দেশে কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শাখা’, ‘উপশাখা’ ও ‘স্টাডি সেন্টার’ ক্যাম্পাস খোলার তোড়জোড় চলছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশে শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ায় কার্যক্রম চালানো চীনের অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশে অনুমোদন দেয়ার চেষ্টা চলছে।
এ প্রক্রিয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বিদেশি ‘কথিত’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস চালুর তৎপরতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের যুক্তি হলো ৮/১০টি ছাড়া বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত আসনে প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। শিক্ষার্থী না পেলে প্রতিষ্ঠানের আয় কমে যায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক সংকটে পড়ছে বলে উদোক্তারা জানিয়েছেন।
যদিও ইউজিসি কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ের’ তালিকায় নাম না থাকলে কোন প্রতিষ্ঠানকে দেশে অনুমোদন দেয়া হবে না। উচ্চশিক্ষার পথ সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে বলে ইউজিসির দাবি।
দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস চালু করতে চান এমন একজন উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘মুখ (ব্যক্তি বিশেষ) দেখে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয় ২০০টির মধ্যে রয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। অথচ অখ্যাত ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে। এতে অদক্ষ জনবল তৈরির পাশাপাশি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হবে কিন্তু উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ হবে না।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে জানা গেছে, চীনের ‘জিয়ামিন’ নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে মালয়েশিয়ায়। এখন মালয়েশিয়া থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের ‘উপশাখা’ (সাব-ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার) ক্যাম্পাস বাংলাদেশে চালু করার তোড়জোড় চালাচ্ছে একটি মহল। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার ‘ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি’কে বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
এছাড়া মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশের আরও ৮/১০টি ‘অখ্যাত’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বা উপশাখা ক্যাম্পাসের কার্যক্রম দেশে চালু করার তৎপরতা চালাচ্ছেন অন্য কয়েকটি পক্ষ। এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্প্রতি দেশে নানা রকম প্রচারণা শুরু হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দেশে অবৈধভাবে নানা নামে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। উচ্চশিক্ষার বিকাশের নামে প্রতারণা, সনদ বিক্রি, ইচ্ছেমতো উপশাখা ক্যাস্পাস ভাড়া দেয়া ও আদম পাচারের ঘটনাও ঘটে।
এ ধরনের অভিযোগে ২০০৭ সালে সরকার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী ৫৬টি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এরপর দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, শাখা, স্টাডি সেন্টার এবং কেউ কেউ বিদেশি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
২০১৪ সালের দিকে কয়েকটি শর্ত দিয়ে দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দিয়ে একটি বিধিমালা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটির আলোকেই ইতোমধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পেয়েছে।
এর মধ্যে গত ১ মার্চ মালয়েশিয়ার ‘ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির’ স্টাডি সেন্টারের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর আগে দেশে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘মোনাশ কলেজ (অস্ট্রেলিয়া)’ স্টাডি সেন্টারের কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেয়া হয়।
এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান সংবাদকে বলেন, ‘মোনাশ হলো অস্ট্রেলিয়ার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়; আর ইউসিএসআই মালয়েশিয়ার এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা যাচাই-বাছাই করেই এগুলোকে অনুমোদন দিয়েছি।’
আরও কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন জমা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মান ভালো না হলে কাউকে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। ভালোভাবে প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।’
তবে এ বিষয়ে জানতে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির’ সাবেক সহ-সভাপতি আবুল কাসেম হায়দার সংবাদকে বলেন, ‘ইউসিএসআই-মালয়েশিয়ার একটি অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। এটি কোন র্যাংকিংয়েই নেই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়ে শিক্ষার বারোটা বাজানো হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। সেখানে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়ে কী লাভ? এতে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ছাড়া কিছুই হবে না।’
‘মোনাস কলেজ’র স্টাডি সেন্টার অনুমোদনের সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল প্রস্তাবিত স্টাডি সেন্টার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনার বিধিমালা, ২০১৪-এ বর্ণিত সব বিধি-বিধান ও শর্ত মেনে চলবে।’
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’র (বিডিইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নুর সংবাদকে বলেন, যেনতেনভাবে অনুমোদন দিলে হবে না; শুধু স্টাডি সেন্টার খুলে শিক্ষার মান রক্ষা করা যাবে না। পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দিতে হবেÑ যেমনটি মালয়েশিয়া, দুবাইয়ে রয়েছে। ওইসব দেশে বিশে^র নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো ব্র্যান্ড ব্যবহার করা.... বিদেশি শিক্ষকও থাকতে হবে... তারা আসবেন, যাবেন। আবার টিউশন ফিও যৌক্তিক হতে হবে।’
২০১৪ সালের ৩১ মে দেশে এ ধরনের স্টাডি সেন্টার স্থাপনের অনুমোদন দেয়ার লক্ষ্যে একটি বিধিমালা জারি করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ওই বিধিমালায় বলা হয় আবেদনকারীর আবেদন ও তথ্যাদি সম্পর্কে সন্তুষ্ট হলে কমিশন প্রাথমিকভাবে আবেদনটি মঞ্জুর করতে পারবে। অথবা কারণ লিপিবদ্ধ করে নামঞ্জুর করতে পারবে। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
২০০৭ সালের দিকে দেশে মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৫৫-৫৬টি। বর্তমানে সেই সংখ্যা ১০৯টির মতো। একই সঙ্গে বাড়ছে সরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সরকার প্রতি জেলায় অন্তত একটি করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দেশে চালু থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এগুলোতে শিক্ষার্থী সংকট যেমন রয়েছে, তেমনি শিক্ষক সংকটও আছে। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও সনদ বাণিজ্য, দুর্নীতি ও সীমিত সংখ্যক শিক্ষক দিয়ে পাঠদানের অভিযোগ রয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের দাবি, যেসব শর্তে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেয়া হচ্ছে, সেগুলো কোচিং সেন্টার-নির্ভর উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে শিক্ষা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, উচ্চশিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বিদ্যমান উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের স্টাডি সেন্টারগুলো সরকারকে ট্যাক্স, ভ্যাট দিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এর ফলে এগুলো বাণিজ-নির্ভর প্রতিষ্ঠানেই পরিণত হবে।
২০১৪ সালের বিধিমালা অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ২৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর এলাকা ও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্থান সংকুলান হয় এমন পর্যাপ্ত পরিমাণে শ্রেণিকক্ষ থাকতে হবে। স্টাডি সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজস্ব অথবা ভাড়া ভবনে কমপক্ষে ১০ হাজার বর্গফুট ফ্লোর এলাকা থাকতে হবে। পাঠদানের জন্য খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কিত কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে। শিক্ষার্থী ভর্তি ফি, টিউশন ফি, ক্রেডিটের সংখ্যা, সেমিস্টারের অ্যাক্টিভিটি ফি ও অন্যান্য ফি বাবদ ধার্য করা অর্থের মধ্যে উদ্যোক্তা, স্থানীয় প্রতিনিধি ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুপাতিক অংশ হারে স্থানীয় প্রতিনিধি ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে বিভাজিত হতে হবে।
ইউজিসি নির্ধারিত তিন সদস্যের সমন্বয়ে একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ থাকতে হবে। পাঠ্য তালিকায় কম্পিউটার সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রকৌশল বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকলে প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি কম্পিউটার ও প্রাসঙ্গিক যন্ত্রপাতিসহ ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হবে।
উচ্চ শিক্ষায় বাড়ছে না শিক্ষার্থী
সম্প্রতি ২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। এ পরীক্ষায় মোট দশ লাখ ১১ হাজার ৯৮৭ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। এসব শিক্ষার্থী এখন অনার্স (সম্মান) ও সমস্তরে ভর্তি হবে। আর স্নাতক, ডিগ্রি পাস কোর্স ও অন্যান্য স্তরে আসন রয়েছে প্রায় ১৪ লাখ। সেই হিসাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তত চার লাখ আসন ফাঁকা থাকতে পারে। কোভিড মহামারীতে বিশেষ মূল্যায়নে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানে ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন পরীক্ষার্থীর সবাইকে পাস দেয়া হয়। এরপর ২০২১ সালে এই স্তরে ১৩ লাখ ছয় হাজার ৬৮১ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। এসব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হয় ২০২২ সালে।
ইউজিসি থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে ৯ লাখের মতো। যা উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর প্রায় ৬৫ শতাংশ। তাছাড়া ২০২২ সালেও বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজারের বেশি আসন ফাঁকা ছিল।
সোমবার, ১৩ মার্চ ২০২৩
দেশে কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শাখা’, ‘উপশাখা’ ও ‘স্টাডি সেন্টার’ ক্যাম্পাস খোলার তোড়জোড় চলছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশে শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ায় কার্যক্রম চালানো চীনের অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশে অনুমোদন দেয়ার চেষ্টা চলছে।
এ প্রক্রিয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বিদেশি ‘কথিত’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস চালুর তৎপরতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের যুক্তি হলো ৮/১০টি ছাড়া বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত আসনে প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। শিক্ষার্থী না পেলে প্রতিষ্ঠানের আয় কমে যায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক সংকটে পড়ছে বলে উদোক্তারা জানিয়েছেন।
যদিও ইউজিসি কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ের’ তালিকায় নাম না থাকলে কোন প্রতিষ্ঠানকে দেশে অনুমোদন দেয়া হবে না। উচ্চশিক্ষার পথ সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে বলে ইউজিসির দাবি।
দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস চালু করতে চান এমন একজন উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘মুখ (ব্যক্তি বিশেষ) দেখে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয় ২০০টির মধ্যে রয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। অথচ অখ্যাত ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে। এতে অদক্ষ জনবল তৈরির পাশাপাশি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হবে কিন্তু উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ হবে না।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে জানা গেছে, চীনের ‘জিয়ামিন’ নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে মালয়েশিয়ায়। এখন মালয়েশিয়া থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের ‘উপশাখা’ (সাব-ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার) ক্যাম্পাস বাংলাদেশে চালু করার তোড়জোড় চালাচ্ছে একটি মহল। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার ‘ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি’কে বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
এছাড়া মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশের আরও ৮/১০টি ‘অখ্যাত’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বা উপশাখা ক্যাম্পাসের কার্যক্রম দেশে চালু করার তৎপরতা চালাচ্ছেন অন্য কয়েকটি পক্ষ। এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্প্রতি দেশে নানা রকম প্রচারণা শুরু হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দেশে অবৈধভাবে নানা নামে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। উচ্চশিক্ষার বিকাশের নামে প্রতারণা, সনদ বিক্রি, ইচ্ছেমতো উপশাখা ক্যাস্পাস ভাড়া দেয়া ও আদম পাচারের ঘটনাও ঘটে।
এ ধরনের অভিযোগে ২০০৭ সালে সরকার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী ৫৬টি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এরপর দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, শাখা, স্টাডি সেন্টার এবং কেউ কেউ বিদেশি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
২০১৪ সালের দিকে কয়েকটি শর্ত দিয়ে দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দিয়ে একটি বিধিমালা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটির আলোকেই ইতোমধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পেয়েছে।
এর মধ্যে গত ১ মার্চ মালয়েশিয়ার ‘ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির’ স্টাডি সেন্টারের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর আগে দেশে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘মোনাশ কলেজ (অস্ট্রেলিয়া)’ স্টাডি সেন্টারের কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেয়া হয়।
এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান সংবাদকে বলেন, ‘মোনাশ হলো অস্ট্রেলিয়ার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়; আর ইউসিএসআই মালয়েশিয়ার এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা যাচাই-বাছাই করেই এগুলোকে অনুমোদন দিয়েছি।’
আরও কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন জমা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মান ভালো না হলে কাউকে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। ভালোভাবে প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।’
তবে এ বিষয়ে জানতে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির’ সাবেক সহ-সভাপতি আবুল কাসেম হায়দার সংবাদকে বলেন, ‘ইউসিএসআই-মালয়েশিয়ার একটি অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। এটি কোন র্যাংকিংয়েই নেই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়ে শিক্ষার বারোটা বাজানো হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। সেখানে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়ে কী লাভ? এতে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ছাড়া কিছুই হবে না।’
‘মোনাস কলেজ’র স্টাডি সেন্টার অনুমোদনের সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল প্রস্তাবিত স্টাডি সেন্টার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনার বিধিমালা, ২০১৪-এ বর্ণিত সব বিধি-বিধান ও শর্ত মেনে চলবে।’
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’র (বিডিইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নুর সংবাদকে বলেন, যেনতেনভাবে অনুমোদন দিলে হবে না; শুধু স্টাডি সেন্টার খুলে শিক্ষার মান রক্ষা করা যাবে না। পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দিতে হবেÑ যেমনটি মালয়েশিয়া, দুবাইয়ে রয়েছে। ওইসব দেশে বিশে^র নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো ব্র্যান্ড ব্যবহার করা.... বিদেশি শিক্ষকও থাকতে হবে... তারা আসবেন, যাবেন। আবার টিউশন ফিও যৌক্তিক হতে হবে।’
২০১৪ সালের ৩১ মে দেশে এ ধরনের স্টাডি সেন্টার স্থাপনের অনুমোদন দেয়ার লক্ষ্যে একটি বিধিমালা জারি করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ওই বিধিমালায় বলা হয় আবেদনকারীর আবেদন ও তথ্যাদি সম্পর্কে সন্তুষ্ট হলে কমিশন প্রাথমিকভাবে আবেদনটি মঞ্জুর করতে পারবে। অথবা কারণ লিপিবদ্ধ করে নামঞ্জুর করতে পারবে। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
২০০৭ সালের দিকে দেশে মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৫৫-৫৬টি। বর্তমানে সেই সংখ্যা ১০৯টির মতো। একই সঙ্গে বাড়ছে সরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সরকার প্রতি জেলায় অন্তত একটি করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দেশে চালু থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এগুলোতে শিক্ষার্থী সংকট যেমন রয়েছে, তেমনি শিক্ষক সংকটও আছে। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও সনদ বাণিজ্য, দুর্নীতি ও সীমিত সংখ্যক শিক্ষক দিয়ে পাঠদানের অভিযোগ রয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের দাবি, যেসব শর্তে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেয়া হচ্ছে, সেগুলো কোচিং সেন্টার-নির্ভর উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে শিক্ষা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, উচ্চশিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বিদ্যমান উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের স্টাডি সেন্টারগুলো সরকারকে ট্যাক্স, ভ্যাট দিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এর ফলে এগুলো বাণিজ-নির্ভর প্রতিষ্ঠানেই পরিণত হবে।
২০১৪ সালের বিধিমালা অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ২৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর এলাকা ও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্থান সংকুলান হয় এমন পর্যাপ্ত পরিমাণে শ্রেণিকক্ষ থাকতে হবে। স্টাডি সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজস্ব অথবা ভাড়া ভবনে কমপক্ষে ১০ হাজার বর্গফুট ফ্লোর এলাকা থাকতে হবে। পাঠদানের জন্য খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কিত কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে। শিক্ষার্থী ভর্তি ফি, টিউশন ফি, ক্রেডিটের সংখ্যা, সেমিস্টারের অ্যাক্টিভিটি ফি ও অন্যান্য ফি বাবদ ধার্য করা অর্থের মধ্যে উদ্যোক্তা, স্থানীয় প্রতিনিধি ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুপাতিক অংশ হারে স্থানীয় প্রতিনিধি ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে বিভাজিত হতে হবে।
ইউজিসি নির্ধারিত তিন সদস্যের সমন্বয়ে একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ থাকতে হবে। পাঠ্য তালিকায় কম্পিউটার সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রকৌশল বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকলে প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি কম্পিউটার ও প্রাসঙ্গিক যন্ত্রপাতিসহ ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হবে।
উচ্চ শিক্ষায় বাড়ছে না শিক্ষার্থী
সম্প্রতি ২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। এ পরীক্ষায় মোট দশ লাখ ১১ হাজার ৯৮৭ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। এসব শিক্ষার্থী এখন অনার্স (সম্মান) ও সমস্তরে ভর্তি হবে। আর স্নাতক, ডিগ্রি পাস কোর্স ও অন্যান্য স্তরে আসন রয়েছে প্রায় ১৪ লাখ। সেই হিসাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তত চার লাখ আসন ফাঁকা থাকতে পারে। কোভিড মহামারীতে বিশেষ মূল্যায়নে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানে ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন পরীক্ষার্থীর সবাইকে পাস দেয়া হয়। এরপর ২০২১ সালে এই স্তরে ১৩ লাখ ছয় হাজার ৬৮১ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। এসব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হয় ২০২২ সালে।
ইউজিসি থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে ৯ লাখের মতো। যা উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর প্রায় ৬৫ শতাংশ। তাছাড়া ২০২২ সালেও বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজারের বেশি আসন ফাঁকা ছিল।