শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) : এভাবেই বয়স্ক রোগীকে নেয়া হচ্ছে হাসপাতালে -সংবাদ
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি জনপদ বোবারথল। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর হলেও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় যেন হারিয়ে যাওয়া এক অধ্যায়। প্রায় ১০-১২ হাজার মানুষের বসতি এই জনপদে, কিন্তু তাদের নিত্যদিনের সংগ্রাম জীবনের মৌলিক চাহিদা নিয়েই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, পানি। প্রতিটি ক্ষেত্রে বোবারথল আজও অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার।
বোবারথলের সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা সুপেয় পানির সংকট। কোনো গভীর বা অগভীর নলকূপ নেই। পুরো এলাকার মানুষ নির্ভরশীল পাহাড়ি ঝর্না, ছড়া বা টিলার কোয়ার পানির উপর। শুষ্ক মৌসুমে এসব ছড়া শুকিয়ে গেলে বাসিন্দাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে পাহাড়ি গর্ত থেকে চুইয়ে পড়া পানি সংগ্রহ করতে হয়।
গৃহবধূ তাছলিমা বেগম বলেন, পাহাড় বেয়ে দিনে দুইবার পানি আনতে হয়। এক গর্তে পানি জমতে দেড়-দুই ঘণ্টা লাগে।
এ পানি খাওয়ার অনুপযোগী হলেও বিকল্প না থাকায় রান্না থেকে শুরু করে গোসল পর্যন্ত সব কাজে ব্যবহার করা হয়। ফলে পানিবাহিত রোগে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রায় সবাই আক্রান্ত হন।
বোবারথলে নেই কোনো উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা প্রশিক্ষিত চিকিৎসাকর্মী। সাধারণ অসুস্থতায় স্থানীয় দোকানদার বা ভেষজ চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করতে হয়। গুরুতর রোগীদের ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরে উপজেলা সদরে নিতে হয়, যা দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আরও ভোগান্তিকর হয়ে ওঠে।
ইউপি সদস্য ময়নুল হক বলেন, রোগীকে হাসপাতালে নিতে হলে বাঁশ-ঝুড়ি দিয়ে কাঁধে করে কাদা-পথ পার হতে হয়। এটা যেন এক যুদ্ধ। বোবারথলের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ পাকা রাস্তার অভাব। ভাঙা কালভার্ট, কর্দমাক্ত টিলাপথ আর ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো পেরিয়ে প্রতিদিন চলাচল করতে হয়। বর্ষাকালে রাস্তা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।
গর্ভবতী নারীদের জন্য এই পথ চলা যেন বিভীষিকাময়। ইসলামনগর গ্রামের সেলিম উদ্দিন বলেন, আমরার গ্রামে একটা ভালো সড়কও নাই, ক্লিনিকও নাই, পানি খাইতেই ভয় লাগে। সরকার কয় উন্নয়ন, আমরার ভাগ্যে তা কই?
এলাকায় কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি মাদ্রাসা ও ১টি হাইস্কুল থাকলেও গুণগত শিক্ষায় ঘাটতি স্পষ্ট। বর্ষায় রাস্তার দুরবস্থার কারণে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। ফলে শিক্ষার্থীদের নিয়মিততা ও মনোযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কলেজ পড়ুয়া রাজিব উদ্দিন জানান, বাড়ি থেকে কলেজে যেতে দৈনিক প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে।
যদিও বিদ্যুৎ সংযোগ আছে, তবে তা প্রায়ই বিচ্ছিন্ন থাকে। মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল এবং ইন্টারনেট কার্যত অকার্যকর। ফলে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ব্যবসা-বাণিজ্য ও জরুরি যোগাযোগও ব্যাহত হচ্ছে।
স্থানীয় মানুষ নিজেদের উদ্যোগে প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে কিছু রাস্তা সংস্কার করেছেন। কিন্তু তা টেকসই হয়নি। বোবারথল প্রবাসী ঐক্য পরিষদের কোষাধ্যক্ষ আব্দুল মুকিত বলেন, সরকারি দপ্তরে দৌড়াদৌড়ি করেও কোনো কার্যকর সমাধান পাইনি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, পাহাড়ি ভৌগোলিক অবস্থার কারণে টিউবওয়েল স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না। বিকল্পভাবে পাইপলাইনে পানি সরবরাহের প্রস্তাব করা হলেও তা ব্যয়বহুল হওয়ায় বাস্তবায়ন হয়নি।
এলজিইডি কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, রুরাল কানেক্টিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (আরসিআইপি)- এর আওতায় রাস্তা উন্নয়নের একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে তা এখনো অনুমোদিত হয়নি।
দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, বোবারথল উন্নয়নের আলো থেকে বঞ্চিত। ইউনিয়নের সীমিত বরাদ্দে এখানে উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকারি পর্যায়ে বিশেষ বরাদ্দই একমাত্র সমাধান।
বোবারথল যেন এক অদৃশ্য বঞ্চনার প্রতীক। সীমান্তবর্তী এই জনপদে মানুষ এখনো ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সুপেয় পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা, যোগাযোগ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে। অথচ স্থানীয়রা আশা হারাননি। তারা বিশ্বাস করেন, যদি সরকার আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসে, তবে বোবারথলের চেহারা বদলাতে বেশি সময় লাগবে না।
শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) : এভাবেই বয়স্ক রোগীকে নেয়া হচ্ছে হাসপাতালে -সংবাদ
মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট ২০২৫
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি জনপদ বোবারথল। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর হলেও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় যেন হারিয়ে যাওয়া এক অধ্যায়। প্রায় ১০-১২ হাজার মানুষের বসতি এই জনপদে, কিন্তু তাদের নিত্যদিনের সংগ্রাম জীবনের মৌলিক চাহিদা নিয়েই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, পানি। প্রতিটি ক্ষেত্রে বোবারথল আজও অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার।
বোবারথলের সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা সুপেয় পানির সংকট। কোনো গভীর বা অগভীর নলকূপ নেই। পুরো এলাকার মানুষ নির্ভরশীল পাহাড়ি ঝর্না, ছড়া বা টিলার কোয়ার পানির উপর। শুষ্ক মৌসুমে এসব ছড়া শুকিয়ে গেলে বাসিন্দাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে পাহাড়ি গর্ত থেকে চুইয়ে পড়া পানি সংগ্রহ করতে হয়।
গৃহবধূ তাছলিমা বেগম বলেন, পাহাড় বেয়ে দিনে দুইবার পানি আনতে হয়। এক গর্তে পানি জমতে দেড়-দুই ঘণ্টা লাগে।
এ পানি খাওয়ার অনুপযোগী হলেও বিকল্প না থাকায় রান্না থেকে শুরু করে গোসল পর্যন্ত সব কাজে ব্যবহার করা হয়। ফলে পানিবাহিত রোগে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রায় সবাই আক্রান্ত হন।
বোবারথলে নেই কোনো উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা প্রশিক্ষিত চিকিৎসাকর্মী। সাধারণ অসুস্থতায় স্থানীয় দোকানদার বা ভেষজ চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করতে হয়। গুরুতর রোগীদের ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরে উপজেলা সদরে নিতে হয়, যা দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আরও ভোগান্তিকর হয়ে ওঠে।
ইউপি সদস্য ময়নুল হক বলেন, রোগীকে হাসপাতালে নিতে হলে বাঁশ-ঝুড়ি দিয়ে কাঁধে করে কাদা-পথ পার হতে হয়। এটা যেন এক যুদ্ধ। বোবারথলের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ পাকা রাস্তার অভাব। ভাঙা কালভার্ট, কর্দমাক্ত টিলাপথ আর ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো পেরিয়ে প্রতিদিন চলাচল করতে হয়। বর্ষাকালে রাস্তা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।
গর্ভবতী নারীদের জন্য এই পথ চলা যেন বিভীষিকাময়। ইসলামনগর গ্রামের সেলিম উদ্দিন বলেন, আমরার গ্রামে একটা ভালো সড়কও নাই, ক্লিনিকও নাই, পানি খাইতেই ভয় লাগে। সরকার কয় উন্নয়ন, আমরার ভাগ্যে তা কই?
এলাকায় কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি মাদ্রাসা ও ১টি হাইস্কুল থাকলেও গুণগত শিক্ষায় ঘাটতি স্পষ্ট। বর্ষায় রাস্তার দুরবস্থার কারণে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। ফলে শিক্ষার্থীদের নিয়মিততা ও মনোযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কলেজ পড়ুয়া রাজিব উদ্দিন জানান, বাড়ি থেকে কলেজে যেতে দৈনিক প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে।
যদিও বিদ্যুৎ সংযোগ আছে, তবে তা প্রায়ই বিচ্ছিন্ন থাকে। মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল এবং ইন্টারনেট কার্যত অকার্যকর। ফলে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ব্যবসা-বাণিজ্য ও জরুরি যোগাযোগও ব্যাহত হচ্ছে।
স্থানীয় মানুষ নিজেদের উদ্যোগে প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে কিছু রাস্তা সংস্কার করেছেন। কিন্তু তা টেকসই হয়নি। বোবারথল প্রবাসী ঐক্য পরিষদের কোষাধ্যক্ষ আব্দুল মুকিত বলেন, সরকারি দপ্তরে দৌড়াদৌড়ি করেও কোনো কার্যকর সমাধান পাইনি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, পাহাড়ি ভৌগোলিক অবস্থার কারণে টিউবওয়েল স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না। বিকল্পভাবে পাইপলাইনে পানি সরবরাহের প্রস্তাব করা হলেও তা ব্যয়বহুল হওয়ায় বাস্তবায়ন হয়নি।
এলজিইডি কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, রুরাল কানেক্টিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (আরসিআইপি)- এর আওতায় রাস্তা উন্নয়নের একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে তা এখনো অনুমোদিত হয়নি।
দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, বোবারথল উন্নয়নের আলো থেকে বঞ্চিত। ইউনিয়নের সীমিত বরাদ্দে এখানে উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকারি পর্যায়ে বিশেষ বরাদ্দই একমাত্র সমাধান।
বোবারথল যেন এক অদৃশ্য বঞ্চনার প্রতীক। সীমান্তবর্তী এই জনপদে মানুষ এখনো ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সুপেয় পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা, যোগাযোগ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে। অথচ স্থানীয়রা আশা হারাননি। তারা বিশ্বাস করেন, যদি সরকার আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসে, তবে বোবারথলের চেহারা বদলাতে বেশি সময় লাগবে না।