alt

বিনোদন

শিল্পকলায় মিলনায়তন ‘সংরক্ষিত’, নাটক হবে কোথায়

বিনোদন প্রতিবেদক : মঙ্গলবার, ১০ জুন ২০২৫

জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তন মাসের দুই-তৃতীয়াংশ দিন সংরক্ষিত রাখা হচ্ছে নিজেদের নানা অনুষ্ঠানের নামে। নাটক প্রদর্শনীর জায়গা না পেয়ে হতাশ, ক্ষুব্ধ ঢাকার নাট্যকর্মীরা। এমনকি শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদের সদস্যরাই বলছেন, মিলনায়তন বরাদ্দের প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ হওয়া দরকার। ওই ‘সংরক্ষিত’ শব্দটির মধ্যে এক ধরনের ‘দুরভিসন্ধির’ আভাস মেলে। মিলনায়তন বরাদ্দের পক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলছেন তারা। এক দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকার নাট্যচর্চা হয়ে উঠেছে শিল্পকলা একাডেমি ঘিরে। সেখানকার তিনটি মিলনায়তন বরাদ্দ নিয়ে ৮০টিরও বেশি নাট্যদল তাদের নাটক প্রদর্শনী করে আসছে।

এর বাইরে বেইলি রোডে মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনেও প্রায় নিয়মিত প্রদর্শনী হয়। কিন্তু নাট্যকর্মীদের অভিযোগ, শিল্পকলা একাডেমি ‘সংরক্ষিত’ নামে মাসের বেশিরভাগ সময় মিলনায়তন ধরে রাখছে। সে কারণে জায়গা সংকটে নাটকের প্রদর্শনী কমে আসছে। অভিযোগ অস্বীকার করে শিল্পকলার একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘নীতিমালা অনুযায়ীই’ তারা মিলনায়তন বরাদ্দ দিচ্ছেন।

শিল্পকলার একাডেমির সচিব ও ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন বলছেন, সংরক্ষিত তারিখগুলোও পরে নাট্যদলগুলোকেই বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো নাট্যদল মিলনায়তন পাচ্ছে না এমন অভিযোগ সত্য নয়। তিনি বলেন, “কেউ মিলনায়তন পাচ্ছে না, আমার কাছে এমন কোনো অভিযোগ কেউ নিয়ে আসেনি। মিলনায়তন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে নীতিমালা অনুযায়ী।”

ঢাকা মহানগর নাট্য পর্ষদের আহ্বায়ক ঠান্ডু রায়হান বলেন, “আমি নিজে শিল্পকলার ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করে মিলনায়তন বরাদ্দে স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে কথা বলেছি। মহানগর নাট্য পর্ষদের নামে উৎসব করার জন্য এক সপ্তাহের জন্য মিলনায়তন বরাদ্দ চেয়েছি। আমাদের দেওয়া হয়নি।” ঢাকার অন্তত পাঁচটি নাট্যদলের দায়িত্বশীলরাও বলছেন, নিয়মানুযায়ী আবেদন করেও তারা মিলনায়তন বরাদ্দ পাচ্ছেন না। জায়গা সংকটে তাদের নাটকের মঞ্চায়ন স্থগিত কিংবা তারিখ একের পর এক পেছাতে হচ্ছে।

গত এপ্রিলে নাট্যদল ‘তাড়ুয়া’ মঞ্চে আনে ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ নাটক। টানা তিন দিনে চারটি প্রদর্শনী হয় এই নাটকের। এরিখ মারিয়া রেমার্কের যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত নাটকের চারটি প্রদশর্নীতে দর্শকের উপস্থিতি ছিল বেশ। চলতি জুন মাসের শেষের দিকে এ নাটকটির প্রদর্শনীর জন্য শিল্পকলার কাছে পাঁচ দিনের জন্য মিলনায়তন চেয়ে একদিনও বরাদ্দ পায়নি নাট্যদলটি।

বরাদ্দ পায়নি নাট্যদল ‘দেশনাটক’ও। অপরদিকে আরণ্যক নাট্যদল তিনটি মিলনায়তনেই একদিন করে বরাদ্দ চেয়েছিল, তাদের কেবল স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আরণ্যক নাট্যদলের জ্যেষ্ঠ সদস্য ঠান্ডু রায়হান বলেন, “আরণ্যক ৫০ বছরের পুরনো নাট্যদল। সেটিকে একদিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে। আরণ্যক তিনটি মিলনায়তনেই একদিন করে বরাদ্দ চেয়েছিল।” জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তন বরাদ্দের তালিকায় দেখা যায়, মে মাসে তিন মিলনায়তনে ৯৩ দিনের মধ্যে ৫৪ দিন ‘সংরক্ষিত’ ছিল শিল্পকলা একাডেমি নিজের জন্য। এর মধ্যে জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তন ২০ দিন, স্টুডিও থিয়েটার হল ২২ দিন ও এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল সংরক্ষিত রাখা হয় ১২ দিন।

নাট্যদল ঢাকা থিয়েটারের সদস্য শাহজাদা সম্রাট বলেন, “ঈদের ছুটিতেও আগে শিল্পকলায় নাটকের প্রদর্শনী হত। আর এবার সরকারি অন্যান্য দপ্তরের মত শিল্পকলার মিলনায়তনও শুক্র-শনিবার বন্ধ রাখা হচ্ছে। শিল্পকলার মিলনায়তন তো বিনোদনকেন্দ্র। এটা তো শুক্র ও শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটির হিসেবে থাকার কথা নয়।” ঈদের ছুটির পর ১৫ জুন খুলবে নাট্যশালার মিলনায়তন। তবে ১৫ থেকে ১৯ জুন, ২৩ থেকে ২৫ এবং ৩০ জুনও স্টুডিও থিয়েটার হল সংরক্ষিত নামে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। জুন মাসে শুধু সাত দিন নাট্যদলগুলো স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তন বরাদ্দ পেয়েছে। এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল জুন মাসে নয় দিন বরাদ্দ পেয়েছে নাট্যদলগুলো। ঈদের পর মূকাভিনয় উৎসব, পুতুল নাট্য উৎসব, যাত্রা উৎসবের নামে সাত দিন বরাদ্দ নিয়েছে শিল্পকলার নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ। মূল মিলনায়তনও শব্দ সরঞ্জাম নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মশালা, আলোক সরঞ্জাম কর্মশালার নামে শিল্পকলা নিজের নামে বরাদ্দ রেখেছে। সংগীত ভবনে আলাদা মিলনায়তন থাকার পরও বিশ্বসংগীত দিবসে নাট্যশালার মূল মিলনায়তন একদিন বরাদ্দ রেখেছে শিল্পকলার নামে।

শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদের সভা ‘নিয়মিত না হওয়ায়’ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারছে না বলে জানিয়েছেন পরিষদের একাধিক সদস্য। পরিচালনা পরিষদ সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিল্পকলা নিজের নামে মিলনায়তন বরাদ্দ রাখতেই পারে। তবে তার যথাযথ ব্যাখ্যাও থাকতে হবে। বরাদ্দ তালিকায় এভাবে ‘সংরক্ষিত’ লিখে দেওয়াটা তো দায়িত্বশীল আচরণ হয় না। কী জন্যে সংরক্ষিত, তার ব্যাখ্যাও থাকতে হবে।”

লিয়াকত আলী লাকী শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকার সময় পরিচালনা পরিষদের সবশেষ সভা হয়েছিল ২০২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। জুলাইয়ে পটপরিবর্তনের পর নতুন করে গঠিত পরিষদের সভা হয় গত ১৮ ডিসেম্বর। পরিচালনা পরিষদের আরেক সদস্য আজাদ আবুল কালাম বলেন, “কোনো নতুন নাটক একবার মঞ্চায়িত হওয়ার পর দেখা যায় তিন-চার মাস আর মিলনায়তন বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য আর মঞ্চায়নও হচ্ছে না। এটা খুবই দুঃখজনক।

“ইদানিং ‘সংরক্ষিত’ নামে শিল্পকলা নিজের কাছে মিলনায়তন আটকে রাখছে। এটা খুবই অস্বচ্ছ একটা প্রক্রিয়া এবং এই ‘সংরক্ষিত’ শব্দটার মধ্যে কেমন জানি একটা দুরভিসন্ধি রয়েছে।” তিনি বলেন, “মিলনায়তন বরাদ্দে আদৌ কোনো নীতিমালা আছে কিনা, তা মানা হচ্ছে কিনাৃ নাট্যকর্মীরা অনেকেই জানেন না কারা মিলনায়তন বরাদ্দ ঠিক করেন, কীভাবে ঠিক করা হয়। এই প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হওয়া জরুরি।”

থিয়েটার পত্রিকা ক্ষ্যাপার নির্বাহী সম্পাদক ও আরণ্যক নাট্যদলের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য অপু মেহেদী বলেন, “নাট্যশালার মিলনায়তন বরাদ্দ নিয়ে তো স্বেচ্ছাচারিতা অনেক আগে থেকেই চলছে। বিগত সরকারের সময় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নামে কিছু লোক ঠিক করত, কারা মিলনায়তন পাবে। তাদের মর্জিমত মিলনায়তন বরাদ্দ দেওয়া হত। “এখন শিল্পকলার কয়েকজন কর্মকর্তা নির্ধারণ করছে কে মিলনায়তন বরাদ্দ পাবে, আর কে পাবে না। হয়ত তাদের পেছনে আরও বড় কারও হাত রয়েছে, যাকে দেখা যায় না। যেই করুক, এই স্বেচ্ছাচারিতা চলতে দেওয়া যায় না। মিলনায়তন বরাদ্দের ক্ষেত্রে একটি নিয়ম থাকা উচিত।”

শিল্পকলা নিজেরাই ‘ইভেন্ট অর্গানাইজারে’ পরিণত হচ্ছে মন্তব্য করে নাট্যদল ‘অনুস্বর’ এর সদস্য মাহফুজ সুমন বলেন, “নাট্যদলসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহযোগিতা করবে শিল্পকলা। তা না করে ইভেন্ট প্রতিষ্ঠানের মত কিছু দায়সারা অনুষ্ঠান আয়োজন করে যাচ্ছে। এদিকে মিলনায়তন সংকটে নাটকের প্রদর্শনী করতে পারছে না নাট্যদলগুলো। এটা দুঃখজনক।”

জাতীয় নাট্যশালার মিলনায়তন বরাদ্দের নীতিমালায় নাট্যশালা নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, নাট্যচর্চার সার্বিক উৎসাহ, উন্নয়ন, প্রসার ও বিকাশ, নাট্যচর্চার জন্য যথাযথভাবে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে নাট্যশালা করা হয়েছে। মঞ্চায়ন উপযোগী যথার্থ থিয়েটার হল নির্মাণের মাধ্যমে নাট্যকর্মীদের জন্য বস্তুগত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবে নাট্যশালা। মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হল নামে নাট্যশালায় তিনটি মিলনায়তন রয়েছে। এর বাইরে সেমিনার কক্ষ, প্রশিক্ষণ কক্ষ রয়েছে নাট্যশালায়।

এগুলো বরাদ্দের ক্ষেত্রে পৃথক নীতিমালা আছে। আলাদা আবেদন ফরমে বরাদ্দ পেতে আবেদন করতে হয়। নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে মূল হলের ভাড়া ৫ হাজার টাকা, অন্য সাংস্কৃতিক আয়োজনের জন্য ২০ হাজার টাকা। পরীক্ষণ থিয়েটার হলের ভাড়া ৩ হাজার টাকা। স্টুডিও থিয়েটার হলে নাটকের জন্য ভাড়া ২ হাজার টাকা, অন্য সাংস্কৃতিক আয়োজনের জন্য ভাড়া ৫ হাজার টাকা।

এর মধ্যে ৭৫০ আসনের মূল মিলনায়তন বরাদ্দের নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রধানত নাটক মঞ্চায়নের জন্য এটি ব্যবহৃত হবে। রাষ্ট্রীয়/ সরকারি অনুষ্ঠানের জন্য এ হল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ পাবে। একাডেমির কোনো নাট্যানুষ্ঠান, নাট্যোৎসব, আবৃত্তি ও অন্যান্য নাট্য সংক্রান্ত অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য হল ব্যবহারের সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। একাডেমির জন্য নির্ধারিত কোনো দিনে অনুষ্ঠান আয়োজন সম্ভব না হলে সেদিন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান (নাট্য সংক্রান্ত) ভাড়া নিতে পারবে।

একাডেমির জরুরি কোনো অনুষ্ঠান বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন জরুরি হয়ে পড়লে পূর্বে দেওয়া হলের বরাদ্দ বাতিলও করা যাবে। আর ৩৫০ আসনের পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তন বা এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলটি নাট্যনুষ্ঠান, নাট্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ, নাট্যকর্মশালা, গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য মঞ্চায়ন, মূকাভিনয়, শ্রুতি নাটক, আবৃত্তি ও আবৃত্তি বিষয়ক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা যাবে। সাধারণভাবে প্রতি মাসে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল সাত দিন ব্যবহার করতে পারবে; তবে গত মে মাসে হলটি ১১ দিন বরাদ্দ ছিল শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব অনুষ্ঠানের জন্য। শিল্পকলা একাডেমির জন্য নির্ধারিত দিনের বাইরে বাকি দিনগুলোতে অন্যান্য নাট্যদল এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল ব্যবহারের সুযোগ পাবে। এ ক্ষেত্রে একাডেমির নিজস্ব প্রযোজনা, নাট্যোৎসব ও নাট্যধর্মী অন্যান্য অনুষ্ঠান সর্বাধিক গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার পাবে।

শিল্পকলা একাডেমির সংরক্ষিত মাসিক সাত দিনের মধ্যে যেসব দিন ব্যবহার করবে না, সেসব দিন অন্যান্য নাট্যদলের জন্য বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ পাবে। এ ক্ষেত্রে একাডেমির মহাপরিচালক যে কোনো নাট্যদল/সংগঠনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হল ব্যবহারের বরাদ্দ দিতে পারবেন। অপরদিকে ২২৫ আসনের স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তন প্রধানত ক্ষুদ্র পরিসর, নিরীক্ষাধর্মী নাটক ও লোকনাট্য মঞ্চায়নের জন্য ব্যবহৃত হবে।

পাশাপাশি হল খালি থাকলে নতুন প্রযোজনা নির্মাণের কারিগরী মহড়ার জন্য হলটি ব্যবহার করা যাবে। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক স্টুডিও থিয়েটার বরাদ্দের অনুমোদন দেবেন। তিনি অপর কোনো কর্মকর্তাকেও বরাদ্দ প্রদানের ক্ষমতা অর্পণও করতে পারেন।

নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিমাসে সাত দিন শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব অনুষ্ঠানের জন্য স্টুডিও থিয়েটার হল সংরক্ষিত থাকবে। যদিও গত মে মাসে শিল্পকলার নামে স্টুডিও থিয়েটার হল বরাদ্দ ছিল ২১ দিন। সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে নাট্যশালার ছুটি আলাদা নিয়মে হলেও জুন মাসে ঈদের সরকারি ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে ১০ দিন বন্ধ রাখা হয়েছে তিন মিলনায়তন। বাকি দিনগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত ও শিল্পকলার অনুষ্ঠানের নামে ১১ দিন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। জুন মাসে স্টুডিও থিয়েটার হল ১৩ দিন শিল্পকলা নিজের নামে সংরক্ষিত রেখেছে। এর সঙ্গে ঈদের বন্ধ ১০ দিন। ফলে মাত্র সাত দিন হল ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে নাট্যদলগুলো। এ মাসে মূল মিলনায়তন আট দিন নিজের জন্য রেখেছে শিল্পকলা একাডেমি। ঈদের বন্ধ আরও ১০ দিন। ফলে জুনে মূল মিলনায়তন ১২ দিন বরাদ্দ পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে নাট্যদলগুলো। প্রাচ্যনাটের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন আবুল কালাম বলেন, “এ নীতিমালা কীভাবে তৈরি হয়েছে নাট্যকর্মীদের অনেকেই জানেন না। মিলনায়তন বরাদ্দে কেমন যেন একটা লুকোচুরি লুকোচুরি খেলা। এই লুকোচুরি ব্যাপারটার মধ্যে কেমন যেন দুরভিসন্ধি আছে। “নাটকের জন্যই তো নাট্যশালা। তাহলে নাটক করতে মিলনায়তন বরাদ্দ পাওয়া যায় না কেন? এই নীতিমালা নিয়ে নাট্যকর্মীদের সঙ্গে শিল্পকলার বসা উচিত, কথা বলা উচিত। প্রয়োজনে নীতিমালা সংশোধন করা উচিত।”

তিনি বলেন, “মিলনায়তন বরাদ্দ পেতে এই যে শিল্পকলার কাছে গিয়ে হাতে পায়ে ধরার একটা প্রক্রিয়া, তাদের ইচ্ছা না হলে দেওয়া হবে না। এই আচরণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।” বেশিরভাগ সময় শিল্পকলার নামে মিলনায়তন বরাদ্দের অভিযোগের বিষয়ে শিল্পকলা একাডেমির সচিব মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন বলেন, “নীতিমালা অনুযায়ী মিলনায়তন বরাদ্দ হচ্ছে। নাট্যদলগুলোর দিক থেকে কোনো অভিযোগ আসেনি আমার কাছে।”

তিন দশক আগের ঢাকার তুলনায় এখন জনসংখ্যা ও আয়তন দুটোই বেড়েছে। কিন্তু নাটক মঞ্চায়নের ‘জায়গা বাড়েনি একটিও’। বেইলি রোড পরিচিত ছিল ‘নাটকপাড়া’ নামে। নব্বইয়ের দশকে সেখানে দুটি মঞ্চ ছিল, যার একটি ‘গাইড হাউস’ মিলনায়তন আর নেই। টিকে আছে মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহীম মিলনায়তন। নাটকপাড়া শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনগুলোকে কেন্দ্র করে সরে এসেছে সেগুনবাগিচায়।

ফলে তিন দশকে ঢাকায় নাটক দেখার স্থান সেই দুইটিই রয়েছে। ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনে ভাগ হওয়ার পর শিল্পকলা একাডেমি কিংবা বেইলি রোডের মহিলা সমিতি দুটোই পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে। নিয়মিত নাটক হবে, এমন কোনো মঞ্চ নেই ঢাকা উত্তর সিটিতে। গত ১৮ এপ্রিল থিয়েটার আর্টিস্টস এসোসিয়েশন অব ঢাকা (টাড) আয়োজিত ‘বাজেট পর্যালোচনা’ বিষয়ক সেমিনারে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, “মিরপুর, উত্তরা, বসুন্ধরা, বনানী—এত বড় জনপদে থিয়েটারের জন্য একটি হলও নেই; নেই পর্যাপ্ত বইয়ের দোকান। সিনেমা হল। অথচ ধানমন্ডি থেকে গুলশান পর্যন্ত হাজারো রেস্টুরেন্টের ভিড়।

“অর্থাৎ আমাদের সমাজে ‘খাওয়া-দাওয়া’ হয়ে উঠেছে প্রধান বিনোদন। এটা এমন এক মানসিকতা, যেখানে জাতির মনন তৈরি হওয়ার সুযোগ কমে গেছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে হয়ত ধনী হচ্ছি, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও মানসিকভাবে গরিবই থেকে যাচ্ছি।” এর আগে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ করা হয়েছিল।

গুলিস্তানে ঘটা করে মহানগর নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করা হলেও সেখানে নাটক মঞ্চায়নের ‘পরিবেশ না থাকায়’ কেউ যায় না। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরের পাশে টাউন হল ঘিরে মিরপুরের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়মিত অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছিল। কিন্তু দুর্বল অবকাঠামোর কারণে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ২০০৩ সালে সেটি ভেঙে ফেলা হয়। এরপর ১৯ বছরেও সেটি আর নির্মাণ হয়নি। টাউন হল পুনরুদ্ধারে আন্দোলনও করেছেন মিরপুরের সংস্কৃতিকর্মীরা।

ছবি

‘তাণ্ডব’ প্রদর্শনী বন্ধে ক্ষুব্ধ আশফাক নিপুন, বললেন—মবের উল্লম্ফন বন্ধ করুন

ছবি

টাঙ্গাইলে ‘তাণ্ডব’ সিনেমার প্রদর্শনী বন্ধ, ‘হুমকি, নিরাপত্তাহীনতার’ অভিযোগ আয়োজকদের

ছবি

নাজনীন হাসান খানের পরিচালনায় ৩ নাটক

ছবি

ঈদে রাজীব মণি দাসের ৫ নাটক

ছবি

ঈদে আসছে জয়ের ‘ধোকা’

ছবি

গানের স্বত্ব ফিরে পেয়েছেন টেইলর

ছবি

মনির খানের হাতে নতুন ২০ গান

ছবি

ঈদের নাটক ‘যাত্রা বিরতি’

ছবি

বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্বের নতুন গল্প

ছবি

ইয়াশ-তিশার ‘কিসমত’

ছবি

গর্ভবতী মা ও নবজাতকদের পাশে পরীমনি

ছবি

‘এক্সিলেন্স ইন সাকসেস অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন যারা

ছবি

ঈদের ‘পাঁচফোড়ন’-এ গাইলেন সাব্বির-সিঁথি

ছবি

প্রকাশ্যে টগরের টিজার

ছবি

আসছে ‘হাইড এন সিক’

ছবি

ঈদে আবার বসছে ‘চাঁদের হাট’

ছবি

ভাবনা এবার যাত্রার নায়িকা

ছবি

বন্যহাতির আক্রমণ সজল-বুবলীর শুটিংয়ে

ছবি

মুক্তি পাচ্ছে না ‘শিরোনাম’

ছবি

আজ জলের গানের একক পরিবেশনা

ছবি

পুরস্কার পেলেন ইধিকা পাল

ছবি

রাশিয়ায় আবার পুরস্কৃত বাংলাদেশি ‘মাস্তুল’

ছবি

হানিমুনে ফ্রান্সে আছেন মেহজাবিন-আদনান

ছবি

অভিনয়ে ২৬ বছর র্পূণ করলেন শাকিব খান

ছবি

সালমান রুশদীর চরিত্রে নাসিরুদ্দিন শাহ

ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের ১০ শহরে গাইবেন বাপ্পা

ছবি

অর্পনা রানী রাজবংশীর রচনায় ‘জামাই বাড়িতে ঈদ’

ছবি

তৌসিফ-তটিনীর ‘মন মঞ্জিল’

ছবি

‘ইনসাফ’-এর গল্প খুব শক্ত -সঞ্জয় সমদ্দার

ছবি

আলিয়া ফ্রান্সে, মুম্বাইয়ে কন্যা সামলাচ্ছেন রণবীর

ছবি

প্রকাশ্যে ‘টগর’ সিনেমার গান ‘১০০% দেশি’

ছবি

জোভান-নীহার ‘আশিকি’

ছবি

নারী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নিয়ে কর্মশালা

ফিরছে ব্ল্যাকপিঙ্ক

ছবি

‘তাণ্ডব’র ডাবিংয়ের কাজে ব্যস্ত জয়া

ছবি

গবেষণায় নজরুল পদক পেলেন জাককানইবি’র প্রথম শিক্ষক রশিদুন নবী

tab

বিনোদন

শিল্পকলায় মিলনায়তন ‘সংরক্ষিত’, নাটক হবে কোথায়

বিনোদন প্রতিবেদক

মঙ্গলবার, ১০ জুন ২০২৫

জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তন মাসের দুই-তৃতীয়াংশ দিন সংরক্ষিত রাখা হচ্ছে নিজেদের নানা অনুষ্ঠানের নামে। নাটক প্রদর্শনীর জায়গা না পেয়ে হতাশ, ক্ষুব্ধ ঢাকার নাট্যকর্মীরা। এমনকি শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদের সদস্যরাই বলছেন, মিলনায়তন বরাদ্দের প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ হওয়া দরকার। ওই ‘সংরক্ষিত’ শব্দটির মধ্যে এক ধরনের ‘দুরভিসন্ধির’ আভাস মেলে। মিলনায়তন বরাদ্দের পক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলছেন তারা। এক দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকার নাট্যচর্চা হয়ে উঠেছে শিল্পকলা একাডেমি ঘিরে। সেখানকার তিনটি মিলনায়তন বরাদ্দ নিয়ে ৮০টিরও বেশি নাট্যদল তাদের নাটক প্রদর্শনী করে আসছে।

এর বাইরে বেইলি রোডে মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনেও প্রায় নিয়মিত প্রদর্শনী হয়। কিন্তু নাট্যকর্মীদের অভিযোগ, শিল্পকলা একাডেমি ‘সংরক্ষিত’ নামে মাসের বেশিরভাগ সময় মিলনায়তন ধরে রাখছে। সে কারণে জায়গা সংকটে নাটকের প্রদর্শনী কমে আসছে। অভিযোগ অস্বীকার করে শিল্পকলার একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘নীতিমালা অনুযায়ীই’ তারা মিলনায়তন বরাদ্দ দিচ্ছেন।

শিল্পকলার একাডেমির সচিব ও ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন বলছেন, সংরক্ষিত তারিখগুলোও পরে নাট্যদলগুলোকেই বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো নাট্যদল মিলনায়তন পাচ্ছে না এমন অভিযোগ সত্য নয়। তিনি বলেন, “কেউ মিলনায়তন পাচ্ছে না, আমার কাছে এমন কোনো অভিযোগ কেউ নিয়ে আসেনি। মিলনায়তন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে নীতিমালা অনুযায়ী।”

ঢাকা মহানগর নাট্য পর্ষদের আহ্বায়ক ঠান্ডু রায়হান বলেন, “আমি নিজে শিল্পকলার ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করে মিলনায়তন বরাদ্দে স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে কথা বলেছি। মহানগর নাট্য পর্ষদের নামে উৎসব করার জন্য এক সপ্তাহের জন্য মিলনায়তন বরাদ্দ চেয়েছি। আমাদের দেওয়া হয়নি।” ঢাকার অন্তত পাঁচটি নাট্যদলের দায়িত্বশীলরাও বলছেন, নিয়মানুযায়ী আবেদন করেও তারা মিলনায়তন বরাদ্দ পাচ্ছেন না। জায়গা সংকটে তাদের নাটকের মঞ্চায়ন স্থগিত কিংবা তারিখ একের পর এক পেছাতে হচ্ছে।

গত এপ্রিলে নাট্যদল ‘তাড়ুয়া’ মঞ্চে আনে ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ নাটক। টানা তিন দিনে চারটি প্রদর্শনী হয় এই নাটকের। এরিখ মারিয়া রেমার্কের যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত নাটকের চারটি প্রদশর্নীতে দর্শকের উপস্থিতি ছিল বেশ। চলতি জুন মাসের শেষের দিকে এ নাটকটির প্রদর্শনীর জন্য শিল্পকলার কাছে পাঁচ দিনের জন্য মিলনায়তন চেয়ে একদিনও বরাদ্দ পায়নি নাট্যদলটি।

বরাদ্দ পায়নি নাট্যদল ‘দেশনাটক’ও। অপরদিকে আরণ্যক নাট্যদল তিনটি মিলনায়তনেই একদিন করে বরাদ্দ চেয়েছিল, তাদের কেবল স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আরণ্যক নাট্যদলের জ্যেষ্ঠ সদস্য ঠান্ডু রায়হান বলেন, “আরণ্যক ৫০ বছরের পুরনো নাট্যদল। সেটিকে একদিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে। আরণ্যক তিনটি মিলনায়তনেই একদিন করে বরাদ্দ চেয়েছিল।” জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তন বরাদ্দের তালিকায় দেখা যায়, মে মাসে তিন মিলনায়তনে ৯৩ দিনের মধ্যে ৫৪ দিন ‘সংরক্ষিত’ ছিল শিল্পকলা একাডেমি নিজের জন্য। এর মধ্যে জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তন ২০ দিন, স্টুডিও থিয়েটার হল ২২ দিন ও এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল সংরক্ষিত রাখা হয় ১২ দিন।

নাট্যদল ঢাকা থিয়েটারের সদস্য শাহজাদা সম্রাট বলেন, “ঈদের ছুটিতেও আগে শিল্পকলায় নাটকের প্রদর্শনী হত। আর এবার সরকারি অন্যান্য দপ্তরের মত শিল্পকলার মিলনায়তনও শুক্র-শনিবার বন্ধ রাখা হচ্ছে। শিল্পকলার মিলনায়তন তো বিনোদনকেন্দ্র। এটা তো শুক্র ও শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটির হিসেবে থাকার কথা নয়।” ঈদের ছুটির পর ১৫ জুন খুলবে নাট্যশালার মিলনায়তন। তবে ১৫ থেকে ১৯ জুন, ২৩ থেকে ২৫ এবং ৩০ জুনও স্টুডিও থিয়েটার হল সংরক্ষিত নামে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। জুন মাসে শুধু সাত দিন নাট্যদলগুলো স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তন বরাদ্দ পেয়েছে। এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল জুন মাসে নয় দিন বরাদ্দ পেয়েছে নাট্যদলগুলো। ঈদের পর মূকাভিনয় উৎসব, পুতুল নাট্য উৎসব, যাত্রা উৎসবের নামে সাত দিন বরাদ্দ নিয়েছে শিল্পকলার নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ। মূল মিলনায়তনও শব্দ সরঞ্জাম নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মশালা, আলোক সরঞ্জাম কর্মশালার নামে শিল্পকলা নিজের নামে বরাদ্দ রেখেছে। সংগীত ভবনে আলাদা মিলনায়তন থাকার পরও বিশ্বসংগীত দিবসে নাট্যশালার মূল মিলনায়তন একদিন বরাদ্দ রেখেছে শিল্পকলার নামে।

শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদের সভা ‘নিয়মিত না হওয়ায়’ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারছে না বলে জানিয়েছেন পরিষদের একাধিক সদস্য। পরিচালনা পরিষদ সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিল্পকলা নিজের নামে মিলনায়তন বরাদ্দ রাখতেই পারে। তবে তার যথাযথ ব্যাখ্যাও থাকতে হবে। বরাদ্দ তালিকায় এভাবে ‘সংরক্ষিত’ লিখে দেওয়াটা তো দায়িত্বশীল আচরণ হয় না। কী জন্যে সংরক্ষিত, তার ব্যাখ্যাও থাকতে হবে।”

লিয়াকত আলী লাকী শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকার সময় পরিচালনা পরিষদের সবশেষ সভা হয়েছিল ২০২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। জুলাইয়ে পটপরিবর্তনের পর নতুন করে গঠিত পরিষদের সভা হয় গত ১৮ ডিসেম্বর। পরিচালনা পরিষদের আরেক সদস্য আজাদ আবুল কালাম বলেন, “কোনো নতুন নাটক একবার মঞ্চায়িত হওয়ার পর দেখা যায় তিন-চার মাস আর মিলনায়তন বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য আর মঞ্চায়নও হচ্ছে না। এটা খুবই দুঃখজনক।

“ইদানিং ‘সংরক্ষিত’ নামে শিল্পকলা নিজের কাছে মিলনায়তন আটকে রাখছে। এটা খুবই অস্বচ্ছ একটা প্রক্রিয়া এবং এই ‘সংরক্ষিত’ শব্দটার মধ্যে কেমন জানি একটা দুরভিসন্ধি রয়েছে।” তিনি বলেন, “মিলনায়তন বরাদ্দে আদৌ কোনো নীতিমালা আছে কিনা, তা মানা হচ্ছে কিনাৃ নাট্যকর্মীরা অনেকেই জানেন না কারা মিলনায়তন বরাদ্দ ঠিক করেন, কীভাবে ঠিক করা হয়। এই প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হওয়া জরুরি।”

থিয়েটার পত্রিকা ক্ষ্যাপার নির্বাহী সম্পাদক ও আরণ্যক নাট্যদলের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য অপু মেহেদী বলেন, “নাট্যশালার মিলনায়তন বরাদ্দ নিয়ে তো স্বেচ্ছাচারিতা অনেক আগে থেকেই চলছে। বিগত সরকারের সময় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নামে কিছু লোক ঠিক করত, কারা মিলনায়তন পাবে। তাদের মর্জিমত মিলনায়তন বরাদ্দ দেওয়া হত। “এখন শিল্পকলার কয়েকজন কর্মকর্তা নির্ধারণ করছে কে মিলনায়তন বরাদ্দ পাবে, আর কে পাবে না। হয়ত তাদের পেছনে আরও বড় কারও হাত রয়েছে, যাকে দেখা যায় না। যেই করুক, এই স্বেচ্ছাচারিতা চলতে দেওয়া যায় না। মিলনায়তন বরাদ্দের ক্ষেত্রে একটি নিয়ম থাকা উচিত।”

শিল্পকলা নিজেরাই ‘ইভেন্ট অর্গানাইজারে’ পরিণত হচ্ছে মন্তব্য করে নাট্যদল ‘অনুস্বর’ এর সদস্য মাহফুজ সুমন বলেন, “নাট্যদলসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহযোগিতা করবে শিল্পকলা। তা না করে ইভেন্ট প্রতিষ্ঠানের মত কিছু দায়সারা অনুষ্ঠান আয়োজন করে যাচ্ছে। এদিকে মিলনায়তন সংকটে নাটকের প্রদর্শনী করতে পারছে না নাট্যদলগুলো। এটা দুঃখজনক।”

জাতীয় নাট্যশালার মিলনায়তন বরাদ্দের নীতিমালায় নাট্যশালা নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, নাট্যচর্চার সার্বিক উৎসাহ, উন্নয়ন, প্রসার ও বিকাশ, নাট্যচর্চার জন্য যথাযথভাবে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে নাট্যশালা করা হয়েছে। মঞ্চায়ন উপযোগী যথার্থ থিয়েটার হল নির্মাণের মাধ্যমে নাট্যকর্মীদের জন্য বস্তুগত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবে নাট্যশালা। মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হল নামে নাট্যশালায় তিনটি মিলনায়তন রয়েছে। এর বাইরে সেমিনার কক্ষ, প্রশিক্ষণ কক্ষ রয়েছে নাট্যশালায়।

এগুলো বরাদ্দের ক্ষেত্রে পৃথক নীতিমালা আছে। আলাদা আবেদন ফরমে বরাদ্দ পেতে আবেদন করতে হয়। নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে মূল হলের ভাড়া ৫ হাজার টাকা, অন্য সাংস্কৃতিক আয়োজনের জন্য ২০ হাজার টাকা। পরীক্ষণ থিয়েটার হলের ভাড়া ৩ হাজার টাকা। স্টুডিও থিয়েটার হলে নাটকের জন্য ভাড়া ২ হাজার টাকা, অন্য সাংস্কৃতিক আয়োজনের জন্য ভাড়া ৫ হাজার টাকা।

এর মধ্যে ৭৫০ আসনের মূল মিলনায়তন বরাদ্দের নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রধানত নাটক মঞ্চায়নের জন্য এটি ব্যবহৃত হবে। রাষ্ট্রীয়/ সরকারি অনুষ্ঠানের জন্য এ হল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ পাবে। একাডেমির কোনো নাট্যানুষ্ঠান, নাট্যোৎসব, আবৃত্তি ও অন্যান্য নাট্য সংক্রান্ত অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য হল ব্যবহারের সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। একাডেমির জন্য নির্ধারিত কোনো দিনে অনুষ্ঠান আয়োজন সম্ভব না হলে সেদিন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান (নাট্য সংক্রান্ত) ভাড়া নিতে পারবে।

একাডেমির জরুরি কোনো অনুষ্ঠান বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন জরুরি হয়ে পড়লে পূর্বে দেওয়া হলের বরাদ্দ বাতিলও করা যাবে। আর ৩৫০ আসনের পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তন বা এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলটি নাট্যনুষ্ঠান, নাট্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ, নাট্যকর্মশালা, গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য মঞ্চায়ন, মূকাভিনয়, শ্রুতি নাটক, আবৃত্তি ও আবৃত্তি বিষয়ক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা যাবে। সাধারণভাবে প্রতি মাসে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল সাত দিন ব্যবহার করতে পারবে; তবে গত মে মাসে হলটি ১১ দিন বরাদ্দ ছিল শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব অনুষ্ঠানের জন্য। শিল্পকলা একাডেমির জন্য নির্ধারিত দিনের বাইরে বাকি দিনগুলোতে অন্যান্য নাট্যদল এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল ব্যবহারের সুযোগ পাবে। এ ক্ষেত্রে একাডেমির নিজস্ব প্রযোজনা, নাট্যোৎসব ও নাট্যধর্মী অন্যান্য অনুষ্ঠান সর্বাধিক গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার পাবে।

শিল্পকলা একাডেমির সংরক্ষিত মাসিক সাত দিনের মধ্যে যেসব দিন ব্যবহার করবে না, সেসব দিন অন্যান্য নাট্যদলের জন্য বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ পাবে। এ ক্ষেত্রে একাডেমির মহাপরিচালক যে কোনো নাট্যদল/সংগঠনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হল ব্যবহারের বরাদ্দ দিতে পারবেন। অপরদিকে ২২৫ আসনের স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তন প্রধানত ক্ষুদ্র পরিসর, নিরীক্ষাধর্মী নাটক ও লোকনাট্য মঞ্চায়নের জন্য ব্যবহৃত হবে।

পাশাপাশি হল খালি থাকলে নতুন প্রযোজনা নির্মাণের কারিগরী মহড়ার জন্য হলটি ব্যবহার করা যাবে। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক স্টুডিও থিয়েটার বরাদ্দের অনুমোদন দেবেন। তিনি অপর কোনো কর্মকর্তাকেও বরাদ্দ প্রদানের ক্ষমতা অর্পণও করতে পারেন।

নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিমাসে সাত দিন শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব অনুষ্ঠানের জন্য স্টুডিও থিয়েটার হল সংরক্ষিত থাকবে। যদিও গত মে মাসে শিল্পকলার নামে স্টুডিও থিয়েটার হল বরাদ্দ ছিল ২১ দিন। সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে নাট্যশালার ছুটি আলাদা নিয়মে হলেও জুন মাসে ঈদের সরকারি ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে ১০ দিন বন্ধ রাখা হয়েছে তিন মিলনায়তন। বাকি দিনগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত ও শিল্পকলার অনুষ্ঠানের নামে ১১ দিন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। জুন মাসে স্টুডিও থিয়েটার হল ১৩ দিন শিল্পকলা নিজের নামে সংরক্ষিত রেখেছে। এর সঙ্গে ঈদের বন্ধ ১০ দিন। ফলে মাত্র সাত দিন হল ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে নাট্যদলগুলো। এ মাসে মূল মিলনায়তন আট দিন নিজের জন্য রেখেছে শিল্পকলা একাডেমি। ঈদের বন্ধ আরও ১০ দিন। ফলে জুনে মূল মিলনায়তন ১২ দিন বরাদ্দ পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে নাট্যদলগুলো। প্রাচ্যনাটের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন আবুল কালাম বলেন, “এ নীতিমালা কীভাবে তৈরি হয়েছে নাট্যকর্মীদের অনেকেই জানেন না। মিলনায়তন বরাদ্দে কেমন যেন একটা লুকোচুরি লুকোচুরি খেলা। এই লুকোচুরি ব্যাপারটার মধ্যে কেমন যেন দুরভিসন্ধি আছে। “নাটকের জন্যই তো নাট্যশালা। তাহলে নাটক করতে মিলনায়তন বরাদ্দ পাওয়া যায় না কেন? এই নীতিমালা নিয়ে নাট্যকর্মীদের সঙ্গে শিল্পকলার বসা উচিত, কথা বলা উচিত। প্রয়োজনে নীতিমালা সংশোধন করা উচিত।”

তিনি বলেন, “মিলনায়তন বরাদ্দ পেতে এই যে শিল্পকলার কাছে গিয়ে হাতে পায়ে ধরার একটা প্রক্রিয়া, তাদের ইচ্ছা না হলে দেওয়া হবে না। এই আচরণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।” বেশিরভাগ সময় শিল্পকলার নামে মিলনায়তন বরাদ্দের অভিযোগের বিষয়ে শিল্পকলা একাডেমির সচিব মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন বলেন, “নীতিমালা অনুযায়ী মিলনায়তন বরাদ্দ হচ্ছে। নাট্যদলগুলোর দিক থেকে কোনো অভিযোগ আসেনি আমার কাছে।”

তিন দশক আগের ঢাকার তুলনায় এখন জনসংখ্যা ও আয়তন দুটোই বেড়েছে। কিন্তু নাটক মঞ্চায়নের ‘জায়গা বাড়েনি একটিও’। বেইলি রোড পরিচিত ছিল ‘নাটকপাড়া’ নামে। নব্বইয়ের দশকে সেখানে দুটি মঞ্চ ছিল, যার একটি ‘গাইড হাউস’ মিলনায়তন আর নেই। টিকে আছে মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহীম মিলনায়তন। নাটকপাড়া শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনগুলোকে কেন্দ্র করে সরে এসেছে সেগুনবাগিচায়।

ফলে তিন দশকে ঢাকায় নাটক দেখার স্থান সেই দুইটিই রয়েছে। ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনে ভাগ হওয়ার পর শিল্পকলা একাডেমি কিংবা বেইলি রোডের মহিলা সমিতি দুটোই পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে। নিয়মিত নাটক হবে, এমন কোনো মঞ্চ নেই ঢাকা উত্তর সিটিতে। গত ১৮ এপ্রিল থিয়েটার আর্টিস্টস এসোসিয়েশন অব ঢাকা (টাড) আয়োজিত ‘বাজেট পর্যালোচনা’ বিষয়ক সেমিনারে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, “মিরপুর, উত্তরা, বসুন্ধরা, বনানী—এত বড় জনপদে থিয়েটারের জন্য একটি হলও নেই; নেই পর্যাপ্ত বইয়ের দোকান। সিনেমা হল। অথচ ধানমন্ডি থেকে গুলশান পর্যন্ত হাজারো রেস্টুরেন্টের ভিড়।

“অর্থাৎ আমাদের সমাজে ‘খাওয়া-দাওয়া’ হয়ে উঠেছে প্রধান বিনোদন। এটা এমন এক মানসিকতা, যেখানে জাতির মনন তৈরি হওয়ার সুযোগ কমে গেছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে হয়ত ধনী হচ্ছি, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও মানসিকভাবে গরিবই থেকে যাচ্ছি।” এর আগে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ করা হয়েছিল।

গুলিস্তানে ঘটা করে মহানগর নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করা হলেও সেখানে নাটক মঞ্চায়নের ‘পরিবেশ না থাকায়’ কেউ যায় না। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরের পাশে টাউন হল ঘিরে মিরপুরের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়মিত অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছিল। কিন্তু দুর্বল অবকাঠামোর কারণে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ২০০৩ সালে সেটি ভেঙে ফেলা হয়। এরপর ১৯ বছরেও সেটি আর নির্মাণ হয়নি। টাউন হল পুনরুদ্ধারে আন্দোলনও করেছেন মিরপুরের সংস্কৃতিকর্মীরা।

back to top