জয়পুরহাট : কাঠের ঘানিতে বৈদ্যুতিক মেশিন ব্যবহার করে তেল উৎপাদন -সংবাদ
গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীদের অবদান অপরিহার্য এবং বহুমুখী। তারা কৃষি, পশুপালন, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং গৃহস্থালি কাজসহ নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে এবং গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। যদিও এই অবদান প্রায়শই স্বীকৃতি পায় না, তবুও গ্রামীণ নারীরা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেন। এমনি এক সফল নারী উদ্যোক্তা জয়পুরহাটে বাদাম তেল উৎপাদনকারী বিথী পারভিন।
এক সময় গরু ও ঘোড়া দিয়ে কাঠের তৈরি ঘানিতে ভাঙানো হতো সরিষা। ঘানি ভাঙানো সরিষার এই তেল দিয়েই মেটানো হতো সংসারে যাবতীয় রান্নায় প্রয়োজনীয় তেলের চাহিদা। কালের বিবর্তন আর সময়ের ব্যবধানে এই ঘানি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। ফলে শতভাগ খাঁটি তেল পাওয়াটা এখন দুষ্কর। এরকম এক পরিস্থিতিতে কাঠের ঘানিতে বৈদ্যুতিক মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে যে তেল উৎপাদন করা যায়, জয়পুরহাটের নারী উদ্যোক্তা বিথী পারভীন তার উদাহরণ।
জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ রাঘবপুর গ্রামের ওয়ালীউল হাসান রিপনের স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তানের জননী এই বিথী পারভিন। ২০১৯ সালে জয়পুরহাট সরকারি কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে স্নাতকোত্তর-বিথী গৃহিণী হিসেবে বাড়িতেই থাকতেন তিনি। তবে কিছু একটা করা দরকার এই চিন্তায় স্থির থাকতে পারেননি তিনি। হঠাৎ করেই একদিন তার মাথায় আসে কাঠের ঘানিতে বাদাম তেল তৈরির কথা। তিনি সাহায্য নেন ইউটিউবের। পরে কাঠের ঘানি প্রস্তুত করে ২০২০ সালের আগস্ট মাসে শুরু করেন কাঠের ঘানিতে বাদাম তেল উৎপাদন। তিনি গরুর পরিবর্তে ঘানিতে বৈদ্যুতিক মেশিন প্রতিস্থাপন করেন। এক কেজি বাদাম বা সরিষা থেকে তেল উৎপাদিত হয় ২৫০ গ্রাম। এখন প্রতিদিন প্রায় ১০ কেজি বাদাম ভাঙানো হয়। বিথি এ প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন ‘জয়পুরী অর্গানিকফুড।’ ইতোমধ্যেই ভালো সাড়া ফেলেছ তার এই তেল। তাই এখানে শুধু বাদাম তেল-ই নয়, সরিষা, কালোজিরাসহ সূর্যমুখী তেল ও উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে তার। তিনি বলেন, বাদাম তেলের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। অনেকেই রান্না, ত্বকের পরিচর্যা, চুলে দেয়া, বাচ্চাদের বিভিন্ন খাবার তৈরির জন্য এই তেল কিনছেন। এ তেল স্বাস্থ্যসম্মত। বর্তমান প্রতিলিটার বাদাম তেল ৮৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
জয়পুরহাট শহর থেকে বাদাম তেল কিনতে আসা হাসিবুল হাসান, নুরুজ্জামান বাবু, বলেন, ব্লাডপেসার ও ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এ তেল খুব উপকারী। আমরাও এটা ব্যবহার করছি এবং প্রতিবেশী-স্বজনদেরও ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করছি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক লিটন চন্দ্র ঘোষ বলেন, কাঠের ঘানিতে তেল ভাঙা একটি হারানো ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে এনেছেন বিথী পারভিন। তিনি কাঠের ঘানিতে বাদাম থেকে তেল উৎপাদন করছেন। বাদাম তেলে সরিষা ও সয়াবিনের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। আর এছাড়াও এ তেলে রয়েছে প্রোটিন, যেটা আমাদের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি পণ্য বিপণনে এই উদ্যোক্তার কোনো সহযোগিতা লাগে, সে ক্ষেত্রে আমরা মেলাসহ অনলাইন গ্রুপ, ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করে দেব। এবং সেই সথে ‘বিএসটিআই’র নিবন্ধন করার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে। আর্থিক কোনো সহযোগিতাসহ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হলেও আমরা তাকে সে সহযোগিতাও করবো।
এ বিষয়ে পুষ্টিবিদ জাহানারা আক্তার সুমি বলেন, বাদাম হলো প্রাকৃতিক উদ্ভিদজাত খাদ্য উপাদান। এটি শরীরের জন্য খুবই উপকারী। এতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। যেমন বাদামে যে প্রোটিন রয়েছে তা অন্যান্য খাদ্য উপাদান থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং উন্নতমানের। ১০০ গ্রাম মিক্সড বাদাম থেকে প্রায় ২০ গ্রাম প্রোটিন আমরা পেতে পারি। বাদামের তেলে যেহেতু বাদাম ব্যবহার করা হয় তাই বাদাম তেলে এসব পুষ্টিগুণ পাওয়া যাবে। বাদাম তেলে যে প্রোটিন রয়েছে তা আমাদের শরীরের মাংসপেশীর গঠন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। বাদাম তেলে যে ফ্যাট রয়েছে তা উপকারী ফ্যাট। সাধারণত খাদ্য থেকে আমরা যে ফ্যাট পাই তা দুই ধরনের। স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। লাল মাংস বা অন্যান্য তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে কিন্তু বাদামে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যেমন মুফা (মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড) এবং পুফা (পলিমনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড) বেশি থাকে। যা আমাদের রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং শরীরের জন্য উপকারী এইচডিএল অর্থাৎ ভালো কোলেস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করে। যা করোনা রিহার্ট ডিজিজ, ব্লাডপ্রেসার কন্ট্রোলে সাহায্য করে থাকে।
জয়পুরহাট : কাঠের ঘানিতে বৈদ্যুতিক মেশিন ব্যবহার করে তেল উৎপাদন -সংবাদ
বুধবার, ২৭ আগস্ট ২০২৫
গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীদের অবদান অপরিহার্য এবং বহুমুখী। তারা কৃষি, পশুপালন, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং গৃহস্থালি কাজসহ নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে এবং গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। যদিও এই অবদান প্রায়শই স্বীকৃতি পায় না, তবুও গ্রামীণ নারীরা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেন। এমনি এক সফল নারী উদ্যোক্তা জয়পুরহাটে বাদাম তেল উৎপাদনকারী বিথী পারভিন।
এক সময় গরু ও ঘোড়া দিয়ে কাঠের তৈরি ঘানিতে ভাঙানো হতো সরিষা। ঘানি ভাঙানো সরিষার এই তেল দিয়েই মেটানো হতো সংসারে যাবতীয় রান্নায় প্রয়োজনীয় তেলের চাহিদা। কালের বিবর্তন আর সময়ের ব্যবধানে এই ঘানি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। ফলে শতভাগ খাঁটি তেল পাওয়াটা এখন দুষ্কর। এরকম এক পরিস্থিতিতে কাঠের ঘানিতে বৈদ্যুতিক মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে যে তেল উৎপাদন করা যায়, জয়পুরহাটের নারী উদ্যোক্তা বিথী পারভীন তার উদাহরণ।
জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ রাঘবপুর গ্রামের ওয়ালীউল হাসান রিপনের স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তানের জননী এই বিথী পারভিন। ২০১৯ সালে জয়পুরহাট সরকারি কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে স্নাতকোত্তর-বিথী গৃহিণী হিসেবে বাড়িতেই থাকতেন তিনি। তবে কিছু একটা করা দরকার এই চিন্তায় স্থির থাকতে পারেননি তিনি। হঠাৎ করেই একদিন তার মাথায় আসে কাঠের ঘানিতে বাদাম তেল তৈরির কথা। তিনি সাহায্য নেন ইউটিউবের। পরে কাঠের ঘানি প্রস্তুত করে ২০২০ সালের আগস্ট মাসে শুরু করেন কাঠের ঘানিতে বাদাম তেল উৎপাদন। তিনি গরুর পরিবর্তে ঘানিতে বৈদ্যুতিক মেশিন প্রতিস্থাপন করেন। এক কেজি বাদাম বা সরিষা থেকে তেল উৎপাদিত হয় ২৫০ গ্রাম। এখন প্রতিদিন প্রায় ১০ কেজি বাদাম ভাঙানো হয়। বিথি এ প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন ‘জয়পুরী অর্গানিকফুড।’ ইতোমধ্যেই ভালো সাড়া ফেলেছ তার এই তেল। তাই এখানে শুধু বাদাম তেল-ই নয়, সরিষা, কালোজিরাসহ সূর্যমুখী তেল ও উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে তার। তিনি বলেন, বাদাম তেলের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। অনেকেই রান্না, ত্বকের পরিচর্যা, চুলে দেয়া, বাচ্চাদের বিভিন্ন খাবার তৈরির জন্য এই তেল কিনছেন। এ তেল স্বাস্থ্যসম্মত। বর্তমান প্রতিলিটার বাদাম তেল ৮৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
জয়পুরহাট শহর থেকে বাদাম তেল কিনতে আসা হাসিবুল হাসান, নুরুজ্জামান বাবু, বলেন, ব্লাডপেসার ও ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এ তেল খুব উপকারী। আমরাও এটা ব্যবহার করছি এবং প্রতিবেশী-স্বজনদেরও ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করছি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক লিটন চন্দ্র ঘোষ বলেন, কাঠের ঘানিতে তেল ভাঙা একটি হারানো ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে এনেছেন বিথী পারভিন। তিনি কাঠের ঘানিতে বাদাম থেকে তেল উৎপাদন করছেন। বাদাম তেলে সরিষা ও সয়াবিনের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। আর এছাড়াও এ তেলে রয়েছে প্রোটিন, যেটা আমাদের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি পণ্য বিপণনে এই উদ্যোক্তার কোনো সহযোগিতা লাগে, সে ক্ষেত্রে আমরা মেলাসহ অনলাইন গ্রুপ, ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করে দেব। এবং সেই সথে ‘বিএসটিআই’র নিবন্ধন করার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে। আর্থিক কোনো সহযোগিতাসহ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হলেও আমরা তাকে সে সহযোগিতাও করবো।
এ বিষয়ে পুষ্টিবিদ জাহানারা আক্তার সুমি বলেন, বাদাম হলো প্রাকৃতিক উদ্ভিদজাত খাদ্য উপাদান। এটি শরীরের জন্য খুবই উপকারী। এতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। যেমন বাদামে যে প্রোটিন রয়েছে তা অন্যান্য খাদ্য উপাদান থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং উন্নতমানের। ১০০ গ্রাম মিক্সড বাদাম থেকে প্রায় ২০ গ্রাম প্রোটিন আমরা পেতে পারি। বাদামের তেলে যেহেতু বাদাম ব্যবহার করা হয় তাই বাদাম তেলে এসব পুষ্টিগুণ পাওয়া যাবে। বাদাম তেলে যে প্রোটিন রয়েছে তা আমাদের শরীরের মাংসপেশীর গঠন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। বাদাম তেলে যে ফ্যাট রয়েছে তা উপকারী ফ্যাট। সাধারণত খাদ্য থেকে আমরা যে ফ্যাট পাই তা দুই ধরনের। স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। লাল মাংস বা অন্যান্য তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে কিন্তু বাদামে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যেমন মুফা (মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড) এবং পুফা (পলিমনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড) বেশি থাকে। যা আমাদের রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং শরীরের জন্য উপকারী এইচডিএল অর্থাৎ ভালো কোলেস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করে। যা করোনা রিহার্ট ডিজিজ, ব্লাডপ্রেসার কন্ট্রোলে সাহায্য করে থাকে।