মহিবুল আলম
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
কতক্ষণ আগেও আকাশের মেঘগুলো উড়ে যাচ্ছিল মোটা মেয়ের ধীর চরণে, ভারি পদক্ষেপ ফেলে। কিন্তু এখন মেঘের তরুণী মন, ত্রস্ত পা। ছেঁড়া ও বিচ্ছিন্ন। সূর্য থেকে খানিকটা দূরত্বে মেঘগুলো শুধু উড়ছে। দুপুরের এক ধরনের ক্লান্তি।
আষাঢ়ের এই দুপুরে রোদটা অবশ্য স্পষ্ট। ক্লান্তিকর দুপুরের ভেতর রোদটুকু দাঁড়িয়ে রয়েছে চিলেকোঠাসহ সমস্ত ছাদ, পার্শ্ববর্তী দালান, নারিকেল গাছের তিরতির ডগা ও পাশের গলিতে।
লেখক দাঁড়িয়ে আছে সেই রৌদ্র গিলে। সামনের দিকে তার ছায়াটা। পুবমুখো ও ছোট্ট। লেখকের দাঁড়ানো স্থান থেকে হাত দুয়েক পর্যন্ত।
লেখকের দৃষ্টি আকাশে। দৃষ্টির ভেতর তার বিন্দু বিন্দু অস্থিরতা জমা হচ্ছে স্পষ্ট সূর্য, পাতলা মেঘে বা আষাঢ়ী দুপুরের কালপাত্রে। লেখকের শরীর স্পষ্টত সটান, কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ দেহটা ঝুলে আছে দু’হাতের অবলম্বনে, কাপড় দেওয়া টানা নাইলনের রশিটা টেনে। হিল হিল তার লম্বা চুলগুলো সিঁথি ভাঙছে।
লেখকের গায়ে ফতুয়া। বুকে ফুলের কাজ। বোতাম নেই একটাও। বোতাম না থাকাতে গলা থেকে নেমে যাওয়া ফতুয়াটাকে মনে হচ্ছে যেন ঠোঁট ফাঁক করে হাসছে। চওড়া বুক। বুকের কালো ঘন লোমে দৃষ্টির মোহটান। এই ঘন লোমের দৃষ্টির ভেতর প্রতিনিয়ত ভেঙ্গে চলছে ভিন্ন গোত্রীয় চোখ। স্বচ্ছ যাতায়াত নিয়ে এক পরনারীর অবাধ চলাচল।
লেখকের দৃষ্টি আকাশ থেকে সরে এল। সরাসরি সমান্তরাল হয়ে তিনতলা পাশের দালানটার ছাদে গিয়ে পড়ল। ছোট্ট একটা সিঁড়িঘর, তার উপর পানির ট্যাংকি। ট্যাংকির হলুদ রেখা বেয়ে বাড়তি জল চুইয়ে পড়ছে। অপর ছাদেও আড়াআড়ি দুটো লাইলনের রশি। হলুদ রঙের। ছাদের এপাশ-ওপাশ। দুপুরের এবেলা পর্যন্ত পরনারী তার স্নানের কাপড় শুকোতে দিতে আসেনি। যদিও হলুদ নাইলনের রশিটায় অন্য কোনো নারীর স্নানের কাপড় ঝুলছে।
লেখক পরনারীর শাড়ি, ব্লাউজ ও সায়া, এমনকি অন্তর্বাস প্রায় সবই চিনে।
লেখক পাশের দালান থেকে দৃষ্টি টেনে নিজের বাসস্থানের দিকে তাকাল। এমনিই। রোদটা ক্রমাগত আরও হলুদ হচ্ছে। ছায়াটা বাড়ছে পূর্বমুখো। অপর তিনতলা দালানটার মতো লেখকের পায়ের নিচের দালানও তিনতলা। শুধু এই দালানের বাড়তি অংশ বলতে একটা চিলেকোঠা। বাইরে পলেস্তারার উপর কালো ছোপ ছোপ শান দাগের এই চিলেকোঠায় লেখক থাকে। এই জীর্ণ চিলেকোঠাটা লেখকের বরাবরই ভালো লাগে এজন্য, সে চিলেকোঠা থেকে বেরিয়েই উঠোন সদৃশ একটা ছাদ পায়। আর বিজাতীয় আকর্ষণে অপর ছাদে পায় তার সেই পরনারীকে।
অপর ছাদে পরনারী হঠাৎ করেই উদয় হলো। ছাদে উঠেই পরনারী স্বাভাবিক পদক্ষেপে কিঞ্চিৎ পশ্চিমে এসে লেখকের দিকে দূরত্ব কমালো। কিন্তু কোনো কথা বলল না। তবে তাকাল খুব সহজ দৃষ্টিতে। তাকানো মাত্রই, তারপর পরনারীর দৃষ্টি অন্যরকম হয়ে গেল। সে হাসল। ভূমিকাহীন কয়েক পা পিছিয়ে গেল এমনিই।
পরনারীর এই ভূমিকাহীন এগিয়ে আসা, পিছিয়ে যাওয়া বা অন্য রকম দৃষ্টি ফেলা- এসব লেখকের নিত্যদিনের গল্পের উপাদান। যেন প্রতিদিনের তিন প্রহরের শকুনের গল্প। আষাঢ়ী হলুদ দুপুরে দূরত্ব আছে। অদৃশ্য দূরত্ব। কিন্তু বাস্তবিক দুজনের দেহ নিথর দাঁড়িয়ে থাকে ভিন্ন প্রশ্রয়ে, অতি সাধারণ নিয়মে।
পরনারী সবে গোছল সেরে এসেছে। উদোম মাথায় চুল ভেজা। পিঠের উপর চুলগুলো ছড়িয়ে দেওয়া। নাক, মুখ ও শরীরে যেন কেমন ভেজা ভেজা ভাব। হাতে ভেজা চিপে নেওয়া শাড়িটা। সঙ্গে ব্লাউজ, সায়া ও ব্রা জড়াজড়ি করছে।
লেখক পরনারীর হাসির বদলে হাসল।
দুই
কখন, কোন অবসরে একদলা মেঘ হননের উল্লাসে সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে লেখক তা খেয়াল করেনি। পড়ন্ত দুপুরকে ঠুকরে খেয়েছে কোনো এক কালপাখি। আকাশে নীলের সর্বত্র খ- খ- মেঘ। চিলেকোঠার পাশেই তিনতলার ছাদের সমতায় নারিকেলের শেষ ডগাটা মন্দ বাতাসে তির তির কাঁপছে। ডগাটার মাথায় একটা ফিঙ্গে। প্রকৃতির অস্থিরতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছে। কিন্তু উড়ছে না। ফিঙ্গের এই অস্থিরতার মতো লেখকও কী এক অস্থিরতায় ভুগছে। কোনো বন্ধন নেই, তবুও বন্ধনের অস্থিরতা। কোনো মোহ নেই, তবুও মোহের অস্থিরতা।
লেখক এ মুহূর্তে চিলেকোঠায় বসে আছে। চিলেকোঠার পশ্চিমে দরজা। পুবে বিশাল একটা জানালা। জানালাটা যে আকারেরই হোক না কেন, পুবের জানালাটা বিশাল হয়ে উঠেছে অপর ছাদের পরনারীর কারণেই।
এ মুহূর্তে অবশ্য অপর ছাদে পরনারী নেই। ফাঁকা সময়। একটা কাক কাপড় ছড়ানো নাইলনের রশিটায় বসে আছে। পরনারীর সায়ার উপর বসে লেখকের জানালার দিকে মুখ করে কাকটা ডাকছে- কা কা, কঁ কঁ, কা কা।
চিলেকোঠায়ও এখন লেখক বাদে কেউ নেই। অবশ্য এ মুহূর্তে কারও থাকার কথাও নয়। চিলেকোঠায় সে একাই থাকে। সারাটা দিন নারিকেলের ডগাটার মতো অস্থিরতায় কাঁপলেও সন্ধ্যা শেষ হতেই লেখকের পত্রিকার ডিউটি শুরু হয়। গল্প-উপন্যাস লেখার পাশাপাশি লেখক একটি জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যের পাতা দেখে।
বরাবরই লেখকের মাথায় চাপ পড়ে কোনো গল্পের শেষ পর্যায়ে এসে। আজও তাই হচ্ছে। লেখকের খুব ইচ্ছে অর্বাচীন নোঙরে প্রথম হননের সঙ্গে দ্বিতীয় হননের মুখোমুখি করা।
কিন্তু প্রথম হননের নায়িকার ভাঙনের গান যে বড্ড তীব্র। আর দ্বিতীয় হননে অপূর্ব সুন্দর চোখ দুটোরইবা দোষ কী? লেখক হিসেব মিলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। এই ব্যস্ততার সূক্ষ্মপ্রচেষ্টায় সে কলম কামড়াল, খাতায় আঁকিবুকি করল। ভাবল, আসলে এ তো স্বতঃসিদ্ধ হিসেব নয় যে সাধারণ কাঠখড় পুড়িয়ে হিসেবটা মিলিয়ে নিবে।
ঠিক তখনই, সেই হিসেবের ফাঁক গলে বেরিয়ে এলো একটি মুখ। মুখটা পাঁচ বছরের এক বাচ্চা ছেলের। ছেলেটা সেই পরনারীর। এই ছেলেটাই পরনারী ও লেখকের মাঝে কাচদেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ছেলেটার নাম রাতুল।
রাতুল ডেকে উঠল, ‘ও সাদা কাকা?’
ডাকটা হঠাৎ লেখককে কেমন চমকে দিল। ফুট পাঁচেক দূরত্ব রেখে অপর ছাদের রেলিং। রেলিং ঘেঁষে রাতুল দাঁড়িয়ে আছে।
প্রথম হনন ও দ্বিতীয় হননের ব্যাঘাত ঘটায় লেখক খানিকটা বিরক্ত হলো।
রাতুল জিজ্ঞেস করল, ‘ও সাদা কাকা, কী করছ?’
লেখক মাথা নাড়াল। ‘সাদা’ লেখকের কোনো নাম নয়। বেশ ফর্সা বলেই রাতুল তাকে সাদা কাকা বলে ডাকে।
লেখক বিরক্তিভাব কাটিয়ে নিঃশব্দে হাসল। বলল, ‘ঘোড়ার ডিম করছি’।
রাতুল খিল খিল করে হেসে উঠল, ‘ঘোড়ার আবার ডিম আছে নাকি?’
লেখক হাসি ধরে রেখেই কৃত্রিম বিস্ময়ে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে কে বলেছে যে ঘোড়ার ডিম নেই?’
রাতুল ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘কেউ না’। তারপর কিছুক্ষণ সময় চুপ থেকে কী ভেবে বলল, ‘জানো সাদা কাকা, মা কী করছে?’
লেখক জিজ্ঞেস করল, ‘কী করছে?’
রাতুল বলল, ‘বাবা বিদেশ থেকে ফোন করেছে। মা ফোনে কাঁদছে’।
লেখক সরাসরি রাতুলের দিকে তাকাল। বেশ কিছুক্ষণ। সে রাতুলের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার দৃষ্টির ভিতর অন্য দৃষ্টি এসে বসত গড়ল। একজন নারী, পরনারীর মুখ। প্রান্তর ভাঙা দৃষ্টি। ভাজ-অভাঁজে গড়ে ওঠা বিজাতীয় দেহের মন্থন।
লেখক ভাবল, পরনারী তার স্বামীর ফোনে কাঁদছে? তিন.
পড়ন্ত বিকেল। দিনান্তের মুখোমুখি হয়ে ক্লান্ত বাতাস আসছে এলোমেলো। সূর্যের একটা লাল রশ্মি পশ্চিমের হাট দরজা গলে চিলেকোঠায় ঢুকে পড়েছে। ভাঙা ভেন্টিলেটরে একজোড়া চড়ুই। চড়ুই জোড়া অনবরত শব্দ করেছে, কিচ কিচ, কিইচ, কি-ই-চ, কিচ কিচ।
লেখক এ মুহূর্তে লিখছে না। কলমের পেছনটা দুই ঠোঁটের মাঝখানে চেপে চুপচাপ ভাবছে। অর্বাচীন নোঙরে প্রথম হননের মুখোমুখি দ্বিতীয় হনন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লেখক কিছুতেই এর তাল মিলাতে পারছে না। আর পারছে না বলে সে ক্রমাগত অস্থির হয়ে উঠছে। অর্বাচীন নোঙরের প্রথম হনন তার স্ত্রী, যে তার ছিল। দ্বিতীয় হননে পরনারী।
লেখক তার স্ত্রীকে শহরে এনে রাখার মতো সামর্থ্য নেই বলে গ্রামের বাড়িতে তার মা’র কাছে রেখেছিল। তার ছিল পাঁচ বছরের একটা ছেলে। ঠিক পরনারীর ছেলে রাতুলের বয়সী।
কতক্ষণ আগে লেখক ছাদে হাঁটাহাঁটি করে এসেছে। বিকেলের নরম রোদের ভেতর তখন পরনারী এসেছিল অপর ছাদে, রশিতে ছড়ানো কাপড়গুলো নিতে।
লেখক ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করে, ‘কী খবর, স্বামীর ফোনে খুব নাকি কেঁদেছ?’
পরনারীর তখন চিরায়ত চোখ শাসানো খিল খিল হাসি। বলে, ‘হ্যাঁ, কেঁদেছি। তোমার কোনো সমস্যা?’
লেখক বলে, ‘সমস্যা তো একটা আছেই’।
পরনারী জিজ্ঞেস করে, ‘কী সমস্যা?’
লেখক বলে, ‘বুঝে নাও কী সমস্যা’।
পরনারী হাসে, হি হি, হি হি।
রাতুলকে নিয়ে পরনারী অপর বিল্ডিংয়ের দোতলায় ভাইয়ের বাসায় থাকে। পরনারীর স্বামী অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত ঝামেলায় অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছে বলে প্রায় তিনবছর হলো দেশে আসতে পারছে না। কবে আসতে পারবে তার নিশ্চয়তা নেই।
চড়ুইজোড়া তখনও কিচ-কিচ করছে। বিকেলে লাল রোদটুকুর খানিকটা তখনও থেমে রয়েছে চিলেকোঠায়। লেখক কলমটা ছোট্ট শব্দ করে অসমাপ্ত লেখাটার পাশে টেবিলে রাখল। আড়মোড়া ভেঙে চেয়ারটা ঘুরিয়ে পূর্বের জানালামুখো করল।
রাতুল অপর ছাদে খেলছে। একাই। ছাদে সে দৌড়াদৌড়ি করছে। কখনও পানির পাইপে উঠছে। কখনও পানির ট্যাংকির উপর বসা বুনো কবুতর দু’টোকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে- হিস হিস, হি-ই-স, হি-ই-স।
কিছুক্ষণ আগে অবশ্য আরও দুই-তিনজন রাতুলের সমবয়সী বাচ্চা ছেলে ছাদে ছিল। রাতুলের সঙ্গে খেলছিল। বিল্ডিংয়ের মালিক মোটা মহিলাটা এসে বকাঝকা করাতে ওরা নেমে গেছে। রাতুল নামেনি।
লেখকের ছাদে অবশ্য লোকজনের তেমন আনাগোনা নেই। খুব দরকার না হলে কেউ ছাদে ওঠে না। হয়তো লেখক চিলেকোঠায় থাকে বলে এমনটা হয়েছে।
চিলেকোঠার জানালায় লেখকের স্পষ্টমুখো চেহারা দেখে রাতুল দৌড়ে এসে আবার ছাদের রেলিং চেপে দাঁড়াল। চোখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ও সাদা কাকা, তুমি সারাদিন রুমে বসে থাকো কেন?’
লেখক হাসল। বলল, নাতো। সারাদিন তো বসে থাকি না। কতক্ষণ আগেও তো ছাদে হেঁটে এলাম। দেখনি তুমি?’
রাতুল শিশুসুলভ চড়া গলায় বলল, ‘এয়্যায়, সে তো মা আসাতে ছাদে হেঁটেছ’।
লেখক চমকে উঠল। অযথাই অপর ছাদে এপাশ-ওপাশে তাকাল। তারপর দৃষ্টিটা রাতুলের চেহারায় স্থির করে কিছুক্ষণ থ হয়ে তাকিয়ে রইল। ভাবল, আশ্চর্য ব্যাপার! এই পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে এত বোঝে?
রাতুল কী মনে করে রেলিং থেকে সরে গেল। পানির ট্যাংকির উপর বুনো কবুতর দু’টি তখনও বসে আছে। রাতুল ওদিকে এগিয়ে গিয়ে কবুতর তাড়াতে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। দু’হাত উপরে তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে শব্দ করতে লাগল, হিস হিস, হি-ই-স, হিস হিস।
কবুতর দুটো দু’বার ডানা ঝাপটিয়ে আকাশমুখো উড়ে গেল। রাতুল খিলখিল করে হাসতে শুরু করল।
রাতুলের উপরের পাটির মাঝখানের একটা দাঁত পোকায় খাওয়া। হাসলে বেশ মিষ্টিই লাগে। সে আবার লেখকের কাছাকাছি হয়ে রেলিঙ চেপে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চুপ করে লেখকের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর রেলিঙে দু’হাত সামান্য টেনে নিয়ে রেলিঙ ঘেঁষা পানির পাইপটায় উঠে দাঁড়াল। শরীরটাকে যথাসম্ভব উপরমুখো ঠেলে টেনে টেনে বলল, ‘জানো সাদা কাকা, আজ মা বাবাকে ফোনে কী বলেছে?’
লেখক জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলেছে?’
‘আমি নাকি অনেক লম্বা হয়েছি?’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ’- বলেই রাতুল শরীরটাকে আরও টানটান করল। বলল, ‘দেখ সাদা কাকা, আমি কত লম্বা’।
লেখক কৌতুক করে বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি আকাশ সমান লম্বা’।
রাতুল ভাব নিয়ে বলল, ‘সাদা কাকা, তুমি দেখবে আমি আরও কত লম্বা হই?’
লেখক বুঝতে না পেরে হাসি হাসি মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, দেখব’।
রাতুল খপ করে পানির পাইপ থেকে ইটের গাঁথুনির রেলিঙের উপর দাঁড়াতে দাঁড়াতে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে বলল, ‘এই দেখ, আমি আরও কত লম্বা হয়েছি’।
লেখক চমকে উঠল। তৎক্ষণাৎ তার মুখ থেকে আঁ-আঁ শব্দ বের হয়ে এলো। সে আশা করেনি রাতুল রেলিঙের উপর উঠে যাবে। পানির পাইপ ধরে রেলিঙটা অবশ্য একটা পাঁচ বছরের ছেলের জন্য খুব একটা উঁচু নয়।
কিন্তু শব্দ করা পর্যন্তই। লেখকের দৃষ্টি বুজে এল। চোখ বুজতেই তার দৃষ্টির সামনে পুরোনো বিধ্বস্ত দৃশ্যটা পচা বোয়াল মাছের পেটির মতো ঝুলে পড়ল। সে বুঝতে পারল না, এ মুহূর্তে সেই পুরোনো বিধ্বস্ত দৃশ্যটা তার ভেতর জানান দিচ্ছে কেন?
লেখকের বারবার মনে হলো, তার নিজের ছেলেটার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তার ছেলেটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সে নিশ্চিত, তাদের আখন্দ বাড়ির লজিং মাস্টার তার ছেলেটাকে বেড়ানোর নাম করে কোনো নির্জনে গোমতী নদীর বর্ষায় ভরাটবানের ভেতর জলগর্ভে ফেলে দিয়েছে...!
লেখক চোখ খুলল।
সূর্যের লাল রশ্মিটা পশ্চিমের হাট দরজা গলে চিলেকোঠায় আর থেমে নেই। সেখানে থেমে রয়েছে ছায়ার একটা স্পষ্ট দাগ। সূর্যটা এরই মধ্যে ডুবে গেছে। কিন্তু চারদিকে গোধূলির আলো কেমন স্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
লেখক অপর ছাদের রেলিঙে রাতুলের ওপর নির্দিষ্ট করে ফেলতে গিয়ে হঠাৎ কেমন কেঁপে উঠল। অপর ছাদের রেলিঙটা যেন কেঁপে উঠল আরও এলোমেলোভাবে।
একটা হিম ¯্রােত বয়ে যাওয়ার আগেই লেখক চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল।
অপর ছাদের রেলিঙ ও ছাদের সর্বত্র তখন ফাঁকা।
চার.
সাজের নিষ্প্রভ আলো কখন যে আঁধারে গিলে খেয়েছে লেখক তা খেয়াল করেনি। দরজা বন্ধ। জানালাটাও বন্ধ এখন। হাত বাড়ালেই লেখক আলো জ্বালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু সে আলো জ্বালাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন আলোটা জ্বালালে তার চেহারার নষ্ট বাঁকগুলো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিবে।
লেখক সামনের দিকে ঝুঁকে স্থাণু হয়ে বসে আছে সেই তখন থেকে। যদিও অন্ধকার গলা চোখ, কিন্তু দৃষ্টিটা এলোমেলো। চিলেকোঠায় নিঃশব্দতা অন্ধকারে মতোই। লেখকের ভেতর আত্মদগ্ধতার ক্ষরণ।
হঠাৎ লেখক এই ক্ষরণের ভেতর নিঃশব্দতা ভেদ করা একটা শব্দ পেল। মনে হলো, যেন সিঁড়িরুমের দরজা খুলে ছাদে উঠে চিলেকোঠার দিকে কেউ আসছে। শব্দের ধরনটা এমন, কট-কট, কয়ট-কয়ট।
পরক্ষণই আবার চুপচাপ।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার শব্দ শুরু হলো। এবারের শব্দগুলো একটু ভিন্নতর, থুপ-থাপ, থুপ-থুপ, খস-খস।
আবারও চুপচাপ। লেখক চোখজোড়া অন্ধকারের ভেতর টান টান করল। দেহটাও আড়মোড়া ভেঙে সটান হলো। লেখকের ঠাহর করানো দৃষ্টি চিলেকোঠার দরজা থেকে জানালা, জানালা থেকে দরজা- এভাবে কিছুক্ষণ ঘুরল। তারপর দৃষ্টিটা আবার স্থির হলো স্থানু হয়ে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল কয়েকটি মুখ। মুখগুলো বিধ্বস্ত ও বড্ড বিপর্যস্ত। এরই মধ্যে একটা মুখ খানিকটা সতেজ ও স্পষ্ট।
লেখকের মনে হলো, এই বুঝি সেই সতেজ মুখটা আহলাদে ডেকে উঠবে, ‘সাদা কাকা, ও সাদা কাকা!’
লেখক যন্ত্রণায় কাতরে উঠল।
বাইরের শব্দটা আবার স্পষ্ট হলো। লেখক যেন এবার তার নিজস্ব তাড়নার পদশব্দ শুনল। এই শব্দটা সম্পর্কে লেখক পরিচিত। কচকচ আওয়াজ। চপ্পলের ঘর্ষণ। খসখসে ধ্বনি। দরজায় মৃদু স্পর্শ।
লেখক ভাবল, নিশ্চয়ই পরনারী এসেছে?
লেখকের তৎক্ষণাৎ একটা করুণ-বিধ্বস্ত দৃশ্য মনে হানা দিল। হয়তোবা তার স্ত্রীটা পালিয়ে যাবার আগে পাশের বাড়ির লজিং মাস্টারের দরজায় এভাবে পরিচিত স্পর্শের শব্দ করত? মাত্র তিন বছরের ব্যবধান।
লেখক উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলল। ঠাহর করানো দৃষ্টি নিয়ে ভেতরের অন্ধকার ভেদ করে সে বাইরের হাল্কা আলো-আঁধারিতে তাকাল। কিন্তু সে তাকিয়েই থমকে গেল। সে চমকে উঠলও বেশ। সে দেখল, তার সামনে রাতুল দাঁড়িয়ে আছে।
রাতুল দাঁত বের করে হাসছে।
লেখক তৎক্ষণাৎ কিছুই বুঝতে পারল না। শুধু নিঃশব্দটা ভেদ করে দরজা বন্ধের শব্দ হলো, পটাস।
রুমের অন্ধকার ও রাতের দেহে লেখক একাকার হয়ে গেল তখনই।
মহিবুল আলম
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫
কতক্ষণ আগেও আকাশের মেঘগুলো উড়ে যাচ্ছিল মোটা মেয়ের ধীর চরণে, ভারি পদক্ষেপ ফেলে। কিন্তু এখন মেঘের তরুণী মন, ত্রস্ত পা। ছেঁড়া ও বিচ্ছিন্ন। সূর্য থেকে খানিকটা দূরত্বে মেঘগুলো শুধু উড়ছে। দুপুরের এক ধরনের ক্লান্তি।
আষাঢ়ের এই দুপুরে রোদটা অবশ্য স্পষ্ট। ক্লান্তিকর দুপুরের ভেতর রোদটুকু দাঁড়িয়ে রয়েছে চিলেকোঠাসহ সমস্ত ছাদ, পার্শ্ববর্তী দালান, নারিকেল গাছের তিরতির ডগা ও পাশের গলিতে।
লেখক দাঁড়িয়ে আছে সেই রৌদ্র গিলে। সামনের দিকে তার ছায়াটা। পুবমুখো ও ছোট্ট। লেখকের দাঁড়ানো স্থান থেকে হাত দুয়েক পর্যন্ত।
লেখকের দৃষ্টি আকাশে। দৃষ্টির ভেতর তার বিন্দু বিন্দু অস্থিরতা জমা হচ্ছে স্পষ্ট সূর্য, পাতলা মেঘে বা আষাঢ়ী দুপুরের কালপাত্রে। লেখকের শরীর স্পষ্টত সটান, কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ দেহটা ঝুলে আছে দু’হাতের অবলম্বনে, কাপড় দেওয়া টানা নাইলনের রশিটা টেনে। হিল হিল তার লম্বা চুলগুলো সিঁথি ভাঙছে।
লেখকের গায়ে ফতুয়া। বুকে ফুলের কাজ। বোতাম নেই একটাও। বোতাম না থাকাতে গলা থেকে নেমে যাওয়া ফতুয়াটাকে মনে হচ্ছে যেন ঠোঁট ফাঁক করে হাসছে। চওড়া বুক। বুকের কালো ঘন লোমে দৃষ্টির মোহটান। এই ঘন লোমের দৃষ্টির ভেতর প্রতিনিয়ত ভেঙ্গে চলছে ভিন্ন গোত্রীয় চোখ। স্বচ্ছ যাতায়াত নিয়ে এক পরনারীর অবাধ চলাচল।
লেখকের দৃষ্টি আকাশ থেকে সরে এল। সরাসরি সমান্তরাল হয়ে তিনতলা পাশের দালানটার ছাদে গিয়ে পড়ল। ছোট্ট একটা সিঁড়িঘর, তার উপর পানির ট্যাংকি। ট্যাংকির হলুদ রেখা বেয়ে বাড়তি জল চুইয়ে পড়ছে। অপর ছাদেও আড়াআড়ি দুটো লাইলনের রশি। হলুদ রঙের। ছাদের এপাশ-ওপাশ। দুপুরের এবেলা পর্যন্ত পরনারী তার স্নানের কাপড় শুকোতে দিতে আসেনি। যদিও হলুদ নাইলনের রশিটায় অন্য কোনো নারীর স্নানের কাপড় ঝুলছে।
লেখক পরনারীর শাড়ি, ব্লাউজ ও সায়া, এমনকি অন্তর্বাস প্রায় সবই চিনে।
লেখক পাশের দালান থেকে দৃষ্টি টেনে নিজের বাসস্থানের দিকে তাকাল। এমনিই। রোদটা ক্রমাগত আরও হলুদ হচ্ছে। ছায়াটা বাড়ছে পূর্বমুখো। অপর তিনতলা দালানটার মতো লেখকের পায়ের নিচের দালানও তিনতলা। শুধু এই দালানের বাড়তি অংশ বলতে একটা চিলেকোঠা। বাইরে পলেস্তারার উপর কালো ছোপ ছোপ শান দাগের এই চিলেকোঠায় লেখক থাকে। এই জীর্ণ চিলেকোঠাটা লেখকের বরাবরই ভালো লাগে এজন্য, সে চিলেকোঠা থেকে বেরিয়েই উঠোন সদৃশ একটা ছাদ পায়। আর বিজাতীয় আকর্ষণে অপর ছাদে পায় তার সেই পরনারীকে।
অপর ছাদে পরনারী হঠাৎ করেই উদয় হলো। ছাদে উঠেই পরনারী স্বাভাবিক পদক্ষেপে কিঞ্চিৎ পশ্চিমে এসে লেখকের দিকে দূরত্ব কমালো। কিন্তু কোনো কথা বলল না। তবে তাকাল খুব সহজ দৃষ্টিতে। তাকানো মাত্রই, তারপর পরনারীর দৃষ্টি অন্যরকম হয়ে গেল। সে হাসল। ভূমিকাহীন কয়েক পা পিছিয়ে গেল এমনিই।
পরনারীর এই ভূমিকাহীন এগিয়ে আসা, পিছিয়ে যাওয়া বা অন্য রকম দৃষ্টি ফেলা- এসব লেখকের নিত্যদিনের গল্পের উপাদান। যেন প্রতিদিনের তিন প্রহরের শকুনের গল্প। আষাঢ়ী হলুদ দুপুরে দূরত্ব আছে। অদৃশ্য দূরত্ব। কিন্তু বাস্তবিক দুজনের দেহ নিথর দাঁড়িয়ে থাকে ভিন্ন প্রশ্রয়ে, অতি সাধারণ নিয়মে।
পরনারী সবে গোছল সেরে এসেছে। উদোম মাথায় চুল ভেজা। পিঠের উপর চুলগুলো ছড়িয়ে দেওয়া। নাক, মুখ ও শরীরে যেন কেমন ভেজা ভেজা ভাব। হাতে ভেজা চিপে নেওয়া শাড়িটা। সঙ্গে ব্লাউজ, সায়া ও ব্রা জড়াজড়ি করছে।
লেখক পরনারীর হাসির বদলে হাসল।
দুই
কখন, কোন অবসরে একদলা মেঘ হননের উল্লাসে সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে লেখক তা খেয়াল করেনি। পড়ন্ত দুপুরকে ঠুকরে খেয়েছে কোনো এক কালপাখি। আকাশে নীলের সর্বত্র খ- খ- মেঘ। চিলেকোঠার পাশেই তিনতলার ছাদের সমতায় নারিকেলের শেষ ডগাটা মন্দ বাতাসে তির তির কাঁপছে। ডগাটার মাথায় একটা ফিঙ্গে। প্রকৃতির অস্থিরতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছে। কিন্তু উড়ছে না। ফিঙ্গের এই অস্থিরতার মতো লেখকও কী এক অস্থিরতায় ভুগছে। কোনো বন্ধন নেই, তবুও বন্ধনের অস্থিরতা। কোনো মোহ নেই, তবুও মোহের অস্থিরতা।
লেখক এ মুহূর্তে চিলেকোঠায় বসে আছে। চিলেকোঠার পশ্চিমে দরজা। পুবে বিশাল একটা জানালা। জানালাটা যে আকারেরই হোক না কেন, পুবের জানালাটা বিশাল হয়ে উঠেছে অপর ছাদের পরনারীর কারণেই।
এ মুহূর্তে অবশ্য অপর ছাদে পরনারী নেই। ফাঁকা সময়। একটা কাক কাপড় ছড়ানো নাইলনের রশিটায় বসে আছে। পরনারীর সায়ার উপর বসে লেখকের জানালার দিকে মুখ করে কাকটা ডাকছে- কা কা, কঁ কঁ, কা কা।
চিলেকোঠায়ও এখন লেখক বাদে কেউ নেই। অবশ্য এ মুহূর্তে কারও থাকার কথাও নয়। চিলেকোঠায় সে একাই থাকে। সারাটা দিন নারিকেলের ডগাটার মতো অস্থিরতায় কাঁপলেও সন্ধ্যা শেষ হতেই লেখকের পত্রিকার ডিউটি শুরু হয়। গল্প-উপন্যাস লেখার পাশাপাশি লেখক একটি জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যের পাতা দেখে।
বরাবরই লেখকের মাথায় চাপ পড়ে কোনো গল্পের শেষ পর্যায়ে এসে। আজও তাই হচ্ছে। লেখকের খুব ইচ্ছে অর্বাচীন নোঙরে প্রথম হননের সঙ্গে দ্বিতীয় হননের মুখোমুখি করা।
কিন্তু প্রথম হননের নায়িকার ভাঙনের গান যে বড্ড তীব্র। আর দ্বিতীয় হননে অপূর্ব সুন্দর চোখ দুটোরইবা দোষ কী? লেখক হিসেব মিলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। এই ব্যস্ততার সূক্ষ্মপ্রচেষ্টায় সে কলম কামড়াল, খাতায় আঁকিবুকি করল। ভাবল, আসলে এ তো স্বতঃসিদ্ধ হিসেব নয় যে সাধারণ কাঠখড় পুড়িয়ে হিসেবটা মিলিয়ে নিবে।
ঠিক তখনই, সেই হিসেবের ফাঁক গলে বেরিয়ে এলো একটি মুখ। মুখটা পাঁচ বছরের এক বাচ্চা ছেলের। ছেলেটা সেই পরনারীর। এই ছেলেটাই পরনারী ও লেখকের মাঝে কাচদেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ছেলেটার নাম রাতুল।
রাতুল ডেকে উঠল, ‘ও সাদা কাকা?’
ডাকটা হঠাৎ লেখককে কেমন চমকে দিল। ফুট পাঁচেক দূরত্ব রেখে অপর ছাদের রেলিং। রেলিং ঘেঁষে রাতুল দাঁড়িয়ে আছে।
প্রথম হনন ও দ্বিতীয় হননের ব্যাঘাত ঘটায় লেখক খানিকটা বিরক্ত হলো।
রাতুল জিজ্ঞেস করল, ‘ও সাদা কাকা, কী করছ?’
লেখক মাথা নাড়াল। ‘সাদা’ লেখকের কোনো নাম নয়। বেশ ফর্সা বলেই রাতুল তাকে সাদা কাকা বলে ডাকে।
লেখক বিরক্তিভাব কাটিয়ে নিঃশব্দে হাসল। বলল, ‘ঘোড়ার ডিম করছি’।
রাতুল খিল খিল করে হেসে উঠল, ‘ঘোড়ার আবার ডিম আছে নাকি?’
লেখক হাসি ধরে রেখেই কৃত্রিম বিস্ময়ে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে কে বলেছে যে ঘোড়ার ডিম নেই?’
রাতুল ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘কেউ না’। তারপর কিছুক্ষণ সময় চুপ থেকে কী ভেবে বলল, ‘জানো সাদা কাকা, মা কী করছে?’
লেখক জিজ্ঞেস করল, ‘কী করছে?’
রাতুল বলল, ‘বাবা বিদেশ থেকে ফোন করেছে। মা ফোনে কাঁদছে’।
লেখক সরাসরি রাতুলের দিকে তাকাল। বেশ কিছুক্ষণ। সে রাতুলের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার দৃষ্টির ভিতর অন্য দৃষ্টি এসে বসত গড়ল। একজন নারী, পরনারীর মুখ। প্রান্তর ভাঙা দৃষ্টি। ভাজ-অভাঁজে গড়ে ওঠা বিজাতীয় দেহের মন্থন।
লেখক ভাবল, পরনারী তার স্বামীর ফোনে কাঁদছে? তিন.
পড়ন্ত বিকেল। দিনান্তের মুখোমুখি হয়ে ক্লান্ত বাতাস আসছে এলোমেলো। সূর্যের একটা লাল রশ্মি পশ্চিমের হাট দরজা গলে চিলেকোঠায় ঢুকে পড়েছে। ভাঙা ভেন্টিলেটরে একজোড়া চড়ুই। চড়ুই জোড়া অনবরত শব্দ করেছে, কিচ কিচ, কিইচ, কি-ই-চ, কিচ কিচ।
লেখক এ মুহূর্তে লিখছে না। কলমের পেছনটা দুই ঠোঁটের মাঝখানে চেপে চুপচাপ ভাবছে। অর্বাচীন নোঙরে প্রথম হননের মুখোমুখি দ্বিতীয় হনন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লেখক কিছুতেই এর তাল মিলাতে পারছে না। আর পারছে না বলে সে ক্রমাগত অস্থির হয়ে উঠছে। অর্বাচীন নোঙরের প্রথম হনন তার স্ত্রী, যে তার ছিল। দ্বিতীয় হননে পরনারী।
লেখক তার স্ত্রীকে শহরে এনে রাখার মতো সামর্থ্য নেই বলে গ্রামের বাড়িতে তার মা’র কাছে রেখেছিল। তার ছিল পাঁচ বছরের একটা ছেলে। ঠিক পরনারীর ছেলে রাতুলের বয়সী।
কতক্ষণ আগে লেখক ছাদে হাঁটাহাঁটি করে এসেছে। বিকেলের নরম রোদের ভেতর তখন পরনারী এসেছিল অপর ছাদে, রশিতে ছড়ানো কাপড়গুলো নিতে।
লেখক ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করে, ‘কী খবর, স্বামীর ফোনে খুব নাকি কেঁদেছ?’
পরনারীর তখন চিরায়ত চোখ শাসানো খিল খিল হাসি। বলে, ‘হ্যাঁ, কেঁদেছি। তোমার কোনো সমস্যা?’
লেখক বলে, ‘সমস্যা তো একটা আছেই’।
পরনারী জিজ্ঞেস করে, ‘কী সমস্যা?’
লেখক বলে, ‘বুঝে নাও কী সমস্যা’।
পরনারী হাসে, হি হি, হি হি।
রাতুলকে নিয়ে পরনারী অপর বিল্ডিংয়ের দোতলায় ভাইয়ের বাসায় থাকে। পরনারীর স্বামী অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত ঝামেলায় অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছে বলে প্রায় তিনবছর হলো দেশে আসতে পারছে না। কবে আসতে পারবে তার নিশ্চয়তা নেই।
চড়ুইজোড়া তখনও কিচ-কিচ করছে। বিকেলে লাল রোদটুকুর খানিকটা তখনও থেমে রয়েছে চিলেকোঠায়। লেখক কলমটা ছোট্ট শব্দ করে অসমাপ্ত লেখাটার পাশে টেবিলে রাখল। আড়মোড়া ভেঙে চেয়ারটা ঘুরিয়ে পূর্বের জানালামুখো করল।
রাতুল অপর ছাদে খেলছে। একাই। ছাদে সে দৌড়াদৌড়ি করছে। কখনও পানির পাইপে উঠছে। কখনও পানির ট্যাংকির উপর বসা বুনো কবুতর দু’টোকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে- হিস হিস, হি-ই-স, হি-ই-স।
কিছুক্ষণ আগে অবশ্য আরও দুই-তিনজন রাতুলের সমবয়সী বাচ্চা ছেলে ছাদে ছিল। রাতুলের সঙ্গে খেলছিল। বিল্ডিংয়ের মালিক মোটা মহিলাটা এসে বকাঝকা করাতে ওরা নেমে গেছে। রাতুল নামেনি।
লেখকের ছাদে অবশ্য লোকজনের তেমন আনাগোনা নেই। খুব দরকার না হলে কেউ ছাদে ওঠে না। হয়তো লেখক চিলেকোঠায় থাকে বলে এমনটা হয়েছে।
চিলেকোঠার জানালায় লেখকের স্পষ্টমুখো চেহারা দেখে রাতুল দৌড়ে এসে আবার ছাদের রেলিং চেপে দাঁড়াল। চোখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ও সাদা কাকা, তুমি সারাদিন রুমে বসে থাকো কেন?’
লেখক হাসল। বলল, নাতো। সারাদিন তো বসে থাকি না। কতক্ষণ আগেও তো ছাদে হেঁটে এলাম। দেখনি তুমি?’
রাতুল শিশুসুলভ চড়া গলায় বলল, ‘এয়্যায়, সে তো মা আসাতে ছাদে হেঁটেছ’।
লেখক চমকে উঠল। অযথাই অপর ছাদে এপাশ-ওপাশে তাকাল। তারপর দৃষ্টিটা রাতুলের চেহারায় স্থির করে কিছুক্ষণ থ হয়ে তাকিয়ে রইল। ভাবল, আশ্চর্য ব্যাপার! এই পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে এত বোঝে?
রাতুল কী মনে করে রেলিং থেকে সরে গেল। পানির ট্যাংকির উপর বুনো কবুতর দু’টি তখনও বসে আছে। রাতুল ওদিকে এগিয়ে গিয়ে কবুতর তাড়াতে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। দু’হাত উপরে তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে শব্দ করতে লাগল, হিস হিস, হি-ই-স, হিস হিস।
কবুতর দুটো দু’বার ডানা ঝাপটিয়ে আকাশমুখো উড়ে গেল। রাতুল খিলখিল করে হাসতে শুরু করল।
রাতুলের উপরের পাটির মাঝখানের একটা দাঁত পোকায় খাওয়া। হাসলে বেশ মিষ্টিই লাগে। সে আবার লেখকের কাছাকাছি হয়ে রেলিঙ চেপে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চুপ করে লেখকের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর রেলিঙে দু’হাত সামান্য টেনে নিয়ে রেলিঙ ঘেঁষা পানির পাইপটায় উঠে দাঁড়াল। শরীরটাকে যথাসম্ভব উপরমুখো ঠেলে টেনে টেনে বলল, ‘জানো সাদা কাকা, আজ মা বাবাকে ফোনে কী বলেছে?’
লেখক জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলেছে?’
‘আমি নাকি অনেক লম্বা হয়েছি?’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ’- বলেই রাতুল শরীরটাকে আরও টানটান করল। বলল, ‘দেখ সাদা কাকা, আমি কত লম্বা’।
লেখক কৌতুক করে বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি আকাশ সমান লম্বা’।
রাতুল ভাব নিয়ে বলল, ‘সাদা কাকা, তুমি দেখবে আমি আরও কত লম্বা হই?’
লেখক বুঝতে না পেরে হাসি হাসি মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, দেখব’।
রাতুল খপ করে পানির পাইপ থেকে ইটের গাঁথুনির রেলিঙের উপর দাঁড়াতে দাঁড়াতে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে বলল, ‘এই দেখ, আমি আরও কত লম্বা হয়েছি’।
লেখক চমকে উঠল। তৎক্ষণাৎ তার মুখ থেকে আঁ-আঁ শব্দ বের হয়ে এলো। সে আশা করেনি রাতুল রেলিঙের উপর উঠে যাবে। পানির পাইপ ধরে রেলিঙটা অবশ্য একটা পাঁচ বছরের ছেলের জন্য খুব একটা উঁচু নয়।
কিন্তু শব্দ করা পর্যন্তই। লেখকের দৃষ্টি বুজে এল। চোখ বুজতেই তার দৃষ্টির সামনে পুরোনো বিধ্বস্ত দৃশ্যটা পচা বোয়াল মাছের পেটির মতো ঝুলে পড়ল। সে বুঝতে পারল না, এ মুহূর্তে সেই পুরোনো বিধ্বস্ত দৃশ্যটা তার ভেতর জানান দিচ্ছে কেন?
লেখকের বারবার মনে হলো, তার নিজের ছেলেটার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তার ছেলেটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সে নিশ্চিত, তাদের আখন্দ বাড়ির লজিং মাস্টার তার ছেলেটাকে বেড়ানোর নাম করে কোনো নির্জনে গোমতী নদীর বর্ষায় ভরাটবানের ভেতর জলগর্ভে ফেলে দিয়েছে...!
লেখক চোখ খুলল।
সূর্যের লাল রশ্মিটা পশ্চিমের হাট দরজা গলে চিলেকোঠায় আর থেমে নেই। সেখানে থেমে রয়েছে ছায়ার একটা স্পষ্ট দাগ। সূর্যটা এরই মধ্যে ডুবে গেছে। কিন্তু চারদিকে গোধূলির আলো কেমন স্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
লেখক অপর ছাদের রেলিঙে রাতুলের ওপর নির্দিষ্ট করে ফেলতে গিয়ে হঠাৎ কেমন কেঁপে উঠল। অপর ছাদের রেলিঙটা যেন কেঁপে উঠল আরও এলোমেলোভাবে।
একটা হিম ¯্রােত বয়ে যাওয়ার আগেই লেখক চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল।
অপর ছাদের রেলিঙ ও ছাদের সর্বত্র তখন ফাঁকা।
চার.
সাজের নিষ্প্রভ আলো কখন যে আঁধারে গিলে খেয়েছে লেখক তা খেয়াল করেনি। দরজা বন্ধ। জানালাটাও বন্ধ এখন। হাত বাড়ালেই লেখক আলো জ্বালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু সে আলো জ্বালাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন আলোটা জ্বালালে তার চেহারার নষ্ট বাঁকগুলো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিবে।
লেখক সামনের দিকে ঝুঁকে স্থাণু হয়ে বসে আছে সেই তখন থেকে। যদিও অন্ধকার গলা চোখ, কিন্তু দৃষ্টিটা এলোমেলো। চিলেকোঠায় নিঃশব্দতা অন্ধকারে মতোই। লেখকের ভেতর আত্মদগ্ধতার ক্ষরণ।
হঠাৎ লেখক এই ক্ষরণের ভেতর নিঃশব্দতা ভেদ করা একটা শব্দ পেল। মনে হলো, যেন সিঁড়িরুমের দরজা খুলে ছাদে উঠে চিলেকোঠার দিকে কেউ আসছে। শব্দের ধরনটা এমন, কট-কট, কয়ট-কয়ট।
পরক্ষণই আবার চুপচাপ।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার শব্দ শুরু হলো। এবারের শব্দগুলো একটু ভিন্নতর, থুপ-থাপ, থুপ-থুপ, খস-খস।
আবারও চুপচাপ। লেখক চোখজোড়া অন্ধকারের ভেতর টান টান করল। দেহটাও আড়মোড়া ভেঙে সটান হলো। লেখকের ঠাহর করানো দৃষ্টি চিলেকোঠার দরজা থেকে জানালা, জানালা থেকে দরজা- এভাবে কিছুক্ষণ ঘুরল। তারপর দৃষ্টিটা আবার স্থির হলো স্থানু হয়ে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল কয়েকটি মুখ। মুখগুলো বিধ্বস্ত ও বড্ড বিপর্যস্ত। এরই মধ্যে একটা মুখ খানিকটা সতেজ ও স্পষ্ট।
লেখকের মনে হলো, এই বুঝি সেই সতেজ মুখটা আহলাদে ডেকে উঠবে, ‘সাদা কাকা, ও সাদা কাকা!’
লেখক যন্ত্রণায় কাতরে উঠল।
বাইরের শব্দটা আবার স্পষ্ট হলো। লেখক যেন এবার তার নিজস্ব তাড়নার পদশব্দ শুনল। এই শব্দটা সম্পর্কে লেখক পরিচিত। কচকচ আওয়াজ। চপ্পলের ঘর্ষণ। খসখসে ধ্বনি। দরজায় মৃদু স্পর্শ।
লেখক ভাবল, নিশ্চয়ই পরনারী এসেছে?
লেখকের তৎক্ষণাৎ একটা করুণ-বিধ্বস্ত দৃশ্য মনে হানা দিল। হয়তোবা তার স্ত্রীটা পালিয়ে যাবার আগে পাশের বাড়ির লজিং মাস্টারের দরজায় এভাবে পরিচিত স্পর্শের শব্দ করত? মাত্র তিন বছরের ব্যবধান।
লেখক উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলল। ঠাহর করানো দৃষ্টি নিয়ে ভেতরের অন্ধকার ভেদ করে সে বাইরের হাল্কা আলো-আঁধারিতে তাকাল। কিন্তু সে তাকিয়েই থমকে গেল। সে চমকে উঠলও বেশ। সে দেখল, তার সামনে রাতুল দাঁড়িয়ে আছে।
রাতুল দাঁত বের করে হাসছে।
লেখক তৎক্ষণাৎ কিছুই বুঝতে পারল না। শুধু নিঃশব্দটা ভেদ করে দরজা বন্ধের শব্দ হলো, পটাস।
রুমের অন্ধকার ও রাতের দেহে লেখক একাকার হয়ে গেল তখনই।