alt

সাময়িকী

কাফকাকে পড়া কাফকাকে পড়ানো

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

ফ্রান্ৎস কাফকা

(পূর্ব প্রকাশের পর)

বাস্তবের উল্লেখ কাফকার লেখালেখির আরেকটি বিষয়ের দিকে আমাদের নিয়ে যায়, এবং তা হচ্ছে বাস্তব-অবাস্তব দ্বন্দ্ব। এর অনেকগুলি দিক রয়েছে, যেমন, একটু আগে যেমন বলা হলো, কাফকীয় জগতের অনুভূত অবাস্তবতা- গ্রেগর সামসা যেমন, কিছুতেই বুঝতে পারে না, সে কি বাস্তবে আছে, না কোনো ঘোর অবাস্তবে? অথচ গল্পটি আমাদের দেখায়, গ্রেগরের পরিবারের কাছে তার মেটামরফসিস ভয়ানক, দুর্বিষহ বাস্তব, ফলে বাস্তব যে প্রকৃতই বাস্তব, একটা বিশাল বিভ্রমের নাম নয়, সে প্রশ্নটাও ওঠে। পাশাপাশি কাফকা আরও একটি মেটামরফসিস দেখান যা গ্রেগরের পরিবারের। তাদেরও বিবর্তন ও রূপান্তর ঘটে- তারা গ্রেগরের পরিবার আর থাকে না, গ্রেগর তাদের কাছে এক দুঃস্বপ্ন। সে মারা গেলে তাই ঘরের চার দেয়ালের রুদ্ধ পরিসরে তৈরি হতে থাকা গল্পের সমাপ্তি ঘটে বিকেলের সুন্দর আলোয়, এক পার্কে, যেখানে মেয়ে যে বিবাহের উপযুক্ত হয়েছে, বাবা মায়ের এই উপলব্ধি এক নতুন জীবনের সন্ধানে যায়। ফিলিস্তিনের গাজাতে এখন যা ঘটছে- প্রতিদিন পঞ্চাশ-একশ’ জন ফিলিস্তিনিকে বোমা মেরে, শেল ছটুড়ে খুন করছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী, যাদের একটা অংশ শিশু- এর মতো নির্মম বাস্তব আর কিছু কি হতে পারে? অথচ সারা দুনিয়ার কাছে এটি যেন স্বাভাবিক কোনো ঘটনা। কোনো প্রতিবাদ নেই, কোনো দুঃখবোধও যেন নেই। যেন বাস্তব যা ঘটছে তা যেন গ্রেগর সামসার মতো, ওই ভিকটিমরাই শুধু অনুভব করছে, যদি মৃত্যুর আগে অনুভব করার মতো সময় তারা পায়, অথবা আহত হয়ে ভেঙ্গে পড়া দালানের ইট-সিমেন্টের নিচে পড়ে যতক্ষণ, যতদিন বাঁচে ততক্ষণ বা ততদিন। গাজায় যা ঘটছে তা যেন দ্য ট্রায়াল-এর মতো- এক সকালে জোসেফ কে’র কাছে হঠাৎ গ্রেপ্তারি তথা মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হওয়া এবং একসময় তার বৈধতা পাওয়া। কোন দোষে মানুষগুলি, নারী-শিশুগুলি মরছে, তারা জানে না। প্রতিকারহীন এই সময়ে তাদের কাছে জীবনটা কাফকীয়, যাতে কোনো অর্থ খটুজে পাওয়াটা মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে মৃত্যুর ব্যবসা করা ইসরায়েল রাষ্ট্রের নির্যাতনের নিচে অসম্ভব। এই প্রসঙ্গে কাফকা সম্পর্কে থিওডোর এডর্নো তাঁর নোট্স অন কাফকা গ্রন্থে (১৯৫৩) যা বলেছেন, তা ভেবে দেখার মতো। এডর্নো বলেছেন, কাফকার বর্ণিত জগৎ প্রকৃত-অপ্রকৃতের বাইরের এক জগতের মতো, যা ধরা দেয় মানুষের সামষ্টিক স্মৃতিবাহিত হয়ে, যাকে ফরাসি ভাষায় ফবলধ াঁ বলা হয়, অর্থাৎ যা ইতিমধ্যে দেখা হয়ে গেছে, যার ভেতর দিয়ে যাওয়া হয়ে গেছে। কাফকার গল্প-উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনাগুলি তো মানবজাতির দেখা হয়ে যাওয়া ঘটনা। এসব মানুষ স্মৃতি থেকে, অনুভূতি থেকে বুঝে নিতে পারে। ডিজিট ম্যাগাজিন-এ ১৭.০৬.২০২৪ তারিখে প্রকাশিত সংখ্যায় এক মেধাবী সমালোচক ক্যাথারিন হুবার তাঁর “লাইস, ল’স, এ্যান্ড লিটারেচার : হোয়াট ফ্রান্ৎস কাফকা টিচেস আস এবাউট পাওয়ার এ্যান্ড পলিটিক্স টুডে” প্রবন্ধেও এর উল্লেখ করেছেন। মিথ্যা এবং আইনের যুগলবন্দী বোধগুলি আমাদের সময়ের প্রায় প্রত্যেক দেশে তাদের নাগরিকদের এক কাফকীয় বাস্তবতা-অবস্তাবতার ভেতর দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। আমাদের এই উপমহাদেশের আদালতগুলির স্থাপত্যে কাফকীয়তা ইট-কাঠ-সিমেন্ট থেকেও বোধ করি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এক নির্মাণ-উপাদান। এসব আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কত অপরাধী দিনশেষে ‘নিরপরাধ’ প্রমাণিত হয়ে যায়, আর কত নিরপরাধ মানুষ অপরাধী হয়ে যায়। যা ভয়ের কথা তারা যে অপরাধী সেটি প্রমাণ করার ক্ষেত্রে নিজেদেরও জড়িয়ে ফেলতে তারা বাধ্য হয়। একজন অভিযুক্তকে যখন রিমান্ডে নেয়া হয়, সে আর পুলিশের মাঝখানে কে থাকে? কোনো আইনজীবী? আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কেউ? আইনের কোনো এ্যাক্টিভিস্ট শিক্ষক বা শিক্ষার্থী? নাকি এক ভয়াবহ শূন্যস্থান, যা পূরণ করে তার বেঁচে থাকার আকুলতা? কাঠগড়ায় যখন কোনো অভিযুক্ত, জোসেফ কে’র মতো নিজেকেই অভিযুক্ত করার কাজটি করে, যে অপরাধবোধে সে আক্রান্ত হয় তার শুরুটা ওই মিথ্যাকে সত্য বানানো (বে)আইনি প্রক্রিয়া, আর শেষটা নিজস্ব একটা অপরাধবোধ, যা একসময় সে হয়তো বিশ^াসই করে বসে। অর্থাৎ দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ হ্যানা আরেন্ট যেমনটা বলেন (তাঁর ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত “কাফকা : এ রিভ্যালুয়েশন” প্রবন্ধে), মানুষ যখন তার প্রকৃত এবং কল্পিত অপরাধবোধকে (কেউ যেহেতু অপরাধ থেকে মুক্ত নয়, ফলে কোনো না কোনো ধরনের অপরাধবোধ থেকেও) তার মনের ভেতরে স্থান দিয়ে ফেলে, তখন বাস্তব আর অবাস্তবের পার্থক্যটা সরে যায়। এজন্য দ্য ট্রায়াল উপন্যাসটিকে তিনি দেখেছেন জোসেফ কে’র এক ধরনের উন্মাদ অবস্থার রূপায়ন, যে অবস্থানটি বহিস্থ কোনো শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এবং যার কেন্দ্রে আছে মানুষের অসহায়ত্ব।

তবে আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় ঠেকেছে বাস্তব-অবাস্তব নিয়ে করা পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের একটি মন্তব্য (যা তাঁর ১৯৫৮ সালে লিখিত প্রবন্ধ “দ্য রেপ্রেজেন্টেশন অফ নেচার ইন কন্টেম্পরারি ফিজিক্স” প্রবন্ধে করেছেন)। হাইজেনবার্গ বলেছেন, পুরনো প্রথা অনুযায়ী সময় ও পরিসরের (স্পেস-এর) মাপে ফেলে পৃথিবীকে একটি নৈর্ব্যস্তুক প্রক্রিয়ার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে, যাতে মানুষের আত্মারও প্রতিফলন ঘটে। বিজ্ঞান, এই সময়ে, বরং প্রমাণ করেছে যে মানুষ আর প্রকৃতির আন্তসংযোগ এমন জটিল এবং বহু পথে বিস্তৃত এক প্রক্রিয়া যে কোনো এক রৈখিক মাপে তাকে ফেলা যায় না। ফলে এক রৈখিক বাস্তব বলে কিছু নেই। অবস্তাবও কোনো ধরে নেয়ার মতো বিষয় নয়, যেহেতু এটি ধরা-ছোঁয়া এড়িয়েই থাকতে চায়। দ্য ক্যাসল পড়ে আমার মনে হয়েছিল দুর্গের পুরনো একক স্থাপত্য বাদ দিয়ে কাফকা যে অনেক দালানের সমষ্টিতে গড়া একটা বহুবিধ স্থাপনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তাতে এই খ-ায়নকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কুড়ি শতকের দ্বিতীয় দশকে চিত্রকলায় ঘনত্ববাদ বা কিউবিজম যখন শুরু হলো, পিকাসো, ব্র্যাখ প্রমুখের হাত ধরে বাস্তবের খ-িত রূপগুলি কোনো নতুন বাস্তবে বা অবাস্তবে তা আমাদের নিয়ে যায় সেই জিজ্ঞাসাটি প্রধান হয়ে উঠল। কিউবিজম-এর এক মূল সূত্র ছিল বহিরাবরণের পেছনে লুকিয়ে থাকা ভেতরটার স্বরূপ উন্মোচন করা। গ্রেগর সামসার ভেতরে যে পোকা লুকিয়ে ছিল- সকলের মধ্যেই যে পোকা কম বেশি থাকে- তা যখন বোঝা গেল, তখন সামসার পৃথিবী প্রকৃত থেকেও অপ্রকৃত হয়ে গেল।

কতভাবেই না কাফকাকে পড়া যায়। কিউবিজমের সঙ্গে কাফকার বর্ণিত পৃথিবীর সাদৃশ্যটা আমি বুঝতে পারি আমেরিকার ইয়েল বিশ^বিদ্যালয়ের চিত্রকলা প্রদর্শনী ঘরে রাখা পিকাসোর সংগ্রহ দেখা শেষে এক কাফেতে বসে কফি খেতে খেতে। এক বৃদ্ধ লাঠি হাতে কাফের বাইরের রাস্তা পার হতে চাইছিলেন, কিন্তু পারছিলেন না। এক তরুণী তাঁকে সাহায্য করতে চাইল, তিনি হেসে সেই সহায়তার ডাক ফিরিয়ে দিলেন। তারপর তিনি এক বেঞ্চে বসে পড়ে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমার মনে হলো তিনি হয়তো রাস্তা পার হতে চাইছেন না, প্রক্রিয়াটার মধ্য দিয়ে কীভাবে যাওয়া যায়, তাই নিয়ে শুধু ভাবছেন। তাঁর কাছে দেখা পৃথিবীর যে রূপ, তার সঙ্গে তাঁর বিরোধটা সময়ের। পুরনো মানুষটা নতুনকে, অথবা নতুন সময়ে এসে পুরাতনকে বোঝার চেষ্টা করছেন। অথবা করছেন না। পিকাসো মানুষ, বস্তু, দালান, বাদ্যযন্ত্র- যাই আঁকুন না কেন, একই সঙ্গে একাধিক প্রেক্ষাপটে তাকে স্থাপন করেছেন। তাতে এক মানুষ বহু মানুষ, এক বস্তু বহু বস্তু হয়ে দেখা দেয়। শেক্সপিয়ারের ভাষায় এই বৈচিত্র্য অন্তহীন- ‘রহভরহরঃব াধৎরবঃু’। তবে সমস্যা হলো, রাষ্ট্র, কর্তৃত্ববাদ, আইন, প্রতিষ্ঠান এই অনন্ত বোঝে না, বৈচিত্র্যও বোঝে না। মানুষের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব তাই চিরন্তন। কিন্তু রাষ্ট্র, আইন ইত্যাদি তো মানুষেরই সৃষ্টি। হ্যাঁ, ক্ষমতাবান মানুষ, যখন সে তাজা থাকে, সেই মানুষের সৃষ্টি। যখন সে বার্ধক্যে নুয়ে পড়ে, কাফের বাইরের রাস্তার পাশে বসা মানুষটার মতো, সে বুঝতে পারে, এই তৈরি পৃথিবীতে তার খাপ খায় না। সে মিসফিট।

কাফকার গল্প-উপন্যাসে এই দ্বন্দ্বগুলি ভাষা পায়। আমি দেখেছি, আমার শিক্ষার্থীরা যখন নিজেদের মতো করে ভাবে, তারা কাফকাতে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারে। কারণ কাফকার সাহিত্য সেই কিউবিস্ট ছবির মতো একই সঙ্গে অনেক পার্সপেক্টিভ ধারণ করে, অনেক ব্যাখ্যা ও সম্ভাবনাও।

কাফকাকে পড়াতে গেলে তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলি সময় নিয়ে আরেকবার পড়তে হয়, এবং যে কোনো লেখককে সময় দিলে তাঁর অনেক অদেখা দিক চোখে পড়ে, অনেক দিক নতুনভাবে উন্মোচিত হয়। এরকম তিনটি দিক নিয়ে সংক্ষেপে বলব, যেগুলি কাফকার সৃষ্টিবৈচিত্র্যের মাত্রাটি আমার কাছে আরেকটু গভীর করেছে। একটি হচ্ছে সেই পুরনো যোগাযোগের সমস্যা। মানুষ যখন সংসারের এবং সমাজের কাঠামো তৈরি করল, তখন থেকেই সেই সমস্যা দেখা দিল। মানুষদের ভেতর যে যোগাযোগ, তার কতটা অর্থবহ? মানুষ কি মানুষের সঙ্গে সত্যিকারভাবেই সংযুক্ত হতে পারে? এই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটি, দ্বিধাহীনভাবে, না। কাফকা দেখান, মানুষের একটি বড় ট্র্যাজেডি যদি হয় এই যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থতা, তাহলে তার বড় ট্র্যাজেডি হচ্ছে নিজের সঙ্গে যোগাযোগের অক্ষমতা। তাঁর প্রধান চরিত্রগুলি নিজেদের ভেতরে থাকা নানা চোরাবালিতে হারিয়ে যায়। তখন এক মানুষ অনেক মানুষ হয়ে যায়, সেই মার্শেল ডুশাম্পের সিঁড়ি বেয়ে নামা নগ্নিকা-র মতো। কাফকা যা দেখান, সেই অনেক মানুষে থাকে অ-হারানো মানুষ, আধখানা মানুষ, আপাত সমাপ্ত মানুষ, অসমাপ্ত মানুষ। কাফকা মানুষের পাপ নিয়ে তেমন কথা বলেননি, ট্র্যাজিক অক্ষমতা নিয়ে বলেছেন। তবে ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের মতে তাঁর লেখার যে অতিপ্রাকৃতিক অর্থাৎ ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়, তাতে ধর্মের ভেতর কাফকার উঁকি দেয়ার বিষয়টি আন্দাজ করা যায়। তাহলে মানুষের যোগাযোগ অক্ষমতা কি তার আদিপাপ? আদমের স্বর্গ থেকে বহিষ্কারের পেছনে ছিল যে পাপ, তা ছিল তার নিষিদ্ধ জ্ঞানের আকাক্সক্ষা। তাহলে যে জ্ঞান মানুষকে অচল করে দেয়, অর্থাৎ আত্মজ্ঞান- যেহেতু তা সমীনাচিহ্নিত অথচ যা অনন্তের আকাক্সক্ষা ধারণ করে, এবং যা মেনে নিতে কোনো কর্তৃত্ব রাজি নয়, তা-ই তাহলে তাকে যোগাযোগ-অক্ষম করে। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে মানুষের যোগাযোগ সীমিত, নিয়ন্ত্রিত; তার ওপর নজরদারি চলে সর্বক্ষণ। সেই নজরদারি মেনে নিতে মানুষ হয়তো একসময় নিজের ওপর নজরদারি চালাতে থাকে। তাতে তার ভাষাটাও তার অধিকারে থাকে না। এর সূত্র ধরে ভাষার প্রসঙ্গটি আসে। ভাষা কি শুধু অক্ষরে-শব্দে সাজানো ব্যাকরণ মানা (প্রমিত, অপ্রমিত যে কোনো অর্থে) বাক্যে বিন্যস্ত উচ্চারণ? ভাষা কি এসব থেকে উর্ধে থাকতে পারে না? গ্রেগর সামসা পোকা হয়ে গেলে তার ভাষা হারিয়ে যায়। কোন ভাষা? তার প্রতিদিনের যোগাযোগের ভাষা, তার অর্থপূর্ণ প্রকাশের ভাষা। কিন্তু ভাষা হারালেও নিজের কাছে সে ভাষাহীন নয়। ভাষাকে মানুষ যখন পোশাকী করেছে, যোগাযোগের মান হিসেবে ধরে নিয়েছে, তার সৃজন ও মননশীল কর্মের প্রকাশ মাধ্যম হিসেবেও, সেদিন ভাষা একটা বেড়া ঘেরা জায়গার ভেতরে হয়তো চলে যায়, যা ডিঙ্গালে রাষ্ট্র মানুষকে শাস্তি দেবে। ভাষা নিষিদ্ধ হয়, ভাষা হারিয়ে যায়। এজন্য কাফকার প্রতিটি গল্প উপন্যাসে ভাষার বিন্যাসকে খুঁটিয়ে দেখতে হয়। দ্য ট্রায়াল-এর ইংরেজি অনুবাদেও বোঝা যায়, ভাষাকে কতটা কঠিন বিন্যাসে ফেলেছেন তিনি, যখন প্রয়োজন তার ভেতর ব্যাপ্তি অথবা ঘনবদ্ধতা এনেছেন। তাঁর ভাষাকে যদি মন দিয়ে পড়া হয়, শুধু তাঁর ভাষাকে, বোঝা যাবে কতটা স্থিতিস্থাপক তিনি তাঁর ভাষাকে হতে দিয়েছেন, যেহেতু তাঁর সেই কাফকীয় পৃথিবীর একটি চাবি আছে সেই ভাষাতে।

আর এতক্ষণ যে কাফকাকে পড়ার নানা পথের সন্ধান আমরা করলাম, যা আমার মনোযোগী শিক্ষার্থীদের অনেকেই পরিশ্রম করে (শেষ বিচারে আনন্দের সঙ্গে) করেছে, তার পেছনে যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রবণতা থাকে, তাকেই একসময় তার কোনো কোনো পাঠক প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। কাফকাকে ব্যাখ্যা করা, তাঁর নানা রহঃবৎঢ়ৎবঃধঃরড়হ হাজির করা এক কঠিন এবং সময় ও পাঠসাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু একসময় এ প্রশ্নটাও তো ওঠে, যেমন দু’এক কাফকা আলোচক করেছেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া, কাফকার নিজের কথা মেনে, ব্যাখ্যার দায়িত্ব তাঁকেই দিয়ে, তাঁকে পড়লে কেমন হয়? কেমন হয যদি তাঁর দ্য ক্যাসল তাঁর চোখেই আমরা দেখি, তাঁর “এ হাঙ্গার আর্টিস্ট” গল্পের মূল চরিত্র কেন একটা খাঁচায় অনশনে বসে, কেন অনশনটাকে সে একটা স্পেক্ট্যাকল-এ পরিণত করল, সেসব তার কাছ থেকেই আমরা শুনি, তার শেষ কথাগুলি আমলে নিয়ে তার মৃত্যুর পর তার খাঁচায় পুরে দেয়া প্যান্থারটির সঙ্গে আমরা নিজেরাই তার তুলনা করি, অথবা “ইন দ্য পিনাল কলোনি”র চার চরিত্রের কথাগুলি তাদের মুখে শুনি, এবং শেষ পর্যন্ত ওই শাস্তির দ্বীপে যে অত্যাচার-যন্ত্রটি আছে, তা যে নষ্ট হতে হতে শেষ হত্যাকা-টি ঘটালো, তার প্রকৃত রূপটি বোঝার চেষ্টা গল্পটা পড়তে পড়তে করি। তবে সমস্যা হলো, সাহিত্য পাঠটা আদতে ইন্টারপ্রিটেশন এবং ব্যাখ্যারই ব্যাপার। লেখক তাঁর মতো করে লিখে ফেললেন, ফলে যা বলার তিনিই বলবেন, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না। প্রথমত, লেখক যে লিখলেন, তিনি কোন জন? বাইরে থেকে তাঁকে যতটা চেনা যায়, তা-ই কি সব? ভেতরের জন যে ভিন্ন একজন নয়, তা নিশ্চিত করে কে বলতে পারবে? সেই ড. জেকিল ও মিস্টার হাইডের বড় বিভাজন বাদ দিলেও, ছোটখাটো বিভাজনেও মানুষ বিভাজিত। কাফকা সম্পর্কে বলা হয়, তিনি এক কাফকার মধ্যে বহু কাফকা- ইডিপাস জটিলতায় ভোগা কাফকা, একাকী-নিঃসঙ্গ কাফকা, ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ওকালতি করা-চাকরিজীবী কাফকা, ম্যাক্স ব্রডের বন্ধু কাফকা, নারীসঙ্গপীড়িত (উভয় অর্থে) কাফকা, প্রাগ শহরের নানা অর্থে সংখ্যালঘু কাফকা, এবং জোসেফ কে অথবা কে-তে মিশে থাকা কাফকা। তাঁর গল্প-উপন্যাসের যেসব তিনি রাতে লিখেছেন, এবং স্যানাটোরিয়াম বা স্বাস্থ্যনিবাসে থাকার সময়, সেগুলি যে-কাফকা লিখেছেন, তাঁকেও বিবেচনায় নিতে হবে। তাহলে কোন সে কাফকা যিনি “দ্য মেটামরফসিস” লিখেছেন, এবং কতটা লিখেছেন- এই প্রশ্ন তো ওঠে। তাহলে এ নিয়ে এই কাফকার সঙ্গে অন্য কাফকাদের মতের মিল নাও তো থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, একজন লেখককে দিয়ে, নব্য ইতিহাসবিদরা যেমন বলেন, তাঁর সময় ও তাঁর সময়ের ইতিহাস তার গল্প-উপন্যাসগুলি লিখিয়ে নেয়। যদি এই চিন্তাটি কিছুটা বৈধ বা যৌক্তিক বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলেও তো লেখক একজন স্বয়ম্ভু ¯্রষ্টার অবস্থানে থাকেন না। এজন্য একজন লেখক যে মুহূর্তে তাঁর লেখাটি ছাপতে পাঠিয়ে দেন, এর রহঃবৎঢ়ৎবঃধঃরড়হ-এর ভারটা তিনি লেখক-আলোচক-সমালোচক-তত্ত্ববিদের হাতে ছেড়ে দেন। মজার ব্যাপার হলো, কাফকাকে নিয়ে যত আলোচনা এ পর্যন্ত হয়েছে, তাতে তিনি আরো বেশি অন্তরঙ্গতা নিয়ে পাঠকের কাছে ধরা দিয়েছেন।

কাফকাকে পড়াতে গেলে আরো যে দু’টি বিষয় একসময় গুরুত্ব পায়- তাঁর লেখার ভাষা এবং তাঁর লেখালেখিতে যে এক ধরনের শুষ্ক, অনেকটা ভেতর থেকে কাটতে থাকা হিউমার বা অম্লমধুর কৌতুকবোধের দেখা পাওয়া যায়- যার উৎস, অনেক আলোচকের মতে, ইহুদী ঐতিহ্যের হিউমারের মধ্যে শনাক্ত করা যায়- সে দু’টি আমলে নিয়ে একসময় তাঁর সাহিত্য কেন আমাদের টানে তা বোঝা যাবে। কাফকার সাহিত্যকে কেউ বলেন একটি ভাষিক প্রকল্প, কেউ বলেন ভাষাগত প্রকৌশল। গুরুত্ব দিয়েই বলেন, কারণ ভাষায় তিনি নিজেকেই বিনিয়োগ করেছেন। ম্যাক্স ব্রড এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, নিজেকে সবসময় অরক্ষিত ভাবতেন কাফকা এবং বলতেন, তাকে সুরক্ষা দিয়েছে নিজের সঙ্গে তার নিজের কথা বলার সামর্থ্যটি। ভাষাটিও তাঁর নিজস্ব। তাঁর বাক্যগুলি শুরু হয় সহজভাবে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই কমা ও ক্লজের আকীর্ণতায় কঠিন হয়ে ওঠে। এই ভাষা দ্রুত বলা ভাষা নয়- বরং সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বলা, এক পা এগিয়ে, দু’পা পিছিয়ে এসে নতুন করে শুরু করার ভাষা। এ ভাষা বাইরের বাস্তবতা যতটা স্বচ্ছন্দভাবে প্রকাশ করে, ভেতরের বাস্তবতা অথবা ভেতর-বাইরের অপ্রকৃত, অবাস্তব বিষয়গুলি প্রকাশ করে ততটাই কঠিনভাবে, সময় নিয়ে, কিছুটা সন্দেহ রেখে দিয়ে। যতবার কাফকাকে পড়েছি, প্রতিবার তাঁর ভাষাকে মনে হয়েছে যেন ট্রেনে বসে দেখা বাইরের প্রকৃতি- যেন দু’টিই সচল, আবার ট্রেনটি যেন থমকে আছে, প্রকৃতি সচল। ভেতর-বাইরের বিভ্রম এত নান্দনিক এবং অনিশ্চিতভাবে কাফকার মতো খুব কম লেখকই দেখাতে পেরেছেন।

আর তাঁর কৌতুকবোধ যেন ঠাট্টার এক কৌশলী কারিগরি। তাঁর অনেক চরিত্রই, তাদের চরিত্রায়নের মধ্য দিয়ে, আমাদের প্রতিদিনের ইট-কাঠ কড়ি বর্গার আর বাজার-অফিস-রাস্তা মাপার জীবনকে নিয়ে করুণ ঠাট্টা করতে পারে। কাফকার হিউমার মানুষকে হাসায় না, বরং তাকে বিমর্ষ করে এবং সেই বিমর্ষতা নিয়ে ঠাট্টা করতে শেখায়।

কাফকার গভীরতা এখনও মাপছি। কিন্তু যেটুকু মাপা হয়েছে- কতটা ঠিক-বেঠিক হয়েছে বলতে পারব না- তা সম্ভব হয়েছে তাঁকে পড়াতে গিয়ে। বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আমার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই পঞ্চাশ বছর কাফকাকে পড়ছি-পড়াচ্ছি। ফলে কাফকা পড়তে বসলে তাঁর দ্য ক্যাস্ল উপন্যাসের ল্যান্ড সার্ভেয়রের মতো আমাকে এক অনিশ্চিত, অসম্পূর্ণ দ্বিধান্বিত কাফকা সার্ভেয়রের মতোই মনে হয়। (সমাপ্ত)

ছবি

চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে গ্রন্থ

ছবি

ভিন্নচোখ: নুতন কবিতা সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকা: মৃত্যুর রূপক এবং আন্দালুসিয়ার লোকজ বিশ্বাস

ছবি

কবিতার শিল্পনিষ্ঠ রূপকার ফারুক মাহমুদ

ছবি

কবি নওশাদ নূরী

ছবি

আঁধার পেরিয়ে আলোর উদ্ভাষণ

ছবি

সন্জীদা খাতুন : কৃতি ও কৃতিত্ব

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

মননশস্যের অমৃত মন্থন

ছবি

অনুবাদ ও ভূমিকা : আলী সিদ্দিকী

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বড়শি

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

এ মুখর বরষায়

ছবি

রক্তে লেখা প্রেম: রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিপ্লব

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শঙ্খজীবন: যাপিত জীবনের অন্তর্গূঢ় প্রতিকথা

ছবি

ওসামা অ্যালোমার এক ঝুড়ি খুদে গল্প

ছবি

প্রযুক্তির আলোয় বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

কাফকার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

সূর্যের দেশ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

লড়াই

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রচলিত সাহিত্যধারার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন মধুসূদন

ছবি

মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন

ছবি

উত্তর-মানবতাবাদ ও শিল্প-সাহিত্যে তার প্রভাব

ছবি

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

দুই ঋতপার কিসসা এবং এক ন্যাকা চৈতন্য

tab

সাময়িকী

কাফকাকে পড়া কাফকাকে পড়ানো

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ফ্রান্ৎস কাফকা

বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

বাস্তবের উল্লেখ কাফকার লেখালেখির আরেকটি বিষয়ের দিকে আমাদের নিয়ে যায়, এবং তা হচ্ছে বাস্তব-অবাস্তব দ্বন্দ্ব। এর অনেকগুলি দিক রয়েছে, যেমন, একটু আগে যেমন বলা হলো, কাফকীয় জগতের অনুভূত অবাস্তবতা- গ্রেগর সামসা যেমন, কিছুতেই বুঝতে পারে না, সে কি বাস্তবে আছে, না কোনো ঘোর অবাস্তবে? অথচ গল্পটি আমাদের দেখায়, গ্রেগরের পরিবারের কাছে তার মেটামরফসিস ভয়ানক, দুর্বিষহ বাস্তব, ফলে বাস্তব যে প্রকৃতই বাস্তব, একটা বিশাল বিভ্রমের নাম নয়, সে প্রশ্নটাও ওঠে। পাশাপাশি কাফকা আরও একটি মেটামরফসিস দেখান যা গ্রেগরের পরিবারের। তাদেরও বিবর্তন ও রূপান্তর ঘটে- তারা গ্রেগরের পরিবার আর থাকে না, গ্রেগর তাদের কাছে এক দুঃস্বপ্ন। সে মারা গেলে তাই ঘরের চার দেয়ালের রুদ্ধ পরিসরে তৈরি হতে থাকা গল্পের সমাপ্তি ঘটে বিকেলের সুন্দর আলোয়, এক পার্কে, যেখানে মেয়ে যে বিবাহের উপযুক্ত হয়েছে, বাবা মায়ের এই উপলব্ধি এক নতুন জীবনের সন্ধানে যায়। ফিলিস্তিনের গাজাতে এখন যা ঘটছে- প্রতিদিন পঞ্চাশ-একশ’ জন ফিলিস্তিনিকে বোমা মেরে, শেল ছটুড়ে খুন করছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী, যাদের একটা অংশ শিশু- এর মতো নির্মম বাস্তব আর কিছু কি হতে পারে? অথচ সারা দুনিয়ার কাছে এটি যেন স্বাভাবিক কোনো ঘটনা। কোনো প্রতিবাদ নেই, কোনো দুঃখবোধও যেন নেই। যেন বাস্তব যা ঘটছে তা যেন গ্রেগর সামসার মতো, ওই ভিকটিমরাই শুধু অনুভব করছে, যদি মৃত্যুর আগে অনুভব করার মতো সময় তারা পায়, অথবা আহত হয়ে ভেঙ্গে পড়া দালানের ইট-সিমেন্টের নিচে পড়ে যতক্ষণ, যতদিন বাঁচে ততক্ষণ বা ততদিন। গাজায় যা ঘটছে তা যেন দ্য ট্রায়াল-এর মতো- এক সকালে জোসেফ কে’র কাছে হঠাৎ গ্রেপ্তারি তথা মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হওয়া এবং একসময় তার বৈধতা পাওয়া। কোন দোষে মানুষগুলি, নারী-শিশুগুলি মরছে, তারা জানে না। প্রতিকারহীন এই সময়ে তাদের কাছে জীবনটা কাফকীয়, যাতে কোনো অর্থ খটুজে পাওয়াটা মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে মৃত্যুর ব্যবসা করা ইসরায়েল রাষ্ট্রের নির্যাতনের নিচে অসম্ভব। এই প্রসঙ্গে কাফকা সম্পর্কে থিওডোর এডর্নো তাঁর নোট্স অন কাফকা গ্রন্থে (১৯৫৩) যা বলেছেন, তা ভেবে দেখার মতো। এডর্নো বলেছেন, কাফকার বর্ণিত জগৎ প্রকৃত-অপ্রকৃতের বাইরের এক জগতের মতো, যা ধরা দেয় মানুষের সামষ্টিক স্মৃতিবাহিত হয়ে, যাকে ফরাসি ভাষায় ফবলধ াঁ বলা হয়, অর্থাৎ যা ইতিমধ্যে দেখা হয়ে গেছে, যার ভেতর দিয়ে যাওয়া হয়ে গেছে। কাফকার গল্প-উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনাগুলি তো মানবজাতির দেখা হয়ে যাওয়া ঘটনা। এসব মানুষ স্মৃতি থেকে, অনুভূতি থেকে বুঝে নিতে পারে। ডিজিট ম্যাগাজিন-এ ১৭.০৬.২০২৪ তারিখে প্রকাশিত সংখ্যায় এক মেধাবী সমালোচক ক্যাথারিন হুবার তাঁর “লাইস, ল’স, এ্যান্ড লিটারেচার : হোয়াট ফ্রান্ৎস কাফকা টিচেস আস এবাউট পাওয়ার এ্যান্ড পলিটিক্স টুডে” প্রবন্ধেও এর উল্লেখ করেছেন। মিথ্যা এবং আইনের যুগলবন্দী বোধগুলি আমাদের সময়ের প্রায় প্রত্যেক দেশে তাদের নাগরিকদের এক কাফকীয় বাস্তবতা-অবস্তাবতার ভেতর দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। আমাদের এই উপমহাদেশের আদালতগুলির স্থাপত্যে কাফকীয়তা ইট-কাঠ-সিমেন্ট থেকেও বোধ করি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এক নির্মাণ-উপাদান। এসব আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কত অপরাধী দিনশেষে ‘নিরপরাধ’ প্রমাণিত হয়ে যায়, আর কত নিরপরাধ মানুষ অপরাধী হয়ে যায়। যা ভয়ের কথা তারা যে অপরাধী সেটি প্রমাণ করার ক্ষেত্রে নিজেদেরও জড়িয়ে ফেলতে তারা বাধ্য হয়। একজন অভিযুক্তকে যখন রিমান্ডে নেয়া হয়, সে আর পুলিশের মাঝখানে কে থাকে? কোনো আইনজীবী? আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কেউ? আইনের কোনো এ্যাক্টিভিস্ট শিক্ষক বা শিক্ষার্থী? নাকি এক ভয়াবহ শূন্যস্থান, যা পূরণ করে তার বেঁচে থাকার আকুলতা? কাঠগড়ায় যখন কোনো অভিযুক্ত, জোসেফ কে’র মতো নিজেকেই অভিযুক্ত করার কাজটি করে, যে অপরাধবোধে সে আক্রান্ত হয় তার শুরুটা ওই মিথ্যাকে সত্য বানানো (বে)আইনি প্রক্রিয়া, আর শেষটা নিজস্ব একটা অপরাধবোধ, যা একসময় সে হয়তো বিশ^াসই করে বসে। অর্থাৎ দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ হ্যানা আরেন্ট যেমনটা বলেন (তাঁর ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত “কাফকা : এ রিভ্যালুয়েশন” প্রবন্ধে), মানুষ যখন তার প্রকৃত এবং কল্পিত অপরাধবোধকে (কেউ যেহেতু অপরাধ থেকে মুক্ত নয়, ফলে কোনো না কোনো ধরনের অপরাধবোধ থেকেও) তার মনের ভেতরে স্থান দিয়ে ফেলে, তখন বাস্তব আর অবাস্তবের পার্থক্যটা সরে যায়। এজন্য দ্য ট্রায়াল উপন্যাসটিকে তিনি দেখেছেন জোসেফ কে’র এক ধরনের উন্মাদ অবস্থার রূপায়ন, যে অবস্থানটি বহিস্থ কোনো শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এবং যার কেন্দ্রে আছে মানুষের অসহায়ত্ব।

তবে আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় ঠেকেছে বাস্তব-অবাস্তব নিয়ে করা পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের একটি মন্তব্য (যা তাঁর ১৯৫৮ সালে লিখিত প্রবন্ধ “দ্য রেপ্রেজেন্টেশন অফ নেচার ইন কন্টেম্পরারি ফিজিক্স” প্রবন্ধে করেছেন)। হাইজেনবার্গ বলেছেন, পুরনো প্রথা অনুযায়ী সময় ও পরিসরের (স্পেস-এর) মাপে ফেলে পৃথিবীকে একটি নৈর্ব্যস্তুক প্রক্রিয়ার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে, যাতে মানুষের আত্মারও প্রতিফলন ঘটে। বিজ্ঞান, এই সময়ে, বরং প্রমাণ করেছে যে মানুষ আর প্রকৃতির আন্তসংযোগ এমন জটিল এবং বহু পথে বিস্তৃত এক প্রক্রিয়া যে কোনো এক রৈখিক মাপে তাকে ফেলা যায় না। ফলে এক রৈখিক বাস্তব বলে কিছু নেই। অবস্তাবও কোনো ধরে নেয়ার মতো বিষয় নয়, যেহেতু এটি ধরা-ছোঁয়া এড়িয়েই থাকতে চায়। দ্য ক্যাসল পড়ে আমার মনে হয়েছিল দুর্গের পুরনো একক স্থাপত্য বাদ দিয়ে কাফকা যে অনেক দালানের সমষ্টিতে গড়া একটা বহুবিধ স্থাপনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তাতে এই খ-ায়নকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কুড়ি শতকের দ্বিতীয় দশকে চিত্রকলায় ঘনত্ববাদ বা কিউবিজম যখন শুরু হলো, পিকাসো, ব্র্যাখ প্রমুখের হাত ধরে বাস্তবের খ-িত রূপগুলি কোনো নতুন বাস্তবে বা অবাস্তবে তা আমাদের নিয়ে যায় সেই জিজ্ঞাসাটি প্রধান হয়ে উঠল। কিউবিজম-এর এক মূল সূত্র ছিল বহিরাবরণের পেছনে লুকিয়ে থাকা ভেতরটার স্বরূপ উন্মোচন করা। গ্রেগর সামসার ভেতরে যে পোকা লুকিয়ে ছিল- সকলের মধ্যেই যে পোকা কম বেশি থাকে- তা যখন বোঝা গেল, তখন সামসার পৃথিবী প্রকৃত থেকেও অপ্রকৃত হয়ে গেল।

কতভাবেই না কাফকাকে পড়া যায়। কিউবিজমের সঙ্গে কাফকার বর্ণিত পৃথিবীর সাদৃশ্যটা আমি বুঝতে পারি আমেরিকার ইয়েল বিশ^বিদ্যালয়ের চিত্রকলা প্রদর্শনী ঘরে রাখা পিকাসোর সংগ্রহ দেখা শেষে এক কাফেতে বসে কফি খেতে খেতে। এক বৃদ্ধ লাঠি হাতে কাফের বাইরের রাস্তা পার হতে চাইছিলেন, কিন্তু পারছিলেন না। এক তরুণী তাঁকে সাহায্য করতে চাইল, তিনি হেসে সেই সহায়তার ডাক ফিরিয়ে দিলেন। তারপর তিনি এক বেঞ্চে বসে পড়ে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমার মনে হলো তিনি হয়তো রাস্তা পার হতে চাইছেন না, প্রক্রিয়াটার মধ্য দিয়ে কীভাবে যাওয়া যায়, তাই নিয়ে শুধু ভাবছেন। তাঁর কাছে দেখা পৃথিবীর যে রূপ, তার সঙ্গে তাঁর বিরোধটা সময়ের। পুরনো মানুষটা নতুনকে, অথবা নতুন সময়ে এসে পুরাতনকে বোঝার চেষ্টা করছেন। অথবা করছেন না। পিকাসো মানুষ, বস্তু, দালান, বাদ্যযন্ত্র- যাই আঁকুন না কেন, একই সঙ্গে একাধিক প্রেক্ষাপটে তাকে স্থাপন করেছেন। তাতে এক মানুষ বহু মানুষ, এক বস্তু বহু বস্তু হয়ে দেখা দেয়। শেক্সপিয়ারের ভাষায় এই বৈচিত্র্য অন্তহীন- ‘রহভরহরঃব াধৎরবঃু’। তবে সমস্যা হলো, রাষ্ট্র, কর্তৃত্ববাদ, আইন, প্রতিষ্ঠান এই অনন্ত বোঝে না, বৈচিত্র্যও বোঝে না। মানুষের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব তাই চিরন্তন। কিন্তু রাষ্ট্র, আইন ইত্যাদি তো মানুষেরই সৃষ্টি। হ্যাঁ, ক্ষমতাবান মানুষ, যখন সে তাজা থাকে, সেই মানুষের সৃষ্টি। যখন সে বার্ধক্যে নুয়ে পড়ে, কাফের বাইরের রাস্তার পাশে বসা মানুষটার মতো, সে বুঝতে পারে, এই তৈরি পৃথিবীতে তার খাপ খায় না। সে মিসফিট।

কাফকার গল্প-উপন্যাসে এই দ্বন্দ্বগুলি ভাষা পায়। আমি দেখেছি, আমার শিক্ষার্থীরা যখন নিজেদের মতো করে ভাবে, তারা কাফকাতে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারে। কারণ কাফকার সাহিত্য সেই কিউবিস্ট ছবির মতো একই সঙ্গে অনেক পার্সপেক্টিভ ধারণ করে, অনেক ব্যাখ্যা ও সম্ভাবনাও।

কাফকাকে পড়াতে গেলে তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলি সময় নিয়ে আরেকবার পড়তে হয়, এবং যে কোনো লেখককে সময় দিলে তাঁর অনেক অদেখা দিক চোখে পড়ে, অনেক দিক নতুনভাবে উন্মোচিত হয়। এরকম তিনটি দিক নিয়ে সংক্ষেপে বলব, যেগুলি কাফকার সৃষ্টিবৈচিত্র্যের মাত্রাটি আমার কাছে আরেকটু গভীর করেছে। একটি হচ্ছে সেই পুরনো যোগাযোগের সমস্যা। মানুষ যখন সংসারের এবং সমাজের কাঠামো তৈরি করল, তখন থেকেই সেই সমস্যা দেখা দিল। মানুষদের ভেতর যে যোগাযোগ, তার কতটা অর্থবহ? মানুষ কি মানুষের সঙ্গে সত্যিকারভাবেই সংযুক্ত হতে পারে? এই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটি, দ্বিধাহীনভাবে, না। কাফকা দেখান, মানুষের একটি বড় ট্র্যাজেডি যদি হয় এই যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থতা, তাহলে তার বড় ট্র্যাজেডি হচ্ছে নিজের সঙ্গে যোগাযোগের অক্ষমতা। তাঁর প্রধান চরিত্রগুলি নিজেদের ভেতরে থাকা নানা চোরাবালিতে হারিয়ে যায়। তখন এক মানুষ অনেক মানুষ হয়ে যায়, সেই মার্শেল ডুশাম্পের সিঁড়ি বেয়ে নামা নগ্নিকা-র মতো। কাফকা যা দেখান, সেই অনেক মানুষে থাকে অ-হারানো মানুষ, আধখানা মানুষ, আপাত সমাপ্ত মানুষ, অসমাপ্ত মানুষ। কাফকা মানুষের পাপ নিয়ে তেমন কথা বলেননি, ট্র্যাজিক অক্ষমতা নিয়ে বলেছেন। তবে ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের মতে তাঁর লেখার যে অতিপ্রাকৃতিক অর্থাৎ ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়, তাতে ধর্মের ভেতর কাফকার উঁকি দেয়ার বিষয়টি আন্দাজ করা যায়। তাহলে মানুষের যোগাযোগ অক্ষমতা কি তার আদিপাপ? আদমের স্বর্গ থেকে বহিষ্কারের পেছনে ছিল যে পাপ, তা ছিল তার নিষিদ্ধ জ্ঞানের আকাক্সক্ষা। তাহলে যে জ্ঞান মানুষকে অচল করে দেয়, অর্থাৎ আত্মজ্ঞান- যেহেতু তা সমীনাচিহ্নিত অথচ যা অনন্তের আকাক্সক্ষা ধারণ করে, এবং যা মেনে নিতে কোনো কর্তৃত্ব রাজি নয়, তা-ই তাহলে তাকে যোগাযোগ-অক্ষম করে। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে মানুষের যোগাযোগ সীমিত, নিয়ন্ত্রিত; তার ওপর নজরদারি চলে সর্বক্ষণ। সেই নজরদারি মেনে নিতে মানুষ হয়তো একসময় নিজের ওপর নজরদারি চালাতে থাকে। তাতে তার ভাষাটাও তার অধিকারে থাকে না। এর সূত্র ধরে ভাষার প্রসঙ্গটি আসে। ভাষা কি শুধু অক্ষরে-শব্দে সাজানো ব্যাকরণ মানা (প্রমিত, অপ্রমিত যে কোনো অর্থে) বাক্যে বিন্যস্ত উচ্চারণ? ভাষা কি এসব থেকে উর্ধে থাকতে পারে না? গ্রেগর সামসা পোকা হয়ে গেলে তার ভাষা হারিয়ে যায়। কোন ভাষা? তার প্রতিদিনের যোগাযোগের ভাষা, তার অর্থপূর্ণ প্রকাশের ভাষা। কিন্তু ভাষা হারালেও নিজের কাছে সে ভাষাহীন নয়। ভাষাকে মানুষ যখন পোশাকী করেছে, যোগাযোগের মান হিসেবে ধরে নিয়েছে, তার সৃজন ও মননশীল কর্মের প্রকাশ মাধ্যম হিসেবেও, সেদিন ভাষা একটা বেড়া ঘেরা জায়গার ভেতরে হয়তো চলে যায়, যা ডিঙ্গালে রাষ্ট্র মানুষকে শাস্তি দেবে। ভাষা নিষিদ্ধ হয়, ভাষা হারিয়ে যায়। এজন্য কাফকার প্রতিটি গল্প উপন্যাসে ভাষার বিন্যাসকে খুঁটিয়ে দেখতে হয়। দ্য ট্রায়াল-এর ইংরেজি অনুবাদেও বোঝা যায়, ভাষাকে কতটা কঠিন বিন্যাসে ফেলেছেন তিনি, যখন প্রয়োজন তার ভেতর ব্যাপ্তি অথবা ঘনবদ্ধতা এনেছেন। তাঁর ভাষাকে যদি মন দিয়ে পড়া হয়, শুধু তাঁর ভাষাকে, বোঝা যাবে কতটা স্থিতিস্থাপক তিনি তাঁর ভাষাকে হতে দিয়েছেন, যেহেতু তাঁর সেই কাফকীয় পৃথিবীর একটি চাবি আছে সেই ভাষাতে।

আর এতক্ষণ যে কাফকাকে পড়ার নানা পথের সন্ধান আমরা করলাম, যা আমার মনোযোগী শিক্ষার্থীদের অনেকেই পরিশ্রম করে (শেষ বিচারে আনন্দের সঙ্গে) করেছে, তার পেছনে যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রবণতা থাকে, তাকেই একসময় তার কোনো কোনো পাঠক প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। কাফকাকে ব্যাখ্যা করা, তাঁর নানা রহঃবৎঢ়ৎবঃধঃরড়হ হাজির করা এক কঠিন এবং সময় ও পাঠসাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু একসময় এ প্রশ্নটাও তো ওঠে, যেমন দু’এক কাফকা আলোচক করেছেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া, কাফকার নিজের কথা মেনে, ব্যাখ্যার দায়িত্ব তাঁকেই দিয়ে, তাঁকে পড়লে কেমন হয়? কেমন হয যদি তাঁর দ্য ক্যাসল তাঁর চোখেই আমরা দেখি, তাঁর “এ হাঙ্গার আর্টিস্ট” গল্পের মূল চরিত্র কেন একটা খাঁচায় অনশনে বসে, কেন অনশনটাকে সে একটা স্পেক্ট্যাকল-এ পরিণত করল, সেসব তার কাছ থেকেই আমরা শুনি, তার শেষ কথাগুলি আমলে নিয়ে তার মৃত্যুর পর তার খাঁচায় পুরে দেয়া প্যান্থারটির সঙ্গে আমরা নিজেরাই তার তুলনা করি, অথবা “ইন দ্য পিনাল কলোনি”র চার চরিত্রের কথাগুলি তাদের মুখে শুনি, এবং শেষ পর্যন্ত ওই শাস্তির দ্বীপে যে অত্যাচার-যন্ত্রটি আছে, তা যে নষ্ট হতে হতে শেষ হত্যাকা-টি ঘটালো, তার প্রকৃত রূপটি বোঝার চেষ্টা গল্পটা পড়তে পড়তে করি। তবে সমস্যা হলো, সাহিত্য পাঠটা আদতে ইন্টারপ্রিটেশন এবং ব্যাখ্যারই ব্যাপার। লেখক তাঁর মতো করে লিখে ফেললেন, ফলে যা বলার তিনিই বলবেন, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না। প্রথমত, লেখক যে লিখলেন, তিনি কোন জন? বাইরে থেকে তাঁকে যতটা চেনা যায়, তা-ই কি সব? ভেতরের জন যে ভিন্ন একজন নয়, তা নিশ্চিত করে কে বলতে পারবে? সেই ড. জেকিল ও মিস্টার হাইডের বড় বিভাজন বাদ দিলেও, ছোটখাটো বিভাজনেও মানুষ বিভাজিত। কাফকা সম্পর্কে বলা হয়, তিনি এক কাফকার মধ্যে বহু কাফকা- ইডিপাস জটিলতায় ভোগা কাফকা, একাকী-নিঃসঙ্গ কাফকা, ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ওকালতি করা-চাকরিজীবী কাফকা, ম্যাক্স ব্রডের বন্ধু কাফকা, নারীসঙ্গপীড়িত (উভয় অর্থে) কাফকা, প্রাগ শহরের নানা অর্থে সংখ্যালঘু কাফকা, এবং জোসেফ কে অথবা কে-তে মিশে থাকা কাফকা। তাঁর গল্প-উপন্যাসের যেসব তিনি রাতে লিখেছেন, এবং স্যানাটোরিয়াম বা স্বাস্থ্যনিবাসে থাকার সময়, সেগুলি যে-কাফকা লিখেছেন, তাঁকেও বিবেচনায় নিতে হবে। তাহলে কোন সে কাফকা যিনি “দ্য মেটামরফসিস” লিখেছেন, এবং কতটা লিখেছেন- এই প্রশ্ন তো ওঠে। তাহলে এ নিয়ে এই কাফকার সঙ্গে অন্য কাফকাদের মতের মিল নাও তো থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, একজন লেখককে দিয়ে, নব্য ইতিহাসবিদরা যেমন বলেন, তাঁর সময় ও তাঁর সময়ের ইতিহাস তার গল্প-উপন্যাসগুলি লিখিয়ে নেয়। যদি এই চিন্তাটি কিছুটা বৈধ বা যৌক্তিক বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলেও তো লেখক একজন স্বয়ম্ভু ¯্রষ্টার অবস্থানে থাকেন না। এজন্য একজন লেখক যে মুহূর্তে তাঁর লেখাটি ছাপতে পাঠিয়ে দেন, এর রহঃবৎঢ়ৎবঃধঃরড়হ-এর ভারটা তিনি লেখক-আলোচক-সমালোচক-তত্ত্ববিদের হাতে ছেড়ে দেন। মজার ব্যাপার হলো, কাফকাকে নিয়ে যত আলোচনা এ পর্যন্ত হয়েছে, তাতে তিনি আরো বেশি অন্তরঙ্গতা নিয়ে পাঠকের কাছে ধরা দিয়েছেন।

কাফকাকে পড়াতে গেলে আরো যে দু’টি বিষয় একসময় গুরুত্ব পায়- তাঁর লেখার ভাষা এবং তাঁর লেখালেখিতে যে এক ধরনের শুষ্ক, অনেকটা ভেতর থেকে কাটতে থাকা হিউমার বা অম্লমধুর কৌতুকবোধের দেখা পাওয়া যায়- যার উৎস, অনেক আলোচকের মতে, ইহুদী ঐতিহ্যের হিউমারের মধ্যে শনাক্ত করা যায়- সে দু’টি আমলে নিয়ে একসময় তাঁর সাহিত্য কেন আমাদের টানে তা বোঝা যাবে। কাফকার সাহিত্যকে কেউ বলেন একটি ভাষিক প্রকল্প, কেউ বলেন ভাষাগত প্রকৌশল। গুরুত্ব দিয়েই বলেন, কারণ ভাষায় তিনি নিজেকেই বিনিয়োগ করেছেন। ম্যাক্স ব্রড এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, নিজেকে সবসময় অরক্ষিত ভাবতেন কাফকা এবং বলতেন, তাকে সুরক্ষা দিয়েছে নিজের সঙ্গে তার নিজের কথা বলার সামর্থ্যটি। ভাষাটিও তাঁর নিজস্ব। তাঁর বাক্যগুলি শুরু হয় সহজভাবে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই কমা ও ক্লজের আকীর্ণতায় কঠিন হয়ে ওঠে। এই ভাষা দ্রুত বলা ভাষা নয়- বরং সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বলা, এক পা এগিয়ে, দু’পা পিছিয়ে এসে নতুন করে শুরু করার ভাষা। এ ভাষা বাইরের বাস্তবতা যতটা স্বচ্ছন্দভাবে প্রকাশ করে, ভেতরের বাস্তবতা অথবা ভেতর-বাইরের অপ্রকৃত, অবাস্তব বিষয়গুলি প্রকাশ করে ততটাই কঠিনভাবে, সময় নিয়ে, কিছুটা সন্দেহ রেখে দিয়ে। যতবার কাফকাকে পড়েছি, প্রতিবার তাঁর ভাষাকে মনে হয়েছে যেন ট্রেনে বসে দেখা বাইরের প্রকৃতি- যেন দু’টিই সচল, আবার ট্রেনটি যেন থমকে আছে, প্রকৃতি সচল। ভেতর-বাইরের বিভ্রম এত নান্দনিক এবং অনিশ্চিতভাবে কাফকার মতো খুব কম লেখকই দেখাতে পেরেছেন।

আর তাঁর কৌতুকবোধ যেন ঠাট্টার এক কৌশলী কারিগরি। তাঁর অনেক চরিত্রই, তাদের চরিত্রায়নের মধ্য দিয়ে, আমাদের প্রতিদিনের ইট-কাঠ কড়ি বর্গার আর বাজার-অফিস-রাস্তা মাপার জীবনকে নিয়ে করুণ ঠাট্টা করতে পারে। কাফকার হিউমার মানুষকে হাসায় না, বরং তাকে বিমর্ষ করে এবং সেই বিমর্ষতা নিয়ে ঠাট্টা করতে শেখায়।

কাফকার গভীরতা এখনও মাপছি। কিন্তু যেটুকু মাপা হয়েছে- কতটা ঠিক-বেঠিক হয়েছে বলতে পারব না- তা সম্ভব হয়েছে তাঁকে পড়াতে গিয়ে। বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আমার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই পঞ্চাশ বছর কাফকাকে পড়ছি-পড়াচ্ছি। ফলে কাফকা পড়তে বসলে তাঁর দ্য ক্যাস্ল উপন্যাসের ল্যান্ড সার্ভেয়রের মতো আমাকে এক অনিশ্চিত, অসম্পূর্ণ দ্বিধান্বিত কাফকা সার্ভেয়রের মতোই মনে হয়। (সমাপ্ত)

back to top