দীর্ঘদিন ধরে খনন না করার কারণে বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর আঞ্চলের প্রায় ২৬টি বড় নদী আজ মৃতপ্রায়। ১৯৮৫ সালের পরে এ অঞ্চলে নৌপথের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ তৃষ্ণার ব্যারেজ নির্মাণ। এ ছাড়া অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের নির্মাণ ও স্লুইচ গেটের কারণে পঞ্চগড়-দিনাজপুর-নওগাঁ-নাটোর-পাবনার ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌরুট আজ হারিয়ে গেছে।
১৯৮০ সালেও এই নৌপথ ব্যবহার ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করত। দীর্ঘ ৩৬ বছর পর উত্তরাঞ্চলের নৌপথ খনন করছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। প্রাথমিকভাবে চারটি নদী খননে প্রায় ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পুরাতন বহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই এবং পুনর্ভবা নদীর নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া বাকি ২২টি নদীর ওপর সমীক্ষার পরিচালনা করা হচ্ছে বলে সংস্থাটির সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক সংবাদকে বলেন, ‘বৃহত্তর রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের নৌপথ চালু জন্য একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দিনাজপুরের চারটি নদী খননকাজ চলছে। এর মধ্যে তুলাই ও আত্রাই নদী খননকাজ চলমান আছে। এ ছাড়া পুনর্ভবা খননকাজ শীঘ্রই শুরু হবে। করোতোয়া নদী খনন করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সমীক্ষা শেষে বাকি নদীগুলো খনন করা হবে।’ নদীগুলো খননের ফলে নদী নাব্য ফিরে আনা, কৃষিকাজে সেচ প্রকল্পের সহায়তা ও পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যার পানি ধারণের সক্ষমতা বাড়বে বলে জানান তিনি।
৩৬ বছর পর সচল হলো তুলাই নৌপথ : দিনাজপুর জেলার তুলাই নদী দীর্ঘদিন ধরে মৃত্যু ছিল। জেলার বোঁচাগঞ্জ উপজেলার ঈশানিয়া হতে বিরল উপজেলার ভান্ডারা পর্যন্ত ৬৮ কিলোমিটার নৌপথ খননে প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এই নৌপথ উদ্ধারে ‘পুরাতন বহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই এবং পুনর্ভবা নদীর নাব্য উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। প্রায় ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে ২০২০ সালের নভেম্বরে। ২০২২ সালের নভেম্বরে নদী খনন কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
নৌপথটি উদ্ধার প্রায় ২৬ লাখ ঘনমিটার মাটি খনন করা হবে। এ পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৫৮ লাখ ঘনমিটার খনন করা হয়েছে। তুলাই নদী খননের ফলে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩৬ বছর পর বোঁচাগঞ্জ এলাকায় তুলাই নদীতে ট্রলার চলাচল করেছে বলে স্থানীয়রা জানান।
১৯৮০ সালে নদী পথে পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করত। ১৯৮৫ সালের পরে এ অঞ্চলে নৌপথের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ তৃষ্ণার ব্যারেজ নির্মাণ। এ ছাড়া অবৈধ বালু উত্তোলন, বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের নির্মাণ ও স্লুইচ গেইটের কারণে পঞ্চগড়-দিনাজপুর-নওগাঁ-নাটোর-পাবনার ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌরুট আজ হারিয়ে গেছে। এই নৌপথ খননের ফলে কৃষি জমিতে সেচ কাজের সুবিধা ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। নদীর দুই পাড়ে বৃক্ষ রোপণের ফলে পরিবেশগত ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা ও উত্তরাঞ্চলের উজানের ঢলে আকস্মিক বন্যা থেকে রক্ষা পাবে বলে স্থানীয়রা জানান।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছাইদুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ নদী দীর্ঘ খনন না করার কারণে পানির লেভেল নিচে নেমে গেছে। এর ফলে গভীর নলকূলে পানি পাওয়া যায় না। নদীতে পানি ধরে রাখতে পারে না। যখন উজানের পাহাড়ি ঢল আসে, তখন তা স্থলভাগে প্রবেশ করে বন্যার সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে নদী ভাঙন হয়।’ তাই উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করে খননের সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
২৬টি নদী আজ মৃত্যু
রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো দীর্ঘদিন ড্রেজিং (খনন) না হওয়ায় শুস্ক মৌসুমে নদীতে পানি থাকে না। কৃষকেরা গভীর নলকূপ ব্যবহার করে কৃষিকাজে পানি সেচ দিয়ে থাকে। ফলে এই অঞ্চলের মাটিতে পানির লেভেল নিচে নেমে যাচ্ছে। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে উজারের পানির ঢলে আকস্মিক বন্যার তলিয়ে যায় নিম্নাঞ্চল।
এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে। তাই নদীগুলো দ্রুত ড্রেজিং করে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীতে সারা বছর পানি থাকবে, কৃষকরা নদীর পানি সেচকাজে ব্যবহার করতে পারবে, নদীতে সারা বছর পানি থাকলে মাছের প্রজনন বৃদ্ধি পাবে, নৌপথে লোকজনের যাতায়াত করতে পারবে বলে স্থানীয়রা জানান।
এর মধ্যে দিনাজপুরের আত্রাই, কাঁকড়া, ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবা নদীর নাব্যতা হারিয়ে গেছে। অনেক স্থানে চর পড়ে গেছে। এ ছাড়া দিনাজপুর জেলার ছোট যমুনা, খড়খড়িয়া, টেপা, যমুনেশ^রী, গর্ভেশ^রী, রাক্ষুসী ও হলুদিয়া একই অবস্থা। এই নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে একেবারেই মৃতপ্রায়। বর্ষা মৌসুমে উজানের পাহাড়ি ঢলে বন্যার সৃষ্টি হয়।
পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার নদীগুলো ভরাট হয়েছে। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও জেলার পুনর্ভবা, পাথরাজ, তীরনাই ও ভুল্লী নদী মরে গেছে। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের করোতোয়া, ডাহুক, বেরং, মহানন্দা ও তিরনাই নদীগুলো দীর্ঘদিন খনন না করার কারণে পলি জমে তলদেশ এবং ভূমি প্রায় একই সমতল হয়েছে বলে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো খননের বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে নৌ-মন্ত্রণালয়।
তিস্তা ব্যারেজের কারণে শুকিয়ে গেছে নৌপথ
তিস্তা ব্যারেজের কারণে শুকিয়ে গেছে উত্তরাঞ্চলের নৌপথ। এর মধ্যে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, করতোয়া, ফুলঝোরসহ এর শাখা প্রশাখা নদী। একটি বড় নদীর অনেক শাখা নদী রয়েছে। মূল নদ-নদীর পানি প্রবাহ না থাকায় শাখা নদীতেও পানি শুকিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, তিস্তা নদী উজানে গোজালডোবা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তিস্তা নদী সিকিম হিমালয়ের ৭ হাজার ২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা নদীও পদ্মা নদীর মত আন্তর্জাতিক নদী।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, তিস্তা নদীটি বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবাহিত ছিল। ১৭৮৭ সালের অতিবৃষ্টিজনিত কারণে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। সেই সময় নদীটি গতিপথ পরিবর্তন করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়। তিস্তা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩০৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ ভূখন্ডে অবস্থিত। তিস্তা একসময় করতোয়া নদীর মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এর অংশবিশেষ এখনও বুড়ি তিস্তা নদী নামে পরিচিত।
গজলডোবা (তিস্তা) ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ২২১ দশমিক ৫৩ মিটার। এর ৪৪ গেটবিশিষ্ট গজলডোবা বাঁধের রয়েছে তিনটি পর্যায়। প্রথম পর্যায় সেচ প্রকল্প, দ্বিতীয় পর্যায় পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং তৃতীয় পর্যায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খাল খনন করে নৌ-পথ তৈরি। তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে লালমনিরহাট জেলার ডালিয়া পয়েন্টে। এই নদী বাংলাদেশের ১২টি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে এসে মিলেছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং এই ১২টি জেলার অর্থনীতি প্রত্যক্ষভাবে তিস্তা নদীর ওপর নির্ভরশীল। তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের মোট চাষযোগ্য জমির শতকরা ১৪ ভাগ তিস্তা নদীর সেচ প্রকল্পের ওপর নির্ভর করে। ১৯৮৫ সালে পশ্চিম বঙ্গের গজল ডোবায় বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করার আগে তিস্তার পানি প্রবাহ ছিল প্রায় ৫ হাজার কিউসেক। নদী ও পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘তিস্তার মূল প্রবাহ ভারত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তিস্তায় ডালিয়া ব্যারেজে উজান থেকে আসা পানি প্রবাহ প্রায় শূন্য। এখন যে ৬-৭শ’ কিউসেক পানি আসছে, তা ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের ভাটির উপনদী থেকে।
শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
দীর্ঘদিন ধরে খনন না করার কারণে বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর আঞ্চলের প্রায় ২৬টি বড় নদী আজ মৃতপ্রায়। ১৯৮৫ সালের পরে এ অঞ্চলে নৌপথের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ তৃষ্ণার ব্যারেজ নির্মাণ। এ ছাড়া অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের নির্মাণ ও স্লুইচ গেটের কারণে পঞ্চগড়-দিনাজপুর-নওগাঁ-নাটোর-পাবনার ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌরুট আজ হারিয়ে গেছে।
১৯৮০ সালেও এই নৌপথ ব্যবহার ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করত। দীর্ঘ ৩৬ বছর পর উত্তরাঞ্চলের নৌপথ খনন করছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। প্রাথমিকভাবে চারটি নদী খননে প্রায় ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পুরাতন বহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই এবং পুনর্ভবা নদীর নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া বাকি ২২টি নদীর ওপর সমীক্ষার পরিচালনা করা হচ্ছে বলে সংস্থাটির সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক সংবাদকে বলেন, ‘বৃহত্তর রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের নৌপথ চালু জন্য একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দিনাজপুরের চারটি নদী খননকাজ চলছে। এর মধ্যে তুলাই ও আত্রাই নদী খননকাজ চলমান আছে। এ ছাড়া পুনর্ভবা খননকাজ শীঘ্রই শুরু হবে। করোতোয়া নদী খনন করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সমীক্ষা শেষে বাকি নদীগুলো খনন করা হবে।’ নদীগুলো খননের ফলে নদী নাব্য ফিরে আনা, কৃষিকাজে সেচ প্রকল্পের সহায়তা ও পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যার পানি ধারণের সক্ষমতা বাড়বে বলে জানান তিনি।
৩৬ বছর পর সচল হলো তুলাই নৌপথ : দিনাজপুর জেলার তুলাই নদী দীর্ঘদিন ধরে মৃত্যু ছিল। জেলার বোঁচাগঞ্জ উপজেলার ঈশানিয়া হতে বিরল উপজেলার ভান্ডারা পর্যন্ত ৬৮ কিলোমিটার নৌপথ খননে প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এই নৌপথ উদ্ধারে ‘পুরাতন বহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই এবং পুনর্ভবা নদীর নাব্য উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। প্রায় ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে ২০২০ সালের নভেম্বরে। ২০২২ সালের নভেম্বরে নদী খনন কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
নৌপথটি উদ্ধার প্রায় ২৬ লাখ ঘনমিটার মাটি খনন করা হবে। এ পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৫৮ লাখ ঘনমিটার খনন করা হয়েছে। তুলাই নদী খননের ফলে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩৬ বছর পর বোঁচাগঞ্জ এলাকায় তুলাই নদীতে ট্রলার চলাচল করেছে বলে স্থানীয়রা জানান।
১৯৮০ সালে নদী পথে পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করত। ১৯৮৫ সালের পরে এ অঞ্চলে নৌপথের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ তৃষ্ণার ব্যারেজ নির্মাণ। এ ছাড়া অবৈধ বালু উত্তোলন, বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের নির্মাণ ও স্লুইচ গেইটের কারণে পঞ্চগড়-দিনাজপুর-নওগাঁ-নাটোর-পাবনার ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌরুট আজ হারিয়ে গেছে। এই নৌপথ খননের ফলে কৃষি জমিতে সেচ কাজের সুবিধা ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। নদীর দুই পাড়ে বৃক্ষ রোপণের ফলে পরিবেশগত ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা ও উত্তরাঞ্চলের উজানের ঢলে আকস্মিক বন্যা থেকে রক্ষা পাবে বলে স্থানীয়রা জানান।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছাইদুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ নদী দীর্ঘ খনন না করার কারণে পানির লেভেল নিচে নেমে গেছে। এর ফলে গভীর নলকূলে পানি পাওয়া যায় না। নদীতে পানি ধরে রাখতে পারে না। যখন উজানের পাহাড়ি ঢল আসে, তখন তা স্থলভাগে প্রবেশ করে বন্যার সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে নদী ভাঙন হয়।’ তাই উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করে খননের সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
২৬টি নদী আজ মৃত্যু
রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো দীর্ঘদিন ড্রেজিং (খনন) না হওয়ায় শুস্ক মৌসুমে নদীতে পানি থাকে না। কৃষকেরা গভীর নলকূপ ব্যবহার করে কৃষিকাজে পানি সেচ দিয়ে থাকে। ফলে এই অঞ্চলের মাটিতে পানির লেভেল নিচে নেমে যাচ্ছে। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে উজারের পানির ঢলে আকস্মিক বন্যার তলিয়ে যায় নিম্নাঞ্চল।
এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে। তাই নদীগুলো দ্রুত ড্রেজিং করে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীতে সারা বছর পানি থাকবে, কৃষকরা নদীর পানি সেচকাজে ব্যবহার করতে পারবে, নদীতে সারা বছর পানি থাকলে মাছের প্রজনন বৃদ্ধি পাবে, নৌপথে লোকজনের যাতায়াত করতে পারবে বলে স্থানীয়রা জানান।
এর মধ্যে দিনাজপুরের আত্রাই, কাঁকড়া, ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবা নদীর নাব্যতা হারিয়ে গেছে। অনেক স্থানে চর পড়ে গেছে। এ ছাড়া দিনাজপুর জেলার ছোট যমুনা, খড়খড়িয়া, টেপা, যমুনেশ^রী, গর্ভেশ^রী, রাক্ষুসী ও হলুদিয়া একই অবস্থা। এই নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে একেবারেই মৃতপ্রায়। বর্ষা মৌসুমে উজানের পাহাড়ি ঢলে বন্যার সৃষ্টি হয়।
পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার নদীগুলো ভরাট হয়েছে। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও জেলার পুনর্ভবা, পাথরাজ, তীরনাই ও ভুল্লী নদী মরে গেছে। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের করোতোয়া, ডাহুক, বেরং, মহানন্দা ও তিরনাই নদীগুলো দীর্ঘদিন খনন না করার কারণে পলি জমে তলদেশ এবং ভূমি প্রায় একই সমতল হয়েছে বলে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো খননের বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে নৌ-মন্ত্রণালয়।
তিস্তা ব্যারেজের কারণে শুকিয়ে গেছে নৌপথ
তিস্তা ব্যারেজের কারণে শুকিয়ে গেছে উত্তরাঞ্চলের নৌপথ। এর মধ্যে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, করতোয়া, ফুলঝোরসহ এর শাখা প্রশাখা নদী। একটি বড় নদীর অনেক শাখা নদী রয়েছে। মূল নদ-নদীর পানি প্রবাহ না থাকায় শাখা নদীতেও পানি শুকিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, তিস্তা নদী উজানে গোজালডোবা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তিস্তা নদী সিকিম হিমালয়ের ৭ হাজার ২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা নদীও পদ্মা নদীর মত আন্তর্জাতিক নদী।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, তিস্তা নদীটি বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবাহিত ছিল। ১৭৮৭ সালের অতিবৃষ্টিজনিত কারণে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। সেই সময় নদীটি গতিপথ পরিবর্তন করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়। তিস্তা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩০৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ ভূখন্ডে অবস্থিত। তিস্তা একসময় করতোয়া নদীর মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এর অংশবিশেষ এখনও বুড়ি তিস্তা নদী নামে পরিচিত।
গজলডোবা (তিস্তা) ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ২২১ দশমিক ৫৩ মিটার। এর ৪৪ গেটবিশিষ্ট গজলডোবা বাঁধের রয়েছে তিনটি পর্যায়। প্রথম পর্যায় সেচ প্রকল্প, দ্বিতীয় পর্যায় পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং তৃতীয় পর্যায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খাল খনন করে নৌ-পথ তৈরি। তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে লালমনিরহাট জেলার ডালিয়া পয়েন্টে। এই নদী বাংলাদেশের ১২টি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে এসে মিলেছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং এই ১২টি জেলার অর্থনীতি প্রত্যক্ষভাবে তিস্তা নদীর ওপর নির্ভরশীল। তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের মোট চাষযোগ্য জমির শতকরা ১৪ ভাগ তিস্তা নদীর সেচ প্রকল্পের ওপর নির্ভর করে। ১৯৮৫ সালে পশ্চিম বঙ্গের গজল ডোবায় বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করার আগে তিস্তার পানি প্রবাহ ছিল প্রায় ৫ হাজার কিউসেক। নদী ও পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘তিস্তার মূল প্রবাহ ভারত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তিস্তায় ডালিয়া ব্যারেজে উজান থেকে আসা পানি প্রবাহ প্রায় শূন্য। এখন যে ৬-৭শ’ কিউসেক পানি আসছে, তা ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের ভাটির উপনদী থেকে।