

‘মার্ডার্ড বাই হেভেন’ আর যা শেষও করেছেন ঐ একই কথায়,-

“ঝযধসনষরহম বধপয ফধু রিঃয সধু ফরভভবৎবহঃ ভধপব

অয, যবধাবহ সঁৎফবৎবফ ড়হব.”

আবার ঐ বইয়েরই তৃতীয় কবিতায়-

‘ডেইজির ক্রি ক্রি-র ভিতরে

যখন ভেঙে যায় বিশুদ্ধ সব গড়ন

তখনই মনে পড়ে তারা, কী ভাবে হত্যা করেছে আমাকেও।

তারা তছনছ করেছে কাফে, কবরখানা এবং গির্জা

উল্টে ফেলেছে মদের পিপে আর কাপড়-শুকোনো কল

তিনটে কঙ্কাল ঘেঁটে-ঘুঁটে তারা উপড়ে নিয়েছে তাদের দাঁতের সোনা

কিন্তু আমাকে, না আমার দেখা পায়নি কখনো।

কখনো দেখা পায়নি আমার?

না, কখনো দেখা পায়নি আমার।’

নিজেই এঁকে যান নিজের মৃত্যু-সম্ভাবনা এবং সেই সঙ্গে মৃত্যুহীনতাও।

প্রফেটিক কোয়ালিটিতে ভরপুর লোরকা তাঁর নাটকে একদিকে এনেছেন মা-কনে-শাশুড়িকে অন্যদিকে লিওনার্দোর সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রী-ঝি-প্রতিবেশিনী-শ্বশুর আর একদল যুবক-যুবতী ও তিনজন কাঠুরিয়াবেশী নিয়তি আর চাঁদ যে স্বয়ং মৃত্যু। এদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে এই নাটক। কিন্তু সামান্য মনোযোগেই আমাদের চোখে পড়বে আরো দুটো চরিত্র, যারা রক্ত মাংসের নয় ঠিকই, কিন্তু রক্ত মাংসের চরিত্রের মতোই খুবই উচ্চকিত, এর প্রথমটির নাম রক্ত, আর অন্যটি ছুরি।

নাটকের শুরুতেই আমরা দেখি, বর চরিত্রটি তাদের আঙুরের ক্ষেতে যাবার আগে মা-কে জানায়, সকালের খাবার পাবার আগে তার বেশি প্রয়োজন একটি ছুটি। ছুটি খুঁজে না-পেয়ে সে সকলকে অভিসম্পাত দিতে থাকে। সেই সঙ্গে সেই স্কাউনড্রেলকেও, ছুরি যার আবিষ্কার। ছুরি থেকে তার গালাগালি ছড়িয়ে পড়ে কামান, বন্দুক, ছোট মাপের হাত-ছুরি থেকে নিড়–নি এমনকি পিচফর্ক পর্যন্ত- যা কিছুই ছিন্নভিন্ন করতে পারে মানুষকে, মানুষের বাঁচার দুর্মর শক্তি ও স্বপ্নকে। আর এই ছুরির সুবাদে আমাদের সামনে ধীরে ধীরে খুলে যেতে থাকে অতীতের ঘটনাক্রম- আমাদের জানা হয়ে যায় প্রতিপক্ষের অস্ত্রাঘাতে নিহত স্বামী ও পুত্রের অকাল মৃত্যুর কথা। নাটকের প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে লিওনার্দোর বাড়িতে, লিওনার্দোর মা ও স্ত্রী ছেলে ভুলানো ছড়া গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে তার শিশুপুত্রকে। সেই ছড়া-গানে থেকে থেকেই ঘুরে ফিরে আসে এক রক্তাক্ত ঘোড়ার জলাতঙ্ক ও জলতৃষ্ণার বিরবণ, যার গভীর চোখের চাউনিতে গাঁথা হয়ে আছে এক রুপালি ছোরা।

নাটকের তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে রক্ত এবং ছুরি পৌঁছে যায় পারস্পরিক সমঝোতায়, কেননা দুজনেই তখন বুঝে গেছে যে একটা নির্দিষ্ট হত্যাকা-ের জন্য তাদের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হবে এখুনি। মৃত্যুর দূত হিসেবে, কাঠুরিয়ার ছদ্মবেশে, সাদা মুখে আর গাঢ় নীল আভার বিচ্ছুরণে যখন মঞ্চে প্রবেশ করে চাঁদ, তখন থেকেই রক্তের প্রয়োজনে ছুরির ভূমিকা হয়ে উঠতে থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতির মতো অনিবার্য। রক্তের পিপাসায় উদ্বেল চাঁদের সংলাপে আমরা তাই শুনি-

‘চাঁদ একটা ছুরিকে ছুরে দিয়েছে বাতাসে

যার ধাতব আক্রমণে রক্তের যন্ত্রণা হয়ে উঠবে অস্থির।’

চাঁদের কাছে আজ এগিয়ে এসেছে সেই শুভরাত্রি যে তার গালকে রাঙিয়ে দেবে রক্তে রক্তে।

বুড়ি ভিখারিণীর ছদ্মবেশে মৃত্যু তার কানে কানে শোনায় সেই পরামর্শ,-

প্রজ্বলিত করো তোমার ওয়েস্টকোট, খুলে দাও সব বোতাম, এরপর ছুরি নিজেই পেয়ে যাবে তার এগোনোর পথ।

চাঁদের কণ্ঠস্বরে, মৃত্যুর কাছে এখন একটাই প্রগাঢ় কামনা,- কিন্তু তাদের মৃত করে রাখো বহুক্ষণ। তাহলেই আমার আঙুলগুলোর ফাঁক দিয়ে গলগল করে গড়িয়ে যাবে তাদের রক্তস্রোত।

এরপর কার্লো সওরার সিনেমায় ব্যালের ফর্মে নাটক এগিয়ে যায় তার নির্দিষ্ট রক্তাক্ত অন্ধকারের দিকে।লোরকা-র (১৮৯৮) জন্ম স্পেনের গ্রানাদায়। উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্রটোলায় এসেই তিনি জড়িয়ে পড়লেন লুই বুনুয়েল ও সালভাদর দালির বন্ধুত্বের ফাঁদে। এই তিনজনের সৃষ্ট শিল্পের মধ্যেও কাজ করেছিল এক অনুচ্চারিত ভালবাসা। লোরকা লিখেছিলেন Ode to Selvadore Dali. লোরকার মৃত্যুও দালিকে আচ্ছন্ন করেছিল গভীর বিষণ্নতায়। কিন্তু সম্পর্কের জটিলতাকে বরণ করে নিয়েই এই শিল্পীরা উধাও হয়ে গিয়েছিলেন জীবনের যাত্রাপথে। গভীর বন্ধুত্বের মধ্যেও লোরকার কবিতায় স্পেনের লোকজীবনের প্রগাঢ় উচ্চারণ দালিকে করে তুলেছিল অসহিষ্ণু; যদিও সমাজের ধনী সম্প্রদায়কে তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন তিনি।

বছর চারেকের বড়ো বুনুয়েল শিল্পী দালিকে মাদ্রিদের নৈশজীবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতা ও নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি অবিচল থাকার জন্য বুনুয়েল বন্ধু দালির কাছ থেকে যথেষ্ট সম্মান ও প্রশংসা আদায় করে নিতেন। তবে দালি ও বুনয়েলের যে প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল লোরকার প্রতি, তা তাদের জীবনে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে। বুনুয়েল ও দালি নিজেদের জীবন ও স্মৃতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন। সেই যন্ত্রণাদগ্ধ এবং শিল্পময় অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ স্মরণীয় গ্রন্থে জীবন ও কালের ইতিহাস পাশপাশি হেঁটেছে। এখানে আপনাদের অনুমতি নিয়ে বুনুয়েলের স্বপ্ন থেকে একটা টুকরো চুরি করে পেশ করছি আপনাদের সামনে-

একটা শতকের চলে যাওয়া আর নতুন একটা শতকের আবির্ভাবের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটাই আমার আত্মার মধ্যে চিরদিন প্রতিফলিত হয়েছে। আমি জন্মেছিলাম ১৯০০ সালে। আমার চেয়ে চার বছরের ছোট প্রবল প্রতিভাবান দালির সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা সকলেই জানে। ওর সঙ্গে যেমনই গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল আমার, তেমনই ছিল ঝগড়াঝাটি। কিন্তু দালির চেয়েও আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছিল আমার চেয়ে দু-বছরের বড়ো ফেদোরিকো। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। সকলেই তাকে খুব ভালবাসত। তার গলার স্বরের মায়াবী পেলবতার মধ্যে লুকিয়েছিল এক বজ্রনির্ঘোষ। সকলেরই মনের দরজা তার জন্য ছিল অবারিত- সে বুদ্ধিজীবী তরুণ ছোকড়াই হোক, অথবা অশিক্ষিত গ্রামের কৃষকই হোক। আর সে কারণেই তার কবিতা আমাকে টানত এত বেশি করে। তার সমাজভাবনা আর যৌনচিন্তার অমলিন উচ্চারণ প্রথমদিকে স্পেনের সরকারকে ততটা বিব্রত করেনি। কিন্তু তার যন্ত্রণার প্রবল উচ্চারণ ছাপিয়ে গিয়েছিল ফ্যাসিস্ত বন্দুকের গর্জনকেও। আমি আজও দেখতে পাই ফ্র্যাঙ্কোর গুপ্তচরেরা যখন তার তরতাজা সুকোমল দেহটাকে বন্দুকের গুলিতে গুলিতে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, তখন, সেই মুহূর্তে তার হাত থেকে ছিটাকে পড়ছে সদ্যসমাপ্ত তার নাটক Bodas de Sangre, (যার বাংলা নাম হতে পারে, রক্তে রাঙানো বিবাহ-বাসর)-এর একটা কপি, ফিনকি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া সবুজ রঙের রক্ত ক্রমশই ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে তার রক্তলাল বইয়ের মলাটটা। ওকে নিয়ে যদি কোনোদিন আমি ছবি বানাই তবে, এটাই হবে প্রথম দৃশ্য।

১৯২৫ সালে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর মা’র অনুমতি মেলায় সে বছরই আমি এসে পৌঁছলাম প্যারিসে। একটু আগে-পরে দালি আর লোরকাও এসে যোগ দিল আমার সঙ্গে। একদিন আমরা তিনজনে মিলে একটা সিনেমা দেখলাম- ফ্রিজ ল্যাং-এর ‘মেট্রোপলিস। ছবিটা আমাদের তিনজনকেই নাড়া দিল গভীরভাবে। আর এর পর পরই আমি পা বাড়ালাম ছবির জগতের দিকে। জাঁ এপস্টাইন-এর সহকারী হিসেবে কয়েকটা ছবির কাজে জড়িয়ে পড়লাম আমি।

সে-সময় কবি হিসেবে লোরকার চারদিকে খুব নামডাক। লোরকা-দালি-র সম্পর্ক নিয়ে বন্ধুমহলে তখন ফিসফাস আর হাসাহাসি। অবশ্য দালি তখন শিল্পজগতে নিজের জায়গাটা বেশ পাকাপোক্ত করে নিচ্ছিল। একদিন সে পিকাসোর সঙ্গে দেখা করতে গেল। দালির প্রতিভার খবর অবশ্য আগাম পৌঁছে গিয়েছিল মহান শিল্পীর কাছে। গভীর আলোচনা চলল দুজনের মধ্যে নানান বিষয় নিয়ে। পিকাসো দালিকে পরামর্শ দিলেন, ইতিহাসকে স্যুরিয়ালিজমের দৃষ্টিতে অনুভব করে শিল্পে তার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে। সেদিন আমাদের সান্ধ্য মজলিশে দালির অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে আমরা ঠিক করে ফেললাম ছবি একটা আমাদের বানাতেই হবে! একই দিনে আমি ও দালি দুজনেই দুটো স্বপ্ন দেখি, দালির স্বপ্নে ভেসে আসে একটা কাটা হাত যাকে অসংখ্য পিঁপড়ে বয়ে নিয়ে চলেছে, আর আমার বীভৎস স্বপ্নে দেখতে পাই একটা পাতলা ছুরি দিয়ে দু-ফালা করে ফেলা হচ্ছে একটা চোখকে। এই স্বপ্ন দুটোর ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠল আমাদের প্রথম ছবির চিত্রনাট্য। পরিচালনার ভার থাকে আমারই ওপর। তিনজনে আলোচনা করে আমরা যে চিত্রনাট্যের খসড়া দাঁড় করালাম তার থেকে লোরকা সরে দাঁড়ানোয় এবং ছবিতে তাঁর নাম ব্যবহারে আপত্তি জানানোয় শেষ পর্যন্ত টাইটেল কার্ড থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।

এর অল্প দিনের মধ্যেই দালির জীবনে আসে ফরাসি কবি পল এল্যুয়ারের স্ত্রী গালা। দালির অনুরোধে এল্যুয়ার সস্ত্রীক এসে উপস্থিত হলেন সমুদ্রঘেরা নয়নাভিরাম ক্যাডাকে- বন্ধুর বাংলোতে, এবং তখনই দালি উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে গালাকে পাবার জন্য। শিল্প-মনস্ক গালার প্রেমও ঝরনার মতো ধাবিত হল দালির দিকে। এরপরও এল্যুয়ার কিন্তু সারা জীবন দালির সঙ্গে স্বাভাবিক সদ্ভাব বজায় রেখে যান। ১৯৩৪ সালে বিয়ে করে দশ বছরের বড়ো গালার প্রেমে অবগাহন করতে করতেই দালি তার সুদীর্ঘ জীবনটা কাটিয়ে দেন। বিষণœতায় আক্রান্ত লোরকা এই ঘটনার পরই আমেরিকায় গিয়ে গা ঢাকা দেয়।

উনিশ শো তিরিশের মাঝামাঝি সময় থেকেই স্পেনের রাজনীতির আকাশকে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ করে দেখা দেয় এক কালো রাত্রির যুগ। ফ্রাঙ্কো তার মরক্কোর সেনাবাহিনী নিয়ে পৌঁছে গেল স্পেনে, তার বাসনা ছিল ‘রিপাবলিক’-কে উচ্ছেদ করে তার নিজের ‘শৃঙ্খলা’ প্রতিষ্ঠা করবে। একদিন ভোরবেলা একঝাঁক বিস্ফোরণ আর কামানের আওয়াজে আমি আতঙ্কে জেগে উঠলাম। একটি রিপাকলিকান বিমান মোস্তানিয়ার ফৌজি ব্যারাকে বোমা ফেলছে। সে সময় স্পেনের সমস্ত ব্যারাকেই সৈন্যসামন্ত গিজগিজ করছে। একদল ফ্যালানজিস্ত মোস্তানিয়ায় গোপন আস্তানা গেড়েছিল, কয়েকদিন ধরেই ওরা জানালা থেকে গুলি চালাচ্ছিল, অনেক সাধারণ মানুষ তাতে জখমও হয়েছিল। আজ আঠারো জুলাইয়ে (১৯৩৪) সকালে আজানিয়ার রিপাবলিকানদের একদল শ্রমিক ব্যারাকগুলোতে গিয়ে চড়াও হয়। বেলা দশটার মধ্যেই সব শেষ বিদ্রোহী অফিসার ও ফ্যালানজিস্তরা খতম। যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে।

আমার ব্যালকনি থেকে দূরের মেসিনগানের আওয়াজ শুনতে শুনতে আমি দেখতে পেলাম নিচের রাস্তা দিয়ে জনা দুই শ্রমিক আর কয়েকজন জিপসি একটা স্লাইডার কামান টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যে বিপ্লব এত বছর ধরে ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করছিল বলে আমরা অনুভব করছিলাম, আমি নিজে যা ব্যক্তিগতভাবে এত উৎসাহভরে চাইছিলাম, আজ সে আমার চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করছে, চোখের সামনে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, আমি শুধু একটা জোর ঝাঁকুনি খেলাম।

একদিন এক রিপাবলিকানের কাছে খবর পেলাম ফেদারিকো গার্সিয়া লোরকা খুন হয়েছে। ‘আন্দালুশিয়ার কুকুর’ তৈরির কিছুদিন আগে লোরকা আর আমার মধ্যে একটু মন কষাকষি হয়েছিল। সে যেহেতু রোগাপটকা আন্দালুশীয়, তাই সে ভেবেছিল ছবিটা বুঝি তার উদ্দেশ্যেই আমার ব্যক্তিগত আক্রমণ। সে লোকজনকে বলতো, ‘বুনুয়েল একটা ছোট্ট ছবি বানিয়েছে, তার নাম ‘আন্দালুশিয়ার কুকুর’- আমার মনে হয় আমিই সেই কুকুর।’

১৯৩৪ সালের শেষের দিকে ও আমেরিকা থেকে ফিরে এলে আমাদের মধ্যে অবশ্য বন্ধুত্ব আবার ফিরে আসে। দালির সঙ্গে কিন্তু ওর সম্পর্কের ভাঙনটা আর তেমনভাবে জোড়া লাগেনি। যদিও লোরকার মৃত্যুর সামান্য কিছু আগে দালি আবার লোরকার সঙ্গে সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ফ্রাঙ্কোর খুনে বাহিনী রিপাবলিকান লোরকাকে বাঁচার সুযোগ দেয়নি। লোরকা যেহেতু রিপাবলিকানদের সমর্থন করত, আর দালি ফ্রাঙ্কোকে তাই ওদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দুস্তর ব্যবধান। লোরকা আর আমি অনেক সময় কাটাতাম একসঙ্গে। উগার্তকে নিয়ে আমরা এল পাউলারের পাহাড়ে গাড়ি চালিয়ে যেতাম, সেখানকার গথিক স্তব্ধতায় কয়েক ঘণ্টা নিরুপদ্রবে কাটাব বলে। এখানকার সবই ভাঙাচোরা, কিন্তু ভেতরে কয়েকটা স্পার্টান ঘর ছিল ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউটের লোকজনদের জন্য। যখন যুদ্ধ চারপাশে ক্রুদ্ধ ড্রাগনের মতো গজরাচ্ছে তখন কবিতা বা চিত্রকলা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। ফ্রাঙ্কের অন্তিম আক্রমণের চার দিন আগে আবেগতাড়িত লোরকা আচমকা ঠিক করল সে গ্রানাদা যাবে, নিজের শহরে।

আমি অনেক অনুনয় করেছিলাম, এই সংকল্প থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে- ফেদেরিকো, বীভৎস সব কাণ্ড হচ্ছে। এখন তুমি ওখানে যেতে পারবে না, বরং এখানেই তুমি অনেকটা নিরাপদে থাকবে। আমাদের কোনো কথাকেই সে কান দিল না, খানিকটা ভীত ও উৎকণ্ঠিতভাবেই সে পরদিন গ্রানাদা চলে গেল। তার এই খুন হবার খবর ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল আমাদের। সারাজীবন যত মানুষ আমি দেখেছি, ফেদেরিকো ছিল তাদের সকলের সেরা। শুধু তার নাটক বা কবিতার কথা আমি বলছি না, মানুষ হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবে তার কোনো তুলনা হয় না।

পিয়ানোতে বসে শপার নকলই করুক অথবা উদ্ভাবন করুক নতুন কোনো মূকাভিনয়, কিংবা নাটকের কোনো দৃশ্য একাই দাপটে অভিনয় করে দেখাক, সে ছিল অপ্রতিরোধ্য। কবিতা পড়ত চমৎকার, আর ছিল আবেগ, সংরাগ, যৌবন আর আনন্দ। ছাত্রটোলায় যখন প্রথম তার সঙ্গে দেখা হয়, আমি ছিলাম গেঁয়ো, অপরিশীলিত, শুধুই খেলাধুলার দিকে ঝোঁক। সেই আমাকে পুরোপুরি রূপান্তরিত করে সম্পূর্ণ নতুন একটা জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সে ছিল আগুনের শিখা। তার মৃতদেহ কোনোদিনই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, তার মৃত্যু সম্বন্ধে রং চড়ানো সব গুজব ছড়াচ্ছিল চারপাশে। কেউ কেউ ইঙ্গিত করছিল সমকামীদের কারও ঈর্ষাই বুঝি কারণ। আসল কথা হল লোরকা খুন হয়েছে কারণ সে ছিল বিপ্লবী কবি। ‘বুদ্ধিজীবীদের খতম করো’- যুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্তদের এটা ছিল একটা প্রিয় জিগির। গ্রানাদায় গিয়ে সে সম্ভবত ফ্যালানজিস্ত কবি রোসালেসের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কারণ সে ছিল লোরকার পরিবারের ঘনিষ্ঠ। আমার ধারণা লোরকা ভেবেছিল রোসালেসদের বাড়িতে সে নিরাপদে থাকবে। কিন্তু আচমকা একরাতে একদল লোক অ্যালোঞ্জো বলে একজনের নেতৃত্বে এসে তাকে গ্রেফতার করে। এবং কয়েকজন বন্দি মজুরের সঙ্গে নিয়ে ট্রাক চালিয়ে উধাও হয়ে যায়। ফেদেরিকো কষ্ট আর মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পেত। আমি অনুমান করতে পারি সে কী অনুভব করেছিল সেই নিশুতি রাতে, একটা ট্রাক ছুটে চলেছে জলপাই বনের দিকে, সেখানে তাকে গুলি করে মারা হবে। এই ছবিটা এখনও মাঝে মাঝে আমাকে উদভ্রান্ত করে তোলে।

কয়েকদিন সেখানে বোন-ভগ্নিপতি আর তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে সারা বছরের সম্পদ আহরণ করে ফিরে আসতাম আমার বউ-ছেলেমেয়েদের সান্নিধ্যে। মাদ্রিদে এসে মাঝে মাঝেই আমি সবার অগোচরে চলে আসতাম আমাদের ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত ছাত্রটোলায়। মাদ্রিদের সেইসব বিকেল-রাত্রি, সালভাদোরের সঙ্গে পথে-পথে হাঁটা, সবই মনে আছে। আর ছোটো বাগানটায় ঘুরকে ঘুরতে মনে পড়ত ফেদেরিকো তোমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রথম দিনটার কথা। তখন তুমি সদ্য গ্রানাদা থেকে ফুয়েস্তে ভ্যাকুয়েস হয়ে ফিরে এসেছ সঙ্গে নিয়ে তোমার বইয়ের প্রথম কবিতা,

সবুজ তোমাকে আমি যেভাবে চাই

সবুজ বাতাস। সবুজ ভালোবাসা...

তোমার গলায় প্রথম শোনা সেই কবিতা। তোমার লেখা সেরা কবিতা। বিনা দ্বিধায় বলা যায় স্পেনীয় কাব্যে শ্রেষ্ঠ। তোমার ‘সবুজ বাতাস’ আমাদের সকলকে স্পর্শ করেছিল, তার সুর এখনও লেগে আছে আমাদের কাছে। না, ভুল বললাম, কানে নয়, আমাদের হৃদয়ে। আমরা যারা শুনতে পাচ্ছি আমাদের শেষ নিঃশ্বাসের শব্দ (Mon Dernier Soupir- My Last Sigh) তারা কিন্তু তোমাকে ভোলেনি। ফেদেরিকো তোমাকে আমরা ভুলব না।

‘ব্লাড ওয়েডিং’ নামকরণেই রয়েছে রক্তপাতের ইশারা। আমাদের উৎসবের শাড়িতে (ঢাকাই/বেনারসী) যেমন জরির কাজ, সেই রকমই লোরকার নাটকে ও কবিতার সর্বাঙ্গে রক্তের ঘন বুনোন। কিন্তু বিশেষ করে ‘ব্লাড ওয়েডিং’-এ তা যেন বৃষ্টির ধারার মতোই ভিজিয়ে দিয়েছে ধরাতল। এখানে যেন কবির অনুভূতিতে জীবন ও মৃত্যু মিলেমিশে একাকার। নাটকের তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে গ্রিক নাটকের কোরাসের মতোই তিনজন কাঠুরিয়ার সংলাপে ধ্বনিত হয়েছে সেই সুর,-

পুর্ণেন্দু পত্রী-র একটা লেখা থেকে আমরা পাচ্ছি-

‘বিশ্ব বিশাল। প্রত্যেকেই বাস করতে পারে এখানে।

কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করবে।

তোমাকে কিন্তু হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে তোমার প্যাশন। পালিয়ে গিয়ে ঠিকই করেছে ওরা।

তারা প্রত্যেকে প্রত্যেককে প্রতারিত করতে চাইছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে রক্ত।

রক্ত!

তোমাকে তো অনুগমন করতেই হবে সেই পথ, যা গড়েছে তোমার রক্ত।

তাতে কী হয়েছে? রক্তকে পচিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে নিজেকে রক্তে ভাসিয়ে মরা ঢের ভাল।’

এই সংলাপের মধ্যে কান পাতলে আমরা শুনতে পাই সভ্যতা ও রক্তপাতের সঙ্গে নিরত যুযুধান লোরকারই কণ্ঠস্বর।

‘পোয়েট ইন ন্যু-ইয়র্ক’ কবিতার বইয়ের শুরুতেই নিজের সম্পর্কে তিনি লিখছেন,-

‘মার্ডার্ড বাই হেভেন’ আর যা শেষও করেছেন ঐ একই কথায়,-

“ঝযধসনষরহম বধপয ফধু রিঃয সধু ফরভভবৎবহঃ ভধপব

অয, যবধাবহ সঁৎফবৎবফ ড়হব.”

আবার ঐ বইয়েরই তৃতীয় কবিতায়-

‘ডেইজির ক্রি ক্রি-র ভিতরে

যখন ভেঙে যায় বিশুদ্ধ সব গড়ন

তখনই মনে পড়ে তারা, কী ভাবে হত্যা করেছে আমাকেও।

তারা তছনছ করেছে কাফে, কবরখানা এবং গির্জা

উল্টে ফেলেছে মদের পিপে আর কাপড়-শুকোনো কল

তিনটে কঙ্কাল ঘেঁটে-ঘুঁটে তারা উপড়ে নিয়েছে তাদের দাঁতের সোনা

কিন্তু আমাকে, না আমার দেখা পায়নি কখনো।

কখনো দেখা পায়নি আমার?

না, কখনো দেখা পায়নি আমার।’

নিজেই এঁকে যান নিজের মৃত্যু-সম্ভাবনা এবং সেই সঙ্গে মৃত্যুহীনতাও।

প্রফেটিক কোয়ালিটিতে ভরপুর লোরকা তাঁর নাটকে একদিকে এনেছেন মা-কনে-শাশুড়িকে অন্যদিকে লিওনার্দোর সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রী-ঝি-প্রতিবেশিনী-শ্বশুর আর একদল যুবক-যুবতী ও তিনজন কাঠুরিয়াবেশী নিয়তি আর চাঁদ যে স্বয়ং মৃত্যু। এদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে এই নাটক। কিন্তু সামান্য মনোযোগেই আমাদের চোখে পড়বে আরো দুটো চরিত্র, যারা রক্ত মাংসের নয় ঠিকই, কিন্তু রক্ত মাংসের চরিত্রের মতোই খুবই উচ্চকিত, এর প্রথমটির নাম রক্ত, আর অন্যটি ছুরি।

নাটকের শুরুতেই আমরা দেখি, বর চরিত্রটি তাদের আঙুরের ক্ষেতে যাবার আগে মা-কে জানায়, সকালের খাবার পাবার আগে তার বেশি প্রয়োজন একটি ছুটি। ছুটি খুঁজে না-পেয়ে সে সকলকে অভিসম্পাত দিতে থাকে। সেই সঙ্গে সেই স্কাউনড্রেলকেও, ছুরি যার আবিষ্কার। ছুরি থেকে তার গালাগালি ছড়িয়ে পড়ে কামান, বন্দুক, ছোট মাপের হাত-ছুরি থেকে নিড়–নি এমনকি পিচফর্ক পর্যন্ত- যা কিছুই ছিন্নভিন্ন করতে পারে মানুষকে, মানুষের বাঁচার দুর্মর শক্তি ও স্বপ্নকে। আর এই ছুরির সুবাদে আমাদের সামনে ধীরে ধীরে খুলে যেতে থাকে অতীতের ঘটনাক্রম- আমাদের জানা হয়ে যায় প্রতিপক্ষের অস্ত্রাঘাতে নিহত স্বামী ও পুত্রের অকাল মৃত্যুর কথা। নাটকের প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে লিওনার্দোর বাড়িতে, লিওনার্দোর মা ও স্ত্রী ছেলে ভুলানো ছড়া গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে তার শিশুপুত্রকে। সেই ছড়া-গানে থেকে থেকেই ঘুরে ফিরে আসে এক রক্তাক্ত ঘোড়ার জলাতঙ্ক ও জলতৃষ্ণার বিরবণ, যার গভীর চোখের চাউনিতে গাঁথা হয়ে আছে এক রুপালি ছোরা।

নাটকের তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে রক্ত এবং ছুরি পৌঁছে যায় পারস্পরিক সমঝোতায়, কেননা দুজনেই তখন বুঝে গেছে যে একটা নির্দিষ্ট হত্যাকা-ের জন্য তাদের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হবে এখুনি। মৃত্যুর দূত হিসেবে, কাঠুরিয়ার ছদ্মবেশে, সাদা মুখে আর গাঢ় নীল আভার বিচ্ছুরণে যখন মঞ্চে প্রবেশ করে চাঁদ, তখন থেকেই রক্তের প্রয়োজনে ছুরির ভূমিকা হয়ে উঠতে থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতির মতো অনিবার্য। রক্তের পিপাসায় উদ্বেল চাঁদের সংলাপে আমরা তাই শুনি-

‘চাঁদ একটা ছুরিকে ছুরে দিয়েছে বাতাসে

যার ধাতব আক্রমণে রক্তের যন্ত্রণা হয়ে উঠবে অস্থির।’

চাঁদের কাছে আজ এগিয়ে এসেছে সেই শুভরাত্রি যে তার গালকে রাঙিয়ে দেবে রক্তে রক্তে।

বুড়ি ভিখারিণীর ছদ্মবেশে মৃত্যু তার কানে কানে শোনায় সেই পরামর্শ,-

প্রজ্বলিত করো তোমার ওয়েস্টকোট, খুলে দাও সব বোতাম, এরপর ছুরি নিজেই পেয়ে যাবে তার এগোনোর পথ।

চাঁদের কণ্ঠস্বরে, মৃত্যুর কাছে এখন একটাই প্রগাঢ় কামনা,- কিন্তু তাদের মৃত করে রাখো বহুক্ষণ। তাহলেই আমার আঙুলগুলোর ফাঁক দিয়ে গলগল করে গড়িয়ে যাবে তাদের রক্তস্রোত।

এরপর কার্লো সওরার সিনেমায় ব্যালের ফর্মে নাটক এগিয়ে যায় তার নির্দিষ্ট রক্তাক্ত অন্ধকারের দিকে।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

রক্তে রাঙানো বিবাহ বাসর

সুরঞ্জন রায়

শুক্রবার, ০২ এপ্রিল ২০২১

লোরকা-র (১৮৯৮) জন্ম স্পেনের গ্রানাদায়। উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্রটোলায় এসেই তিনি জড়িয়ে পড়লেন লুই বুনুয়েল ও সালভাদর দালির বন্ধুত্বের ফাঁদে। এই তিনজনের সৃষ্ট শিল্পের মধ্যেও কাজ করেছিল এক অনুচ্চারিত ভালবাসা। লোরকা লিখেছিলেন Ode to Selvadore Dali. লোরকার মৃত্যুও দালিকে আচ্ছন্ন করেছিল গভীর বিষণ্নতায়। কিন্তু সম্পর্কের জটিলতাকে বরণ করে নিয়েই এই শিল্পীরা উধাও হয়ে গিয়েছিলেন জীবনের যাত্রাপথে। গভীর বন্ধুত্বের মধ্যেও লোরকার কবিতায় স্পেনের লোকজীবনের প্রগাঢ় উচ্চারণ দালিকে করে তুলেছিল অসহিষ্ণু; যদিও সমাজের ধনী সম্প্রদায়কে তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন তিনি।

বছর চারেকের বড়ো বুনুয়েল শিল্পী দালিকে মাদ্রিদের নৈশজীবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতা ও নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি অবিচল থাকার জন্য বুনুয়েল বন্ধু দালির কাছ থেকে যথেষ্ট সম্মান ও প্রশংসা আদায় করে নিতেন। তবে দালি ও বুনয়েলের যে প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল লোরকার প্রতি, তা তাদের জীবনে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে। বুনুয়েল ও দালি নিজেদের জীবন ও স্মৃতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন। সেই যন্ত্রণাদগ্ধ এবং শিল্পময় অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ স্মরণীয় গ্রন্থে জীবন ও কালের ইতিহাস পাশপাশি হেঁটেছে। এখানে আপনাদের অনুমতি নিয়ে বুনুয়েলের স্বপ্ন থেকে একটা টুকরো চুরি করে পেশ করছি আপনাদের সামনে-

একটা শতকের চলে যাওয়া আর নতুন একটা শতকের আবির্ভাবের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটাই আমার আত্মার মধ্যে চিরদিন প্রতিফলিত হয়েছে। আমি জন্মেছিলাম ১৯০০ সালে। আমার চেয়ে চার বছরের ছোট প্রবল প্রতিভাবান দালির সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা সকলেই জানে। ওর সঙ্গে যেমনই গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল আমার, তেমনই ছিল ঝগড়াঝাটি। কিন্তু দালির চেয়েও আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছিল আমার চেয়ে দু-বছরের বড়ো ফেদোরিকো। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। সকলেই তাকে খুব ভালবাসত। তার গলার স্বরের মায়াবী পেলবতার মধ্যে লুকিয়েছিল এক বজ্রনির্ঘোষ। সকলেরই মনের দরজা তার জন্য ছিল অবারিত- সে বুদ্ধিজীবী তরুণ ছোকড়াই হোক, অথবা অশিক্ষিত গ্রামের কৃষকই হোক। আর সে কারণেই তার কবিতা আমাকে টানত এত বেশি করে। তার সমাজভাবনা আর যৌনচিন্তার অমলিন উচ্চারণ প্রথমদিকে স্পেনের সরকারকে ততটা বিব্রত করেনি। কিন্তু তার যন্ত্রণার প্রবল উচ্চারণ ছাপিয়ে গিয়েছিল ফ্যাসিস্ত বন্দুকের গর্জনকেও। আমি আজও দেখতে পাই ফ্র্যাঙ্কোর গুপ্তচরেরা যখন তার তরতাজা সুকোমল দেহটাকে বন্দুকের গুলিতে গুলিতে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, তখন, সেই মুহূর্তে তার হাত থেকে ছিটাকে পড়ছে সদ্যসমাপ্ত তার নাটক Bodas de Sangre, (যার বাংলা নাম হতে পারে, রক্তে রাঙানো বিবাহ-বাসর)-এর একটা কপি, ফিনকি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া সবুজ রঙের রক্ত ক্রমশই ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে তার রক্তলাল বইয়ের মলাটটা। ওকে নিয়ে যদি কোনোদিন আমি ছবি বানাই তবে, এটাই হবে প্রথম দৃশ্য।

১৯২৫ সালে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর মা’র অনুমতি মেলায় সে বছরই আমি এসে পৌঁছলাম প্যারিসে। একটু আগে-পরে দালি আর লোরকাও এসে যোগ দিল আমার সঙ্গে। একদিন আমরা তিনজনে মিলে একটা সিনেমা দেখলাম- ফ্রিজ ল্যাং-এর ‘মেট্রোপলিস। ছবিটা আমাদের তিনজনকেই নাড়া দিল গভীরভাবে। আর এর পর পরই আমি পা বাড়ালাম ছবির জগতের দিকে। জাঁ এপস্টাইন-এর সহকারী হিসেবে কয়েকটা ছবির কাজে জড়িয়ে পড়লাম আমি।

সে-সময় কবি হিসেবে লোরকার চারদিকে খুব নামডাক। লোরকা-দালি-র সম্পর্ক নিয়ে বন্ধুমহলে তখন ফিসফাস আর হাসাহাসি। অবশ্য দালি তখন শিল্পজগতে নিজের জায়গাটা বেশ পাকাপোক্ত করে নিচ্ছিল। একদিন সে পিকাসোর সঙ্গে দেখা করতে গেল। দালির প্রতিভার খবর অবশ্য আগাম পৌঁছে গিয়েছিল মহান শিল্পীর কাছে। গভীর আলোচনা চলল দুজনের মধ্যে নানান বিষয় নিয়ে। পিকাসো দালিকে পরামর্শ দিলেন, ইতিহাসকে স্যুরিয়ালিজমের দৃষ্টিতে অনুভব করে শিল্পে তার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে। সেদিন আমাদের সান্ধ্য মজলিশে দালির অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে আমরা ঠিক করে ফেললাম ছবি একটা আমাদের বানাতেই হবে! একই দিনে আমি ও দালি দুজনেই দুটো স্বপ্ন দেখি, দালির স্বপ্নে ভেসে আসে একটা কাটা হাত যাকে অসংখ্য পিঁপড়ে বয়ে নিয়ে চলেছে, আর আমার বীভৎস স্বপ্নে দেখতে পাই একটা পাতলা ছুরি দিয়ে দু-ফালা করে ফেলা হচ্ছে একটা চোখকে। এই স্বপ্ন দুটোর ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠল আমাদের প্রথম ছবির চিত্রনাট্য। পরিচালনার ভার থাকে আমারই ওপর। তিনজনে আলোচনা করে আমরা যে চিত্রনাট্যের খসড়া দাঁড় করালাম তার থেকে লোরকা সরে দাঁড়ানোয় এবং ছবিতে তাঁর নাম ব্যবহারে আপত্তি জানানোয় শেষ পর্যন্ত টাইটেল কার্ড থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।

এর অল্প দিনের মধ্যেই দালির জীবনে আসে ফরাসি কবি পল এল্যুয়ারের স্ত্রী গালা। দালির অনুরোধে এল্যুয়ার সস্ত্রীক এসে উপস্থিত হলেন সমুদ্রঘেরা নয়নাভিরাম ক্যাডাকে- বন্ধুর বাংলোতে, এবং তখনই দালি উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে গালাকে পাবার জন্য। শিল্প-মনস্ক গালার প্রেমও ঝরনার মতো ধাবিত হল দালির দিকে। এরপরও এল্যুয়ার কিন্তু সারা জীবন দালির সঙ্গে স্বাভাবিক সদ্ভাব বজায় রেখে যান। ১৯৩৪ সালে বিয়ে করে দশ বছরের বড়ো গালার প্রেমে অবগাহন করতে করতেই দালি তার সুদীর্ঘ জীবনটা কাটিয়ে দেন। বিষণœতায় আক্রান্ত লোরকা এই ঘটনার পরই আমেরিকায় গিয়ে গা ঢাকা দেয়।

উনিশ শো তিরিশের মাঝামাঝি সময় থেকেই স্পেনের রাজনীতির আকাশকে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ করে দেখা দেয় এক কালো রাত্রির যুগ। ফ্রাঙ্কো তার মরক্কোর সেনাবাহিনী নিয়ে পৌঁছে গেল স্পেনে, তার বাসনা ছিল ‘রিপাবলিক’-কে উচ্ছেদ করে তার নিজের ‘শৃঙ্খলা’ প্রতিষ্ঠা করবে। একদিন ভোরবেলা একঝাঁক বিস্ফোরণ আর কামানের আওয়াজে আমি আতঙ্কে জেগে উঠলাম। একটি রিপাকলিকান বিমান মোস্তানিয়ার ফৌজি ব্যারাকে বোমা ফেলছে। সে সময় স্পেনের সমস্ত ব্যারাকেই সৈন্যসামন্ত গিজগিজ করছে। একদল ফ্যালানজিস্ত মোস্তানিয়ায় গোপন আস্তানা গেড়েছিল, কয়েকদিন ধরেই ওরা জানালা থেকে গুলি চালাচ্ছিল, অনেক সাধারণ মানুষ তাতে জখমও হয়েছিল। আজ আঠারো জুলাইয়ে (১৯৩৪) সকালে আজানিয়ার রিপাবলিকানদের একদল শ্রমিক ব্যারাকগুলোতে গিয়ে চড়াও হয়। বেলা দশটার মধ্যেই সব শেষ বিদ্রোহী অফিসার ও ফ্যালানজিস্তরা খতম। যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে।

আমার ব্যালকনি থেকে দূরের মেসিনগানের আওয়াজ শুনতে শুনতে আমি দেখতে পেলাম নিচের রাস্তা দিয়ে জনা দুই শ্রমিক আর কয়েকজন জিপসি একটা স্লাইডার কামান টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যে বিপ্লব এত বছর ধরে ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করছিল বলে আমরা অনুভব করছিলাম, আমি নিজে যা ব্যক্তিগতভাবে এত উৎসাহভরে চাইছিলাম, আজ সে আমার চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করছে, চোখের সামনে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, আমি শুধু একটা জোর ঝাঁকুনি খেলাম।

একদিন এক রিপাবলিকানের কাছে খবর পেলাম ফেদারিকো গার্সিয়া লোরকা খুন হয়েছে। ‘আন্দালুশিয়ার কুকুর’ তৈরির কিছুদিন আগে লোরকা আর আমার মধ্যে একটু মন কষাকষি হয়েছিল। সে যেহেতু রোগাপটকা আন্দালুশীয়, তাই সে ভেবেছিল ছবিটা বুঝি তার উদ্দেশ্যেই আমার ব্যক্তিগত আক্রমণ। সে লোকজনকে বলতো, ‘বুনুয়েল একটা ছোট্ট ছবি বানিয়েছে, তার নাম ‘আন্দালুশিয়ার কুকুর’- আমার মনে হয় আমিই সেই কুকুর।’

১৯৩৪ সালের শেষের দিকে ও আমেরিকা থেকে ফিরে এলে আমাদের মধ্যে অবশ্য বন্ধুত্ব আবার ফিরে আসে। দালির সঙ্গে কিন্তু ওর সম্পর্কের ভাঙনটা আর তেমনভাবে জোড়া লাগেনি। যদিও লোরকার মৃত্যুর সামান্য কিছু আগে দালি আবার লোরকার সঙ্গে সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ফ্রাঙ্কোর খুনে বাহিনী রিপাবলিকান লোরকাকে বাঁচার সুযোগ দেয়নি। লোরকা যেহেতু রিপাবলিকানদের সমর্থন করত, আর দালি ফ্রাঙ্কোকে তাই ওদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দুস্তর ব্যবধান। লোরকা আর আমি অনেক সময় কাটাতাম একসঙ্গে। উগার্তকে নিয়ে আমরা এল পাউলারের পাহাড়ে গাড়ি চালিয়ে যেতাম, সেখানকার গথিক স্তব্ধতায় কয়েক ঘণ্টা নিরুপদ্রবে কাটাব বলে। এখানকার সবই ভাঙাচোরা, কিন্তু ভেতরে কয়েকটা স্পার্টান ঘর ছিল ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউটের লোকজনদের জন্য। যখন যুদ্ধ চারপাশে ক্রুদ্ধ ড্রাগনের মতো গজরাচ্ছে তখন কবিতা বা চিত্রকলা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। ফ্রাঙ্কের অন্তিম আক্রমণের চার দিন আগে আবেগতাড়িত লোরকা আচমকা ঠিক করল সে গ্রানাদা যাবে, নিজের শহরে।

আমি অনেক অনুনয় করেছিলাম, এই সংকল্প থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে- ফেদেরিকো, বীভৎস সব কাণ্ড হচ্ছে। এখন তুমি ওখানে যেতে পারবে না, বরং এখানেই তুমি অনেকটা নিরাপদে থাকবে। আমাদের কোনো কথাকেই সে কান দিল না, খানিকটা ভীত ও উৎকণ্ঠিতভাবেই সে পরদিন গ্রানাদা চলে গেল। তার এই খুন হবার খবর ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল আমাদের। সারাজীবন যত মানুষ আমি দেখেছি, ফেদেরিকো ছিল তাদের সকলের সেরা। শুধু তার নাটক বা কবিতার কথা আমি বলছি না, মানুষ হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবে তার কোনো তুলনা হয় না।

পিয়ানোতে বসে শপার নকলই করুক অথবা উদ্ভাবন করুক নতুন কোনো মূকাভিনয়, কিংবা নাটকের কোনো দৃশ্য একাই দাপটে অভিনয় করে দেখাক, সে ছিল অপ্রতিরোধ্য। কবিতা পড়ত চমৎকার, আর ছিল আবেগ, সংরাগ, যৌবন আর আনন্দ। ছাত্রটোলায় যখন প্রথম তার সঙ্গে দেখা হয়, আমি ছিলাম গেঁয়ো, অপরিশীলিত, শুধুই খেলাধুলার দিকে ঝোঁক। সেই আমাকে পুরোপুরি রূপান্তরিত করে সম্পূর্ণ নতুন একটা জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সে ছিল আগুনের শিখা। তার মৃতদেহ কোনোদিনই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, তার মৃত্যু সম্বন্ধে রং চড়ানো সব গুজব ছড়াচ্ছিল চারপাশে। কেউ কেউ ইঙ্গিত করছিল সমকামীদের কারও ঈর্ষাই বুঝি কারণ। আসল কথা হল লোরকা খুন হয়েছে কারণ সে ছিল বিপ্লবী কবি। ‘বুদ্ধিজীবীদের খতম করো’- যুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্তদের এটা ছিল একটা প্রিয় জিগির। গ্রানাদায় গিয়ে সে সম্ভবত ফ্যালানজিস্ত কবি রোসালেসের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কারণ সে ছিল লোরকার পরিবারের ঘনিষ্ঠ। আমার ধারণা লোরকা ভেবেছিল রোসালেসদের বাড়িতে সে নিরাপদে থাকবে। কিন্তু আচমকা একরাতে একদল লোক অ্যালোঞ্জো বলে একজনের নেতৃত্বে এসে তাকে গ্রেফতার করে। এবং কয়েকজন বন্দি মজুরের সঙ্গে নিয়ে ট্রাক চালিয়ে উধাও হয়ে যায়। ফেদেরিকো কষ্ট আর মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পেত। আমি অনুমান করতে পারি সে কী অনুভব করেছিল সেই নিশুতি রাতে, একটা ট্রাক ছুটে চলেছে জলপাই বনের দিকে, সেখানে তাকে গুলি করে মারা হবে। এই ছবিটা এখনও মাঝে মাঝে আমাকে উদভ্রান্ত করে তোলে।

কয়েকদিন সেখানে বোন-ভগ্নিপতি আর তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে সারা বছরের সম্পদ আহরণ করে ফিরে আসতাম আমার বউ-ছেলেমেয়েদের সান্নিধ্যে। মাদ্রিদে এসে মাঝে মাঝেই আমি সবার অগোচরে চলে আসতাম আমাদের ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত ছাত্রটোলায়। মাদ্রিদের সেইসব বিকেল-রাত্রি, সালভাদোরের সঙ্গে পথে-পথে হাঁটা, সবই মনে আছে। আর ছোটো বাগানটায় ঘুরকে ঘুরতে মনে পড়ত ফেদেরিকো তোমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রথম দিনটার কথা। তখন তুমি সদ্য গ্রানাদা থেকে ফুয়েস্তে ভ্যাকুয়েস হয়ে ফিরে এসেছ সঙ্গে নিয়ে তোমার বইয়ের প্রথম কবিতা,

সবুজ তোমাকে আমি যেভাবে চাই

সবুজ বাতাস। সবুজ ভালোবাসা...

তোমার গলায় প্রথম শোনা সেই কবিতা। তোমার লেখা সেরা কবিতা। বিনা দ্বিধায় বলা যায় স্পেনীয় কাব্যে শ্রেষ্ঠ। তোমার ‘সবুজ বাতাস’ আমাদের সকলকে স্পর্শ করেছিল, তার সুর এখনও লেগে আছে আমাদের কাছে। না, ভুল বললাম, কানে নয়, আমাদের হৃদয়ে। আমরা যারা শুনতে পাচ্ছি আমাদের শেষ নিঃশ্বাসের শব্দ (Mon Dernier Soupir- My Last Sigh) তারা কিন্তু তোমাকে ভোলেনি। ফেদেরিকো তোমাকে আমরা ভুলব না।

‘ব্লাড ওয়েডিং’ নামকরণেই রয়েছে রক্তপাতের ইশারা। আমাদের উৎসবের শাড়িতে (ঢাকাই/বেনারসী) যেমন জরির কাজ, সেই রকমই লোরকার নাটকে ও কবিতার সর্বাঙ্গে রক্তের ঘন বুনোন। কিন্তু বিশেষ করে ‘ব্লাড ওয়েডিং’-এ তা যেন বৃষ্টির ধারার মতোই ভিজিয়ে দিয়েছে ধরাতল। এখানে যেন কবির অনুভূতিতে জীবন ও মৃত্যু মিলেমিশে একাকার। নাটকের তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে গ্রিক নাটকের কোরাসের মতোই তিনজন কাঠুরিয়ার সংলাপে ধ্বনিত হয়েছে সেই সুর,-

পুর্ণেন্দু পত্রী-র একটা লেখা থেকে আমরা পাচ্ছি-

‘বিশ্ব বিশাল। প্রত্যেকেই বাস করতে পারে এখানে।

কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করবে।

তোমাকে কিন্তু হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে তোমার প্যাশন। পালিয়ে গিয়ে ঠিকই করেছে ওরা।

তারা প্রত্যেকে প্রত্যেককে প্রতারিত করতে চাইছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে রক্ত।

রক্ত!

তোমাকে তো অনুগমন করতেই হবে সেই পথ, যা গড়েছে তোমার রক্ত।

তাতে কী হয়েছে? রক্তকে পচিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে নিজেকে রক্তে ভাসিয়ে মরা ঢের ভাল।’

এই সংলাপের মধ্যে কান পাতলে আমরা শুনতে পাই সভ্যতা ও রক্তপাতের সঙ্গে নিরত যুযুধান লোরকারই কণ্ঠস্বর।

‘পোয়েট ইন ন্যু-ইয়র্ক’ কবিতার বইয়ের শুরুতেই নিজের সম্পর্কে তিনি লিখছেন,-

‘মার্ডার্ড বাই হেভেন’ আর যা শেষও করেছেন ঐ একই কথায়,-

“ঝযধসনষরহম বধপয ফধু রিঃয সধু ফরভভবৎবহঃ ভধপব

অয, যবধাবহ সঁৎফবৎবফ ড়হব.”

আবার ঐ বইয়েরই তৃতীয় কবিতায়-

‘ডেইজির ক্রি ক্রি-র ভিতরে

যখন ভেঙে যায় বিশুদ্ধ সব গড়ন

তখনই মনে পড়ে তারা, কী ভাবে হত্যা করেছে আমাকেও।

তারা তছনছ করেছে কাফে, কবরখানা এবং গির্জা

উল্টে ফেলেছে মদের পিপে আর কাপড়-শুকোনো কল

তিনটে কঙ্কাল ঘেঁটে-ঘুঁটে তারা উপড়ে নিয়েছে তাদের দাঁতের সোনা

কিন্তু আমাকে, না আমার দেখা পায়নি কখনো।

কখনো দেখা পায়নি আমার?

না, কখনো দেখা পায়নি আমার।’

নিজেই এঁকে যান নিজের মৃত্যু-সম্ভাবনা এবং সেই সঙ্গে মৃত্যুহীনতাও।

প্রফেটিক কোয়ালিটিতে ভরপুর লোরকা তাঁর নাটকে একদিকে এনেছেন মা-কনে-শাশুড়িকে অন্যদিকে লিওনার্দোর সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রী-ঝি-প্রতিবেশিনী-শ্বশুর আর একদল যুবক-যুবতী ও তিনজন কাঠুরিয়াবেশী নিয়তি আর চাঁদ যে স্বয়ং মৃত্যু। এদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে এই নাটক। কিন্তু সামান্য মনোযোগেই আমাদের চোখে পড়বে আরো দুটো চরিত্র, যারা রক্ত মাংসের নয় ঠিকই, কিন্তু রক্ত মাংসের চরিত্রের মতোই খুবই উচ্চকিত, এর প্রথমটির নাম রক্ত, আর অন্যটি ছুরি।

নাটকের শুরুতেই আমরা দেখি, বর চরিত্রটি তাদের আঙুরের ক্ষেতে যাবার আগে মা-কে জানায়, সকালের খাবার পাবার আগে তার বেশি প্রয়োজন একটি ছুটি। ছুটি খুঁজে না-পেয়ে সে সকলকে অভিসম্পাত দিতে থাকে। সেই সঙ্গে সেই স্কাউনড্রেলকেও, ছুরি যার আবিষ্কার। ছুরি থেকে তার গালাগালি ছড়িয়ে পড়ে কামান, বন্দুক, ছোট মাপের হাত-ছুরি থেকে নিড়–নি এমনকি পিচফর্ক পর্যন্ত- যা কিছুই ছিন্নভিন্ন করতে পারে মানুষকে, মানুষের বাঁচার দুর্মর শক্তি ও স্বপ্নকে। আর এই ছুরির সুবাদে আমাদের সামনে ধীরে ধীরে খুলে যেতে থাকে অতীতের ঘটনাক্রম- আমাদের জানা হয়ে যায় প্রতিপক্ষের অস্ত্রাঘাতে নিহত স্বামী ও পুত্রের অকাল মৃত্যুর কথা। নাটকের প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে লিওনার্দোর বাড়িতে, লিওনার্দোর মা ও স্ত্রী ছেলে ভুলানো ছড়া গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে তার শিশুপুত্রকে। সেই ছড়া-গানে থেকে থেকেই ঘুরে ফিরে আসে এক রক্তাক্ত ঘোড়ার জলাতঙ্ক ও জলতৃষ্ণার বিরবণ, যার গভীর চোখের চাউনিতে গাঁথা হয়ে আছে এক রুপালি ছোরা।

নাটকের তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে রক্ত এবং ছুরি পৌঁছে যায় পারস্পরিক সমঝোতায়, কেননা দুজনেই তখন বুঝে গেছে যে একটা নির্দিষ্ট হত্যাকা-ের জন্য তাদের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হবে এখুনি। মৃত্যুর দূত হিসেবে, কাঠুরিয়ার ছদ্মবেশে, সাদা মুখে আর গাঢ় নীল আভার বিচ্ছুরণে যখন মঞ্চে প্রবেশ করে চাঁদ, তখন থেকেই রক্তের প্রয়োজনে ছুরির ভূমিকা হয়ে উঠতে থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতির মতো অনিবার্য। রক্তের পিপাসায় উদ্বেল চাঁদের সংলাপে আমরা তাই শুনি-

‘চাঁদ একটা ছুরিকে ছুরে দিয়েছে বাতাসে

যার ধাতব আক্রমণে রক্তের যন্ত্রণা হয়ে উঠবে অস্থির।’

চাঁদের কাছে আজ এগিয়ে এসেছে সেই শুভরাত্রি যে তার গালকে রাঙিয়ে দেবে রক্তে রক্তে।

বুড়ি ভিখারিণীর ছদ্মবেশে মৃত্যু তার কানে কানে শোনায় সেই পরামর্শ,-

প্রজ্বলিত করো তোমার ওয়েস্টকোট, খুলে দাও সব বোতাম, এরপর ছুরি নিজেই পেয়ে যাবে তার এগোনোর পথ।

চাঁদের কণ্ঠস্বরে, মৃত্যুর কাছে এখন একটাই প্রগাঢ় কামনা,- কিন্তু তাদের মৃত করে রাখো বহুক্ষণ। তাহলেই আমার আঙুলগুলোর ফাঁক দিয়ে গলগল করে গড়িয়ে যাবে তাদের রক্তস্রোত।

এরপর কার্লো সওরার সিনেমায় ব্যালের ফর্মে নাটক এগিয়ে যায় তার নির্দিষ্ট রক্তাক্ত অন্ধকারের দিকে।লোরকা-র (১৮৯৮) জন্ম স্পেনের গ্রানাদায়। উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্রটোলায় এসেই তিনি জড়িয়ে পড়লেন লুই বুনুয়েল ও সালভাদর দালির বন্ধুত্বের ফাঁদে। এই তিনজনের সৃষ্ট শিল্পের মধ্যেও কাজ করেছিল এক অনুচ্চারিত ভালবাসা। লোরকা লিখেছিলেন Ode to Selvadore Dali. লোরকার মৃত্যুও দালিকে আচ্ছন্ন করেছিল গভীর বিষণ্নতায়। কিন্তু সম্পর্কের জটিলতাকে বরণ করে নিয়েই এই শিল্পীরা উধাও হয়ে গিয়েছিলেন জীবনের যাত্রাপথে। গভীর বন্ধুত্বের মধ্যেও লোরকার কবিতায় স্পেনের লোকজীবনের প্রগাঢ় উচ্চারণ দালিকে করে তুলেছিল অসহিষ্ণু; যদিও সমাজের ধনী সম্প্রদায়কে তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন তিনি।

বছর চারেকের বড়ো বুনুয়েল শিল্পী দালিকে মাদ্রিদের নৈশজীবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতা ও নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি অবিচল থাকার জন্য বুনুয়েল বন্ধু দালির কাছ থেকে যথেষ্ট সম্মান ও প্রশংসা আদায় করে নিতেন। তবে দালি ও বুনয়েলের যে প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল লোরকার প্রতি, তা তাদের জীবনে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে। বুনুয়েল ও দালি নিজেদের জীবন ও স্মৃতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন। সেই যন্ত্রণাদগ্ধ এবং শিল্পময় অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ স্মরণীয় গ্রন্থে জীবন ও কালের ইতিহাস পাশপাশি হেঁটেছে। এখানে আপনাদের অনুমতি নিয়ে বুনুয়েলের স্বপ্ন থেকে একটা টুকরো চুরি করে পেশ করছি আপনাদের সামনে-

একটা শতকের চলে যাওয়া আর নতুন একটা শতকের আবির্ভাবের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটাই আমার আত্মার মধ্যে চিরদিন প্রতিফলিত হয়েছে। আমি জন্মেছিলাম ১৯০০ সালে। আমার চেয়ে চার বছরের ছোট প্রবল প্রতিভাবান দালির সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা সকলেই জানে। ওর সঙ্গে যেমনই গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল আমার, তেমনই ছিল ঝগড়াঝাটি। কিন্তু দালির চেয়েও আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছিল আমার চেয়ে দু-বছরের বড়ো ফেদোরিকো। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। সকলেই তাকে খুব ভালবাসত। তার গলার স্বরের মায়াবী পেলবতার মধ্যে লুকিয়েছিল এক বজ্রনির্ঘোষ। সকলেরই মনের দরজা তার জন্য ছিল অবারিত- সে বুদ্ধিজীবী তরুণ ছোকড়াই হোক, অথবা অশিক্ষিত গ্রামের কৃষকই হোক। আর সে কারণেই তার কবিতা আমাকে টানত এত বেশি করে। তার সমাজভাবনা আর যৌনচিন্তার অমলিন উচ্চারণ প্রথমদিকে স্পেনের সরকারকে ততটা বিব্রত করেনি। কিন্তু তার যন্ত্রণার প্রবল উচ্চারণ ছাপিয়ে গিয়েছিল ফ্যাসিস্ত বন্দুকের গর্জনকেও। আমি আজও দেখতে পাই ফ্র্যাঙ্কোর গুপ্তচরেরা যখন তার তরতাজা সুকোমল দেহটাকে বন্দুকের গুলিতে গুলিতে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, তখন, সেই মুহূর্তে তার হাত থেকে ছিটাকে পড়ছে সদ্যসমাপ্ত তার নাটক Bodas de Sangre, (যার বাংলা নাম হতে পারে, রক্তে রাঙানো বিবাহ-বাসর)-এর একটা কপি, ফিনকি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া সবুজ রঙের রক্ত ক্রমশই ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে তার রক্তলাল বইয়ের মলাটটা। ওকে নিয়ে যদি কোনোদিন আমি ছবি বানাই তবে, এটাই হবে প্রথম দৃশ্য।

১৯২৫ সালে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর মা’র অনুমতি মেলায় সে বছরই আমি এসে পৌঁছলাম প্যারিসে। একটু আগে-পরে দালি আর লোরকাও এসে যোগ দিল আমার সঙ্গে। একদিন আমরা তিনজনে মিলে একটা সিনেমা দেখলাম- ফ্রিজ ল্যাং-এর ‘মেট্রোপলিস। ছবিটা আমাদের তিনজনকেই নাড়া দিল গভীরভাবে। আর এর পর পরই আমি পা বাড়ালাম ছবির জগতের দিকে। জাঁ এপস্টাইন-এর সহকারী হিসেবে কয়েকটা ছবির কাজে জড়িয়ে পড়লাম আমি।

সে-সময় কবি হিসেবে লোরকার চারদিকে খুব নামডাক। লোরকা-দালি-র সম্পর্ক নিয়ে বন্ধুমহলে তখন ফিসফাস আর হাসাহাসি। অবশ্য দালি তখন শিল্পজগতে নিজের জায়গাটা বেশ পাকাপোক্ত করে নিচ্ছিল। একদিন সে পিকাসোর সঙ্গে দেখা করতে গেল। দালির প্রতিভার খবর অবশ্য আগাম পৌঁছে গিয়েছিল মহান শিল্পীর কাছে। গভীর আলোচনা চলল দুজনের মধ্যে নানান বিষয় নিয়ে। পিকাসো দালিকে পরামর্শ দিলেন, ইতিহাসকে স্যুরিয়ালিজমের দৃষ্টিতে অনুভব করে শিল্পে তার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে। সেদিন আমাদের সান্ধ্য মজলিশে দালির অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে আমরা ঠিক করে ফেললাম ছবি একটা আমাদের বানাতেই হবে! একই দিনে আমি ও দালি দুজনেই দুটো স্বপ্ন দেখি, দালির স্বপ্নে ভেসে আসে একটা কাটা হাত যাকে অসংখ্য পিঁপড়ে বয়ে নিয়ে চলেছে, আর আমার বীভৎস স্বপ্নে দেখতে পাই একটা পাতলা ছুরি দিয়ে দু-ফালা করে ফেলা হচ্ছে একটা চোখকে। এই স্বপ্ন দুটোর ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠল আমাদের প্রথম ছবির চিত্রনাট্য। পরিচালনার ভার থাকে আমারই ওপর। তিনজনে আলোচনা করে আমরা যে চিত্রনাট্যের খসড়া দাঁড় করালাম তার থেকে লোরকা সরে দাঁড়ানোয় এবং ছবিতে তাঁর নাম ব্যবহারে আপত্তি জানানোয় শেষ পর্যন্ত টাইটেল কার্ড থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।

এর অল্প দিনের মধ্যেই দালির জীবনে আসে ফরাসি কবি পল এল্যুয়ারের স্ত্রী গালা। দালির অনুরোধে এল্যুয়ার সস্ত্রীক এসে উপস্থিত হলেন সমুদ্রঘেরা নয়নাভিরাম ক্যাডাকে- বন্ধুর বাংলোতে, এবং তখনই দালি উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে গালাকে পাবার জন্য। শিল্প-মনস্ক গালার প্রেমও ঝরনার মতো ধাবিত হল দালির দিকে। এরপরও এল্যুয়ার কিন্তু সারা জীবন দালির সঙ্গে স্বাভাবিক সদ্ভাব বজায় রেখে যান। ১৯৩৪ সালে বিয়ে করে দশ বছরের বড়ো গালার প্রেমে অবগাহন করতে করতেই দালি তার সুদীর্ঘ জীবনটা কাটিয়ে দেন। বিষণœতায় আক্রান্ত লোরকা এই ঘটনার পরই আমেরিকায় গিয়ে গা ঢাকা দেয়।

উনিশ শো তিরিশের মাঝামাঝি সময় থেকেই স্পেনের রাজনীতির আকাশকে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ করে দেখা দেয় এক কালো রাত্রির যুগ। ফ্রাঙ্কো তার মরক্কোর সেনাবাহিনী নিয়ে পৌঁছে গেল স্পেনে, তার বাসনা ছিল ‘রিপাবলিক’-কে উচ্ছেদ করে তার নিজের ‘শৃঙ্খলা’ প্রতিষ্ঠা করবে। একদিন ভোরবেলা একঝাঁক বিস্ফোরণ আর কামানের আওয়াজে আমি আতঙ্কে জেগে উঠলাম। একটি রিপাকলিকান বিমান মোস্তানিয়ার ফৌজি ব্যারাকে বোমা ফেলছে। সে সময় স্পেনের সমস্ত ব্যারাকেই সৈন্যসামন্ত গিজগিজ করছে। একদল ফ্যালানজিস্ত মোস্তানিয়ায় গোপন আস্তানা গেড়েছিল, কয়েকদিন ধরেই ওরা জানালা থেকে গুলি চালাচ্ছিল, অনেক সাধারণ মানুষ তাতে জখমও হয়েছিল। আজ আঠারো জুলাইয়ে (১৯৩৪) সকালে আজানিয়ার রিপাবলিকানদের একদল শ্রমিক ব্যারাকগুলোতে গিয়ে চড়াও হয়। বেলা দশটার মধ্যেই সব শেষ বিদ্রোহী অফিসার ও ফ্যালানজিস্তরা খতম। যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে।

আমার ব্যালকনি থেকে দূরের মেসিনগানের আওয়াজ শুনতে শুনতে আমি দেখতে পেলাম নিচের রাস্তা দিয়ে জনা দুই শ্রমিক আর কয়েকজন জিপসি একটা স্লাইডার কামান টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যে বিপ্লব এত বছর ধরে ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করছিল বলে আমরা অনুভব করছিলাম, আমি নিজে যা ব্যক্তিগতভাবে এত উৎসাহভরে চাইছিলাম, আজ সে আমার চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করছে, চোখের সামনে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, আমি শুধু একটা জোর ঝাঁকুনি খেলাম।

একদিন এক রিপাবলিকানের কাছে খবর পেলাম ফেদারিকো গার্সিয়া লোরকা খুন হয়েছে। ‘আন্দালুশিয়ার কুকুর’ তৈরির কিছুদিন আগে লোরকা আর আমার মধ্যে একটু মন কষাকষি হয়েছিল। সে যেহেতু রোগাপটকা আন্দালুশীয়, তাই সে ভেবেছিল ছবিটা বুঝি তার উদ্দেশ্যেই আমার ব্যক্তিগত আক্রমণ। সে লোকজনকে বলতো, ‘বুনুয়েল একটা ছোট্ট ছবি বানিয়েছে, তার নাম ‘আন্দালুশিয়ার কুকুর’- আমার মনে হয় আমিই সেই কুকুর।’

১৯৩৪ সালের শেষের দিকে ও আমেরিকা থেকে ফিরে এলে আমাদের মধ্যে অবশ্য বন্ধুত্ব আবার ফিরে আসে। দালির সঙ্গে কিন্তু ওর সম্পর্কের ভাঙনটা আর তেমনভাবে জোড়া লাগেনি। যদিও লোরকার মৃত্যুর সামান্য কিছু আগে দালি আবার লোরকার সঙ্গে সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ফ্রাঙ্কোর খুনে বাহিনী রিপাবলিকান লোরকাকে বাঁচার সুযোগ দেয়নি। লোরকা যেহেতু রিপাবলিকানদের সমর্থন করত, আর দালি ফ্রাঙ্কোকে তাই ওদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দুস্তর ব্যবধান। লোরকা আর আমি অনেক সময় কাটাতাম একসঙ্গে। উগার্তকে নিয়ে আমরা এল পাউলারের পাহাড়ে গাড়ি চালিয়ে যেতাম, সেখানকার গথিক স্তব্ধতায় কয়েক ঘণ্টা নিরুপদ্রবে কাটাব বলে। এখানকার সবই ভাঙাচোরা, কিন্তু ভেতরে কয়েকটা স্পার্টান ঘর ছিল ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউটের লোকজনদের জন্য। যখন যুদ্ধ চারপাশে ক্রুদ্ধ ড্রাগনের মতো গজরাচ্ছে তখন কবিতা বা চিত্রকলা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। ফ্রাঙ্কের অন্তিম আক্রমণের চার দিন আগে আবেগতাড়িত লোরকা আচমকা ঠিক করল সে গ্রানাদা যাবে, নিজের শহরে।

আমি অনেক অনুনয় করেছিলাম, এই সংকল্প থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে- ফেদেরিকো, বীভৎস সব কাণ্ড হচ্ছে। এখন তুমি ওখানে যেতে পারবে না, বরং এখানেই তুমি অনেকটা নিরাপদে থাকবে। আমাদের কোনো কথাকেই সে কান দিল না, খানিকটা ভীত ও উৎকণ্ঠিতভাবেই সে পরদিন গ্রানাদা চলে গেল। তার এই খুন হবার খবর ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল আমাদের। সারাজীবন যত মানুষ আমি দেখেছি, ফেদেরিকো ছিল তাদের সকলের সেরা। শুধু তার নাটক বা কবিতার কথা আমি বলছি না, মানুষ হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবে তার কোনো তুলনা হয় না।

পিয়ানোতে বসে শপার নকলই করুক অথবা উদ্ভাবন করুক নতুন কোনো মূকাভিনয়, কিংবা নাটকের কোনো দৃশ্য একাই দাপটে অভিনয় করে দেখাক, সে ছিল অপ্রতিরোধ্য। কবিতা পড়ত চমৎকার, আর ছিল আবেগ, সংরাগ, যৌবন আর আনন্দ। ছাত্রটোলায় যখন প্রথম তার সঙ্গে দেখা হয়, আমি ছিলাম গেঁয়ো, অপরিশীলিত, শুধুই খেলাধুলার দিকে ঝোঁক। সেই আমাকে পুরোপুরি রূপান্তরিত করে সম্পূর্ণ নতুন একটা জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সে ছিল আগুনের শিখা। তার মৃতদেহ কোনোদিনই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, তার মৃত্যু সম্বন্ধে রং চড়ানো সব গুজব ছড়াচ্ছিল চারপাশে। কেউ কেউ ইঙ্গিত করছিল সমকামীদের কারও ঈর্ষাই বুঝি কারণ। আসল কথা হল লোরকা খুন হয়েছে কারণ সে ছিল বিপ্লবী কবি। ‘বুদ্ধিজীবীদের খতম করো’- যুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্তদের এটা ছিল একটা প্রিয় জিগির। গ্রানাদায় গিয়ে সে সম্ভবত ফ্যালানজিস্ত কবি রোসালেসের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কারণ সে ছিল লোরকার পরিবারের ঘনিষ্ঠ। আমার ধারণা লোরকা ভেবেছিল রোসালেসদের বাড়িতে সে নিরাপদে থাকবে। কিন্তু আচমকা একরাতে একদল লোক অ্যালোঞ্জো বলে একজনের নেতৃত্বে এসে তাকে গ্রেফতার করে। এবং কয়েকজন বন্দি মজুরের সঙ্গে নিয়ে ট্রাক চালিয়ে উধাও হয়ে যায়। ফেদেরিকো কষ্ট আর মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পেত। আমি অনুমান করতে পারি সে কী অনুভব করেছিল সেই নিশুতি রাতে, একটা ট্রাক ছুটে চলেছে জলপাই বনের দিকে, সেখানে তাকে গুলি করে মারা হবে। এই ছবিটা এখনও মাঝে মাঝে আমাকে উদভ্রান্ত করে তোলে।

কয়েকদিন সেখানে বোন-ভগ্নিপতি আর তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে সারা বছরের সম্পদ আহরণ করে ফিরে আসতাম আমার বউ-ছেলেমেয়েদের সান্নিধ্যে। মাদ্রিদে এসে মাঝে মাঝেই আমি সবার অগোচরে চলে আসতাম আমাদের ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত ছাত্রটোলায়। মাদ্রিদের সেইসব বিকেল-রাত্রি, সালভাদোরের সঙ্গে পথে-পথে হাঁটা, সবই মনে আছে। আর ছোটো বাগানটায় ঘুরকে ঘুরতে মনে পড়ত ফেদেরিকো তোমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রথম দিনটার কথা। তখন তুমি সদ্য গ্রানাদা থেকে ফুয়েস্তে ভ্যাকুয়েস হয়ে ফিরে এসেছ সঙ্গে নিয়ে তোমার বইয়ের প্রথম কবিতা,

সবুজ তোমাকে আমি যেভাবে চাই

সবুজ বাতাস। সবুজ ভালোবাসা...

তোমার গলায় প্রথম শোনা সেই কবিতা। তোমার লেখা সেরা কবিতা। বিনা দ্বিধায় বলা যায় স্পেনীয় কাব্যে শ্রেষ্ঠ। তোমার ‘সবুজ বাতাস’ আমাদের সকলকে স্পর্শ করেছিল, তার সুর এখনও লেগে আছে আমাদের কাছে। না, ভুল বললাম, কানে নয়, আমাদের হৃদয়ে। আমরা যারা শুনতে পাচ্ছি আমাদের শেষ নিঃশ্বাসের শব্দ (Mon Dernier Soupir- My Last Sigh) তারা কিন্তু তোমাকে ভোলেনি। ফেদেরিকো তোমাকে আমরা ভুলব না।

‘ব্লাড ওয়েডিং’ নামকরণেই রয়েছে রক্তপাতের ইশারা। আমাদের উৎসবের শাড়িতে (ঢাকাই/বেনারসী) যেমন জরির কাজ, সেই রকমই লোরকার নাটকে ও কবিতার সর্বাঙ্গে রক্তের ঘন বুনোন। কিন্তু বিশেষ করে ‘ব্লাড ওয়েডিং’-এ তা যেন বৃষ্টির ধারার মতোই ভিজিয়ে দিয়েছে ধরাতল। এখানে যেন কবির অনুভূতিতে জীবন ও মৃত্যু মিলেমিশে একাকার। নাটকের তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে গ্রিক নাটকের কোরাসের মতোই তিনজন কাঠুরিয়ার সংলাপে ধ্বনিত হয়েছে সেই সুর,-

পুর্ণেন্দু পত্রী-র একটা লেখা থেকে আমরা পাচ্ছি-

‘বিশ্ব বিশাল। প্রত্যেকেই বাস করতে পারে এখানে।

কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করবে।

তোমাকে কিন্তু হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে তোমার প্যাশন। পালিয়ে গিয়ে ঠিকই করেছে ওরা।

তারা প্রত্যেকে প্রত্যেককে প্রতারিত করতে চাইছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে রক্ত।

রক্ত!

তোমাকে তো অনুগমন করতেই হবে সেই পথ, যা গড়েছে তোমার রক্ত।

তাতে কী হয়েছে? রক্তকে পচিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে নিজেকে রক্তে ভাসিয়ে মরা ঢের ভাল।’

এই সংলাপের মধ্যে কান পাতলে আমরা শুনতে পাই সভ্যতা ও রক্তপাতের সঙ্গে নিরত যুযুধান লোরকারই কণ্ঠস্বর।

‘পোয়েট ইন ন্যু-ইয়র্ক’ কবিতার বইয়ের শুরুতেই নিজের সম্পর্কে তিনি লিখছেন,-

‘মার্ডার্ড বাই হেভেন’ আর যা শেষও করেছেন ঐ একই কথায়,-

“ঝযধসনষরহম বধপয ফধু রিঃয সধু ফরভভবৎবহঃ ভধপব

অয, যবধাবহ সঁৎফবৎবফ ড়হব.”

আবার ঐ বইয়েরই তৃতীয় কবিতায়-

‘ডেইজির ক্রি ক্রি-র ভিতরে

যখন ভেঙে যায় বিশুদ্ধ সব গড়ন

তখনই মনে পড়ে তারা, কী ভাবে হত্যা করেছে আমাকেও।

তারা তছনছ করেছে কাফে, কবরখানা এবং গির্জা

উল্টে ফেলেছে মদের পিপে আর কাপড়-শুকোনো কল

তিনটে কঙ্কাল ঘেঁটে-ঘুঁটে তারা উপড়ে নিয়েছে তাদের দাঁতের সোনা

কিন্তু আমাকে, না আমার দেখা পায়নি কখনো।

কখনো দেখা পায়নি আমার?

না, কখনো দেখা পায়নি আমার।’

নিজেই এঁকে যান নিজের মৃত্যু-সম্ভাবনা এবং সেই সঙ্গে মৃত্যুহীনতাও।

প্রফেটিক কোয়ালিটিতে ভরপুর লোরকা তাঁর নাটকে একদিকে এনেছেন মা-কনে-শাশুড়িকে অন্যদিকে লিওনার্দোর সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রী-ঝি-প্রতিবেশিনী-শ্বশুর আর একদল যুবক-যুবতী ও তিনজন কাঠুরিয়াবেশী নিয়তি আর চাঁদ যে স্বয়ং মৃত্যু। এদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে এই নাটক। কিন্তু সামান্য মনোযোগেই আমাদের চোখে পড়বে আরো দুটো চরিত্র, যারা রক্ত মাংসের নয় ঠিকই, কিন্তু রক্ত মাংসের চরিত্রের মতোই খুবই উচ্চকিত, এর প্রথমটির নাম রক্ত, আর অন্যটি ছুরি।

নাটকের শুরুতেই আমরা দেখি, বর চরিত্রটি তাদের আঙুরের ক্ষেতে যাবার আগে মা-কে জানায়, সকালের খাবার পাবার আগে তার বেশি প্রয়োজন একটি ছুটি। ছুটি খুঁজে না-পেয়ে সে সকলকে অভিসম্পাত দিতে থাকে। সেই সঙ্গে সেই স্কাউনড্রেলকেও, ছুরি যার আবিষ্কার। ছুরি থেকে তার গালাগালি ছড়িয়ে পড়ে কামান, বন্দুক, ছোট মাপের হাত-ছুরি থেকে নিড়–নি এমনকি পিচফর্ক পর্যন্ত- যা কিছুই ছিন্নভিন্ন করতে পারে মানুষকে, মানুষের বাঁচার দুর্মর শক্তি ও স্বপ্নকে। আর এই ছুরির সুবাদে আমাদের সামনে ধীরে ধীরে খুলে যেতে থাকে অতীতের ঘটনাক্রম- আমাদের জানা হয়ে যায় প্রতিপক্ষের অস্ত্রাঘাতে নিহত স্বামী ও পুত্রের অকাল মৃত্যুর কথা। নাটকের প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে লিওনার্দোর বাড়িতে, লিওনার্দোর মা ও স্ত্রী ছেলে ভুলানো ছড়া গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে তার শিশুপুত্রকে। সেই ছড়া-গানে থেকে থেকেই ঘুরে ফিরে আসে এক রক্তাক্ত ঘোড়ার জলাতঙ্ক ও জলতৃষ্ণার বিরবণ, যার গভীর চোখের চাউনিতে গাঁথা হয়ে আছে এক রুপালি ছোরা।

নাটকের তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে রক্ত এবং ছুরি পৌঁছে যায় পারস্পরিক সমঝোতায়, কেননা দুজনেই তখন বুঝে গেছে যে একটা নির্দিষ্ট হত্যাকা-ের জন্য তাদের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হবে এখুনি। মৃত্যুর দূত হিসেবে, কাঠুরিয়ার ছদ্মবেশে, সাদা মুখে আর গাঢ় নীল আভার বিচ্ছুরণে যখন মঞ্চে প্রবেশ করে চাঁদ, তখন থেকেই রক্তের প্রয়োজনে ছুরির ভূমিকা হয়ে উঠতে থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতির মতো অনিবার্য। রক্তের পিপাসায় উদ্বেল চাঁদের সংলাপে আমরা তাই শুনি-

‘চাঁদ একটা ছুরিকে ছুরে দিয়েছে বাতাসে

যার ধাতব আক্রমণে রক্তের যন্ত্রণা হয়ে উঠবে অস্থির।’

চাঁদের কাছে আজ এগিয়ে এসেছে সেই শুভরাত্রি যে তার গালকে রাঙিয়ে দেবে রক্তে রক্তে।

বুড়ি ভিখারিণীর ছদ্মবেশে মৃত্যু তার কানে কানে শোনায় সেই পরামর্শ,-

প্রজ্বলিত করো তোমার ওয়েস্টকোট, খুলে দাও সব বোতাম, এরপর ছুরি নিজেই পেয়ে যাবে তার এগোনোর পথ।

চাঁদের কণ্ঠস্বরে, মৃত্যুর কাছে এখন একটাই প্রগাঢ় কামনা,- কিন্তু তাদের মৃত করে রাখো বহুক্ষণ। তাহলেই আমার আঙুলগুলোর ফাঁক দিয়ে গলগল করে গড়িয়ে যাবে তাদের রক্তস্রোত।

এরপর কার্লো সওরার সিনেমায় ব্যালের ফর্মে নাটক এগিয়ে যায় তার নির্দিষ্ট রক্তাক্ত অন্ধকারের দিকে।

back to top