alt

literature » samoeky

অনন্ত নক্ষত্র বিথিতে এক নির্বাসিত কবির যাত্রা

পারভেজ আহসান

: বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫

দাউদ হায়দার

মৃত্যুই ইতি টানল কবি দাউদ হায়দারের নির্বাসিত জীবন। এই জনপদে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর আর হাঁটা হলো না তাঁর। দেখা হলো না ছোট্ট ইছামতির ধুধু বালুচর, বর্ষায় নদীর প্রমত্ততা। নিউমার্কেটে প্রাবন্ধিক হাসান ফেরদৌসের সাথে আর আড্ডা দেওয়া হলো না। ১০ মার্চ ১৯৭৪ সালে মতিঝিলে বাদল সরকারের লেখা বহুরূপীর প্রযোজনায় শম্ভু মিত্র কর্তৃক পরিচালিত নাটক, ‘পাগলা ঘোড়া’ দেখতে না পারার আফসোস বুকের গভীরে জমা রেখেই গত ২৬ এপ্রিল শনিবার জার্মানিতে স্থানীয় সময় রাত ন’টায় ৭৩ বছর বয়সে অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ খ্যাত এই কবি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে বার্লিনের রাইনিকেডর্ফ এলাকায় নিজ বাড়ির সিঁড়িতে পড়ে জ্ঞান হারালে প্রথমে রাইনিকেডর্ফ হাসপাতালে এবং পরবর্তীতে নয়েকোলন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসকদের ধারণা আঘাতজনিত কারণে মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় তিনি জ্ঞান হারান। এ অবস্থায় তাঁকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হলে তাঁর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয় এবং জ্ঞান ফিরে আসে, তবে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছিলেন না তিনি। তাঁর ¯œায়বিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে গ্রাইফভাল্ডার শহরের এক নিউরো হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেই হাসপাতালে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটলে গত মার্চ মাসে বার্লিন শহরের শ্যোনেবের্গ ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেই ক্লিনিকেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

স্কুল জীবন থেকেই কবি দাউদ হায়দারের কবিতা চর্চা শুরু। সিদ্ধেশ^রী স্কুলে অধ্যয়নকালে স্কুলের এক অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পাঠ করার মধ্য দিয়েই তার আত্মপ্রকাশ। ১৯৬৭ সালে ঢাকার একটি দৈনিকের রবিবাসরীয় সংখ্যায় তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয়। সত্তরের দশকের শুরুতে বিশ বছরে পা দিতে না দিতেই কবিতায় নিমগ্ন ও ধ্যানস্থ এই মানুষটি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে যান। ১৯৭৩ সালে লন্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি দাউদ হায়দারের একটি কবিতাকে ‘দ্য বেস্ট পোয়েম অব এশিয়া’ সম্মানে ভূষিত করে। তাঁর কাব্য প্রতিভার আলোকচ্ছটা যখন চতুর্দিক ছড়িয়ে পড়ছিল ঠিক তখনই ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎ¯œায় কালো বন্যায়’ শীর্ষক কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সৃষ্টির অভিযোগ এনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সে বছরের ১১ মার্চ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ২০ মার্চ তাকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ঠিক পরের দিন ১৯৭৪ সালের ২১ মে তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর দাউদ হায়দার হচ্ছেন প্রথম কবি যাঁকে কবিতা লেখার কারণে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কলকাতায় তিনি ১৩ বছর অবস্থান করেন। সেখানে বিশিষ্ট কবি ও লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। তিনি ১৯৮৭ সালের ২২ জুন জার্মানির নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের সহযোগিতায় ভারত ত্যাগ করে জার্মানিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

সাহিত্যের ইতিহাসে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় অনেক লেখক, কবি ও নাট্যকার কাটিয়েছেন নির্বাসিত জীবন। ফরাসি লেখক এমিল জোলা গ্রেফতার এড়াতে পাড়ি জমিয়েছিলেন লন্ডনে। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান ছিল ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও উদারনৈতিকতার পক্ষে। তিনি তার খোলা কলাম ‘জ একিজ’-এ ফ্রান্সের বিচার ব্যবস্থা ও সরকারের সমালোচনা করেন। উনিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ফরাসি সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো কাটিয়েছিলেন নির্বাসিত জীবন। তাঁর লেখায় রাজনীতি সম্পর্কে ভিন্ন বিষয় প্রকাশ করায় তৃতীয় নেপোলিয়নের রোষানলে পড়েন এবং দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন। যুক্তরাজ্য থেকে নিজদেশে ফেরা হয়নি ভিক্টর হুগোর। ইংল্যান্ডে অবস্থান করেই সামাজিক অবিচারের বিষয়কে উপজীব্য করে রচনা করেন ‘লা মিজারেবল’। অস্কার ওয়াইল্ড পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পাকার। অশোভন আচরণের জন্যে তিনি দ-প্রাপ্ত হন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি প্যারিসে চলে যান। সেখানে অবস্থান করেই রচনা করেন- ‘দি ইম্পর্ট্যানস অব বিইং অনেস্ট’। চির নির্বাসিত কবির নাম মাহমুদ দারবিশ। পৃথিবীর নীপিড়িত মানুষের হৃদয়ে প্রেরণার কন্ঠস্বর এই ফিলিস্থিনি কবি। ১৯৪১ সালের ৩১ মার্চ ফিলিস্তিনের গালিলি অঞ্চলের বিরওয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া এ বিপ্লবী কবি কাটিয়েছেন নির্বাসিত জীবন। ১৯৪৮ সালের এক রাতে ইসরাইলি সৈন্যরা তাদের গ্রাম আক্রমণ করলে তার পরিবারের সদস্যরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেয় পাশের দামুন গ্রামে। পরবর্তীতে পার্শ^বর্তী দেশ লেবাননে আশ্রয় নেয় তার পরিবার। সেই সময় থেকে দারবিশের শরনার্থী জীবন শুরু। কোথাও তার নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছিল না। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন প্রবাসে। কিন্তু কবি দাউদ হায়দারের প্রেক্ষাপট ছিল কিছুটা ভিন্ন। একটি কবিতাই রুদ্ধ করেছিল দেশে ফেরার সমস্থ পথ। প্রবল আকুলতা থাকা সত্ত্বেও এ কবি নিজ মাতৃভূমিতে আসতে পারেন নি। ফলে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা, শূন্যতা ও দুঃখের ভেতর কাটাতে হয়েছে সারাটা জীবন। একজন প্রবাসীই উপলব্ধি করতে পারে নিজ দেশ না ফিরতে পারার তীব্র দহন, তীব্র ক্ষরণ। প্রিয় মুখগুলোকে না দেখার অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। তাঁর ‘তোমার কথা’ কবিতায় মাতৃভূমির প্রতি প্রবল টান ও অনুরাগ মূর্ত হয়েং ওঠে কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে : ‘মাঝে মাঝে মনে হয় /অসীম শূন্যের ভেতর উড়ে যাই।/ মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার/বাংলাদেশ ঘুরে আসি। / মনে হয়, মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে /চিৎকার ক’রে / আকাশ ফাটিয়ে বলি; /.দ্যাখো, সীমান্তে ওই পাশে আমার ঘর/এইখানে আমি একা, ভীনদেশী।’

বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে দাউদ হায়দার আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলা সাহিত্যকে তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। বাংলা ভাষাকে হৃদয়ে ধারণকারী এই কবির দেশত্যাগের আগে কেবল ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুওেলা হচ্ছে: ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, ‘বেলাভূমে যখন হাঁটছিলাম, ঘটনার সূত্রপাত’, ‘সম্পন্ন মানুষ নই’, ‘নারকীয় ভুবনে কবিতা’ , ‘যে দেশে সবাই অন্ধ’, ‘সংগস অব ডেস্পায়ার’, ‘এই শাওনে এই পরবাসে’, ‘সমস্ত স্তরে ক্ষতচিহ্ন’, এবং ‘আমি পুড়েছি জ¦ালা ও আগুনে’। তাঁর লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ জার্মান, স্প্যানিশ, ফরাসি, ইংরেজি, জাপানি ও হিন্দি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

ইতিহাসে একজন কবির অথবা সাহিত্যিকের অবস্থান কতটুকু সুদৃঢ় হবে তা কেবল সময়ই নির্ধারণ করে। ঠিক একইভাবে নির্ধারণ করবে দাউদ হায়দারের কাব্য প্রতিভা ও শিল্পগুণ কতটুকু উজ্জ্বল।

পোয়েমস দ্যাট কেম টু মি

ছবি

লালন ও রবীন্দ্রনাথ অন্তর্জগতের আলাপন

ছবি

বংশধারা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

তিন প্রহরের শকুন

ছবি

ইলিয়াসের আশ্চর্য নিরীক্ষা

ছবি

যতীন সরকার : সাম্যবাদের চেতনায় একজীবন

ছবি

‘প্রান্তিক মানুষের হারানোর কিছু নেই’

ছবি

ভাঙা ছাদ

ছবি

চন্দ্রাবতী : মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি

ছবি

আধুনিক-উত্তর সময়ের নির্মিতি

ছবি

বংশধারা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আবুবকর সিদ্দিকের ছোট গল্পে রাজনীতি

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের তুলনামূলক বিচার

ছবি

সমকালীন কাব্যভাষায় কবি শহীদ কাদরী

ছবি

চরফুলের কন্যা

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রলোভন এবং ধৈর্যের গল্প

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

প্রেম, অস্তিত্ববাদ ও বেদনার দোলাচল

ছবি

‘কবিতার যুবরাজ’ কবি আবুল হাসান

ছবি

মানুষ, প্রকৃতি ও সুলতানের স্বকীয় অভিযাত্রা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

শালুক-এর শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা বাংলাদেশের সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন

ছবি

‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’: কুহক ও বিভ্রমের গল্প

ছবি

কল্পগল্প

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

আনন্দদায়ক ও অপ্রত্যাশিত নোবেল পুরস্কার

ছবি

জীবনবোধ ও শিল্পকর্ম

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

ছবি

কৃষ্ণাঙ্গ দাস থেকে হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমান কবি

শ্রাবণ বর্ষণে

ছবি

শতবর্ষ পরে ‘মিসেস ডালোওয়ে’

tab

literature » samoeky

অনন্ত নক্ষত্র বিথিতে এক নির্বাসিত কবির যাত্রা

পারভেজ আহসান

দাউদ হায়দার

বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫

মৃত্যুই ইতি টানল কবি দাউদ হায়দারের নির্বাসিত জীবন। এই জনপদে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর আর হাঁটা হলো না তাঁর। দেখা হলো না ছোট্ট ইছামতির ধুধু বালুচর, বর্ষায় নদীর প্রমত্ততা। নিউমার্কেটে প্রাবন্ধিক হাসান ফেরদৌসের সাথে আর আড্ডা দেওয়া হলো না। ১০ মার্চ ১৯৭৪ সালে মতিঝিলে বাদল সরকারের লেখা বহুরূপীর প্রযোজনায় শম্ভু মিত্র কর্তৃক পরিচালিত নাটক, ‘পাগলা ঘোড়া’ দেখতে না পারার আফসোস বুকের গভীরে জমা রেখেই গত ২৬ এপ্রিল শনিবার জার্মানিতে স্থানীয় সময় রাত ন’টায় ৭৩ বছর বয়সে অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ খ্যাত এই কবি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে বার্লিনের রাইনিকেডর্ফ এলাকায় নিজ বাড়ির সিঁড়িতে পড়ে জ্ঞান হারালে প্রথমে রাইনিকেডর্ফ হাসপাতালে এবং পরবর্তীতে নয়েকোলন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসকদের ধারণা আঘাতজনিত কারণে মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় তিনি জ্ঞান হারান। এ অবস্থায় তাঁকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হলে তাঁর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয় এবং জ্ঞান ফিরে আসে, তবে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছিলেন না তিনি। তাঁর ¯œায়বিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে গ্রাইফভাল্ডার শহরের এক নিউরো হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেই হাসপাতালে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটলে গত মার্চ মাসে বার্লিন শহরের শ্যোনেবের্গ ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেই ক্লিনিকেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

স্কুল জীবন থেকেই কবি দাউদ হায়দারের কবিতা চর্চা শুরু। সিদ্ধেশ^রী স্কুলে অধ্যয়নকালে স্কুলের এক অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পাঠ করার মধ্য দিয়েই তার আত্মপ্রকাশ। ১৯৬৭ সালে ঢাকার একটি দৈনিকের রবিবাসরীয় সংখ্যায় তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয়। সত্তরের দশকের শুরুতে বিশ বছরে পা দিতে না দিতেই কবিতায় নিমগ্ন ও ধ্যানস্থ এই মানুষটি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে যান। ১৯৭৩ সালে লন্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি দাউদ হায়দারের একটি কবিতাকে ‘দ্য বেস্ট পোয়েম অব এশিয়া’ সম্মানে ভূষিত করে। তাঁর কাব্য প্রতিভার আলোকচ্ছটা যখন চতুর্দিক ছড়িয়ে পড়ছিল ঠিক তখনই ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎ¯œায় কালো বন্যায়’ শীর্ষক কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সৃষ্টির অভিযোগ এনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সে বছরের ১১ মার্চ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ২০ মার্চ তাকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ঠিক পরের দিন ১৯৭৪ সালের ২১ মে তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর দাউদ হায়দার হচ্ছেন প্রথম কবি যাঁকে কবিতা লেখার কারণে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কলকাতায় তিনি ১৩ বছর অবস্থান করেন। সেখানে বিশিষ্ট কবি ও লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। তিনি ১৯৮৭ সালের ২২ জুন জার্মানির নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের সহযোগিতায় ভারত ত্যাগ করে জার্মানিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

সাহিত্যের ইতিহাসে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় অনেক লেখক, কবি ও নাট্যকার কাটিয়েছেন নির্বাসিত জীবন। ফরাসি লেখক এমিল জোলা গ্রেফতার এড়াতে পাড়ি জমিয়েছিলেন লন্ডনে। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান ছিল ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও উদারনৈতিকতার পক্ষে। তিনি তার খোলা কলাম ‘জ একিজ’-এ ফ্রান্সের বিচার ব্যবস্থা ও সরকারের সমালোচনা করেন। উনিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ফরাসি সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো কাটিয়েছিলেন নির্বাসিত জীবন। তাঁর লেখায় রাজনীতি সম্পর্কে ভিন্ন বিষয় প্রকাশ করায় তৃতীয় নেপোলিয়নের রোষানলে পড়েন এবং দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন। যুক্তরাজ্য থেকে নিজদেশে ফেরা হয়নি ভিক্টর হুগোর। ইংল্যান্ডে অবস্থান করেই সামাজিক অবিচারের বিষয়কে উপজীব্য করে রচনা করেন ‘লা মিজারেবল’। অস্কার ওয়াইল্ড পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পাকার। অশোভন আচরণের জন্যে তিনি দ-প্রাপ্ত হন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি প্যারিসে চলে যান। সেখানে অবস্থান করেই রচনা করেন- ‘দি ইম্পর্ট্যানস অব বিইং অনেস্ট’। চির নির্বাসিত কবির নাম মাহমুদ দারবিশ। পৃথিবীর নীপিড়িত মানুষের হৃদয়ে প্রেরণার কন্ঠস্বর এই ফিলিস্থিনি কবি। ১৯৪১ সালের ৩১ মার্চ ফিলিস্তিনের গালিলি অঞ্চলের বিরওয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া এ বিপ্লবী কবি কাটিয়েছেন নির্বাসিত জীবন। ১৯৪৮ সালের এক রাতে ইসরাইলি সৈন্যরা তাদের গ্রাম আক্রমণ করলে তার পরিবারের সদস্যরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেয় পাশের দামুন গ্রামে। পরবর্তীতে পার্শ^বর্তী দেশ লেবাননে আশ্রয় নেয় তার পরিবার। সেই সময় থেকে দারবিশের শরনার্থী জীবন শুরু। কোথাও তার নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছিল না। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন প্রবাসে। কিন্তু কবি দাউদ হায়দারের প্রেক্ষাপট ছিল কিছুটা ভিন্ন। একটি কবিতাই রুদ্ধ করেছিল দেশে ফেরার সমস্থ পথ। প্রবল আকুলতা থাকা সত্ত্বেও এ কবি নিজ মাতৃভূমিতে আসতে পারেন নি। ফলে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা, শূন্যতা ও দুঃখের ভেতর কাটাতে হয়েছে সারাটা জীবন। একজন প্রবাসীই উপলব্ধি করতে পারে নিজ দেশ না ফিরতে পারার তীব্র দহন, তীব্র ক্ষরণ। প্রিয় মুখগুলোকে না দেখার অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। তাঁর ‘তোমার কথা’ কবিতায় মাতৃভূমির প্রতি প্রবল টান ও অনুরাগ মূর্ত হয়েং ওঠে কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে : ‘মাঝে মাঝে মনে হয় /অসীম শূন্যের ভেতর উড়ে যাই।/ মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার/বাংলাদেশ ঘুরে আসি। / মনে হয়, মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে /চিৎকার ক’রে / আকাশ ফাটিয়ে বলি; /.দ্যাখো, সীমান্তে ওই পাশে আমার ঘর/এইখানে আমি একা, ভীনদেশী।’

বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে দাউদ হায়দার আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলা সাহিত্যকে তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। বাংলা ভাষাকে হৃদয়ে ধারণকারী এই কবির দেশত্যাগের আগে কেবল ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুওেলা হচ্ছে: ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, ‘বেলাভূমে যখন হাঁটছিলাম, ঘটনার সূত্রপাত’, ‘সম্পন্ন মানুষ নই’, ‘নারকীয় ভুবনে কবিতা’ , ‘যে দেশে সবাই অন্ধ’, ‘সংগস অব ডেস্পায়ার’, ‘এই শাওনে এই পরবাসে’, ‘সমস্ত স্তরে ক্ষতচিহ্ন’, এবং ‘আমি পুড়েছি জ¦ালা ও আগুনে’। তাঁর লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ জার্মান, স্প্যানিশ, ফরাসি, ইংরেজি, জাপানি ও হিন্দি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

ইতিহাসে একজন কবির অথবা সাহিত্যিকের অবস্থান কতটুকু সুদৃঢ় হবে তা কেবল সময়ই নির্ধারণ করে। ঠিক একইভাবে নির্ধারণ করবে দাউদ হায়দারের কাব্য প্রতিভা ও শিল্পগুণ কতটুকু উজ্জ্বল।

back to top