alt

সাময়িকী

স্মৃতিগদ্য : ২

দিনান্তবেলায়

হ অঞ্জনা সাহা

: বৃহস্পতিবার, ০৮ জুলাই ২০২১

৩০শে চৈত্র, ১৪২৭। রাত পোহালেই নতুন ভোর ঝলমল করে উঠবে। শুরু হবে নবরূপে নতুন বছরের সূচনা- ১লা বৈশাখ ১৪২৮। শৈশবে দোকানে দোকানে হালখাতার উৎসব দেখেছি। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। তেমন করে দেখা যায় না আড়ং বা মেলা। এখন বলতে গেলে সবই প্রায় পোশাকী। করোনাকাল বলে এবার ‘ছায়ানট’-এর যে বর্ষবরণের উৎসব আয়োজনের জন্য প্রায় বছরব্যাপী মহড়া চলে, তাও স্থগিত থাকে। বন্ধ থাকে চারুকলার আকর্ষণীয় মঙ্গল শোভাযাত্রাও। সব মিলিয়ে শুধু প্রার্থনা থাকে- মঙ্গল হোক, শান্তি হোক ধরণীমাতার কোলে ফিরে আসুক স্বস্তি, ফিরে আসুক স্বাভাবিক জীবন। হে ঈশ্বর, মলিনমর্ম মুছিয়ে দাও আমাদের। শান্ত আর সমাহিত হোক পৃথিবী।

১৪২৮-এর পহেলা বৈশাখ। সকাল থেকেই অপেক্ষা করে আছি, কখন দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার আঁধার নামবে? আমরা ঘরে বসেই বর্ষবরণের একটি অনুষ্ঠানে হোয়াটসআপে মিলিত হবো। রাত ৮টা বাজতেই আমার আত্মজ হোয়াটসআপে যুক্ত হয়ে সকলকে তৈরি হতে বলল। ইথারে প্রায় দুহাজার মাইল দূর থেকে ওর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। আমরা পরিবারের সদস্যরা শুরু করলাম বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। শুরু হলো “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো” দিয়ে। আমার বোন গাইল অতুলপ্রসাদের “প্রেমে জল হয়ে যাও গলে...।” এরপর আমি গাইলাম ব্রহ্মসঙ্গীত “নতুন প্রাণ দাও প্রাণসখা...।” এ-আমার ছায়ানট-এর শিক্ষা ও আদর্শ। একসময় গান গাইতে গাইতে চোখ জলে ভরে এলো। আমার শিক্ষাগুরু সন্জীদা আপা (সন্জীদা খাতুন) কতো যত্ন করে গানগুলো শিখিয়েছিলেন! জীবনের যে মূল্যবান সময় তাঁর সান্নিধ্যে কাটিয়েছি, সেই ক্ষণ আমার জীবনে মহার্ঘ্য হয়ে আছে! তা ঘুরেফিরে চেতনে-অবচেতনে সারাক্ষণ সেলুলয়েডের পর্দায় ভেসে ওঠা ছবির মতো জীবন্ত হয়ে নড়েচড়ে বেড়ায়। মনে হয়, এই তো সে-দিনের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারের তিনতলায় আপার বৈঠকখানায় বসে আপা আর আমি পালাক্রমে রবীন্দ্রনাথ পড়ছি। অথবা নিমগ্ন হয়ে তিনি গান গাইছেন; আর আমি চোখ বুজে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তা শুনছি- ‘অশ্রুনদীর সুদূরপাড়ে...’, ‘বিমল আনন্দে জাগো রে...’, ‘সে যে মনের মানুষ, কেন তারে বসিয়ে রাখো...’ অথবা ‘আজি সাঁঝের যমুনায় গো...।’ এভাবে একে একে তিনি তাঁর প্রিয় গানগুলো গেয়ে যেতেন।

আমি প্রায় প্রতিদিনই আপার বাসায় যেতাম। সেখানে যাবার সময় নিচের বাগান থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ লিলিফুল তুলে নিতাম। কখনও দোলনচাঁপা, আবার কখনও নাগকেশর। এই সুগন্ধি ফুলগুলো আপার খুবই পছন্দের। এ-ছাড়া গন্ধরাজ ও বেলীও তিনি খুব ভালোবাসেন। রাতে ঘুমনোর সময় একটা পাত্রে বেলীফুলের আধো ফোটা কুঁড়ি জল ছিটিয়ে মাথার কাছে রেখে দিতেন। ঘরময় সে-সবের সৌগন্ধ্যে একটা স্বপ্নময় আবেশ তৈরি হতো। আর সেই আবেশ সঙ্গে নিয়েই তিনি ঘুমের রাজ্যে ডুবে যেতেন। তাঁর সান্নিধ্যে এসে এইসব আমার জানবার সৌভাগ্য হয়েছে।

মাঝে মাঝে প্রখ্যাত উদ্ভিদ জীনতত্ত্ববিজ্ঞানী ও আলোকচিত্রী নওয়াজেশ আহ্মদ আপার বাসায় আসতেন। আমি প্রতিদিনের স্বপ্রণোদিত অতিথি। তাই আমার সৌভাগ্য হয়ে কপালে জুটে যেতো এমন জ্যোতির্ময় মানুষের সঙ্গ। আমাদের গল্প, গানে ও আড্ডায় আপার বৈঠকখানা ঘর আনন্দের আবহে ভরে থাকতো। রাত বাড়লে ফিলে আসতাম বাসায়। কখনও কখনও বেশি রাত হয়ে গেলে আমার বড় ছেলে অভ্র আমাকে আনতে যেতো। রাত করে ফেরার কারণে বর মশায়ের বকুনিও জুটতো! কিন্তু সে-বকুনি গায়ে লাগতো না! একবুক আনন্দ নিয়ে ফিরলে তার কাছে সবকিছুই ফিকে মনে হতো। নওয়াজেশ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগতো। এতো সহজ আর আন্তরিক ছিলেন তিনি। কখনও মনেই হতো না যে, এতো বড় একজন মানুষের সঙ্গে বসে কথা বলছি! একবার তিনি গল্পে গল্পে বার্মা ভ্রমণের কথা বলছিলেন। তিনি ওদের কৃষিপদ্ধতির ব্যাপারে আমাদের কাছে বিষদ বর্ণনা করলেন। ওদের কৃষিজমি কম বলে নদীর জলের ওপর কেমন করে বাঁশের মাচান তৈরি করে ভেলার মতো ভাসিয়ে, কচুরিপানায় ভরাট করে এবং তার ওপর মাটির বেড বানিয়ে তারা বীজধান বপন ক’রে ধানচাষ করে, সেই পদ্ধতি দেখে এসেছিলেন। যেহেতু ভাসমান জমি, তাই সেচ দিতে হয় না! বাংলাদেশের কোথাও কোথাও এই পদ্ধতিতে ধানচাষ করার কথা শুনেছি। নওয়াজেশ ভাই কৃষিবিজ্ঞানের বই লিখেছেন এবং দেশ-বিদেশ থেকে অনেক সম্মাননাও পেয়েছেন।

আমি প্রায় প্রতিদিন সন্জীদা আপার জন্য ফুলের নৈবেদ্য সাজিয়ে নিয়ে যেতাম। ফুল কিনবার মতো সামর্থ্য ছিলো না বলে আপার স্টাফ কোয়ার্টারের নিচের বাগান থেকে দু’হাত ভরে তুলে নিতাম। উদ্দেশ্য একটাই, আপার মনে একটু আনন্দের ছোঁয়া লাগানো। নওয়াজেশ ভাই যেদিন দিনের আলো থাকতে থাকতে আসতেন, সেদিন পার্থসারথি এসে খবর দিতো, নাগকেশর ফুটেছে। আমরা সবাই সেই ফুল দেখতে নিচে নেমে যেতাম। আপা, আমি, নওয়াজেশ ভাই আর সঙ্গে থাকতো পার্থসারথিও! ওর উচ্চতা বেশি বলে একেকটা ফুটন্ত নাগকেশরের ডাল ধরে টেনে নামিয়ে আপার হাতে তুলে দিতো। মৃদু সুগন্ধে আমাদের মস্তিষ্কে মদালস আবেশ ছড়িয়ে যেতো। পরম যতেœ ফুলগুলো দুহাতে জড়িয়ে আপা ঘরে ফিরে আসতেন। সঙ্গে আমরাও ফিরতাম। নওয়াজেশ ভাই বায়না করতেন গান শুনবার। পার্থসারথি হারমোনিয়ামটা টেনে এনে দিতেই আপা গেয়ে উঠতেন- “ওগো শেফালি বনের মনের কামনা/কোন সুদূর গগনে গগনে/আছো মিলায়ে পবনে পবনে।/তুমি মূরতি ধরিয়া নামো না।” একে এক চললো গান, চললো চা-জলখাবারের পালা। একসময় শেষ হলো আসর। এবার ফিরবার পালা। মনে মনে গুন গুন করতে করতে বাড়ি ফিরতাম অনাবিল আনন্দ নিয়ে।

আহ, কী অপূর্ব স্মৃতিময় দিন! আমার জীবনপাত্র যেন উছ্লে পড়ে তাঁর অভিনব দানে! আমি প্রতিমুহূর্তে পূর্ণ হতে থাকি আকণ্ঠ ঋণে। আমার জীবন ভরে ওঠে তাঁর অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে, যা আমার সারা জীবনের অক্ষয় সম্পদ হয়ে আছে।

৩০ শে চৈত্র ১৪২৭ / ১৩ই এপ্রিল ২০২১

ছবি

চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে গ্রন্থ

ছবি

ভিন্নচোখ: নুতন কবিতা সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকা: মৃত্যুর রূপক এবং আন্দালুসিয়ার লোকজ বিশ্বাস

ছবি

কবিতার শিল্পনিষ্ঠ রূপকার ফারুক মাহমুদ

ছবি

কাফকাকে পড়া কাফকাকে পড়ানো

ছবি

কবি নওশাদ নূরী

ছবি

আঁধার পেরিয়ে আলোর উদ্ভাষণ

ছবি

সন্জীদা খাতুন : কৃতি ও কৃতিত্ব

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

মননশস্যের অমৃত মন্থন

ছবি

অনুবাদ ও ভূমিকা : আলী সিদ্দিকী

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বড়শি

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

এ মুখর বরষায়

ছবি

রক্তে লেখা প্রেম: রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিপ্লব

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শঙ্খজীবন: যাপিত জীবনের অন্তর্গূঢ় প্রতিকথা

ছবি

ওসামা অ্যালোমার এক ঝুড়ি খুদে গল্প

ছবি

প্রযুক্তির আলোয় বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

কাফকার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

সূর্যের দেশ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

লড়াই

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রচলিত সাহিত্যধারার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন মধুসূদন

ছবি

মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন

ছবি

উত্তর-মানবতাবাদ ও শিল্প-সাহিত্যে তার প্রভাব

ছবি

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

tab

সাময়িকী

স্মৃতিগদ্য : ২

দিনান্তবেলায়

হ অঞ্জনা সাহা

বৃহস্পতিবার, ০৮ জুলাই ২০২১

৩০শে চৈত্র, ১৪২৭। রাত পোহালেই নতুন ভোর ঝলমল করে উঠবে। শুরু হবে নবরূপে নতুন বছরের সূচনা- ১লা বৈশাখ ১৪২৮। শৈশবে দোকানে দোকানে হালখাতার উৎসব দেখেছি। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। তেমন করে দেখা যায় না আড়ং বা মেলা। এখন বলতে গেলে সবই প্রায় পোশাকী। করোনাকাল বলে এবার ‘ছায়ানট’-এর যে বর্ষবরণের উৎসব আয়োজনের জন্য প্রায় বছরব্যাপী মহড়া চলে, তাও স্থগিত থাকে। বন্ধ থাকে চারুকলার আকর্ষণীয় মঙ্গল শোভাযাত্রাও। সব মিলিয়ে শুধু প্রার্থনা থাকে- মঙ্গল হোক, শান্তি হোক ধরণীমাতার কোলে ফিরে আসুক স্বস্তি, ফিরে আসুক স্বাভাবিক জীবন। হে ঈশ্বর, মলিনমর্ম মুছিয়ে দাও আমাদের। শান্ত আর সমাহিত হোক পৃথিবী।

১৪২৮-এর পহেলা বৈশাখ। সকাল থেকেই অপেক্ষা করে আছি, কখন দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার আঁধার নামবে? আমরা ঘরে বসেই বর্ষবরণের একটি অনুষ্ঠানে হোয়াটসআপে মিলিত হবো। রাত ৮টা বাজতেই আমার আত্মজ হোয়াটসআপে যুক্ত হয়ে সকলকে তৈরি হতে বলল। ইথারে প্রায় দুহাজার মাইল দূর থেকে ওর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। আমরা পরিবারের সদস্যরা শুরু করলাম বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। শুরু হলো “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো” দিয়ে। আমার বোন গাইল অতুলপ্রসাদের “প্রেমে জল হয়ে যাও গলে...।” এরপর আমি গাইলাম ব্রহ্মসঙ্গীত “নতুন প্রাণ দাও প্রাণসখা...।” এ-আমার ছায়ানট-এর শিক্ষা ও আদর্শ। একসময় গান গাইতে গাইতে চোখ জলে ভরে এলো। আমার শিক্ষাগুরু সন্জীদা আপা (সন্জীদা খাতুন) কতো যত্ন করে গানগুলো শিখিয়েছিলেন! জীবনের যে মূল্যবান সময় তাঁর সান্নিধ্যে কাটিয়েছি, সেই ক্ষণ আমার জীবনে মহার্ঘ্য হয়ে আছে! তা ঘুরেফিরে চেতনে-অবচেতনে সারাক্ষণ সেলুলয়েডের পর্দায় ভেসে ওঠা ছবির মতো জীবন্ত হয়ে নড়েচড়ে বেড়ায়। মনে হয়, এই তো সে-দিনের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারের তিনতলায় আপার বৈঠকখানায় বসে আপা আর আমি পালাক্রমে রবীন্দ্রনাথ পড়ছি। অথবা নিমগ্ন হয়ে তিনি গান গাইছেন; আর আমি চোখ বুজে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তা শুনছি- ‘অশ্রুনদীর সুদূরপাড়ে...’, ‘বিমল আনন্দে জাগো রে...’, ‘সে যে মনের মানুষ, কেন তারে বসিয়ে রাখো...’ অথবা ‘আজি সাঁঝের যমুনায় গো...।’ এভাবে একে একে তিনি তাঁর প্রিয় গানগুলো গেয়ে যেতেন।

আমি প্রায় প্রতিদিনই আপার বাসায় যেতাম। সেখানে যাবার সময় নিচের বাগান থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ লিলিফুল তুলে নিতাম। কখনও দোলনচাঁপা, আবার কখনও নাগকেশর। এই সুগন্ধি ফুলগুলো আপার খুবই পছন্দের। এ-ছাড়া গন্ধরাজ ও বেলীও তিনি খুব ভালোবাসেন। রাতে ঘুমনোর সময় একটা পাত্রে বেলীফুলের আধো ফোটা কুঁড়ি জল ছিটিয়ে মাথার কাছে রেখে দিতেন। ঘরময় সে-সবের সৌগন্ধ্যে একটা স্বপ্নময় আবেশ তৈরি হতো। আর সেই আবেশ সঙ্গে নিয়েই তিনি ঘুমের রাজ্যে ডুবে যেতেন। তাঁর সান্নিধ্যে এসে এইসব আমার জানবার সৌভাগ্য হয়েছে।

মাঝে মাঝে প্রখ্যাত উদ্ভিদ জীনতত্ত্ববিজ্ঞানী ও আলোকচিত্রী নওয়াজেশ আহ্মদ আপার বাসায় আসতেন। আমি প্রতিদিনের স্বপ্রণোদিত অতিথি। তাই আমার সৌভাগ্য হয়ে কপালে জুটে যেতো এমন জ্যোতির্ময় মানুষের সঙ্গ। আমাদের গল্প, গানে ও আড্ডায় আপার বৈঠকখানা ঘর আনন্দের আবহে ভরে থাকতো। রাত বাড়লে ফিলে আসতাম বাসায়। কখনও কখনও বেশি রাত হয়ে গেলে আমার বড় ছেলে অভ্র আমাকে আনতে যেতো। রাত করে ফেরার কারণে বর মশায়ের বকুনিও জুটতো! কিন্তু সে-বকুনি গায়ে লাগতো না! একবুক আনন্দ নিয়ে ফিরলে তার কাছে সবকিছুই ফিকে মনে হতো। নওয়াজেশ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগতো। এতো সহজ আর আন্তরিক ছিলেন তিনি। কখনও মনেই হতো না যে, এতো বড় একজন মানুষের সঙ্গে বসে কথা বলছি! একবার তিনি গল্পে গল্পে বার্মা ভ্রমণের কথা বলছিলেন। তিনি ওদের কৃষিপদ্ধতির ব্যাপারে আমাদের কাছে বিষদ বর্ণনা করলেন। ওদের কৃষিজমি কম বলে নদীর জলের ওপর কেমন করে বাঁশের মাচান তৈরি করে ভেলার মতো ভাসিয়ে, কচুরিপানায় ভরাট করে এবং তার ওপর মাটির বেড বানিয়ে তারা বীজধান বপন ক’রে ধানচাষ করে, সেই পদ্ধতি দেখে এসেছিলেন। যেহেতু ভাসমান জমি, তাই সেচ দিতে হয় না! বাংলাদেশের কোথাও কোথাও এই পদ্ধতিতে ধানচাষ করার কথা শুনেছি। নওয়াজেশ ভাই কৃষিবিজ্ঞানের বই লিখেছেন এবং দেশ-বিদেশ থেকে অনেক সম্মাননাও পেয়েছেন।

আমি প্রায় প্রতিদিন সন্জীদা আপার জন্য ফুলের নৈবেদ্য সাজিয়ে নিয়ে যেতাম। ফুল কিনবার মতো সামর্থ্য ছিলো না বলে আপার স্টাফ কোয়ার্টারের নিচের বাগান থেকে দু’হাত ভরে তুলে নিতাম। উদ্দেশ্য একটাই, আপার মনে একটু আনন্দের ছোঁয়া লাগানো। নওয়াজেশ ভাই যেদিন দিনের আলো থাকতে থাকতে আসতেন, সেদিন পার্থসারথি এসে খবর দিতো, নাগকেশর ফুটেছে। আমরা সবাই সেই ফুল দেখতে নিচে নেমে যেতাম। আপা, আমি, নওয়াজেশ ভাই আর সঙ্গে থাকতো পার্থসারথিও! ওর উচ্চতা বেশি বলে একেকটা ফুটন্ত নাগকেশরের ডাল ধরে টেনে নামিয়ে আপার হাতে তুলে দিতো। মৃদু সুগন্ধে আমাদের মস্তিষ্কে মদালস আবেশ ছড়িয়ে যেতো। পরম যতেœ ফুলগুলো দুহাতে জড়িয়ে আপা ঘরে ফিরে আসতেন। সঙ্গে আমরাও ফিরতাম। নওয়াজেশ ভাই বায়না করতেন গান শুনবার। পার্থসারথি হারমোনিয়ামটা টেনে এনে দিতেই আপা গেয়ে উঠতেন- “ওগো শেফালি বনের মনের কামনা/কোন সুদূর গগনে গগনে/আছো মিলায়ে পবনে পবনে।/তুমি মূরতি ধরিয়া নামো না।” একে এক চললো গান, চললো চা-জলখাবারের পালা। একসময় শেষ হলো আসর। এবার ফিরবার পালা। মনে মনে গুন গুন করতে করতে বাড়ি ফিরতাম অনাবিল আনন্দ নিয়ে।

আহ, কী অপূর্ব স্মৃতিময় দিন! আমার জীবনপাত্র যেন উছ্লে পড়ে তাঁর অভিনব দানে! আমি প্রতিমুহূর্তে পূর্ণ হতে থাকি আকণ্ঠ ঋণে। আমার জীবন ভরে ওঠে তাঁর অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে, যা আমার সারা জীবনের অক্ষয় সম্পদ হয়ে আছে।

৩০ শে চৈত্র ১৪২৭ / ১৩ই এপ্রিল ২০২১

back to top