উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে কনকনে ঠাণ্ডা, শৈত্য প্রবাহের কারণে ‘লাফিয়ে লাফিয়ে’বাড়ছে শীতের তীব্রতা। হিমেল বাতাস আর ঘন কুয়াশায় জবুথবু জনজীবন। শৈত্যপ্রবাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। শহরের ফুটপাতে শীতবস্ত্র বিক্রির হিড়িকও পড়ছে। মাথায় বাঁদর টুপি, গায়ে মোটা জ্যাকেট পরা মানুষ হরহামেশা চোখে পড়ছে।
দেশের, বিশেষত উত্তরের জনপদগুলোয় দিনের বেলা আলো জ্বালিয়ে চলে সড়কের যানবাহনগুলো।
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) রাজধানীতেও সকাল থেকেই ছিল কুয়াশার দাপট। সেই সঙ্গে কমে যায় তাপমাত্রা। দিনের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় শীতের অনুভূতি তীব্র ছিল বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা ১ জানুয়ারি বুধবারের চেয়ে কমে গেছে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, এবারের শীতের মৌসুমে এতটা কুয়াশা আগে দেখা যায়নি। ডিসেম্বর মাসে তাপমাত্রা সেই মাত্রায় কমেনি, খুব ঘন কুয়াশাও দেখা যায়নি বেশি সময় ধরে। এর কারণ হলো, গত মাসে অন্তত তিনটি লঘুচাপ দেখা গেছে বঙ্গোপসাগরে। আর লঘুচাপের কারণে দিনের তাপমাত্রা গেছে বেড়ে। তাই শীতও ততটা পড়েনি।
উত্তারাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সারাদেশের মতো পঞ্চগড়ে কমছে দিনের ও রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান। বুধবার থেকে সূর্যের দেখা না মেলায় কনকনে শীত অনুভূত হয়েছে ।
আবহাওয়া অফিস জানাচ্ছে, সকাল নয়টায় জেলার তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বুধবার দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ১৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুয়াশা কম থাকলেও ঠাণ্ডার তীব্রতার কারণে বেলা বাড়লেও গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কিছুটা কম লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে ঠাণ্ডার কারণে সময় মতো কাজে যেতে পারছেন না জেলার নিম্নআয়ের সাধারণ মানুষজন। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্রনাথ রায় বলেন, ‘আকাশে মেঘ এবং মৌসুমি বায়ু নিষ্ক্রিয়তা থাকার কারণে তাপমাত্রাটা একটু বেড়েছে।’
গত তিনদিন থেকে গাইবান্ধায় সূর্যের কোনো দেখা নাই। তাপমাত্রা ১৩ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠানামা করছে। গত কয়েকদিন আশেপাশের জেলাগুলোর চেয়ে গাবইবান্ধার সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ১৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে পুরাতন গরম কাপড়ের দোকানগুলোতে ভিড় করছেন নিম্ন ও নিম্ন-মধ্য আয়ের ক্রেতারা। শীত বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষই বেশি। তাই উষ্ণতা পেতে তারা বাধ্য হয়েইে ঝুঁকেছেন পুরাতন কাপড়ের দিকে।
বিভিন্ন হাট-বাজারে পুরাতন গরম কাপড়ের ব্যবসা এখন বেশ জমজমাট। শহরের মার্কেট ও হাট-বাজার ঘুরে পুরাতন কাপড় বিক্রির ধুম পড়ছে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। বিশেষ করে এর সিংহভাগ ক্রেতাই হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বিভিন্ন রিকশা বা ভ্যানচালক ও বিভিন্ন শ্রমিকরা দেদার এই কাপড় কিনে নিজেদের উষ্ণ রাখার চেষ্টা করছেন।
রিকশাচালক হুমায়ন বলেন,‘ দুইদিন প্যাডেলে চাপ দেয়াই যাচ্ছে না। রিকশার ছাড়লেই শীর শীর করে শরীলোত বাতাস ঢোকে। আর গাউ কোনা ঝাকি দিয়ে উঠে। দুকনা ছলসহ বাড়িত চারজন খানেওলা। শীত লাগলে হবে কি? মুই কামাই না করলে সকলোক ওপাস থাকা লাগবে।’
শীতের কাঁপড় ক্রেতা মামুদ হাসান বলেন, ‘কত দুইদিন থেকে হঠাৎ শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। শহরের নামী- দামি মার্কেট গুলোতে গরম কাঁপড়ের দাম অনেক বেশি। সাধ্যমতে কেনার জন্য ফুটপাতে এসেছি।’
আরেক ক্রেতা সাদিকা কনা বলেন, ‘হঠাৎ করে অতিমাত্রায় ঠাণ্ডা পড়ার কারণে, সবাই একসঙ্গে গরম কাঁপড়ের দোকান মুখী হয়েছে। কাস্টমারে ভিড়ে দোকানদাররা কাঁপড়ের দাম বেশি চাচ্ছে।’
গাইবান্ধা শহরের ভ্রাম্যমান গরম কাঁপড় বিক্রেতা জাহিদ হাসান বলেন, ‘এই পুরাতন কাপড়গুলো কম দামে পাওয়া যায় বলেই কাস্টমার পাওয়া যায়।এখানে বিভিন্ন নিম্ন আয়ের মানুষ, রিকশা-ভ্যানচালক যাদের আয় কম তারাই এসব গরম কাপড় কেনেন বেশি। এসব পুরোনো গরম কাপড় বেশ আরামদায়ক বলেও জানান তিনি।
আরেক বিক্রেতা পাপ্পু মিয়া বলেন, ‘মোকামে কাঁপড়ে দাম বেশি। কাস্টামার কিনতে আসলেই বলে বেশি দাম চাচ্ছি। আমরা তো চেষ্টা করি কম দামে কিনে সমান্য লাভে বিক্রি করি।’
গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইেউএনও) মাহমুদ আল হাসান বলেন, ‘সদর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে ১ হাজার ৭০০টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও বিতরণ করা হবে। এই জেলার চারদিক দিয়ে নদী থাকার কারনে এখানে শীতের তীব্রতা অনেকটাই বেশি।’
শৈত্যপ্রবাহে রংপুর বিভাগের শীতবস্ত্রের অভাবে দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে অসহনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত শনিবার সকালে রংপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। রংপুর নগরীসহ বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে। কাজ ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না কেউ। কমে গেছে যানবাহন চলাচল।
জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানকার দরিদ্র মানুষরা অনেকেই খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন খেটে খাওয়া ও ছিন্নমূল মানুষ। মানুষজনের পাশাপাশি কাহিল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে গবাদিপশু ও প্রাণিকূলেও। তৃণমূল মানুষরা উপজেলায় যোগায়োগ করলেও নানান জটিলতার কারণে তারা শীতের কম্বল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
রংপুর আবাহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, ডিসেম্বরে রংপুরে শীতের দাপট খুব একটা দেখা না গেলেও গত তিনদিনে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। রংপুরসহ আশে-পাশের এলাকায় তাপমাত্রা এখন ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। তিনদিন থেকে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কোথাও দেখা গেলে তাও ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য।
বৃহস্পতিবার সকালে রংপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি চলে আসায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। বিরূপ আবহাওয়ায় ফসলের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়, ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস:
চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, জেলায় বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিই দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। বুধবার ছিল ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গত ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা কমেছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাপমাত্রা কমে এসেছে প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের সিনিয়র আবহাওয়া পর্যবেক্ষক রকিবুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইছে। বৃহস্পতিবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগামী দিনগুলোতে তাপমাত্রার পারদ আরও কমবে।’
তাপমাত্রা কোথায় কেমন:
দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বা দিনের তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ৫১টি স্টেশন থেকে আবহাওয়ার উপাত্ত সংগ্রহ করে। দেখা গেছে, এই ৫১ স্টেশনের মধ্যে বৃহস্পতিবার ৫টিতে শুধু তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে আছে।
রাজধানীতেই বুধবারের দিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বৃহস্পতিবার প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে গেছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, যেটিকে দিনের তাপমাত্রা হিসেবে রেকর্ড করা হয়, রাজধানীতে বৃহস্পতিবার তা ছিল ২০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কুয়াশা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কমেছে তাপমাত্রা, বেড়েছে শীত। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সর্বিনম্ন তাপমাত্রা আরও কমে গেছে। সকাল পৌঁনে ৯টায় এ তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কী বলছে আবহাওয়া অফিস:
দেশের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম ও কুয়াশা থাকার কারণে এ কুয়াশাকে আবহাওয়াবিদেরা ‘অ্যাডভেকশন ফগ’ বা পরিচালন কুয়াশা বলে অভিহিত করছেন। এই যে কুয়াশার বিরাট চাদর, এটি কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। যেমন গত বছরের জানুয়ারি মাসে এটি ছিল প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ জানান, পরিচালন কুয়াশা মানে হলো এটি এক জায়গায় থাকে না। এখন যে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে, এটি ভারতের দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মূলত উত্তরাঞ্চল দিয়ে। আজ শুধু রাজধানী নয়, উত্তরের রংপুর বিভাগ, রাজশাহীর বড় অংশ, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ এলাকা ও নোয়াখালী পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কুয়াশা অপেক্ষাকৃত কম আছে।’
বজলুর রশীদ আরও বলেন, ‘আগামী দুই থেকে তিনদিন এমন অবস্থা থাকতে পারে। পরে কুয়াশা ও শীত কিছুটা কমতে পারে। পরে আবার তা বাড়তে পারে।
কেমন যাবে জানুয়ারি মাস:
এক মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর মাসে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। ওই মাসে একাধিক লঘুচাপের কারণেই শীতের প্রকোপ কমে গিয়েছিল, এ মত দেন আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক। তিনি বলেন, অন্তত তিনটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয় ডিসেম্বরে।
এখন আবহাওয়া অধিদপ্তর জানুয়ারির পূর্বাভাসে বলেছে, এ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হতে পারে। আবার এ মাসে এক থেকে দুটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে বঙ্গোপসাগরে।
দেশের পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দুয়েকটি মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। দেশের অন্যত্র দুই থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ঠিক কোন সময়ে হবে সে বিষয়ে আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, ‘তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এ মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পশ্চিম, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল ও নদী অববাহিকা এলাকায় মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। অন্য জায়গাগুলোতে হালকা থেকে মাঝারি কুয়াশা পড়তে পারে।
সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। আর এ তাপমাত্রা ৬ দশমিক ১ থেকে ৮ হলে তা মাঝারি, তাপমাত্রা ৪ দশমিক ১ থেকে ৬ ডিগ্রি হলে তা তীব্র আর তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে চলে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫
উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে কনকনে ঠাণ্ডা, শৈত্য প্রবাহের কারণে ‘লাফিয়ে লাফিয়ে’বাড়ছে শীতের তীব্রতা। হিমেল বাতাস আর ঘন কুয়াশায় জবুথবু জনজীবন। শৈত্যপ্রবাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। শহরের ফুটপাতে শীতবস্ত্র বিক্রির হিড়িকও পড়ছে। মাথায় বাঁদর টুপি, গায়ে মোটা জ্যাকেট পরা মানুষ হরহামেশা চোখে পড়ছে।
দেশের, বিশেষত উত্তরের জনপদগুলোয় দিনের বেলা আলো জ্বালিয়ে চলে সড়কের যানবাহনগুলো।
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) রাজধানীতেও সকাল থেকেই ছিল কুয়াশার দাপট। সেই সঙ্গে কমে যায় তাপমাত্রা। দিনের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় শীতের অনুভূতি তীব্র ছিল বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা ১ জানুয়ারি বুধবারের চেয়ে কমে গেছে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, এবারের শীতের মৌসুমে এতটা কুয়াশা আগে দেখা যায়নি। ডিসেম্বর মাসে তাপমাত্রা সেই মাত্রায় কমেনি, খুব ঘন কুয়াশাও দেখা যায়নি বেশি সময় ধরে। এর কারণ হলো, গত মাসে অন্তত তিনটি লঘুচাপ দেখা গেছে বঙ্গোপসাগরে। আর লঘুচাপের কারণে দিনের তাপমাত্রা গেছে বেড়ে। তাই শীতও ততটা পড়েনি।
উত্তারাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সারাদেশের মতো পঞ্চগড়ে কমছে দিনের ও রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান। বুধবার থেকে সূর্যের দেখা না মেলায় কনকনে শীত অনুভূত হয়েছে ।
আবহাওয়া অফিস জানাচ্ছে, সকাল নয়টায় জেলার তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বুধবার দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ১৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুয়াশা কম থাকলেও ঠাণ্ডার তীব্রতার কারণে বেলা বাড়লেও গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কিছুটা কম লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে ঠাণ্ডার কারণে সময় মতো কাজে যেতে পারছেন না জেলার নিম্নআয়ের সাধারণ মানুষজন। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্রনাথ রায় বলেন, ‘আকাশে মেঘ এবং মৌসুমি বায়ু নিষ্ক্রিয়তা থাকার কারণে তাপমাত্রাটা একটু বেড়েছে।’
গত তিনদিন থেকে গাইবান্ধায় সূর্যের কোনো দেখা নাই। তাপমাত্রা ১৩ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠানামা করছে। গত কয়েকদিন আশেপাশের জেলাগুলোর চেয়ে গাবইবান্ধার সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ১৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে পুরাতন গরম কাপড়ের দোকানগুলোতে ভিড় করছেন নিম্ন ও নিম্ন-মধ্য আয়ের ক্রেতারা। শীত বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষই বেশি। তাই উষ্ণতা পেতে তারা বাধ্য হয়েইে ঝুঁকেছেন পুরাতন কাপড়ের দিকে।
বিভিন্ন হাট-বাজারে পুরাতন গরম কাপড়ের ব্যবসা এখন বেশ জমজমাট। শহরের মার্কেট ও হাট-বাজার ঘুরে পুরাতন কাপড় বিক্রির ধুম পড়ছে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। বিশেষ করে এর সিংহভাগ ক্রেতাই হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বিভিন্ন রিকশা বা ভ্যানচালক ও বিভিন্ন শ্রমিকরা দেদার এই কাপড় কিনে নিজেদের উষ্ণ রাখার চেষ্টা করছেন।
রিকশাচালক হুমায়ন বলেন,‘ দুইদিন প্যাডেলে চাপ দেয়াই যাচ্ছে না। রিকশার ছাড়লেই শীর শীর করে শরীলোত বাতাস ঢোকে। আর গাউ কোনা ঝাকি দিয়ে উঠে। দুকনা ছলসহ বাড়িত চারজন খানেওলা। শীত লাগলে হবে কি? মুই কামাই না করলে সকলোক ওপাস থাকা লাগবে।’
শীতের কাঁপড় ক্রেতা মামুদ হাসান বলেন, ‘কত দুইদিন থেকে হঠাৎ শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। শহরের নামী- দামি মার্কেট গুলোতে গরম কাঁপড়ের দাম অনেক বেশি। সাধ্যমতে কেনার জন্য ফুটপাতে এসেছি।’
আরেক ক্রেতা সাদিকা কনা বলেন, ‘হঠাৎ করে অতিমাত্রায় ঠাণ্ডা পড়ার কারণে, সবাই একসঙ্গে গরম কাঁপড়ের দোকান মুখী হয়েছে। কাস্টমারে ভিড়ে দোকানদাররা কাঁপড়ের দাম বেশি চাচ্ছে।’
গাইবান্ধা শহরের ভ্রাম্যমান গরম কাঁপড় বিক্রেতা জাহিদ হাসান বলেন, ‘এই পুরাতন কাপড়গুলো কম দামে পাওয়া যায় বলেই কাস্টমার পাওয়া যায়।এখানে বিভিন্ন নিম্ন আয়ের মানুষ, রিকশা-ভ্যানচালক যাদের আয় কম তারাই এসব গরম কাপড় কেনেন বেশি। এসব পুরোনো গরম কাপড় বেশ আরামদায়ক বলেও জানান তিনি।
আরেক বিক্রেতা পাপ্পু মিয়া বলেন, ‘মোকামে কাঁপড়ে দাম বেশি। কাস্টামার কিনতে আসলেই বলে বেশি দাম চাচ্ছি। আমরা তো চেষ্টা করি কম দামে কিনে সমান্য লাভে বিক্রি করি।’
গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইেউএনও) মাহমুদ আল হাসান বলেন, ‘সদর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে ১ হাজার ৭০০টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও বিতরণ করা হবে। এই জেলার চারদিক দিয়ে নদী থাকার কারনে এখানে শীতের তীব্রতা অনেকটাই বেশি।’
শৈত্যপ্রবাহে রংপুর বিভাগের শীতবস্ত্রের অভাবে দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে অসহনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত শনিবার সকালে রংপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। রংপুর নগরীসহ বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে। কাজ ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না কেউ। কমে গেছে যানবাহন চলাচল।
জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানকার দরিদ্র মানুষরা অনেকেই খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন খেটে খাওয়া ও ছিন্নমূল মানুষ। মানুষজনের পাশাপাশি কাহিল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে গবাদিপশু ও প্রাণিকূলেও। তৃণমূল মানুষরা উপজেলায় যোগায়োগ করলেও নানান জটিলতার কারণে তারা শীতের কম্বল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
রংপুর আবাহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, ডিসেম্বরে রংপুরে শীতের দাপট খুব একটা দেখা না গেলেও গত তিনদিনে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। রংপুরসহ আশে-পাশের এলাকায় তাপমাত্রা এখন ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। তিনদিন থেকে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কোথাও দেখা গেলে তাও ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য।
বৃহস্পতিবার সকালে রংপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি চলে আসায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। বিরূপ আবহাওয়ায় ফসলের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়, ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস:
চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, জেলায় বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিই দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। বুধবার ছিল ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গত ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা কমেছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাপমাত্রা কমে এসেছে প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের সিনিয়র আবহাওয়া পর্যবেক্ষক রকিবুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইছে। বৃহস্পতিবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগামী দিনগুলোতে তাপমাত্রার পারদ আরও কমবে।’
তাপমাত্রা কোথায় কেমন:
দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বা দিনের তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ৫১টি স্টেশন থেকে আবহাওয়ার উপাত্ত সংগ্রহ করে। দেখা গেছে, এই ৫১ স্টেশনের মধ্যে বৃহস্পতিবার ৫টিতে শুধু তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে আছে।
রাজধানীতেই বুধবারের দিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বৃহস্পতিবার প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে গেছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, যেটিকে দিনের তাপমাত্রা হিসেবে রেকর্ড করা হয়, রাজধানীতে বৃহস্পতিবার তা ছিল ২০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কুয়াশা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কমেছে তাপমাত্রা, বেড়েছে শীত। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সর্বিনম্ন তাপমাত্রা আরও কমে গেছে। সকাল পৌঁনে ৯টায় এ তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কী বলছে আবহাওয়া অফিস:
দেশের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম ও কুয়াশা থাকার কারণে এ কুয়াশাকে আবহাওয়াবিদেরা ‘অ্যাডভেকশন ফগ’ বা পরিচালন কুয়াশা বলে অভিহিত করছেন। এই যে কুয়াশার বিরাট চাদর, এটি কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। যেমন গত বছরের জানুয়ারি মাসে এটি ছিল প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ জানান, পরিচালন কুয়াশা মানে হলো এটি এক জায়গায় থাকে না। এখন যে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে, এটি ভারতের দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মূলত উত্তরাঞ্চল দিয়ে। আজ শুধু রাজধানী নয়, উত্তরের রংপুর বিভাগ, রাজশাহীর বড় অংশ, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ এলাকা ও নোয়াখালী পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কুয়াশা অপেক্ষাকৃত কম আছে।’
বজলুর রশীদ আরও বলেন, ‘আগামী দুই থেকে তিনদিন এমন অবস্থা থাকতে পারে। পরে কুয়াশা ও শীত কিছুটা কমতে পারে। পরে আবার তা বাড়তে পারে।
কেমন যাবে জানুয়ারি মাস:
এক মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর মাসে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। ওই মাসে একাধিক লঘুচাপের কারণেই শীতের প্রকোপ কমে গিয়েছিল, এ মত দেন আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক। তিনি বলেন, অন্তত তিনটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয় ডিসেম্বরে।
এখন আবহাওয়া অধিদপ্তর জানুয়ারির পূর্বাভাসে বলেছে, এ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হতে পারে। আবার এ মাসে এক থেকে দুটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে বঙ্গোপসাগরে।
দেশের পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দুয়েকটি মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। দেশের অন্যত্র দুই থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ঠিক কোন সময়ে হবে সে বিষয়ে আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, ‘তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এ মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পশ্চিম, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল ও নদী অববাহিকা এলাকায় মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। অন্য জায়গাগুলোতে হালকা থেকে মাঝারি কুয়াশা পড়তে পারে।
সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। আর এ তাপমাত্রা ৬ দশমিক ১ থেকে ৮ হলে তা মাঝারি, তাপমাত্রা ৪ দশমিক ১ থেকে ৬ ডিগ্রি হলে তা তীব্র আর তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে চলে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।