কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) : কুয়াকাটা ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল চিকিৎসক সংকট ও অব্যবস্থাপনার নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে -সংবাদ
দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সাগরকন্যা কুয়াকাটা। সানরাইজ অ্যান্ড সানসেট পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত এই জনপদে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের সমাগম ঘটে। অথচ প্রান্তিক এই জনপদের একমাত্র সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র কুয়াকাটা ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল চিকিৎসক সংকট ও অব্যবস্থাপনার নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটি নামেই হাসপাতাল! আছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। সরকারি ওয়েবসাইট অনুযায়ী কাগজে কলমে ২৪ জনের পদ থাকলেও বাস্তবে কর্মরত আছেন মাত্র ৭ জন। ফলে চিকিৎসা সেবা বলতে এখন শুধু সাইনবোর্ড আর ফাঁকা ভবন হাসপাতালের সাইনবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা ভবনের মধ্যে রয়েছে নীরব হাহাকার। হাসপাতালের পাশের বাসিন্দা বেলাল খান বলেন, হাসপাতালই তো অসুস্থ সেবা দিবে কে?’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুয়াকাটায় ২০ শয্যা হাসপাতালে চারজন জুনিয়র কনসালটেন্ট, একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও একজন মেডিকেল অফিসারের পদ আছে। কিন্তু বর্তমানে শুধু একজন আরএমও সুপ্রিয়া দাস দায়িত্বে আছেন। জরুরি বিভাগ চলছে শুধু একজন ফার্মাসিস্টের ভরসায়। নামেমাত্র ২০ শয্যার এই হাসপাতালটি দীর্ঘদিন ধরেই বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। এখানে প্রতিদিন সেবা নিতে আসেন গড়ে ৫০ জন রোগী। কিন্তু অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরে যান। কেউ পাড়ি জমান ২২ কিলোমিটার দূরের কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই, ওষুধ নেই অথচ এটি সরকারি হাসপাতাল।
মটরসাইকেল দূর্ঘটনায় আহত এক রোগীর স্বজন আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া কিছুই হয় না। আমার ভাই দূর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। এখানে নিয়ে এসেছি, জরুরি বিভাগ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কলাপাড়ায় রেফার করেছেন।
২০১২ সালে একজন চিকিৎসক দিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর অনিয়ম, অনুপস্থিতি আর দায়সারা চিকিৎসায় এই হাসপাতাল কার্যত কখনোই পূর্ণ সক্ষমতায় চালু হয়নি। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন মুমসাদ সায়েম পুনম। গত ১৭ এপ্রিল দুই মাসের প্রশিক্ষণে গিয়ে আর ফেরেননি। তখন থেকেই চিকিৎসক শুন্য হাসপাতালটি। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমসিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
‘কুয়াকাটায় ঘুরতে আসা, সমুদ্রগামী জেলেসহ উপকূলীয় এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে হাসপাতালটি করা হয়েছিলো। এ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায় উপকুলের মানুষ হতাশ।
হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে একজন উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) যোগদান করেছেন। তিঁনি কতদিন এখানে থাকবেন তার কোন নিশ্চিয়তা নেই। এখানের চিকিৎসকরা ক্রিকেট খেলার বেটারদের মতো আসা-যাওয়ার তালে থাকেন। শিশু রোগ, গাইনি বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কল্পনা করা আর গভীর রাতে সূর্যের আলো দেখতে চাওয়া সমান। সরকারি নীতিমালায় বরাদ্দ থাকলেও বহুদিন ধরেই নেই সার্জারি, ল্যাব, এক্স-রে বা ইসিজি সুবিধা।
চিকিৎসা নিতে আসা এক গৃহিনী হাফসা বেগম বলেন, ‘রক্তচাপ বেশি ছিল, এখানে এসেছি। ডাক্তার একজনই আছেন, তিনিও দুপুরে চলে গেছেন। ওষুধও পেলাম না, বললো ‘বাইরে থেকে কিনেন’। তাহলে হাসপাতাল থেকে কি করব? স্থানীয় জেলে একলাস মাঝি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ হাসপাতাল যেন শুধু দেখার জন্য, চিকিৎসা তো মেলে না। কেউ গিয়ে ডাক্তার খুঁজলে বলে, ডাক্তার নেই!’
পর্যটক থাকলেও জরুরি সেবার প্রস্তুতি থাকে না। এ হাসপাতাল জরুরি সেবা বা অ্যাম্বুলেন্স সুবিধায় ভয়াবহভাবে পিছিয়ে। দুর্ঘটনা বা হঠাৎ অসুস্থতাজনিত জটিলতায় পর্যটকদের ভরসা বলতে প্রাইভেট ক্লিনিক কিংবা কলাপাড়া, পটুয়াখালী ও বরিশালের হাসপাতাল। হাসপাতালের মধ্যে যা অবস্থা, তাতে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পরবে। হাসপাতালের বাহিরে এবং ভিতরে যত্রতত্র পরে ময়লার স্তুপ। বিভিন্ন ওয়ার্ডের পাশের টয়লেটগুলোর বেহাল অবস্থায়। দরজা-জানালা ভেঙ্গে পড়ে আছে। নিয়মিত পরিস্কার করার মনে হয় কেউ নেই। ফলে স্বাস্থ্যসেবার এই সংকটে ভুগছে কুয়াকাটায় আগত পর্যটক, সমুদ্র আহত জেলেসহ উপকূলের সাধারণ মানুষ।
ছবি ও ফুটেজ নিতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক সাইদুর রহমান ফেসবুক পোষ্টে লেখেন, ‘আপনার কল্পনাকেও হার মানাবে যে হাসপাতালটি।’ তিনি বলেন, এখানে হাসপাতাল আছে, কিন্তু রোগী দেখতে গেলে মনে হয় ওয়ার্ডে চিকিৎসার চেয়ে ধুলা বেশি জমে আছে।’ হাসপাতালে ভবন আছে, নেই ব্যবস্থাপনা। ২০১২ সালে নির্মিত হাসপাতাল ভবনটি আজও পুরোপুরি ব্যবহারযোগ্য নয়। দীর্ঘদিন ধরে আবাসিক কোয়ার্টার খালি পড়ে আছে, নার্স ও স্টাফদের জন্য নেই মানসম্পন্ন আবাসন বা নিরাপত্তা। ২০ শয্যার হাসপাতালের কোন বেডই ব্যবহৃত হয় না। মহিপুর থানার তিনটি ইউনিয়ন ও কুয়াকাটা পৌরসভার অন্তত ৫০ হাজার মানুষ এই হাসপাতালে নির্ভরশীল। কিন্তু নিয়মিত সেবা না পেয়ে তারা স্থানীয় ওষুধের দোকানদার, হোমিও বা কবিরাজের দ্বারস্থ হয়। ফলে একদিকে ভুল চিকিৎসার ঝুঁকি, অন্যদিকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষ পড়ছেন চিকিৎসা বঞ্চনায়। স্বাস্থ্য সেবায় জড়িত একজন চিকিৎসক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই হাসপাতালের জন্য ৬ জন চিকিৎসক, ৫ জন নার্স এবং ১ জন ফার্মাসিস্ট পদের অনুমোদন আছে। কিন্তু নার্সের পদগুলো পরিপূর্ণ থাকলেও চিকিৎসকসহ প্রায় সব পদই খালি। স্থানীয়ভাবে চাহিদা থাকলেও রিকুইজিশনের ঘাটতি ও নজরদারির অভাবেই সেবা নিশ্চিত হচ্ছে না।’ স্বাস্থ্য সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হলেও কুয়াকাটার এই হাসপাতালের চিত্র যেন সেই প্রতিশ্রুতির ব্যঙ্গচিত্র। একটি জনবহুল পর্যটন শহর, যেখানে প্রতিনিয়ত শত মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে, সেখানে ২০ শয্যার হাসপাতাল চিকিৎসক-সেবিকা-সেবা ছাড়াই পড়ে রয়েছে। এটি শুধু একটি হাসপাতালের নয়, সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থারই অসুস্থ প্রতিচ্ছবি। কথাগুলো বললেন খুলনা থেকে আসা স্থানীয় একটি ফার্মেসীর পল্লী চিকিৎসক। ২০ শয্যার জন্য সরকার নির্ধারিত ৫ জন নার্স থাকলেও ওয়ার্ডবয়, ল্যাব টেকনিশিয়ান ও ফার্মাসিস্টসহ বেশিরভাগ পদ শূন্য। ফলে প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি ওষুধ বিতরণ, স্যালাইন লাগানো, রোগী দেখভালসবই করতে হয় সীমিত সংখ্যক স্টাফকে। এর ফলে রোগী যেমন ক্ষতিগ্রস্থ, তেমনি কর্মীরাও অতিরিক্ত কাজের চাপে ক্লান্ত। কুয়াকাটা শুধু স্থানীয়দের জন্য নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও বিবেচিত। অথচ পর্যটকদের জন্য এখানে কোনো ইমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিস নেই। পর্যটকদের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে রীতিমতো মহাবিপদ। দ্রুত ঢাকা-বরিশাল নেয়া ছাড়া বড় চিকিৎসা এখানে নেই। অ্যাম্বুলেন্স নেই, নেই এক্স-রে মেশিন। থাকবে কেন? এগুলো থাকবে প্রাইভেট ক্লিনিকে!
কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন (কুটুম) সাধারণ সম্পাদক হোসাইন আমির বলেন, ‘হাজার হাজার পর্যটক আসে এখানে। অথচ ছোটখাটো দুর্ঘটনার পড়লে তাদের নিয়ে যেতে হয় কলাপাড়া বা পটুয়াখালী। এটা আমাদের পর্যটন সেক্টরের জন্য লজ্জাজনক।’ পটুয়াখালী সিভিল সার্জন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, “কুয়াকাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বারবার চিঠি দিয়েছি লোকবল ও সরঞ্জাম বৃদ্ধির জন্য। তবে এখনো স্থায়ী কোনো বরাদ্দ মেলেনি।’ স্থানীয়রা বারবার দাবি জানিয়ে আসছেন, কুয়াকাটা হাসপাতালকে কমপক্ষে ৫০ শয্যায় উন্নীত করার এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্স ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনের। কারণ এখানে শুধু স্থানীয় নয়, হাজারো ভাসমান জনসংখ্যা এবং পর্যটকের নির্ভরতার কেন্দ্রও এটি।
তুলাতলী বাস টার্মিনালের দোকানদার আহসান হাবিব বলেন, স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক অধিকার হলেও আমাদের জন্য তা এখনো অধরা। পর্যটন নগরীর ভরসা একমাত্র হাসপাতালটির এমন অসুস্থ দশা উন্নয়নের সব প্রচেষ্টাকে ম্লান করে দিচ্ছে।’ হাসপাতালের সেবা দিবে কে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন আজ উপকূলের প্রান্তিক জনপদের মানুষ। সদ্য যোগদান করা আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) সুপ্রিয়া দাস বলেন, ‘বর্তমানে হাসপাতালে পরিবেশগত ও সরঞ্জামাদির যে সমস্যা আছে, তা দ্রুত নিরসন করার চেষ্টা থাকবে। আগত রোগীদের শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করবো।’ এ বিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ শংকর প্রসাদ অধিকারী বলেন, ‘কুয়াকাটা ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ৬ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও দুর্ভাগ্যবশত আমরা ডাক্তার পাইনি। গত শনিবার একজন ডাক্তার আরএমও পদে যোগদান করেছেন, তিঁনি ওখানে মেডিকেল অফিসার হিসেবে থাকবেন। আমরা ডাক্তার চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। আশা করছি এ সমস্যা হয়ে যাবে।’এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ খালেদুর রহমান মিয়া বলেন,‘শুধু কুয়াকাটা নয়, সমগ্র পটুয়াখালী জেলায় চিকিৎসকের চরম সংকট রয়েছে। পটুয়াখালীর আট উপজেলায় মাত্র ২১জন চিকিৎসক কর্মরত আছেন। বিষয়টি আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। দ্রুত সময়ের চিকিৎসকের সংকট কেটে যাবে।
কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) : কুয়াকাটা ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল চিকিৎসক সংকট ও অব্যবস্থাপনার নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে -সংবাদ
মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট ২০২৫
দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সাগরকন্যা কুয়াকাটা। সানরাইজ অ্যান্ড সানসেট পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত এই জনপদে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের সমাগম ঘটে। অথচ প্রান্তিক এই জনপদের একমাত্র সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র কুয়াকাটা ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল চিকিৎসক সংকট ও অব্যবস্থাপনার নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটি নামেই হাসপাতাল! আছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। সরকারি ওয়েবসাইট অনুযায়ী কাগজে কলমে ২৪ জনের পদ থাকলেও বাস্তবে কর্মরত আছেন মাত্র ৭ জন। ফলে চিকিৎসা সেবা বলতে এখন শুধু সাইনবোর্ড আর ফাঁকা ভবন হাসপাতালের সাইনবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা ভবনের মধ্যে রয়েছে নীরব হাহাকার। হাসপাতালের পাশের বাসিন্দা বেলাল খান বলেন, হাসপাতালই তো অসুস্থ সেবা দিবে কে?’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুয়াকাটায় ২০ শয্যা হাসপাতালে চারজন জুনিয়র কনসালটেন্ট, একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও একজন মেডিকেল অফিসারের পদ আছে। কিন্তু বর্তমানে শুধু একজন আরএমও সুপ্রিয়া দাস দায়িত্বে আছেন। জরুরি বিভাগ চলছে শুধু একজন ফার্মাসিস্টের ভরসায়। নামেমাত্র ২০ শয্যার এই হাসপাতালটি দীর্ঘদিন ধরেই বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। এখানে প্রতিদিন সেবা নিতে আসেন গড়ে ৫০ জন রোগী। কিন্তু অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরে যান। কেউ পাড়ি জমান ২২ কিলোমিটার দূরের কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই, ওষুধ নেই অথচ এটি সরকারি হাসপাতাল।
মটরসাইকেল দূর্ঘটনায় আহত এক রোগীর স্বজন আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া কিছুই হয় না। আমার ভাই দূর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। এখানে নিয়ে এসেছি, জরুরি বিভাগ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কলাপাড়ায় রেফার করেছেন।
২০১২ সালে একজন চিকিৎসক দিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর অনিয়ম, অনুপস্থিতি আর দায়সারা চিকিৎসায় এই হাসপাতাল কার্যত কখনোই পূর্ণ সক্ষমতায় চালু হয়নি। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন মুমসাদ সায়েম পুনম। গত ১৭ এপ্রিল দুই মাসের প্রশিক্ষণে গিয়ে আর ফেরেননি। তখন থেকেই চিকিৎসক শুন্য হাসপাতালটি। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমসিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
‘কুয়াকাটায় ঘুরতে আসা, সমুদ্রগামী জেলেসহ উপকূলীয় এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে হাসপাতালটি করা হয়েছিলো। এ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায় উপকুলের মানুষ হতাশ।
হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে একজন উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) যোগদান করেছেন। তিঁনি কতদিন এখানে থাকবেন তার কোন নিশ্চিয়তা নেই। এখানের চিকিৎসকরা ক্রিকেট খেলার বেটারদের মতো আসা-যাওয়ার তালে থাকেন। শিশু রোগ, গাইনি বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কল্পনা করা আর গভীর রাতে সূর্যের আলো দেখতে চাওয়া সমান। সরকারি নীতিমালায় বরাদ্দ থাকলেও বহুদিন ধরেই নেই সার্জারি, ল্যাব, এক্স-রে বা ইসিজি সুবিধা।
চিকিৎসা নিতে আসা এক গৃহিনী হাফসা বেগম বলেন, ‘রক্তচাপ বেশি ছিল, এখানে এসেছি। ডাক্তার একজনই আছেন, তিনিও দুপুরে চলে গেছেন। ওষুধও পেলাম না, বললো ‘বাইরে থেকে কিনেন’। তাহলে হাসপাতাল থেকে কি করব? স্থানীয় জেলে একলাস মাঝি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ হাসপাতাল যেন শুধু দেখার জন্য, চিকিৎসা তো মেলে না। কেউ গিয়ে ডাক্তার খুঁজলে বলে, ডাক্তার নেই!’
পর্যটক থাকলেও জরুরি সেবার প্রস্তুতি থাকে না। এ হাসপাতাল জরুরি সেবা বা অ্যাম্বুলেন্স সুবিধায় ভয়াবহভাবে পিছিয়ে। দুর্ঘটনা বা হঠাৎ অসুস্থতাজনিত জটিলতায় পর্যটকদের ভরসা বলতে প্রাইভেট ক্লিনিক কিংবা কলাপাড়া, পটুয়াখালী ও বরিশালের হাসপাতাল। হাসপাতালের মধ্যে যা অবস্থা, তাতে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পরবে। হাসপাতালের বাহিরে এবং ভিতরে যত্রতত্র পরে ময়লার স্তুপ। বিভিন্ন ওয়ার্ডের পাশের টয়লেটগুলোর বেহাল অবস্থায়। দরজা-জানালা ভেঙ্গে পড়ে আছে। নিয়মিত পরিস্কার করার মনে হয় কেউ নেই। ফলে স্বাস্থ্যসেবার এই সংকটে ভুগছে কুয়াকাটায় আগত পর্যটক, সমুদ্র আহত জেলেসহ উপকূলের সাধারণ মানুষ।
ছবি ও ফুটেজ নিতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক সাইদুর রহমান ফেসবুক পোষ্টে লেখেন, ‘আপনার কল্পনাকেও হার মানাবে যে হাসপাতালটি।’ তিনি বলেন, এখানে হাসপাতাল আছে, কিন্তু রোগী দেখতে গেলে মনে হয় ওয়ার্ডে চিকিৎসার চেয়ে ধুলা বেশি জমে আছে।’ হাসপাতালে ভবন আছে, নেই ব্যবস্থাপনা। ২০১২ সালে নির্মিত হাসপাতাল ভবনটি আজও পুরোপুরি ব্যবহারযোগ্য নয়। দীর্ঘদিন ধরে আবাসিক কোয়ার্টার খালি পড়ে আছে, নার্স ও স্টাফদের জন্য নেই মানসম্পন্ন আবাসন বা নিরাপত্তা। ২০ শয্যার হাসপাতালের কোন বেডই ব্যবহৃত হয় না। মহিপুর থানার তিনটি ইউনিয়ন ও কুয়াকাটা পৌরসভার অন্তত ৫০ হাজার মানুষ এই হাসপাতালে নির্ভরশীল। কিন্তু নিয়মিত সেবা না পেয়ে তারা স্থানীয় ওষুধের দোকানদার, হোমিও বা কবিরাজের দ্বারস্থ হয়। ফলে একদিকে ভুল চিকিৎসার ঝুঁকি, অন্যদিকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষ পড়ছেন চিকিৎসা বঞ্চনায়। স্বাস্থ্য সেবায় জড়িত একজন চিকিৎসক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই হাসপাতালের জন্য ৬ জন চিকিৎসক, ৫ জন নার্স এবং ১ জন ফার্মাসিস্ট পদের অনুমোদন আছে। কিন্তু নার্সের পদগুলো পরিপূর্ণ থাকলেও চিকিৎসকসহ প্রায় সব পদই খালি। স্থানীয়ভাবে চাহিদা থাকলেও রিকুইজিশনের ঘাটতি ও নজরদারির অভাবেই সেবা নিশ্চিত হচ্ছে না।’ স্বাস্থ্য সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হলেও কুয়াকাটার এই হাসপাতালের চিত্র যেন সেই প্রতিশ্রুতির ব্যঙ্গচিত্র। একটি জনবহুল পর্যটন শহর, যেখানে প্রতিনিয়ত শত মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে, সেখানে ২০ শয্যার হাসপাতাল চিকিৎসক-সেবিকা-সেবা ছাড়াই পড়ে রয়েছে। এটি শুধু একটি হাসপাতালের নয়, সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থারই অসুস্থ প্রতিচ্ছবি। কথাগুলো বললেন খুলনা থেকে আসা স্থানীয় একটি ফার্মেসীর পল্লী চিকিৎসক। ২০ শয্যার জন্য সরকার নির্ধারিত ৫ জন নার্স থাকলেও ওয়ার্ডবয়, ল্যাব টেকনিশিয়ান ও ফার্মাসিস্টসহ বেশিরভাগ পদ শূন্য। ফলে প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি ওষুধ বিতরণ, স্যালাইন লাগানো, রোগী দেখভালসবই করতে হয় সীমিত সংখ্যক স্টাফকে। এর ফলে রোগী যেমন ক্ষতিগ্রস্থ, তেমনি কর্মীরাও অতিরিক্ত কাজের চাপে ক্লান্ত। কুয়াকাটা শুধু স্থানীয়দের জন্য নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও বিবেচিত। অথচ পর্যটকদের জন্য এখানে কোনো ইমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিস নেই। পর্যটকদের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে রীতিমতো মহাবিপদ। দ্রুত ঢাকা-বরিশাল নেয়া ছাড়া বড় চিকিৎসা এখানে নেই। অ্যাম্বুলেন্স নেই, নেই এক্স-রে মেশিন। থাকবে কেন? এগুলো থাকবে প্রাইভেট ক্লিনিকে!
কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন (কুটুম) সাধারণ সম্পাদক হোসাইন আমির বলেন, ‘হাজার হাজার পর্যটক আসে এখানে। অথচ ছোটখাটো দুর্ঘটনার পড়লে তাদের নিয়ে যেতে হয় কলাপাড়া বা পটুয়াখালী। এটা আমাদের পর্যটন সেক্টরের জন্য লজ্জাজনক।’ পটুয়াখালী সিভিল সার্জন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, “কুয়াকাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বারবার চিঠি দিয়েছি লোকবল ও সরঞ্জাম বৃদ্ধির জন্য। তবে এখনো স্থায়ী কোনো বরাদ্দ মেলেনি।’ স্থানীয়রা বারবার দাবি জানিয়ে আসছেন, কুয়াকাটা হাসপাতালকে কমপক্ষে ৫০ শয্যায় উন্নীত করার এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্স ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনের। কারণ এখানে শুধু স্থানীয় নয়, হাজারো ভাসমান জনসংখ্যা এবং পর্যটকের নির্ভরতার কেন্দ্রও এটি।
তুলাতলী বাস টার্মিনালের দোকানদার আহসান হাবিব বলেন, স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক অধিকার হলেও আমাদের জন্য তা এখনো অধরা। পর্যটন নগরীর ভরসা একমাত্র হাসপাতালটির এমন অসুস্থ দশা উন্নয়নের সব প্রচেষ্টাকে ম্লান করে দিচ্ছে।’ হাসপাতালের সেবা দিবে কে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন আজ উপকূলের প্রান্তিক জনপদের মানুষ। সদ্য যোগদান করা আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) সুপ্রিয়া দাস বলেন, ‘বর্তমানে হাসপাতালে পরিবেশগত ও সরঞ্জামাদির যে সমস্যা আছে, তা দ্রুত নিরসন করার চেষ্টা থাকবে। আগত রোগীদের শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করবো।’ এ বিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ শংকর প্রসাদ অধিকারী বলেন, ‘কুয়াকাটা ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ৬ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও দুর্ভাগ্যবশত আমরা ডাক্তার পাইনি। গত শনিবার একজন ডাক্তার আরএমও পদে যোগদান করেছেন, তিঁনি ওখানে মেডিকেল অফিসার হিসেবে থাকবেন। আমরা ডাক্তার চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। আশা করছি এ সমস্যা হয়ে যাবে।’এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ খালেদুর রহমান মিয়া বলেন,‘শুধু কুয়াকাটা নয়, সমগ্র পটুয়াখালী জেলায় চিকিৎসকের চরম সংকট রয়েছে। পটুয়াখালীর আট উপজেলায় মাত্র ২১জন চিকিৎসক কর্মরত আছেন। বিষয়টি আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। দ্রুত সময়ের চিকিৎসকের সংকট কেটে যাবে।