alt

সাময়িকী

শেষ চুমুকের আগে : জীবনের বাইপাসে ব্যক্তিগত ভ্রমণ

বীরেন মুখার্জী

: বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১

‘শেষ চুমুকের আগে’ বাক্যটি দ্ব্যর্থবোধক। দ্ব্যর্থবোধক এ কারণেই যে, এটি অনিশ্চয়তাপূর্ণ। বাক্যটি পাঠক-শ্রোতার সামনে রহস্যময় এক জগত তৈরি করে। আর এটি যদি হয় কোনো কবিতাগ্রন্থের শিরোনাম, তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায়, কবিতাপ্রেমী পাঠক সেই রহস্যের প্রেমে না পড়ে পারেন না। ‘শেষ চুমুকের আগে’ গ্রন্থের কবিতাগুলোতে কবি কানিজ পারিজাত কোন রহস্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন, একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে তা জানতে বইটি হাতে নিয়ে আমি বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠি। বইয়ের বিমূর্ত প্রচ্ছদে চোখ রেখে রহস্যের অতলে তলিয়ে যেতে থাকি। বিস্ময়-ঘোরে ডুবে থাকি কিছু সময়। এরপর গ্রন্থের কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ভূমিকা থেকে জানতে পারি, ‘কবির ভাবনার পৃথিবী অবারিত এবং বহির্মুখী। যা প্রধানত সন্দেহাতীত এবং কল্পনাপ্রসূত। কবি স্বপ্নাচারী। তার কল্পনার অসীম দিগরেখায় যা দৃশ্যায়িত হয় তা শুধু কবিই অনুভব করতে পারেন। ফলে কবির রচনায় পাঠকমন মস্তিষ্কগতভাবে নয়, হৃদয়গতভাবে আন্দোলিত হয়।’ ভূমিকা পাঠ শেষে ভেতরের কবিতাগুলো পাঠ করতে গিয়ে, কবি-ছড়াকার ফারুক নওয়াজের প্রবেশক অবলোকনের সঙ্গে কবির কল্পনার সরোবরে আমিও অবগাহন করতে থাকি। গ্রন্থের ভূমিকাটি অত্যন্ত সহায়ক এবং মনোগ্রাহী। কেননা ভূমিকাটি পাঠের পর ভেতরের কবিতাগুলো পাঠে দারুণভাবে উৎসাহিত হয়েছি। পাশাপাশি ‘কবিতা’ কী- পুরনো এ প্রশ্নটিও নতুন করে আমাকে প্রশ্নশীল করে তুলেছে।

‘মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে : কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে’- কবিতা নিয়ে এই উক্তিটি অধ্যাপক-কবি-গবেষক ড. হুমায়ুন আজাদের। অপরদিকে ‘আধুনিকতা’ এবং ‘ফিউচারিজম’ আন্দোলনের প্রবক্তা প্যারিসে জন্মগ্রহণকারী সুইজারল্যান্ডের কবি-উপন্যাসিক ব্লেজ সঁদ্রার (ইষধরংব ঈবহফৎধৎ) বলেছেন, ‘প্রত্যেকটি জীবন একটা কবিতা, একটা গতি ছাড়া আর কিছুই নয়’ -অমর একুশে বইমেলা ২০২১-এ প্রকাশিত কানিজ পারিজাতের ‘শেষ চুমুকের আগে’ গ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠ করতে গিয়ে কবিতাবিষয়ক এই কথাগুলো বারংবার মস্তিষ্কে অনুরণন তুলছিল। কবিতা সম্পর্কিত দেশ-বিদেশের নানান গুণী কবি-সমালোচক-বোদ্ধাদের মতামত থেকে এটা অবধারিতভাবেই বলা যেতে পারে, কবিতা রহস্যের আধার। যুগে যুগে যত কবিতা লিখিত হয়েছে, কানিজ পারিজাতের কবিতাও এর উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। কবি যখন উচ্চারণ করেন-

‘এ পথে হাঁটো না তুমি বহুদিন;

শুনেছি নতুন পথ ধরে হেঁটে যাও পুবে- বাইপাস!

মাঝে মাঝে ভাবি, আমিও বাইপাস খুঁজি;

নতুন পথ ধরে হেঁটে যাই

দক্ষিণে-পশ্চিমে-উত্তরে!

মেঠোপথটা হাতছানি দিয়ে ডাকে-

আমার আর বাইপাস খোঁজা হয় না।’

[বাইপাস/ শেষ চুমুকের আগে, পৃষ্ঠা ৬২]

কবিতাটি পাঠে কবিতাপ্রেমী পাঠকের হৃদয়ে এক ধরনের শূন্যতা অনুভূত হয়। কবি যখন কাক্সিক্ষত বিষয় বা বস্তুর সন্ধানে ‘বাইপাস’ খুঁজতে মনস্থির করেন, তখন চারিপাশের প্রকৃতিই কবিকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যায় কবিমন। কবির পাশাপাশি পাঠকও নিমজ্জিত হন প্রকৃতির করিডোরে। প্রকৃতিই তো মানুষের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তবে শুধু ‘বাইপাস’ নয়, গ্রন্থের অন্যান্য কবিতা পাঠেও আমার মনে হয়েছে কবি কল্পনার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি ও জীবনের বাইপাসে ব্যক্তিগত ভ্রমণ করেছেন। এ ভ্রমণ কখনো কবির ব্যক্তিগত, কখনোবা সর্বজনীন মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। পাঠকও কবির সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব মনোলোকে ব্যক্তিগত ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন।

কবিতাবোদ্ধারা বলেন, কবিতায় আবেগের সংযত প্রকাশ থাকা জরুরি। কিন্তু ‘শেষ চুমুকের আগে’ গ্রন্থের বেশ কিছু কবিতায় আবেগের ফল্গুধারা প্রবহমান। এটা দোষের কিছু নয়। মানুষের অন্তস্থিত আবেগ থেকেই তো কবিতার জন্ম। আবার কোনো কোনো কবিতা লিখিত হয়েছে গল্পের বয়ানে। এটা সত্যি যে, গল্প আর কবিতা- উভয়ই জীবনের অন্তর্গত বিষয়। জীবনের অন্তদর্শন থেকেই এর উৎপত্তি। উপস্থাপনগত কারণে কবিতা এবং গল্পকে সহজে পৃথক করা যায়। কবিতায় রূপক, অলঙ্কার, চিত্রকল্প, ছন্দ, উপমার সন্নিবেশ থাকা জরুরি। তাহিলে কানিজ পারিজাতের কবিতায় কি কাব্যিক অলঙ্কার অনুপস্থিত? ব্যঞ্জনা নেই? নিশ্চয়ই থাকতে পারে। এগুলো উপস্থাপনের দায় বোদ্ধা সমালোচকের। কিন্তু সাধারণ পাঠক হিসেবে আমি অত্যন্ত সংশয়ী। অদীক্ষিত, অনভিজ্ঞও বটে। যে কারণে কবিতা পাঠ করতে শুরু করলে এসব প্রশ্ন আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায়, আর সংশয়ী চিত্ত নিয়েই কবিতা পাঠ করতে হয়। বলতে দ্বিধা নেই, যে ধরনের কবিতা আমার সর্বাধিক পছন্দের, কানিজ পারিজাতের কবিতা ঠিক তেমনটি নয়। উদ্ভাবনঘনিষ্ঠতা, শিল্পঘনিষ্ঠতা, জীবনঘনিষ্ঠতা আমাকে ভাবিত করে তুলতে না পারলে তা আমার কাছে কবিতা নয়। কবিতাবিষয়ক এই উপলব্ধিও আমার ব্যক্তিগত। আমার মনে হয়েছে কানিজ পারিজাতের কবিতা প্রতিদিন লিখিত হওয়া শত শত কবিতার ধারাবাহিকতা। এসব কবিতায় আছে যথাযথ চিত্রকল্পের ঘাটতি, আছে ছন্দহীনতা, আছে রূপক-উপমাসহ নানান কাব্যিক অসামঞ্জস্য।

কবি কানিজ পারিজাত পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন। অভিনয় এবং আবৃত্তিতে রয়েছে কবির অসামান্য দক্ষতা। যে কারণে কবির বেশিরভাগ কবিতা হয়ে উঠেছে আবৃত্তিযোগ্য। মোটাদাগে কানিজ পারিজাতের কবিতার ভেতর পরিভ্রমণের সুযোগ আছে। কবিকল্পনার শক্তিশালী ভিত্তিও লক্ষ করা যায়। কবির নিজস্ব দর্শনজাত উপলব্ধি ও আবেগ কবিকে দিয়ে কিছু সুখপাঠ্য কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে, এ কথা হলফ করেই বলা যায়। কবি ছন্দসচেতন হলে তার কাছ থেকে পাঠক আরো ভালো কবিতা উপহার পাবেন বলে বিশ্বাস করি। এ কথাও সত্যি যে, বর্তমানের শব্দজঞ্জাল কবিতার মতো কানিজ পারিজাতের কবিতা দুর্বোধ্য নয়। তিনি সচেতনভাবেই সাধারণ শব্দসমবায়ে গড়ে তুলেছেন কবিতার সৌধ। তার কবিতার বেশিরভাগজুড়েই রয়েছে প্রকৃতির সরব উপস্থিতি। যে কারণে গ্রন্থভুক্ত ৪৯টি কবিতা মন্ময়ী পাঠকসহ সব ধরনের পাঠকেরই ভালো লাগবে। প্রখ্যাত প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষের নান্দনিক প্রচ্ছদে ‘শেষ চুমুকের আগে’ কবিতাগ্রন্থটির প্রকাশক সঞ্জয় মজুমদার। মূর্ধন্য প্রকাশনীর ব্যানারে ঢাকার ৪১ কনকর্ড এম্পোরিয়াম থেকে এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে এটি প্রকাশিত হয়েছে। ৬৪ পৃষ্ঠা সম্বলিত উন্নত বাঁধাইয়ে গ্রন্থটির মুদ্রিত মূল্য একশত পঞ্চাশ টাকা। গ্রন্থটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করছি।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

শেষ চুমুকের আগে : জীবনের বাইপাসে ব্যক্তিগত ভ্রমণ

বীরেন মুখার্জী

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১

‘শেষ চুমুকের আগে’ বাক্যটি দ্ব্যর্থবোধক। দ্ব্যর্থবোধক এ কারণেই যে, এটি অনিশ্চয়তাপূর্ণ। বাক্যটি পাঠক-শ্রোতার সামনে রহস্যময় এক জগত তৈরি করে। আর এটি যদি হয় কোনো কবিতাগ্রন্থের শিরোনাম, তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায়, কবিতাপ্রেমী পাঠক সেই রহস্যের প্রেমে না পড়ে পারেন না। ‘শেষ চুমুকের আগে’ গ্রন্থের কবিতাগুলোতে কবি কানিজ পারিজাত কোন রহস্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন, একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে তা জানতে বইটি হাতে নিয়ে আমি বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠি। বইয়ের বিমূর্ত প্রচ্ছদে চোখ রেখে রহস্যের অতলে তলিয়ে যেতে থাকি। বিস্ময়-ঘোরে ডুবে থাকি কিছু সময়। এরপর গ্রন্থের কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ভূমিকা থেকে জানতে পারি, ‘কবির ভাবনার পৃথিবী অবারিত এবং বহির্মুখী। যা প্রধানত সন্দেহাতীত এবং কল্পনাপ্রসূত। কবি স্বপ্নাচারী। তার কল্পনার অসীম দিগরেখায় যা দৃশ্যায়িত হয় তা শুধু কবিই অনুভব করতে পারেন। ফলে কবির রচনায় পাঠকমন মস্তিষ্কগতভাবে নয়, হৃদয়গতভাবে আন্দোলিত হয়।’ ভূমিকা পাঠ শেষে ভেতরের কবিতাগুলো পাঠ করতে গিয়ে, কবি-ছড়াকার ফারুক নওয়াজের প্রবেশক অবলোকনের সঙ্গে কবির কল্পনার সরোবরে আমিও অবগাহন করতে থাকি। গ্রন্থের ভূমিকাটি অত্যন্ত সহায়ক এবং মনোগ্রাহী। কেননা ভূমিকাটি পাঠের পর ভেতরের কবিতাগুলো পাঠে দারুণভাবে উৎসাহিত হয়েছি। পাশাপাশি ‘কবিতা’ কী- পুরনো এ প্রশ্নটিও নতুন করে আমাকে প্রশ্নশীল করে তুলেছে।

‘মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে : কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে’- কবিতা নিয়ে এই উক্তিটি অধ্যাপক-কবি-গবেষক ড. হুমায়ুন আজাদের। অপরদিকে ‘আধুনিকতা’ এবং ‘ফিউচারিজম’ আন্দোলনের প্রবক্তা প্যারিসে জন্মগ্রহণকারী সুইজারল্যান্ডের কবি-উপন্যাসিক ব্লেজ সঁদ্রার (ইষধরংব ঈবহফৎধৎ) বলেছেন, ‘প্রত্যেকটি জীবন একটা কবিতা, একটা গতি ছাড়া আর কিছুই নয়’ -অমর একুশে বইমেলা ২০২১-এ প্রকাশিত কানিজ পারিজাতের ‘শেষ চুমুকের আগে’ গ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠ করতে গিয়ে কবিতাবিষয়ক এই কথাগুলো বারংবার মস্তিষ্কে অনুরণন তুলছিল। কবিতা সম্পর্কিত দেশ-বিদেশের নানান গুণী কবি-সমালোচক-বোদ্ধাদের মতামত থেকে এটা অবধারিতভাবেই বলা যেতে পারে, কবিতা রহস্যের আধার। যুগে যুগে যত কবিতা লিখিত হয়েছে, কানিজ পারিজাতের কবিতাও এর উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। কবি যখন উচ্চারণ করেন-

‘এ পথে হাঁটো না তুমি বহুদিন;

শুনেছি নতুন পথ ধরে হেঁটে যাও পুবে- বাইপাস!

মাঝে মাঝে ভাবি, আমিও বাইপাস খুঁজি;

নতুন পথ ধরে হেঁটে যাই

দক্ষিণে-পশ্চিমে-উত্তরে!

মেঠোপথটা হাতছানি দিয়ে ডাকে-

আমার আর বাইপাস খোঁজা হয় না।’

[বাইপাস/ শেষ চুমুকের আগে, পৃষ্ঠা ৬২]

কবিতাটি পাঠে কবিতাপ্রেমী পাঠকের হৃদয়ে এক ধরনের শূন্যতা অনুভূত হয়। কবি যখন কাক্সিক্ষত বিষয় বা বস্তুর সন্ধানে ‘বাইপাস’ খুঁজতে মনস্থির করেন, তখন চারিপাশের প্রকৃতিই কবিকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যায় কবিমন। কবির পাশাপাশি পাঠকও নিমজ্জিত হন প্রকৃতির করিডোরে। প্রকৃতিই তো মানুষের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তবে শুধু ‘বাইপাস’ নয়, গ্রন্থের অন্যান্য কবিতা পাঠেও আমার মনে হয়েছে কবি কল্পনার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি ও জীবনের বাইপাসে ব্যক্তিগত ভ্রমণ করেছেন। এ ভ্রমণ কখনো কবির ব্যক্তিগত, কখনোবা সর্বজনীন মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। পাঠকও কবির সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব মনোলোকে ব্যক্তিগত ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন।

কবিতাবোদ্ধারা বলেন, কবিতায় আবেগের সংযত প্রকাশ থাকা জরুরি। কিন্তু ‘শেষ চুমুকের আগে’ গ্রন্থের বেশ কিছু কবিতায় আবেগের ফল্গুধারা প্রবহমান। এটা দোষের কিছু নয়। মানুষের অন্তস্থিত আবেগ থেকেই তো কবিতার জন্ম। আবার কোনো কোনো কবিতা লিখিত হয়েছে গল্পের বয়ানে। এটা সত্যি যে, গল্প আর কবিতা- উভয়ই জীবনের অন্তর্গত বিষয়। জীবনের অন্তদর্শন থেকেই এর উৎপত্তি। উপস্থাপনগত কারণে কবিতা এবং গল্পকে সহজে পৃথক করা যায়। কবিতায় রূপক, অলঙ্কার, চিত্রকল্প, ছন্দ, উপমার সন্নিবেশ থাকা জরুরি। তাহিলে কানিজ পারিজাতের কবিতায় কি কাব্যিক অলঙ্কার অনুপস্থিত? ব্যঞ্জনা নেই? নিশ্চয়ই থাকতে পারে। এগুলো উপস্থাপনের দায় বোদ্ধা সমালোচকের। কিন্তু সাধারণ পাঠক হিসেবে আমি অত্যন্ত সংশয়ী। অদীক্ষিত, অনভিজ্ঞও বটে। যে কারণে কবিতা পাঠ করতে শুরু করলে এসব প্রশ্ন আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায়, আর সংশয়ী চিত্ত নিয়েই কবিতা পাঠ করতে হয়। বলতে দ্বিধা নেই, যে ধরনের কবিতা আমার সর্বাধিক পছন্দের, কানিজ পারিজাতের কবিতা ঠিক তেমনটি নয়। উদ্ভাবনঘনিষ্ঠতা, শিল্পঘনিষ্ঠতা, জীবনঘনিষ্ঠতা আমাকে ভাবিত করে তুলতে না পারলে তা আমার কাছে কবিতা নয়। কবিতাবিষয়ক এই উপলব্ধিও আমার ব্যক্তিগত। আমার মনে হয়েছে কানিজ পারিজাতের কবিতা প্রতিদিন লিখিত হওয়া শত শত কবিতার ধারাবাহিকতা। এসব কবিতায় আছে যথাযথ চিত্রকল্পের ঘাটতি, আছে ছন্দহীনতা, আছে রূপক-উপমাসহ নানান কাব্যিক অসামঞ্জস্য।

কবি কানিজ পারিজাত পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন। অভিনয় এবং আবৃত্তিতে রয়েছে কবির অসামান্য দক্ষতা। যে কারণে কবির বেশিরভাগ কবিতা হয়ে উঠেছে আবৃত্তিযোগ্য। মোটাদাগে কানিজ পারিজাতের কবিতার ভেতর পরিভ্রমণের সুযোগ আছে। কবিকল্পনার শক্তিশালী ভিত্তিও লক্ষ করা যায়। কবির নিজস্ব দর্শনজাত উপলব্ধি ও আবেগ কবিকে দিয়ে কিছু সুখপাঠ্য কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে, এ কথা হলফ করেই বলা যায়। কবি ছন্দসচেতন হলে তার কাছ থেকে পাঠক আরো ভালো কবিতা উপহার পাবেন বলে বিশ্বাস করি। এ কথাও সত্যি যে, বর্তমানের শব্দজঞ্জাল কবিতার মতো কানিজ পারিজাতের কবিতা দুর্বোধ্য নয়। তিনি সচেতনভাবেই সাধারণ শব্দসমবায়ে গড়ে তুলেছেন কবিতার সৌধ। তার কবিতার বেশিরভাগজুড়েই রয়েছে প্রকৃতির সরব উপস্থিতি। যে কারণে গ্রন্থভুক্ত ৪৯টি কবিতা মন্ময়ী পাঠকসহ সব ধরনের পাঠকেরই ভালো লাগবে। প্রখ্যাত প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষের নান্দনিক প্রচ্ছদে ‘শেষ চুমুকের আগে’ কবিতাগ্রন্থটির প্রকাশক সঞ্জয় মজুমদার। মূর্ধন্য প্রকাশনীর ব্যানারে ঢাকার ৪১ কনকর্ড এম্পোরিয়াম থেকে এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে এটি প্রকাশিত হয়েছে। ৬৪ পৃষ্ঠা সম্বলিত উন্নত বাঁধাইয়ে গ্রন্থটির মুদ্রিত মূল্য একশত পঞ্চাশ টাকা। গ্রন্থটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করছি।

back to top