১২শ’ কোটি টাকা ফেরত যাওয়ার শঙ্কা
মাউশির অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া ১০টি বড় প্রকল্পের পাঁচটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী মাসে। নির্ধারিত পাঁচ বছর শেষে চার প্রকল্পের অগ্রগতি ৯ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ। অন্য একটি পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্প ১২ বছরে অগ্রগতি দাঁড়ালো ৭৩ শতাংশ। বাকি পাঁচটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতিও ‘নাজুক’।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের অধীনে বর্তমানে ৭৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, যার বেশিরভাগই সঙ্কটে রয়েছে। নির্ধারিত মেয়াদে বাস্তবায়ন হয়নি অধিকাংশ প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির জন্য মন্ত্রণালয়, মাউশির কর্মকর্তা ও পিডিরা পরস্পরকে দায়ী করছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) মোট ৭৮টি প্রকল্পের অনুকূলে মোট আট হাজার ২৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে গত এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। বাকি সময়ে (জুনের মধ্যে) পুরো অর্থ ব্যয় হচ্ছে না। অন্তত ১৫ শতাংশ অর্থ যা প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা ফেরত যাওয়ার আশঙ্ক করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘পরিকল্পনা ও উন্নয়ন’ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রকল্পগুলো অচলাবস্থায় পড়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও অদক্ষ জনবল এবং মন্ত্রণালয় ও এর অধীনন্থ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে যেকোন মূল্যে বরাদ্দকৃত অর্থ নির্ধারিত সময়ে ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে ওই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তিনজন প্রকল্প কর্মকর্তারা (পিডি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা-ব্যক্তিদের গাফিলতির কারণে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পের ডিপিপি (প্রকল্প দলিল) সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কিন্তু যথাসময়ে সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন হচ্ছে না। এতে বিভিন্ন ক্রয় প্রক্রিয়া ঝুলে গেছে। মাউশিও এ কাজে যথাযথ সহযোগিতা করছে না।
মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ গত ১৮ এপ্রিল বিভিন্ন প্রকল্পের পিডিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় বলেন, ‘কোভিডের কথা বলে কাজ সম্পূর্ণ হয়নি এ কথা বলার সুযোগ এখন আর নেই। মন্ত্রণালয়ে কোন বিষয়ে শুধু পত্র প্রেরণ করলেই হবে না, কাজটি তুলে নিয়ে আসার জন্য ২/১ একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে রাখতে হবে যারা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবে।’
মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডিপিপি বা ডেভেলাপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল সংশোধনের সাচিবিক কাজ প্রকল্প অফিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকেই শুরু হয়। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় হয়ে একনেকে অনুমোদন হয়। কিন্তু কর্মকর্তারা এসব কাজে ‘ঠিকমতো’ মনোযোগ বা যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না।
১০ প্রকল্পের দৈন্যদশা :
এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীনে বর্তমানে ১০টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর প্রায় সবকটিই নানা সঙ্কটে রয়েছে।
‘ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ’ (এনএএএনডি) প্রকল্পের বাস্তবায়ন দুর্নীতিতে আটকে গেছে। ৪২২ কোটি ৩৩ লাখ টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি। পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বারবার ডিপিপি সংশোধন বা পরিবর্তন হয়েছে।
সর্বশেষ পরিবর্তিত ডিপিপি অনুযায়ী ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হবে। অথচ গত এপ্রিল পর্যন্ত ‘এনএএএনডি’ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি অর্থাৎ ব্যয় হয়েছে মাত্র ৭৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকার মতো। মোট অগ্রগতি ১৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। এই প্রকল্পের আওতায় একটি নতুন অটিজম একাডেমি স্থাপনের কথা রয়েছে।
সরকার বিভাগীয় শহরের পাশে নতুন ৯টি সরকারি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পটি গ্রহণ করে। ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়ে এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ৩০ জুনের মধ্যে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হওয়া কথা রয়েছে। অথচ গত এপ্রিল পর্যন্ত এই প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৩৪ শতাংশ।
জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন নতুন শিক্ষাভবন নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১ আগস্ট সরকার ‘৭০ পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজ’ প্রকল্প গ্রহণ করে। এক হাজার ৬৯০ কোটি ৪৪ লাখ টাকার এই প্রকল্পের আওতায় গত এপ্রিল পর্যন্ত এক হাজার ২৩৭ কোটি ২৫ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৭৩ দশমিক ১৯ শতাংশ।
আগামী ৩০ জুন এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হচ্ছে। প্রকল্পের পুরো বাস্তবায়নের জন্য মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও মাউশির গাফিলতির কারণে প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনের প্রস্তাব ঝুলে আছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
‘৭০ পোস্ট গ্রাজুয়েট’ কলেজ প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন সংবাদ’কে বলেন, ‘প্রকল্পটি ২০১০ সালের আগস্টে শুরু হলেও প্রকল্পের ১০তলা ভবন নির্মাণের কার্যক্রমটি যুক্ত হয় ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে। পরবর্তীতে এসব ভবনে নির্মাণ কাজ শুরু হলেও কোভিড পরিস্থিতি, সাইট না পাওয়া ইত্যাদি কারণে যথাসময়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।’
বর্তমানে ৩৬টি ভবনের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে ১১টির নির্মাণ কাজ চলতি বছরে শেষ হবে। কাজ শেষে লিফ্ট লাগাতে হবে। ২৫টি ভবনের ভৌত কাজ শেষ হবে না এবং এর মধ্যে ১৫টি ১০তলা ভবন রয়েছে। এই অবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়লে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের করার কী আছে?’
তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজসমূহের (১৫শ’ কলেজে নতুন ভবন স্থাপন ও পুরাতন ভবন সংস্কার) উন্নয়ন’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ২০১২ সালের ১ জুলাই। পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প ২০১৭ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
সর্বশেষ পরিবর্তিত ডিপিপি অনুযায়ী পাঁচ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন আগামী ৩১ ডিসেম্বর সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। গত এপ্রিল পর্যন্ত এই প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৭৪ দশমিক ২৮ শতাংশ।
‘সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইম্প্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম’ (সেসিপ) তিন হাজার ৮২৭ কোটি টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রোগ্রাম আগামী ৩১ ডিসেম্বর শেষ হচ্ছে। অথচ গত এপ্রিল পর্যন্ত এই প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৮৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন’ (পর্যায়-২) প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৬ সালের ১ জুলাই। এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার এই প্রকল্প আগামী মাসের ৩০ জুন এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। গত এপ্রিল নাগাদ এই প্রকল্পের ১১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। অথচ বাস্তবায়ন অগ্রগতি মাত্র ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
কেনাকাটায় দুর্নীতি, অনিয়ম ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে অর্থ তছরুপসহ নানা কারণে এই প্রকল্পটি ডুবেছে। তিন দফা প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হলেও অভিযুক্ত একাধিক কর্মকর্তা এখনও বহাল তবিয়তেই আছে।
‘আইসিটি-২’ প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক মোরশীদুল হাসান সম্প্রতি মাউশির এক সভায় জানান, তার প্রকল্পের প্রায় ৫৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকার অডিট ‘আপত্তি নিষ্পত্তির কার্যক্রম’ চলমান রয়েছে।
‘ঢাকা শহরের সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি। ৬৭৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন আগামী ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। অথচ এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের (৩২৩টি) উন্নয়ন’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি। তিন হাজার ২৮৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন আগামী ৩০ জুন শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
কিন্তু বারবার ডিপিপি সংশোধন ও মাউশির ‘অসহযোগিতার’ কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ধীর গতিতে এগুচ্ছে। গত এপ্রিল নাগাদ এই প্রকল্পের অগ্রগতি ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
‘৩২৩টি’ স্কুল প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক নাসির উদ্দিন সংবাদ’কে বলেন, ‘কোভিড পরিস্থিতিতে দুই বছর আমাদের প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ ছিল। তাছাড়া প্রকল্পের ডিপিপিও সংশোধন হচ্ছে। এ কারণে অগ্রগতি একটু স্লো।’
‘সরকারি কলেজসমূহের বিজ্ঞান শিক্ষার সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি। দুই হাজার ৫১১ কোটি ৫১ লাখ টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়নও আগামী ৩০ শেষ হওয়ার কথা। অথচ গত এপ্রিল নাগাদ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ।
এই প্রকল্পের পিডি ড. খন্দকার মুজাহিদুল হক সম্প্রতি মাউশির এক সভায় জানান, ‘গত ১১ এপ্রিল পিএসসি (প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় শুধুমাত্র যে কাজগুলো চলছে সেগুলো চলমান রেখে অর্থাৎ ৯৪টি একাডেমিক ভবন নির্মাণ, ৪৭টি হোস্টেলের মধ্যে ২৯টি কাজ চলমান এবং আরও ৪টির কাজ গ্রহণ এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা ছাড়া কোন কাজ গ্রহণ করা যাবে না মর্মে পিএসসি সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’
খন্দকার মুজাহিদুল হক সম্প্রতি সংবাদ’কে বলেন, ‘বারবার প্রকল্প দলিল সংশোধন হচ্ছে। এ কাজেও অনেক সময় চলে যায়। বাস্তবায়নও পিছিয়ে যায়।’
১২শ’ কোটি টাকা ফেরত যাওয়ার শঙ্কা
শনিবার, ২১ মে ২০২২
মাউশির অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া ১০টি বড় প্রকল্পের পাঁচটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী মাসে। নির্ধারিত পাঁচ বছর শেষে চার প্রকল্পের অগ্রগতি ৯ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ। অন্য একটি পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্প ১২ বছরে অগ্রগতি দাঁড়ালো ৭৩ শতাংশ। বাকি পাঁচটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতিও ‘নাজুক’।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের অধীনে বর্তমানে ৭৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, যার বেশিরভাগই সঙ্কটে রয়েছে। নির্ধারিত মেয়াদে বাস্তবায়ন হয়নি অধিকাংশ প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির জন্য মন্ত্রণালয়, মাউশির কর্মকর্তা ও পিডিরা পরস্পরকে দায়ী করছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) মোট ৭৮টি প্রকল্পের অনুকূলে মোট আট হাজার ২৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে গত এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। বাকি সময়ে (জুনের মধ্যে) পুরো অর্থ ব্যয় হচ্ছে না। অন্তত ১৫ শতাংশ অর্থ যা প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা ফেরত যাওয়ার আশঙ্ক করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘পরিকল্পনা ও উন্নয়ন’ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রকল্পগুলো অচলাবস্থায় পড়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও অদক্ষ জনবল এবং মন্ত্রণালয় ও এর অধীনন্থ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে যেকোন মূল্যে বরাদ্দকৃত অর্থ নির্ধারিত সময়ে ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে ওই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তিনজন প্রকল্প কর্মকর্তারা (পিডি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা-ব্যক্তিদের গাফিলতির কারণে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পের ডিপিপি (প্রকল্প দলিল) সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কিন্তু যথাসময়ে সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন হচ্ছে না। এতে বিভিন্ন ক্রয় প্রক্রিয়া ঝুলে গেছে। মাউশিও এ কাজে যথাযথ সহযোগিতা করছে না।
মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ গত ১৮ এপ্রিল বিভিন্ন প্রকল্পের পিডিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় বলেন, ‘কোভিডের কথা বলে কাজ সম্পূর্ণ হয়নি এ কথা বলার সুযোগ এখন আর নেই। মন্ত্রণালয়ে কোন বিষয়ে শুধু পত্র প্রেরণ করলেই হবে না, কাজটি তুলে নিয়ে আসার জন্য ২/১ একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে রাখতে হবে যারা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবে।’
মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডিপিপি বা ডেভেলাপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল সংশোধনের সাচিবিক কাজ প্রকল্প অফিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকেই শুরু হয়। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় হয়ে একনেকে অনুমোদন হয়। কিন্তু কর্মকর্তারা এসব কাজে ‘ঠিকমতো’ মনোযোগ বা যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না।
১০ প্রকল্পের দৈন্যদশা :
এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীনে বর্তমানে ১০টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর প্রায় সবকটিই নানা সঙ্কটে রয়েছে।
‘ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ’ (এনএএএনডি) প্রকল্পের বাস্তবায়ন দুর্নীতিতে আটকে গেছে। ৪২২ কোটি ৩৩ লাখ টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি। পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বারবার ডিপিপি সংশোধন বা পরিবর্তন হয়েছে।
সর্বশেষ পরিবর্তিত ডিপিপি অনুযায়ী ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হবে। অথচ গত এপ্রিল পর্যন্ত ‘এনএএএনডি’ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি অর্থাৎ ব্যয় হয়েছে মাত্র ৭৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকার মতো। মোট অগ্রগতি ১৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। এই প্রকল্পের আওতায় একটি নতুন অটিজম একাডেমি স্থাপনের কথা রয়েছে।
সরকার বিভাগীয় শহরের পাশে নতুন ৯টি সরকারি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পটি গ্রহণ করে। ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়ে এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ৩০ জুনের মধ্যে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হওয়া কথা রয়েছে। অথচ গত এপ্রিল পর্যন্ত এই প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৩৪ শতাংশ।
জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন নতুন শিক্ষাভবন নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১ আগস্ট সরকার ‘৭০ পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজ’ প্রকল্প গ্রহণ করে। এক হাজার ৬৯০ কোটি ৪৪ লাখ টাকার এই প্রকল্পের আওতায় গত এপ্রিল পর্যন্ত এক হাজার ২৩৭ কোটি ২৫ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৭৩ দশমিক ১৯ শতাংশ।
আগামী ৩০ জুন এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হচ্ছে। প্রকল্পের পুরো বাস্তবায়নের জন্য মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও মাউশির গাফিলতির কারণে প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনের প্রস্তাব ঝুলে আছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
‘৭০ পোস্ট গ্রাজুয়েট’ কলেজ প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন সংবাদ’কে বলেন, ‘প্রকল্পটি ২০১০ সালের আগস্টে শুরু হলেও প্রকল্পের ১০তলা ভবন নির্মাণের কার্যক্রমটি যুক্ত হয় ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে। পরবর্তীতে এসব ভবনে নির্মাণ কাজ শুরু হলেও কোভিড পরিস্থিতি, সাইট না পাওয়া ইত্যাদি কারণে যথাসময়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।’
বর্তমানে ৩৬টি ভবনের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে ১১টির নির্মাণ কাজ চলতি বছরে শেষ হবে। কাজ শেষে লিফ্ট লাগাতে হবে। ২৫টি ভবনের ভৌত কাজ শেষ হবে না এবং এর মধ্যে ১৫টি ১০তলা ভবন রয়েছে। এই অবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়লে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের করার কী আছে?’
তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজসমূহের (১৫শ’ কলেজে নতুন ভবন স্থাপন ও পুরাতন ভবন সংস্কার) উন্নয়ন’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ২০১২ সালের ১ জুলাই। পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প ২০১৭ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
সর্বশেষ পরিবর্তিত ডিপিপি অনুযায়ী পাঁচ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন আগামী ৩১ ডিসেম্বর সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। গত এপ্রিল পর্যন্ত এই প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৭৪ দশমিক ২৮ শতাংশ।
‘সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইম্প্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম’ (সেসিপ) তিন হাজার ৮২৭ কোটি টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রোগ্রাম আগামী ৩১ ডিসেম্বর শেষ হচ্ছে। অথচ গত এপ্রিল পর্যন্ত এই প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৮৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন’ (পর্যায়-২) প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৬ সালের ১ জুলাই। এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার এই প্রকল্প আগামী মাসের ৩০ জুন এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। গত এপ্রিল নাগাদ এই প্রকল্পের ১১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। অথচ বাস্তবায়ন অগ্রগতি মাত্র ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
কেনাকাটায় দুর্নীতি, অনিয়ম ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে অর্থ তছরুপসহ নানা কারণে এই প্রকল্পটি ডুবেছে। তিন দফা প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হলেও অভিযুক্ত একাধিক কর্মকর্তা এখনও বহাল তবিয়তেই আছে।
‘আইসিটি-২’ প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক মোরশীদুল হাসান সম্প্রতি মাউশির এক সভায় জানান, তার প্রকল্পের প্রায় ৫৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকার অডিট ‘আপত্তি নিষ্পত্তির কার্যক্রম’ চলমান রয়েছে।
‘ঢাকা শহরের সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি। ৬৭৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন আগামী ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। অথচ এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের (৩২৩টি) উন্নয়ন’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি। তিন হাজার ২৮৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন আগামী ৩০ জুন শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
কিন্তু বারবার ডিপিপি সংশোধন ও মাউশির ‘অসহযোগিতার’ কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ধীর গতিতে এগুচ্ছে। গত এপ্রিল নাগাদ এই প্রকল্পের অগ্রগতি ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
‘৩২৩টি’ স্কুল প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক নাসির উদ্দিন সংবাদ’কে বলেন, ‘কোভিড পরিস্থিতিতে দুই বছর আমাদের প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ ছিল। তাছাড়া প্রকল্পের ডিপিপিও সংশোধন হচ্ছে। এ কারণে অগ্রগতি একটু স্লো।’
‘সরকারি কলেজসমূহের বিজ্ঞান শিক্ষার সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি। দুই হাজার ৫১১ কোটি ৫১ লাখ টাকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়নও আগামী ৩০ শেষ হওয়ার কথা। অথচ গত এপ্রিল নাগাদ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ।
এই প্রকল্পের পিডি ড. খন্দকার মুজাহিদুল হক সম্প্রতি মাউশির এক সভায় জানান, ‘গত ১১ এপ্রিল পিএসসি (প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় শুধুমাত্র যে কাজগুলো চলছে সেগুলো চলমান রেখে অর্থাৎ ৯৪টি একাডেমিক ভবন নির্মাণ, ৪৭টি হোস্টেলের মধ্যে ২৯টি কাজ চলমান এবং আরও ৪টির কাজ গ্রহণ এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা ছাড়া কোন কাজ গ্রহণ করা যাবে না মর্মে পিএসসি সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’
খন্দকার মুজাহিদুল হক সম্প্রতি সংবাদ’কে বলেন, ‘বারবার প্রকল্প দলিল সংশোধন হচ্ছে। এ কাজেও অনেক সময় চলে যায়। বাস্তবায়নও পিছিয়ে যায়।’