বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাসহ মুজিবনগর সরকারের নেতাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি বাতিলের খবরটি ‘সঠিক নয়’ বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম।
মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা দিয়ে তিন বছর আগের করা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধন করে গত মঙ্গলবার রাতে অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তনের পাশাপাশি আগে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন, তাদের একটি অংশকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ বলা হয়েছে।
তাতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতাসহ মুজিবনগর সরকারের এমএনএ বা এমপিএদের মুক্তিযোদ্ধা ‘স্বীকৃতি আর থাকল না’ বলে খবর প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
বুধবার (৪ জুন) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, ‘এটা সঠিক নয়। সঠিক নয় এই অর্থে যে, এখানে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে- ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার)। মুজিবনগর সরকার লেখা আছে, তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন, মনসুর আলী সাহেব ছিলেন, কামারুজ্জামান সাহেব ছিলেন, খন্দকার মোশতাক সাহেব ছিলেন, এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফারুক ই আজম বলেন, ‘এই যুদ্ধটা এই সরকার (মুজিবনগর) পরিচালনা করেছে। এই সরকারের লেজিটিমেসির বাইরে কাউকে স্বীকৃতিই দেয়া হয় নাই। এই সরকারটাই তখন ছিল বাংলাদেশে স্বীকৃত সরকার, যেটা প্রবাসী সরকার।’
নতুন সংজ্ঞায় বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা
‘যাহারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামে-গঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এরূপ সব বেসামরিক নাগরিক (ওই সময়ে যাদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনি¤œ বয়সের মধ্যে); এবং সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তি বাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ও উক্ত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্যরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।’
একই সঙ্গে অধ্যাদেশের নতুন সংজ্ঞায় ‘হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীর মাধ্যমে নির্যাতিত সব নারী (বীরাঙ্গনা)’ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন। পাশাপাশি ‘মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা সহকারীরারও’ হবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলছেন, অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) আছে, সুতরাং ওই সরকারের সংশ্লিষ্ট নেতারাও মুক্তিযোদ্ধা।’
মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী যারা
অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর সংজ্ঞায় যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি, তাদের পাঁচ ক্যাটাগরি করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে বা প্রবাসে অবস্থান করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনের প্রেক্ষাপটে যেসব বাংলাদেশের নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছেন।’
যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত এবং ওই সরকারের নিয়োগ করা চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন; মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ বা এমপিএ; যারা পরে গণপরিষদের সদস্য গণ্য হয়েছিলেন; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়-তাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ বলা হয়েছে অধ্যাদেশে।
একজন সাংবাদিক জানতে চান, এই সংজ্ঞার অর্থ এ রকম কিনা যে, যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা?
জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘এইটা হয় নাই, কারণ রণাঙ্গনটা ওরা পরিচালনা করেছেন। তাহলে তো একই কথা আপনি সেক্টর কমান্ডারদের ব্যাপারেও বলতে পারেন। তারা কি যুদ্ধ করে নাই? যুদ্ধ ডিজাইন করেছে, যুদ্ধে কারা যাবে, না যাবে সেটা পরিচালনা করেছে। ঠিক একই রকমের, মুজিবনগর সরকার তো পুরো যুদ্ধটা পরিচালনা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রেশন কোথা থেকে আসবে, অস্ত্র কোথা থেকে আসবে, এগুলো সব এই সরকার করছে না? ফলে এইটা তো ঐতিহাসিক সত্য যে এই সরকার পুরো যুদ্ধটা পরিচালনা করেছে। তো এটা কেমন করে ইতিহাস পরিবর্তন করা যায়?’ তিনি বলেন, ‘এটা একটা মিসলিডিং নিউজ। আমার মনে হচ্ছে যেন এটা সত্য হয় নাই। এখানে (অধ্যাদেশে) সুস্পষ্টভাবেই বলা আছে।’
মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী অংশে মুজিবনগর সরকারের যে বিষয় আছে, সেটা কেন- তা জানতে চান একজন সাংবাদিক।
উপদেষ্টা বলেন, ‘ওইটা মুজিবনগরের কর্মচারীরা। ওইখানে মুজিবনগর সরকারের অধীনে যে সমস্ত বেতনধারী কর্মচারীরা ছিল, তাদের বলা হয়েছে ‘সহযোগী’। সরকারকে বলা হয়নি। আর এমপিএ, এমএনএ দের মধ্যেও যারা সশস্ত্রভাবে এসে যুদ্ধ করেছে, তারাও মুক্তিযোদ্ধা।’ মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগীদের মর্যাদায় কোনো হেরফের করা হয়নি বলেও মন্তব্য করেন ফারুক ই আজম, যিনি নিজেও একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি বলেন, ‘সর্বাঙ্গীনভাবে এইটাকে মর্যাদাশীল করা হয়েছে। এইটা এই নয় যে যারা সহযোগী হবেন, তাদের মর্যাদা ক্ষুণœ হয়েছে। এইটা মোটেও না। কারণ ওই অবদানেও অসাধারণ এবং সেইভাবেই উনাদের সম্মানিত করা হচ্ছে, যে কে কী ধরনের ভূমিকাতে সেই সময় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে সুবিধাদি, রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত ভাতা ইত্যাদি নানা সুবিধার ক্ষেত্রেও কোনো বৈষম্য নেই, সবাই সমান।’
‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে আলাদা করার ব্যাখ্যায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘যারা যুদ্ধ করেনি তারা কী করে (মুক্তিযোদ্ধা) হইতে পারে? যারা মুক্তিযুদ্ধের কারণে ভারতে গেছে, নানা রকমের কাজে তারা এনগেজ ছিল সেখানে হয়তো, কেউ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, তারপরে কূটনৈতিক এবং অন্যান্য কাজে তারা ব্যস্ত ছিল, তারা সহযোগিতা করেছে, তারা তো রণাঙ্গনে এসে লড়াই করে নাই।’
ফারুক ই আজম দাবি করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির কারণেই এই সময়ে এসে সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে এ সরকার নতুন করে কোনো সংজ্ঞা প্রবর্তন করেনি। তিনি বলেন, ‘বাহাত্তরেও এমন সংজ্ঞা ছিল। এটা পরিবর্তন করা হয়েছে ২০১৮ সলে ও ২০২২ সালে। এখন বাহাত্তরের সংজ্ঞাটা দেয়া হয়েছে। ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় রাখা। দেশের মানুষ জানে মুক্তিযুদ্ধ কারা করেছে। মুক্তিযুদ্ধটা যেন বিতর্কিত না হয় সে চেষ্টা করছি আমরা।’
শেখ মুজিব, চার নেতাসহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের খবর ‘ভিত্তিহীন’: প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়
শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, মো. মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানসহ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল হয়েছে- এমন সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার (সিএ) কার্যালয়।
সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্ট (ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজ) থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং দুই মন্ত্রী মো. মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল বলে সমকাল, যুগান্তর, ইত্তেফাক ও কালেরকন্ঠসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর।’
প্রেস উইং ফ্যাক্টের বিবৃতিতে বলা হয়- এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, ‘মুজিবনগর সরকারের সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা, কারণ তারাই যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। আর ওই সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃত।’ তিনি আরও জানান, ‘১৯৭২ সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা অনুযায়ীই বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যদিও ২০১৮ ও ২০২২ সালে এই সংজ্ঞায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়, তবে মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা- দুজনের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা একই থাকবে।’
বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫
বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাসহ মুজিবনগর সরকারের নেতাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি বাতিলের খবরটি ‘সঠিক নয়’ বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম।
মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা দিয়ে তিন বছর আগের করা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধন করে গত মঙ্গলবার রাতে অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তনের পাশাপাশি আগে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন, তাদের একটি অংশকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ বলা হয়েছে।
তাতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতাসহ মুজিবনগর সরকারের এমএনএ বা এমপিএদের মুক্তিযোদ্ধা ‘স্বীকৃতি আর থাকল না’ বলে খবর প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
বুধবার (৪ জুন) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, ‘এটা সঠিক নয়। সঠিক নয় এই অর্থে যে, এখানে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে- ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার)। মুজিবনগর সরকার লেখা আছে, তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন, মনসুর আলী সাহেব ছিলেন, কামারুজ্জামান সাহেব ছিলেন, খন্দকার মোশতাক সাহেব ছিলেন, এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফারুক ই আজম বলেন, ‘এই যুদ্ধটা এই সরকার (মুজিবনগর) পরিচালনা করেছে। এই সরকারের লেজিটিমেসির বাইরে কাউকে স্বীকৃতিই দেয়া হয় নাই। এই সরকারটাই তখন ছিল বাংলাদেশে স্বীকৃত সরকার, যেটা প্রবাসী সরকার।’
নতুন সংজ্ঞায় বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা
‘যাহারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামে-গঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এরূপ সব বেসামরিক নাগরিক (ওই সময়ে যাদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনি¤œ বয়সের মধ্যে); এবং সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তি বাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ও উক্ত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্যরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।’
একই সঙ্গে অধ্যাদেশের নতুন সংজ্ঞায় ‘হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীর মাধ্যমে নির্যাতিত সব নারী (বীরাঙ্গনা)’ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন। পাশাপাশি ‘মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা সহকারীরারও’ হবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলছেন, অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) আছে, সুতরাং ওই সরকারের সংশ্লিষ্ট নেতারাও মুক্তিযোদ্ধা।’
মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী যারা
অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর সংজ্ঞায় যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি, তাদের পাঁচ ক্যাটাগরি করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে বা প্রবাসে অবস্থান করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনের প্রেক্ষাপটে যেসব বাংলাদেশের নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছেন।’
যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত এবং ওই সরকারের নিয়োগ করা চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন; মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ বা এমপিএ; যারা পরে গণপরিষদের সদস্য গণ্য হয়েছিলেন; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়-তাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ বলা হয়েছে অধ্যাদেশে।
একজন সাংবাদিক জানতে চান, এই সংজ্ঞার অর্থ এ রকম কিনা যে, যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা?
জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘এইটা হয় নাই, কারণ রণাঙ্গনটা ওরা পরিচালনা করেছেন। তাহলে তো একই কথা আপনি সেক্টর কমান্ডারদের ব্যাপারেও বলতে পারেন। তারা কি যুদ্ধ করে নাই? যুদ্ধ ডিজাইন করেছে, যুদ্ধে কারা যাবে, না যাবে সেটা পরিচালনা করেছে। ঠিক একই রকমের, মুজিবনগর সরকার তো পুরো যুদ্ধটা পরিচালনা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রেশন কোথা থেকে আসবে, অস্ত্র কোথা থেকে আসবে, এগুলো সব এই সরকার করছে না? ফলে এইটা তো ঐতিহাসিক সত্য যে এই সরকার পুরো যুদ্ধটা পরিচালনা করেছে। তো এটা কেমন করে ইতিহাস পরিবর্তন করা যায়?’ তিনি বলেন, ‘এটা একটা মিসলিডিং নিউজ। আমার মনে হচ্ছে যেন এটা সত্য হয় নাই। এখানে (অধ্যাদেশে) সুস্পষ্টভাবেই বলা আছে।’
মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী অংশে মুজিবনগর সরকারের যে বিষয় আছে, সেটা কেন- তা জানতে চান একজন সাংবাদিক।
উপদেষ্টা বলেন, ‘ওইটা মুজিবনগরের কর্মচারীরা। ওইখানে মুজিবনগর সরকারের অধীনে যে সমস্ত বেতনধারী কর্মচারীরা ছিল, তাদের বলা হয়েছে ‘সহযোগী’। সরকারকে বলা হয়নি। আর এমপিএ, এমএনএ দের মধ্যেও যারা সশস্ত্রভাবে এসে যুদ্ধ করেছে, তারাও মুক্তিযোদ্ধা।’ মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগীদের মর্যাদায় কোনো হেরফের করা হয়নি বলেও মন্তব্য করেন ফারুক ই আজম, যিনি নিজেও একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি বলেন, ‘সর্বাঙ্গীনভাবে এইটাকে মর্যাদাশীল করা হয়েছে। এইটা এই নয় যে যারা সহযোগী হবেন, তাদের মর্যাদা ক্ষুণœ হয়েছে। এইটা মোটেও না। কারণ ওই অবদানেও অসাধারণ এবং সেইভাবেই উনাদের সম্মানিত করা হচ্ছে, যে কে কী ধরনের ভূমিকাতে সেই সময় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে সুবিধাদি, রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত ভাতা ইত্যাদি নানা সুবিধার ক্ষেত্রেও কোনো বৈষম্য নেই, সবাই সমান।’
‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে আলাদা করার ব্যাখ্যায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘যারা যুদ্ধ করেনি তারা কী করে (মুক্তিযোদ্ধা) হইতে পারে? যারা মুক্তিযুদ্ধের কারণে ভারতে গেছে, নানা রকমের কাজে তারা এনগেজ ছিল সেখানে হয়তো, কেউ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, তারপরে কূটনৈতিক এবং অন্যান্য কাজে তারা ব্যস্ত ছিল, তারা সহযোগিতা করেছে, তারা তো রণাঙ্গনে এসে লড়াই করে নাই।’
ফারুক ই আজম দাবি করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির কারণেই এই সময়ে এসে সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে এ সরকার নতুন করে কোনো সংজ্ঞা প্রবর্তন করেনি। তিনি বলেন, ‘বাহাত্তরেও এমন সংজ্ঞা ছিল। এটা পরিবর্তন করা হয়েছে ২০১৮ সলে ও ২০২২ সালে। এখন বাহাত্তরের সংজ্ঞাটা দেয়া হয়েছে। ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় রাখা। দেশের মানুষ জানে মুক্তিযুদ্ধ কারা করেছে। মুক্তিযুদ্ধটা যেন বিতর্কিত না হয় সে চেষ্টা করছি আমরা।’
শেখ মুজিব, চার নেতাসহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের খবর ‘ভিত্তিহীন’: প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়
শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, মো. মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানসহ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল হয়েছে- এমন সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার (সিএ) কার্যালয়।
সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্ট (ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজ) থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং দুই মন্ত্রী মো. মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল বলে সমকাল, যুগান্তর, ইত্তেফাক ও কালেরকন্ঠসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর।’
প্রেস উইং ফ্যাক্টের বিবৃতিতে বলা হয়- এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, ‘মুজিবনগর সরকারের সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা, কারণ তারাই যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। আর ওই সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃত।’ তিনি আরও জানান, ‘১৯৭২ সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা অনুযায়ীই বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যদিও ২০১৮ ও ২০২২ সালে এই সংজ্ঞায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়, তবে মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা- দুজনের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা একই থাকবে।’