alt

সাময়িকী

মুগ্ধপাঠ: একটি প্রবন্ধ সংকলন

সালেহা চৌধুরী

: বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১

হাতে পেলাম উদয় শংকর দুর্জয়ের বই প্রবন্ধ সংগ্রহ। মন ভরে গেল এই সুশ্রী বইটির দিতে তাকিয়ে। অবাক হয়ে গেলাম চাকরি, বাড়ি, সন্তান সবকিছু সামলে কখন ও লেখে এইসব প্রবন্ধ? আমিও লিখি। কখন সময় পাই এমন প্রশ্নের উত্তরে আমি কী বলি? বলি একটা গল্প। সেটা হলো- একবার একজন পাঠক একজন লেখককে প্রশ্ন করেছিলেন- আপনি কখন লেখার সময় পান? আমি তো একটা চিঠি লিখবারও সময় পাই না। উত্তরে বলেছিলেন লেখক- তাহলে একটা কথা মনে রাখবেন একজন লেখক ও পাঠকের ভেতর পার্থক্য একটিই। সে হলো সবকিছুর ভেতর একজন লেখক সময় বের করতে পারেন, সাধারণ পাঠক সেটা পারেন না। অতএব আমি প্রশ্ন করবো না তুমি সময় পাও কখন?

এখানে আছে পনেরোটি প্রবন্ধ। আটটি কবিতার উপরে আর সাতটি গদ্যের উপরে। এর মধ্যে গদ্যের একটি ওর নিজস্ব ভাবনার প্রবন্ধ ‘পাপ’ কাকে বলে।

প্রথম প্রবন্ধের নাম- ‘অন্যভাষার মুগ্ধপাঠ’ এবং আত্মোপলদ্ধি। আসলে অন্য ভাষার মুগ্ধপাঠই তাঁর লেখার বিশেষ অনুপ্রেরণা। এইটি আমারও আছে। যা পড়লাম ভাগ করে নিতে চাই অন্যের সঙ্গে।

কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে দেশি ও বিদেশি কবিদের নিয়ে সমৃদ্ধ আলোচনা আছে। টিএস এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, ওয়ার্ডস ওয়ার্থ, বায়রন, কোলরিজ, অডেন, বব ডিলোন এবং আরো। বলেছেন আধুনিক তিরিশের কবিদের প্রকাশ ও বিকাশের কথা। এবং তাদের সময়কাল। এবং টিএস এলিয়টের ভাবনার প্রভাব। ১৯২২ সালের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর প্রভাব এবং এইসব। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ কী লিখছিলেন, কী ভাবছিলেন সেইসবও লিখেছেন। আর জীবনানন্দের বনলতা সেনের সঙ্গে বায়রন আর এডগার এ্যালান পো’র কবিতার মিল নিয়েও কথা বলেছেন। দুর্জয় বলেন- ‘বনলতা সেন কবিতায় বায়রন আর পো’র যে অনুষঙ্গ দেখতে পাওয়া যায় বিশ্লেষণ করলে ‘বনলতা সেনকেই বেশি উৎকৃষ্ট মনে হয়’। ‘সি ওয়াক্স ইন বিউটি’ এবং ‘টু হেলেন’ কবিতার কথা বলেছেন তিনি। এইভাবে মিল খুঁজবার কোনো কারণ কি আছে? হয়তো আছে না হলে খোঁজা হয় কেন। বনলতা পড়তে গিয়ে আমি কিন্তু জানতে চাইবো না কোন কবিতার প্রভাব এখানে।

এইসব রোমান্টিক কবিদের কেন পছন্দ করেন তারও কথা আছে। বেশ কিছু কবি ও কবিতার খোঁজ খবর পাওয়া যায় এইখানে। ‘ত্রিশে রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য’ চমৎকার একটি প্রবন্ধ। যেখানে ওর নিজস্ব চিন্তা, এলিয়টের প্রভাব পাঁচজন তিরিশের কবি ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কথা বলেছেন। ডিলান টমাস-এর কবিতার কথা এবং তার প্রভাবও সবকিছুই বলতে চেয়েছেন।

আমার একটি প্রবন্ধ খুবই অসাধারণ মনে হয়েছে সেইটির নাম- ‘মেরি শেলি : ফ্রাংকেনস্টাইন, প্রথম সায়েন্স ফিকশন’। কেমন করে এক বৃষ্টির রাতে বায়রন, পার্সি বিসি শেলি, মেরি শেলি ভূতপ্রেত নিয়ে কথা বলতে বলতে, ভূতের গল্প পর্যায়ক্রমে পড়তে পড়তে হঠাৎ করে মেরি শেলির মাথায় ফ্রাংকেনস্টাইন লিখবার ভাবনা আসে এবং কেমন করে একটি ছোটগল্প থেকে এই বড় উপন্যাসটির জন্ম হয় সে কথা সুন্দর করে সবিস্তারে লিখেছেন। মেরি ওয়ালস্টোর ক্রফটের কন্যা ছিলেন মেরি শেলী। ১৮৩১ সালে এই বইটি প্রকাশ করেন মেরি শেলি। একটি অসাধারণ সায়েন্স ফিকশন। এবং পরিবর্তীকালে ফ্রাংকেনস্টাইন কীভাবে আরো লেখককে এই ধারার নানা ধরনের বই লিখতে অনুপ্রাণিত করে সে কথাও আছে। এই বইটিতে সাতটি গদ্য নিয়ে লেখা প্রবন্ধ, আমার মতে এইটি অন্যতম প্রধান একটি গদ্য নিয়ে লেখা।

এমনি আর একটি গদ্য রচনা স্টিফেন হকিংস। এই কিংবদন্তি বিজ্ঞানীকে নিয়ে লিখতে অনেকেই চাইবে। যে মানুষ প্রমাণ করেছেন- আসলে মস্তিষ্কই আমাদের একমাত্র নিজস্ব জিনিস। বাঁকি সব কিছু বদলানো সম্ভব কিন্তু মগজ নয়। ‘মোটর নিউরন’ তাঁকে অচল করেছিল, বসিয়ে দিয়েছিল চেয়ারে, বন্ধ করে দিয়েছিল কথা বলা কিন্তু কেবল মস্তিষ্কের ভাবনাকে পড়তে পারার যন্ত্র থেকে স্টিফেন হকিংস আজ তাই মহাকাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক। তিনিই প্রথম বলেছিলেন ‘ব্লাকহোল’ বা কৃষ্ণ গহ্বরেরর কথা। আর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে নিতে বলেছিলেন- এই গ্রহ মানুষের বসবাসের উপযুক্ত নেই আর তাই খুঁজে পেতে হবে আর একটি নতুন গ্রহ। করোনাকালের গ্রহের দিকে তাকালে এ কথা কি সত্য মনে হয় না? জারাজীর্ণ পাপে আর অপব্যবহারে আজকের পৃথিবী। এমন কোনো সমুদ্র নেই যার পুণ্য পানিতে শুদ্ধ হবে পৃথিবী।

বাংলা কবিদের আলোচনায় স্থান পেয়েছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং তাঁর পরাবাস্তবতা, নেপথ্য প্রান্তরের বেহাল বাদক শহীদ কাদরী। একজন কবিকে আমি জেনেছি এই বই থেকে। এই কবির নাম নবারুণ ভট্টাচার্য। আমি তাঁকে জানতাম না। নবারুন মহাশ্বেতা দেবী ও নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের একমাত্র সন্তান। তাঁর প্রবন্ধের নাম- নবারুনের কবিতায় বারুদ আর বহমান নান্দনিকতা। শিরোনামেই বুঝতে পারা যায় তিনি কেমন কবিতা লেখেন। ‘মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’। এই বইটির পর তিনি পরিচিত হন ভালোভাবে। এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ‘হারবাটর্’’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। ১৯৯৩ সালে প্রকাশের পর সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার পায়। নবারুণ কেবল শব্দ নিয়ে খেলেন না, লেখেন জীবনের নানা অসঙ্গতি। দুর্জয়ের ভাষায়- নোটবুকের বুকে রেখে যান কালের সাক্ষী-স্বাক্ষর, একদিন আগামী প্রজন্ম তরঙ্গায়িত কালের ধুলো পেরিয়ে সেইসব ভাঁজের আড়ালে, জ্বলে থাকা ক্রন্দিত নক্ষত্রের ইতিহাস জেনে যাবে।’ দুর্জয়ের বাংলা ভাষার উপরে খুব ভালো দখল আছে। বার বার এই প্রবন্ধের বইতে সে কথা প্রমাণ করেছে।

বেনজামিন জেফানইয়া এবং ভি এস নাইপলের লেখাও মন দিয় পড়েছি। কারণ ওদের নিয়ে আমিও লিখেছি। দেখলাম আমাদের ভাবনার সমান্তরাল অনেকটা একরকম। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এই সব লেখক নিয়ে প্রচুর ভাবনাচিন্তা করেছে ও। অন্য ভাষার পাঠজ্ঞান জোরালো এইসব লেখায়।

নাগরিক শহীদ কাদরী প্রসঙ্গে বলেন- ‘ফ্রন্সে একটি প্রবাদ সচারাচর শোনা যায় যে, আধুনিক কবিদের জন্ম শহরে আর তা বোদলেয়ারের সংস্পর্শে। প্রবাদটি কাদরি সাহেবের সাথে পুরোপুরি মানানসই। থেকেছেন বার্লিন, লন্ডন, এবং নিউইয়র্কেও। নগরের সব কোলাহল গায়ে মেখেও এঁকেছেন রুপোলি বাংলার ছবি। ভেবেছেন বাঙালির কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা।’ এমন আরো অনেক উদ্ধৃতি দেবার লোভ সামলাতে হলো কারণ বই নিয়ে খুব বড় আলোচনার জায়গা কাগজে সবসময় থাকে না। দুর্জয় বলেন- শহীদ কাদরী অশ্বারোহীর মতো ছোটাতে থাকেন তীব্র যন্ত্রণার ধনুক, ক্ষুরের সাথে বেঁধে রাখেন বিষন্ন বিপন্নতা।’ চমৎকার।

নিশিযাপনের সুরিয়ালিস্ট কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ এ তাঁর কবিতার নানা উদ্ধৃতিতে সুরিয়ালিস্ট ভাবনার ব্যাখ্যা করেছেন- ‘তোমার চোখের হ্রদে চুরি করে চলে যাব রাজহাঁস, তোমাদের বাড়ির সামনের ফুটপাতে করবো মুহূর্ত, তোমার বুকের চাঁদ দেখে মেঘের ভেতর দিয়ে বজ্র চলে যাবো, করে দাও মিল্টনের মত অন্ধ, বেটোফেনের মত বধির।’ (সেরেনাদ ২ কবিতা)। আশা করি আমি ঠিক বুঝতে না পারলেও পাঠক বুঝতে পেরেছেন এই উক্তির সারাৎসার। সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তব পড়লাম আর বুঝে ফেললাম তাই কি হয়?

এমনি করে প্রতিটি প্রবন্ধ থেকে কথা ও শব্দ তুলে নিয়ে অনেক কিছু বলা যায়। কিন্তু আমাকে তো থামতেই হয় একসময়। যা বলা হয়েছে সেইটিই সব নয়, যা বলা হয়নি সেই অনেক। কবি জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গে তাঁর প্রবন্ধ ‘অগ্রন্থিত নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ’। মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে যারা কবিতাকে ভাষা ও ছন্দ দিয়ে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন তাঁরা- জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে এবং অমিয় চক্রবর্তী। আমরা হয়তো অনেকেই জানি কবিতার ভাষাকে নতুন করবার দাবি যার সবচাইতে বেশি তিনি জীবনানন্দ। যার জীবিতকালে সর্বসাকল্যে ১৬২টি কবিতার কথা জেনেছে সকলে। কিন্তু পরে পাওয়া গেছে তাঁর গল্প, উপন্যাস এবং আরো অনেক কবিতা। এমনি করে এই কবিকে নিয়ে একটি সারগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। তাঁর কস্তুরি আভার চাঁদ জোছনা ঝরায় যেই সব শব্দে আর ছন্দে।

আমার মনে হয় কবি উদয় শংকর দুর্জয় কেবল কবিতা ভাবনা নিয়েই একটি বই লিখতে পারেন। কারণ নিজে কবি এবং ইংরেজি বাংলা কবিতার ধারণা চমৎকার। সম্প্রতি তিনি কবিতায় সাহিত্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর লিটারেচার পুরস্কার পেয়েছেন। আমাকে বলেছিলেন- ওকে যেমন জানি তাই নিয়ে ইংরাজিতে একটি চিঠি লিখতে। ওর কবিতার সঙ্গে চিঠিটি দেবে। কর্তৃপক্ষ এমন একটি চিঠি চেয়েছে। খুশি মনে লিখেছিলাম ‘টু হোম ইট মে কনসার্ন’। ভালো লাগছে ওর কবিতা সমাদৃত ও পুরস্কৃত হয়েছে। আমি নিজেও এই পুরস্কারের আনন্দ ওরই মতো সামানভাবে পেয়েছি।

বইটি প্রকাশ করেছে- অনুপ্রাণন প্রকাশন। মূল্য ২৪৫ টাকা। ভুলভ্রান্তি নেই বললেই চলে। দেখলার প্রবন্ধের শেষে তথ্য সূত্র সব প্রবন্ধে নেই। মনে হয় এখানে একটা কিছু কারণ আছে। প্রকাশক আর কবির হাজার হাজার মাইল দূরত্ব।

আমি উদয় শংকর দুর্জয়ের উজ্জ্বল শস্যসফল ভবিষ্যত কামনা করি। ওকে তো লিখতেই হবে আরো অনেক কিছু কারণ ও তো জেনে গেছে সময় কেমন করে বের করতে হয়। যেমন আমি জানি। জয়তু উদয় শংকর দুর্জয়।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

মুগ্ধপাঠ: একটি প্রবন্ধ সংকলন

সালেহা চৌধুরী

বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১

হাতে পেলাম উদয় শংকর দুর্জয়ের বই প্রবন্ধ সংগ্রহ। মন ভরে গেল এই সুশ্রী বইটির দিতে তাকিয়ে। অবাক হয়ে গেলাম চাকরি, বাড়ি, সন্তান সবকিছু সামলে কখন ও লেখে এইসব প্রবন্ধ? আমিও লিখি। কখন সময় পাই এমন প্রশ্নের উত্তরে আমি কী বলি? বলি একটা গল্প। সেটা হলো- একবার একজন পাঠক একজন লেখককে প্রশ্ন করেছিলেন- আপনি কখন লেখার সময় পান? আমি তো একটা চিঠি লিখবারও সময় পাই না। উত্তরে বলেছিলেন লেখক- তাহলে একটা কথা মনে রাখবেন একজন লেখক ও পাঠকের ভেতর পার্থক্য একটিই। সে হলো সবকিছুর ভেতর একজন লেখক সময় বের করতে পারেন, সাধারণ পাঠক সেটা পারেন না। অতএব আমি প্রশ্ন করবো না তুমি সময় পাও কখন?

এখানে আছে পনেরোটি প্রবন্ধ। আটটি কবিতার উপরে আর সাতটি গদ্যের উপরে। এর মধ্যে গদ্যের একটি ওর নিজস্ব ভাবনার প্রবন্ধ ‘পাপ’ কাকে বলে।

প্রথম প্রবন্ধের নাম- ‘অন্যভাষার মুগ্ধপাঠ’ এবং আত্মোপলদ্ধি। আসলে অন্য ভাষার মুগ্ধপাঠই তাঁর লেখার বিশেষ অনুপ্রেরণা। এইটি আমারও আছে। যা পড়লাম ভাগ করে নিতে চাই অন্যের সঙ্গে।

কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে দেশি ও বিদেশি কবিদের নিয়ে সমৃদ্ধ আলোচনা আছে। টিএস এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, ওয়ার্ডস ওয়ার্থ, বায়রন, কোলরিজ, অডেন, বব ডিলোন এবং আরো। বলেছেন আধুনিক তিরিশের কবিদের প্রকাশ ও বিকাশের কথা। এবং তাদের সময়কাল। এবং টিএস এলিয়টের ভাবনার প্রভাব। ১৯২২ সালের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর প্রভাব এবং এইসব। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ কী লিখছিলেন, কী ভাবছিলেন সেইসবও লিখেছেন। আর জীবনানন্দের বনলতা সেনের সঙ্গে বায়রন আর এডগার এ্যালান পো’র কবিতার মিল নিয়েও কথা বলেছেন। দুর্জয় বলেন- ‘বনলতা সেন কবিতায় বায়রন আর পো’র যে অনুষঙ্গ দেখতে পাওয়া যায় বিশ্লেষণ করলে ‘বনলতা সেনকেই বেশি উৎকৃষ্ট মনে হয়’। ‘সি ওয়াক্স ইন বিউটি’ এবং ‘টু হেলেন’ কবিতার কথা বলেছেন তিনি। এইভাবে মিল খুঁজবার কোনো কারণ কি আছে? হয়তো আছে না হলে খোঁজা হয় কেন। বনলতা পড়তে গিয়ে আমি কিন্তু জানতে চাইবো না কোন কবিতার প্রভাব এখানে।

এইসব রোমান্টিক কবিদের কেন পছন্দ করেন তারও কথা আছে। বেশ কিছু কবি ও কবিতার খোঁজ খবর পাওয়া যায় এইখানে। ‘ত্রিশে রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য’ চমৎকার একটি প্রবন্ধ। যেখানে ওর নিজস্ব চিন্তা, এলিয়টের প্রভাব পাঁচজন তিরিশের কবি ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কথা বলেছেন। ডিলান টমাস-এর কবিতার কথা এবং তার প্রভাবও সবকিছুই বলতে চেয়েছেন।

আমার একটি প্রবন্ধ খুবই অসাধারণ মনে হয়েছে সেইটির নাম- ‘মেরি শেলি : ফ্রাংকেনস্টাইন, প্রথম সায়েন্স ফিকশন’। কেমন করে এক বৃষ্টির রাতে বায়রন, পার্সি বিসি শেলি, মেরি শেলি ভূতপ্রেত নিয়ে কথা বলতে বলতে, ভূতের গল্প পর্যায়ক্রমে পড়তে পড়তে হঠাৎ করে মেরি শেলির মাথায় ফ্রাংকেনস্টাইন লিখবার ভাবনা আসে এবং কেমন করে একটি ছোটগল্প থেকে এই বড় উপন্যাসটির জন্ম হয় সে কথা সুন্দর করে সবিস্তারে লিখেছেন। মেরি ওয়ালস্টোর ক্রফটের কন্যা ছিলেন মেরি শেলী। ১৮৩১ সালে এই বইটি প্রকাশ করেন মেরি শেলি। একটি অসাধারণ সায়েন্স ফিকশন। এবং পরিবর্তীকালে ফ্রাংকেনস্টাইন কীভাবে আরো লেখককে এই ধারার নানা ধরনের বই লিখতে অনুপ্রাণিত করে সে কথাও আছে। এই বইটিতে সাতটি গদ্য নিয়ে লেখা প্রবন্ধ, আমার মতে এইটি অন্যতম প্রধান একটি গদ্য নিয়ে লেখা।

এমনি আর একটি গদ্য রচনা স্টিফেন হকিংস। এই কিংবদন্তি বিজ্ঞানীকে নিয়ে লিখতে অনেকেই চাইবে। যে মানুষ প্রমাণ করেছেন- আসলে মস্তিষ্কই আমাদের একমাত্র নিজস্ব জিনিস। বাঁকি সব কিছু বদলানো সম্ভব কিন্তু মগজ নয়। ‘মোটর নিউরন’ তাঁকে অচল করেছিল, বসিয়ে দিয়েছিল চেয়ারে, বন্ধ করে দিয়েছিল কথা বলা কিন্তু কেবল মস্তিষ্কের ভাবনাকে পড়তে পারার যন্ত্র থেকে স্টিফেন হকিংস আজ তাই মহাকাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক। তিনিই প্রথম বলেছিলেন ‘ব্লাকহোল’ বা কৃষ্ণ গহ্বরেরর কথা। আর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে নিতে বলেছিলেন- এই গ্রহ মানুষের বসবাসের উপযুক্ত নেই আর তাই খুঁজে পেতে হবে আর একটি নতুন গ্রহ। করোনাকালের গ্রহের দিকে তাকালে এ কথা কি সত্য মনে হয় না? জারাজীর্ণ পাপে আর অপব্যবহারে আজকের পৃথিবী। এমন কোনো সমুদ্র নেই যার পুণ্য পানিতে শুদ্ধ হবে পৃথিবী।

বাংলা কবিদের আলোচনায় স্থান পেয়েছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং তাঁর পরাবাস্তবতা, নেপথ্য প্রান্তরের বেহাল বাদক শহীদ কাদরী। একজন কবিকে আমি জেনেছি এই বই থেকে। এই কবির নাম নবারুণ ভট্টাচার্য। আমি তাঁকে জানতাম না। নবারুন মহাশ্বেতা দেবী ও নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের একমাত্র সন্তান। তাঁর প্রবন্ধের নাম- নবারুনের কবিতায় বারুদ আর বহমান নান্দনিকতা। শিরোনামেই বুঝতে পারা যায় তিনি কেমন কবিতা লেখেন। ‘মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’। এই বইটির পর তিনি পরিচিত হন ভালোভাবে। এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ‘হারবাটর্’’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। ১৯৯৩ সালে প্রকাশের পর সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার পায়। নবারুণ কেবল শব্দ নিয়ে খেলেন না, লেখেন জীবনের নানা অসঙ্গতি। দুর্জয়ের ভাষায়- নোটবুকের বুকে রেখে যান কালের সাক্ষী-স্বাক্ষর, একদিন আগামী প্রজন্ম তরঙ্গায়িত কালের ধুলো পেরিয়ে সেইসব ভাঁজের আড়ালে, জ্বলে থাকা ক্রন্দিত নক্ষত্রের ইতিহাস জেনে যাবে।’ দুর্জয়ের বাংলা ভাষার উপরে খুব ভালো দখল আছে। বার বার এই প্রবন্ধের বইতে সে কথা প্রমাণ করেছে।

বেনজামিন জেফানইয়া এবং ভি এস নাইপলের লেখাও মন দিয় পড়েছি। কারণ ওদের নিয়ে আমিও লিখেছি। দেখলাম আমাদের ভাবনার সমান্তরাল অনেকটা একরকম। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এই সব লেখক নিয়ে প্রচুর ভাবনাচিন্তা করেছে ও। অন্য ভাষার পাঠজ্ঞান জোরালো এইসব লেখায়।

নাগরিক শহীদ কাদরী প্রসঙ্গে বলেন- ‘ফ্রন্সে একটি প্রবাদ সচারাচর শোনা যায় যে, আধুনিক কবিদের জন্ম শহরে আর তা বোদলেয়ারের সংস্পর্শে। প্রবাদটি কাদরি সাহেবের সাথে পুরোপুরি মানানসই। থেকেছেন বার্লিন, লন্ডন, এবং নিউইয়র্কেও। নগরের সব কোলাহল গায়ে মেখেও এঁকেছেন রুপোলি বাংলার ছবি। ভেবেছেন বাঙালির কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা।’ এমন আরো অনেক উদ্ধৃতি দেবার লোভ সামলাতে হলো কারণ বই নিয়ে খুব বড় আলোচনার জায়গা কাগজে সবসময় থাকে না। দুর্জয় বলেন- শহীদ কাদরী অশ্বারোহীর মতো ছোটাতে থাকেন তীব্র যন্ত্রণার ধনুক, ক্ষুরের সাথে বেঁধে রাখেন বিষন্ন বিপন্নতা।’ চমৎকার।

নিশিযাপনের সুরিয়ালিস্ট কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ এ তাঁর কবিতার নানা উদ্ধৃতিতে সুরিয়ালিস্ট ভাবনার ব্যাখ্যা করেছেন- ‘তোমার চোখের হ্রদে চুরি করে চলে যাব রাজহাঁস, তোমাদের বাড়ির সামনের ফুটপাতে করবো মুহূর্ত, তোমার বুকের চাঁদ দেখে মেঘের ভেতর দিয়ে বজ্র চলে যাবো, করে দাও মিল্টনের মত অন্ধ, বেটোফেনের মত বধির।’ (সেরেনাদ ২ কবিতা)। আশা করি আমি ঠিক বুঝতে না পারলেও পাঠক বুঝতে পেরেছেন এই উক্তির সারাৎসার। সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তব পড়লাম আর বুঝে ফেললাম তাই কি হয়?

এমনি করে প্রতিটি প্রবন্ধ থেকে কথা ও শব্দ তুলে নিয়ে অনেক কিছু বলা যায়। কিন্তু আমাকে তো থামতেই হয় একসময়। যা বলা হয়েছে সেইটিই সব নয়, যা বলা হয়নি সেই অনেক। কবি জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গে তাঁর প্রবন্ধ ‘অগ্রন্থিত নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ’। মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে যারা কবিতাকে ভাষা ও ছন্দ দিয়ে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন তাঁরা- জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে এবং অমিয় চক্রবর্তী। আমরা হয়তো অনেকেই জানি কবিতার ভাষাকে নতুন করবার দাবি যার সবচাইতে বেশি তিনি জীবনানন্দ। যার জীবিতকালে সর্বসাকল্যে ১৬২টি কবিতার কথা জেনেছে সকলে। কিন্তু পরে পাওয়া গেছে তাঁর গল্প, উপন্যাস এবং আরো অনেক কবিতা। এমনি করে এই কবিকে নিয়ে একটি সারগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। তাঁর কস্তুরি আভার চাঁদ জোছনা ঝরায় যেই সব শব্দে আর ছন্দে।

আমার মনে হয় কবি উদয় শংকর দুর্জয় কেবল কবিতা ভাবনা নিয়েই একটি বই লিখতে পারেন। কারণ নিজে কবি এবং ইংরেজি বাংলা কবিতার ধারণা চমৎকার। সম্প্রতি তিনি কবিতায় সাহিত্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর লিটারেচার পুরস্কার পেয়েছেন। আমাকে বলেছিলেন- ওকে যেমন জানি তাই নিয়ে ইংরাজিতে একটি চিঠি লিখতে। ওর কবিতার সঙ্গে চিঠিটি দেবে। কর্তৃপক্ষ এমন একটি চিঠি চেয়েছে। খুশি মনে লিখেছিলাম ‘টু হোম ইট মে কনসার্ন’। ভালো লাগছে ওর কবিতা সমাদৃত ও পুরস্কৃত হয়েছে। আমি নিজেও এই পুরস্কারের আনন্দ ওরই মতো সামানভাবে পেয়েছি।

বইটি প্রকাশ করেছে- অনুপ্রাণন প্রকাশন। মূল্য ২৪৫ টাকা। ভুলভ্রান্তি নেই বললেই চলে। দেখলার প্রবন্ধের শেষে তথ্য সূত্র সব প্রবন্ধে নেই। মনে হয় এখানে একটা কিছু কারণ আছে। প্রকাশক আর কবির হাজার হাজার মাইল দূরত্ব।

আমি উদয় শংকর দুর্জয়ের উজ্জ্বল শস্যসফল ভবিষ্যত কামনা করি। ওকে তো লিখতেই হবে আরো অনেক কিছু কারণ ও তো জেনে গেছে সময় কেমন করে বের করতে হয়। যেমন আমি জানি। জয়তু উদয় শংকর দুর্জয়।

back to top