স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে দেশের মোট রপ্তানি আয়ে পাটের অবদান ছিল ৯৩ শতাংশ। বাকি ৩ শতাংশ ছিল অন্যান্য পণ্যের। সেই চিত্র এখন পুরোটাই বিপরীত। ক্রমেই কমে আসে পাটের প্রাধান্য। গত সোমবার প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুারোর (ইপিবি) প্রতিবেদন বলছে, গত মার্চ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট রপ্তানিতে পাটের অবদান মাত্র ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের পুরো সময়ে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন) ছিল ১ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটের ‘সোনালি দিন’ ফিরিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। বিভিন্ন সরকারের সময়ে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা হয়নি। পাঁচ বছর আগে পাটের সুদিন ফিরে আসার হাতছানি দেখা দিয়েছিল। পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে প্রথমবারের মতো রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। মোট রপ্তানিতে পাট খাতের অবদান ৩ শতাংশ ছাড়িয়েছিল।
কিন্তু এর পর ফের হোঁচট। কমতে থাকে রপ্তানির অঙ্ক। অথচ নানা বাধাবিপত্তির মধ্যেও রপ্তানি বাণিজ্যে সুবাতাস বইছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য রপ্তানি থেকে ৩ হাজার ৭১৯ কোটি ১৩ লাখ (৩৭.১৯ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। আর এই প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক। মোট আয়ের ৮১ দশমিক ৩২ শতাংশই এসেছে এই খাত থেকে। এছাড়া চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মাছ, ওষুধ, কৃষিপণ্যসহ প্রায় সব খাতেই রপ্তানি বেড়েছে। ব্যতিক্রম শুধু পাট খাত।
এই নয় মাসে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। কৃষি পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। হিমায়িত মাছে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি বেড়েছে ৫ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ শতাংশ। ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ৮ শতাংশ। সেই সঙ্গে প্রকৌশল পণ্য (১০ দশমিক ৮৮%), হ্যান্ডিক্রাফট (১০.৬২%), প্লাস্টিক দ্রব্য (২০.৬৬%), বাইসাইকেল (১৩.৩০%), আসবাবপত্র (৯.১%), সিরামিক পণ্যসহ (১৪%) আরও কিছু অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানিতেও ভালো সাফল্য এসেছে।
হতাশা দেখা দিয়েছে শুধু পাট ও পাটজাত পণ্যে: বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটের ‘সোনালি দিন’ ফিরে আসার হাতছানি দেখা দিয়েছিল ২০২০-২১ অর্থ বছরে। ওই বছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১১৬ কোটি ১৫ লাখ (১.১৬ বিলিয়ন) ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে রপ্তানি তালিকায় চামড়াকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল এই খাত। আগের অর্থ বছরের (২০১৯-২০) চেয়ে রপ্তানি বেড়েছিল ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। কিন্তু এর পর থেকেই কমছেই; নেমে এসেছে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের নিচে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ৬২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। গত অর্থ বছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ৬৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। এই হিসাবে জুলাই-মার্চ সময়ে গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে পাট খাতে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ৮৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার আয় হয়েছিল, যা ছিল আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ১৬ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আয়ের অঙ্ক ছিল ৯১ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগের অর্থ বছরের চেয়ে কমেছিল ১৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এই খাত থেকে আয় হয়েছিল ১১২ কোটি ৭৬ লাখ (১.১২ বিলিয়ন) ডলার। আগের অর্থ বছরের চেয়ে কমেছিল ২ দশমিক ৯১ শতাংশ।
বছরের পর বছর লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) ২৫টি পাটকল ২০২০ সালের ১ জুলাই বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। সে কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত কোনও পাটকল এখন উৎপাদনে নেই। সরকারিভাবে পাট ও পাটজাত পণ্য এখন আর রপ্তানি হয় না। অথচ বন্ধ হওয়ার আগে বিজেএমসির পাটকলগুলো থেকে এ খাতের রপ্তানির ২০ শতাংশের মতো আসত।
বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল বলেন বলেন, ‘২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে প্রায় সোয়া বিলিয়ন ডলার আয় হওয়ায় আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম- আমাদের সোনালি আঁশ পাটের সুদিন হয়তো ফিরে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সে আশায় গুড়েবালি। কেনোদিনই আর সোনালী আঁশের সোনালি দিন ফিরে আসবে না। কেননা, প্রতি বছরই এই খাত থেকে রপ্তানি আয় কমছে। চলতি অর্থ বছরেও সেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।’
বড় বিস্ময় পোশাক খাত: স্বাধীনতার পর পণ্য রপ্তানির তালিকায় তৈরি পোশাকের কোনো নাম-নিশানা ছিল না। সেই পোশাক খাত থেকেই এখন সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের প্রধান উৎস এখন রপ্তানি আয়। নানা বাধাবিপত্তি চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রতি বছরই তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় বেড়ে চলেছে। অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখে চলেছে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের নবম মাস মার্চে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪২৪ কোটি ৮৬ লাখ (৪.২৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক আগের মাস ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। আর গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। মার্চ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের মার্চের চেয়ে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের মার্চে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৩ দশমিক শূন্য ছয় বিলিয়ন ডলার।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থ বছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট ৩ হাজার ৭১৯ কোটি ১৩ লাখ (৩৭.১৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের পণ্য রপ্তানি থেকে মোট জুলাই-মার্চ সময়ে ৩ হাজার ৩৬১ কোটি ৭৪ লাখ (৩৩.৭২ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুলাই-মার্চ সময়ে মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ৮১ দশমিক ৩২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এই নয় মাসে ৩০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ে ছিল ২৭ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার।
হিসাব বলছে, জুলাই-মার্চ সময়ে গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এই নয় মাসে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ২২ শতাংশ। ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার; বেড়েছে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। মার্চ মাসে নিট পোশাক থেকে আয় হয়েছে ১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার; বেড়েছে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ।
অন্যান্য খাত: ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, মার্চ মাসে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য খাতের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ৯ কোটি ৪৫ লাখ ১০ হাজার ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের মার্চে আয়ের অঙ্ক ছিল ৭ কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) হিসাবে বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এই নয় মাসে ৮৫ কোটি ২০ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থ বছরের একই সময়ে রপ্তানি অঙ্ক ছিল ৭৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। মার্চে কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে ৬ কোটি ৪৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার আয় হয়েছে। গত বছরের মার্চে আয়ের অঙ্ক ছিল ৮ কোটি ৬৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার। কমেছে ২৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। তবে নয় মাসের হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন ধরনের কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে ৮০ কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার ডলার আয় হয়েছে। গত অর্থ বছরের একই সময়ে আয়ের অঙ্ক ছিল ৭৬ কোটি ৪ লাখ ডলার।
মার্চ মাসে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ; নয় মাসের হিসাবে বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। মার্চে হিমায়িত মাচ রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। নয় মাসের হিসাবে বেড়েছে ২৭ দশমিক ১০ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের অর্থ বছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ কম। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫
স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে দেশের মোট রপ্তানি আয়ে পাটের অবদান ছিল ৯৩ শতাংশ। বাকি ৩ শতাংশ ছিল অন্যান্য পণ্যের। সেই চিত্র এখন পুরোটাই বিপরীত। ক্রমেই কমে আসে পাটের প্রাধান্য। গত সোমবার প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুারোর (ইপিবি) প্রতিবেদন বলছে, গত মার্চ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট রপ্তানিতে পাটের অবদান মাত্র ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের পুরো সময়ে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন) ছিল ১ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটের ‘সোনালি দিন’ ফিরিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। বিভিন্ন সরকারের সময়ে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা হয়নি। পাঁচ বছর আগে পাটের সুদিন ফিরে আসার হাতছানি দেখা দিয়েছিল। পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে প্রথমবারের মতো রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। মোট রপ্তানিতে পাট খাতের অবদান ৩ শতাংশ ছাড়িয়েছিল।
কিন্তু এর পর ফের হোঁচট। কমতে থাকে রপ্তানির অঙ্ক। অথচ নানা বাধাবিপত্তির মধ্যেও রপ্তানি বাণিজ্যে সুবাতাস বইছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য রপ্তানি থেকে ৩ হাজার ৭১৯ কোটি ১৩ লাখ (৩৭.১৯ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। আর এই প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক। মোট আয়ের ৮১ দশমিক ৩২ শতাংশই এসেছে এই খাত থেকে। এছাড়া চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মাছ, ওষুধ, কৃষিপণ্যসহ প্রায় সব খাতেই রপ্তানি বেড়েছে। ব্যতিক্রম শুধু পাট খাত।
এই নয় মাসে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। কৃষি পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। হিমায়িত মাছে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি বেড়েছে ৫ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ শতাংশ। ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ৮ শতাংশ। সেই সঙ্গে প্রকৌশল পণ্য (১০ দশমিক ৮৮%), হ্যান্ডিক্রাফট (১০.৬২%), প্লাস্টিক দ্রব্য (২০.৬৬%), বাইসাইকেল (১৩.৩০%), আসবাবপত্র (৯.১%), সিরামিক পণ্যসহ (১৪%) আরও কিছু অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানিতেও ভালো সাফল্য এসেছে।
হতাশা দেখা দিয়েছে শুধু পাট ও পাটজাত পণ্যে: বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটের ‘সোনালি দিন’ ফিরে আসার হাতছানি দেখা দিয়েছিল ২০২০-২১ অর্থ বছরে। ওই বছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১১৬ কোটি ১৫ লাখ (১.১৬ বিলিয়ন) ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে রপ্তানি তালিকায় চামড়াকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল এই খাত। আগের অর্থ বছরের (২০১৯-২০) চেয়ে রপ্তানি বেড়েছিল ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। কিন্তু এর পর থেকেই কমছেই; নেমে এসেছে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের নিচে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ৬২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। গত অর্থ বছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ৬৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। এই হিসাবে জুলাই-মার্চ সময়ে গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে পাট খাতে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ৮৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার আয় হয়েছিল, যা ছিল আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ১৬ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আয়ের অঙ্ক ছিল ৯১ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগের অর্থ বছরের চেয়ে কমেছিল ১৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এই খাত থেকে আয় হয়েছিল ১১২ কোটি ৭৬ লাখ (১.১২ বিলিয়ন) ডলার। আগের অর্থ বছরের চেয়ে কমেছিল ২ দশমিক ৯১ শতাংশ।
বছরের পর বছর লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) ২৫টি পাটকল ২০২০ সালের ১ জুলাই বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। সে কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত কোনও পাটকল এখন উৎপাদনে নেই। সরকারিভাবে পাট ও পাটজাত পণ্য এখন আর রপ্তানি হয় না। অথচ বন্ধ হওয়ার আগে বিজেএমসির পাটকলগুলো থেকে এ খাতের রপ্তানির ২০ শতাংশের মতো আসত।
বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল বলেন বলেন, ‘২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে প্রায় সোয়া বিলিয়ন ডলার আয় হওয়ায় আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম- আমাদের সোনালি আঁশ পাটের সুদিন হয়তো ফিরে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সে আশায় গুড়েবালি। কেনোদিনই আর সোনালী আঁশের সোনালি দিন ফিরে আসবে না। কেননা, প্রতি বছরই এই খাত থেকে রপ্তানি আয় কমছে। চলতি অর্থ বছরেও সেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।’
বড় বিস্ময় পোশাক খাত: স্বাধীনতার পর পণ্য রপ্তানির তালিকায় তৈরি পোশাকের কোনো নাম-নিশানা ছিল না। সেই পোশাক খাত থেকেই এখন সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের প্রধান উৎস এখন রপ্তানি আয়। নানা বাধাবিপত্তি চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রতি বছরই তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় বেড়ে চলেছে। অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখে চলেছে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের নবম মাস মার্চে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪২৪ কোটি ৮৬ লাখ (৪.২৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক আগের মাস ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। আর গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। মার্চ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের মার্চের চেয়ে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের মার্চে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৩ দশমিক শূন্য ছয় বিলিয়ন ডলার।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থ বছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট ৩ হাজার ৭১৯ কোটি ১৩ লাখ (৩৭.১৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের পণ্য রপ্তানি থেকে মোট জুলাই-মার্চ সময়ে ৩ হাজার ৩৬১ কোটি ৭৪ লাখ (৩৩.৭২ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুলাই-মার্চ সময়ে মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ৮১ দশমিক ৩২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এই নয় মাসে ৩০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ে ছিল ২৭ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার।
হিসাব বলছে, জুলাই-মার্চ সময়ে গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এই নয় মাসে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ২২ শতাংশ। ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার; বেড়েছে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। মার্চ মাসে নিট পোশাক থেকে আয় হয়েছে ১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার; বেড়েছে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ।
অন্যান্য খাত: ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, মার্চ মাসে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য খাতের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ৯ কোটি ৪৫ লাখ ১০ হাজার ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের মার্চে আয়ের অঙ্ক ছিল ৭ কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) হিসাবে বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এই নয় মাসে ৮৫ কোটি ২০ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থ বছরের একই সময়ে রপ্তানি অঙ্ক ছিল ৭৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। মার্চে কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে ৬ কোটি ৪৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার আয় হয়েছে। গত বছরের মার্চে আয়ের অঙ্ক ছিল ৮ কোটি ৬৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার। কমেছে ২৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। তবে নয় মাসের হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন ধরনের কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে ৮০ কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার ডলার আয় হয়েছে। গত অর্থ বছরের একই সময়ে আয়ের অঙ্ক ছিল ৭৬ কোটি ৪ লাখ ডলার।
মার্চ মাসে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ; নয় মাসের হিসাবে বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। মার্চে হিমায়িত মাচ রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। নয় মাসের হিসাবে বেড়েছে ২৭ দশমিক ১০ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের অর্থ বছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ কম। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরেছে অন্তর্বর্তী সরকার।