সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
নজরুল ইসলামের প্রতিভা অনেক দিক দিয়েই বিস্ময়কর। সবচেয়ে অধিক বিস্ময়ের ব্যাপার বোধ করি কবি হওয়ার জন্যে তাঁর প্রস্তুতির আপাত-সামান্যতা। তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেননি। না করুন, তাঁর পরিবেশ, পরিবারে, গৃহে তো থাকতে পারতো উচ্চতর সাংস্কৃতিক উপাদান। একটি সমৃদ্ধশালী সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে তাঁর জন্ম ও লালন হতে পারতো। না তেমন পরিবেশ তাঁর আদৌ ছিল না। বিত্ত ছিল না গৃহে, সুসংগৃহীত পাঠাগার ছিল না বাড়িতে। ঘরও ছিল না বলতে গেলে, স্রোতের মধ্যে ভেসে ভেসে বেড়িয়েছেন তিনি, সারাটা জীবন।
‘কী ভীষণ দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে অনশনে অর্ধাশনে দিন কাটিয়ে আমাদের নতুন লেখকদের বেঁচে থাকতে হয় লক্ষ্মীর কৃপায় কবিগুরুর তা জানা নেই।’ নজরুল লিখেছিলেন একসময়ে। আরো বলেছিলেন, ‘ভগবান করুন, তাঁকে যেন জানতে না হয়। কবিগুরু কোনদিন আমাদের মতো সাহিত্যিকদের কুটিরে যেন পদার্পণ করেননি হয়ত তাঁর মহিমা ক্ষুণœ হ’তো না তাতে নৈলে দেখতে পেতেন আমাদের জীবনযাত্রার দৈন্য কত ভীষণ। এই দীন-মলিন বেশ নিয়ে আমরা আছি দেশের একটেরে আত্মগোপন করে। দেশে দেশে প্রোপাগা-া করাতো দূরের কথা বাড়ি ছেড়ে পথে দাঁড়াতে লজ্জা করে। কিছুতেই ছেঁড়া জামার তালিগুলিকে লুকাতে পারিনে। ভদ্র শিক্ষিতদের মাঝে ব’সে সর্বদাই মন খুঁতখুঁত করে, যেন কত বড় অপরাধ করে ফেলেছি বাইরের দৈন্য-অভাব যত ভিতরে ভিতরে চাবকাতে থাকে, তত মনটা বিদ্রোহী হ’য়ে উঠতে থাকে।’
এই বর্ণনায় অতিশয়োক্তি নেই। অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে এসেছিলেন তিনি, সেই দারিদ্র্য তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি, অত্যন্ত উচ্চ প্রতিষ্ঠার দিনেও নয় তাহলে কী করে, কোন গোপন রহস্যাচ্ছন্ন কারণে, পরিবেশের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি বড় কবি হলেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আমরা নজরুলের যে শক্তি তার একটি বড় উৎস এবং সেই সঙ্গে তার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণের সামনে এসে দাঁড়াই। উৎস হচ্ছে জীবনকে গ্রহণ করার অসামান্য ক্ষমতা। জীবনকে পরিপূর্ণভাবে, দ্বিধাহীন চিত্তে, নিঃশঙ্ক সাহসে গ্রহণ করবার মধ্যে দিয়ে বড় কবি হয়েছেন তিনি, পিছনে পড়ে রয়েছে পরিবেশের প্রতিকূলতা, পড়ে রয়েছে প্রস্তুতির তথাকথিত অকিঞ্চিৎকরতা। জীবনকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই বড় তিনি, গ্রহণ করতে পেরেছিলন বলেই বড়। নজরুল যে প্রথম মহাযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের পরের লেখক এই সত্যও তাঁর গ্রহণ-ক্ষমতার দরুন তাঁর লেখার অভ্যন্তরে যেমনভাবে প্রতিভাত, তেমনভাবে প্রতিভাত হয়নি অন্য কোনো বাঙালি কবির রচনায়।
কায়কোবাদের মতো তিনিও দেখেছেন অনাহারক্লিষ্ট শিশুকে তাঁর চারপাশে কাঁদতে, কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে সেই হীনম্মন্যতা ছিল না যা আপন সন্তানকে বলতে শেখায় ‘অপোগ- শিশু’, শেখায় করুণা করতে নিজেকে। দারিদ্র্য তাঁকে দুর্বল করেনি, মহৎ করেছে তাঁকে দিয়েছে খ্রিস্টের সম্মান। আত্মকরুণা যে নজরুল ইসলামে নেই তা নয়, আছে; অশ্রু ও অভিমান, ‘ফুল নেব না অশ্রু নেব’ এই প্রশ্ন, অর্থাৎ নানা প্রকারে ভঙ্গিমা; কিন্তু সবকিছু নিজের মধ্যে ধারণ করে, সবকিছুকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে জীবনের সামান্যতাকে নিচে রেখে বড় হয়ে উঠেছেন তিনি।
তিনি গৃহের কবি নন, কবি তিনি উন্মুক্ত পথের, যদিও গৃহ তাঁর রচনার মধ্যে আছে। আগামী দিনের মানুষ নজরুলকে কিভাবে মেনে নেবে সেটা তাদের বিবেচ্য, কিন্তু আমাদের পক্ষে নজরুলের এই পরিচয়টাই প্রধান যে, কবি তিনি উন্মুক্ত পথের। একেক যুগে একেকভাবে নেয় একই প্রতিভাকে, আমাদের পক্ষে উন্মুক্ত পথে স্বচ্ছন্দ যাত্রী নজরুল ইসলামই প্রধানতম। সেইখানেই বিদ্রোহী তিনি, মৌলিক ও বিশিষ্ট। এই পরিচয়টাই যে বড় করে চোখে পড়ে তার কারণ দুটি। প্রথম কারণ, আমাদের জীবনে পথের অভাব, অভাব পথচারীর। আমরা সকলেই গৃহে, গৃহের বাইরে ছোট ছোট গলিঘুপচি আঁকাবাঁকা আছে বটে কিন্তু উন্মুক্ত পথ নেই খুব বেশি। পথ যেখানে-বা আছে অভাব আছে যাত্রীর। দ্বিতীয় কারণ এই যে, গৃহহীন নজরুলের পক্ষে গৃহী হওয়াই স্বাভাবিক ছিল, গৃহী না হওয়ার মধ্যে তাঁর অসাধারণত্ব যেমনভাবে প্রকাশ পেয়েছে তেমনি বোধহয় অন্য কোথাও নয়। সকলেই জানেন যে, নজরুলের ওপর প্রভাব পড়েছিল ওয়াল্ট হুইটম্যানের। সেই প্রভাব একান্ত স্বাভাবিক, কেননা হুইটম্যানও কবি ছিলেন উন্মুক্ত পথেরই। উন্মুক্ত পথের পথিক বলেই অতি অনায়াসে সর্বগামী হয়েছেন তিনি। হিন্দু মুসলমানের মিলন তাঁর লেখার মধ্যে যেমন ঘটেছে, রাজনীতিতে, বা সাহিত্যে কোথাও ঘটেনি বাংলাদেশের। হিন্দু-ঐতিহ্য ও মুসলিম ঐতিহ্য উভয়কে কাব্যক্ষেত্রে একত্রে উপস্থিত করে কাব্যে ঐতিহ্যের ব্যবহারকে প্রসারতা দানের ক্ষেত্রে এমন একটা কাজ করলেন তিনি যা তাঁর আগের কোন কবি বা লেখক করেননি, করতে পারেননি, করার কথা ভাবেননি। এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও উদার কাজটি যে তাঁর অপেক্ষাতেই পড়ে ছিল, বাকি ছিল। সাধারণ মানুষের জীবনে তিনি যেমনভাবে প্রবেশ করেছেন তাঁর আগে অন্য কোনো লেখক তেমনভাবে প্রবেশ করতে পারেননি। তাঁর অসামান্য গল্প রাক্ষসীতে তিনি শুধু বাগদী মেয়েকে আনেননি, এনেছেন বাগদীদের মুখের ভাষাকেও। বাগদী মেয়ে ভদ্রসমাজে চলে এসেছে অকুণ্ঠ পদে, নিজের ভাষায় কথা বলতে বলতে। সন্দেহ নেই নজরুলের লেখা নাটকগুলোই তাঁর সাহিত্যের দুর্বলতম অংশ। সেখানে ভাবালুতা অধিক, কিন্তু সেই ভাবালুতার মধ্যেও নারীশক্তির উদ্বোধন ভিন্ন যে মুক্তি নেই আমাদের, এই কঠিন সত্যটিকে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করেছেন তিনি ‘ভূতের ভয়’ নাটকে। ‘ঝিলিমিলিতে বিএ পাস করা-না-করার যে প্রাণঘাতী বিতর্ক হত্যা করলো ফিরোজাকে সে শুধু বিতর্ক নয় একটা, সেটা হচ্ছে মুসলমান সমাজের গৃহাভ্যন্তরের যে প্রাণহীনতা, যে-আনন্দহীনতা ঘরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে অন্যায় শাসনের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে তারই প্রকাশ। চিরকালের মেয়ে ফিরোজা নজরুলের কালে এসে লাঞ্ছিত হয়েছে মুসলমানের গৃহে আটকা পড়ে। সন্ত্রাসবাদী তরুণকে নজরুল যেমনভাবে বুঝেছেন তেমনভাবে এমনকি রবীন্দ্রনাথও বোঝেননি। ‘চার অধ্যায়’-এর তুলনায় ‘কুহেলিকা’র সাহিত্যিক মূল্য স্বল্প সন্দেহ নেই, কিন্তু ‘কুহেলিকা’য় যে সহানুভূতি আছে তরুণ সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি ‘চার অধ্যায়’-এ তা নেই। ‘কুহেলিকা’র জাহাঙ্গীর সমসাময়িক মুসলিম সমাজে ছিল না। নজরুল নানাদিক থেকে এগিয়ে ছিলেন তাঁর সমাজের তুলনায়। আনসার যখন নতুন রাজনীতিকে গ্রহণ করেছে, কৃষক-শ্রমিকের রাজনীতিকে, তখন বোঝা যায় নজরুল এগিয়ে গেছেন সমসাময়িক লেখকদের অনেককে পেছনে ফেলে। আনসারকে তিনি শরৎচন্দ্রের সব্যসাচী করেননি, কল্পনার আতিশয্যকে পরিহার করার মধ্যে যে বাস্তববুদ্ধি প্রকাশিত হয়েছে তা সাধারণ নয়।
তাঁর যুগের অসন্তোষ ও বিক্ষোভ, অস্থিরতা, তরুণ মনের দুঃসাহসিক স্পর্ধা, স্বাধীনতার সুতীব্র আগ্রহ সমস্ত কিছু অসংকোচে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর মধ্য দিয়ে। বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর, কাব্যের সঙ্গে কবির, যুগের সঙ্গে যুগ-প্রতিনিধির কোনো ব্যবধান রইলো না তাঁর ক্ষেত্রে। শুধু বিদ্রোহ নয়, যুগের অভিমান ও আধ্যাত্মিকতাও নিয়েছেন তিনি। চরকা নিয়েছেন, নিয়েছেন সন্ত্রাসবাদ। সাম্যবাদ নিয়েছেন, নিয়েছেন অধ্যাত্মবাদ। তাঁর কাব্যে হুঙ্কার আছে, আছে অশ্রুপাত। স্ববিরোধিতা বলা যায় এদেরকে, বললে মানতে হয় সে যুক্তি। কিন্তু এই স্ববিরোধিতার মূল কথা হচ্ছে জীবন ও যুগের সকল প্রবণতাকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করা। নিজের করে নেয়া।
পরিবেশের যে-প্রতিকূলতা, দারিদ্র্যের যে নিপীড়ন ব্যক্তি নজরুলের জন্য অমিত্রসুলভ ছিল, সেই প্রতিকূলতা ও দারিদ্র্যই তাঁর মিত্র হয়ে দেখা দিল কাব্যের ক্ষেত্রে। দরিদ্র, মেহনতি মানুষের মানসিকতা ছিল তাঁর; ছিল না নিম্নমধ্যবিত্তের মানসিকতা। নিম্নমধ্যবিত্ত শুচিবায়ুগ্রস্ত, সে বর্জনবাদী, অকারণ শত্রুতা-বিলাসী। মেহনতি মানুষের সুযোগ নেই বিলাস করবে শুচিবায়ুর, বর্জনের, অনর্থক শত্রুতার। সে গ্রহণ করে, সকলকে জড়িয়ে ধরে। তার ভয় নেই হারাবার। নজরুল ভীত ছিলেন না।
নিম্নমধ্যবিত্তের চেতনার নিশ্চিত প্রমাণ আছে বর্জনবাদিতায়। নজরুলের তুলনায় অধিক সুযোগপ্রাপ্ত সমসাময়িকদের মধ্যেও এই বর্জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করবার মতো। এর প্রধান কারণ লেখকদের শ্রেণীগত অবস্থান। অবিভক্ত বাংলাদেশের জনসমষ্টিতে শতকরা হিসাবে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অধিক, কিন্তু সাহিত্যে তাদের যথাযোগ্য অনুপস্থিতি সেই সত্যকেই নির্দেশিত করছিল যে-সত্য অন্তর্ঘাতী শক্তি হিসেবে বঙ্গভূমির বিভাজনে কাজ করেছিল। আরো বড় কথা, সাধারণ মানুষের মানবিক উপস্থিতিতেও উজ্জ্বল ছিল না সাহিত্য। করুণা ছিল, অভাব ছিল স্বীকৃতির। নজরুল অসাম্প্রদায়িক উভয় অর্থেই, তিনি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং তিনি ধনী-নির্ধনের বেড়াজাল মানেননি।
আস্ফালনকারী মোহিতলাল মজুমদারের সঙ্গে তুলনা করলে নজরুলের গ্রহণ-শক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। মোহিতলাল আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেছেন কিন্তু স্বদেশী মুসলিম জীবনচেতনাকে সাহিত্যে উপস্থিত করতে পারেননি। নজরুল পেরেছিলেন হিন্দু মানসিকতাকেও সাহিত্যে প্রতিফলিত করতে, তাঁর শ্যামা-সংগীত সেই শক্তির অকৃপণ পরিচয় বহন করে। নজরুল গজলের অনুবাদ করেছেন গজলের মতো করে, অনুবাদ করেছেন আমপারা, করেছেন ইন্টারন্যাশনাল সংগীতের, শুধু অর্থের অনুবাদ নয়, সুরেরও। রুশ-বিপ্লবের মর্মবাণী তাঁর লেখায় যেমনভাবে প্রতিভাত হয়েছে তেমনভাবে তার সময়ে, অত আগে, আর কারো লেখায় হয়নি। নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ প্রকাশের ছয় বছর পর মুন্সীগঞ্জ সাহিত্য সম্মেলনে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘এই অভিশপ্ত অশেষ দুঃখের দেশে নিজের অভিমান বিসর্জন দিয়ে রুশ-সাহিত্যের মতো যদি সে সমাজের আরও নিচের স্তরে নেমে গিয়ে তাদের সুখ-দুঃখ-বেদনার মাঝখানে দাঁড়াতে পারবে, সেদিন এই সাহিত্যসাধনা কেবল স্বদেশে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও আপনার স্থান করে নিতে পারবে।’
শরৎচন্দ্রে দরিদ্র মানুষের কথা আছে, কিন্তু তিনি প্রধানত নিম্ন ও উচ্চ মধ্যবিত্তেরই লেখক। সামাজিক সংস্কারের হৃদয়হীনতার চিত্র শরৎ-সাহিত্যে পাব, কিন্তু শরৎচন্দ্র সংস্কারসমূহকে মেনেই নিয়েছেন শেষ পর্যন্ত, বরঞ্চ যারা সংস্কার মানে না, সমাজ মানতে চায় না তাদের ভাগ্যেই দুর্ভোগ ঘটে শরৎচন্দ্রের লেখায়। ধর্ম-কর্মে, পালা-পার্বণে তাঁর ভালো চরিত্ররা আস্থা রাখে, তারা তীর্থে যায়, অন্যের সেবা করে। বিধবাদের ব্যাপারে শরৎচন্দ্র বঙ্কিমচন্দ্রের চাইতেও রক্ষণশীল। নজরুল সেই তুলনায় অনেক বেশি সংস্কারমুক্ত। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াই ও সামন্তবাদী-বিরোধী লড়াই যে একই লড়াই, অভিন্ন যে তারা এই সত্য নজরুল হৃদয় দিয়ে জেনে নিয়েছিলেন, তাঁর কালে অন্য কোনো লেখক তেমনভাবে জানেননি, পারেননি জানতে। ওদিকে সাহিত্যিক বিদ্রোহীরা উচ্চশিক্ষিত, পাশ্চাত্য চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত ছিলেন ঠিকই, কিন্তু না ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, না সামন্তবাদ-বিরোধী। বরঞ্চ উভয়েরই প্রতি তাঁরা গোপনে ভালোবাসা পোষণ করতেন। তাঁদের বিদ্রোহ জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে নয়, বাদ দিয়ে। নজরুলের সাহিত্যিক বিদ্রোহ ‘কল্লোলে’র লেখকদের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল, সাহিত্যিক তাঁর সামাজিক বিদ্রোহ তুলনাবিরহিত। সামাজিক কুসংস্কারকে, অন্ধতাকে, অশিক্ষাকে নজরুল সরাসরি আঘাত করলেন দুরন্ত সাহসে। অন্যদিকে আবার, নজরুল গ্রামে গেছেন, কিন্তু তিনি গ্রাম্য নন, গ্রামীণও নন। জসীম উদ্দীনের কবিতা থেকে অনেক দূরবর্তী তিনি, সামন্তবাদ-বিরোধিতার কারণে।
নজরুলে নিম্নমধ্যবিত্তের অভিমান নেই একথা অবশ্যি সত্য নয়। অভিমান তিনি অনেক সময়ে করেছেন। তাঁর গদ্য রচনাতেও মা’কে নিয়ে, তিনি যে শিল্পী এই পরিচয় নিয়ে অনেক প্রসঙ্গ আছে অভিমানের। চোখ-ভরা অশ্রুজল অনেক গান ও কবিতাতে টলমল করছে। তথাকথিত আধ্যাত্মিকতা ও ভাববাদী-প্রবণতা অনুপস্থিত নয়। কিন্তু তাঁর মূল পরিচয় তিনি মেহনতি মানুষের অসংকুচিত দৃষ্টি নিয়ে জগৎকে দেখেছেন, জীবনকে গ্রহণ করেছেন।
জীবনকে অসংকোচে গ্রহণের ক্ষমতাই তাঁকে আবার দিয়েছে যাকে তিনি বলেছেন অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস। সাহস যে শুধু শব্দ ব্যবহারে ছিল তা নয়, ছিল সাহিত্যে আঙ্গিক ও রূপকল্পকে কম মূল্য দেয়ার মধ্যেই। কবি যিনি তাঁর রচনায় আঙ্গিকের শৃঙ্খলা ও রূপকল্পের সৌন্দর্য না-থাকলেই নয়। আছেও। তবু বিষয়বস্তুকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু নিজের প্রয়োজনে, যথোপযুক্ত মাধ্যম খুঁজে নিয়েছে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানসিকতার সার্থক প্রতিনিধি বুদ্ধদেব বসু আঙ্গিক ও রূপকল্পকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করেছেন। নিম্ন-মধ্যবিত্তের কাছে আচার-আচরণ, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ভদ্রতা ইত্যাদি অমূল্য রত্ন বিশেষ, নজরুল তাদের পরোয়া করেননি, তিনি আপনাকে প্রকাশ করেছেন অসংকোচে।
সেই সঙ্গে আছে স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রচণ্ড তেজস্বিতা। রোমান্টিক কবিদের মতো জন্মস্বতঃস্ফূর্ত তিনি, তেজস্বী সর্বসময়ে। এ সকল গুণকে তাঁর যুদ্ধে যাওয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। বরঞ্চ বলা যায় যে, এই সকল গুণ ছিল বলেই তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। যুদ্ধে আরো অনেকে গেছেন, ফিরে এসে ব্যবসায়ী হয়েছেন কেউ, কেউ কেরানি, কেউ সাবরেজিস্ট্রার। নজরুল ইসলাম অন্যকিছু হতে পারতেন, বিদ্রোহী কবি না হয়ে। কিন্তু হলেন না, তাঁর চিন্তা-চেতনার কারণে। সেই চিন্তা-চেতনা নিজের চারপাশের জীবনের মধ্যে শত্রুকে আক্রমণ করে অভদ্রজনোচিত আপসবিহীনতায়। এ হচ্ছে সরল, স্বতঃস্ফূর্ত ও তেজস্বী এবং আশাবাদী। নজরুল ইসলামের যে অত্যন্ত স্পষ্ট ও দৃঢ় আশাবাদ আছে তা বিরল। জীবনানন্দ দাশের সম্পূর্ণ বিপরীত কোটিতে অবস্থিত তিনি এই দিক দিয়ে। জীবনানন্দ দাশ সময়কে জয় করতে চান সময়ের বাইরে চলে গিয়ে, কিটসের মতো তিনি, বিষণ্ন, বিব্রত। নজরুল ইসলাম তাঁর প্রতিনিধিত্বমূলক কবিতাসমূহে সব সময়েই উদ্দীপ্ত, আশাবাদী, ভবিষ্যতে বিশ্বাসী। শ্রমজীবী মানুষের জীবনে হতাশা আসবে এমন পরিসর নেই, হতাশা সেখানে বিলাস বই নয়।
সাম্রাজ্যবাদী শাসন অর্থাৎ শোষণ যে দেশের জনসাধারণের হাড়-মাংস-মজ্জা পর্যন্ত নিঃশেষ করে দিচ্ছিল, মানুষকে পরিণত করছিল মানুষের জীর্ণ কঙ্কালে এই সত্যকে নজরুল সামনে এনে রাখলেন দেশবাসীর, এমনভাবে রাখলেন যেমনভাবে আর কেউ রাখতে পারেননি, আগে বা পরে। কবির যদি রাজনৈতিক বক্তব্য থাকে তবে তা যে অধিকতর প্রভাবশালী হয়ে উঠবে এই সত্য প্রমাণিত হয়েছে নজরুলের ক্ষেত্রে। বলা বাহুল্য, তাঁর রাজনীতি ছিল সমাজ-পরিবর্তনের কর্মসূচি ও উদ্যম। স্বাধীনতা বলতে তিনি ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস বোঝেননি, বুঝেছেন পূর্ণ স্বাধীনতা।
সামন্তবাদকেও চিনেছিলেন তিনি শত্রু হিসেবে। অন্ধকারাচ্ছন্ন যে-শক্তি পেছন থেকে টেনে ধরে, এগোতে দেয় না সামনে, যে জন্ম দেয় কুসংস্কার ও অন্ধকার, ভয় ও আলস্যের, লালন করে যে অল্পে সন্তুষ্টি ও চলমান বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতা, সেই গ্রাম্য অথচ ক্ষমতাবান সামন্তবাদকে মুক্তির শত্রু হিসেবে চিনে নিয়েছিলেন নজরুল।
‘সাম্যের কথা বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন একদা, কিন্তু পরে তিনি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, ভয় পেয়ে। ভয় কিসের? ইংরেজের নয়, ভয় দেশবাসীর। কেননা সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক, তারা টেনে ভেঙে ফেলুক প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থাকে, এমন অনাচার বঙ্কিমচন্দ্র চাননি। তাঁর কৃষক-প্রীতি সামাজিক ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন ও অবিচল রেখেই, তাকে ভেঙে ফেলে নয়। সমাজব্যবস্থা বদলে গেলে তাঁর ও তাঁদের বিশেষ অসুবিধা, সুযোগ-সুবিধার ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। নজরুল সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, সুবিধাকে প্রতিষ্ঠিত রাখায় আগ্রহীও ছিলেন না। তিনি অন্যায় সমাজ ব্যবস্থার ওপর হাতুড়ি, কোদাল, শাবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। একা নয়, সকলে মিলে।
সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ-বিরোধী সুস্পষ্ট চিন্তা তিনি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন দেশবাসীর, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মনে। শুধু চিন্তা নয়-আবেগও। আবেগকে পরিশীলিত করতে চেয়েছিলেন নজরুল। বুদ্ধি অবশ্যই মূল্যবান; কিন্তু বিবেকহীন বুদ্ধির মধ্যে ধ্বংসের প্রতিশ্রুতি আছে। বিবেক আসে আবেগ থেকে। মানুষের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান কাজ, আবেগের সহায়তা ভিন্ন সম্ভব হয়নি কখনো। বুদ্ধির আবিষ্কারসমূহ কল্যাণকর হয়েছে তখন যখন তাদের পেছনে থেকেছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা। বুদ্ধির বিকাশ আবশ্যক, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবশ্যক বুদ্ধির ওপর আবেগের নিয়ন্ত্রণ। নজরুল তাঁর সাহিত্য-সাধনায় দ্বারা এ দেশবাসীর আবেগকে সুশিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। আবেগকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন বিবেকে।
মানুষে মানুষে প্রয়োজনীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রসঙ্গে যখন আসে তখনও দরকার পড়ে আবেগের। হৃদয়ানুভূতি ব্যতীত গভীর এ ব্যাপক ঐক্য সম্ভব হয় না, স্থায়ী হয় না। আবেগের অনুশীলনের মাধ্যমে নজরুল দেশের মানুষের মধ্যে গভীর, ব্যাপক ও স্থায়ী ঐক্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
সাহিত্য নজরুলের কাছে জীবনের বিকল্প ছিল না, ছিল জীবনেরই অপরিহার্য, অবিভাজ্য অংশ। সুন্দরকে জীবন্ত করার চাইতে তাঁর অধিক আগ্রহ ছিল জীবনকে সুন্দর করায়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সোমবার, ৩০ আগস্ট ২০২১
নজরুল ইসলামের প্রতিভা অনেক দিক দিয়েই বিস্ময়কর। সবচেয়ে অধিক বিস্ময়ের ব্যাপার বোধ করি কবি হওয়ার জন্যে তাঁর প্রস্তুতির আপাত-সামান্যতা। তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেননি। না করুন, তাঁর পরিবেশ, পরিবারে, গৃহে তো থাকতে পারতো উচ্চতর সাংস্কৃতিক উপাদান। একটি সমৃদ্ধশালী সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে তাঁর জন্ম ও লালন হতে পারতো। না তেমন পরিবেশ তাঁর আদৌ ছিল না। বিত্ত ছিল না গৃহে, সুসংগৃহীত পাঠাগার ছিল না বাড়িতে। ঘরও ছিল না বলতে গেলে, স্রোতের মধ্যে ভেসে ভেসে বেড়িয়েছেন তিনি, সারাটা জীবন।
‘কী ভীষণ দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে অনশনে অর্ধাশনে দিন কাটিয়ে আমাদের নতুন লেখকদের বেঁচে থাকতে হয় লক্ষ্মীর কৃপায় কবিগুরুর তা জানা নেই।’ নজরুল লিখেছিলেন একসময়ে। আরো বলেছিলেন, ‘ভগবান করুন, তাঁকে যেন জানতে না হয়। কবিগুরু কোনদিন আমাদের মতো সাহিত্যিকদের কুটিরে যেন পদার্পণ করেননি হয়ত তাঁর মহিমা ক্ষুণœ হ’তো না তাতে নৈলে দেখতে পেতেন আমাদের জীবনযাত্রার দৈন্য কত ভীষণ। এই দীন-মলিন বেশ নিয়ে আমরা আছি দেশের একটেরে আত্মগোপন করে। দেশে দেশে প্রোপাগা-া করাতো দূরের কথা বাড়ি ছেড়ে পথে দাঁড়াতে লজ্জা করে। কিছুতেই ছেঁড়া জামার তালিগুলিকে লুকাতে পারিনে। ভদ্র শিক্ষিতদের মাঝে ব’সে সর্বদাই মন খুঁতখুঁত করে, যেন কত বড় অপরাধ করে ফেলেছি বাইরের দৈন্য-অভাব যত ভিতরে ভিতরে চাবকাতে থাকে, তত মনটা বিদ্রোহী হ’য়ে উঠতে থাকে।’
এই বর্ণনায় অতিশয়োক্তি নেই। অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে এসেছিলেন তিনি, সেই দারিদ্র্য তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি, অত্যন্ত উচ্চ প্রতিষ্ঠার দিনেও নয় তাহলে কী করে, কোন গোপন রহস্যাচ্ছন্ন কারণে, পরিবেশের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি বড় কবি হলেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আমরা নজরুলের যে শক্তি তার একটি বড় উৎস এবং সেই সঙ্গে তার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণের সামনে এসে দাঁড়াই। উৎস হচ্ছে জীবনকে গ্রহণ করার অসামান্য ক্ষমতা। জীবনকে পরিপূর্ণভাবে, দ্বিধাহীন চিত্তে, নিঃশঙ্ক সাহসে গ্রহণ করবার মধ্যে দিয়ে বড় কবি হয়েছেন তিনি, পিছনে পড়ে রয়েছে পরিবেশের প্রতিকূলতা, পড়ে রয়েছে প্রস্তুতির তথাকথিত অকিঞ্চিৎকরতা। জীবনকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই বড় তিনি, গ্রহণ করতে পেরেছিলন বলেই বড়। নজরুল যে প্রথম মহাযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের পরের লেখক এই সত্যও তাঁর গ্রহণ-ক্ষমতার দরুন তাঁর লেখার অভ্যন্তরে যেমনভাবে প্রতিভাত, তেমনভাবে প্রতিভাত হয়নি অন্য কোনো বাঙালি কবির রচনায়।
কায়কোবাদের মতো তিনিও দেখেছেন অনাহারক্লিষ্ট শিশুকে তাঁর চারপাশে কাঁদতে, কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে সেই হীনম্মন্যতা ছিল না যা আপন সন্তানকে বলতে শেখায় ‘অপোগ- শিশু’, শেখায় করুণা করতে নিজেকে। দারিদ্র্য তাঁকে দুর্বল করেনি, মহৎ করেছে তাঁকে দিয়েছে খ্রিস্টের সম্মান। আত্মকরুণা যে নজরুল ইসলামে নেই তা নয়, আছে; অশ্রু ও অভিমান, ‘ফুল নেব না অশ্রু নেব’ এই প্রশ্ন, অর্থাৎ নানা প্রকারে ভঙ্গিমা; কিন্তু সবকিছু নিজের মধ্যে ধারণ করে, সবকিছুকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে জীবনের সামান্যতাকে নিচে রেখে বড় হয়ে উঠেছেন তিনি।
তিনি গৃহের কবি নন, কবি তিনি উন্মুক্ত পথের, যদিও গৃহ তাঁর রচনার মধ্যে আছে। আগামী দিনের মানুষ নজরুলকে কিভাবে মেনে নেবে সেটা তাদের বিবেচ্য, কিন্তু আমাদের পক্ষে নজরুলের এই পরিচয়টাই প্রধান যে, কবি তিনি উন্মুক্ত পথের। একেক যুগে একেকভাবে নেয় একই প্রতিভাকে, আমাদের পক্ষে উন্মুক্ত পথে স্বচ্ছন্দ যাত্রী নজরুল ইসলামই প্রধানতম। সেইখানেই বিদ্রোহী তিনি, মৌলিক ও বিশিষ্ট। এই পরিচয়টাই যে বড় করে চোখে পড়ে তার কারণ দুটি। প্রথম কারণ, আমাদের জীবনে পথের অভাব, অভাব পথচারীর। আমরা সকলেই গৃহে, গৃহের বাইরে ছোট ছোট গলিঘুপচি আঁকাবাঁকা আছে বটে কিন্তু উন্মুক্ত পথ নেই খুব বেশি। পথ যেখানে-বা আছে অভাব আছে যাত্রীর। দ্বিতীয় কারণ এই যে, গৃহহীন নজরুলের পক্ষে গৃহী হওয়াই স্বাভাবিক ছিল, গৃহী না হওয়ার মধ্যে তাঁর অসাধারণত্ব যেমনভাবে প্রকাশ পেয়েছে তেমনি বোধহয় অন্য কোথাও নয়। সকলেই জানেন যে, নজরুলের ওপর প্রভাব পড়েছিল ওয়াল্ট হুইটম্যানের। সেই প্রভাব একান্ত স্বাভাবিক, কেননা হুইটম্যানও কবি ছিলেন উন্মুক্ত পথেরই। উন্মুক্ত পথের পথিক বলেই অতি অনায়াসে সর্বগামী হয়েছেন তিনি। হিন্দু মুসলমানের মিলন তাঁর লেখার মধ্যে যেমন ঘটেছে, রাজনীতিতে, বা সাহিত্যে কোথাও ঘটেনি বাংলাদেশের। হিন্দু-ঐতিহ্য ও মুসলিম ঐতিহ্য উভয়কে কাব্যক্ষেত্রে একত্রে উপস্থিত করে কাব্যে ঐতিহ্যের ব্যবহারকে প্রসারতা দানের ক্ষেত্রে এমন একটা কাজ করলেন তিনি যা তাঁর আগের কোন কবি বা লেখক করেননি, করতে পারেননি, করার কথা ভাবেননি। এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও উদার কাজটি যে তাঁর অপেক্ষাতেই পড়ে ছিল, বাকি ছিল। সাধারণ মানুষের জীবনে তিনি যেমনভাবে প্রবেশ করেছেন তাঁর আগে অন্য কোনো লেখক তেমনভাবে প্রবেশ করতে পারেননি। তাঁর অসামান্য গল্প রাক্ষসীতে তিনি শুধু বাগদী মেয়েকে আনেননি, এনেছেন বাগদীদের মুখের ভাষাকেও। বাগদী মেয়ে ভদ্রসমাজে চলে এসেছে অকুণ্ঠ পদে, নিজের ভাষায় কথা বলতে বলতে। সন্দেহ নেই নজরুলের লেখা নাটকগুলোই তাঁর সাহিত্যের দুর্বলতম অংশ। সেখানে ভাবালুতা অধিক, কিন্তু সেই ভাবালুতার মধ্যেও নারীশক্তির উদ্বোধন ভিন্ন যে মুক্তি নেই আমাদের, এই কঠিন সত্যটিকে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করেছেন তিনি ‘ভূতের ভয়’ নাটকে। ‘ঝিলিমিলিতে বিএ পাস করা-না-করার যে প্রাণঘাতী বিতর্ক হত্যা করলো ফিরোজাকে সে শুধু বিতর্ক নয় একটা, সেটা হচ্ছে মুসলমান সমাজের গৃহাভ্যন্তরের যে প্রাণহীনতা, যে-আনন্দহীনতা ঘরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে অন্যায় শাসনের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে তারই প্রকাশ। চিরকালের মেয়ে ফিরোজা নজরুলের কালে এসে লাঞ্ছিত হয়েছে মুসলমানের গৃহে আটকা পড়ে। সন্ত্রাসবাদী তরুণকে নজরুল যেমনভাবে বুঝেছেন তেমনভাবে এমনকি রবীন্দ্রনাথও বোঝেননি। ‘চার অধ্যায়’-এর তুলনায় ‘কুহেলিকা’র সাহিত্যিক মূল্য স্বল্প সন্দেহ নেই, কিন্তু ‘কুহেলিকা’য় যে সহানুভূতি আছে তরুণ সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি ‘চার অধ্যায়’-এ তা নেই। ‘কুহেলিকা’র জাহাঙ্গীর সমসাময়িক মুসলিম সমাজে ছিল না। নজরুল নানাদিক থেকে এগিয়ে ছিলেন তাঁর সমাজের তুলনায়। আনসার যখন নতুন রাজনীতিকে গ্রহণ করেছে, কৃষক-শ্রমিকের রাজনীতিকে, তখন বোঝা যায় নজরুল এগিয়ে গেছেন সমসাময়িক লেখকদের অনেককে পেছনে ফেলে। আনসারকে তিনি শরৎচন্দ্রের সব্যসাচী করেননি, কল্পনার আতিশয্যকে পরিহার করার মধ্যে যে বাস্তববুদ্ধি প্রকাশিত হয়েছে তা সাধারণ নয়।
তাঁর যুগের অসন্তোষ ও বিক্ষোভ, অস্থিরতা, তরুণ মনের দুঃসাহসিক স্পর্ধা, স্বাধীনতার সুতীব্র আগ্রহ সমস্ত কিছু অসংকোচে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর মধ্য দিয়ে। বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর, কাব্যের সঙ্গে কবির, যুগের সঙ্গে যুগ-প্রতিনিধির কোনো ব্যবধান রইলো না তাঁর ক্ষেত্রে। শুধু বিদ্রোহ নয়, যুগের অভিমান ও আধ্যাত্মিকতাও নিয়েছেন তিনি। চরকা নিয়েছেন, নিয়েছেন সন্ত্রাসবাদ। সাম্যবাদ নিয়েছেন, নিয়েছেন অধ্যাত্মবাদ। তাঁর কাব্যে হুঙ্কার আছে, আছে অশ্রুপাত। স্ববিরোধিতা বলা যায় এদেরকে, বললে মানতে হয় সে যুক্তি। কিন্তু এই স্ববিরোধিতার মূল কথা হচ্ছে জীবন ও যুগের সকল প্রবণতাকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করা। নিজের করে নেয়া।
পরিবেশের যে-প্রতিকূলতা, দারিদ্র্যের যে নিপীড়ন ব্যক্তি নজরুলের জন্য অমিত্রসুলভ ছিল, সেই প্রতিকূলতা ও দারিদ্র্যই তাঁর মিত্র হয়ে দেখা দিল কাব্যের ক্ষেত্রে। দরিদ্র, মেহনতি মানুষের মানসিকতা ছিল তাঁর; ছিল না নিম্নমধ্যবিত্তের মানসিকতা। নিম্নমধ্যবিত্ত শুচিবায়ুগ্রস্ত, সে বর্জনবাদী, অকারণ শত্রুতা-বিলাসী। মেহনতি মানুষের সুযোগ নেই বিলাস করবে শুচিবায়ুর, বর্জনের, অনর্থক শত্রুতার। সে গ্রহণ করে, সকলকে জড়িয়ে ধরে। তার ভয় নেই হারাবার। নজরুল ভীত ছিলেন না।
নিম্নমধ্যবিত্তের চেতনার নিশ্চিত প্রমাণ আছে বর্জনবাদিতায়। নজরুলের তুলনায় অধিক সুযোগপ্রাপ্ত সমসাময়িকদের মধ্যেও এই বর্জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করবার মতো। এর প্রধান কারণ লেখকদের শ্রেণীগত অবস্থান। অবিভক্ত বাংলাদেশের জনসমষ্টিতে শতকরা হিসাবে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অধিক, কিন্তু সাহিত্যে তাদের যথাযোগ্য অনুপস্থিতি সেই সত্যকেই নির্দেশিত করছিল যে-সত্য অন্তর্ঘাতী শক্তি হিসেবে বঙ্গভূমির বিভাজনে কাজ করেছিল। আরো বড় কথা, সাধারণ মানুষের মানবিক উপস্থিতিতেও উজ্জ্বল ছিল না সাহিত্য। করুণা ছিল, অভাব ছিল স্বীকৃতির। নজরুল অসাম্প্রদায়িক উভয় অর্থেই, তিনি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং তিনি ধনী-নির্ধনের বেড়াজাল মানেননি।
আস্ফালনকারী মোহিতলাল মজুমদারের সঙ্গে তুলনা করলে নজরুলের গ্রহণ-শক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। মোহিতলাল আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেছেন কিন্তু স্বদেশী মুসলিম জীবনচেতনাকে সাহিত্যে উপস্থিত করতে পারেননি। নজরুল পেরেছিলেন হিন্দু মানসিকতাকেও সাহিত্যে প্রতিফলিত করতে, তাঁর শ্যামা-সংগীত সেই শক্তির অকৃপণ পরিচয় বহন করে। নজরুল গজলের অনুবাদ করেছেন গজলের মতো করে, অনুবাদ করেছেন আমপারা, করেছেন ইন্টারন্যাশনাল সংগীতের, শুধু অর্থের অনুবাদ নয়, সুরেরও। রুশ-বিপ্লবের মর্মবাণী তাঁর লেখায় যেমনভাবে প্রতিভাত হয়েছে তেমনভাবে তার সময়ে, অত আগে, আর কারো লেখায় হয়নি। নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ প্রকাশের ছয় বছর পর মুন্সীগঞ্জ সাহিত্য সম্মেলনে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘এই অভিশপ্ত অশেষ দুঃখের দেশে নিজের অভিমান বিসর্জন দিয়ে রুশ-সাহিত্যের মতো যদি সে সমাজের আরও নিচের স্তরে নেমে গিয়ে তাদের সুখ-দুঃখ-বেদনার মাঝখানে দাঁড়াতে পারবে, সেদিন এই সাহিত্যসাধনা কেবল স্বদেশে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও আপনার স্থান করে নিতে পারবে।’
শরৎচন্দ্রে দরিদ্র মানুষের কথা আছে, কিন্তু তিনি প্রধানত নিম্ন ও উচ্চ মধ্যবিত্তেরই লেখক। সামাজিক সংস্কারের হৃদয়হীনতার চিত্র শরৎ-সাহিত্যে পাব, কিন্তু শরৎচন্দ্র সংস্কারসমূহকে মেনেই নিয়েছেন শেষ পর্যন্ত, বরঞ্চ যারা সংস্কার মানে না, সমাজ মানতে চায় না তাদের ভাগ্যেই দুর্ভোগ ঘটে শরৎচন্দ্রের লেখায়। ধর্ম-কর্মে, পালা-পার্বণে তাঁর ভালো চরিত্ররা আস্থা রাখে, তারা তীর্থে যায়, অন্যের সেবা করে। বিধবাদের ব্যাপারে শরৎচন্দ্র বঙ্কিমচন্দ্রের চাইতেও রক্ষণশীল। নজরুল সেই তুলনায় অনেক বেশি সংস্কারমুক্ত। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াই ও সামন্তবাদী-বিরোধী লড়াই যে একই লড়াই, অভিন্ন যে তারা এই সত্য নজরুল হৃদয় দিয়ে জেনে নিয়েছিলেন, তাঁর কালে অন্য কোনো লেখক তেমনভাবে জানেননি, পারেননি জানতে। ওদিকে সাহিত্যিক বিদ্রোহীরা উচ্চশিক্ষিত, পাশ্চাত্য চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত ছিলেন ঠিকই, কিন্তু না ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, না সামন্তবাদ-বিরোধী। বরঞ্চ উভয়েরই প্রতি তাঁরা গোপনে ভালোবাসা পোষণ করতেন। তাঁদের বিদ্রোহ জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে নয়, বাদ দিয়ে। নজরুলের সাহিত্যিক বিদ্রোহ ‘কল্লোলে’র লেখকদের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল, সাহিত্যিক তাঁর সামাজিক বিদ্রোহ তুলনাবিরহিত। সামাজিক কুসংস্কারকে, অন্ধতাকে, অশিক্ষাকে নজরুল সরাসরি আঘাত করলেন দুরন্ত সাহসে। অন্যদিকে আবার, নজরুল গ্রামে গেছেন, কিন্তু তিনি গ্রাম্য নন, গ্রামীণও নন। জসীম উদ্দীনের কবিতা থেকে অনেক দূরবর্তী তিনি, সামন্তবাদ-বিরোধিতার কারণে।
নজরুলে নিম্নমধ্যবিত্তের অভিমান নেই একথা অবশ্যি সত্য নয়। অভিমান তিনি অনেক সময়ে করেছেন। তাঁর গদ্য রচনাতেও মা’কে নিয়ে, তিনি যে শিল্পী এই পরিচয় নিয়ে অনেক প্রসঙ্গ আছে অভিমানের। চোখ-ভরা অশ্রুজল অনেক গান ও কবিতাতে টলমল করছে। তথাকথিত আধ্যাত্মিকতা ও ভাববাদী-প্রবণতা অনুপস্থিত নয়। কিন্তু তাঁর মূল পরিচয় তিনি মেহনতি মানুষের অসংকুচিত দৃষ্টি নিয়ে জগৎকে দেখেছেন, জীবনকে গ্রহণ করেছেন।
জীবনকে অসংকোচে গ্রহণের ক্ষমতাই তাঁকে আবার দিয়েছে যাকে তিনি বলেছেন অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস। সাহস যে শুধু শব্দ ব্যবহারে ছিল তা নয়, ছিল সাহিত্যে আঙ্গিক ও রূপকল্পকে কম মূল্য দেয়ার মধ্যেই। কবি যিনি তাঁর রচনায় আঙ্গিকের শৃঙ্খলা ও রূপকল্পের সৌন্দর্য না-থাকলেই নয়। আছেও। তবু বিষয়বস্তুকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু নিজের প্রয়োজনে, যথোপযুক্ত মাধ্যম খুঁজে নিয়েছে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানসিকতার সার্থক প্রতিনিধি বুদ্ধদেব বসু আঙ্গিক ও রূপকল্পকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করেছেন। নিম্ন-মধ্যবিত্তের কাছে আচার-আচরণ, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ভদ্রতা ইত্যাদি অমূল্য রত্ন বিশেষ, নজরুল তাদের পরোয়া করেননি, তিনি আপনাকে প্রকাশ করেছেন অসংকোচে।
সেই সঙ্গে আছে স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রচণ্ড তেজস্বিতা। রোমান্টিক কবিদের মতো জন্মস্বতঃস্ফূর্ত তিনি, তেজস্বী সর্বসময়ে। এ সকল গুণকে তাঁর যুদ্ধে যাওয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। বরঞ্চ বলা যায় যে, এই সকল গুণ ছিল বলেই তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। যুদ্ধে আরো অনেকে গেছেন, ফিরে এসে ব্যবসায়ী হয়েছেন কেউ, কেউ কেরানি, কেউ সাবরেজিস্ট্রার। নজরুল ইসলাম অন্যকিছু হতে পারতেন, বিদ্রোহী কবি না হয়ে। কিন্তু হলেন না, তাঁর চিন্তা-চেতনার কারণে। সেই চিন্তা-চেতনা নিজের চারপাশের জীবনের মধ্যে শত্রুকে আক্রমণ করে অভদ্রজনোচিত আপসবিহীনতায়। এ হচ্ছে সরল, স্বতঃস্ফূর্ত ও তেজস্বী এবং আশাবাদী। নজরুল ইসলামের যে অত্যন্ত স্পষ্ট ও দৃঢ় আশাবাদ আছে তা বিরল। জীবনানন্দ দাশের সম্পূর্ণ বিপরীত কোটিতে অবস্থিত তিনি এই দিক দিয়ে। জীবনানন্দ দাশ সময়কে জয় করতে চান সময়ের বাইরে চলে গিয়ে, কিটসের মতো তিনি, বিষণ্ন, বিব্রত। নজরুল ইসলাম তাঁর প্রতিনিধিত্বমূলক কবিতাসমূহে সব সময়েই উদ্দীপ্ত, আশাবাদী, ভবিষ্যতে বিশ্বাসী। শ্রমজীবী মানুষের জীবনে হতাশা আসবে এমন পরিসর নেই, হতাশা সেখানে বিলাস বই নয়।
সাম্রাজ্যবাদী শাসন অর্থাৎ শোষণ যে দেশের জনসাধারণের হাড়-মাংস-মজ্জা পর্যন্ত নিঃশেষ করে দিচ্ছিল, মানুষকে পরিণত করছিল মানুষের জীর্ণ কঙ্কালে এই সত্যকে নজরুল সামনে এনে রাখলেন দেশবাসীর, এমনভাবে রাখলেন যেমনভাবে আর কেউ রাখতে পারেননি, আগে বা পরে। কবির যদি রাজনৈতিক বক্তব্য থাকে তবে তা যে অধিকতর প্রভাবশালী হয়ে উঠবে এই সত্য প্রমাণিত হয়েছে নজরুলের ক্ষেত্রে। বলা বাহুল্য, তাঁর রাজনীতি ছিল সমাজ-পরিবর্তনের কর্মসূচি ও উদ্যম। স্বাধীনতা বলতে তিনি ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস বোঝেননি, বুঝেছেন পূর্ণ স্বাধীনতা।
সামন্তবাদকেও চিনেছিলেন তিনি শত্রু হিসেবে। অন্ধকারাচ্ছন্ন যে-শক্তি পেছন থেকে টেনে ধরে, এগোতে দেয় না সামনে, যে জন্ম দেয় কুসংস্কার ও অন্ধকার, ভয় ও আলস্যের, লালন করে যে অল্পে সন্তুষ্টি ও চলমান বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতা, সেই গ্রাম্য অথচ ক্ষমতাবান সামন্তবাদকে মুক্তির শত্রু হিসেবে চিনে নিয়েছিলেন নজরুল।
‘সাম্যের কথা বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন একদা, কিন্তু পরে তিনি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, ভয় পেয়ে। ভয় কিসের? ইংরেজের নয়, ভয় দেশবাসীর। কেননা সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক, তারা টেনে ভেঙে ফেলুক প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থাকে, এমন অনাচার বঙ্কিমচন্দ্র চাননি। তাঁর কৃষক-প্রীতি সামাজিক ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন ও অবিচল রেখেই, তাকে ভেঙে ফেলে নয়। সমাজব্যবস্থা বদলে গেলে তাঁর ও তাঁদের বিশেষ অসুবিধা, সুযোগ-সুবিধার ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। নজরুল সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, সুবিধাকে প্রতিষ্ঠিত রাখায় আগ্রহীও ছিলেন না। তিনি অন্যায় সমাজ ব্যবস্থার ওপর হাতুড়ি, কোদাল, শাবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। একা নয়, সকলে মিলে।
সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ-বিরোধী সুস্পষ্ট চিন্তা তিনি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন দেশবাসীর, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মনে। শুধু চিন্তা নয়-আবেগও। আবেগকে পরিশীলিত করতে চেয়েছিলেন নজরুল। বুদ্ধি অবশ্যই মূল্যবান; কিন্তু বিবেকহীন বুদ্ধির মধ্যে ধ্বংসের প্রতিশ্রুতি আছে। বিবেক আসে আবেগ থেকে। মানুষের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান কাজ, আবেগের সহায়তা ভিন্ন সম্ভব হয়নি কখনো। বুদ্ধির আবিষ্কারসমূহ কল্যাণকর হয়েছে তখন যখন তাদের পেছনে থেকেছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা। বুদ্ধির বিকাশ আবশ্যক, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবশ্যক বুদ্ধির ওপর আবেগের নিয়ন্ত্রণ। নজরুল তাঁর সাহিত্য-সাধনায় দ্বারা এ দেশবাসীর আবেগকে সুশিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। আবেগকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন বিবেকে।
মানুষে মানুষে প্রয়োজনীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রসঙ্গে যখন আসে তখনও দরকার পড়ে আবেগের। হৃদয়ানুভূতি ব্যতীত গভীর এ ব্যাপক ঐক্য সম্ভব হয় না, স্থায়ী হয় না। আবেগের অনুশীলনের মাধ্যমে নজরুল দেশের মানুষের মধ্যে গভীর, ব্যাপক ও স্থায়ী ঐক্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
সাহিত্য নজরুলের কাছে জীবনের বিকল্প ছিল না, ছিল জীবনেরই অপরিহার্য, অবিভাজ্য অংশ। সুন্দরকে জীবন্ত করার চাইতে তাঁর অধিক আগ্রহ ছিল জীবনকে সুন্দর করায়।