বিমল গুহ
ফারুক মাহমুদ / জন্ম : ১৭ জুলাই ১৯৫২
স্বাধীনতা-উত্তরকালে এ অঞ্চলের মানুষের চেতনায় যে-প্রবল স্রোত বয়ে যায়, তার বেগবান ধারাটি ছিলো সাহিত্য; বিশেষ করে কবিতা। সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ তখন অনিবার্য প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছিলো। সেই সময়-পরিসরে বাংলাদেশের সাহিত্যভুবনে আবির্ভূত হয় একদল নবীন সাহিত্যকর্মী। অন্তরের তাগিদেই তাঁরা এসেছিল; তীব্র আবেগেরও একটা ব্যাপার তখন ছিলো। নতুন দেশপ্রাপ্তির আনন্দে বিভোর জাতি। কবি-সাহিত্যিকগণের চেতনায়ও আসে নতুন জোয়ার। নবীন-প্রবীণ কবিরা লিখেছেন জাতির মহান লগ্নের সেইসব অনুভূতি তাঁদের কবিতায়- যা কাল-চিহ্নিত সময়ের ফসল। কবিতা এমন এক শিল্প-মাধ্যম, যা মানুষের বোধকে জাগিয়ে তুলতে পারে একটি শব্দের টোকায়। সমাজকে মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারে। কবিতার শব্দের শক্তি, কর্মজীবী মানুষকেও তাদের কাজে বাড়তি শক্তির জোগান দিতে পারে। এমনকি প্রতিবাদী শব্দের দ্যোতনা যুদ্ধের মাঠে যোদ্ধাদেরও সাহস জোগাতে পারে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে আমাদের কবিতা প্রবল প্রতাপে এগিয়ে যেতে থাকে। রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য জেলা শহরে কবিতাশিল্পের জোয়ার বয়ে যায়! শিল্পের স্বাভাবিক নিয়মে শেষাবধি টিকে থাকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন। তবুও সাহিত্যের ইতিহাসে সকলের অবদান অঙ্কিত থাকে উজ্জ্বল অক্ষরে। আজ যে-কজন কবি স্বাধীনতা-উত্তর কবিতার প্রতিনিধিত্ব করছেন, ফারুক মাহমুদ তাঁদের একজন। এঁরা বড় জায়গা দখল করে আছেন আমাদের কবিতায়। বাংলা কবিতারও অন্যতম প্রতিনিধি কণ্ঠস্বর এঁরা। ভাবতে অবাকই লাগে- কীভাবে সময় বয়ে যায়! সেই কবিকুল আজ প্রৌঢ় হতে চলেছেন।
কবি ফারুক মাহমুদ ৭৪ বছরে পদার্পণ করলেন আজ। জন্ম ১৯৫২ সালের ১৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের ভৈরবে, হাওর-বাওর অধ্যুষিত অঞ্চলে। সেখান থেকে একসময় উচ্চশিক্ষার জন্য আসেন ঢাকায়। সত্তরের এক তুমুল ঝড়ের সহযাত্রী হিসেবে তখন পেয়েছিলেন একঝাঁক তরুণ মেধাবীদের- যাঁরা পরবর্তীকালে বাংলা কবিতায় রেখেছেন অসামান্য স্বাক্ষর। আমারও ফারুক মাহমুদকে নিবিড়ভাবে দেখার ও পাঠের সুযোগ হয়েছে, একজন সতীর্থ হিসেবে। কবিতার নানান বিষয়ে আমাদের মধ্যে একান্ত আলোচনা হয় প্রায়শই। কবিতার এমন বহু বিষয় রয়েছে, যা পরিণত বোধের আলোচনায় কূল পেতে পারে। কবিতা তো অংক নয়, দুয়ে-দুয়ে চার হবে! কবিতা ব্যক্তিগত বোধে ও মননে ধারণের মতো বিষয়। এর নানা অনুষঙ্গ- অলংকার, শিল্পসুষমা, দর্শন ইত্যাদি ব্যক্তির নিজস্ব বোধের ও প্রয়োগের বিষয়, যা একজন কবিকে বিশিষ্টতা দেয়।
ফারুক মাহমুদের কবিতা সৃষ্টিমানসের চেতনাজাত উচ্চারণ। কবিতার শব্দ, ইঙ্গিত, রূপকল্প আপনা থেকে যখন কবির বোধে নাড়া দেয়, তখন তা শিল্পের আদলে প্রকাশ পায়। ফারুক মাহমুদের কবিতা পাঠ করলে এই বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। তিনি শিল্পের শাসন মেনে চলেন, যে কারণে তাঁর কবিতা পাঠকপ্রিয় হয়েছে। আমাদের কবিতার ভুবনে পরিণত বোধ ও মননের মানুষ তিনি। তাঁর প্রথম কাব্য ‘পাথরের ফুল‘ প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা‘ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। তাঁর অন্য কাব্যগ্রন্থ- ‘অপূর্ণ তুমি আনন্দ বিষাদে’, ‘অনন্ত বেলা থেকে আছি’, ‘এত কাছে এত দূরে’, ‘সৌন্দর্য হে ভয়ানক’, ‘বাঘের বিষণœ দিন’, ‘হৃদয়ে প্রেমের দিন’, ‘অন্ধকারে মুগ্ধ’, ‘রৌদ্র ও জলের পিপাসা’, ‘ভ্রƒণপদ্য’, ‘ফিরে যাবো দূরত্বের কাছে’, ‘সামান্য আগুন যথেষ্ট জীবন’, ‘মহাভারতের প্রেম’, ‘আগুনে আপত্তি নেই’, ‘দাগ নয় চিহ্ন’, ‘দুই হৃদয়ের নদী’, ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ কাব্য ‘দ-িত ঘোড়ার স্বপ্ন’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২৪ সালে। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ- ‘কবি লিখলেন মেঘ’; উপন্যাস- ‘খুন হলেন কালিদাস‘। শিশুকিশোর সাহিত্যে তাঁর উল্লেখ করার মতো অবদান রয়েছে।
ফারুক মাহমুদের উচ্চারণ পরিশীলিত ও শিল্পসম্মত। কবিতার উচ্চারণে থাকে ব্যক্তির অন্তর্গত চেতনার শিল্পিত প্রকাশ- যা মানববোধের ইঙ্গিতবাহী শিল্প। কবিতার বেলায় বাচ্য নয়, বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনাই প্রধান অনুষঙ্গ। এতে লুকিয়ে থাকে রহস্য। এই রহস্য কবিতার ভিত্তি। তাই সকল উচ্চারণ সফল কবিতা হয় না। জীবনানন্দ বলেছেন, আধুনিক কবির ‘হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা’ থাকে। এই ‘অভিজ্ঞতার সারবত্তা’র প্রকাশ মানুষের কল্যাণের বিপরীতে হয় না। কবি হবেন সুন্দরের পূজারী, মানবপ্রেমী। তাঁর চিন্তা সর্বদা কল্যাণমুখী। ফারুক মাহমুদের কবিতা এসব বিবেচনায় উত্তীর্ণ এক শব্দশিল্প।
আজ কবির জন্মদিন। কবির জন্য শুভ কামনা।
বিমল গুহ
ফারুক মাহমুদ / জন্ম : ১৭ জুলাই ১৯৫২
বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫
স্বাধীনতা-উত্তরকালে এ অঞ্চলের মানুষের চেতনায় যে-প্রবল স্রোত বয়ে যায়, তার বেগবান ধারাটি ছিলো সাহিত্য; বিশেষ করে কবিতা। সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ তখন অনিবার্য প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছিলো। সেই সময়-পরিসরে বাংলাদেশের সাহিত্যভুবনে আবির্ভূত হয় একদল নবীন সাহিত্যকর্মী। অন্তরের তাগিদেই তাঁরা এসেছিল; তীব্র আবেগেরও একটা ব্যাপার তখন ছিলো। নতুন দেশপ্রাপ্তির আনন্দে বিভোর জাতি। কবি-সাহিত্যিকগণের চেতনায়ও আসে নতুন জোয়ার। নবীন-প্রবীণ কবিরা লিখেছেন জাতির মহান লগ্নের সেইসব অনুভূতি তাঁদের কবিতায়- যা কাল-চিহ্নিত সময়ের ফসল। কবিতা এমন এক শিল্প-মাধ্যম, যা মানুষের বোধকে জাগিয়ে তুলতে পারে একটি শব্দের টোকায়। সমাজকে মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারে। কবিতার শব্দের শক্তি, কর্মজীবী মানুষকেও তাদের কাজে বাড়তি শক্তির জোগান দিতে পারে। এমনকি প্রতিবাদী শব্দের দ্যোতনা যুদ্ধের মাঠে যোদ্ধাদেরও সাহস জোগাতে পারে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে আমাদের কবিতা প্রবল প্রতাপে এগিয়ে যেতে থাকে। রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য জেলা শহরে কবিতাশিল্পের জোয়ার বয়ে যায়! শিল্পের স্বাভাবিক নিয়মে শেষাবধি টিকে থাকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন। তবুও সাহিত্যের ইতিহাসে সকলের অবদান অঙ্কিত থাকে উজ্জ্বল অক্ষরে। আজ যে-কজন কবি স্বাধীনতা-উত্তর কবিতার প্রতিনিধিত্ব করছেন, ফারুক মাহমুদ তাঁদের একজন। এঁরা বড় জায়গা দখল করে আছেন আমাদের কবিতায়। বাংলা কবিতারও অন্যতম প্রতিনিধি কণ্ঠস্বর এঁরা। ভাবতে অবাকই লাগে- কীভাবে সময় বয়ে যায়! সেই কবিকুল আজ প্রৌঢ় হতে চলেছেন।
কবি ফারুক মাহমুদ ৭৪ বছরে পদার্পণ করলেন আজ। জন্ম ১৯৫২ সালের ১৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের ভৈরবে, হাওর-বাওর অধ্যুষিত অঞ্চলে। সেখান থেকে একসময় উচ্চশিক্ষার জন্য আসেন ঢাকায়। সত্তরের এক তুমুল ঝড়ের সহযাত্রী হিসেবে তখন পেয়েছিলেন একঝাঁক তরুণ মেধাবীদের- যাঁরা পরবর্তীকালে বাংলা কবিতায় রেখেছেন অসামান্য স্বাক্ষর। আমারও ফারুক মাহমুদকে নিবিড়ভাবে দেখার ও পাঠের সুযোগ হয়েছে, একজন সতীর্থ হিসেবে। কবিতার নানান বিষয়ে আমাদের মধ্যে একান্ত আলোচনা হয় প্রায়শই। কবিতার এমন বহু বিষয় রয়েছে, যা পরিণত বোধের আলোচনায় কূল পেতে পারে। কবিতা তো অংক নয়, দুয়ে-দুয়ে চার হবে! কবিতা ব্যক্তিগত বোধে ও মননে ধারণের মতো বিষয়। এর নানা অনুষঙ্গ- অলংকার, শিল্পসুষমা, দর্শন ইত্যাদি ব্যক্তির নিজস্ব বোধের ও প্রয়োগের বিষয়, যা একজন কবিকে বিশিষ্টতা দেয়।
ফারুক মাহমুদের কবিতা সৃষ্টিমানসের চেতনাজাত উচ্চারণ। কবিতার শব্দ, ইঙ্গিত, রূপকল্প আপনা থেকে যখন কবির বোধে নাড়া দেয়, তখন তা শিল্পের আদলে প্রকাশ পায়। ফারুক মাহমুদের কবিতা পাঠ করলে এই বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। তিনি শিল্পের শাসন মেনে চলেন, যে কারণে তাঁর কবিতা পাঠকপ্রিয় হয়েছে। আমাদের কবিতার ভুবনে পরিণত বোধ ও মননের মানুষ তিনি। তাঁর প্রথম কাব্য ‘পাথরের ফুল‘ প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা‘ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। তাঁর অন্য কাব্যগ্রন্থ- ‘অপূর্ণ তুমি আনন্দ বিষাদে’, ‘অনন্ত বেলা থেকে আছি’, ‘এত কাছে এত দূরে’, ‘সৌন্দর্য হে ভয়ানক’, ‘বাঘের বিষণœ দিন’, ‘হৃদয়ে প্রেমের দিন’, ‘অন্ধকারে মুগ্ধ’, ‘রৌদ্র ও জলের পিপাসা’, ‘ভ্রƒণপদ্য’, ‘ফিরে যাবো দূরত্বের কাছে’, ‘সামান্য আগুন যথেষ্ট জীবন’, ‘মহাভারতের প্রেম’, ‘আগুনে আপত্তি নেই’, ‘দাগ নয় চিহ্ন’, ‘দুই হৃদয়ের নদী’, ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ কাব্য ‘দ-িত ঘোড়ার স্বপ্ন’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২৪ সালে। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ- ‘কবি লিখলেন মেঘ’; উপন্যাস- ‘খুন হলেন কালিদাস‘। শিশুকিশোর সাহিত্যে তাঁর উল্লেখ করার মতো অবদান রয়েছে।
ফারুক মাহমুদের উচ্চারণ পরিশীলিত ও শিল্পসম্মত। কবিতার উচ্চারণে থাকে ব্যক্তির অন্তর্গত চেতনার শিল্পিত প্রকাশ- যা মানববোধের ইঙ্গিতবাহী শিল্প। কবিতার বেলায় বাচ্য নয়, বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনাই প্রধান অনুষঙ্গ। এতে লুকিয়ে থাকে রহস্য। এই রহস্য কবিতার ভিত্তি। তাই সকল উচ্চারণ সফল কবিতা হয় না। জীবনানন্দ বলেছেন, আধুনিক কবির ‘হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা’ থাকে। এই ‘অভিজ্ঞতার সারবত্তা’র প্রকাশ মানুষের কল্যাণের বিপরীতে হয় না। কবি হবেন সুন্দরের পূজারী, মানবপ্রেমী। তাঁর চিন্তা সর্বদা কল্যাণমুখী। ফারুক মাহমুদের কবিতা এসব বিবেচনায় উত্তীর্ণ এক শব্দশিল্প।
আজ কবির জন্মদিন। কবির জন্য শুভ কামনা।