দামুড়হুদার নাটুদা অঞ্চলের জমিদার নফর পাল চৌধুরীর স্মৃতি বিজড়িত সকল কীর্তিই আজ ধ্বংসের পথে। আজ আর নেই সেই জমিদার মহলের খাজনা আদায়ের লাঠিয়াল বাহিনী, নেই জমিদার মহলের নর্তকীর নাচের ঝলকানি, নেই কোন পাইক পেয়াদা, বরকন্দাজ, চাকর-বাকর, ঘোড়াশাল আর সুবিশাল অট্রালিকা। কালের বিবর্তনে প্রায় সব কিছুই আজ ধ্বংসের পথে। অধিকাংশ কীর্তি ধ্বংস হয়ে গেলেও কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও স্মৃতি চিহৃ বহন করে চলেছে দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদা অঞ্চলের জমিদার নফর পাল চৌধুরীর জমিদার বাড়ির প্রবেশ দ্বারে স্থাপিত দুটি মন্দির বা প্রধান ফটক।
জানা গেছে, বৃটিশ শাসন আমলে লর্ড কর্ণওয়ালিশ কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করা হলে সে সময়ে ভারতের ২৪ পরগনার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব শ্রী মধুসুদন পালের একমাত্র সন্তান শ্রী নফর পাল চৌধুরী (নাটুদা, কার্পাসডাঙ্গা হাতাবাড়ি, মেমনগর, বাগোয়ান, পরগনা, মেদনীপুর) এই গোটা এলাকা বৃটিশদের কাছ থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গ্রহন করেন এবং নাটুদাকে সদর স্টেট হিসেবে ঘোষনা দিয়ে জমিদারী কার্যক্রম চালু করেন। সেই থেকে জমিদারী প্রথা চলে আসলেও প্রায় দেড়শো বছর পর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির মধ্য দিয়ে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি হয়।
জমিদার গিন্নি রাধারানীও ছিলেন একজন প্রজা হিতৈষী মমনের মানুষ। তৎকালিন সময়ে এলাকায় ছিল অধিকাংশ অশিক্ষিত লোকের বসবাস। এলাকার শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে জমিদার গিন্নিই প্রথম স্বপ্নের বীজ বপন করেন। তারই অনুরোধে জমিদার নফর পাল চৌধুরী জমিদার ভবনের উত্তর পাশে জোলের ধার ঘেষে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করেন।
খড়ের ছাউনী দিয়ে নির্মিত বিদ্যালয়টিতে এলাকার ছেলে মেয়েরা প্রথম দিকে ঠিকমত আসতে না চাইলেও জমিদার গিন্নির তরফ থেকে তাদেরকে টিফিনের ব্যবস্থা করার পর ছোট ছোট শিশু কিশোরদের পদচারণায় ভরে ওঠে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জমিদার বাবু ১৯০৬ সালে তার স্ত্রীর নামে বড় আকারের বিদ্যালয় ভবন গড়ে তোলেন। যার নাম দেওয়া হয় নাটুদা রাধারানী ইন্সটিটিউট। এলাকায় শিক্ষিত লোক না পাওয়ায় জমিদার গিন্নির অনুরোধে তিনি সুদুর কলকাতা থেকে শ্রী নরেন্দ্র নাথ সিংহকে এনে প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে ওই বিদ্যালয়টিকে বলা হতো হাজার দুয়ারি স্কুল। যা বর্তমানে নাটুদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে পরিচালিত হয়ে আসছে।
১৯৩৫ সালের শেষের দিকে শ্রী নফর পাল চৌধুরী সকলকে কাঁদিয়ে ইহধাম ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর জমিদারী ভাগ হয়ে যায়। তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সতিষ চন্দ্র পাল নাটুদা সদর স্ট্রেট, বাগোয়ান মৌজা, কার্পাসডাঙ্গা হাতাবাড়ি ও মেমনগর মৌজা পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত হন।
বাকি দুঅংশ অপর দুছেলে জতিষ ও ক্ষিতিশ চন্দ্র পাল পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার হুগলী, বর্ধমানসহ কলকাতা জুড়ে ভাগ হয়। বড় ছেলে সতিষ চন্দ্র পাল বাবার অবর্তমানে ইে এলাকার দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
১৯৪৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্য অবসান হয় এবং তৎকালিন গর্ভনর লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের নেতৃত্বে দেশ বিভক্তি হয়। সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্থান নামে দুটি দেশ তথা রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রীয়ভাবে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গৃহিত হওয়ার পর জমিদার সতিশ চন্দ্র পার স্বেচ্ছায় তার যাবতীয় সম্মত্তি প্রজাদের মধ্যে বিলি করে এদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান।
বর্তমানে ওই সমস্ত সম্মত্তির বেশীরভাগই এনিমি বা শত্রু সম্মত্তি হয়ে যায়। পরবর্তীতে জমিদার বাবুর ওই সমস্ত সুবিশাল অট্রালিকা ভবনগুলো এলাকার এক শ্রেণির স্বার্থন্বেষী মহল কৌশলে ভেঙ্গে বিক্রি করে দেয়। হাতিয়ে নেয় লক্ষ লক্ষ টাকা। বিলিন হয়ে যায় জমিদার পুত্রের সেই সাধের হাওয়া ভবন তথা কামরা ভবন থেকে শুরু করে নাটুদা স্ট্রেট তথা জমিদার মহলের সব কিছুই। জগনাথপুর গ্রামের প্রবীন ব্যক্তি রমজান আলী বলেন, জমিদার নফর পাল চৌধুরী ছিলেন একজন প্রজা হিতৈষী সহজ সরল শিক্ষিত ও উন্নত মনের মানুষ। তৎকালিন সময়ে অত্র এলাকা ছিল হিন্দু প্রধান এলাকা।
মুসলমান প্রজার সংখ্যা ছিল খুবই কম। জমিদার নফর পাল চৌধুরী উদারচিত্তে সব সম্প্রদায়ের মানুষকেই দেখতেন সমান চোখে। ফলে জমিদার মহল ছিল হিন্দু-মুসলিম পাইক পেয়াদা, বরকন্দাজ ও চাকর চাকরানীতে ভরপুর। সম্মিলিতভাবে মাথায় লাল ফিতে বেঁধে জমিদার মহলের লাঠিয়াল বাহিনী ও কর্মচারিরা যখন এলাকায় খাজনা আদায় করতে যেতো সে দৃশ্যও ছিল চোখে পড়ার মত।
তবে তিনি কখনও প্রজাদের উপর জুলুম করতেন না। বরং গরীব ও দু:স্থ প্রজাদের তিনি খাজনা মওকুফ করার মত অনেক ঘটনা রয়েছে।
এলাকাবাসীর দাবী আগামী নতুন প্রজন্ম এজনপদের জমিদারী বিষয় জানতে শেষ স্মৃতি চিহৃ ইতিহাস হিসেবে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসুক সবাই।
রোববার, ০১ জুন ২০২৫
দামুড়হুদার নাটুদা অঞ্চলের জমিদার নফর পাল চৌধুরীর স্মৃতি বিজড়িত সকল কীর্তিই আজ ধ্বংসের পথে। আজ আর নেই সেই জমিদার মহলের খাজনা আদায়ের লাঠিয়াল বাহিনী, নেই জমিদার মহলের নর্তকীর নাচের ঝলকানি, নেই কোন পাইক পেয়াদা, বরকন্দাজ, চাকর-বাকর, ঘোড়াশাল আর সুবিশাল অট্রালিকা। কালের বিবর্তনে প্রায় সব কিছুই আজ ধ্বংসের পথে। অধিকাংশ কীর্তি ধ্বংস হয়ে গেলেও কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও স্মৃতি চিহৃ বহন করে চলেছে দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদা অঞ্চলের জমিদার নফর পাল চৌধুরীর জমিদার বাড়ির প্রবেশ দ্বারে স্থাপিত দুটি মন্দির বা প্রধান ফটক।
জানা গেছে, বৃটিশ শাসন আমলে লর্ড কর্ণওয়ালিশ কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করা হলে সে সময়ে ভারতের ২৪ পরগনার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব শ্রী মধুসুদন পালের একমাত্র সন্তান শ্রী নফর পাল চৌধুরী (নাটুদা, কার্পাসডাঙ্গা হাতাবাড়ি, মেমনগর, বাগোয়ান, পরগনা, মেদনীপুর) এই গোটা এলাকা বৃটিশদের কাছ থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গ্রহন করেন এবং নাটুদাকে সদর স্টেট হিসেবে ঘোষনা দিয়ে জমিদারী কার্যক্রম চালু করেন। সেই থেকে জমিদারী প্রথা চলে আসলেও প্রায় দেড়শো বছর পর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির মধ্য দিয়ে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি হয়।
জমিদার গিন্নি রাধারানীও ছিলেন একজন প্রজা হিতৈষী মমনের মানুষ। তৎকালিন সময়ে এলাকায় ছিল অধিকাংশ অশিক্ষিত লোকের বসবাস। এলাকার শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে জমিদার গিন্নিই প্রথম স্বপ্নের বীজ বপন করেন। তারই অনুরোধে জমিদার নফর পাল চৌধুরী জমিদার ভবনের উত্তর পাশে জোলের ধার ঘেষে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করেন।
খড়ের ছাউনী দিয়ে নির্মিত বিদ্যালয়টিতে এলাকার ছেলে মেয়েরা প্রথম দিকে ঠিকমত আসতে না চাইলেও জমিদার গিন্নির তরফ থেকে তাদেরকে টিফিনের ব্যবস্থা করার পর ছোট ছোট শিশু কিশোরদের পদচারণায় ভরে ওঠে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জমিদার বাবু ১৯০৬ সালে তার স্ত্রীর নামে বড় আকারের বিদ্যালয় ভবন গড়ে তোলেন। যার নাম দেওয়া হয় নাটুদা রাধারানী ইন্সটিটিউট। এলাকায় শিক্ষিত লোক না পাওয়ায় জমিদার গিন্নির অনুরোধে তিনি সুদুর কলকাতা থেকে শ্রী নরেন্দ্র নাথ সিংহকে এনে প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে ওই বিদ্যালয়টিকে বলা হতো হাজার দুয়ারি স্কুল। যা বর্তমানে নাটুদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে পরিচালিত হয়ে আসছে।
১৯৩৫ সালের শেষের দিকে শ্রী নফর পাল চৌধুরী সকলকে কাঁদিয়ে ইহধাম ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর জমিদারী ভাগ হয়ে যায়। তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সতিষ চন্দ্র পাল নাটুদা সদর স্ট্রেট, বাগোয়ান মৌজা, কার্পাসডাঙ্গা হাতাবাড়ি ও মেমনগর মৌজা পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত হন।
বাকি দুঅংশ অপর দুছেলে জতিষ ও ক্ষিতিশ চন্দ্র পাল পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার হুগলী, বর্ধমানসহ কলকাতা জুড়ে ভাগ হয়। বড় ছেলে সতিষ চন্দ্র পাল বাবার অবর্তমানে ইে এলাকার দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
১৯৪৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্য অবসান হয় এবং তৎকালিন গর্ভনর লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের নেতৃত্বে দেশ বিভক্তি হয়। সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্থান নামে দুটি দেশ তথা রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রীয়ভাবে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গৃহিত হওয়ার পর জমিদার সতিশ চন্দ্র পার স্বেচ্ছায় তার যাবতীয় সম্মত্তি প্রজাদের মধ্যে বিলি করে এদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান।
বর্তমানে ওই সমস্ত সম্মত্তির বেশীরভাগই এনিমি বা শত্রু সম্মত্তি হয়ে যায়। পরবর্তীতে জমিদার বাবুর ওই সমস্ত সুবিশাল অট্রালিকা ভবনগুলো এলাকার এক শ্রেণির স্বার্থন্বেষী মহল কৌশলে ভেঙ্গে বিক্রি করে দেয়। হাতিয়ে নেয় লক্ষ লক্ষ টাকা। বিলিন হয়ে যায় জমিদার পুত্রের সেই সাধের হাওয়া ভবন তথা কামরা ভবন থেকে শুরু করে নাটুদা স্ট্রেট তথা জমিদার মহলের সব কিছুই। জগনাথপুর গ্রামের প্রবীন ব্যক্তি রমজান আলী বলেন, জমিদার নফর পাল চৌধুরী ছিলেন একজন প্রজা হিতৈষী সহজ সরল শিক্ষিত ও উন্নত মনের মানুষ। তৎকালিন সময়ে অত্র এলাকা ছিল হিন্দু প্রধান এলাকা।
মুসলমান প্রজার সংখ্যা ছিল খুবই কম। জমিদার নফর পাল চৌধুরী উদারচিত্তে সব সম্প্রদায়ের মানুষকেই দেখতেন সমান চোখে। ফলে জমিদার মহল ছিল হিন্দু-মুসলিম পাইক পেয়াদা, বরকন্দাজ ও চাকর চাকরানীতে ভরপুর। সম্মিলিতভাবে মাথায় লাল ফিতে বেঁধে জমিদার মহলের লাঠিয়াল বাহিনী ও কর্মচারিরা যখন এলাকায় খাজনা আদায় করতে যেতো সে দৃশ্যও ছিল চোখে পড়ার মত।
তবে তিনি কখনও প্রজাদের উপর জুলুম করতেন না। বরং গরীব ও দু:স্থ প্রজাদের তিনি খাজনা মওকুফ করার মত অনেক ঘটনা রয়েছে।
এলাকাবাসীর দাবী আগামী নতুন প্রজন্ম এজনপদের জমিদারী বিষয় জানতে শেষ স্মৃতি চিহৃ ইতিহাস হিসেবে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসুক সবাই।