কবি হালিম আজাদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মাতৃভূমি স্বাধীন করার লক্ষ্যে, বাঙালির মুক্তির প্রত্যাশায় বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে মাঠে ময়দানে, গ্রাম-গঞ্জে সক্রিয় ছিলেন তিনি। গ্রামের কৃষক, মজুর তাঁর খুব আপন। তাঁর লেখা কবিতায় কৃষক মজুর জেলে মাঝিদের কথা ফুটে উঠেছে। বাদ পড়েনি ইট পাথরের শহরের খেটে খাওয়া শ্রমিকের কথাও। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সুখ দুঃখ বেদনার সাথে ছোটবেলা থেকেই কবির পরিচয় ঘটে। আর সে কারণেই বোধহয় কবি হালিম আজাদ নিজেকে তাদেরই একজন মনে করেন। তাঁর লেখা কবিতায় শোষিত শ্রেণির আহার যোগানোর কষ্টের কথা, আবার অনাহারে দিন যাপনের করুণ আকুতি ফুঁটে উঠতে দেখা যায়। এসব বিষয় গতানুগতিক হলেও কাব্য শিল্পে রূপদেয়ার যে কৌশল তা কবির মেধারই প্রতিফলন।
কবি লিখেছেন- “ভাত, আহা কী অদ্ভুত জাতের জিনিস- তোর জন্যই তহুরা বিবি গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেল,/তবুও কি তোর পাষাণ মুখ দেখবে না সরল মানুষ! জীবন আহা কী দুষ্প্রাপ্য-অবৈধ দোতরার গান! (কবিতা: ভাত ও তহুরার কথা)।
হা ভাতের সংসারে কবির তীক্ষ্ণ নজর পড়েছে। শিল্পের বিকাশ ঘটায় এখন কিছুটা কমে আসলেও একসময় এই সমাজে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যাই বেশি ছিল। অভাবি মানুষের জীবন সংগ্রাম কারো দৃষ্টি এড়াতে পারত না। কবি হালিম আজাদও অভাবি মানুষের ছায়া থেকে দৃষ্টি সরাতে পারেনি। তাঁর লেখায় সুনিপুণভাবে উঠে এসেছে “ভাত ও তহুরার কথা” কবিতায়। সমাজের মানুষের দুঃখ কষ্ট যেন কবির আষ্টেপৃষ্টে লেগে গিয়েছিল। ভুখা-নাঙ্গা মানুষের কষ্টে কবির হৃদয়ে পীড়ন জেগে উঠত।
আবার কবি হালিম আজাদ একসময় হতাশায়ও ভুগেছেন। দুঃখযন্ত্রণা অনাহার অর্ধাহার থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুকে আহ্বান করেছেন। তিনি মনে করেছেন মৃত্যুর পরে আর কোন দুঃখ থাকবে না। যন্ত্রণা পোহাতে হবে না। চাহিদা থাকবে না আহারের। তাই তিনি “সমুদ্রদহন থেকে” কবিতায়-একটি চরণ এইভাবে তুলে ধরেন- ‘আমি শুধু তোমার অন্তর থেকে একটি যোগ্য ব্যাধি চাই,/ বারবার দুঃখ পাবার চেয়ে,/মৃত্যুর ঠিকানা- এরকম বাঁচার সাহস চাই!’
হতাশার কথা বলতে গেলে “একদিন অন্ধকার” কবিতার দুটি লাই তুলে ধরা যেতে পারে- ‘একদিন অন্ধকার বিষাক্ত পিঁপড়ে হবে, খুব করে কেটে / নেবে সাজানো সভ্যতা, কেড়ে নেবে পৃথিবীর সব সুন্দর।’
শুধুযে হতাশা তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে তা কিন্তু নয়। কবি অনেক ক্ষেত্রে আশাবাদীও হয়ে ওঠেন। বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুন্দরের পূজারী ছিলেন। সুন্দরের প্রতি তাঁর যে মোহ তা রবীন্দ্রনাথের কবিতা গল্প ও গানে অসংখ্যবার উঠে এসেছে। আর প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামও কম যায়নি কোন অংশে। সুন্দরের প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের দুর্বলতা খুব খোলামেলা ভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। তাদের মতো না হলেও হালিম আজাদ সুন্দরকে প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁর নিজের মতো করে। তিনি সুন্দর সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেন। এ কারণে তিনি আহ্বান করেছেন ‘সাত খণ্ডের গল্প’ শিরোনামের কবিতায়- ‘বুক পেতে দাও। যা কিছু পাও। এই যে নাও-/ভাসাও সুন্দরের দিকে। দূর করো যত নষ্ট ফিকে।’
হালিম আজাদ প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার কবি। রাষ্ট্র বা সমাজে সমাজতন্ত্র না হোক অন্তত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাক এই প্রত্যাশা করেন কবি হালিম আজাদ। আর সে কারণেই হয়তো তার কলমে নেমে এসেছে ‘নেতারা সবাই জেলে। রাজপথ ফাঁকা।/ তারা যে-মাঠের ঘাসেতে বসতেন,/ যে রেস্তোরায় বসে চলত সারাক্ষণ গাঁ-গেরামের গল্পমালা,/ সবই যেন কাঁদছে। পথের ধুলারও মন ভাল নেই।’ (সাত খণ্ডের গল্প)। রাজনৈতিক নেতারা কারাবন্দি হয়ে পড়ায় আন্দোলন সংগ্রাম স্থবির হয়ে গেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য সকলেই আন্দোলন করার অধিকার রাখে। তবে আন্দোলনে নেতৃত্ব খুবই জরুরি। নেতারা জেলে বন্দি হলে নেতৃত্ব দেবার কেউ থাকে না। এসব কারণে কবির হয়তো মন খারাপ। আর তাই কবিতার ভাষায় হালিম আজাদ প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
তিনি মানবতার মুক্তির প্রত্যাশা করেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু মানবিক সরকারের দেখা মেলে না। স্বৈরাচার আর শোষক হয়েই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে থাকে। যারা যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে তখন তাদেরই ভাগ্য পরিবর্তন হয়। ভাগ্যের উন্নতি ঘটে। কিন্তু যারা সাধারণ নাগরিক তাদের কোন প্রকার ভাগ্যের উন্নয়ন ফিরে আসে না। এবিষয়টি কবিকে বড় পীড়া দেয়। আর সেই যন্ত্রণা থেকে কবি হালিম আজাদের কলমের স্ফুলিঙ্গ- ‘কতগুলো বাঁকা নুড়ির বিলাপ শুনতে শুনতে আজকাল সময় কেটে যায়/ বড় চেষ্টা করেও এসব তাড়াতে পারি না। বঙ্গভবনের দরোজা থেকে/পারি না তাড়াতে কুৎসিত ছায়া। বারবার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি/ নির্লজ্জ অমাবস্যা থেকে মুক্তি চাই। মানবতার মুক্তি চাই।’ (এইখানে এখন)।
শুধু কবিতায়ই নয়। কবি হালিম আজাদ ব্যাক্তি জীবনেও মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তিনি অপরাজনীতি এবং ভিলেজ পলিটিক্স থেকেও মুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। ঘৃণা করেন অনর্থক মানুষের ক্ষতি করা, বদনাম রটানো এবং মানুষকে ছোট করে দেখা। সবসময় তিনি মানুষের সাথে মানবিক আচরণ করার চেষ্টা করে থাকেন। মানব সেবা তাঁর ব্রত।
তিনি একজন প্রকৃতি প্রেমিক। প্রকৃতির সাথে তাঁর ভাব অনড়। হালিম আজাদ একটি কবিতার চরণ এভাবে নির্মাণ করেছের- ‘কোন কোন পথ আছে শুধুই আমার।/ কোন কোন নদী আমার সঙ্গেই হেঁটে যায়-/ বেতবন কেটে কেটে।’
রাষ্ট্র যখন অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে অথবা দায়িত্বে থেকেও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়ে তখন অন্যায় অত্যাচার ঘুষ দুর্নীতি ও হত্যাযজ্ঞসহ নানা রকম অপকর্ম সংঘটিত হতে থাকে। সাধারণ নাগরিকের সমাজে অশান্তির সীমা থাকে না। কবি মনে করেন এমন পরিস্থিতি কোনো সভ্য দেশে সভ্য সমাজে থাকা উচিৎ নয়। থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের ভাল অভিভাবক চাই। রাষ্ট্রেুর অভিভাবক মানে নাগরিকের অভিভাবক। যোগ্য এবং টেকসই অভিভাবক ছাড়া উন্নয়ন ও জাতি গঠন সম্ভব নয়। কবি প্রতীকী অভিভাবক হিসেবে বটগাছকে বেছে নিয়েছেন। কবি মনে করেন প্রকৃতির এই বট গাছেরে মত শিকরবাকর ছড়িয়ে দেয়া অসীম শক্তিশালী একজন অভিভাবক দেশের জন্য জরুরি। বটগাছ ছায়া দেয়। ছায়া থেকে শান্তির ছোঁয়া পায় মানুষ। ঠিক তেমনি শান্তির বার্তা দেবে অভিভাবক এমনটাই প্রত্যাশা কবি হালিম আজাদের। বটগাছ তুমি আমাদের উপদেষ্টা হও কবিতায় এভাবে বর্ণনা দিয়েছেন তিনি- ‘বটগাছ সন্ত্রাস বোঝে না মানুষ হত্যা জানে না,/ মানুষ মানুষকে যখন পেট্রল মেরে পুড়িয়ে ছাই করে,/ বটগাছ এইসব দেখে হাসে। আবার কখনো নীরবে নীরবে ক্রন্দন করে।’
কবি আবার লিখেছেন- “এখন পৃথিবীতে কোন যোগ্য উপদেষ্ঠা নেই।/এখন পৃথিবীতে অবক্ষয় থামানোর জন্য কেউ নেই।/ বটগাছ তুমি আমাদের উপদেষ্ঠা হও!”
দুই বাংলার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান আশির দশকে তরুণ কবি হালিম আজাদের কবিতা পড়ে মন্তব্য করেছিলে ‘ইদানীং আমাদের কাব্য ক্ষেত্রে অনেক শক্তিধর তরুণের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, হালিম আজাদ এই তরুণদেরই একজন। তাঁর লেখায় দেশপ্রেম অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে।’
নির্দ্বিধায় বলা যায় হালিম আজাদ একজন দেশপ্রেমিক। প্রকৃত কবিরা দেশ প্রেমিক না হয়ে পারে না। হালিম আজাদের কবিতায় জাতির অধিকার অদায়ের সংগ্রাম, সুজলা সুফলা সবুজ প্রকৃতি, জাতরি পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বৃটিশ থেকে শুরু করে পাকি শোষক ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শাণিত উচ্চারণ পাঠকের মনে রাখার মতো। তাঁর কবিতায় রয়েছে সহজ সরল স্বাভাবিক চিত্রকল্প ও অন্তর্নিহিত ছন্দ- যা পাঠককে মুগ্ধ করে।
সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১
কবি হালিম আজাদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মাতৃভূমি স্বাধীন করার লক্ষ্যে, বাঙালির মুক্তির প্রত্যাশায় বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে মাঠে ময়দানে, গ্রাম-গঞ্জে সক্রিয় ছিলেন তিনি। গ্রামের কৃষক, মজুর তাঁর খুব আপন। তাঁর লেখা কবিতায় কৃষক মজুর জেলে মাঝিদের কথা ফুটে উঠেছে। বাদ পড়েনি ইট পাথরের শহরের খেটে খাওয়া শ্রমিকের কথাও। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সুখ দুঃখ বেদনার সাথে ছোটবেলা থেকেই কবির পরিচয় ঘটে। আর সে কারণেই বোধহয় কবি হালিম আজাদ নিজেকে তাদেরই একজন মনে করেন। তাঁর লেখা কবিতায় শোষিত শ্রেণির আহার যোগানোর কষ্টের কথা, আবার অনাহারে দিন যাপনের করুণ আকুতি ফুঁটে উঠতে দেখা যায়। এসব বিষয় গতানুগতিক হলেও কাব্য শিল্পে রূপদেয়ার যে কৌশল তা কবির মেধারই প্রতিফলন।
কবি লিখেছেন- “ভাত, আহা কী অদ্ভুত জাতের জিনিস- তোর জন্যই তহুরা বিবি গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেল,/তবুও কি তোর পাষাণ মুখ দেখবে না সরল মানুষ! জীবন আহা কী দুষ্প্রাপ্য-অবৈধ দোতরার গান! (কবিতা: ভাত ও তহুরার কথা)।
হা ভাতের সংসারে কবির তীক্ষ্ণ নজর পড়েছে। শিল্পের বিকাশ ঘটায় এখন কিছুটা কমে আসলেও একসময় এই সমাজে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যাই বেশি ছিল। অভাবি মানুষের জীবন সংগ্রাম কারো দৃষ্টি এড়াতে পারত না। কবি হালিম আজাদও অভাবি মানুষের ছায়া থেকে দৃষ্টি সরাতে পারেনি। তাঁর লেখায় সুনিপুণভাবে উঠে এসেছে “ভাত ও তহুরার কথা” কবিতায়। সমাজের মানুষের দুঃখ কষ্ট যেন কবির আষ্টেপৃষ্টে লেগে গিয়েছিল। ভুখা-নাঙ্গা মানুষের কষ্টে কবির হৃদয়ে পীড়ন জেগে উঠত।
আবার কবি হালিম আজাদ একসময় হতাশায়ও ভুগেছেন। দুঃখযন্ত্রণা অনাহার অর্ধাহার থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুকে আহ্বান করেছেন। তিনি মনে করেছেন মৃত্যুর পরে আর কোন দুঃখ থাকবে না। যন্ত্রণা পোহাতে হবে না। চাহিদা থাকবে না আহারের। তাই তিনি “সমুদ্রদহন থেকে” কবিতায়-একটি চরণ এইভাবে তুলে ধরেন- ‘আমি শুধু তোমার অন্তর থেকে একটি যোগ্য ব্যাধি চাই,/ বারবার দুঃখ পাবার চেয়ে,/মৃত্যুর ঠিকানা- এরকম বাঁচার সাহস চাই!’
হতাশার কথা বলতে গেলে “একদিন অন্ধকার” কবিতার দুটি লাই তুলে ধরা যেতে পারে- ‘একদিন অন্ধকার বিষাক্ত পিঁপড়ে হবে, খুব করে কেটে / নেবে সাজানো সভ্যতা, কেড়ে নেবে পৃথিবীর সব সুন্দর।’
শুধুযে হতাশা তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে তা কিন্তু নয়। কবি অনেক ক্ষেত্রে আশাবাদীও হয়ে ওঠেন। বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুন্দরের পূজারী ছিলেন। সুন্দরের প্রতি তাঁর যে মোহ তা রবীন্দ্রনাথের কবিতা গল্প ও গানে অসংখ্যবার উঠে এসেছে। আর প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামও কম যায়নি কোন অংশে। সুন্দরের প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের দুর্বলতা খুব খোলামেলা ভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। তাদের মতো না হলেও হালিম আজাদ সুন্দরকে প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁর নিজের মতো করে। তিনি সুন্দর সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেন। এ কারণে তিনি আহ্বান করেছেন ‘সাত খণ্ডের গল্প’ শিরোনামের কবিতায়- ‘বুক পেতে দাও। যা কিছু পাও। এই যে নাও-/ভাসাও সুন্দরের দিকে। দূর করো যত নষ্ট ফিকে।’
হালিম আজাদ প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার কবি। রাষ্ট্র বা সমাজে সমাজতন্ত্র না হোক অন্তত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাক এই প্রত্যাশা করেন কবি হালিম আজাদ। আর সে কারণেই হয়তো তার কলমে নেমে এসেছে ‘নেতারা সবাই জেলে। রাজপথ ফাঁকা।/ তারা যে-মাঠের ঘাসেতে বসতেন,/ যে রেস্তোরায় বসে চলত সারাক্ষণ গাঁ-গেরামের গল্পমালা,/ সবই যেন কাঁদছে। পথের ধুলারও মন ভাল নেই।’ (সাত খণ্ডের গল্প)। রাজনৈতিক নেতারা কারাবন্দি হয়ে পড়ায় আন্দোলন সংগ্রাম স্থবির হয়ে গেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য সকলেই আন্দোলন করার অধিকার রাখে। তবে আন্দোলনে নেতৃত্ব খুবই জরুরি। নেতারা জেলে বন্দি হলে নেতৃত্ব দেবার কেউ থাকে না। এসব কারণে কবির হয়তো মন খারাপ। আর তাই কবিতার ভাষায় হালিম আজাদ প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
তিনি মানবতার মুক্তির প্রত্যাশা করেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু মানবিক সরকারের দেখা মেলে না। স্বৈরাচার আর শোষক হয়েই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে থাকে। যারা যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে তখন তাদেরই ভাগ্য পরিবর্তন হয়। ভাগ্যের উন্নতি ঘটে। কিন্তু যারা সাধারণ নাগরিক তাদের কোন প্রকার ভাগ্যের উন্নয়ন ফিরে আসে না। এবিষয়টি কবিকে বড় পীড়া দেয়। আর সেই যন্ত্রণা থেকে কবি হালিম আজাদের কলমের স্ফুলিঙ্গ- ‘কতগুলো বাঁকা নুড়ির বিলাপ শুনতে শুনতে আজকাল সময় কেটে যায়/ বড় চেষ্টা করেও এসব তাড়াতে পারি না। বঙ্গভবনের দরোজা থেকে/পারি না তাড়াতে কুৎসিত ছায়া। বারবার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি/ নির্লজ্জ অমাবস্যা থেকে মুক্তি চাই। মানবতার মুক্তি চাই।’ (এইখানে এখন)।
শুধু কবিতায়ই নয়। কবি হালিম আজাদ ব্যাক্তি জীবনেও মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তিনি অপরাজনীতি এবং ভিলেজ পলিটিক্স থেকেও মুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। ঘৃণা করেন অনর্থক মানুষের ক্ষতি করা, বদনাম রটানো এবং মানুষকে ছোট করে দেখা। সবসময় তিনি মানুষের সাথে মানবিক আচরণ করার চেষ্টা করে থাকেন। মানব সেবা তাঁর ব্রত।
তিনি একজন প্রকৃতি প্রেমিক। প্রকৃতির সাথে তাঁর ভাব অনড়। হালিম আজাদ একটি কবিতার চরণ এভাবে নির্মাণ করেছের- ‘কোন কোন পথ আছে শুধুই আমার।/ কোন কোন নদী আমার সঙ্গেই হেঁটে যায়-/ বেতবন কেটে কেটে।’
রাষ্ট্র যখন অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে অথবা দায়িত্বে থেকেও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়ে তখন অন্যায় অত্যাচার ঘুষ দুর্নীতি ও হত্যাযজ্ঞসহ নানা রকম অপকর্ম সংঘটিত হতে থাকে। সাধারণ নাগরিকের সমাজে অশান্তির সীমা থাকে না। কবি মনে করেন এমন পরিস্থিতি কোনো সভ্য দেশে সভ্য সমাজে থাকা উচিৎ নয়। থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের ভাল অভিভাবক চাই। রাষ্ট্রেুর অভিভাবক মানে নাগরিকের অভিভাবক। যোগ্য এবং টেকসই অভিভাবক ছাড়া উন্নয়ন ও জাতি গঠন সম্ভব নয়। কবি প্রতীকী অভিভাবক হিসেবে বটগাছকে বেছে নিয়েছেন। কবি মনে করেন প্রকৃতির এই বট গাছেরে মত শিকরবাকর ছড়িয়ে দেয়া অসীম শক্তিশালী একজন অভিভাবক দেশের জন্য জরুরি। বটগাছ ছায়া দেয়। ছায়া থেকে শান্তির ছোঁয়া পায় মানুষ। ঠিক তেমনি শান্তির বার্তা দেবে অভিভাবক এমনটাই প্রত্যাশা কবি হালিম আজাদের। বটগাছ তুমি আমাদের উপদেষ্টা হও কবিতায় এভাবে বর্ণনা দিয়েছেন তিনি- ‘বটগাছ সন্ত্রাস বোঝে না মানুষ হত্যা জানে না,/ মানুষ মানুষকে যখন পেট্রল মেরে পুড়িয়ে ছাই করে,/ বটগাছ এইসব দেখে হাসে। আবার কখনো নীরবে নীরবে ক্রন্দন করে।’
কবি আবার লিখেছেন- “এখন পৃথিবীতে কোন যোগ্য উপদেষ্ঠা নেই।/এখন পৃথিবীতে অবক্ষয় থামানোর জন্য কেউ নেই।/ বটগাছ তুমি আমাদের উপদেষ্ঠা হও!”
দুই বাংলার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান আশির দশকে তরুণ কবি হালিম আজাদের কবিতা পড়ে মন্তব্য করেছিলে ‘ইদানীং আমাদের কাব্য ক্ষেত্রে অনেক শক্তিধর তরুণের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, হালিম আজাদ এই তরুণদেরই একজন। তাঁর লেখায় দেশপ্রেম অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে।’
নির্দ্বিধায় বলা যায় হালিম আজাদ একজন দেশপ্রেমিক। প্রকৃত কবিরা দেশ প্রেমিক না হয়ে পারে না। হালিম আজাদের কবিতায় জাতির অধিকার অদায়ের সংগ্রাম, সুজলা সুফলা সবুজ প্রকৃতি, জাতরি পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বৃটিশ থেকে শুরু করে পাকি শোষক ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শাণিত উচ্চারণ পাঠকের মনে রাখার মতো। তাঁর কবিতায় রয়েছে সহজ সরল স্বাভাবিক চিত্রকল্প ও অন্তর্নিহিত ছন্দ- যা পাঠককে মুগ্ধ করে।