দেশে উৎপাদিত একমাত্র আঁশবিহিন স্বুসাদু রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম দেশে উৎপাদিত সকল আমের সেরা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। এবার গাছে আম পুষ্ট হবার আগেই মালেয়শিয়া, নেপাল ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে ২০ কোটি টাকার আম রফতানীর অর্ডার পেয়েছে অবাগান মালিকরা, আরো অর্ডার পাওয়ার আশা করছেন তারা।

রংপুর কৃঘি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর রংপুরে ১ হাজার ৯শ ১৫ হেক্টর জমিতে হাড়িভাঙ্গা আমের চাষ করা হয়েছিলো। যা গত বছরের চেয়ে ৫০ হেক্টর বেশী জমি। তবে এবার আবহাওয়া অনুকুল থাকায়, বৃষ্টি না হওয়া, প্রচণ্ড দাবদাহসহ নানান কারণে ফলন মোটামুটি হয়েছে বলে আমচাষীরা জানিয়েছেন।

এদিকে হাড়িভাঙ্গা আম জিআইপন্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় আমের রাজধানী বলে খ্যাত মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগজ্ঞ , খোড়াগাছসহ বিভিন্ন অঞ্চলের আমচাষিরা প্রচণ্ড খুশি।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, আমের ফলন এবার গতবারের চেয়ে সামান্য কম হওয়ার পরও প্রায় ২৯ হাজার ৮শ ৫১ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবার সম্ভাবনা রয়েছে । বিক্রি দু’শ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি জানান, আমচাষি , কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের সাথে যৌথ বৈঠকে আগামী ২০ জুন বৃহস্পতিবার থেকে হাড়িভাঙ্গা আম বাজারে আসার কথা থাকলেও ৩ দিন আগেই ১৭ জুন মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে বাগান থেকে আম সংগ্রহ করে বাজারজাত করা শুরু হয়েছে। তিনি আরো বলেন, হাড়ি ভাঙ্গা আমের পুরোপুরি পুষ্ট হতে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আমের চেয়ে একটু বেশী সময় লাগে বলেই পুরোপুরি পুষ্ঠু হবার জন্যই ওই তারিখ নির্ধারন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে হাড়ি ভাঙ্গা আমের আকার এবার ভালো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

রংপুরের বদরগজ্ঞ উপজেলার পদাগজ্ঞ এলাকায় হাড়িভাঙ্গা আম প্রথম উৎপাদন করে কৃষক সালাম। সম্পুর্ন আঁশমুক্ত ভীষন সুস্বাদু হওয়ায় এ আমের চাহিদা এখন দেশ ছাপিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বদরগজ্ঞ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর , পদাগজ্ঞ কুতুবপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট সর্দ্দারপাড়া সদর উপজেলার সদ্যপুস্করনী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়ি পার্শ্বে মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের সবগুলো গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভিত্তিতে হাড়ি ভাঙ্গা আমের বাগান গড়ে উঠেছে। মুলত লালমাটি এলাকায় হাড়িভাঙ্গা আমের চাষ হয় আর লালমাটির আম ভীষন সুস্বাদু। গত বছর আমচাষিরা আমের দাম ভাল পাওয়ায় আরও নতুন নতুন আম বাগান গড়ে তুলেছেন এলাকার সাধারন মানুষ। এবার হাড়িভাঙ্গা আমের ফলনও হয়েছে তুলনামুলক ভালো। তবে ক্ষুদ্র চাষীদের অভিযোগ ত্রান ন্যায্য মুল্য পায়না যদি আম সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকতো তাহলে তারা আরো বেশি লাভবান হতেন। বড় বড় ব্যবসায়ীরা আগাম টাকা দিয়ে আমের বাগান কিনে নেয়ায় তারা লাভবান হচ্ছেন বেশি বলে আম চাষীদের অভিযোগ। তার পরেও হাড়ি ভাঙ্গা আম বদরগজ্ঞ ও মিঠাপুকুর উপজেলার ৯০ টি গ্রামের মানুষের ভাগ্যের চাকা খুলে দিয়েছে হাড়িভাঙ্গা আম। এই আম চাষ করে তারা এখন পুরোপুরি স্বাবলম্বি।

সরেজমিন রংপুরের বদরগজ্ঞ উপজেলার পদাগজ্ঞ ও খোড়াগাছ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সারি সারি আমের বাগান এ ছাড়াও প্রতিটি বাড়িতে ১০ থেকে ১৫টি হাড়িভাঙ্গা আমের গাছ আবার কোন কোন বাড়িতে তার চেয়ে বেশি হাড়িভাঙ্গা আমের গাছ। সবগুলো গাছের আম পাকা শুরু হয়ে গেছে বলে আমচাষীরা জানাল। ওই এলাকার আমচাষি রহমত আলী, আশরাফ আলী, মনোয়ারা বেগম, কামরুন নাহারসহ অনেকেই জানালো ১০ বছর আগেও এসব এলাকা ছিল চরম দারিদ্র্যপিড়ীত এলাকা। মানুষ তিন বেলা তো দূরের কথা এক বেলাও খাবার জোটাতে পারতোনা। এলাকার মাটি লাল হওয়ায় এখানে বছরে একবার ধান উৎপাদন হয়। বাকি ৮ মাস পতিত পড়ে থাকে জমি। কিন্তু হাড়ি ভাঙ্গা আম তাদের ভাগ্যের চাকা বদলে দিয়েছে। এখন ধানের বদলে ওই জমিতে আমের বাগান গড়ে তুলেছেন তারা। বছরে আম বিক্রি করে তাদের সংসারে এখন সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

কিন্তু যাদের জমি নেই সেই সব ভূমিহীন পরিবারগুলো তাদের বাস্তভিটাতেই হাড়ি ভাঙ্গা আম গাছ লাগিয়ে উৎপাদিত আম বিক্রি করে সচ্ছল ভাবেই জীবন যাপন করছেন। তবে আমচাষিদের সকলের একটাই দাবি আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। কারণ সংরক্ষণের ব্যাবস্থা না থাকায় তাদের অনেক কম দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেবে এমন প্রত্যাশা তাদের।

এদিকে জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সাল হাসান জানিয়েছেন, সরাসরি বাগান থেকে যাতে আম কিনতে পারে সেজন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আমের পাইকারদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। টাকা লেনদেনের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ খোলা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হবে। এদিকে আম দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাবার জন্য নামকরা কুরিয়ার সার্ভিসগুলো পদাগজ্ঞ এলাকায় বিশেষ অফিস স্থাপন করছেন। তারা বাগান থেকে আম সরাসরি গ্রাহকদের কাছে পৌছে দেবার জন্য বিশেষ গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন অন্যান্য সব জাতের আমের চেয়ে একটু দেরিতে পুষ্ট হয়। আম চাষিরাও আনুষ্ঠানিকভাবে আম পারা শুরু করেছেন।