alt

নগর-মহানগর

রোলিং মিল বস্তিতে আগুন

পুড়েছে ৩ শতাধিক পরিবারের স্বপ্ন

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট : মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ ২০২৩

রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের কুনিপাড়ায় রোলিং মিলের পাশে বটতলা ধরে সরু রাস্তা দিয়ে হাজী শামসুদ্দিন লেনের দু’পাশে বাঁশ-কাঠের খুঁটিতে গড়ে তোলা হয়েছে টিনশেড একাধিক বাড়ি। ঘনবসতিপূর্ণ এসব বাড়িতে নিম্ন আয়ের মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। দু’দিন আগে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে থাকা পরিবারগুলো এখন খোলা আকাশের নিচে। কারণ গত সোমবার রাতে ভয়াবহ আগুনে বস্তির ৩ শতাধিক ঘর ছাই হয়েছে। সেইসঙ্গে ছাই হয়েছে পরিবারগুলোর বেঁচে থাকার সহায়-সম্বলও।

গত সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রোলিং মিল বস্তিতে আগুন লাগে। একটি টিনশেড বাড়ির গ্যাস সংযোগের লিকেজ থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা বস্তিবাসীদের। প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর আগুন যখন নিয়ন্ত্রণে আনা হয় তখন ৩ শতাধিক পরিবারের বেঁচে থাকার স্বপ্ন ছাই হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিটকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়। মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) সকালেও ভস্মীভূত টিন ও আসবাবপত্রের ছাই থেকে থেমে থেমে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও বের হচ্ছিল ধোঁয়া।

স্থানীয়রা বলছেন, রোলিং মিল বস্তি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বস্তিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বৈধ কি না তা নিশ্চিত নয় বসবাসকারীরা। প্রায়ই বস্তিতে গ্যাস সংযোগ থেকে ছোটখাটো আগুন লাগতো। তবে সোমবার রাতে যে আগুন লাগে সেটি আর ছোট পর্যায়ে ছিল না। মুহূর্তের মধ্যে ভস্মীভূত করেছে ৩ শতাধিক ঘর। চোখের সামনে বস্তিতে বসবাসকারীরা তাদের শেষ সম্বল আগুনে পুড়ে আঙ্গার হতে দেখেছে।

স্থানীয়রা জানান, ভবনের আদলে ছাদ করে লোহার পাটাতন আর টিন দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল বিশাল ২-৩তলা বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে কমপক্ষে ৫০-১০০টি ঘর। সরু রাস্তা, ঘিঞ্জি ঘর, অপরিকল্পিত গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইনের কারণে প্রতিটি বাড়ি আগ থেকেই ছিল মৃত্যুকূপ। মৃত্যুকূপ জেনেও ভাড়া কিছুটা কম হওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন স্বল্প আয়ের মানুষ। টিন দিয়ে ঘেরা ছোট ঘরগুলোতে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন সাজানো সংসার। সোমবার রাতে যখন আগুন লাগে তখন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ৬টি বাড়ির কমপক্ষে তিন শতাধিক ঘর। আগুনে পুড়ে ৩তলা দুটি বাড়ির এমন অবস্থা হয়েছে যে পোড়া টিন আর অঙ্গার হওয়া আসবাবপত্র না থাকলে বোঝাই যেত না সেখানে কোন বাড়ি ছিল।

তবে কারো কারো দাবি, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বাড়িগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সেখানে দেয়া হয়েছে তিতাস গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ওয়াসার বৈধ লাইন। গ্যাসের বৈধ লাইন হলেও প্রায় চুলার লিকেজ থেকে ছোট ছোট আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। যে টিনের ভবন থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেটির দোতলায় কিছুদিন আগেই গ্যাসের চুলায় আগুন লেগেছিল। যদিও সোমবার রাতে শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে দাবি করেন তারা।

বস্তিটিতে ২৫ বছর ধরে বসবাস করা মুদি দোকানদার ইয়ামিন রহমান বলেন, জায়গাটিতে এক সময় ঝিল থাকলেও ধীরে ধীরে এই ঘর-বাড়ি গড়ে ওঠে। এখানকার বেশিরভাগ জায়গার মালিক যার নামে এই লেনের নামকরণ করা হয়েছে, সেই প্রয়াত হাজী শামসুদ্দিনের সন্তানেরা। অনেকে তাদের কাছ থেকে জায়গা ভাড়া নিয়ে বা কিনে বাড়ি গড়েছেন। আগুন সম্পর্কে ইয়ামিন বলেন, সোমবার রাত ৮টার দিকে হাজী শামসুদ্দিনের মেজো ছেলে মৃত শরীফ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হালিমার ৩তলা ভবনের ২য় তলার ৩ নম্বর ঘর থেকে আগুন লাগে। এরপর মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর ফায়ার সার্ভিস আসলেও সরু রাস্তার কারণে তারা ভেতরে আসতে পারেনি। একটি ইউনিট কাজ শুরু করলেও কিছুক্ষণ পর জানায় পানি শেষ। এতে আগুন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে। হালিমার বাড়ির নিচতলায় থাকা সেলুনের নাপিত মো. আলী বলেন, হুট করেই আগুন আগুন চিৎকার শুনতে পান। তখন সবাই জীবন বাঁচাতে দৌঁড়ে বেড়িয়ে যায়।

৪টি বাড়ির ২ শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে আক্কাস আলীর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে ছিলাম। এসে দেখি সব শেষ। তিনি বলেন, কোন বাড়িতেই অবৈধ কোন লাইন নেই। সবকিছুই আমরা বৈধভাবে নিয়েছি। নিয়মিত বিলও পরিশোধ করে আসছি। অগ্নিকান্ডের পর ঘটনাস্থলে বিভিন্ন রঙের কৌটা ও কেমিক্যালের ছোট ড্রাম দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের রোভার স্কাউট গ্রুপের সদস্য মো. মুহিবুল্লাহ।

অগ্নিকান্ডের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসে পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেইন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বস্তির ঘরগুলো টিনের ও কাঠের তৈরি এবং ঘরগুলো ছিল দুইতলা ও তিনতলা। এজন্য সহজেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থাও ছিল না। এছাড়া ঢাকা শহরে যানজটের কারণে চলাফেরা করা খুবই কঠিন। এ কারণে আমাদের পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হয়। এছাড়া পার্কিং ও সরু রাস্তাসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের গাড়ি প্রবেশ করতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। এরপরও বিকল্প পানির উৎস খুঁজে ১১টি ইউনিটের ২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কি কারণে আগুন লেগেছে সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলেনি ফায়ার সার্ভিস।

থামছে না সর্বহারাদের কান্না

অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সর্বস্ব হারানো বস্তিবাসীকে মঙ্গলবারও যার যার ঘরের সামনে বসে বিলাপ করতে দেখা গেছে। অগ্নিকান্ডের পর সোমবার রাত কাটিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশীদের ঘরে, কেউ নিয়েছেন আত্মীয়ের বাসায়। তবে ভোর হতেই সহায়-সম্বলহারা বস্তিবাসী ছুটে আসেন পোড়া ঘরের সামনে। তাদের কেউ ছাইয়ের মধ্যে অবশিষ্ট কিছু আছে কি না তা খুঁজছেন, কেউ কেউ কপালে হাত দিয়ে পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে বসে আছেন।

তাদেরই একজন বৃদ্ধ নুরজাহান বেগম। পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে বসে বিলাপ করছিলেন তিনি। কান্না করতে করতে বলেন, ছেঁড়া কাপড়ে কাজে গেছিলাম, এসে দেখি বাসার সব পুড়ে গেছে। পরনের কাপড় ছাড়া কিছু অবশিষ্ট নাই। রাস্তার ফকির হয়ে গেলাম। স্বামী নাই। ৬ মাস হলো ছেলেটা বউ ও ২ ছেলেকে রেখে কোথায় যেন চলে গেছে। পিঠার দোকান করে সংসার চালাই। সামনে রোজার মাস পিঠা চলবে না। এজন্য অনেক কষ্ট করে চাল ডাল কিনে রাখছিলাম। সব শেষ আমার। এখন থেকে রাস্তায় থাকা লাগবে।

শুধু নূরজাহান বেগমই নয়, অগ্নিকান্ডে সব খুইয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন শত শত মানুষ। বস্তিতে নিজের টেইলার্সের থাকা সেলাই মেশিন দেখিয়ে রাহাত হোসেন বলেন, ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার। ৫টি সেলাই মেশিন ছিল। এখন লোহার ফ্রেম ছাড়া কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। মানুষে নিয়ে গেছে। আর কাপড়ের পিস সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হওয়া হালিমার বাড়ির ২য় তলার বাসিন্দা দিনমজুর বলেন, তিলে তিলে গড়ে তোলা ফ্রিজ, আলমারি খাটসহ সব পুড়ে গেছে। একবেলা খাবো সেই উপায় আমাদের নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্যাস লিকেজ থেকে প্রায়ই আগুন লাগতো। আমি নিজেই একবার গ্যাসের চুলা চালাতে গিয়ে আগুন ধরে গিয়েছিল। তবুও কম ভাড়ার জন্য ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করা লাগে।

ছবি

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে ইজিবাইক চালকদের হামলা, আহত ২১

ছবি

‘বারান্দা থেকে পড়ে’ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু, শিক্ষার্থীদের মধ্যে শোক

ছবি

ঢাকায় ‘সি জিনপিং: দেশ প্রশাসন’ বই বিষয়ক সভা

ছবি

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের নতুন সিইও কামাল আকবর, স্নিগ্ধ পদত্যাগ করে পর্ষদে

ছবি

দুবাইয়ে ফ্ল্যাট জব্দ, ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ: বেনজীরের মেয়ের বিরুদ্ধে আদালতের আদেশ

ছবি

‘‌নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হোক’

ছবি

ক্যান্টনমেন্টে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে শিক্ষার্থীকে ফেলে দিল ছিনতাইকারীরা

ছবি

বিআরটিএ’র ৩৫ কার্যালয়ে ঘুষ-দালালচক্র বিরোধী দুদকের অভিযান

ছবি

জাহাজবাড়িতে ‘জঙ্গিবিরোধী’ অভিযানঃ সাবেক আইজিপি শহীদুল হক ও দুইজনকে দ্বিতীয় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি

ছবি

শ্রমিক নিহতের প্রতিবাদে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ, সোয়া দুই ঘণ্টা পর যান চলাচল শুরু

ছবি

বেইলি রোডে বহুতল ভবনে আগুন, ১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস

লোকজন নিয়ে রাতে বাসায় ঢুকে ‘ভাঙচুর ও অর্থ আদায়’, কলাবাগান থানার ওসি ও দুই কর্মকর্তা বরখাস্ত

ছবি

সাবেক বিমান প্রধান আব্দুল হান্নানসহ ছয়জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা

ছবি

শাপলা চত্বরের ঘটনায় অর্ধেক মামলা নিষ্পত্তি, বাকিগুলো তদন্তাধীন

ছবি

নাজমুল হাসান পাপনের বিরুদ্ধে মামলা পথে দুদক, সন্দেহজনক লেনদেন শত কোটি টাকা

ছবি

গাজীপুরে গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ পাঁচজনের সবাই মারা গেলেন

ছবি

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলায় উদ্বেগ সম্পাদক পরিষদের, সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি মাহ্ফুজ আনামের

ছবি

এনায়েত উল্লাহর পরিবারভুক্ত কোম্পানির ১৯০টি যানবাহন জব্দের আদেশ

ছবি

পল্টনের সাব্বির টাওয়ারে আগুন, নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস

ছবি

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষ, আহত কয়েকজন

ছবি

খিলক্ষেত রেললাইনে ট্রেনের ধাক্কায় যুবক নিহত, কিশোর আহত

ছবি

খিলগাঁওয়ে ভবনের লিফটের ফাঁকা জায়গা থেকে নিরাপত্তাকর্মীর লাশ উদ্ধার

কারওয়ান বাজারে বাইকের ধাক্কায় বৃদ্ধের মৃত্যু, বাইক আরোহী দম্পতি আহত

ছবি

বনানীতে গাড়ি চাপায় নিহত ১

ছবি

নসরুল হামিদের গুলশানের ২০০ কোটি টাকার জমি জব্দের আদেশ

ছবি

শেয়ার ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ: বসুন্ধরা চেয়ারম্যানসহ পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে

ছবি

অধ্যক্ষকে হেনস্তার প্রতিবাদে চিকিৎসা সেবা বন্ধ রেখে আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও ইন্টার্নি চিকিৎসকরা

ছবি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক হিসেবে আনসার উদ্দিন খান পাঠান নিয়োগপ্রাপ্ত

ছবি

চাকরি স্থায়ীকরণ ও বকেয়া বেতনের দাবিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ফটকে তালা

ছবি

ছয় দফা দাবিতে পলিটেকনিকে তালা ঝুলিয়ে ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি

ছবি

টঙ্গীতে ছাঁটাইকৃত ও নিয়মিত শ্রমিকদের সংঘর্ষ, পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ

ছবি

দুদক অনুসন্ধান করছে নাজমুল হাসান পাপনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে

ছবি

মানহানির মামলায় বাসসের এমডি মাহবুব মোর্শেদের জামিন

ছবি

ইসির গেজেট: ঢাকা দক্ষিণ সিটির নতুন মেয়র ইশরাক হোসেন

ছবি

এস আলম গ্রুপের স্টিল মিল, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও তেল কারখানার জমি নিলামে তুলেছে ইসলামী ব্যাংক

সিলেট বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনষ্টিক ওনার্স এসোসিয়েশনের কমিটি গঠন

tab

নগর-মহানগর

রোলিং মিল বস্তিতে আগুন

পুড়েছে ৩ শতাধিক পরিবারের স্বপ্ন

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ ২০২৩

রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের কুনিপাড়ায় রোলিং মিলের পাশে বটতলা ধরে সরু রাস্তা দিয়ে হাজী শামসুদ্দিন লেনের দু’পাশে বাঁশ-কাঠের খুঁটিতে গড়ে তোলা হয়েছে টিনশেড একাধিক বাড়ি। ঘনবসতিপূর্ণ এসব বাড়িতে নিম্ন আয়ের মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। দু’দিন আগে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে থাকা পরিবারগুলো এখন খোলা আকাশের নিচে। কারণ গত সোমবার রাতে ভয়াবহ আগুনে বস্তির ৩ শতাধিক ঘর ছাই হয়েছে। সেইসঙ্গে ছাই হয়েছে পরিবারগুলোর বেঁচে থাকার সহায়-সম্বলও।

গত সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রোলিং মিল বস্তিতে আগুন লাগে। একটি টিনশেড বাড়ির গ্যাস সংযোগের লিকেজ থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা বস্তিবাসীদের। প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর আগুন যখন নিয়ন্ত্রণে আনা হয় তখন ৩ শতাধিক পরিবারের বেঁচে থাকার স্বপ্ন ছাই হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিটকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়। মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) সকালেও ভস্মীভূত টিন ও আসবাবপত্রের ছাই থেকে থেমে থেমে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও বের হচ্ছিল ধোঁয়া।

স্থানীয়রা বলছেন, রোলিং মিল বস্তি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বস্তিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বৈধ কি না তা নিশ্চিত নয় বসবাসকারীরা। প্রায়ই বস্তিতে গ্যাস সংযোগ থেকে ছোটখাটো আগুন লাগতো। তবে সোমবার রাতে যে আগুন লাগে সেটি আর ছোট পর্যায়ে ছিল না। মুহূর্তের মধ্যে ভস্মীভূত করেছে ৩ শতাধিক ঘর। চোখের সামনে বস্তিতে বসবাসকারীরা তাদের শেষ সম্বল আগুনে পুড়ে আঙ্গার হতে দেখেছে।

স্থানীয়রা জানান, ভবনের আদলে ছাদ করে লোহার পাটাতন আর টিন দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল বিশাল ২-৩তলা বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে কমপক্ষে ৫০-১০০টি ঘর। সরু রাস্তা, ঘিঞ্জি ঘর, অপরিকল্পিত গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইনের কারণে প্রতিটি বাড়ি আগ থেকেই ছিল মৃত্যুকূপ। মৃত্যুকূপ জেনেও ভাড়া কিছুটা কম হওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন স্বল্প আয়ের মানুষ। টিন দিয়ে ঘেরা ছোট ঘরগুলোতে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন সাজানো সংসার। সোমবার রাতে যখন আগুন লাগে তখন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ৬টি বাড়ির কমপক্ষে তিন শতাধিক ঘর। আগুনে পুড়ে ৩তলা দুটি বাড়ির এমন অবস্থা হয়েছে যে পোড়া টিন আর অঙ্গার হওয়া আসবাবপত্র না থাকলে বোঝাই যেত না সেখানে কোন বাড়ি ছিল।

তবে কারো কারো দাবি, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বাড়িগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সেখানে দেয়া হয়েছে তিতাস গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ওয়াসার বৈধ লাইন। গ্যাসের বৈধ লাইন হলেও প্রায় চুলার লিকেজ থেকে ছোট ছোট আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। যে টিনের ভবন থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেটির দোতলায় কিছুদিন আগেই গ্যাসের চুলায় আগুন লেগেছিল। যদিও সোমবার রাতে শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে দাবি করেন তারা।

বস্তিটিতে ২৫ বছর ধরে বসবাস করা মুদি দোকানদার ইয়ামিন রহমান বলেন, জায়গাটিতে এক সময় ঝিল থাকলেও ধীরে ধীরে এই ঘর-বাড়ি গড়ে ওঠে। এখানকার বেশিরভাগ জায়গার মালিক যার নামে এই লেনের নামকরণ করা হয়েছে, সেই প্রয়াত হাজী শামসুদ্দিনের সন্তানেরা। অনেকে তাদের কাছ থেকে জায়গা ভাড়া নিয়ে বা কিনে বাড়ি গড়েছেন। আগুন সম্পর্কে ইয়ামিন বলেন, সোমবার রাত ৮টার দিকে হাজী শামসুদ্দিনের মেজো ছেলে মৃত শরীফ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হালিমার ৩তলা ভবনের ২য় তলার ৩ নম্বর ঘর থেকে আগুন লাগে। এরপর মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর ফায়ার সার্ভিস আসলেও সরু রাস্তার কারণে তারা ভেতরে আসতে পারেনি। একটি ইউনিট কাজ শুরু করলেও কিছুক্ষণ পর জানায় পানি শেষ। এতে আগুন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে। হালিমার বাড়ির নিচতলায় থাকা সেলুনের নাপিত মো. আলী বলেন, হুট করেই আগুন আগুন চিৎকার শুনতে পান। তখন সবাই জীবন বাঁচাতে দৌঁড়ে বেড়িয়ে যায়।

৪টি বাড়ির ২ শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে আক্কাস আলীর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে ছিলাম। এসে দেখি সব শেষ। তিনি বলেন, কোন বাড়িতেই অবৈধ কোন লাইন নেই। সবকিছুই আমরা বৈধভাবে নিয়েছি। নিয়মিত বিলও পরিশোধ করে আসছি। অগ্নিকান্ডের পর ঘটনাস্থলে বিভিন্ন রঙের কৌটা ও কেমিক্যালের ছোট ড্রাম দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের রোভার স্কাউট গ্রুপের সদস্য মো. মুহিবুল্লাহ।

অগ্নিকান্ডের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসে পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেইন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বস্তির ঘরগুলো টিনের ও কাঠের তৈরি এবং ঘরগুলো ছিল দুইতলা ও তিনতলা। এজন্য সহজেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থাও ছিল না। এছাড়া ঢাকা শহরে যানজটের কারণে চলাফেরা করা খুবই কঠিন। এ কারণে আমাদের পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হয়। এছাড়া পার্কিং ও সরু রাস্তাসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের গাড়ি প্রবেশ করতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। এরপরও বিকল্প পানির উৎস খুঁজে ১১টি ইউনিটের ২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কি কারণে আগুন লেগেছে সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলেনি ফায়ার সার্ভিস।

থামছে না সর্বহারাদের কান্না

অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সর্বস্ব হারানো বস্তিবাসীকে মঙ্গলবারও যার যার ঘরের সামনে বসে বিলাপ করতে দেখা গেছে। অগ্নিকান্ডের পর সোমবার রাত কাটিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশীদের ঘরে, কেউ নিয়েছেন আত্মীয়ের বাসায়। তবে ভোর হতেই সহায়-সম্বলহারা বস্তিবাসী ছুটে আসেন পোড়া ঘরের সামনে। তাদের কেউ ছাইয়ের মধ্যে অবশিষ্ট কিছু আছে কি না তা খুঁজছেন, কেউ কেউ কপালে হাত দিয়ে পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে বসে আছেন।

তাদেরই একজন বৃদ্ধ নুরজাহান বেগম। পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে বসে বিলাপ করছিলেন তিনি। কান্না করতে করতে বলেন, ছেঁড়া কাপড়ে কাজে গেছিলাম, এসে দেখি বাসার সব পুড়ে গেছে। পরনের কাপড় ছাড়া কিছু অবশিষ্ট নাই। রাস্তার ফকির হয়ে গেলাম। স্বামী নাই। ৬ মাস হলো ছেলেটা বউ ও ২ ছেলেকে রেখে কোথায় যেন চলে গেছে। পিঠার দোকান করে সংসার চালাই। সামনে রোজার মাস পিঠা চলবে না। এজন্য অনেক কষ্ট করে চাল ডাল কিনে রাখছিলাম। সব শেষ আমার। এখন থেকে রাস্তায় থাকা লাগবে।

শুধু নূরজাহান বেগমই নয়, অগ্নিকান্ডে সব খুইয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন শত শত মানুষ। বস্তিতে নিজের টেইলার্সের থাকা সেলাই মেশিন দেখিয়ে রাহাত হোসেন বলেন, ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার। ৫টি সেলাই মেশিন ছিল। এখন লোহার ফ্রেম ছাড়া কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। মানুষে নিয়ে গেছে। আর কাপড়ের পিস সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হওয়া হালিমার বাড়ির ২য় তলার বাসিন্দা দিনমজুর বলেন, তিলে তিলে গড়ে তোলা ফ্রিজ, আলমারি খাটসহ সব পুড়ে গেছে। একবেলা খাবো সেই উপায় আমাদের নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্যাস লিকেজ থেকে প্রায়ই আগুন লাগতো। আমি নিজেই একবার গ্যাসের চুলা চালাতে গিয়ে আগুন ধরে গিয়েছিল। তবুও কম ভাড়ার জন্য ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করা লাগে।

back to top