alt

অর্থ-বাণিজ্য

ট্রাম্পের কর: বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার আশঙ্কা বাংলাদেশের

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক : বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

সিরাজগঞ্জ : শীতল পাটি বুননে ব্যস্ত নারী -সংবাদ

দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। বলা যায়, সঙ্কটের এই সময়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে রেমিটেন্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ২ হাজার ৪৫৩ কোটি ৬৩ লাখ (২৪.৫৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি।

আর রেমিটেন্সের এই উল্লম্ফনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী প্রবাসীরা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশটি থেকে জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৪২৭ কোটি ৬৮ লাখ (৪.২৮ বিলিয়ন) ডলার এসেছে, যা মোট রেমিটেন্সের ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৫২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, দশ মাসের এই রেমিটেন্সের ওপর ট্রাম্পের ৫ শতাংশ কর আরোপিত হলে করের পরিমাণ দাঁড়াত প্রায় ২২ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

জুলাই-এপ্রিল সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে রেমিটেন্স এসেছে, তা গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। শতাংশ হিসাবে বেড়েছে ৮৮ দশমিক শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছেও নেই সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা অন্য কোনো দেশে। কিন্তু এই সুসময়ের মধ্যেই এসেছে আরেক ধাক্কা। আর সেই সেই ধাক্কা দিয়েছেন যথারীতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

বাণিজ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপের পর এবার ট্রাম্প অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়ের ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন। ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ নামে হাউস বাজেট কমিটিতে অনুমোদিত আইনের আওতায় এই কর আরোপ করা হবে।

এই আইনে মার্কিন নাগরিক ছাড়া সব অভিবাসীর প্রেরিত অর্থে করারোপ করা হবে। গ্রিন কার্ডধারী ও এইচ-১বি ভিসাপ্রাপ্তরাও এর আওতায় পড়বেন। কর আরোপের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সীমা নির্ধারণ করা হয়নি, অর্থাৎ ছোট অঙ্কের অর্থ পাঠালেও কর প্রযোজ্য হবে। ফলে বাংলাদেশিদের প্রেরিত প্রবাসী আয়েও এই কর প্রযোজ্য হবে। ১ হাজার ১১৬ পৃষ্ঠার এই বিল গত রোববার রাতে হাউস অব রেপ্রেজেনটেটিভে ১৭-১৬ ভোটে পাস হয়েছে। এরপর তা সিনেটে উত্থাপিত হবে।

বিলটি আইনে পরিণত হলে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র। প্রবাসী আয় প্রেরণের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কর দিতে হলে ব্যাংকিং মাধ্যমে প্রবাসী পাঠানো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসী আয় প্রেরণ বেড়ে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনা আছে। একইভাবে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণে প্রবাসী আয় পায়। ফলে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

গত বছর হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় আসা বেড়ে যায়। জানা যায়, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে একধরনের বড় পরিবর্তন হয়েছে। এখন প্রবাসী আয় প্রেরণকারী বৈশ্বিক বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশ থেকে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রবাসী আয় কিনে নেয়। পরে সেসব আয় একত্র করে নির্দিষ্ট একটি দেশ থেকে তা গন্তব্য দেশে পাঠায়। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রামসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রিগেটেড (সমন্বিত) পদ্ধতিতে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করে প্রেরণ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের অন্যতম প্রধান উৎস। গত এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ৩৩ কোটি ৭ লাখ ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ৪২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৫২ হাজার ২৬ কোটি টাকা(১ ডলার সমান ১২২ টাকা)। এরপর ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপিত হলে করের পরিমাণ দাঁড়াত প্রায় ২১ দশমিক ৮৫ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৬৬৫ দশমিক ৭ কোটি টাকা।

‘রেমিটেন্স মানেই সৌদি থেকে আসে’ সবার মুখে মুখে ছিল এতদিন। কিন্তু গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ঘটে ব্যতিক্রম; ওই অর্থ বছরে সৌদিকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সেটাও উল্টে গেছে। এখন সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এতদিন প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকা সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছেও নেই।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে ভারতে। সে বছর তারা পেয়েছে ১২৯ বিলিয়ন বা ১২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ষষ্ঠ। বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার।

প্রবাসী আয় হলো দেশে মার্কিন ডলার জোগানের একমাত্র দায়বিহীন উৎস। এই আয়ের বিপরীতে কোনো বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয় না বা কোনো দায় পরিশোধ করার দরকার পড়ে না। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ের বিপরীতে দেশে ডলার এলেও তার জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে আবার বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয়। আবার বিদেশি ঋণ পরিশোধেও ডলারের প্রয়োজন হয়। সার্বিকভাবে প্রবাসী আয় বাড়লে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের রিজার্ভ বা মজুত দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

এই বাস্তবতায় ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ৫ শতাংশ কর বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর দায়বিহীন ডলার পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে বলে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। যদি বিলটি আইনে পরিণত হয়, তাহলে ভারত এবং ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রচুর পরিমাণে রেমিটেন্স যায়, তারা তীব্রভাবে প্রভাবিত হবে। বর্তমান পেক্ষাপটে প্রবাসী আয় পাঠানোর আনুষ্ঠানিক চ্যানেল আরও আকর্ষণীয় করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক সেলিম রায়হান।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান তিনি বলেছেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো রেমিটেন্সে ৫ শতাংশ হারে করারোপ হলে বাংলাদেশের জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হবে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় গ্রহণকারী প্রধান দেশগুলোর একটি হওয়ায় এ প্রস্তাব কার্যকর হলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে যে রেমিটেন্স আসছে, তার প্রায় ২০ শতাংশই আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ পরিসংখ্যান থেকে মার্কিন প্রবাসী বাংলাদেশিদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা কতটা, তা পরিষ্কার হয়ে যায়। এ ধরনের করারোপ করা হলে সরাসরি প্রবাসী পরিবারের প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ কমে যাবে। তখন অনেকে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে অনানুষ্ঠানিক পন্থা অবলম্বনে বাধ্য হবেন। ফলে হুন্ডির মতো অনিয়ন্ত্রিত পন্থার ব্যবহার বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে আর্থিক প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। এ পরিস্থিতির কারণে প্রবাসী আয়ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে নেওয়া দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগগুলো দুর্বল হয়ে যাবে। এ ছাড়া এমন সময় দেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে, যখন বৈদেশিক খাত এখনো চাপের মুখে আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রস্তাবের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের উচিত হবে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করা। সেই সঙ্গে কর প্রস্তাবের পরিণতি এবং এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর লাখ লাখ পরিবারের ওপর যে প্রভাব পড়বে, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। প্রবাসী আয় পাঠানোর আনুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো আরও আকর্ষণীয় করে তোলার দিকেও নজর দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকিং সেবার সহজলভ্যতা বাড়ানো, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবহার আরও সহজ করা আর দ্রুত ও কম খরচে লেনদেনের সুযোগ তৈরি করা।’

এ ছাড়া প্রবাসী আয় প্রেরক ও দেশীয় গ্রহীতাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের উপকারিতা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে জনসচেতনতামূলক প্রচার চালানোর পরামর্শ দেন সেলিম রায়হান।

ছবি

চামড়ায় দেরিতে লবণ দেওয়ায় অনেকে কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি : শিল্প উপদেষ্টা

রংপুরে কোরবানীর পশুর চামড়া কেনা নিয়ে চরম নৈরাজ্য, লোকসানের আশংকা মৌসুমী ব্যাবসায়ীদের

ছবি

কোরবানীর পশুর চামড়া সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না

ছবি

সংকটে যশোরের চামড়া ব্যবসায়ীরা

ছবি

বিদেশ থেকে বছরে একবারই সোনা আনার সুযোগ, শুল্কও বাড়ল

ছবি

আইএমএফের ছকের বাজেট শিল্পের জন্য ‘হুমকি’: বিসিআই

ছবি

জুলাই থেকে নতুন হারে আয়কর: এনবিআর চেয়ারম্যান

শিক্ষা বাজেট: ‘গতানুগতিক’ ও ‘হতাশার’, বলছেন শিক্ষাবিদরা

ছবি

হঠাৎ করে অনেক সাহসী বাজেট দেয়া সম্ভব ছিল না: অর্থ উপদেষ্টা

ছবি

“ক্ষমতা নয়, দায়িত্ব নিয়েছি”—বাজেট নিয়ে অর্থ উপদেষ্টার মন্তব্য

ছবি

বিনিময় হারে স্বস্তিতে মূল্যস্ফীতি কমার আশা দেখছেন গভর্নর আহসান মনসুর

ছবি

বাজেটে আইসিটি খাতে ‘সুখবর’ দেখতে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা

ছবি

বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা বিদেশী উদ্যোক্তাদের

ছবি

ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে বাজেট ততটা আশাব্যঞ্জক নয়: ডিসিসিআই

ছবি

ওসমানী মিলনায়তনে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা ও সচিবরা

ক্রেডিট কার্ডসহ ১২ সেবায় রিটার্ন নয়, লাগবে শুধু টিআইএন সনদ

ছবি

আবাসনে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল, বাড়ছে করহার

ছবি

নতুন বেতন কাঠামো নয়, বাড়ছে ‘বিশেষ সুবিধা’

মূল্যস্ফীতি কমাতে বাজেটে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই: ঢাকা চেম্বার

ছবি

নোবেলসহ ১০টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের অর্থ করমুক্ত রাখার প্রস্তাব

ছবি

বাজেট: বৈষম্যহীনতার প্রতিশ্রুতি, পুরনো কৌশলেই ভরসা

কালো টাকাকে বৈধতা দেয়া অন্তর্বর্তী সরকারের স্ববিরোধিতা: টিআইবি

দাম কমতে পারে

দাম বাড়তে পারে

ছবি

যাত্রী পরিবহনে খরচ কমাতে এয়ারলাইন্সে ভ্যাট ছাড়

ছবি

নতুন শুল্কে গলা টিপে ধরার শঙ্কায় ওটিটি ইন্ডাস্ট্রি

ছবি

ত্রৈমাসিক রিটার্ন, দলিল যাচাইয়ে নতুন কর বিধান

মূল্যস্ফীতির হার ২৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন

ছবি

বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা

ছবি

২০২৫-২৬ বাজেটে কালোটাকা সাদা রাখার প্রস্তাব, কর হার বাড়ল এলাকাভেদে

ছবি

ব্লু ইকোনমি ও বিজ্ঞান গবেষণায় ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব

ছবি

বাড়লো না করমুক্ত আয়ের সীমা, কর ধাপ সাত থেকে ছয়ে, বাড়বে করের বোঝা

ছবি

বাজেটে বিনিয়োগকারীর জন্য সরাসরি প্রণোদনা নেই, শেয়ারবাজারে অনিশ্চয়তা

ছবি

ট্যারিফ ভ্যালুর বদলে ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক প্রস্তাব, বিপিসির শুল্ক হার কমানোর উদ্যোগ

ছবি

ছোট আমানতকারীদের স্বস্তি: আবগারি শুল্ক ছাড়ের সীমা বাড়ল

ছবি

মে মাসে রেমিটেন্স এসেছে ২৯৭ কোটি ডলার

tab

অর্থ-বাণিজ্য

ট্রাম্পের কর: বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার আশঙ্কা বাংলাদেশের

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

সিরাজগঞ্জ : শীতল পাটি বুননে ব্যস্ত নারী -সংবাদ

বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। বলা যায়, সঙ্কটের এই সময়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে রেমিটেন্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ২ হাজার ৪৫৩ কোটি ৬৩ লাখ (২৪.৫৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি।

আর রেমিটেন্সের এই উল্লম্ফনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী প্রবাসীরা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশটি থেকে জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৪২৭ কোটি ৬৮ লাখ (৪.২৮ বিলিয়ন) ডলার এসেছে, যা মোট রেমিটেন্সের ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৫২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, দশ মাসের এই রেমিটেন্সের ওপর ট্রাম্পের ৫ শতাংশ কর আরোপিত হলে করের পরিমাণ দাঁড়াত প্রায় ২২ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

জুলাই-এপ্রিল সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে রেমিটেন্স এসেছে, তা গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। শতাংশ হিসাবে বেড়েছে ৮৮ দশমিক শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছেও নেই সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা অন্য কোনো দেশে। কিন্তু এই সুসময়ের মধ্যেই এসেছে আরেক ধাক্কা। আর সেই সেই ধাক্কা দিয়েছেন যথারীতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

বাণিজ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপের পর এবার ট্রাম্প অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়ের ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন। ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ নামে হাউস বাজেট কমিটিতে অনুমোদিত আইনের আওতায় এই কর আরোপ করা হবে।

এই আইনে মার্কিন নাগরিক ছাড়া সব অভিবাসীর প্রেরিত অর্থে করারোপ করা হবে। গ্রিন কার্ডধারী ও এইচ-১বি ভিসাপ্রাপ্তরাও এর আওতায় পড়বেন। কর আরোপের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সীমা নির্ধারণ করা হয়নি, অর্থাৎ ছোট অঙ্কের অর্থ পাঠালেও কর প্রযোজ্য হবে। ফলে বাংলাদেশিদের প্রেরিত প্রবাসী আয়েও এই কর প্রযোজ্য হবে। ১ হাজার ১১৬ পৃষ্ঠার এই বিল গত রোববার রাতে হাউস অব রেপ্রেজেনটেটিভে ১৭-১৬ ভোটে পাস হয়েছে। এরপর তা সিনেটে উত্থাপিত হবে।

বিলটি আইনে পরিণত হলে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র। প্রবাসী আয় প্রেরণের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কর দিতে হলে ব্যাংকিং মাধ্যমে প্রবাসী পাঠানো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসী আয় প্রেরণ বেড়ে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনা আছে। একইভাবে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণে প্রবাসী আয় পায়। ফলে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

গত বছর হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় আসা বেড়ে যায়। জানা যায়, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে একধরনের বড় পরিবর্তন হয়েছে। এখন প্রবাসী আয় প্রেরণকারী বৈশ্বিক বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশ থেকে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রবাসী আয় কিনে নেয়। পরে সেসব আয় একত্র করে নির্দিষ্ট একটি দেশ থেকে তা গন্তব্য দেশে পাঠায়। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রামসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রিগেটেড (সমন্বিত) পদ্ধতিতে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করে প্রেরণ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের অন্যতম প্রধান উৎস। গত এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ৩৩ কোটি ৭ লাখ ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ৪২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৫২ হাজার ২৬ কোটি টাকা(১ ডলার সমান ১২২ টাকা)। এরপর ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপিত হলে করের পরিমাণ দাঁড়াত প্রায় ২১ দশমিক ৮৫ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৬৬৫ দশমিক ৭ কোটি টাকা।

‘রেমিটেন্স মানেই সৌদি থেকে আসে’ সবার মুখে মুখে ছিল এতদিন। কিন্তু গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ঘটে ব্যতিক্রম; ওই অর্থ বছরে সৌদিকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সেটাও উল্টে গেছে। এখন সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এতদিন প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকা সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছেও নেই।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে ভারতে। সে বছর তারা পেয়েছে ১২৯ বিলিয়ন বা ১২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ষষ্ঠ। বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার।

প্রবাসী আয় হলো দেশে মার্কিন ডলার জোগানের একমাত্র দায়বিহীন উৎস। এই আয়ের বিপরীতে কোনো বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয় না বা কোনো দায় পরিশোধ করার দরকার পড়ে না। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ের বিপরীতে দেশে ডলার এলেও তার জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে আবার বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয়। আবার বিদেশি ঋণ পরিশোধেও ডলারের প্রয়োজন হয়। সার্বিকভাবে প্রবাসী আয় বাড়লে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের রিজার্ভ বা মজুত দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

এই বাস্তবতায় ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ৫ শতাংশ কর বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর দায়বিহীন ডলার পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে বলে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। যদি বিলটি আইনে পরিণত হয়, তাহলে ভারত এবং ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রচুর পরিমাণে রেমিটেন্স যায়, তারা তীব্রভাবে প্রভাবিত হবে। বর্তমান পেক্ষাপটে প্রবাসী আয় পাঠানোর আনুষ্ঠানিক চ্যানেল আরও আকর্ষণীয় করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক সেলিম রায়হান।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান তিনি বলেছেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো রেমিটেন্সে ৫ শতাংশ হারে করারোপ হলে বাংলাদেশের জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হবে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় গ্রহণকারী প্রধান দেশগুলোর একটি হওয়ায় এ প্রস্তাব কার্যকর হলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে যে রেমিটেন্স আসছে, তার প্রায় ২০ শতাংশই আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ পরিসংখ্যান থেকে মার্কিন প্রবাসী বাংলাদেশিদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা কতটা, তা পরিষ্কার হয়ে যায়। এ ধরনের করারোপ করা হলে সরাসরি প্রবাসী পরিবারের প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ কমে যাবে। তখন অনেকে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে অনানুষ্ঠানিক পন্থা অবলম্বনে বাধ্য হবেন। ফলে হুন্ডির মতো অনিয়ন্ত্রিত পন্থার ব্যবহার বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে আর্থিক প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। এ পরিস্থিতির কারণে প্রবাসী আয়ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে নেওয়া দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগগুলো দুর্বল হয়ে যাবে। এ ছাড়া এমন সময় দেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে, যখন বৈদেশিক খাত এখনো চাপের মুখে আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রস্তাবের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের উচিত হবে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করা। সেই সঙ্গে কর প্রস্তাবের পরিণতি এবং এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর লাখ লাখ পরিবারের ওপর যে প্রভাব পড়বে, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। প্রবাসী আয় পাঠানোর আনুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো আরও আকর্ষণীয় করে তোলার দিকেও নজর দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকিং সেবার সহজলভ্যতা বাড়ানো, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবহার আরও সহজ করা আর দ্রুত ও কম খরচে লেনদেনের সুযোগ তৈরি করা।’

এ ছাড়া প্রবাসী আয় প্রেরক ও দেশীয় গ্রহীতাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের উপকারিতা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে জনসচেতনতামূলক প্রচার চালানোর পরামর্শ দেন সেলিম রায়হান।

back to top