বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেই নয় শুধু, বিশ্বপরিসরে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছিল ৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের কাছে থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু বাঙালিরা জাতি হিসেবে মাতৃভাষার প্রাপ্য মর্যাদা পাননি, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। এই বঞ্চনাবোধ বাঙালিকে পাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাবাপন্ন করে তোলে। সেই বিদ্বেষ এক সময় রূপ নেয়া সর্বাত্মক আন্দোলনে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দেয়ার দাবি আন্দোলন যা ইতিহাসে ভাষা আন্দেলন নামে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল।
আজ ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির তৃতীয় দিন। ফেব্রুয়ারি প্রথম দিন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাষা অদালনের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসা জানানো হচ্ছে। বাঙালি নানা আয়োজনে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কখনোই কার্পণ্য করেনি। প্রতিটি আয়োজনে বাংলা ভাষার মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে দৃপ্ত শপথের কথাই ব্যক্ত করছে বাঙালি জাতি। যথারীতি মাসের প্রথম দিন থেকে বাংলা একাডেমি চত্বরে শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। মেলার দ্বিতীয় দিনে দিনভর মেলা ঘুরে বেড়িয়েছেন বইপ্রেমীরা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা কবি ও কবিতাপ্রেমীদের পদচারণায় মুখর ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরে অনুষ্ঠিত কবিতা উৎসব প্রাঙ্গণও।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে ভেসে ওঠে বাঙালির বীরত্বের গৌরবগাথা। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে নতুন দেশ সৃষ্টি হলো দু’টি দেশ। একটি ভারত। অন্যটি পাকিস্তান। বর্তমান বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের অংশ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো মিল ছিল না। বরং দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল সংশয় সন্দেহ। আর তাই যুগল পথ চলার শুরুতেই বিরাট বাধা। পাকিস্তানের শাসকরা রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠার দূরভিসন্ধি নিয়ে এগোতে থাকে। কিন্তু মায়ের ভাষা বাংলা ভুলে নতুন ভাষা শেখার কথা চিন্তাও করতে পারে না বাঙালি। তাদের উপলব্ধি হয়, শুধু ভাষার প্রতি নয় এ আঘাত বাঙালি সংস্কৃতির ওপর। প্রতিবাদে তাই ফেটে পড়ে তারা। বিশেষ করে ছাত্ররা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয়।
এরপরও দারুণ স্পর্ধা দেখিয়ে চলে গোঁয়ার পাকিস্তানিরা। ১৯৫২ সালের আজকের দিনে আবারও উর্দু নিয়ে খায়েশের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন। ১০ দিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থান সফর করে ৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে গভর্নমেন্ট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। এ সময় পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও অখ-তার স্বার্থে একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। শুধু তাই নয়, খাজা সাহেব এদিন বেশ কঠোর ছিলেন বলে মনে হয়। তার বক্তব্যটি ছিল এরকম ‘আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হতে চলেছে, অন্য কোনো ভাষা নয়। তবে এটা যথাসময়ে হবে।’
তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নাকচ করে দেন। তবে হুঙ্কারে কোনো কাজ হয় না। বরং সংগঠিত হওয়ার তাগিদ বোধ করে বাঙালি। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার নতুন শপথ নেয় তারা।
বায়ান্ন সালের পর থেকে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে ভাষা আন্দোলনের মাস। এ মাসে প্রতিদিনই ভাষার মর্যাদার দাবিতে বাঙালিরা সংগ্রামের মশাল জ্বালিয়ে এগিয়ে যায় দাবি আদায়ের দিকে। বাঙালি চায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করতে, তাই সংগ্রাম-আন্দোলনই তাদের পথ। চরম আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানিরা এক সময় বাধ্য হয় বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে। এরপর থেকে প্রতিবছরই এই ফেব্রুয়ারি মাস এলে বাঙালি জেগে ওঠে নতুন চেতনায়, নতুন আবেগে। বাঙালি জাতি ভাষার প্রতি ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন এবং অন্তরের মমতায় একুশের ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
রোববার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেই নয় শুধু, বিশ্বপরিসরে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছিল ৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের কাছে থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু বাঙালিরা জাতি হিসেবে মাতৃভাষার প্রাপ্য মর্যাদা পাননি, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। এই বঞ্চনাবোধ বাঙালিকে পাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাবাপন্ন করে তোলে। সেই বিদ্বেষ এক সময় রূপ নেয়া সর্বাত্মক আন্দোলনে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দেয়ার দাবি আন্দোলন যা ইতিহাসে ভাষা আন্দেলন নামে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল।
আজ ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির তৃতীয় দিন। ফেব্রুয়ারি প্রথম দিন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাষা অদালনের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসা জানানো হচ্ছে। বাঙালি নানা আয়োজনে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কখনোই কার্পণ্য করেনি। প্রতিটি আয়োজনে বাংলা ভাষার মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে দৃপ্ত শপথের কথাই ব্যক্ত করছে বাঙালি জাতি। যথারীতি মাসের প্রথম দিন থেকে বাংলা একাডেমি চত্বরে শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। মেলার দ্বিতীয় দিনে দিনভর মেলা ঘুরে বেড়িয়েছেন বইপ্রেমীরা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা কবি ও কবিতাপ্রেমীদের পদচারণায় মুখর ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরে অনুষ্ঠিত কবিতা উৎসব প্রাঙ্গণও।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে ভেসে ওঠে বাঙালির বীরত্বের গৌরবগাথা। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে নতুন দেশ সৃষ্টি হলো দু’টি দেশ। একটি ভারত। অন্যটি পাকিস্তান। বর্তমান বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের অংশ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো মিল ছিল না। বরং দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল সংশয় সন্দেহ। আর তাই যুগল পথ চলার শুরুতেই বিরাট বাধা। পাকিস্তানের শাসকরা রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠার দূরভিসন্ধি নিয়ে এগোতে থাকে। কিন্তু মায়ের ভাষা বাংলা ভুলে নতুন ভাষা শেখার কথা চিন্তাও করতে পারে না বাঙালি। তাদের উপলব্ধি হয়, শুধু ভাষার প্রতি নয় এ আঘাত বাঙালি সংস্কৃতির ওপর। প্রতিবাদে তাই ফেটে পড়ে তারা। বিশেষ করে ছাত্ররা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয়।
এরপরও দারুণ স্পর্ধা দেখিয়ে চলে গোঁয়ার পাকিস্তানিরা। ১৯৫২ সালের আজকের দিনে আবারও উর্দু নিয়ে খায়েশের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন। ১০ দিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থান সফর করে ৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে গভর্নমেন্ট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। এ সময় পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও অখ-তার স্বার্থে একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। শুধু তাই নয়, খাজা সাহেব এদিন বেশ কঠোর ছিলেন বলে মনে হয়। তার বক্তব্যটি ছিল এরকম ‘আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হতে চলেছে, অন্য কোনো ভাষা নয়। তবে এটা যথাসময়ে হবে।’
তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নাকচ করে দেন। তবে হুঙ্কারে কোনো কাজ হয় না। বরং সংগঠিত হওয়ার তাগিদ বোধ করে বাঙালি। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার নতুন শপথ নেয় তারা।
বায়ান্ন সালের পর থেকে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে ভাষা আন্দোলনের মাস। এ মাসে প্রতিদিনই ভাষার মর্যাদার দাবিতে বাঙালিরা সংগ্রামের মশাল জ্বালিয়ে এগিয়ে যায় দাবি আদায়ের দিকে। বাঙালি চায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করতে, তাই সংগ্রাম-আন্দোলনই তাদের পথ। চরম আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানিরা এক সময় বাধ্য হয় বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে। এরপর থেকে প্রতিবছরই এই ফেব্রুয়ারি মাস এলে বাঙালি জেগে ওঠে নতুন চেতনায়, নতুন আবেগে। বাঙালি জাতি ভাষার প্রতি ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন এবং অন্তরের মমতায় একুশের ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।