alt

সাময়িকী

অলকানন্দা

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

: শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১

কাঁচা হলুদ রং মেখেছে আকাশ। যেন ডিম ভেঙে কুসুমটা ছড়িয়ে পড়েছে। গাছগুলোও চাঁদিতে মেখেছে সেই আভা। ঝিলের জলে মুখ দেখছে শেষ বিকেলের রূপ। পার্কের বেঞ্চি, কাঠের ঝুলন্ত হাঁটার পথ, রেলিংয়েও চিকচিক করছে অন্তরীক্ষের আলো। সূর্যটা পশ্চিমে গলে গলে নাই হয়ে গেছে সেই কখন। দেবদারু, আকাশমণি, অর্জুন, জারুল, শিমুল, কনকচূড়া গাছ পরম বান্ধবের মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। একদ- বিশ্রামের আশ্রয় বাঁধানো ছাতিমতলা। ঝিলের পারে পানবটের বড় সংসার। ডালপালা ছড়িয়ে আছে ঝিলের অনেকটা জুড়ে। তার ডালে ডালে ঘুঘু, শালিক, বনপায়রার দল। হঠাৎ হঠাৎ একটা-দুটো টিয়ে ‘টিউক, টিউক’ ডেকে উঠছে। টুনটুনির ফুরুৎ ফুরুৎ উড়ে যাওয়া, মাছরাঙার ছুটোছুটিও চোখে পড়ছে ক্ষণে ক্ষণে।

শহরের বুকে এমন এক টুকুরো শ্যামল নিসর্গে বুক ভরে দম নিতে প্রায়ই আসেন শামসুল কবীর। প্রায় বললে ভুল হবে, প্রতিদিনই আসেন। অবসরে এসেছেন প্রায় তিন যুগ হতে চলল। চাকরি শেষে যে টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে এই নগরেই পনেরো-ষোল শ’ বর্গফুটের একটা ফ্ল্যাটও কিনেছেন। সেই ফ্ল্যাটে নিঃসঙ্গ জীবন তার।

গৌরবর্ণ চেহারা। ব্যাকব্রাশ চুল। সুদর্শন পুরুষ বলতে যা বোঝায়, তাই। অশীতিপর কবীর সাহেবের চেহারায় সৌম্যকান্তি ভাব অনেকটাই অটুট। শরীরের ত্বক লাবণ্যতা হারালেও এখনো বেশ উজ্জ্বল। উচ্চতা ছ’ফুট দুই ইঞ্চি। সুঠাম দেহি পুরুষ ছিলেন। বয়সে শরীর ভেঙেছে কিছুটা। একেবারে ম্লান হয়ে যায়নি। নিজের উচ্চতা নিয়ে তার অবশ্য গর্ব আছে মনে মনে। কখনো প্রকাশ্যেও বলেন সে কথা। জানেন তো, রবীন্দ্রনাথের উচ্চতা কত ছিল? ছ’ফুট তিন ইঞ্চি। আর সত্যজিৎ রায়ের? ছ’ফুট পাঁচ। কোনো এক পত্রিকাতে তিনি পড়েছেন, শিল্পী ধ্রুব এষের উচ্চতাও ছ’ফুট দুই ইঞ্চি। তার মানে ছ’ফুট প্লাস ক্লাবের সদস্যরা প্রায়ই নামকরা ব্যক্তিত্ব। স্বভাবচরিত অন্যদের চেয়ে অনেক আলাদা।

সরকারের সাবেক সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা শামসুল কবীরও তার পরিবারের ব্যতিক্রমী মানুষ। ভাই-বোনেরা, পরে তাদের ছেলে-মেয়েরাও বিয়ে থা করে সংসার পাতলেও তিনি আর সে পথে যাননি। একা ছিলেন, আছেন। বিয়ে, সংসার, ছেলেপুলে এসবে আগ্রহ নেই তার। পরিবার থেকে চেষ্টা হয়েছে। কাজ হয়নি। বিয়ে করবেন না- এক কথাতেই অটল ছিলেন। কেন করবেন না, এই প্রশ্নটিও রেখেছিলেন কেউ কেউ। জবাব মেলেনি। কেবল বলেছেন, ‘ভালোই তো আছি একা।’

সত্যি বলতে একা খারাপ ছিলেন না কবীর সাহেব। চাকরিতে থাকতে দায়িত্বের ব্যস্ততায়, সহকর্মীদের সাহচর্যে একবারও মনে হয়নি তিনি একা। অবসরে আসার পর অবশ্য কাজের ব্যস্ততা নেই। সহকর্মীদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ হয় না দীর্ঘদিন। সহকর্মীদের অনেকে বেঁচেও নেই হয়তো। হঠাৎ হঠাৎ নিঃসঙ্গ বোধ হয়। তখন অ্যালুমিনিয়ামের স্লিম ওয়াকিং স্টিকটাকে সঙ্গী করে চলে আসেন বাসার কাছেই এই নগর-অরণ্যে। রাতবিরাতে একা লাগলে সালামত মিয়াকে ডেকে গল্প করেন। মূলত একার সংসারে সালামত মিয়াই তার ভরসা। গেল পঁচিশ বছর কবীর সাহেবের দেখভাল, ঘরকন্নার কাজ তিনিই সামলে রাখছেন।

সালামত মিয়াও একা। তবে বিয়ে করেছিলেন। সংসারও ছিল। এখনও আছে। নিজের না। ছেলে-মেয়েদের। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেও বিয়ে করে সংসার পেতেছে। স্ত্রী গত হয়েছে বছর দশেক হচ্ছে। তারপর থেকে গ্রামের ভিটায় তালা ঝুলছে। নির্ঞ্ঝাট জীবন। কবীর সাহেবের সঙ্গে তার ভালোই দিন কাটছে।

কবীর সাহেব বসে আছেন পার্কটার উত্তরে, ছাতিমতলায়। গাছের গুঁড়ি বাঁধানো জায়গাটা বেশ প্রিয় তার। প্রতিদিন এসেই ধীর পায়ে পুরো পার্কটা একবার চক্কর দিয়ে এখানে বসেন তিনি। ঘন গাছে ঘেরা চারপাশ। রোদ খুব একটা না পড়ায় ঠা-া থাকে। কাছেধারে কাঠগোলাপের গাছ। হঠাৎ হঠাৎ মৃদু হাওয়ায় ঝরছে একটা-দুটো হলদে-সাদা ফুল। গন্ধটা ভাসিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বাতাস। আষাঢ়ের আকাশ। এই ভালো, এই মন্দ। দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই উটকো মেঘ এসে জড়ো হচ্ছিল ধীরে ধীরে। সূর্য ডোবার সময় সেই মেঘ কোথায় যেন ভেসে ভেসে পালিয়ে গেল! ফিরে এল আবার। শীতল হাওয়া ছেড়েছে। কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। এখানেও হবে। মাথার ওপর কু-ুলি মেঘের আসর বসেছে। শলা-পরামর্শ করছে কতটা ভিজিয়ে দেবে এই সবুজ উদ্যান, ইটপাথরের দালান, নগরের পথঘাট, ঘরে ফেরা মানুষ কিংবা পাখিদের।

এখন পার্ক থেকে বেরোলেও বৃষ্টির আগে বাসায় পৌঁছতে পারবেন না কবীর সাহেব। তার চেয়ে আকাশটা পরিষ্কার হলেই যাওয়া ভালো। বাসায় ফেরার তাড়া তো আর নেই। কাছেই ছাউনিটা মাথা তুলে আছে ছাতার মতো। তার নিচে লোহাকাঠের বেঞ্চি। ওদিকে গেলে আরামে বসা যায়। আবার বৃষ্টিতেও ভিজতে হবে না। কবীর সাহেব গেলেন না। ছাতিমতলাতেই বসে রইলেন। মাথা তুলে উপরে তাকালেন। ছাতিমের ঘন পত্রপল্লবের ছাউনি গলিয়ে বৃষ্টি সহসা নিচে নামতে পারবে বলে মনে হয় না। অনেকদিন এভাবে অরণ্যের জলসায় বসে বৃষ্টি দেখা হয় না। প্রকৃতির সঙ্গে বৃষ্টির মিলন- কী মনোরম সেই দৃশ্য! ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। মাঠজুড়ে বৃষ্টি ঝরছে। আষাঢ়ের হুটহাট বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দৌড়ে গিয়ে বুড়োবটের তলায় ঠাঁই নেওয়া। পাতার ফাঁক গলিয়ে ছোট্ট ছোট্ট ফোঁটায় ভিজে যাওয়া। ঝিরঝিরে কুয়াশা-বর্ষণে ভিজে বাড়ি ফেরা- সোনার খাঁচায় মোড়া দিনগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল জীবন থেকে! আর কখনোই ফিরবে না। চাইলেও আর ফেরা যাবে না শৈশব-কৈশোরের আবির মাখা দিনে।

ছয় ভাইবোনের বড় সংসার। চাষবাসই ছিল বাবার পেশা। কষ্টেশিষ্টে মানুষ হতে হয়েছে পিঠাপিঠি ভাইবোনদের। কবীর সাহেব আর তার পিঠাপিঠি বড়বোন একই ক্লাসে পড়তেন। টাকার অভাবে বই কেনার সাধ্য ছিল না। একসেট বই দিয়ে পড়তে হয়েছে দুই ভাইবোনকে। হাফপ্যান্ট আর ছিতি পড়ে কালো হয়ে যাওয়া পলিয়েস্টারের শার্টই ছিল স্কুল ড্রেস। প্যান্টের জিপার ছিড়ে গেলে সেফটিপিন দিতে আটকে রাখতে হতো। হাতে পাঁকানো সুতলি ছিল কোমরের বন্ধনী। এক পোশাকেই সারা বছর কেটে যেত। পরের বছর ছোট ভাইটির জন্য বরাদ্দ হতো ড্রেসটি। স্কুলজীবনে জুতো পরেছেন কিনা কখনো, মনে নেই।

মূলত একার সংসারে সালামত মিয়াই তার ভরসা। গেল পঁচিশ বছর কবীর সাহেবের দেখভাল, ঘরকন্নার কাজ তিনিই সামলে রাখছেন

বিছানো হাঁটার পথ। বর্ষণের ফোঁটায় ফোঁটায় ধুলোময়লা কেটে গেলে টকটকে লাল টালি জেগে উঠছে। পথের পাশের ঘাস, কানদুলি, ঢোলপাতার নীলচে ফুলগুলো নেচে উঠছে বৃষ্টির ছন্দে। কলরব শুরু হয়েছে তৃণশাখে। কবীর সাহেব একধ্যানে তাকিয়ে প্রকৃতির নৃত্য উপভোগ করছেন। সন্ধে নেমেছে। ঘনিভূত অন্ধকার হটাতে মরিয়া এলইডি বাতি। তবে এদিকটা ঘন গাছগাছালির প্রচীর ডিঙিয়ে বাতির আলো খুব একটা পৌঁছতে পারছে না। যতটুকু পৌঁছেছে তাতে তৈরি হয়েছে অন্যরকম এক আলো-আঁধারি।

কবীর সাহেব একধ্যানে চোখ রেখেছেন পথের ওপর। অবিরত বর্ষণে চোখ ধাঁধানো ধোঁয়াশা চাদর। সেই চাদর ফুঁড়ে দুটো কিশোর-কিশোরী ভিজছে। হালকা আলো এসে পড়েছে ওদের গায়ে। ছেলেটার পরনে খয়েরি রংয়ের হাফপ্যান্ট, গায়ে সবুজ শার্ট। মেয়েটার কুচি দেওয়া ফ্রকে শর্ষে ফুলের হলদে রং। ছেলেটার ভিজে যাওয়া ছোটছোট চুলগুলো লেপ্টে আছে মাথায়। হ্যাংলা লিকলিকে। গায়ের রঙ বেশ পরিষ্কার। ঝারা হাত-পা। বয়সের তুলনায় লম্বাটে। আলোর বিপরীতে মেয়েটার চোখেমুখে ছায়া পড়েছে ছেলেটার। চুল নেমেছে কাঁধ থেকে খানিক নিচে। ভিজে পাটের আঁশের মতো জমে আছে কাঁধে-পিঠে। লাফিয়ে উঠে দু-পা শূন্যে তুলে দুজনই আনন্দে আত্মহারা। নতুন পানির মাছের মতো খলবল করছে। কী যেন বলছে দুজনে। পরক্ষণে হেসে কুটিপাটি হচ্ছে একসাথে। শব্দটা কলকাকলির মতো। ছেলেটার হাতে একটা কদমফুল। ওদের লম্ফঝম্ফে ফুলটাও দুলছে বলের মতো। লাফাতে লাফাতে খানিক ক্লান্ত হয়ে থিতু হয়ে দাঁড়াল দুজন। মুখে তখনো হাসির রেখা। হঠাৎ বাজ পড়ল কোথাও। আতঙ্কে একে অন্যকে জড়িয়ে নিল বুকে। দুজনে মিলে যেন যৌথ ভাস্কর্য।

বৃষ্টির ঘোরলাগা এই সন্ধ্যায় ওদের অবগাহন দেখে আনন্দ পাচ্ছিলেন কবীর সাহেব। গভীর মন দিয়ে দেখছিলেন। কোথাও একটা মিল খুঁজছেন এই ছেলেমেয়ের দুটোর সঙ্গে। তার চোখে ঝাপসা হয়ে আসা দূর-স্মৃতি সেল্যুলয়েডের পর্দায় ভেসে উঠছে। স্মৃতির আলোকরেখায় স্পষ্ট হচ্ছে শৈশব-কৈশোরের সেই আমরাঝুড়ি গ্রাম। যেখানে বাপ-দাদা আর তারও নাড়িপোতা। বর্ষায় কচা নদীর পাড়ের গ্রামটাকে মনে হতো বিস্তীর্ণ সমুদ্র। খাল, বিল, দোন, মাঠঘাট- সব কেমন তলিয়ে যেত জলে। জোয়ারের মুখে চাঁই পাতা। শিলন্দ, রিঠা, ফলি, চিংড়ি, ভেটকি- কত রকমের মাছ মিলত ভাটায়! কোষা বেয়ে যেতে হতো ইশকুলে, হাটে। কী রঙিন ছিল দিনগুলি!

আমরাঝুড়ির কথা সহসা মনে করতে চান না কবীর সাহেব। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যাওয়া ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখে মনের গহনে লুকিয়ে থাকা একটা অস্ফুট ব্যথা ডুকরে উঠল। এমন একটা কৈশোর ছিল তারও। কিশোরী মেয়েটির মতো তারও খেলার সাথী ছিল- অলকানন্দা। সহপাঠীও। অলকা বলেই ডাকত সবাই। স্কুল থেকে ফেরার সময় কতদিন এমন বৃষ্টির কবলে পড়েছে দুজন! অলকা নিজের ফ্রকের নিচে দুজনের বইগুলো লুকিয়ে রেখেছে। যেন বৃষ্টি দেখতে না পায়। কত বৃষ্টি সিঁধিয়ে গেছে তাদের দুজনের শরীরে! কদম ফুল খুব প্রিয় ছিল অলকার। বায়না ছিল কদম ফুল। বিনিময়ে শামসুর জন্য থাকতো চিড়ে, নাককেলের নাড়–। নাড়ুর লোভ কিংবা অলকাকে খুশি করতেই হোক, তার কাজ ছিল কদম ফুল জোগাড় করা। বনে-বাঁদারে ঘুরে বেড়ানো। ভর দুপুরে পোড়াভিটার জাম গাছে চড়া, সুবেদ আলী মেম্বারের বাগান থেকে সফেদা, টকটকে লাল বিলাতি গাব, হলদে কাউফল চুরি করা- কত রোমাঞ্চকর অভিযান ছিল সেসব। চকচকে পাকা বেতফল পাড়তে গিয়ে কতদিন কাঁটার আঁচড়ে ছিন্ন হয়েছে বুক-পিঠ। টকমিষ্টি ফলটা ওদের দুজনরেই বেশ প্রিয় ছিল। কী সব দিন কেটেছে আমরাঝুড়িতে!

ছেলেবেলার সাথী অলকার সঙ্গে বাঁধনটা হঠাৎ করেই একরাতের ব্যবধানে ছিঁড়ে গেল। আর জোড়া গেল না। এক সকালে ঘুম ভাঙলে জানতে পারল অলকারা চলে গেছে। ‘চইল্যা গ্যাছে? কই গ্যাল মা?’

-হ্যারা হগলডি দ্যাশ ছাইড়া গ্যাছে। জবাবে বলেছিলেন মা।

-আর আইবো না মা?

-ক্যামনে কমু বাজান। আওনের লাইগা কি গ্যাছে মনে কয়।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন শামসুল কবীর। এক দৌড়ে গিয়ে উঠেছিলেন অলকাদের উঠোনে। বাড়ির দুয়ারে সুপারির ডাল কাটা বসার মাচান, গোবর-মাটিতে নিকানো উঠোন, তার একপাশে গোড়াবাঁধানো তুলসি গাছ, উত্তরে বাঁশ-কাঠের মুরগির খোয়াড়, দখিন দুয়ারি কাঠের ঘর, তার গায়ে নকশা কাটা, পেছনে ওস্যাঘর, একটা শাদা বেড়াল গুটিশুটি হয়ে বসে আছে, তার পাশে খালি জায়গায় অনাদরে গজিয়ে ওঠা আমের চারা, পুঁইয়ের লতা, পটল চারা, লকলকে কচু গাছ, তার পাশে পুকুর, খেঁজুর গাছের ঘাটলা, ওপাশে মেহগনী-চাম্বল-শেরেজ-অর্জুন-আমলকি-নারকেল বাগান, পশ্চিমে পাটকাঠির বেড়া-হোগলাপাতার ছাউনিতে গোয়ালঘর, পুবে-পশ্চিমে সারি সারি সুপারি গাছ অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, তাফালের পাশে ধান সিদ্ধ করার দুটো ডোঙা, ঘরের দেয়ালের সঙ্গে পেরেক পুঁতে রাখা চাঁই, ছাবিজাল, কোণায় রাখা পলো, উঠোনের পুব কোণে গইয়া গাছ, ছোলম গাছ, তার তলায় উশ্যি মাচান, ছেঁড়া ঝাঁকিজালে বাঁধানো গোড়া, হাঁস-মুরগির কুড়ামাখানো মাটির খোলা- সবই আছে যে যার জায়গায়। কেবল ঘরের দুয়ারে ঝুলছে মস্ত তালা। মনে হচ্ছে, এ বাড়ির পুরুষেরা সব জমিতে গেছে। গোয়াল শূন্য করে গরুগুলো মাঠে নিয়ে গেছে রাখাল। ছেলেপুলেরাও গেছে ইশকুলে। এই ফাঁকে দুয়ার এঁটে বাড়ির মেয়েরা হয়তো আত্মীয় বাড়িতে গেছে, কোনো প্রয়োজনে। ফিরেও আসবে। একটি বারও মনে হচ্ছে না সবাই একেবারে চলে গেছে। এই দেশ ছেড়ে, অন্য দেশে। অলকা তাকে একটিবারও বলে গেল না? কিছুই জানল না সে? সেদিন খুব কেঁদেছিলেন কবীর। বুকের কষ্ট উজাড় করে দিয়েছিলেন কান্নার শব্দে। কেউ শোনেনি, খা খা রোদ্দুর, নির্জন ভিটা, শূন্য উঠোন, শাদা বেড়াল আর গাছপালা ছাড়া। সেদিন কিশোর মনে খুব আঘাত পেয়েছিলেন শামসুল কবীর। জন্মেছিল গভীর এক ক্ষত। সেই ক্ষত আজও সাড়েনি। বড় হয়ে পরিচয় হয় দাঙ্গা-দেশভাগ-বাস্তুত্যাগ- শব্দগুলোর সঙ্গে। কিন্তু ততদিনে অলকার রেখে যাওয়া দাগ গেঁথে গেছে অন্তরের অন্তস্তলে। সে দাগ আর ওঠেনি।

কিশোর কবীর ভাবতেন, অলকারা একদিন নিশ্চয়ই ফিরবে। যেভাবে একসকালে শুনেছিলেন, অলকারা চলে গেছে, সেভাবে কোনো এক ভোরে তার ঘুম ভাঙবে অলকানন্দার ডাকে- এই আশা বুকে নিয়ে চোখ বুজেছে রাতের পর রাত। আজও প্রতিরাতে ঘুমের বিছানায় গড়াগড়ি খায় ছেলেবেলার সেই সঙ্গিনীর ভাবনা। অফিসের কাজে, ব্যক্তিগত ভ্রমণে যতবারই কলকাতা গিয়েছেন, মনে মনে খুঁজেছেন অলকাকে। দৈবাৎ যদি দেখা হয়ে যায়! কতকিছুই তো ঘটে আকস্মিক। অলকা কি আর সেই কিশোরীটি আছে! বড় হয়েছে, বুড়ো হয়েছে, তার মতই। সে কি আগের মতো আছে দেখতে? বদলে গেছে নিশ্চয়ই। দেখলেই কি চিনতে পারতেন অলকাকে? কবীর সাহেবের বিশ্বাস তিনি ঠিকই চিনে নিতেন কৈশোরের সেই খেলার সাথীকে। বন-বাঁদালি গন্ধ, বুনোফুলের সুবাস, নদীর জলে স্নানের সৌরভ, বাতাসের ঘ্রাণ, চিবুকে বিন্দু বিন্দু নোনার কটুঘ্রাণ, চুলে মাখা বাসনা-তেলের সুগন্ধ, চুল বাঁধার লাল-নীল-হলুদ ফিতের খুশবু, রোদের ঘ্রাণ, বর্ষার সুরভি, কদমফুলের নির্যাস, কাশফুলের ¯িœগ্ধতা, নতুন ধানের সোঁদা গন্ধ, শীত-কুয়াশার ভেজাঘ্রাণ, গরম কাপড়ের পুরনো গন্ধ, নলেন গুড়ের খোশবাই, হলদে কনকচাঁপার সুরভি- সবই কি মুছে গেছে অলকার শরীর থেকে? সত্যিই কি মুছে যায় সব? চেনা সেই ঘ্রাণের কিছু না কিছু হয়তো আজও বয়ে বেড়াচ্ছে অলকা। কাছাকাছি গেলে ঠিকই শৈশবের শামসুর নাকে ধরা দিত। তা থেকেই তিনি চিনে নিতেন অলকাকে। অলকাও কি পারত? পারত হয়তো। ছেলেবেলার সঙ্গীকে সেও হয়তো এভাবেই খুঁজে পেত।

হঠাৎ মনে হয়, অলকা বেঁচে আছে তো? তার বয়সী কতজনই তো লোকান্তরে পাড়ি দিয়েছে। অন্য কিছু ভাবতে চান না কবীর। অলকা আজও তার হৃদয়ে টলটলের জলের স্মৃতি। চুলের বেণীতে ফুল তোলা কিশোরী। ভুলতে পারেননি। এক মুহূর্তের জন্যও না। অলকার জায়গায় বসাতেও পারেননি কাউকে। তাই হয়তো একাই কাটিয়ে দিলেন দীর্ঘ একটা জীবন। অলকা তা কখনোই জানবে না। আচ্ছা অলকা কি তাকে ভুলে গেছে? জানা হবে না এ কথাও।

ছাতিম গাছের পাতা গলিয়ে টপটপ জল পড়ছে। বৃষ্টির ছাটও আসছে বাতাসের তোরে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ভিজে যেতে হবে। কবীর সাহেব ওয়াকিং স্টিকটায় ভর দিয়ে ধীরে ধীরে পাশের ছাউনিতে গিয়ে উঠলেন। মাথায় পড়া বৃষ্টির ফোঁটা হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বেঞ্চিতে বসলেন। ছেলেবেলার কথা মনে করে নিজেকে আরও ভারাক্রান্ত মনে হচ্ছে তার। ঝিলের জলের মতো টলমল করছে চোখ। কেন যে স্মৃতিগুলো সুযোগ পেলেই ভাবনায় জেঁকে বসে! এখন এসব মনে করতে চান না তিনি। অতীত বলতে কিছু নেই তার জীবনে। ভবিষ্যতও নেই। কেবলই বর্তমান। এই যে তিনি বেঁচে আছেন, ভালো আছেন, এর বেশি কী চাই তার।

রয়েসয়ে ঝরছে বৃষ্টি। একটু থেমে ফের শুরু হয়েছে অঝোর ধারায়। ঝুপঝুপ ঝপঝপ। ছেলেমেয়ে দুটো তখনো ভিজছে। পথের ধারে পাশাপাশি বসে। কবীর সাহেব কী মনে করে গলা তুলে ডাকলেন, ‘এই এত ভিজলে ঠাণ্ডা লাগবে না?’

ওরা দুজন ঝিলের দিকে মুখ করে বসে ছিল। ছেলেটি ফিরে তাকাল। পরক্ষণে মেয়েটিও। কবীর সাহেব হাত উঁচিয়ে ইশারা করলেন, ‘এদিকে এসো, শোনো।’

ওরা উঠে এসে তার সামনে দাঁড়াল। কবীর সাহেব মেয়েটির হাত ধরলেন। বললেন, ‘সেই কখন থেকে ভিজেই যাচ্ছো। শরীর তো বরফ গেছে দেখি। জ্বর হবে না?’

মেয়েটি কিছু বলল না। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিল। ছেলেটিও হাসল। কবীর সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ‘বাহ্! তোমার হাসিটা তো খুব সুন্দর।’

মেয়েটা পাতলটা ঠোঁট দুটো চেপে হাসিটা আটকে রাখার চেষ্টা করল। ছেলেটি বলল, ‘বৃষ্টিতে ভিজলে আমাগো ঠাণ্ডা লাগে না। গরিব মানুষের আবার অসুখ কী।’

‘তাই নাকি? তুমি তো বেশ কথা জানো। কী নাম তোমার?’ কবীর সাহেব জানতে চাইলেন।

‘শামসুল কবীর। ডাকনাম শামসু।’

কবীর সাহেব চমকে উঠলেন। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মেয়েটির দিকে তাকালেন। বললেন, ‘তোমার নাম?’

মেয়েটি ফের ফিক করে হেসে উঠল। বলল, ‘অলকা’।

কবীর সাহেব একবার শামসুর দিকে, একবার অলকার দিকে তাকালেন। মনে মনে বললেন, এও কি সম্ভব! নাকি তিনি ভুল শুনেছেন?

* ব্যবহৃত কিছু আঞ্চলিক শব্দের অর্থ

-ওস্যাঘর-রান্নাঘর, তাফালের-বড় চুলা, ডোঙা-বড় টিনের পাত্র, গইয়া-পেয়ারা, শেরেজ- রেইন ট্রি, ছোলম-জাম্বুরা, উশ্যি-শিম।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

অলকানন্দা

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১

কাঁচা হলুদ রং মেখেছে আকাশ। যেন ডিম ভেঙে কুসুমটা ছড়িয়ে পড়েছে। গাছগুলোও চাঁদিতে মেখেছে সেই আভা। ঝিলের জলে মুখ দেখছে শেষ বিকেলের রূপ। পার্কের বেঞ্চি, কাঠের ঝুলন্ত হাঁটার পথ, রেলিংয়েও চিকচিক করছে অন্তরীক্ষের আলো। সূর্যটা পশ্চিমে গলে গলে নাই হয়ে গেছে সেই কখন। দেবদারু, আকাশমণি, অর্জুন, জারুল, শিমুল, কনকচূড়া গাছ পরম বান্ধবের মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। একদ- বিশ্রামের আশ্রয় বাঁধানো ছাতিমতলা। ঝিলের পারে পানবটের বড় সংসার। ডালপালা ছড়িয়ে আছে ঝিলের অনেকটা জুড়ে। তার ডালে ডালে ঘুঘু, শালিক, বনপায়রার দল। হঠাৎ হঠাৎ একটা-দুটো টিয়ে ‘টিউক, টিউক’ ডেকে উঠছে। টুনটুনির ফুরুৎ ফুরুৎ উড়ে যাওয়া, মাছরাঙার ছুটোছুটিও চোখে পড়ছে ক্ষণে ক্ষণে।

শহরের বুকে এমন এক টুকুরো শ্যামল নিসর্গে বুক ভরে দম নিতে প্রায়ই আসেন শামসুল কবীর। প্রায় বললে ভুল হবে, প্রতিদিনই আসেন। অবসরে এসেছেন প্রায় তিন যুগ হতে চলল। চাকরি শেষে যে টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে এই নগরেই পনেরো-ষোল শ’ বর্গফুটের একটা ফ্ল্যাটও কিনেছেন। সেই ফ্ল্যাটে নিঃসঙ্গ জীবন তার।

গৌরবর্ণ চেহারা। ব্যাকব্রাশ চুল। সুদর্শন পুরুষ বলতে যা বোঝায়, তাই। অশীতিপর কবীর সাহেবের চেহারায় সৌম্যকান্তি ভাব অনেকটাই অটুট। শরীরের ত্বক লাবণ্যতা হারালেও এখনো বেশ উজ্জ্বল। উচ্চতা ছ’ফুট দুই ইঞ্চি। সুঠাম দেহি পুরুষ ছিলেন। বয়সে শরীর ভেঙেছে কিছুটা। একেবারে ম্লান হয়ে যায়নি। নিজের উচ্চতা নিয়ে তার অবশ্য গর্ব আছে মনে মনে। কখনো প্রকাশ্যেও বলেন সে কথা। জানেন তো, রবীন্দ্রনাথের উচ্চতা কত ছিল? ছ’ফুট তিন ইঞ্চি। আর সত্যজিৎ রায়ের? ছ’ফুট পাঁচ। কোনো এক পত্রিকাতে তিনি পড়েছেন, শিল্পী ধ্রুব এষের উচ্চতাও ছ’ফুট দুই ইঞ্চি। তার মানে ছ’ফুট প্লাস ক্লাবের সদস্যরা প্রায়ই নামকরা ব্যক্তিত্ব। স্বভাবচরিত অন্যদের চেয়ে অনেক আলাদা।

সরকারের সাবেক সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা শামসুল কবীরও তার পরিবারের ব্যতিক্রমী মানুষ। ভাই-বোনেরা, পরে তাদের ছেলে-মেয়েরাও বিয়ে থা করে সংসার পাতলেও তিনি আর সে পথে যাননি। একা ছিলেন, আছেন। বিয়ে, সংসার, ছেলেপুলে এসবে আগ্রহ নেই তার। পরিবার থেকে চেষ্টা হয়েছে। কাজ হয়নি। বিয়ে করবেন না- এক কথাতেই অটল ছিলেন। কেন করবেন না, এই প্রশ্নটিও রেখেছিলেন কেউ কেউ। জবাব মেলেনি। কেবল বলেছেন, ‘ভালোই তো আছি একা।’

সত্যি বলতে একা খারাপ ছিলেন না কবীর সাহেব। চাকরিতে থাকতে দায়িত্বের ব্যস্ততায়, সহকর্মীদের সাহচর্যে একবারও মনে হয়নি তিনি একা। অবসরে আসার পর অবশ্য কাজের ব্যস্ততা নেই। সহকর্মীদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ হয় না দীর্ঘদিন। সহকর্মীদের অনেকে বেঁচেও নেই হয়তো। হঠাৎ হঠাৎ নিঃসঙ্গ বোধ হয়। তখন অ্যালুমিনিয়ামের স্লিম ওয়াকিং স্টিকটাকে সঙ্গী করে চলে আসেন বাসার কাছেই এই নগর-অরণ্যে। রাতবিরাতে একা লাগলে সালামত মিয়াকে ডেকে গল্প করেন। মূলত একার সংসারে সালামত মিয়াই তার ভরসা। গেল পঁচিশ বছর কবীর সাহেবের দেখভাল, ঘরকন্নার কাজ তিনিই সামলে রাখছেন।

সালামত মিয়াও একা। তবে বিয়ে করেছিলেন। সংসারও ছিল। এখনও আছে। নিজের না। ছেলে-মেয়েদের। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেও বিয়ে করে সংসার পেতেছে। স্ত্রী গত হয়েছে বছর দশেক হচ্ছে। তারপর থেকে গ্রামের ভিটায় তালা ঝুলছে। নির্ঞ্ঝাট জীবন। কবীর সাহেবের সঙ্গে তার ভালোই দিন কাটছে।

কবীর সাহেব বসে আছেন পার্কটার উত্তরে, ছাতিমতলায়। গাছের গুঁড়ি বাঁধানো জায়গাটা বেশ প্রিয় তার। প্রতিদিন এসেই ধীর পায়ে পুরো পার্কটা একবার চক্কর দিয়ে এখানে বসেন তিনি। ঘন গাছে ঘেরা চারপাশ। রোদ খুব একটা না পড়ায় ঠা-া থাকে। কাছেধারে কাঠগোলাপের গাছ। হঠাৎ হঠাৎ মৃদু হাওয়ায় ঝরছে একটা-দুটো হলদে-সাদা ফুল। গন্ধটা ভাসিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বাতাস। আষাঢ়ের আকাশ। এই ভালো, এই মন্দ। দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই উটকো মেঘ এসে জড়ো হচ্ছিল ধীরে ধীরে। সূর্য ডোবার সময় সেই মেঘ কোথায় যেন ভেসে ভেসে পালিয়ে গেল! ফিরে এল আবার। শীতল হাওয়া ছেড়েছে। কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। এখানেও হবে। মাথার ওপর কু-ুলি মেঘের আসর বসেছে। শলা-পরামর্শ করছে কতটা ভিজিয়ে দেবে এই সবুজ উদ্যান, ইটপাথরের দালান, নগরের পথঘাট, ঘরে ফেরা মানুষ কিংবা পাখিদের।

এখন পার্ক থেকে বেরোলেও বৃষ্টির আগে বাসায় পৌঁছতে পারবেন না কবীর সাহেব। তার চেয়ে আকাশটা পরিষ্কার হলেই যাওয়া ভালো। বাসায় ফেরার তাড়া তো আর নেই। কাছেই ছাউনিটা মাথা তুলে আছে ছাতার মতো। তার নিচে লোহাকাঠের বেঞ্চি। ওদিকে গেলে আরামে বসা যায়। আবার বৃষ্টিতেও ভিজতে হবে না। কবীর সাহেব গেলেন না। ছাতিমতলাতেই বসে রইলেন। মাথা তুলে উপরে তাকালেন। ছাতিমের ঘন পত্রপল্লবের ছাউনি গলিয়ে বৃষ্টি সহসা নিচে নামতে পারবে বলে মনে হয় না। অনেকদিন এভাবে অরণ্যের জলসায় বসে বৃষ্টি দেখা হয় না। প্রকৃতির সঙ্গে বৃষ্টির মিলন- কী মনোরম সেই দৃশ্য! ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। মাঠজুড়ে বৃষ্টি ঝরছে। আষাঢ়ের হুটহাট বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দৌড়ে গিয়ে বুড়োবটের তলায় ঠাঁই নেওয়া। পাতার ফাঁক গলিয়ে ছোট্ট ছোট্ট ফোঁটায় ভিজে যাওয়া। ঝিরঝিরে কুয়াশা-বর্ষণে ভিজে বাড়ি ফেরা- সোনার খাঁচায় মোড়া দিনগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল জীবন থেকে! আর কখনোই ফিরবে না। চাইলেও আর ফেরা যাবে না শৈশব-কৈশোরের আবির মাখা দিনে।

ছয় ভাইবোনের বড় সংসার। চাষবাসই ছিল বাবার পেশা। কষ্টেশিষ্টে মানুষ হতে হয়েছে পিঠাপিঠি ভাইবোনদের। কবীর সাহেব আর তার পিঠাপিঠি বড়বোন একই ক্লাসে পড়তেন। টাকার অভাবে বই কেনার সাধ্য ছিল না। একসেট বই দিয়ে পড়তে হয়েছে দুই ভাইবোনকে। হাফপ্যান্ট আর ছিতি পড়ে কালো হয়ে যাওয়া পলিয়েস্টারের শার্টই ছিল স্কুল ড্রেস। প্যান্টের জিপার ছিড়ে গেলে সেফটিপিন দিতে আটকে রাখতে হতো। হাতে পাঁকানো সুতলি ছিল কোমরের বন্ধনী। এক পোশাকেই সারা বছর কেটে যেত। পরের বছর ছোট ভাইটির জন্য বরাদ্দ হতো ড্রেসটি। স্কুলজীবনে জুতো পরেছেন কিনা কখনো, মনে নেই।

মূলত একার সংসারে সালামত মিয়াই তার ভরসা। গেল পঁচিশ বছর কবীর সাহেবের দেখভাল, ঘরকন্নার কাজ তিনিই সামলে রাখছেন

বিছানো হাঁটার পথ। বর্ষণের ফোঁটায় ফোঁটায় ধুলোময়লা কেটে গেলে টকটকে লাল টালি জেগে উঠছে। পথের পাশের ঘাস, কানদুলি, ঢোলপাতার নীলচে ফুলগুলো নেচে উঠছে বৃষ্টির ছন্দে। কলরব শুরু হয়েছে তৃণশাখে। কবীর সাহেব একধ্যানে তাকিয়ে প্রকৃতির নৃত্য উপভোগ করছেন। সন্ধে নেমেছে। ঘনিভূত অন্ধকার হটাতে মরিয়া এলইডি বাতি। তবে এদিকটা ঘন গাছগাছালির প্রচীর ডিঙিয়ে বাতির আলো খুব একটা পৌঁছতে পারছে না। যতটুকু পৌঁছেছে তাতে তৈরি হয়েছে অন্যরকম এক আলো-আঁধারি।

কবীর সাহেব একধ্যানে চোখ রেখেছেন পথের ওপর। অবিরত বর্ষণে চোখ ধাঁধানো ধোঁয়াশা চাদর। সেই চাদর ফুঁড়ে দুটো কিশোর-কিশোরী ভিজছে। হালকা আলো এসে পড়েছে ওদের গায়ে। ছেলেটার পরনে খয়েরি রংয়ের হাফপ্যান্ট, গায়ে সবুজ শার্ট। মেয়েটার কুচি দেওয়া ফ্রকে শর্ষে ফুলের হলদে রং। ছেলেটার ভিজে যাওয়া ছোটছোট চুলগুলো লেপ্টে আছে মাথায়। হ্যাংলা লিকলিকে। গায়ের রঙ বেশ পরিষ্কার। ঝারা হাত-পা। বয়সের তুলনায় লম্বাটে। আলোর বিপরীতে মেয়েটার চোখেমুখে ছায়া পড়েছে ছেলেটার। চুল নেমেছে কাঁধ থেকে খানিক নিচে। ভিজে পাটের আঁশের মতো জমে আছে কাঁধে-পিঠে। লাফিয়ে উঠে দু-পা শূন্যে তুলে দুজনই আনন্দে আত্মহারা। নতুন পানির মাছের মতো খলবল করছে। কী যেন বলছে দুজনে। পরক্ষণে হেসে কুটিপাটি হচ্ছে একসাথে। শব্দটা কলকাকলির মতো। ছেলেটার হাতে একটা কদমফুল। ওদের লম্ফঝম্ফে ফুলটাও দুলছে বলের মতো। লাফাতে লাফাতে খানিক ক্লান্ত হয়ে থিতু হয়ে দাঁড়াল দুজন। মুখে তখনো হাসির রেখা। হঠাৎ বাজ পড়ল কোথাও। আতঙ্কে একে অন্যকে জড়িয়ে নিল বুকে। দুজনে মিলে যেন যৌথ ভাস্কর্য।

বৃষ্টির ঘোরলাগা এই সন্ধ্যায় ওদের অবগাহন দেখে আনন্দ পাচ্ছিলেন কবীর সাহেব। গভীর মন দিয়ে দেখছিলেন। কোথাও একটা মিল খুঁজছেন এই ছেলেমেয়ের দুটোর সঙ্গে। তার চোখে ঝাপসা হয়ে আসা দূর-স্মৃতি সেল্যুলয়েডের পর্দায় ভেসে উঠছে। স্মৃতির আলোকরেখায় স্পষ্ট হচ্ছে শৈশব-কৈশোরের সেই আমরাঝুড়ি গ্রাম। যেখানে বাপ-দাদা আর তারও নাড়িপোতা। বর্ষায় কচা নদীর পাড়ের গ্রামটাকে মনে হতো বিস্তীর্ণ সমুদ্র। খাল, বিল, দোন, মাঠঘাট- সব কেমন তলিয়ে যেত জলে। জোয়ারের মুখে চাঁই পাতা। শিলন্দ, রিঠা, ফলি, চিংড়ি, ভেটকি- কত রকমের মাছ মিলত ভাটায়! কোষা বেয়ে যেতে হতো ইশকুলে, হাটে। কী রঙিন ছিল দিনগুলি!

আমরাঝুড়ির কথা সহসা মনে করতে চান না কবীর সাহেব। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যাওয়া ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখে মনের গহনে লুকিয়ে থাকা একটা অস্ফুট ব্যথা ডুকরে উঠল। এমন একটা কৈশোর ছিল তারও। কিশোরী মেয়েটির মতো তারও খেলার সাথী ছিল- অলকানন্দা। সহপাঠীও। অলকা বলেই ডাকত সবাই। স্কুল থেকে ফেরার সময় কতদিন এমন বৃষ্টির কবলে পড়েছে দুজন! অলকা নিজের ফ্রকের নিচে দুজনের বইগুলো লুকিয়ে রেখেছে। যেন বৃষ্টি দেখতে না পায়। কত বৃষ্টি সিঁধিয়ে গেছে তাদের দুজনের শরীরে! কদম ফুল খুব প্রিয় ছিল অলকার। বায়না ছিল কদম ফুল। বিনিময়ে শামসুর জন্য থাকতো চিড়ে, নাককেলের নাড়–। নাড়ুর লোভ কিংবা অলকাকে খুশি করতেই হোক, তার কাজ ছিল কদম ফুল জোগাড় করা। বনে-বাঁদারে ঘুরে বেড়ানো। ভর দুপুরে পোড়াভিটার জাম গাছে চড়া, সুবেদ আলী মেম্বারের বাগান থেকে সফেদা, টকটকে লাল বিলাতি গাব, হলদে কাউফল চুরি করা- কত রোমাঞ্চকর অভিযান ছিল সেসব। চকচকে পাকা বেতফল পাড়তে গিয়ে কতদিন কাঁটার আঁচড়ে ছিন্ন হয়েছে বুক-পিঠ। টকমিষ্টি ফলটা ওদের দুজনরেই বেশ প্রিয় ছিল। কী সব দিন কেটেছে আমরাঝুড়িতে!

ছেলেবেলার সাথী অলকার সঙ্গে বাঁধনটা হঠাৎ করেই একরাতের ব্যবধানে ছিঁড়ে গেল। আর জোড়া গেল না। এক সকালে ঘুম ভাঙলে জানতে পারল অলকারা চলে গেছে। ‘চইল্যা গ্যাছে? কই গ্যাল মা?’

-হ্যারা হগলডি দ্যাশ ছাইড়া গ্যাছে। জবাবে বলেছিলেন মা।

-আর আইবো না মা?

-ক্যামনে কমু বাজান। আওনের লাইগা কি গ্যাছে মনে কয়।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন শামসুল কবীর। এক দৌড়ে গিয়ে উঠেছিলেন অলকাদের উঠোনে। বাড়ির দুয়ারে সুপারির ডাল কাটা বসার মাচান, গোবর-মাটিতে নিকানো উঠোন, তার একপাশে গোড়াবাঁধানো তুলসি গাছ, উত্তরে বাঁশ-কাঠের মুরগির খোয়াড়, দখিন দুয়ারি কাঠের ঘর, তার গায়ে নকশা কাটা, পেছনে ওস্যাঘর, একটা শাদা বেড়াল গুটিশুটি হয়ে বসে আছে, তার পাশে খালি জায়গায় অনাদরে গজিয়ে ওঠা আমের চারা, পুঁইয়ের লতা, পটল চারা, লকলকে কচু গাছ, তার পাশে পুকুর, খেঁজুর গাছের ঘাটলা, ওপাশে মেহগনী-চাম্বল-শেরেজ-অর্জুন-আমলকি-নারকেল বাগান, পশ্চিমে পাটকাঠির বেড়া-হোগলাপাতার ছাউনিতে গোয়ালঘর, পুবে-পশ্চিমে সারি সারি সুপারি গাছ অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, তাফালের পাশে ধান সিদ্ধ করার দুটো ডোঙা, ঘরের দেয়ালের সঙ্গে পেরেক পুঁতে রাখা চাঁই, ছাবিজাল, কোণায় রাখা পলো, উঠোনের পুব কোণে গইয়া গাছ, ছোলম গাছ, তার তলায় উশ্যি মাচান, ছেঁড়া ঝাঁকিজালে বাঁধানো গোড়া, হাঁস-মুরগির কুড়ামাখানো মাটির খোলা- সবই আছে যে যার জায়গায়। কেবল ঘরের দুয়ারে ঝুলছে মস্ত তালা। মনে হচ্ছে, এ বাড়ির পুরুষেরা সব জমিতে গেছে। গোয়াল শূন্য করে গরুগুলো মাঠে নিয়ে গেছে রাখাল। ছেলেপুলেরাও গেছে ইশকুলে। এই ফাঁকে দুয়ার এঁটে বাড়ির মেয়েরা হয়তো আত্মীয় বাড়িতে গেছে, কোনো প্রয়োজনে। ফিরেও আসবে। একটি বারও মনে হচ্ছে না সবাই একেবারে চলে গেছে। এই দেশ ছেড়ে, অন্য দেশে। অলকা তাকে একটিবারও বলে গেল না? কিছুই জানল না সে? সেদিন খুব কেঁদেছিলেন কবীর। বুকের কষ্ট উজাড় করে দিয়েছিলেন কান্নার শব্দে। কেউ শোনেনি, খা খা রোদ্দুর, নির্জন ভিটা, শূন্য উঠোন, শাদা বেড়াল আর গাছপালা ছাড়া। সেদিন কিশোর মনে খুব আঘাত পেয়েছিলেন শামসুল কবীর। জন্মেছিল গভীর এক ক্ষত। সেই ক্ষত আজও সাড়েনি। বড় হয়ে পরিচয় হয় দাঙ্গা-দেশভাগ-বাস্তুত্যাগ- শব্দগুলোর সঙ্গে। কিন্তু ততদিনে অলকার রেখে যাওয়া দাগ গেঁথে গেছে অন্তরের অন্তস্তলে। সে দাগ আর ওঠেনি।

কিশোর কবীর ভাবতেন, অলকারা একদিন নিশ্চয়ই ফিরবে। যেভাবে একসকালে শুনেছিলেন, অলকারা চলে গেছে, সেভাবে কোনো এক ভোরে তার ঘুম ভাঙবে অলকানন্দার ডাকে- এই আশা বুকে নিয়ে চোখ বুজেছে রাতের পর রাত। আজও প্রতিরাতে ঘুমের বিছানায় গড়াগড়ি খায় ছেলেবেলার সেই সঙ্গিনীর ভাবনা। অফিসের কাজে, ব্যক্তিগত ভ্রমণে যতবারই কলকাতা গিয়েছেন, মনে মনে খুঁজেছেন অলকাকে। দৈবাৎ যদি দেখা হয়ে যায়! কতকিছুই তো ঘটে আকস্মিক। অলকা কি আর সেই কিশোরীটি আছে! বড় হয়েছে, বুড়ো হয়েছে, তার মতই। সে কি আগের মতো আছে দেখতে? বদলে গেছে নিশ্চয়ই। দেখলেই কি চিনতে পারতেন অলকাকে? কবীর সাহেবের বিশ্বাস তিনি ঠিকই চিনে নিতেন কৈশোরের সেই খেলার সাথীকে। বন-বাঁদালি গন্ধ, বুনোফুলের সুবাস, নদীর জলে স্নানের সৌরভ, বাতাসের ঘ্রাণ, চিবুকে বিন্দু বিন্দু নোনার কটুঘ্রাণ, চুলে মাখা বাসনা-তেলের সুগন্ধ, চুল বাঁধার লাল-নীল-হলুদ ফিতের খুশবু, রোদের ঘ্রাণ, বর্ষার সুরভি, কদমফুলের নির্যাস, কাশফুলের ¯িœগ্ধতা, নতুন ধানের সোঁদা গন্ধ, শীত-কুয়াশার ভেজাঘ্রাণ, গরম কাপড়ের পুরনো গন্ধ, নলেন গুড়ের খোশবাই, হলদে কনকচাঁপার সুরভি- সবই কি মুছে গেছে অলকার শরীর থেকে? সত্যিই কি মুছে যায় সব? চেনা সেই ঘ্রাণের কিছু না কিছু হয়তো আজও বয়ে বেড়াচ্ছে অলকা। কাছাকাছি গেলে ঠিকই শৈশবের শামসুর নাকে ধরা দিত। তা থেকেই তিনি চিনে নিতেন অলকাকে। অলকাও কি পারত? পারত হয়তো। ছেলেবেলার সঙ্গীকে সেও হয়তো এভাবেই খুঁজে পেত।

হঠাৎ মনে হয়, অলকা বেঁচে আছে তো? তার বয়সী কতজনই তো লোকান্তরে পাড়ি দিয়েছে। অন্য কিছু ভাবতে চান না কবীর। অলকা আজও তার হৃদয়ে টলটলের জলের স্মৃতি। চুলের বেণীতে ফুল তোলা কিশোরী। ভুলতে পারেননি। এক মুহূর্তের জন্যও না। অলকার জায়গায় বসাতেও পারেননি কাউকে। তাই হয়তো একাই কাটিয়ে দিলেন দীর্ঘ একটা জীবন। অলকা তা কখনোই জানবে না। আচ্ছা অলকা কি তাকে ভুলে গেছে? জানা হবে না এ কথাও।

ছাতিম গাছের পাতা গলিয়ে টপটপ জল পড়ছে। বৃষ্টির ছাটও আসছে বাতাসের তোরে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ভিজে যেতে হবে। কবীর সাহেব ওয়াকিং স্টিকটায় ভর দিয়ে ধীরে ধীরে পাশের ছাউনিতে গিয়ে উঠলেন। মাথায় পড়া বৃষ্টির ফোঁটা হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বেঞ্চিতে বসলেন। ছেলেবেলার কথা মনে করে নিজেকে আরও ভারাক্রান্ত মনে হচ্ছে তার। ঝিলের জলের মতো টলমল করছে চোখ। কেন যে স্মৃতিগুলো সুযোগ পেলেই ভাবনায় জেঁকে বসে! এখন এসব মনে করতে চান না তিনি। অতীত বলতে কিছু নেই তার জীবনে। ভবিষ্যতও নেই। কেবলই বর্তমান। এই যে তিনি বেঁচে আছেন, ভালো আছেন, এর বেশি কী চাই তার।

রয়েসয়ে ঝরছে বৃষ্টি। একটু থেমে ফের শুরু হয়েছে অঝোর ধারায়। ঝুপঝুপ ঝপঝপ। ছেলেমেয়ে দুটো তখনো ভিজছে। পথের ধারে পাশাপাশি বসে। কবীর সাহেব কী মনে করে গলা তুলে ডাকলেন, ‘এই এত ভিজলে ঠাণ্ডা লাগবে না?’

ওরা দুজন ঝিলের দিকে মুখ করে বসে ছিল। ছেলেটি ফিরে তাকাল। পরক্ষণে মেয়েটিও। কবীর সাহেব হাত উঁচিয়ে ইশারা করলেন, ‘এদিকে এসো, শোনো।’

ওরা উঠে এসে তার সামনে দাঁড়াল। কবীর সাহেব মেয়েটির হাত ধরলেন। বললেন, ‘সেই কখন থেকে ভিজেই যাচ্ছো। শরীর তো বরফ গেছে দেখি। জ্বর হবে না?’

মেয়েটি কিছু বলল না। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিল। ছেলেটিও হাসল। কবীর সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ‘বাহ্! তোমার হাসিটা তো খুব সুন্দর।’

মেয়েটা পাতলটা ঠোঁট দুটো চেপে হাসিটা আটকে রাখার চেষ্টা করল। ছেলেটি বলল, ‘বৃষ্টিতে ভিজলে আমাগো ঠাণ্ডা লাগে না। গরিব মানুষের আবার অসুখ কী।’

‘তাই নাকি? তুমি তো বেশ কথা জানো। কী নাম তোমার?’ কবীর সাহেব জানতে চাইলেন।

‘শামসুল কবীর। ডাকনাম শামসু।’

কবীর সাহেব চমকে উঠলেন। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মেয়েটির দিকে তাকালেন। বললেন, ‘তোমার নাম?’

মেয়েটি ফের ফিক করে হেসে উঠল। বলল, ‘অলকা’।

কবীর সাহেব একবার শামসুর দিকে, একবার অলকার দিকে তাকালেন। মনে মনে বললেন, এও কি সম্ভব! নাকি তিনি ভুল শুনেছেন?

* ব্যবহৃত কিছু আঞ্চলিক শব্দের অর্থ

-ওস্যাঘর-রান্নাঘর, তাফালের-বড় চুলা, ডোঙা-বড় টিনের পাত্র, গইয়া-পেয়ারা, শেরেজ- রেইন ট্রি, ছোলম-জাম্বুরা, উশ্যি-শিম।

back to top