alt

literature » samoeky

বংশধারা

আনিস রহমান

: বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বিকেলে বাড়ির সামনে খোলা চাতালে শালিস বসে। ইউপি চেয়ারম্যান, লোকাল মেম্বারও এসেছে এবার। রহিম বক্সই ওদের আনার বন্দোবস্ত করেছে।

তা মজি প্রধান তার ভিটি বিক্রি করতেই পারে। ঘর বিক্রি করতেই পারে। আমরা বাধা দেয়ার কে?

চেয়ারম্যানের কথার জোগালি হিশেবে এবার মেম্বার গলা খাকারি দিয়ে বাজখাঁই শব্দ তোলে, মুরুব্বিদের কাছে জানতে চাই, এইহানে আমরা রহিম বক্সের কামে বাধা দেয়ার কেডা! মজি কাকার বাপ-দাদার ভিটি এইডা। কী কথা ঠিক কইলাম কিনা!

হাছা কথাই তো!

তার বাপের এক পুত সে! তাইলে ওর জমি ওর ভিটি হেয় বিক্রি করবো আমরা বাধা দেই কোন আক্কেলে!

বাড়ির লোকজন সবাই চুপ। বাইরে থেকে আনা ভাড়াটে লোকজন কেবল সায় দিয়ে যাচ্ছিল মেম্বারের কথায়।

আসলে যা বুঝলাম কোনো সমস্যা নাই। রহিম বক্স জায়গা কিনছে ভিটি অহন ওর। ও ঘর তুলবো না গোয়াল ঘর করবো এইডা ওর ব্যাপার! আমরা বাধা দেওয়ার কেডা? কেউ বাধা দিলে খবর আছে!

মেম্বার এবার দম নেয়। মনে হয় মুশকিল আসান! অন্তত ওর হাবভাবে তাই মনে হচ্ছে।

বুড়– প্রধান সর্ষের তেল মাখা ওর চকচকে মুখখানি দুহাতের তালু দিয়ে ঘষতে ঘষতে বললো, মেম্বার সাবের কথাই যদি বিচার হয়, তাইলে তো আপনাগো এই বিচার মানলাম না চেয়ারম্যান সাব! এইডা মানা যায় না! একতরফা শালিস!

কী! চোখমুখ লাল হয়ে যায় গেসু চেয়ারম্যানের। মেম্বার চেয়ারের হাতল চেপে একবার উঠে দাঁড়ায়। ফের বসে পড়ে। বুড়– তোমার সাহস কত?

সাহসের কথা কেন কইতাছেন? আমরা কি আপনাগো শালিসি করার জন্য ডাকছি। আমরা তো ডাকি নাই আপনাগো। আমরা আপনাগো ডাকে সাড়া না দিলেও তো পারতাম। কারণ এই শালিসের আমরা কোনো পক্ষ না। কাউরে ডাকিও নাই!

তোমরা ডাকো নাই! তবে রহিম বক্স লিখিত বিচার দিছে!

আমরা কি তবে বিবাদী! বাদী কন আর বিবাদী কন, আপনাগো যেহেতু ডাকি নাই আমরা! কিংবা শালিসির কোনো নোটিশ পাই নাই! সেহেতু আপনাগো বিচার মানার কোনো বাধ্যবাধকতা কিংবা দায় আমাগো নাই। আপনারা এইবার আসতে পারেন!

শুধু সাহস না, দুঃসাহস দেখাইলা বুড়–।

অলি এবার একটু আড়মোড়া ভেঙে বলে, সাহসের কী দেখলেন। ন্যায্য কতা কইছে! ভুল কিছু তো কয় নাই!

মেম্বার এবার গলা ছাড়ে- বুড়–র কথা কি তোমাদেরও কথা!

বাড়ির সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, কাকার কথা আমাগো মনের কথা। আমাগো সিদ্ধান্ত। এর একচুলও নড়চড় হবার নয়!

এরপর টাবলু ওর মামা, উকিল এবং মেম্বার, চেয়ারম্যান ও রহিম বক্স মিলে সামান্য দূরে গিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ায়, আকারে-ইঙ্গিতে কী সব কথা বলে শরীর ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ছড়িয়ে পড়ে ওরা যার যার গন্তব্যে।

তখন পেছন থেকে শুধু ওদের কানে আসে- সাহস থাকলে তবে মোকাবেলা করুক!

কী শলাপরামর্শ হয়েছে কে জানে! পরের শুক্রবার থেকে এ বাড়ির মসজিদে এসে জুমার নামাজ পড়ছে রহিম বক্স। মসজিদে এলে সবার দৃষ্টি পড়বে, গুরুত্ব পাবে অন্যরকম, এমনটিই আশা করেছিলো বোধ হয় রহিম বক্স। কিন্তু সামনে যাবার কোনো সুযোগ পায়নি কিংবা কেউ সরে বসতে দেয়নি ওকে সামনের কোনো লাইনে। কারও কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই ওর প্রতি! নামাজ শেষে কেউ ফিরেও দেখেনি ওকে। যে যার মতো বাড়ির দিকে রওনা দেয় ক্ষেতের আল ধরে।

ভিড় কমে এলে একটু একটু করে ওর নতুন ভিটির দিকে পা বাড়ায় রহিম। উঠোন মাড়িয়ে ঘরের ভিটি অবধি যে যাবে সে সুযোগ আর হয় না। কয়েকটা নেড়ি কুত্তা ঘেউ ঘেউ করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নেয় মুহূর্তে। খোপের পায়রাগুলো এলোপাতাড়ি ওড়াউড়ি জুড়ে দেয়। পাখিদের বিচলিত-আতঙ্কিত কিচির-মিচির গাছের শাখায়। বাসা আগলে থাকা পাখিগুলো ডিম না হয় ছানাদের ছেড়ে সরছে না কোথাও। দু’ডানা মেলে উড়ে উড়ে বাসা পাহারা দিচ্ছে পাখিগুলো।

“অবস্থা তো বেগতিক! বাঘডাঁশা অইলো নাকি!” হুশ হুশ করে বাইরে আসে মতি। এসে দেখে কিসের বাঘডাঁশা! রহিম বক্স!

আপনি এইহানে কী করেন। চোরের লাহান চুপিচুপি আইয়া কী দেহেন!

রহিম বক্স মুখে কিছু না বলে শরীর ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ফের ফিরতি পথে পা বাড়ায়। শুধু রেখে যায় ওর গায়ে মাখা আতরের পলকা সুবাস!

প্রায় দু’শ’ বছরের পুরনো এ বাড়ি। অনেক রক্তের প্রবাহ থেকে তৈরি হয়েছে নতুন অনেক জীবন। প্রাণ থেকে হয়েছে নতুন প্রাণের সঞ্চার। একসময় অর্থ ছিলো, ঐতিহ্য ছিলো, আভিজাত্য ছিলো, বনেদী জীবন ছিলো এ ভিটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেসংগে ছিলো আভিজাত্যে অন্ধ মানুষের উন্মাদনা। সময়কে হাত ধরে কাছে টানেনি কেউ। বুকে জড়িয়ে ধরেনি কেউ। বরং ছিলো উপেক্ষা এবং ভ্রƒক্ষেপ না করার অনীহা। স্বভাবতই ঐতিহ্যের মহিমায় ফাটল ধরে। সে ধারা অক্ষুণœ থাকেনি। আভিজাত্যকে ধরে রাখতে পারিনি বংশধরেরা।

কৃষিতে মনোনিবেশ ছিলো সবার। পাঠে নয়। স্কুলে নয়। চড়াই-উৎরাইয়ের সে এক জীবন ছিলো বটে!। কখনও ফসল গোলায় উঠেছে। কখনও অতি বৃষ্টি না হয় অনাবৃষ্টিতে ফসল মাঠে মারা গেছে। অভাব উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। সুতরাং জমি বন্ধক দিয়ে ঋণ নেবার নতুন জীবন ধারার সূচনা হলো। কখনও কখনও একনাগাড়ে ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে প্রত্যেকেরই মাজা ভেঙে পড়ে এক এক করে। “তাই বইলা শরীরে তো লোউ (রক্ত) অহনো আছে। তারে তো বাদ দেওয়া যাইবো না! এ রক্তরে অস্বীকারও করা যাইবো না!”

ভাঙা ঘরে শন পড়েনি। জল পড়ে টুপটাপ, একটু বৃষ্টি হলেই। বাঁশের ভেতরে ঘুণের বাসা। বাঁশ কাঁপে, ঘর কাঁপে একটু বাতাস দিতেই। ডোবা-বিলে-ধানক্ষেতে জমে থাকা জলের যৎসামান্য মাছের ওপর জীবন ওদের। কদাচিৎ ঘরের মুরগি। এর বাইরে জীবন তো শাকভাত আর লঙ্কার মধ্যেই আটকে আছে! “শাক, শুঁটকি আর পেঁয়াজ খাওয়া রক্ত হইলে কী হইবে! কিন্তু শইল্যের লউ তো মিছা না! এট্টুখানি খোঁচা দিলে ফিনকি দিয়া যে লউ বার অইবো তা তো ধার করা কোনো লউ না। তা পরধাইন্যাগো লউ। লউয়ের ধারা দেখলেই কওন যায়- আর কারও না! এইডা পরধাইন্যাগো লউ!”

ওদের স্বগোক্তি- এই রক্তের মানুষ হাতি চড়ে বেড়াতে যেতো। পালকি চড়ে নায়রে যেতো। বাঘ শিকারে যেতো সুদূর বার্মাতে। রোজ রোজ চেনা-অচেনা, জানা-অজানা অসংখ্য মানুষের পাত পড়তো এবাড়িতে। গয়না নৌকার বহর যখন ছুটতো বরযাত্রী নিয়ে- মানুষ চক্ষে চড়ক দেখতো শুধু। “সেই পরধাইন্যা গো লউ এই বাড়ির হগল মানুষের গায়ে। তিরতির কইরা বয় সারাদিন। কোনো নিস্তার নাই। বইয়া যায় বিরামহীন গতিতে। সেই পরধাইন্যাগোর ভিটিতে ঘর করলেই কি আর পরধাইন্যা বংশের মানুষ অওয়া যায়! এই বংশের মানুষ অইতে অইলে এই রক্তের মধ্যে জন্ম নিতে হয়।”

“ঘর মিছা মাডি মিছা কিন্তু বংশের লউ! বংশের কতাই।”

টাকার জোরে ভিটি হয়। দালান হয়। ঘর হয়। কিন্তু রক্ত! এ রক্ত পাবে কোথায় রহিম বক্স! সুতরাং বারবাড়ির কোনো মানুষ এবাড়ির ভিটিতে পা দিতে পারবে না। কখনওই না! এ বাড়ির নিজস্ব এক পর্দা আছে। আদব আছে। “ইচ্ছা করলেই কি কেউ এ বাড়ির মাগি (মেয়ে) মাইন্যের (মানুষ) লগে দেহা করতে পারে! পুরুষের লগে কথা কইতে অইলেও তমিজের সংগে কইতে হয়। হেই বাড়িতে কোনো মুল্লুকের রহিম বক্স ঘর করবো ভিটি বাঁধবো! কল্পনায়ও সম্ভব না। সাফ কথা।” তীব্র ক্রোধ আর ক্ষোভ সংগে মিশিয়ে গর্জে ওঠে অনেকগুলো কণ্ঠ সমস্বরে!

এই ত্রিসীমানার মধ্যে রহিম বক্সের স্বজন-আত্মীয় বলে কেউ নেই। গুদারাঘাটের কাছে জমি কিনে ওর ব্যবসা। ঘর কোথায়, বাড়ি কোথায়, পরিবার কোথায় কেউ জানে না। গুদারাঘাটও কাছে না একেবারে! পাঁচ মাইল দূরে- শীতলক্ষ্যার ধারে। “সে আইসে পরধাইন্যাগ বংশ কিনতে!” সালামের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ে তীব্রভাবে।

এদিকটায় আগে সেভাবে কখনও আসেনি রহিম বক্স। এবারে প্রধানদের ভিটি কেনার সুবাদে আশেপাশের জমি, চক, ডোবা পুকুর সব যেন তন্ন তন্ন করে মুখস্থ করে নেয় রহিম বক্স। ছবি এঁকে নেয় মস্তিষ্কের কোষে কোষে, হৃদয়ে, চিন্তার সকল অলিগলিতে।

সত্যি অবাক করার মতো ঘটনা!

কদিন বাদেই এখানকার সড়কে বড় বড় দুটো ট্রাক্টর এসে ভটভট শব্দ তুলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে রাস্তা দাপিয়ে বেড়াতে থাকে। সকাল থেকে শুরু হয়। সন্ধ্যা অবধি চলে ট্রাক্টরের নির্যাতন। শব্দে বুক কাঁপে। কান তবদা লেগে যায়। সবচেয়ে বড় কথা ইটের সলিং করা সরু রাস্তাটি ভেঙে পড়তে থাকে এখানে ওখানে। দুদিনেই রাস্তার চেহারা পাল্টে গেছে অনেকখানি। খানা-খন্দকে ভরে উঠছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল রহিম বক্সের ট্রাক্টর এ দুটো। মাটি সাপ্লাইয়ের কাজ নিয়েছে ও কদিন হলো। এদিককার মাটি নাকি সরোস- বেশ আঁঠলো। তাই এখানকার মাটি পুঁজি করে নতুন ব্যবসা ফেঁদেছে রহিম বক্স!

ওর ট্রাক্টর আসে। লোকজন আসে নিয়মিত। মাটি কাটে, ট্রাক্টর বোঝাই করে ভট্ভট্ শব্দ তুলে চলে যায়। ফের আসে। কিন্তু কখনও রহিম বক্স আসে না। আসে না ওর নতুন ব্যবসার খোঁজ নিতে। অগত্যা হাটের দিন পাড়ার লোকজন দল বেঁধে যায় রহিম বক্সের কাছে। গিয়ে শোনে, সে আর তখন ‘বক্স’ নেই। মাতুব্বর হয়েছে। রহিম মাতুব্বর! হাটের লোকজন কেউ কেউ মুচকি হাসে। কেউ চোখে চোখে চায়। কৌতুকপ্রদ দৃষ্ট ওদের। ওরা জানায় রহিম বক্সকে, রাস্তার কথা, বিকট শব্দের কথা! জমির মাটি কাটা নিয়ে বিপদের কথা। শেষে জানায়- ট্রাক্টর তুলতে হবে! এ রাস্তা থেকে। এ রাস্তায় ট্রাক্টর চলবে না। রহিম বক্স দ্রুত হাতড়ে ক্যাশের টাকা বের করছিলো। একশ পঞ্চাশ পাঁচশ হাজার নোটগুলো আলাদা করে রাখছিলো পাশে। ব্যাংকারকের মতোই দ্রুত টাকা গুনতে জানে রহিম বক্স। হিসাবে একটু ভুল হয়ে যায় ওদের কথা শুনে। স্থির চোখে খানিক সময় দেখে ওদের। ফের টাকা গোনায় মন দেয়। ওরা আবারও বলে, গলা নামিয়ে দাঁত চিবিয়ে—“ট্রাক্টর উঠাইতে অইবো রহিম বক্স।”

আমি বক্স না মাতুব্বর।

তাও ভালো- পরে আবার পরধাইন্যাগ বংশ লইয়া টানাটানি কইরো না!

রহিম বক্স ঝিম মেরে যায়। শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে আসে! কথা বলতে পারে না অনেকটা সময়!

ভিটি কিনছি- ঘর করতে পারুম না! ট্রাক্টর কিনছি- চালাইতে পারুম না! আরও কী কী পারুম না- কইয়া যাও! বাপ-দাদার রাস্তা যেন!- কথাগুলো তখনই বাতাসে মিলিয়ে যায়। কানে তোলে না রহিম বক্স।

ওরা এবার শাসানো কণ্ঠে, খাদে নামিয়ে আনা কণ্ঠে ফের জানিয়ে দেয়।“রাস্তায় ট্রাক্টর চলবো না। এক কথা!”

ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ এবং উত্তেজিত অনেকগুলো শরীর সরে যেতেই একদঙ্গল বাতাস এসে হামলে পড়ে রহিম বক্সের গদিতে। ও চোখ বোজে চরম ক্লান্তি নিয়ে। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর নেমে যাচ্ছে একটু একটু করে। বিড়বিড় করে ওঠে- “পাংখা গজাইছে। শুয়রের ছাও হগল!”

এদিকে রহিম বক্স নিয়মিত প্রধানদের বাড়ি আসে। মসজিদ অবধি ওর দৌড়। এর বেশি এগোতে সাহস করে না। তবে এখন জুমার নামাজ ছাড়াও কখনও বিকেলে-সন্ধ্যায় আসে নামাজ আদায় করতে।

এক বিকেলে নামাজ শেষে কারও কোনো অনুমতি ছাড়াই ইমাম সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়- মুসল্লিগণ দুইডা কথা কইতাম।

কী কথা! আপনার আবার কী কথা! বিরক্তির সুর ঘরজুড়ে।

বেশি না। দুইডা কথা! এক কথা, পাশের জমিটা নিয়া কেতুর লগে আমার কথা অইছে। জমিডা ও বিক্রি করবো, আমি কিনুম। তারপর এ জমি মসজিদে ওয়াক্ফ কইরা দিমু। মানে দান করমু! নিয়ত পাক্কা! মসজিদের জায়গা বড় হইবো তখন! রহিম বক্সের কণ্ঠে গদগদ ভাব!

সবাই কেমন ঝিম মেরে যায়। এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। চোখের দিকে তাকায়! কারও মুখে রা সরে না। সবার চোখে শুধু বিস্ময় এবং কৌতূহল।

রহিম বক্স ফের গলা সাফ করে বলে, আমি দেখলাম মসজিদের সীমানায় আপনারা সব ফল-ফলারির গাছ লাগাইছেন! এর বিপদ নিয়া কেউ কি এট্টু ভাবছেন! মহা বিপদ! ঘোর বিপদ! ভাবলে আমার চোখে ঘুম আসে না!

না, আমরা কিছু ভাবি নাই। আপনি কী ভাবছেন কন!

রহিম বক্স চোখ উল্টে পুতুলি দুটো কোথায় যেন গায়েব করে দেয় মুহূর্তে! শুধু চোখের ঘোলাটে জমিটুকু ভেসে থাকে মরা মাছে ফ্যাকাশে চোখের মতো! এরপর চোখ দুটো স্বাভাবিক করে বলে, চাইর দিকে এতো গাছগাছালি। কী মনোরকম। কিন্তু গাছগুলা অহনও বাত্তি অয় নাই। জোয়ান হইতে দেরি আছে! কিন্তু এসব গাছে যখন...!

রশিদ বাধা দিয়ে বলে, আপনার আসল কথা কী তাই কন!

আসলে গাছগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়া ভাবছে রহিম বক্স। গাছগুলো নিয়ে ওর উৎকণ্ঠার শেষ নেই। কারণ একসময় এসব গাছে ফল হবে, ফল পাকবে। ঝড়ে না হয় বাতাসে, না হয় পাখির ঠোকর খেয়ে যেসব ফল ঝরে পড়বে। তখন সেসব ফলের ভাগ নিয়ে হবে লাঠালাঠি, মারামারি। নির্ঘাত কখনও কখনও মানুষও খুন হবে। দিব্যচোখে তা দেখতে পাচ্ছে রহিম বক্স। প্রায় পাকা ফল গাছ থেকে পড়লো, এ নিয়ে দুটো বাচ্চার মধ্যে কাড়াকাড়ি, পরে মারামারি হতে কতক্ষণ। গাছগুলো সব অশান্তির প্রতীক। গাছগুলো শুধু রক্ত চায়। দিব্য চোখে তাই দেখতে পাচ্ছে রহিম বক্স! বাচ্চাদের মারামারি, ঝগড়াঝাটি শেষে পরিবার থেকে পড়শি পর্যন্ত গড়াবে। সুতরাং ফল-ফলারির গাছ নয়। কোনোভাবেই নয়। এসব গাছ এখনই কেটে ফেলতে হবে। পরে নতুন জমি ভরাট করে ওষুধি আর কাঠ গাছ লাগাতে হবে। এ আমার পরিকল্পনা!

এর মধ্যে নানা গুঞ্জন, ফিসফিস কণ্ঠের ওঠা-নামা শুরু হয়ে গেছে। এ ফাঁকে আনু পাগলা কখন যে বেরিয়ে গেছে মসজিদ থেকে কেউ খেয়াল করেনি। হঠাৎ আনু পাগলা গলা চড়াতে চড়াতে ছুটে আসে “গাছে কাডল (কাঁঠাল) গোঁফে তেল। গাছে কাডল...। বলেই লাঠি উঁচিয়ে ঢুকে পড়ে মসজিদে- তর পরিকল্পনার গুষ্টি খিলাই। বাঁচতে চাইলে এহনি দৌড়া। দৌড়া কইতাছি!” বলেই মসজিদের দেয়ালের মেঝেতে দরাম করে আঘাত করে ওর লাঠি দিয়ে।

ঘটনার আকস্মিকতায় রহিম বক্স হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে দ্বিগি¦দিক ছুটতে থাকে ক্ষেতের আল ধরে। পেছন পেছন আনু পাগলা। আকাশ মুখো ওর লাঠি। চকচক চকচক করছে শুধু। কী ক্ষিপ্র তার সংগে দৌড়!

এদিকে দিন যায়। কিন্তু অবস্থা যে কে সেই! দিনভর ভটভটি শব্দ! রাস্তা এবড়ো-খেবড়ো হয়েছে আরও অনেক জায়গাজুড়ে। বিকেল গা মেলেছে তখন। বাতাসে বৃষ্টি ভেজা প্রশান্তি। রোদের গায়ে মোমগলা কোমলতা! কিন্তু উপভোগের সুযোগ নেই। ভটভটির বিকট শব্দ! কেড়ে নিয়েছে সুখ।

এ পথটি এঁকেবেঁকে উত্তরে চলে গেছে অনেক দূর। কী এক ইশারায় পথের দু-ধারে গ্রাম থেকে মানুষ এসে জড়ো হয় একে একে। আগের রাতে অনেকে বসে কী যেন শলাপরামর্শ করেছে। এদের ডাকেই কি সাড়া দিয়ে আসছে লোকগুলো! কে জানে! কিন্তু চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা ঘটবে হয়তো। এরই মধ্যে দুটো ট্রাক্টর প্রায় মুখোমুখি। প্রধানদের বাড়ি ছেড়ে আরও খানিকটা এগিয়ে ক্রস করছিলো একটি আরেকটিকে। একটি মাটি ভরা- রাখতে যাচ্ছে। অন্যটি মাটি রেখে শূন্য ট্রাক্টর ফিরেছে। দুটো ট্রাক্টরকে হাতের ইশারায় থামাতে বলে লোকজন। শেষে ওদের রাস্তার একপাশে সরিয়ে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে মুহূর্তে। অমনি হুইসেল বাজতেই হামলে পড়ে ওরা ড্রাইভার আর লেবারদের ওপর। স্টিয়ারিং ভেঙে ফেলে মুহূর্তে, শাবল আর কুড়োলের আঘাতে। ইলেকট্রিক কানেকশন ছিঁড়ে ফেলে। তেলের ট্যাংক ছিদ্র করে ফেলে কুড়োলের আঘাতে!

চাকার ওপর শাবল-কুড়োলের ঘা পড়ে মুহুর্মুহু। বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন প্রান্তিক মানুষগুলোকে যেন এখন আর চেনা যায় না। ছাইয়ের মধ্যে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত বুলেটের মতো যেন ফুটছে ওরা। বেদম মার খেয়ে ড্রাইভার এবং ওদের লোকজন খোড়াতে খোড়াতে চলে যায়!

কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে আগুন দেয়ার চেষ্টা করে ট্রাক্টরের গায়ে। কিন্তু বাঁধার মুখে আর পারেনি। অঙ্গহীন হয়ে ট্রাক্টরগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে রাস্তার ধারে।

রাত আরও বাড়ে। গভীর হয়। জোনাক পোকারা আরও স্বতঃস্ফূর্ত আরও আলোকময়! সে সংগে মানুষের জটলাও কমে আসে একটু একটু করে। তখুনি চোখে পড়ে বাতি আর হ্যাজাক ও হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কারা যেন আসছে এদিকে। মাঝে মাঝে মোবাইলের টর্চ পিড়িক পিড়িক জ্বলে উঠছে অন্ধকার ভেদ করে। মøান আলোয় হ্যাজাক আর হ্যারিকেনের কিম্ভুকিমাকার দুটো ছায়া দুলতে থাকে। নেতাগোছের কয়েকজন মানুষ তখনও ছিলো ট্রাক্টরের আশপাশে। পুলিশ ভেবে ওরা একটু সরে যায় আড়ালে। গভীর অন্ধকারে।

লোকগুলো ট্রাক্টরের আশপাশ ঘিরে দাঁড়ায়। সবাই শাদা পোশাকে। সম্ভবত পুলিশের কেউ না! ক্ষয়ক্ষতি মেপেজোকে দেখে ওরা।

“মানুষগুলা মনে হয় কুত্তা পাগলা হইয়া গেছিলো! না হইলে এতো বড় ট্রাক্টর অথচ ক্ষতি...। মুখে চুকচুক করে ওঠে লোকগুলো।

ড্রাইভার লেবার ওগো খবর কী, কেমন আছে? খসখসে কণ্ঠে কে যেন জানতে চায়।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হইছে!

আহা! আহা! বেজন্মার ঘরের বেজন্মা। মানুষের পয়দা না! অমানুষের মতো মারছে আমার মানুষগুলারে।

কণ্ঠ চেনা চেনা। কিন্তু মানুষটা চেনা যায় না! একে তো অন্ধকার! তার ওপর গামছায় মুখ ঢাকা। মাথায় কালো কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা।

খুব সকালে দূত আসে বাড়িতে। ট্রাক্টর আর চলবে না এ সড়কে। এখন শুধু চাবি দরকার! ট্রাক্টর সরিয়ে নেবে নতুন বাড়ির শখ নাকি মিটে গেছে ওর! বিকেলে খবর আসে রহিম বক্স মজি প্রধানের বাড়ি গিয়েছে ঢাকায়। দলিল ফিরিয়ে দিতে গেছে। সংগে আহত লোকদের রক্তখমাখা ছবি এবং ক্ষতবিক্ষত ট্রাক্টরের ছবি মোবাইলে লোড করে নিয়েছে।

শেষ অবধি রক্তের ভেজাল করার নীলনক্শা রুখে দিতে পেরে আনন্দের সীমা নেই গাঁয়ের মানুষগুলোর।

“আমাগো রক্ত দূষিত করার, ভেজাল করার দুঃসাহস আর কেউ দেহাইবো না কোনোদিন!

“শিক্ষা হইছে! চরম শিক্ষা!”

বিক্ষিপ্তভাবে কারা যেন মন্তব্য করছে এদিক-ওদিক! চেনা যায় না! অসংখ্য মুখ! কে কাকে চেনে! দূর-দূরান্ত থেকেও এসেছে অনেকে!

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা কিংবা ভয়মুক্ত পাখিদের ঝাঁক তখন উড়ে যাচ্ছে। আনন্দকে ডানায় করে এখন ওদের ঘরে ফেরার পালা। ঠোঁটে ওদের ঝঙ্কার। পাখায় মাতাল ছন্দ। শেষ বিকেলের পয়মন্ত রোদ ওদের আদর করে দিচ্ছে পরম মমতায়!

সে রোদ ছুঁয়ে আছে আনন্দে মাতাল গাঁয়ের মানুষগুলোর তামাটে শরীর! সুন্দর! শুধু সুন্দরের আহ্বান তখন চারদিকে! (সমাপ্ত)

পোয়েমস দ্যাট কেম টু মি

ছবি

লালন ও রবীন্দ্রনাথ অন্তর্জগতের আলাপন

ছবি

অনন্ত নক্ষত্র বিথিতে এক নির্বাসিত কবির যাত্রা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

তিন প্রহরের শকুন

ছবি

ইলিয়াসের আশ্চর্য নিরীক্ষা

ছবি

যতীন সরকার : সাম্যবাদের চেতনায় একজীবন

ছবি

‘প্রান্তিক মানুষের হারানোর কিছু নেই’

ছবি

ভাঙা ছাদ

ছবি

চন্দ্রাবতী : মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি

ছবি

আধুনিক-উত্তর সময়ের নির্মিতি

ছবি

বংশধারা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আবুবকর সিদ্দিকের ছোট গল্পে রাজনীতি

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের তুলনামূলক বিচার

ছবি

সমকালীন কাব্যভাষায় কবি শহীদ কাদরী

ছবি

চরফুলের কন্যা

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রলোভন এবং ধৈর্যের গল্প

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

প্রেম, অস্তিত্ববাদ ও বেদনার দোলাচল

ছবি

‘কবিতার যুবরাজ’ কবি আবুল হাসান

ছবি

মানুষ, প্রকৃতি ও সুলতানের স্বকীয় অভিযাত্রা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

শালুক-এর শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা বাংলাদেশের সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন

ছবি

‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’: কুহক ও বিভ্রমের গল্প

ছবি

কল্পগল্প

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

আনন্দদায়ক ও অপ্রত্যাশিত নোবেল পুরস্কার

ছবি

জীবনবোধ ও শিল্পকর্ম

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

ছবি

কৃষ্ণাঙ্গ দাস থেকে হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমান কবি

শ্রাবণ বর্ষণে

ছবি

শতবর্ষ পরে ‘মিসেস ডালোওয়ে’

tab

literature » samoeky

বংশধারা

আনিস রহমান

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫

বিকেলে বাড়ির সামনে খোলা চাতালে শালিস বসে। ইউপি চেয়ারম্যান, লোকাল মেম্বারও এসেছে এবার। রহিম বক্সই ওদের আনার বন্দোবস্ত করেছে।

তা মজি প্রধান তার ভিটি বিক্রি করতেই পারে। ঘর বিক্রি করতেই পারে। আমরা বাধা দেয়ার কে?

চেয়ারম্যানের কথার জোগালি হিশেবে এবার মেম্বার গলা খাকারি দিয়ে বাজখাঁই শব্দ তোলে, মুরুব্বিদের কাছে জানতে চাই, এইহানে আমরা রহিম বক্সের কামে বাধা দেয়ার কেডা! মজি কাকার বাপ-দাদার ভিটি এইডা। কী কথা ঠিক কইলাম কিনা!

হাছা কথাই তো!

তার বাপের এক পুত সে! তাইলে ওর জমি ওর ভিটি হেয় বিক্রি করবো আমরা বাধা দেই কোন আক্কেলে!

বাড়ির লোকজন সবাই চুপ। বাইরে থেকে আনা ভাড়াটে লোকজন কেবল সায় দিয়ে যাচ্ছিল মেম্বারের কথায়।

আসলে যা বুঝলাম কোনো সমস্যা নাই। রহিম বক্স জায়গা কিনছে ভিটি অহন ওর। ও ঘর তুলবো না গোয়াল ঘর করবো এইডা ওর ব্যাপার! আমরা বাধা দেওয়ার কেডা? কেউ বাধা দিলে খবর আছে!

মেম্বার এবার দম নেয়। মনে হয় মুশকিল আসান! অন্তত ওর হাবভাবে তাই মনে হচ্ছে।

বুড়– প্রধান সর্ষের তেল মাখা ওর চকচকে মুখখানি দুহাতের তালু দিয়ে ঘষতে ঘষতে বললো, মেম্বার সাবের কথাই যদি বিচার হয়, তাইলে তো আপনাগো এই বিচার মানলাম না চেয়ারম্যান সাব! এইডা মানা যায় না! একতরফা শালিস!

কী! চোখমুখ লাল হয়ে যায় গেসু চেয়ারম্যানের। মেম্বার চেয়ারের হাতল চেপে একবার উঠে দাঁড়ায়। ফের বসে পড়ে। বুড়– তোমার সাহস কত?

সাহসের কথা কেন কইতাছেন? আমরা কি আপনাগো শালিসি করার জন্য ডাকছি। আমরা তো ডাকি নাই আপনাগো। আমরা আপনাগো ডাকে সাড়া না দিলেও তো পারতাম। কারণ এই শালিসের আমরা কোনো পক্ষ না। কাউরে ডাকিও নাই!

তোমরা ডাকো নাই! তবে রহিম বক্স লিখিত বিচার দিছে!

আমরা কি তবে বিবাদী! বাদী কন আর বিবাদী কন, আপনাগো যেহেতু ডাকি নাই আমরা! কিংবা শালিসির কোনো নোটিশ পাই নাই! সেহেতু আপনাগো বিচার মানার কোনো বাধ্যবাধকতা কিংবা দায় আমাগো নাই। আপনারা এইবার আসতে পারেন!

শুধু সাহস না, দুঃসাহস দেখাইলা বুড়–।

অলি এবার একটু আড়মোড়া ভেঙে বলে, সাহসের কী দেখলেন। ন্যায্য কতা কইছে! ভুল কিছু তো কয় নাই!

মেম্বার এবার গলা ছাড়ে- বুড়–র কথা কি তোমাদেরও কথা!

বাড়ির সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, কাকার কথা আমাগো মনের কথা। আমাগো সিদ্ধান্ত। এর একচুলও নড়চড় হবার নয়!

এরপর টাবলু ওর মামা, উকিল এবং মেম্বার, চেয়ারম্যান ও রহিম বক্স মিলে সামান্য দূরে গিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ায়, আকারে-ইঙ্গিতে কী সব কথা বলে শরীর ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ছড়িয়ে পড়ে ওরা যার যার গন্তব্যে।

তখন পেছন থেকে শুধু ওদের কানে আসে- সাহস থাকলে তবে মোকাবেলা করুক!

কী শলাপরামর্শ হয়েছে কে জানে! পরের শুক্রবার থেকে এ বাড়ির মসজিদে এসে জুমার নামাজ পড়ছে রহিম বক্স। মসজিদে এলে সবার দৃষ্টি পড়বে, গুরুত্ব পাবে অন্যরকম, এমনটিই আশা করেছিলো বোধ হয় রহিম বক্স। কিন্তু সামনে যাবার কোনো সুযোগ পায়নি কিংবা কেউ সরে বসতে দেয়নি ওকে সামনের কোনো লাইনে। কারও কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই ওর প্রতি! নামাজ শেষে কেউ ফিরেও দেখেনি ওকে। যে যার মতো বাড়ির দিকে রওনা দেয় ক্ষেতের আল ধরে।

ভিড় কমে এলে একটু একটু করে ওর নতুন ভিটির দিকে পা বাড়ায় রহিম। উঠোন মাড়িয়ে ঘরের ভিটি অবধি যে যাবে সে সুযোগ আর হয় না। কয়েকটা নেড়ি কুত্তা ঘেউ ঘেউ করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নেয় মুহূর্তে। খোপের পায়রাগুলো এলোপাতাড়ি ওড়াউড়ি জুড়ে দেয়। পাখিদের বিচলিত-আতঙ্কিত কিচির-মিচির গাছের শাখায়। বাসা আগলে থাকা পাখিগুলো ডিম না হয় ছানাদের ছেড়ে সরছে না কোথাও। দু’ডানা মেলে উড়ে উড়ে বাসা পাহারা দিচ্ছে পাখিগুলো।

“অবস্থা তো বেগতিক! বাঘডাঁশা অইলো নাকি!” হুশ হুশ করে বাইরে আসে মতি। এসে দেখে কিসের বাঘডাঁশা! রহিম বক্স!

আপনি এইহানে কী করেন। চোরের লাহান চুপিচুপি আইয়া কী দেহেন!

রহিম বক্স মুখে কিছু না বলে শরীর ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ফের ফিরতি পথে পা বাড়ায়। শুধু রেখে যায় ওর গায়ে মাখা আতরের পলকা সুবাস!

প্রায় দু’শ’ বছরের পুরনো এ বাড়ি। অনেক রক্তের প্রবাহ থেকে তৈরি হয়েছে নতুন অনেক জীবন। প্রাণ থেকে হয়েছে নতুন প্রাণের সঞ্চার। একসময় অর্থ ছিলো, ঐতিহ্য ছিলো, আভিজাত্য ছিলো, বনেদী জীবন ছিলো এ ভিটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেসংগে ছিলো আভিজাত্যে অন্ধ মানুষের উন্মাদনা। সময়কে হাত ধরে কাছে টানেনি কেউ। বুকে জড়িয়ে ধরেনি কেউ। বরং ছিলো উপেক্ষা এবং ভ্রƒক্ষেপ না করার অনীহা। স্বভাবতই ঐতিহ্যের মহিমায় ফাটল ধরে। সে ধারা অক্ষুণœ থাকেনি। আভিজাত্যকে ধরে রাখতে পারিনি বংশধরেরা।

কৃষিতে মনোনিবেশ ছিলো সবার। পাঠে নয়। স্কুলে নয়। চড়াই-উৎরাইয়ের সে এক জীবন ছিলো বটে!। কখনও ফসল গোলায় উঠেছে। কখনও অতি বৃষ্টি না হয় অনাবৃষ্টিতে ফসল মাঠে মারা গেছে। অভাব উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। সুতরাং জমি বন্ধক দিয়ে ঋণ নেবার নতুন জীবন ধারার সূচনা হলো। কখনও কখনও একনাগাড়ে ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে প্রত্যেকেরই মাজা ভেঙে পড়ে এক এক করে। “তাই বইলা শরীরে তো লোউ (রক্ত) অহনো আছে। তারে তো বাদ দেওয়া যাইবো না! এ রক্তরে অস্বীকারও করা যাইবো না!”

ভাঙা ঘরে শন পড়েনি। জল পড়ে টুপটাপ, একটু বৃষ্টি হলেই। বাঁশের ভেতরে ঘুণের বাসা। বাঁশ কাঁপে, ঘর কাঁপে একটু বাতাস দিতেই। ডোবা-বিলে-ধানক্ষেতে জমে থাকা জলের যৎসামান্য মাছের ওপর জীবন ওদের। কদাচিৎ ঘরের মুরগি। এর বাইরে জীবন তো শাকভাত আর লঙ্কার মধ্যেই আটকে আছে! “শাক, শুঁটকি আর পেঁয়াজ খাওয়া রক্ত হইলে কী হইবে! কিন্তু শইল্যের লউ তো মিছা না! এট্টুখানি খোঁচা দিলে ফিনকি দিয়া যে লউ বার অইবো তা তো ধার করা কোনো লউ না। তা পরধাইন্যাগো লউ। লউয়ের ধারা দেখলেই কওন যায়- আর কারও না! এইডা পরধাইন্যাগো লউ!”

ওদের স্বগোক্তি- এই রক্তের মানুষ হাতি চড়ে বেড়াতে যেতো। পালকি চড়ে নায়রে যেতো। বাঘ শিকারে যেতো সুদূর বার্মাতে। রোজ রোজ চেনা-অচেনা, জানা-অজানা অসংখ্য মানুষের পাত পড়তো এবাড়িতে। গয়না নৌকার বহর যখন ছুটতো বরযাত্রী নিয়ে- মানুষ চক্ষে চড়ক দেখতো শুধু। “সেই পরধাইন্যা গো লউ এই বাড়ির হগল মানুষের গায়ে। তিরতির কইরা বয় সারাদিন। কোনো নিস্তার নাই। বইয়া যায় বিরামহীন গতিতে। সেই পরধাইন্যাগোর ভিটিতে ঘর করলেই কি আর পরধাইন্যা বংশের মানুষ অওয়া যায়! এই বংশের মানুষ অইতে অইলে এই রক্তের মধ্যে জন্ম নিতে হয়।”

“ঘর মিছা মাডি মিছা কিন্তু বংশের লউ! বংশের কতাই।”

টাকার জোরে ভিটি হয়। দালান হয়। ঘর হয়। কিন্তু রক্ত! এ রক্ত পাবে কোথায় রহিম বক্স! সুতরাং বারবাড়ির কোনো মানুষ এবাড়ির ভিটিতে পা দিতে পারবে না। কখনওই না! এ বাড়ির নিজস্ব এক পর্দা আছে। আদব আছে। “ইচ্ছা করলেই কি কেউ এ বাড়ির মাগি (মেয়ে) মাইন্যের (মানুষ) লগে দেহা করতে পারে! পুরুষের লগে কথা কইতে অইলেও তমিজের সংগে কইতে হয়। হেই বাড়িতে কোনো মুল্লুকের রহিম বক্স ঘর করবো ভিটি বাঁধবো! কল্পনায়ও সম্ভব না। সাফ কথা।” তীব্র ক্রোধ আর ক্ষোভ সংগে মিশিয়ে গর্জে ওঠে অনেকগুলো কণ্ঠ সমস্বরে!

এই ত্রিসীমানার মধ্যে রহিম বক্সের স্বজন-আত্মীয় বলে কেউ নেই। গুদারাঘাটের কাছে জমি কিনে ওর ব্যবসা। ঘর কোথায়, বাড়ি কোথায়, পরিবার কোথায় কেউ জানে না। গুদারাঘাটও কাছে না একেবারে! পাঁচ মাইল দূরে- শীতলক্ষ্যার ধারে। “সে আইসে পরধাইন্যাগ বংশ কিনতে!” সালামের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ে তীব্রভাবে।

এদিকটায় আগে সেভাবে কখনও আসেনি রহিম বক্স। এবারে প্রধানদের ভিটি কেনার সুবাদে আশেপাশের জমি, চক, ডোবা পুকুর সব যেন তন্ন তন্ন করে মুখস্থ করে নেয় রহিম বক্স। ছবি এঁকে নেয় মস্তিষ্কের কোষে কোষে, হৃদয়ে, চিন্তার সকল অলিগলিতে।

সত্যি অবাক করার মতো ঘটনা!

কদিন বাদেই এখানকার সড়কে বড় বড় দুটো ট্রাক্টর এসে ভটভট শব্দ তুলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে রাস্তা দাপিয়ে বেড়াতে থাকে। সকাল থেকে শুরু হয়। সন্ধ্যা অবধি চলে ট্রাক্টরের নির্যাতন। শব্দে বুক কাঁপে। কান তবদা লেগে যায়। সবচেয়ে বড় কথা ইটের সলিং করা সরু রাস্তাটি ভেঙে পড়তে থাকে এখানে ওখানে। দুদিনেই রাস্তার চেহারা পাল্টে গেছে অনেকখানি। খানা-খন্দকে ভরে উঠছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল রহিম বক্সের ট্রাক্টর এ দুটো। মাটি সাপ্লাইয়ের কাজ নিয়েছে ও কদিন হলো। এদিককার মাটি নাকি সরোস- বেশ আঁঠলো। তাই এখানকার মাটি পুঁজি করে নতুন ব্যবসা ফেঁদেছে রহিম বক্স!

ওর ট্রাক্টর আসে। লোকজন আসে নিয়মিত। মাটি কাটে, ট্রাক্টর বোঝাই করে ভট্ভট্ শব্দ তুলে চলে যায়। ফের আসে। কিন্তু কখনও রহিম বক্স আসে না। আসে না ওর নতুন ব্যবসার খোঁজ নিতে। অগত্যা হাটের দিন পাড়ার লোকজন দল বেঁধে যায় রহিম বক্সের কাছে। গিয়ে শোনে, সে আর তখন ‘বক্স’ নেই। মাতুব্বর হয়েছে। রহিম মাতুব্বর! হাটের লোকজন কেউ কেউ মুচকি হাসে। কেউ চোখে চোখে চায়। কৌতুকপ্রদ দৃষ্ট ওদের। ওরা জানায় রহিম বক্সকে, রাস্তার কথা, বিকট শব্দের কথা! জমির মাটি কাটা নিয়ে বিপদের কথা। শেষে জানায়- ট্রাক্টর তুলতে হবে! এ রাস্তা থেকে। এ রাস্তায় ট্রাক্টর চলবে না। রহিম বক্স দ্রুত হাতড়ে ক্যাশের টাকা বের করছিলো। একশ পঞ্চাশ পাঁচশ হাজার নোটগুলো আলাদা করে রাখছিলো পাশে। ব্যাংকারকের মতোই দ্রুত টাকা গুনতে জানে রহিম বক্স। হিসাবে একটু ভুল হয়ে যায় ওদের কথা শুনে। স্থির চোখে খানিক সময় দেখে ওদের। ফের টাকা গোনায় মন দেয়। ওরা আবারও বলে, গলা নামিয়ে দাঁত চিবিয়ে—“ট্রাক্টর উঠাইতে অইবো রহিম বক্স।”

আমি বক্স না মাতুব্বর।

তাও ভালো- পরে আবার পরধাইন্যাগ বংশ লইয়া টানাটানি কইরো না!

রহিম বক্স ঝিম মেরে যায়। শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে আসে! কথা বলতে পারে না অনেকটা সময়!

ভিটি কিনছি- ঘর করতে পারুম না! ট্রাক্টর কিনছি- চালাইতে পারুম না! আরও কী কী পারুম না- কইয়া যাও! বাপ-দাদার রাস্তা যেন!- কথাগুলো তখনই বাতাসে মিলিয়ে যায়। কানে তোলে না রহিম বক্স।

ওরা এবার শাসানো কণ্ঠে, খাদে নামিয়ে আনা কণ্ঠে ফের জানিয়ে দেয়।“রাস্তায় ট্রাক্টর চলবো না। এক কথা!”

ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ এবং উত্তেজিত অনেকগুলো শরীর সরে যেতেই একদঙ্গল বাতাস এসে হামলে পড়ে রহিম বক্সের গদিতে। ও চোখ বোজে চরম ক্লান্তি নিয়ে। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর নেমে যাচ্ছে একটু একটু করে। বিড়বিড় করে ওঠে- “পাংখা গজাইছে। শুয়রের ছাও হগল!”

এদিকে রহিম বক্স নিয়মিত প্রধানদের বাড়ি আসে। মসজিদ অবধি ওর দৌড়। এর বেশি এগোতে সাহস করে না। তবে এখন জুমার নামাজ ছাড়াও কখনও বিকেলে-সন্ধ্যায় আসে নামাজ আদায় করতে।

এক বিকেলে নামাজ শেষে কারও কোনো অনুমতি ছাড়াই ইমাম সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়- মুসল্লিগণ দুইডা কথা কইতাম।

কী কথা! আপনার আবার কী কথা! বিরক্তির সুর ঘরজুড়ে।

বেশি না। দুইডা কথা! এক কথা, পাশের জমিটা নিয়া কেতুর লগে আমার কথা অইছে। জমিডা ও বিক্রি করবো, আমি কিনুম। তারপর এ জমি মসজিদে ওয়াক্ফ কইরা দিমু। মানে দান করমু! নিয়ত পাক্কা! মসজিদের জায়গা বড় হইবো তখন! রহিম বক্সের কণ্ঠে গদগদ ভাব!

সবাই কেমন ঝিম মেরে যায়। এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। চোখের দিকে তাকায়! কারও মুখে রা সরে না। সবার চোখে শুধু বিস্ময় এবং কৌতূহল।

রহিম বক্স ফের গলা সাফ করে বলে, আমি দেখলাম মসজিদের সীমানায় আপনারা সব ফল-ফলারির গাছ লাগাইছেন! এর বিপদ নিয়া কেউ কি এট্টু ভাবছেন! মহা বিপদ! ঘোর বিপদ! ভাবলে আমার চোখে ঘুম আসে না!

না, আমরা কিছু ভাবি নাই। আপনি কী ভাবছেন কন!

রহিম বক্স চোখ উল্টে পুতুলি দুটো কোথায় যেন গায়েব করে দেয় মুহূর্তে! শুধু চোখের ঘোলাটে জমিটুকু ভেসে থাকে মরা মাছে ফ্যাকাশে চোখের মতো! এরপর চোখ দুটো স্বাভাবিক করে বলে, চাইর দিকে এতো গাছগাছালি। কী মনোরকম। কিন্তু গাছগুলা অহনও বাত্তি অয় নাই। জোয়ান হইতে দেরি আছে! কিন্তু এসব গাছে যখন...!

রশিদ বাধা দিয়ে বলে, আপনার আসল কথা কী তাই কন!

আসলে গাছগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়া ভাবছে রহিম বক্স। গাছগুলো নিয়ে ওর উৎকণ্ঠার শেষ নেই। কারণ একসময় এসব গাছে ফল হবে, ফল পাকবে। ঝড়ে না হয় বাতাসে, না হয় পাখির ঠোকর খেয়ে যেসব ফল ঝরে পড়বে। তখন সেসব ফলের ভাগ নিয়ে হবে লাঠালাঠি, মারামারি। নির্ঘাত কখনও কখনও মানুষও খুন হবে। দিব্যচোখে তা দেখতে পাচ্ছে রহিম বক্স। প্রায় পাকা ফল গাছ থেকে পড়লো, এ নিয়ে দুটো বাচ্চার মধ্যে কাড়াকাড়ি, পরে মারামারি হতে কতক্ষণ। গাছগুলো সব অশান্তির প্রতীক। গাছগুলো শুধু রক্ত চায়। দিব্য চোখে তাই দেখতে পাচ্ছে রহিম বক্স! বাচ্চাদের মারামারি, ঝগড়াঝাটি শেষে পরিবার থেকে পড়শি পর্যন্ত গড়াবে। সুতরাং ফল-ফলারির গাছ নয়। কোনোভাবেই নয়। এসব গাছ এখনই কেটে ফেলতে হবে। পরে নতুন জমি ভরাট করে ওষুধি আর কাঠ গাছ লাগাতে হবে। এ আমার পরিকল্পনা!

এর মধ্যে নানা গুঞ্জন, ফিসফিস কণ্ঠের ওঠা-নামা শুরু হয়ে গেছে। এ ফাঁকে আনু পাগলা কখন যে বেরিয়ে গেছে মসজিদ থেকে কেউ খেয়াল করেনি। হঠাৎ আনু পাগলা গলা চড়াতে চড়াতে ছুটে আসে “গাছে কাডল (কাঁঠাল) গোঁফে তেল। গাছে কাডল...। বলেই লাঠি উঁচিয়ে ঢুকে পড়ে মসজিদে- তর পরিকল্পনার গুষ্টি খিলাই। বাঁচতে চাইলে এহনি দৌড়া। দৌড়া কইতাছি!” বলেই মসজিদের দেয়ালের মেঝেতে দরাম করে আঘাত করে ওর লাঠি দিয়ে।

ঘটনার আকস্মিকতায় রহিম বক্স হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে দ্বিগি¦দিক ছুটতে থাকে ক্ষেতের আল ধরে। পেছন পেছন আনু পাগলা। আকাশ মুখো ওর লাঠি। চকচক চকচক করছে শুধু। কী ক্ষিপ্র তার সংগে দৌড়!

এদিকে দিন যায়। কিন্তু অবস্থা যে কে সেই! দিনভর ভটভটি শব্দ! রাস্তা এবড়ো-খেবড়ো হয়েছে আরও অনেক জায়গাজুড়ে। বিকেল গা মেলেছে তখন। বাতাসে বৃষ্টি ভেজা প্রশান্তি। রোদের গায়ে মোমগলা কোমলতা! কিন্তু উপভোগের সুযোগ নেই। ভটভটির বিকট শব্দ! কেড়ে নিয়েছে সুখ।

এ পথটি এঁকেবেঁকে উত্তরে চলে গেছে অনেক দূর। কী এক ইশারায় পথের দু-ধারে গ্রাম থেকে মানুষ এসে জড়ো হয় একে একে। আগের রাতে অনেকে বসে কী যেন শলাপরামর্শ করেছে। এদের ডাকেই কি সাড়া দিয়ে আসছে লোকগুলো! কে জানে! কিন্তু চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা ঘটবে হয়তো। এরই মধ্যে দুটো ট্রাক্টর প্রায় মুখোমুখি। প্রধানদের বাড়ি ছেড়ে আরও খানিকটা এগিয়ে ক্রস করছিলো একটি আরেকটিকে। একটি মাটি ভরা- রাখতে যাচ্ছে। অন্যটি মাটি রেখে শূন্য ট্রাক্টর ফিরেছে। দুটো ট্রাক্টরকে হাতের ইশারায় থামাতে বলে লোকজন। শেষে ওদের রাস্তার একপাশে সরিয়ে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে মুহূর্তে। অমনি হুইসেল বাজতেই হামলে পড়ে ওরা ড্রাইভার আর লেবারদের ওপর। স্টিয়ারিং ভেঙে ফেলে মুহূর্তে, শাবল আর কুড়োলের আঘাতে। ইলেকট্রিক কানেকশন ছিঁড়ে ফেলে। তেলের ট্যাংক ছিদ্র করে ফেলে কুড়োলের আঘাতে!

চাকার ওপর শাবল-কুড়োলের ঘা পড়ে মুহুর্মুহু। বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন প্রান্তিক মানুষগুলোকে যেন এখন আর চেনা যায় না। ছাইয়ের মধ্যে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত বুলেটের মতো যেন ফুটছে ওরা। বেদম মার খেয়ে ড্রাইভার এবং ওদের লোকজন খোড়াতে খোড়াতে চলে যায়!

কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে আগুন দেয়ার চেষ্টা করে ট্রাক্টরের গায়ে। কিন্তু বাঁধার মুখে আর পারেনি। অঙ্গহীন হয়ে ট্রাক্টরগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে রাস্তার ধারে।

রাত আরও বাড়ে। গভীর হয়। জোনাক পোকারা আরও স্বতঃস্ফূর্ত আরও আলোকময়! সে সংগে মানুষের জটলাও কমে আসে একটু একটু করে। তখুনি চোখে পড়ে বাতি আর হ্যাজাক ও হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কারা যেন আসছে এদিকে। মাঝে মাঝে মোবাইলের টর্চ পিড়িক পিড়িক জ্বলে উঠছে অন্ধকার ভেদ করে। মøান আলোয় হ্যাজাক আর হ্যারিকেনের কিম্ভুকিমাকার দুটো ছায়া দুলতে থাকে। নেতাগোছের কয়েকজন মানুষ তখনও ছিলো ট্রাক্টরের আশপাশে। পুলিশ ভেবে ওরা একটু সরে যায় আড়ালে। গভীর অন্ধকারে।

লোকগুলো ট্রাক্টরের আশপাশ ঘিরে দাঁড়ায়। সবাই শাদা পোশাকে। সম্ভবত পুলিশের কেউ না! ক্ষয়ক্ষতি মেপেজোকে দেখে ওরা।

“মানুষগুলা মনে হয় কুত্তা পাগলা হইয়া গেছিলো! না হইলে এতো বড় ট্রাক্টর অথচ ক্ষতি...। মুখে চুকচুক করে ওঠে লোকগুলো।

ড্রাইভার লেবার ওগো খবর কী, কেমন আছে? খসখসে কণ্ঠে কে যেন জানতে চায়।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হইছে!

আহা! আহা! বেজন্মার ঘরের বেজন্মা। মানুষের পয়দা না! অমানুষের মতো মারছে আমার মানুষগুলারে।

কণ্ঠ চেনা চেনা। কিন্তু মানুষটা চেনা যায় না! একে তো অন্ধকার! তার ওপর গামছায় মুখ ঢাকা। মাথায় কালো কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা।

খুব সকালে দূত আসে বাড়িতে। ট্রাক্টর আর চলবে না এ সড়কে। এখন শুধু চাবি দরকার! ট্রাক্টর সরিয়ে নেবে নতুন বাড়ির শখ নাকি মিটে গেছে ওর! বিকেলে খবর আসে রহিম বক্স মজি প্রধানের বাড়ি গিয়েছে ঢাকায়। দলিল ফিরিয়ে দিতে গেছে। সংগে আহত লোকদের রক্তখমাখা ছবি এবং ক্ষতবিক্ষত ট্রাক্টরের ছবি মোবাইলে লোড করে নিয়েছে।

শেষ অবধি রক্তের ভেজাল করার নীলনক্শা রুখে দিতে পেরে আনন্দের সীমা নেই গাঁয়ের মানুষগুলোর।

“আমাগো রক্ত দূষিত করার, ভেজাল করার দুঃসাহস আর কেউ দেহাইবো না কোনোদিন!

“শিক্ষা হইছে! চরম শিক্ষা!”

বিক্ষিপ্তভাবে কারা যেন মন্তব্য করছে এদিক-ওদিক! চেনা যায় না! অসংখ্য মুখ! কে কাকে চেনে! দূর-দূরান্ত থেকেও এসেছে অনেকে!

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা কিংবা ভয়মুক্ত পাখিদের ঝাঁক তখন উড়ে যাচ্ছে। আনন্দকে ডানায় করে এখন ওদের ঘরে ফেরার পালা। ঠোঁটে ওদের ঝঙ্কার। পাখায় মাতাল ছন্দ। শেষ বিকেলের পয়মন্ত রোদ ওদের আদর করে দিচ্ছে পরম মমতায়!

সে রোদ ছুঁয়ে আছে আনন্দে মাতাল গাঁয়ের মানুষগুলোর তামাটে শরীর! সুন্দর! শুধু সুন্দরের আহ্বান তখন চারদিকে! (সমাপ্ত)

back to top