রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বিনিয়োগ নিয়ে হতাশা ছিলই, তবে তা এখন পৌঁছে গেছে উদ্বেগজনক স্তরে। দেশে বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যা সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে। সামনে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা এখনও আঁচ করার অবস্থায় না থাকায় বিনিয়োগে খরা কাটবে বলে আশাবাদী হতে পারছেন না অর্থনীতিবিদরা। ফলে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ কাটছে না।
এর মধ্যেই দুঃসংবাদ দিয়েছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড)। সংস্থাটি বলেছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ কমেছে। গত বছর নিট বা প্রকৃত এফডিআই এসেছে মাত্র ১২৭ কোটি (১.২৭ বিলিয়ন) ডলার। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১৫ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ১৪৬ কোটি ৪০ লাখ (১.৪৬ বিলিয়ন) ডলার।
২০২২ সালে বাংলাদেশে নিট এফডিআই এসেছিল ১৫২ কোটি (১.৫২ বিলিয়ন) ডলার। ২০২১ সালে এই অঙ্ক ছিল ১৫৭ কোটি (১.৫৭ বিলিয়ন) ডলার। ২০২০ সালে এসেছিল ১৪৬ কোটি (১.৪৬ বিলিয়ন) ডলার।
গত বৃহস্পতিবার আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসার এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে আঙ্কটাড ‘ওয়ার্ল্ড ইনেভেস্টমন্ট রিপোর্ট-২০২৫’ নামে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাকি দেশের পরিসংখ্যান ওই প্রতিবেদনে রয়েছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সমপর্যায়ের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। গত বছর যে পরিমাণ এফডিআই এসেছে, তা এক মাসে রেমিটেন্সের অর্ধেক এবং রপ্তানি আয়ের চার ভাগের এক ভাগ।
একটি নির্দিষ্ট বছরের মোট বিদেশি বিনিয়োগ বলতে বাইরের উদ্যোক্তাদের থেকে নতুন পুঁজি, বিদ্যমান বিনিয়োগের মুনাফা থেকে পুনর্বিনিয়োগ এবং আন্তঃকোম্পানি ঋণের সমষ্টিকে বোঝানো হয়। একই সময়ের মধ্যে পুঁজি প্রত্যাহার, মূল কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া এবং আন্তঃকোম্পানি ঋণ পরিশোধ বাদ দিয়ে নিট বিনিয়োগের হিসাব করা হয়।
বাংলাদেশে ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ১ হাজার ৮২৯ কোটি ডলার, যা দেশের জিডিপির মাত্র ৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ক্ষেত্রে গড় হার ১৩ শতাংশ। ভারতের হার ১৪ শতাংশ। ভুটানের মতো দেশে এ হার ১৭ শতাংশ। গত বছর ভুটানে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৬ গুণ। বাংলাদেশে ২০২৪ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগে (গ্রিনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট) অর্থের ঘোষণার পরিমাণও কমেছে। ঘোষিত অর্থের পরিমাণ ১৭৫ কোটি (১.৭৫ বিলিয়ন) ডলার।
২০২৩ সালে যা ছিল ২৭০ কোটি (২.৭০ বিলিয়ন) ডলার। গত বছর কমে যাওয়ার হার ৩৫ শতাংশ। গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগের ঘোষণা ভবিষ্যতের প্রকৃত বিনিয়োগের ইঙ্গিত দেয়। এদিকে ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, এই ১০ মাসে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ কমেছে ২৯ শতাংশ।
বিদায়ী অর্থ বছরে জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৯১ কোটি ডলারের নিট এফডিআই পেয়েছে বাংলাদেশ। গত অর্থ বছরে (২০২৩-২৪) একই সময়ে এসেছিল ১২৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আর পুরো সময়ে (১২ মাস, ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন) এসেছিল ১৪৭ কোটি (১.৪৭ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ কম। এমনিতেই গত কয়েক বছর এফডিআইতে ছিল নিম্নমুখী প্রবণতা। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তা আরও নিম্নমুখী হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট এফডিআইর পরিমাণ ছিল ১৭১ কোটি (১.৭১ বিলিয়ন) ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে ১৬১ কোটি (১.৬১ বিলিয়ন) ডলারে নেমে আসে। করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১৭৭ কোটি ১০ লাখ (১.৭৭ বিলিয়ন) ডলারের নিট এফডিআই এসেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল ৩৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি।
তার আগের অর্থ বছরে (২০১৯-২০) নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ (১.২৭ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থ বছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে। ওই বছরে ২৬৩ কোটি (২.৬৩ বিলিয়ন) ডলারের নিট এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ।
এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তাদের মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের মোট এফডিআইর ৯০ শতাংশের বেশি প্রতিনিধিত্ব করে ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই-ফিকি)।
তবে সম্প্রতি আশিক চৌধুরী বিডার ফেসবুকে ‘আমাদের আমলনামা’ নামে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি বিডায় তার আট মাসের দায়িত্ব পালনকালে বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, গত অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশি বিনোয়োগের পরিমাণ আগের একই সময়ের তুলনায় প্রায় একই। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পরে এত তাড়াতাড়ি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ আগের জায়গায় ফিরে গেছে, যা আশার কথা।
আঙ্কটাড শুধু দেশওয়ারি বিনিয়োগ আসার তথ্য প্রকাশ করে না। কোনো দেশ থেকে বাইরে কী পরিমাণ বিনিয়োগ হয়, তার তথ্যও দেয়। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে বিদেশে মাত্র ৭০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে দেশের বাইরে সর্বাধিক ৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। ২০২৪ সাল শেষে বিদেশে বাংলাদেশিদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৩২ কোটি ২০ লাখ ডলার। আগের বছরের তুলনায় যা ৮ শতাংশ কম।
২০২৪ সালে প্রকৃত বৈশ্বিক বিনিয়োগ ১১ শতাংশ কমে দেড় ট্রিলিয়ন ডলারে নেমেছে। ২০২৫ সালেও পরিস্থিতি নেতিবাচক থাকতে পারে পূর্বাভাস দিয়েছে আঙ্কটাড। বাণিজ্য উত্তেজনা, নীতি অনিশ্চয়তা এবং ভূরাজনৈতিক বিভক্তি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মূল কারণ বলে মনে করছে সংস্থাটি। গত বছর দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ এসেছে ৩ হাজার ৪৫৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের মতোই। ভারতে এফডিআই কমেছে প্রায় ২ শতাংশ।
এদিকে দেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি খুবই নাজুক। গত ২৭ মে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদনের) আকার দাঁড়িয়েছে ৪৬২ বিলিয়ন ডলার। টাকার হিসাবে এই অঙ্ক ৫০ লাখ ৫২ লাখ ৭৫৩ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগ হয়েছে ১৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জিডিপির ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে দেশে। এই বিনিয়োগ গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। সেই সঙ্গে ১০ বছর পর জিডিপির সাপেক্ষে বিনিয়োগ ৩০ শতাংশের নিচে নেমেছে। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে জিডিপির ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছিল। এর পর ১০ বছরে এত কম বিনিয়োগ আর কখনই হয়নি দেশে। এমনকি কোভিড মহামারির সময়েও এর চেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে। জাতীয় বিনিয়োগ জিডিপির ৩০ থেকে সাড়ে ৩২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে জিডিপির ৩২ দশমিক ২১ শতাংশ অর্থ দেশে বিনিয়োগ হয়, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ।
মহামারির ধাক্কায় ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থ বছরে তা কমে যথাক্রমে ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ ও ৩১ দশমিক শূন্য দুই শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে তা বেড়ে ফের ৩২ শতাংশ ছাড়িয়ে ৩২ দশমিক শূন্য দুই শতাংশে দাঁড়ায়। মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয়।
তিন বছর পার হলেও সেই যুদ্ধের জের এখনও টানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জিডিপির ৩০ দশমিক ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছিল দেশে। তার আগের অর্থ বছরে (২০২২-২৩) এই হার ছিল ৩০ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
শনিবার, ২১ জুন ২০২৫
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বিনিয়োগ নিয়ে হতাশা ছিলই, তবে তা এখন পৌঁছে গেছে উদ্বেগজনক স্তরে। দেশে বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যা সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে। সামনে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা এখনও আঁচ করার অবস্থায় না থাকায় বিনিয়োগে খরা কাটবে বলে আশাবাদী হতে পারছেন না অর্থনীতিবিদরা। ফলে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ কাটছে না।
এর মধ্যেই দুঃসংবাদ দিয়েছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড)। সংস্থাটি বলেছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ কমেছে। গত বছর নিট বা প্রকৃত এফডিআই এসেছে মাত্র ১২৭ কোটি (১.২৭ বিলিয়ন) ডলার। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১৫ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ১৪৬ কোটি ৪০ লাখ (১.৪৬ বিলিয়ন) ডলার।
২০২২ সালে বাংলাদেশে নিট এফডিআই এসেছিল ১৫২ কোটি (১.৫২ বিলিয়ন) ডলার। ২০২১ সালে এই অঙ্ক ছিল ১৫৭ কোটি (১.৫৭ বিলিয়ন) ডলার। ২০২০ সালে এসেছিল ১৪৬ কোটি (১.৪৬ বিলিয়ন) ডলার।
গত বৃহস্পতিবার আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসার এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে আঙ্কটাড ‘ওয়ার্ল্ড ইনেভেস্টমন্ট রিপোর্ট-২০২৫’ নামে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাকি দেশের পরিসংখ্যান ওই প্রতিবেদনে রয়েছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সমপর্যায়ের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। গত বছর যে পরিমাণ এফডিআই এসেছে, তা এক মাসে রেমিটেন্সের অর্ধেক এবং রপ্তানি আয়ের চার ভাগের এক ভাগ।
একটি নির্দিষ্ট বছরের মোট বিদেশি বিনিয়োগ বলতে বাইরের উদ্যোক্তাদের থেকে নতুন পুঁজি, বিদ্যমান বিনিয়োগের মুনাফা থেকে পুনর্বিনিয়োগ এবং আন্তঃকোম্পানি ঋণের সমষ্টিকে বোঝানো হয়। একই সময়ের মধ্যে পুঁজি প্রত্যাহার, মূল কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া এবং আন্তঃকোম্পানি ঋণ পরিশোধ বাদ দিয়ে নিট বিনিয়োগের হিসাব করা হয়।
বাংলাদেশে ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ১ হাজার ৮২৯ কোটি ডলার, যা দেশের জিডিপির মাত্র ৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ক্ষেত্রে গড় হার ১৩ শতাংশ। ভারতের হার ১৪ শতাংশ। ভুটানের মতো দেশে এ হার ১৭ শতাংশ। গত বছর ভুটানে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৬ গুণ। বাংলাদেশে ২০২৪ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগে (গ্রিনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট) অর্থের ঘোষণার পরিমাণও কমেছে। ঘোষিত অর্থের পরিমাণ ১৭৫ কোটি (১.৭৫ বিলিয়ন) ডলার।
২০২৩ সালে যা ছিল ২৭০ কোটি (২.৭০ বিলিয়ন) ডলার। গত বছর কমে যাওয়ার হার ৩৫ শতাংশ। গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগের ঘোষণা ভবিষ্যতের প্রকৃত বিনিয়োগের ইঙ্গিত দেয়। এদিকে ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, এই ১০ মাসে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ কমেছে ২৯ শতাংশ।
বিদায়ী অর্থ বছরে জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৯১ কোটি ডলারের নিট এফডিআই পেয়েছে বাংলাদেশ। গত অর্থ বছরে (২০২৩-২৪) একই সময়ে এসেছিল ১২৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আর পুরো সময়ে (১২ মাস, ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন) এসেছিল ১৪৭ কোটি (১.৪৭ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ কম। এমনিতেই গত কয়েক বছর এফডিআইতে ছিল নিম্নমুখী প্রবণতা। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তা আরও নিম্নমুখী হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট এফডিআইর পরিমাণ ছিল ১৭১ কোটি (১.৭১ বিলিয়ন) ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে ১৬১ কোটি (১.৬১ বিলিয়ন) ডলারে নেমে আসে। করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১৭৭ কোটি ১০ লাখ (১.৭৭ বিলিয়ন) ডলারের নিট এফডিআই এসেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল ৩৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি।
তার আগের অর্থ বছরে (২০১৯-২০) নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ (১.২৭ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থ বছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে। ওই বছরে ২৬৩ কোটি (২.৬৩ বিলিয়ন) ডলারের নিট এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ।
এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তাদের মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের মোট এফডিআইর ৯০ শতাংশের বেশি প্রতিনিধিত্ব করে ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই-ফিকি)।
তবে সম্প্রতি আশিক চৌধুরী বিডার ফেসবুকে ‘আমাদের আমলনামা’ নামে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি বিডায় তার আট মাসের দায়িত্ব পালনকালে বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, গত অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশি বিনোয়োগের পরিমাণ আগের একই সময়ের তুলনায় প্রায় একই। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পরে এত তাড়াতাড়ি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ আগের জায়গায় ফিরে গেছে, যা আশার কথা।
আঙ্কটাড শুধু দেশওয়ারি বিনিয়োগ আসার তথ্য প্রকাশ করে না। কোনো দেশ থেকে বাইরে কী পরিমাণ বিনিয়োগ হয়, তার তথ্যও দেয়। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে বিদেশে মাত্র ৭০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে দেশের বাইরে সর্বাধিক ৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। ২০২৪ সাল শেষে বিদেশে বাংলাদেশিদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৩২ কোটি ২০ লাখ ডলার। আগের বছরের তুলনায় যা ৮ শতাংশ কম।
২০২৪ সালে প্রকৃত বৈশ্বিক বিনিয়োগ ১১ শতাংশ কমে দেড় ট্রিলিয়ন ডলারে নেমেছে। ২০২৫ সালেও পরিস্থিতি নেতিবাচক থাকতে পারে পূর্বাভাস দিয়েছে আঙ্কটাড। বাণিজ্য উত্তেজনা, নীতি অনিশ্চয়তা এবং ভূরাজনৈতিক বিভক্তি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মূল কারণ বলে মনে করছে সংস্থাটি। গত বছর দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ এসেছে ৩ হাজার ৪৫৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের মতোই। ভারতে এফডিআই কমেছে প্রায় ২ শতাংশ।
এদিকে দেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি খুবই নাজুক। গত ২৭ মে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদনের) আকার দাঁড়িয়েছে ৪৬২ বিলিয়ন ডলার। টাকার হিসাবে এই অঙ্ক ৫০ লাখ ৫২ লাখ ৭৫৩ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগ হয়েছে ১৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জিডিপির ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে দেশে। এই বিনিয়োগ গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। সেই সঙ্গে ১০ বছর পর জিডিপির সাপেক্ষে বিনিয়োগ ৩০ শতাংশের নিচে নেমেছে। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে জিডিপির ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছিল। এর পর ১০ বছরে এত কম বিনিয়োগ আর কখনই হয়নি দেশে। এমনকি কোভিড মহামারির সময়েও এর চেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে। জাতীয় বিনিয়োগ জিডিপির ৩০ থেকে সাড়ে ৩২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে জিডিপির ৩২ দশমিক ২১ শতাংশ অর্থ দেশে বিনিয়োগ হয়, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ।
মহামারির ধাক্কায় ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থ বছরে তা কমে যথাক্রমে ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ ও ৩১ দশমিক শূন্য দুই শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে তা বেড়ে ফের ৩২ শতাংশ ছাড়িয়ে ৩২ দশমিক শূন্য দুই শতাংশে দাঁড়ায়। মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয়।
তিন বছর পার হলেও সেই যুদ্ধের জের এখনও টানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জিডিপির ৩০ দশমিক ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছিল দেশে। তার আগের অর্থ বছরে (২০২২-২৩) এই হার ছিল ৩০ দশমিক ৯৫ শতাংশ।