নানান চ্যালেঞ্জ নিয়ে রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) খুলছে স্কুল। তবে মূল ‘চ্যালেঞ্জ’ হলো শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পার্থক্য কমানো। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষায় শহর ও গ্রামের মধ্যে এমনিতেই পার্থক্য ছিল। করোনা সংক্রমণের কারণে সে পার্থক্য আরও বেড়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) মনে করছেন, চলমান ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ বা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমে আসবে। যদিও অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া এবং নিজ নিজ বাসা থেকে খাতায় লিখে তা স্কুলে জমা দেয়ার এই প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীর পরিবর্তে মা-বাবা ও প্রাইভেট টিউটররা তা লিখে দিচ্ছেন বলে শিক্ষাবিদদের অভিযোগ।
গত ৫ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভা শেষে আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেন। ৭ সেপ্টেম্বর ওই সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সে অনুযায়ী ম্যানেজ (ব্যবস্থা) করতে হবে।’
ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন মাউশি মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক। তিনি শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) সংবাদকে বলেন, ‘ম্যানেজমেন্টের বিষয়টি আমি বুঝতে পারিনি। তবে আমরা যে অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছি, সেটি নিয়মিত বাস্তবায়ন হচ্ছে। এতে শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পার্থক্য কমে আসবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান সংবাদকে বলেন, ‘শিক্ষায় শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য আগে থেকেই ছিল। করোনা মহামারীতে তা আরও বেড়েছে। এ বৈষম্য কমাতে না পারলে উন্নত বিশে^র সঙ্গে তাল মেলাতে পিছিয়ে পড়বে আমাদের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশে যারা লেখাপড়া করতে যেতে চায়, তারা মেধার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়তে পারে।’
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকা ড. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘গ্রামাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনিতেই ইলেকট্রনিকস ডিভাইস, স্মার্টফোন, মোবাইল নেটওয়ার্কসহ প্রযুক্তিগত নানান অপ্রতুলতা রয়েছে। এ কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের মতো অনলাইনে সমান পাঠলাভের সুযোগ পেয়েছে, সেটি বলা যাবে না।’
পাঠলাভের এই বৈষম্য নিরসনের বিষয়ে মাউশির সাবেক মহাপরিচালক বলেন, ‘গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আপাতত ডবল শিফ্ট চালু ও অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা যায়, বিদ্যালয়ে ক্লাসের সময়সূচি বাড়ানো যায়। একই সঙ্গে সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের আরও বেশি মনোযোগী ও দায়িত্বশীল হতে হবে।’
করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ সময়ে বিকল্প ‘শিক্ষা কার্যক্রম’ হিসেবে টেলিভিশন ও রেডিওতে ক্লাস প্রচারণা, অনলাইনে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের ক্লাস প্রচার করে আসছে শিক্ষা প্রশাসন। সর্বশেষ উদ্যোগ হিসেবে, অনলাইনে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দিচ্ছে মাউশি, সেগুলো বাসায় লিখে স্কুলে জমা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এই অ্যাসাইনমেন্ট ‘মূল্যায়ন’ করে ছাত্রছাত্রীদের মেধা যাচাই করছেন শ্রেণী শিক্ষকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর দুটি সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সংবাদকে জানান, অ্যাসাইনমেন্টের ‘মূল্যায়ন’ যথাযথভাবেই করছেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরা যেহেতু বাসায় বসে বিষয় অনুযায়ী অ্যাসাইনমেন্ট লিখে খাতা জমা দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে নানানভাবে ‘হেল্প’ (সহায়তা) নেয়ার সুযোগ আছে। ঢাকার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ছে, তারা টিউটরের সহায়তায় অ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়ন করে থাকতে পারে। এখানকার বেশির ভাগই ছেলেমেয়েই ‘ইউটিউব’ বা ‘অনলাইন’ ব্যবহারে অভ্যস্ত, তারাও সেভাবে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ তৈরি করে থাকতে পারে। এরপরও এ প্রক্রিয়া ‘মন্দের ভালো’ বলে মনে করছেন শিক্ষকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও ‘শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির সংবাদকে বলেন, ‘অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ নৈতিকতা হারাচ্ছে। শিক্ষা প্রশাসন অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দায় সারছেন এবং শিক্ষার্থীরা বাসায় বসে গাইড বই দেখে তা পূরণ করছে। কারও কারও ক্ষেত্রে মা-বাবা অ্যাসাইনমেন্ট লিখে দিচ্ছেন। প্রাইভেট টিউটর ও শ্রেণী শিক্ষকরাও তা করে দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের এই নৈতিক ক্ষতির জন্য মা-বাবাও দায়ী।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রুটিন তৈরির ১০ নির্দেশনা
১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণী পাঠদান শুরু হবে। স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব মেনে শ্রেণী পাঠদান নিশ্চিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রুটিন তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
শুক্রবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ রুটিন তৈরির একটি নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিদিন নির্দিষ্ট শ্রেণীতে দুটি করে ক্লাস ধরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রুটিন তৈরি করবে হবে। ১. ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবে। ২. প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা একদিন প্রতিষ্ঠানে আসবে। ৩. সপ্তাহে প্রতিদিন নির্দিষ্ট শ্রেণীতে দুটি করে ক্লাস ধরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রুটিন তৈরি করবে। ৪. রুটিনের সঙ্গে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যবহারিক ক্লাস নির্ধারণ করা যেতে পারে। ৫. যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তর সংযুক্ত রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠান ওই সব স্তরের জন্য নির্ধারিত ক্লাসগুলো সমন্বয় করে রুটিন করবে। ৬. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চলমান ডিগ্রি, সম্মান ও মাস্টার্স পরীক্ষার সঙ্গে সমন্বয় সাপেক্ষে ২০২১ ও ২০২২ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য রুটিন প্রণয়ন করে শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ৭. রুটিন প্রণয়নের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ, প্রস্থান ও অবস্থানের সময় স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের মতো ঘটনা না ঘটে। ৮. রুটিন এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যেন ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে এবং প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়। ৯. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আপাতত এসেম্বলি বন্ধ থাকবে। ১০. প্রতিদিন নির্ধারিত চেকলিস্ট অনুযায়ী তথ্য পাঠাতে হবে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত ক্লাস রুটিন তৈরির ক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করতে হবে।
জরিপ কী বলছে
গত বছরের জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) জানিয়েছিল, ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছে। এর মধ্যে ৫৬টি বেসরকারি ও বাকি সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। সাধারণ ছুটিতে বেশির শিক্ষার্থী গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় প্রযুক্তিগত বিশেষ করে ইন্টারনেটের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই অনলাইন পাঠলাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গত ১৯ জানুয়ারি এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মোর্চা গণস্বাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত ‘এডুকেশন ওয়াচ-২০২১’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে টেলিভিশন, রেডিও এবং অনলাইনের মাধ্যমে চলা দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেনি। দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ না নেয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় ডিভাইসের অভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অনলাইন ক্লাস আকর্ষণীয় না হওয়ায় ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশগ্রহণ করেনি।
শুক্রবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১
নানান চ্যালেঞ্জ নিয়ে রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) খুলছে স্কুল। তবে মূল ‘চ্যালেঞ্জ’ হলো শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পার্থক্য কমানো। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষায় শহর ও গ্রামের মধ্যে এমনিতেই পার্থক্য ছিল। করোনা সংক্রমণের কারণে সে পার্থক্য আরও বেড়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) মনে করছেন, চলমান ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ বা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমে আসবে। যদিও অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া এবং নিজ নিজ বাসা থেকে খাতায় লিখে তা স্কুলে জমা দেয়ার এই প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীর পরিবর্তে মা-বাবা ও প্রাইভেট টিউটররা তা লিখে দিচ্ছেন বলে শিক্ষাবিদদের অভিযোগ।
গত ৫ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভা শেষে আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেন। ৭ সেপ্টেম্বর ওই সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সে অনুযায়ী ম্যানেজ (ব্যবস্থা) করতে হবে।’
ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন মাউশি মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক। তিনি শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) সংবাদকে বলেন, ‘ম্যানেজমেন্টের বিষয়টি আমি বুঝতে পারিনি। তবে আমরা যে অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছি, সেটি নিয়মিত বাস্তবায়ন হচ্ছে। এতে শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পার্থক্য কমে আসবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান সংবাদকে বলেন, ‘শিক্ষায় শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য আগে থেকেই ছিল। করোনা মহামারীতে তা আরও বেড়েছে। এ বৈষম্য কমাতে না পারলে উন্নত বিশে^র সঙ্গে তাল মেলাতে পিছিয়ে পড়বে আমাদের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশে যারা লেখাপড়া করতে যেতে চায়, তারা মেধার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়তে পারে।’
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকা ড. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘গ্রামাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনিতেই ইলেকট্রনিকস ডিভাইস, স্মার্টফোন, মোবাইল নেটওয়ার্কসহ প্রযুক্তিগত নানান অপ্রতুলতা রয়েছে। এ কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের মতো অনলাইনে সমান পাঠলাভের সুযোগ পেয়েছে, সেটি বলা যাবে না।’
পাঠলাভের এই বৈষম্য নিরসনের বিষয়ে মাউশির সাবেক মহাপরিচালক বলেন, ‘গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আপাতত ডবল শিফ্ট চালু ও অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা যায়, বিদ্যালয়ে ক্লাসের সময়সূচি বাড়ানো যায়। একই সঙ্গে সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের আরও বেশি মনোযোগী ও দায়িত্বশীল হতে হবে।’
করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ সময়ে বিকল্প ‘শিক্ষা কার্যক্রম’ হিসেবে টেলিভিশন ও রেডিওতে ক্লাস প্রচারণা, অনলাইনে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের ক্লাস প্রচার করে আসছে শিক্ষা প্রশাসন। সর্বশেষ উদ্যোগ হিসেবে, অনলাইনে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দিচ্ছে মাউশি, সেগুলো বাসায় লিখে স্কুলে জমা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এই অ্যাসাইনমেন্ট ‘মূল্যায়ন’ করে ছাত্রছাত্রীদের মেধা যাচাই করছেন শ্রেণী শিক্ষকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর দুটি সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সংবাদকে জানান, অ্যাসাইনমেন্টের ‘মূল্যায়ন’ যথাযথভাবেই করছেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরা যেহেতু বাসায় বসে বিষয় অনুযায়ী অ্যাসাইনমেন্ট লিখে খাতা জমা দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে নানানভাবে ‘হেল্প’ (সহায়তা) নেয়ার সুযোগ আছে। ঢাকার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ছে, তারা টিউটরের সহায়তায় অ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়ন করে থাকতে পারে। এখানকার বেশির ভাগই ছেলেমেয়েই ‘ইউটিউব’ বা ‘অনলাইন’ ব্যবহারে অভ্যস্ত, তারাও সেভাবে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ তৈরি করে থাকতে পারে। এরপরও এ প্রক্রিয়া ‘মন্দের ভালো’ বলে মনে করছেন শিক্ষকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও ‘শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির সংবাদকে বলেন, ‘অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ নৈতিকতা হারাচ্ছে। শিক্ষা প্রশাসন অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দায় সারছেন এবং শিক্ষার্থীরা বাসায় বসে গাইড বই দেখে তা পূরণ করছে। কারও কারও ক্ষেত্রে মা-বাবা অ্যাসাইনমেন্ট লিখে দিচ্ছেন। প্রাইভেট টিউটর ও শ্রেণী শিক্ষকরাও তা করে দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের এই নৈতিক ক্ষতির জন্য মা-বাবাও দায়ী।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রুটিন তৈরির ১০ নির্দেশনা
১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণী পাঠদান শুরু হবে। স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব মেনে শ্রেণী পাঠদান নিশ্চিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রুটিন তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
শুক্রবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ রুটিন তৈরির একটি নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিদিন নির্দিষ্ট শ্রেণীতে দুটি করে ক্লাস ধরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রুটিন তৈরি করবে হবে। ১. ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবে। ২. প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা একদিন প্রতিষ্ঠানে আসবে। ৩. সপ্তাহে প্রতিদিন নির্দিষ্ট শ্রেণীতে দুটি করে ক্লাস ধরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রুটিন তৈরি করবে। ৪. রুটিনের সঙ্গে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যবহারিক ক্লাস নির্ধারণ করা যেতে পারে। ৫. যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তর সংযুক্ত রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠান ওই সব স্তরের জন্য নির্ধারিত ক্লাসগুলো সমন্বয় করে রুটিন করবে। ৬. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চলমান ডিগ্রি, সম্মান ও মাস্টার্স পরীক্ষার সঙ্গে সমন্বয় সাপেক্ষে ২০২১ ও ২০২২ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য রুটিন প্রণয়ন করে শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ৭. রুটিন প্রণয়নের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ, প্রস্থান ও অবস্থানের সময় স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের মতো ঘটনা না ঘটে। ৮. রুটিন এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যেন ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে এবং প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়। ৯. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আপাতত এসেম্বলি বন্ধ থাকবে। ১০. প্রতিদিন নির্ধারিত চেকলিস্ট অনুযায়ী তথ্য পাঠাতে হবে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত ক্লাস রুটিন তৈরির ক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করতে হবে।
জরিপ কী বলছে
গত বছরের জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) জানিয়েছিল, ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছে। এর মধ্যে ৫৬টি বেসরকারি ও বাকি সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। সাধারণ ছুটিতে বেশির শিক্ষার্থী গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় প্রযুক্তিগত বিশেষ করে ইন্টারনেটের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই অনলাইন পাঠলাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গত ১৯ জানুয়ারি এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মোর্চা গণস্বাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত ‘এডুকেশন ওয়াচ-২০২১’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে টেলিভিশন, রেডিও এবং অনলাইনের মাধ্যমে চলা দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেনি। দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ না নেয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় ডিভাইসের অভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অনলাইন ক্লাস আকর্ষণীয় না হওয়ায় ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশগ্রহণ করেনি।