alt

অর্থ-বাণিজ্য

কমলো রপ্তানি আয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মূল্যস্ফীতির প্রভাব

রেজাউল করিম : রোববার, ০২ অক্টোবর ২০২২

দীর্ঘ ১৩ মাস পর রপ্তানি আয়ে হোঁচট খেলো বাংলাদেশ। গত মাসে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ ৩৯০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। আর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৭ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। খরচ কমাতে তারা পোশাক কেনা কমিয়ে খাদ্য কিনছেন বেশি। তাই বাংলাদেশের রপ্তানিও কমেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান আশঙ্কা করেছিল, আগামী বছর বড় মন্দায় পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব। এর প্রধান কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির আশঙ্কা করেছিল। তবে সেটি যে এই মুহূর্তে ধেয়ে আসবে তা ধারণা করেনি তারা। তবে তাই হয়েছে।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আয় হয়েছিল ৪ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। দীর্ঘদিন পর পণ্য রপ্তানি কমলো বাংলাদেশের। এই নেতিবাচক ধারা কতদূর পর্যন্ত যাবে তা বলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ আয় আসে তৈরি পোশাক থেকে। এ বিষয়ে দেশের পোশাক রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। তাই তারা খরচ কমানোর জন্য পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের খাদ্যের পেছনেই অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে। আর সে কারণেই রপ্তানি আয় কমছে।

গত মাসে কমলেও চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) হিসাবে এখনও প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রোববার (২ অক্টোবর) প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ১২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করছেন, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি দশমিক ৬২ শতাংশ।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আগের বছরের জুলাইয়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ৬ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। এরপর থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে রপ্তানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে এসে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

রপ্তানির সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে এবার ভাটা পড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে ১৫৪ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এই অঙ্ক গত ৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ (প্রায় ১.৫৪ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। প্রবাসী আয়ের এ অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ কোটি ৭২ লাখ ডলার বা ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম।

তৈরি পোশাকের কারণে মোট রপ্তানি কমেছে

ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি কমার কারণেই মোট রপ্তানি কমেছে। গত মাসে ৩১৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। গত মাসে ওভেন ও নিট উভয় ধরনের পোশাক রপ্তানিই হ্রাস পেয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানিতে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশের বেশি, পাট ও পাটজাত দ্রব্যে ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ, প্লাস্টিক পণ্যে ৫৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও চামড়াজাত পণ্যে ২০ দশমিক ৮৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

অন্যদিকে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম আয় হয়েছে একাধিক পণ্যে। কৃষিপণ্যে ১৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ, কেমিক্যাল পণ্যে ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ ও কাঁচজাত পণ্যে ৫২ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম আয় হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিই প্রধান কারণ

কয়েক মাস ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধির পর কেন রপ্তানি কমলো এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিকে দায়ী করেন। পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের এখন খাদ্যের পেছনেই অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে। সে কারণেই আমাদের রপ্তানি আয় কমেছে।’

এদিকে পোশাক রপ্তানি কমবে সেটা আগেই আশঙ্কা করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ পরিচালক ও মুখপাত্র মহিউদ্দিন রুবেল। তিনি বলেন, ‘সেপ্টেম্বর থেকে যে প্রবৃদ্ধিতে মন্দা হবে, সে বিষয়ে ইতোমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিজিএমইএ। কোভিড-পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী খুচরা বাজার বিভিন্ন সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে কনটেইনারের অপ্রতুলতা এবং সাপ্লাই চেইন সংকট, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং পরবর্তীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে পূর্বাভাস অনুযায়ী মন্দার আবির্ভাব যার কারণে খুচরা বিক্রয়ে ধস নেমেছে, ক্রেতাদের পোশাকের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে প্রভৃতি সংকটে শিল্প বিপর্যস্ত। এই মন্দা কবে নাগাদ শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না।’

বড় বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থনীতিবিদের নিয়ে মতামত জরিপ করেছে। সেখানে ৭৩ শতাংশ অর্থনীতিবিদ মত দিয়েছেন, ২০২৩ সালে মন্দা হতে পারে। তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ মন্দার আশঙ্কা করেছেন। বাকি ৯ শতাংশ শক্তিশালী মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আবার প্রবৃদ্ধি কমার পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতিও বৈশ্বিক সংকটে রূপ নিচ্ছে। এছাড়া মজুরি হ্রাস, দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা করেছেন জরিপে অংশ নেয়া অর্থনীতিবিদরা।

সম্প্রতি ডব্লিউইএফের ওয়েবসাইটে ‘ইকোনমিস্টস আউটলুক’ নামে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তরদাতা অর্থনীতিবিদদের প্রতি ১০ জনের ৯ জনই বলেছেন ইউরোপের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দুর্বল বা খুব দুর্বল হবে। আর ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন চীনের প্রবৃদ্ধিও দুর্বল বা খুব দুর্বল হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূলত তিনটি কারণে বিভিন্ন দেশের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। প্রথমত, ইউক্রেন যুদ্ধ, দ্বিতীয়ত, বিশ্বের দেশে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং তৃতীয়ত, বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখে পড়া জ্বালানি সরবরাহ।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২২ সালের শেষের দিকে মন্দা হবে এবং জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেহেতু বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার ইউরোপের ওপর অতি নির্ভরশীল, তাই ইউরোপে মন্দা দেখা দিলে দেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই মাসে রপ্তানি কমার কারণও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব।’

ছবি

বিআইসিএমের উদ্যোগে হবে পুঁজিবাজার সম্মেলন

ছবি

যমুনা ব্যাংক ও ডেল্টা লাইফের মধ্যে চুক্তি

ছবি

সোনার দাম আরও কমলো

ছবি

ডিএমডি হিসেবে পদোন্নতি পেলেন মোঃ নুরুল ইসলাম মজুমদার

ছবি

রিজার্ভ কমায় উদ্বেগ ও আতঙ্ক বাড়ছে

ছবি

তড়িঘড়ি ব্যাংক একীভূতকরণ খেলাপিদের দায়মুক্তির নতুন মুখোশ: টিআইবি

ছবি

হঠাৎ ঝলকের পর আবার পতন, বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ

ছবি

শেয়ারবাজারে টানা দরপতনের প্রতিবাদে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ

ছবি

পদত্যাগ করেছেন পদ্মা ব্যাংকের এমডি তারেক রিয়াজ

ঈদের পর শেয়ারবাজার কিছুটা ভালো হতে শুরু করেছে

ছবি

দিনাজপুরে বাঁশ ফুলের চাল তৈরি

ছবি

অভিনেতা ওয়ালিউল হক রুমি মারা গেছেন

ছবি

বিআইপিডি’র অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করছে : এফএফআইএল

ছবি

চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সরকার বদ্ধপরিকর

ছবি

রাজধানীতে ঈদের পরও চড়া সবজির বাজার

ছবি

সয়াবিন তেলের লিটার প্রতি দাম বাড়ল ৪ টাকা

ছবি

সূচকের পতনে পুঁজিবাজারে চলছে লেনদেন

ছবি

ব্যাংক এশিয়া কিনবে পাকিস্তানি ব্যাংক আলফালাহর বাংলাদেশ অংশ

ছবি

এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫.৭%: আইএমএফ

ছবি

একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় থাকা ব্যাংক চাইলে সরে যেতে পারবে, তবে শর্তসাপেক্ষে : কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ছবি

পণ্যের দাম ঠিক রাখতে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে : প্রতিমন্ত্রী

ছবি

একীভূত ব্যাংক : পাঁচটির বাইরে আপাতত আর না

ছবি

ঈদে মানুষের মাঝে স্বস্তি দেখেছি : বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী

ছবি

বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বিশ্ব ব্যাংকের চেয়ে বেশি দেখছে এডিবি

ছবি

মার্চে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯.৮১ শতাংশ

ছবি

ঈদের আগে পাঁচ দিনে দেশে এলো ৪৬ কোটি ডলার

ছবি

শিল্পাঞ্চলের বাইরের কারখানায় গ্যাস-বিদ্যুৎ আর নয়, পাবেনা ঋণও

এবার ঈদে পর্যটন খাত চাঙ্গা হওয়ার আশা

ছবি

জাতীয় লজিস্টিক নীতির খসড়ার অনুমোদন

সোনালীতে একীভূত হচ্ছে বিডিবিএল

ছবি

সোনার দাম আবার বাড়লো, ভরি ১ লাখ ১৭ হাজার ৫৭৩ টাকা

ছবি

সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বেসিক ব্যাংক

ছবি

বিজিএমইএর দায়িত্ব নিলেন এস এম মান্নান কচি

ছবি

বাজার মূলধন কিছুটা বাড়লো, তবু লাখ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি

ছবি

নতুন বিদেশী ঋণ নিয়ে পুরনো ঋণ শোধ করছে সরকার : সিপিডি

ছবি

ব্যাংক একীভুতকরনে নীতিমালা জারি

tab

অর্থ-বাণিজ্য

কমলো রপ্তানি আয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মূল্যস্ফীতির প্রভাব

রেজাউল করিম

রোববার, ০২ অক্টোবর ২০২২

দীর্ঘ ১৩ মাস পর রপ্তানি আয়ে হোঁচট খেলো বাংলাদেশ। গত মাসে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ ৩৯০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। আর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৭ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। খরচ কমাতে তারা পোশাক কেনা কমিয়ে খাদ্য কিনছেন বেশি। তাই বাংলাদেশের রপ্তানিও কমেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান আশঙ্কা করেছিল, আগামী বছর বড় মন্দায় পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব। এর প্রধান কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির আশঙ্কা করেছিল। তবে সেটি যে এই মুহূর্তে ধেয়ে আসবে তা ধারণা করেনি তারা। তবে তাই হয়েছে।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আয় হয়েছিল ৪ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। দীর্ঘদিন পর পণ্য রপ্তানি কমলো বাংলাদেশের। এই নেতিবাচক ধারা কতদূর পর্যন্ত যাবে তা বলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ আয় আসে তৈরি পোশাক থেকে। এ বিষয়ে দেশের পোশাক রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। তাই তারা খরচ কমানোর জন্য পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের খাদ্যের পেছনেই অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে। আর সে কারণেই রপ্তানি আয় কমছে।

গত মাসে কমলেও চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) হিসাবে এখনও প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রোববার (২ অক্টোবর) প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ১২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করছেন, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি দশমিক ৬২ শতাংশ।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আগের বছরের জুলাইয়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ৬ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। এরপর থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে রপ্তানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে এসে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

রপ্তানির সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে এবার ভাটা পড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে ১৫৪ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এই অঙ্ক গত ৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ (প্রায় ১.৫৪ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। প্রবাসী আয়ের এ অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ কোটি ৭২ লাখ ডলার বা ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম।

তৈরি পোশাকের কারণে মোট রপ্তানি কমেছে

ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি কমার কারণেই মোট রপ্তানি কমেছে। গত মাসে ৩১৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। গত মাসে ওভেন ও নিট উভয় ধরনের পোশাক রপ্তানিই হ্রাস পেয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানিতে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশের বেশি, পাট ও পাটজাত দ্রব্যে ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ, প্লাস্টিক পণ্যে ৫৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও চামড়াজাত পণ্যে ২০ দশমিক ৮৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

অন্যদিকে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম আয় হয়েছে একাধিক পণ্যে। কৃষিপণ্যে ১৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ, কেমিক্যাল পণ্যে ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ ও কাঁচজাত পণ্যে ৫২ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম আয় হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিই প্রধান কারণ

কয়েক মাস ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধির পর কেন রপ্তানি কমলো এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিকে দায়ী করেন। পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের এখন খাদ্যের পেছনেই অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে। সে কারণেই আমাদের রপ্তানি আয় কমেছে।’

এদিকে পোশাক রপ্তানি কমবে সেটা আগেই আশঙ্কা করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ পরিচালক ও মুখপাত্র মহিউদ্দিন রুবেল। তিনি বলেন, ‘সেপ্টেম্বর থেকে যে প্রবৃদ্ধিতে মন্দা হবে, সে বিষয়ে ইতোমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিজিএমইএ। কোভিড-পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী খুচরা বাজার বিভিন্ন সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে কনটেইনারের অপ্রতুলতা এবং সাপ্লাই চেইন সংকট, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং পরবর্তীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে পূর্বাভাস অনুযায়ী মন্দার আবির্ভাব যার কারণে খুচরা বিক্রয়ে ধস নেমেছে, ক্রেতাদের পোশাকের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে প্রভৃতি সংকটে শিল্প বিপর্যস্ত। এই মন্দা কবে নাগাদ শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না।’

বড় বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থনীতিবিদের নিয়ে মতামত জরিপ করেছে। সেখানে ৭৩ শতাংশ অর্থনীতিবিদ মত দিয়েছেন, ২০২৩ সালে মন্দা হতে পারে। তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ মন্দার আশঙ্কা করেছেন। বাকি ৯ শতাংশ শক্তিশালী মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আবার প্রবৃদ্ধি কমার পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতিও বৈশ্বিক সংকটে রূপ নিচ্ছে। এছাড়া মজুরি হ্রাস, দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা করেছেন জরিপে অংশ নেয়া অর্থনীতিবিদরা।

সম্প্রতি ডব্লিউইএফের ওয়েবসাইটে ‘ইকোনমিস্টস আউটলুক’ নামে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তরদাতা অর্থনীতিবিদদের প্রতি ১০ জনের ৯ জনই বলেছেন ইউরোপের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দুর্বল বা খুব দুর্বল হবে। আর ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন চীনের প্রবৃদ্ধিও দুর্বল বা খুব দুর্বল হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূলত তিনটি কারণে বিভিন্ন দেশের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। প্রথমত, ইউক্রেন যুদ্ধ, দ্বিতীয়ত, বিশ্বের দেশে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং তৃতীয়ত, বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখে পড়া জ্বালানি সরবরাহ।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২২ সালের শেষের দিকে মন্দা হবে এবং জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেহেতু বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার ইউরোপের ওপর অতি নির্ভরশীল, তাই ইউরোপে মন্দা দেখা দিলে দেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই মাসে রপ্তানি কমার কারণও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব।’

back to top