ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিতব্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের অংশগ্রহণের হার উদ্বেগজনকভাবে কম। বিশেষ করে হল সংসদ নির্বাচনে ১০টি ছাত্রী হলের মধ্যে পাঁচটিতে সব পদে প্রার্থী পাওয়া যায়নি, যেখানে প্রতিটি হল সংসদে ১৫টি করে পদ রয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাইবার হয়রানি, চরিত্রহনন, অশালীন মন্তব্য এবং বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন নারী প্রার্থীরা।
হল সংসদ নির্বাচনে ১০টি ছাত্রী হলের মধ্যে পাঁচটিতে সব পদে প্রার্থী পাওয়া যায়নি, যেখানে প্রতিটি হল সংসদে ১৫টি করে পদ রয়েছে
মোট ৭৪০টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে, যার
মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদের
জন্য ২৭৬টি
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও এই নিম্নমুখী অংশগ্রহণের পেছনে সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সাইবার প্রতিবন্ধকতাকে দায়ী করছে শিক্ষার্থীরা। নির্বাচনী কমিশনারের কাছে অভিযোগ জমা দেয়া, যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন এবং সচেতনতা কর্মসূচির মতো পদক্ষেপ নেয়া হলেও, এই সমস্যা নিরসনে আরও প্রশাসনিক সক্রিয়তা এবং সমাজের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা উঠে এসেছে সচেতন মহল থেকে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা সত্ত্বেও জাকসু নির্বাচনে তাদের প্রতিনিধিত্বের অভাব লক্ষণীয়। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, মোট ৭৪০টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদের জন্য ২৭৬টি এবং হল সংসদের জন্য বাকি। তবে নারী প্রার্থীদের সংখ্যা অত্যন্ত কম, বিশেষ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে গঠিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ থেকে মনোনীত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ১৪ জুলাই, ১৫ জুলাই সন্ধ্যা ও রাত এবং ১৭ জুলাই প্রতিটি মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল সাহসী ও অনন্য। ছাত্রলীগ হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা করলেও বোনদের দৃঢ়তায় তা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তাদের সেই অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। সাইবার বুলিং ও শেইমিং আজ নারীদের অংশগ্রহণের বড় অন্তরায়। প্রচারে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়ে কটূক্তি ও অশালীন মন্তব্য ছড়ানো হয়, ফলে তারা ট্রমার মধ্যে পড়েন।’ তিনি নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন।
একই প্যানেলের আরেক প্রার্থী আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা, সাইবার হয়রানির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘নারীদের নেতৃত্বে না আসার প্রধান কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। কোনো নারী যখন নেতৃত্বে আসতে চায় তখন সাইবার বুলিং, ট্যাগিং, ব্যাশিংয়ের শিকার হয়। চরিত্র নিয়ে কথা তোলা হয়। ইসলামি মতাদর্শের হলে ‘ছাত্রীসংস্থার’ বলা হয় আর মুক্তমনা হলে ‘শাহাবাগী গোলস কর’ বলা হয়। মুক্তমনারা হয়তো কিছুটা ওভারকাম করতে পারেন। কিন্তু ধার্মিক কিংবা সাদাসিধে পরিবারের একটি মেয়ে এসব টপকে আসতে পারেন না। আমি শিবির সমর্থিত প্যানেলে জোটবদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই বিভিন্ন পেইজ, বট আইডি, বিভিন্ন ব্যক্তি আমাকে নিয়ে নোংরামো করেছে। এমনকি একটি প্যানেলের একজন নেত্রী আমার যোগ্যতায় প্রশ্ন তুলেছেন।’ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর উদ্দেশে বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০% নারী শিক্ষার্থী থাকার পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনগুলো মেয়েদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য, তাদের সচেতন করার জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। অন্তত আমার নজরে পড়েনি।’
‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থী ফারিয়া জামান নিকি বলেন, ‘আমি জাকসু কেন্দ্রীয় নির্বাচন করবো অনেক ভয়ে ভয়ে পরিবারকে জানাই। আমার বাবা এটা জানার পর প্রচ- টেনশনে পড়ে যায় আর আমাকে নমিনেশন না ওঠানোর কথা বলে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্যাপিটালের কারণে আমি সমাজের অনেক মানুষের থেকেই বেশি প্রিভিলেজপ্রাপ্ত। আমার শিক্ষিত পরিবারই যদি এমন করে যে, মেয়েটা কৃষকের সন্তান কিংবা যার বাবা মাদ্রাসার সামান্য বেতনভুক্ত কর্মচারী তার মেয়ে রাজনীতিতে এলে কেমন আচরণ করবে তা খালি কল্পনাই করতে পারি। আপনি কোন দল করছেন এটা মুখ্য নয়, মুখ্য হলো আপনি নারী। আপনি আপনার স্বাচ্ছন্দ্যের পোশাক পরেন কিংবা ধর্মীয় পোশাক পরেন- কোনো কিছুতেই আপনি রক্ষা পাবেন না। কারণ আসলে আপনি যে পোশাকই পরেন না কেন, যে আদর্শেরই রাজনীতিই করেন না কেন- এই যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, এটা নিয়েই তাদের সমস্যা।
তিনি আরও বলেন, “বিএনপির রুমিন ফারহানাকে স্লাটশেইম বডি শেম করা একপ্রকার নরমালই হয়ে গেছে। বাগছাসের তাসনিম যারাকে নিয়ে যে পরিমাণ নোংরামি হয়েছে যা এখন তাসনিম জারার যে কোনো ভিডিও এলে আমি সরিয়ে দিই। সবশেষে ছাত্রীসংস্থার মেয়েদের নিয়ে ‘কুৎসিত’, ‘দেখতে বাজে’ এমন মিম অহরহ দেখা যায়। আর বামপন্থি নারীদের নিয়ে কত কিসিমের কত ধরনের যে নোংরা ভিডিও হয় তা কি আর বলার প্রয়োজন আছে?”
ফারিয়া জামান নিকি নারীদের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাসের মেয়েরা একটা অদ্ভুত শক্তি। ওইদিন আমরা যে সাহস দেখিয়েছি তা সারা বাংলাদেশকে সাহস জুগিয়েছিল। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাকসু হতে যাচ্ছে। এই যে জাকসু হতে যাচ্ছে এটা আমাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফল। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ করবো ইতিহাসের অংশ হওয়ার কথা চিন্তা করে হলেও হল সংসদের জন্য অংশগ্রহণ করেন। মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছেন, লড়াইয়ের প্রবণতাটা আপনার জন্মগত।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী জান্নাতুল ফিরদাউস আনজুম বলেন, ‘৯৯-এর ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসের সব আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা অগ্রগামী। কেবল অংশগ্রহণ নয়, নারীরা এই ক্যাম্পাসে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে নারীরা কখনোই তার যোগ্য মূল্যায়ন পাননি। মূল্যায়ন না পাওয়ায় আন্দোলনের এই নেত্রীরা কখনও রাজনীতিতে যুক্ত হন না। তাদের তখন রাজনৈতিক ‘শোকেজিং’-এ ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়। ফলে একটি বড় অংশের যোগ্য নারীরা এ ধরনের রাজনীতিতে আসতে হীনম্মন্যতায় ভোগেনে। একপর্যায়ে অনীহা-অনাস্থায় তারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন হয়ে পড়েন।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘ডাকসু, জাকসুতে ভিপি, জিএস, এজিএসের মতো অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ পদেও যদি অধিক পরিমাণে যোগ্য নারী স্বতন্ত্র পদপ্রার্থীরা সাহস করে এগিয়ে আসে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর ভরসা করে কেবল তখনই এর সমাধান হতে পারে। কারণ এই ডাকসু, জাকসুই হতে পারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শেষ ভরসা।’
আইবিএ-এর ৫০তম আবর্তনের শিক্ষার্থী ফারহানা ফারিনা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক পদে ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ থেকে, তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের এত শত ত্যাগ ও তিতীক্ষার পর একটা ছাত্রসংসদ নির্বাচন আদায় করেনি, কিন্তু সেইখানে জনপ্রিয় কিছু রাজনৈতিক ছাত্রীদের ছাড়া খুবই হাতেগোনা কিছু স্বতন্ত্র মেয়ে প্রার্থী দেখতে পাই। হল সংসদগুলোর অবস্থা তো আরও খারাপ। প্যানেল বাদ দেন, সেইখানে তো অনেক পদে কেউ এখনও মনোনয়নই জমা দেননি! কিন্তু এখন এসে সেই নারীদের থেকেই যদি এমন একটা শূন্যস্থান আমরা দেখি তখন আসলে ওই ৩৬ দিনের সিলসিলাটা বিদ্যমান থাকে না। আপনারা দেশের সবচাইতে ক্রান্তিকালে দেশের হাল ধরেছিলেন, সেই সময়টা এখনও শেষ হয়নি।’
তিনি নারীদের অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তাই দল, মত নির্বিশেষে, সব প্যানেল ও প্যানেলের বাইরে স্বতন্ত্র হিসেবে হলেও নারী শিক্ষার্থীদের কাছে অনুরোধ, নিজেদের হারিয়ে যেতে দিয়েন না। ইতিহাসে এই সুযোগ বহু বছর পর এসেছে, আপনার, আমার মতো মেয়েদের হাত ধরেই এসেছে। শুধু আপনার ব্যক্তিগত জায়গা থেকে না বরং ইতিহাসের পাতা থেকে মেয়েদের অবদানকে মুছে যেতে না দেয়ার জন্য হলেও জাকসুর কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করেন।
#যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন
সাইবার হয়রানির মোকাবিলায় পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা) যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করেছে। সেল সম্পাদক ফারহানা বিনতে জিগার ফারিনা জানান, ‘নির্বাচন চলাকালে কোনো নারী বা পুরুষ শিক্ষার্থী বা প্রার্থী যদি কোনো ধরনের যৌন হয়রানি, মৌখিক বা শারীরিক নিপীড়ন, সাইবার বুলিং অথবা অন্য যে কোনো ধরনের অন্যায় আচরণের শিকার হন, তাহলে আমাদের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের পক্ষ থেকে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে। নিপীড়নের শিকার ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের সেল দ্রুত তদন্ত করে দেখবে এবং সত্যতা প্রমাণিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।’ অভিযোগের জন্য ইমেইল (farhanabintejigar@gmail.com) এবং মোবাইল নম্বর (০১৭২০১৫৩৩৪৬) দেয়া হয়েছে।
এছাড়া, রোববার,(২৪ আগস্ট ২০২৫) সিনেট ভবনে সচেতনতা ও আহ্বান কর্মসূচিতে সাধারণ শিক্ষার্থী, প্রার্থী ও ছাত্র সংগঠনগুলোকে জাকসু নির্বাচন কমিশনারের কাছে অভিযোগ জমা দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই কর্মসূচির উদ্যোক্তা সুকান্ত বর্মন বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেইজের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও জাকসু প্রার্থীদের ওপর হেনস্তা এবং বিভ্রান্তিকর পোস্টের ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পেইজের অ্যাডমিন পরিচয় প্রকাশ না থাকায় এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করা কঠিন। শিক্ষার্থীদের মানসিক নিরাপত্তা রক্ষা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও ব্র্যান্ডের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা, সব প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বজায় রাখা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।’
জাকসু নির্বাচন ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে এবং এতে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রার্থীদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ছাত্রশিবির প্যানেলে নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নারী প্রার্থীদের সাইবার হয়রানি রোধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং নির্বাচনী কমিশনের ভূমিকা আরও সক্রিয় হওয়ার দাবি তুলেছে শিক্ষার্থীরা, যাতে একটি নিরাপদ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
রোববার, ২৪ আগস্ট ২০২৫
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিতব্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের অংশগ্রহণের হার উদ্বেগজনকভাবে কম। বিশেষ করে হল সংসদ নির্বাচনে ১০টি ছাত্রী হলের মধ্যে পাঁচটিতে সব পদে প্রার্থী পাওয়া যায়নি, যেখানে প্রতিটি হল সংসদে ১৫টি করে পদ রয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাইবার হয়রানি, চরিত্রহনন, অশালীন মন্তব্য এবং বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন নারী প্রার্থীরা।
হল সংসদ নির্বাচনে ১০টি ছাত্রী হলের মধ্যে পাঁচটিতে সব পদে প্রার্থী পাওয়া যায়নি, যেখানে প্রতিটি হল সংসদে ১৫টি করে পদ রয়েছে
মোট ৭৪০টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে, যার
মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদের
জন্য ২৭৬টি
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও এই নিম্নমুখী অংশগ্রহণের পেছনে সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সাইবার প্রতিবন্ধকতাকে দায়ী করছে শিক্ষার্থীরা। নির্বাচনী কমিশনারের কাছে অভিযোগ জমা দেয়া, যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন এবং সচেতনতা কর্মসূচির মতো পদক্ষেপ নেয়া হলেও, এই সমস্যা নিরসনে আরও প্রশাসনিক সক্রিয়তা এবং সমাজের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা উঠে এসেছে সচেতন মহল থেকে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা সত্ত্বেও জাকসু নির্বাচনে তাদের প্রতিনিধিত্বের অভাব লক্ষণীয়। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, মোট ৭৪০টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদের জন্য ২৭৬টি এবং হল সংসদের জন্য বাকি। তবে নারী প্রার্থীদের সংখ্যা অত্যন্ত কম, বিশেষ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে গঠিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ থেকে মনোনীত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ১৪ জুলাই, ১৫ জুলাই সন্ধ্যা ও রাত এবং ১৭ জুলাই প্রতিটি মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল সাহসী ও অনন্য। ছাত্রলীগ হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা করলেও বোনদের দৃঢ়তায় তা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তাদের সেই অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। সাইবার বুলিং ও শেইমিং আজ নারীদের অংশগ্রহণের বড় অন্তরায়। প্রচারে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়ে কটূক্তি ও অশালীন মন্তব্য ছড়ানো হয়, ফলে তারা ট্রমার মধ্যে পড়েন।’ তিনি নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন।
একই প্যানেলের আরেক প্রার্থী আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা, সাইবার হয়রানির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘নারীদের নেতৃত্বে না আসার প্রধান কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। কোনো নারী যখন নেতৃত্বে আসতে চায় তখন সাইবার বুলিং, ট্যাগিং, ব্যাশিংয়ের শিকার হয়। চরিত্র নিয়ে কথা তোলা হয়। ইসলামি মতাদর্শের হলে ‘ছাত্রীসংস্থার’ বলা হয় আর মুক্তমনা হলে ‘শাহাবাগী গোলস কর’ বলা হয়। মুক্তমনারা হয়তো কিছুটা ওভারকাম করতে পারেন। কিন্তু ধার্মিক কিংবা সাদাসিধে পরিবারের একটি মেয়ে এসব টপকে আসতে পারেন না। আমি শিবির সমর্থিত প্যানেলে জোটবদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই বিভিন্ন পেইজ, বট আইডি, বিভিন্ন ব্যক্তি আমাকে নিয়ে নোংরামো করেছে। এমনকি একটি প্যানেলের একজন নেত্রী আমার যোগ্যতায় প্রশ্ন তুলেছেন।’ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর উদ্দেশে বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০% নারী শিক্ষার্থী থাকার পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনগুলো মেয়েদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য, তাদের সচেতন করার জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। অন্তত আমার নজরে পড়েনি।’
‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থী ফারিয়া জামান নিকি বলেন, ‘আমি জাকসু কেন্দ্রীয় নির্বাচন করবো অনেক ভয়ে ভয়ে পরিবারকে জানাই। আমার বাবা এটা জানার পর প্রচ- টেনশনে পড়ে যায় আর আমাকে নমিনেশন না ওঠানোর কথা বলে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্যাপিটালের কারণে আমি সমাজের অনেক মানুষের থেকেই বেশি প্রিভিলেজপ্রাপ্ত। আমার শিক্ষিত পরিবারই যদি এমন করে যে, মেয়েটা কৃষকের সন্তান কিংবা যার বাবা মাদ্রাসার সামান্য বেতনভুক্ত কর্মচারী তার মেয়ে রাজনীতিতে এলে কেমন আচরণ করবে তা খালি কল্পনাই করতে পারি। আপনি কোন দল করছেন এটা মুখ্য নয়, মুখ্য হলো আপনি নারী। আপনি আপনার স্বাচ্ছন্দ্যের পোশাক পরেন কিংবা ধর্মীয় পোশাক পরেন- কোনো কিছুতেই আপনি রক্ষা পাবেন না। কারণ আসলে আপনি যে পোশাকই পরেন না কেন, যে আদর্শেরই রাজনীতিই করেন না কেন- এই যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, এটা নিয়েই তাদের সমস্যা।
তিনি আরও বলেন, “বিএনপির রুমিন ফারহানাকে স্লাটশেইম বডি শেম করা একপ্রকার নরমালই হয়ে গেছে। বাগছাসের তাসনিম যারাকে নিয়ে যে পরিমাণ নোংরামি হয়েছে যা এখন তাসনিম জারার যে কোনো ভিডিও এলে আমি সরিয়ে দিই। সবশেষে ছাত্রীসংস্থার মেয়েদের নিয়ে ‘কুৎসিত’, ‘দেখতে বাজে’ এমন মিম অহরহ দেখা যায়। আর বামপন্থি নারীদের নিয়ে কত কিসিমের কত ধরনের যে নোংরা ভিডিও হয় তা কি আর বলার প্রয়োজন আছে?”
ফারিয়া জামান নিকি নারীদের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাসের মেয়েরা একটা অদ্ভুত শক্তি। ওইদিন আমরা যে সাহস দেখিয়েছি তা সারা বাংলাদেশকে সাহস জুগিয়েছিল। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাকসু হতে যাচ্ছে। এই যে জাকসু হতে যাচ্ছে এটা আমাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফল। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ করবো ইতিহাসের অংশ হওয়ার কথা চিন্তা করে হলেও হল সংসদের জন্য অংশগ্রহণ করেন। মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছেন, লড়াইয়ের প্রবণতাটা আপনার জন্মগত।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী জান্নাতুল ফিরদাউস আনজুম বলেন, ‘৯৯-এর ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসের সব আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা অগ্রগামী। কেবল অংশগ্রহণ নয়, নারীরা এই ক্যাম্পাসে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে নারীরা কখনোই তার যোগ্য মূল্যায়ন পাননি। মূল্যায়ন না পাওয়ায় আন্দোলনের এই নেত্রীরা কখনও রাজনীতিতে যুক্ত হন না। তাদের তখন রাজনৈতিক ‘শোকেজিং’-এ ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়। ফলে একটি বড় অংশের যোগ্য নারীরা এ ধরনের রাজনীতিতে আসতে হীনম্মন্যতায় ভোগেনে। একপর্যায়ে অনীহা-অনাস্থায় তারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন হয়ে পড়েন।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘ডাকসু, জাকসুতে ভিপি, জিএস, এজিএসের মতো অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ পদেও যদি অধিক পরিমাণে যোগ্য নারী স্বতন্ত্র পদপ্রার্থীরা সাহস করে এগিয়ে আসে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর ভরসা করে কেবল তখনই এর সমাধান হতে পারে। কারণ এই ডাকসু, জাকসুই হতে পারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শেষ ভরসা।’
আইবিএ-এর ৫০তম আবর্তনের শিক্ষার্থী ফারহানা ফারিনা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক পদে ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ থেকে, তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের এত শত ত্যাগ ও তিতীক্ষার পর একটা ছাত্রসংসদ নির্বাচন আদায় করেনি, কিন্তু সেইখানে জনপ্রিয় কিছু রাজনৈতিক ছাত্রীদের ছাড়া খুবই হাতেগোনা কিছু স্বতন্ত্র মেয়ে প্রার্থী দেখতে পাই। হল সংসদগুলোর অবস্থা তো আরও খারাপ। প্যানেল বাদ দেন, সেইখানে তো অনেক পদে কেউ এখনও মনোনয়নই জমা দেননি! কিন্তু এখন এসে সেই নারীদের থেকেই যদি এমন একটা শূন্যস্থান আমরা দেখি তখন আসলে ওই ৩৬ দিনের সিলসিলাটা বিদ্যমান থাকে না। আপনারা দেশের সবচাইতে ক্রান্তিকালে দেশের হাল ধরেছিলেন, সেই সময়টা এখনও শেষ হয়নি।’
তিনি নারীদের অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তাই দল, মত নির্বিশেষে, সব প্যানেল ও প্যানেলের বাইরে স্বতন্ত্র হিসেবে হলেও নারী শিক্ষার্থীদের কাছে অনুরোধ, নিজেদের হারিয়ে যেতে দিয়েন না। ইতিহাসে এই সুযোগ বহু বছর পর এসেছে, আপনার, আমার মতো মেয়েদের হাত ধরেই এসেছে। শুধু আপনার ব্যক্তিগত জায়গা থেকে না বরং ইতিহাসের পাতা থেকে মেয়েদের অবদানকে মুছে যেতে না দেয়ার জন্য হলেও জাকসুর কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করেন।
#যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন
সাইবার হয়রানির মোকাবিলায় পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা) যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করেছে। সেল সম্পাদক ফারহানা বিনতে জিগার ফারিনা জানান, ‘নির্বাচন চলাকালে কোনো নারী বা পুরুষ শিক্ষার্থী বা প্রার্থী যদি কোনো ধরনের যৌন হয়রানি, মৌখিক বা শারীরিক নিপীড়ন, সাইবার বুলিং অথবা অন্য যে কোনো ধরনের অন্যায় আচরণের শিকার হন, তাহলে আমাদের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের পক্ষ থেকে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে। নিপীড়নের শিকার ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের সেল দ্রুত তদন্ত করে দেখবে এবং সত্যতা প্রমাণিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।’ অভিযোগের জন্য ইমেইল (farhanabintejigar@gmail.com) এবং মোবাইল নম্বর (০১৭২০১৫৩৩৪৬) দেয়া হয়েছে।
এছাড়া, রোববার,(২৪ আগস্ট ২০২৫) সিনেট ভবনে সচেতনতা ও আহ্বান কর্মসূচিতে সাধারণ শিক্ষার্থী, প্রার্থী ও ছাত্র সংগঠনগুলোকে জাকসু নির্বাচন কমিশনারের কাছে অভিযোগ জমা দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই কর্মসূচির উদ্যোক্তা সুকান্ত বর্মন বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেইজের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও জাকসু প্রার্থীদের ওপর হেনস্তা এবং বিভ্রান্তিকর পোস্টের ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পেইজের অ্যাডমিন পরিচয় প্রকাশ না থাকায় এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করা কঠিন। শিক্ষার্থীদের মানসিক নিরাপত্তা রক্ষা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও ব্র্যান্ডের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা, সব প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বজায় রাখা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।’
জাকসু নির্বাচন ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে এবং এতে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রার্থীদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ছাত্রশিবির প্যানেলে নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নারী প্রার্থীদের সাইবার হয়রানি রোধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং নির্বাচনী কমিশনের ভূমিকা আরও সক্রিয় হওয়ার দাবি তুলেছে শিক্ষার্থীরা, যাতে একটি নিরাপদ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।