alt

আন্তর্জাতিক

মধ্যপ্রাচ্য কি না ফেরার অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে?

বিদেশী সংবাদ মাধ্যম : বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

ইসরায়েল যখন ইরানের ওপর হামলার মাত্রা ক্রমেই বাড়াচ্ছে, তখন একে এক মহাবিপর্যয়ের শুরু বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি রাষ্ট্র যদি উন্মুক্ত যুদ্ধের পথে যায়, তবে গোটা মধ্যপ্রাচ্যই ঢুকে পড়তে পারে এক অনির্দিষ্ট, ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যতের ভেতর। আন্তর্জাতিক কূটনীতি যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে এই অঞ্চলের জন্য অপেক্ষা করছে অন্ধকার ভবিষ্যৎ। টিআরটি ওয়ার্ল্ড এ খবর জানিয়েছে।

ইসরায়েলের দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গাজা থেকে লেবানন পর্যন্ত যুদ্ধে জড়ানোর আগে বারবার সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা, এমনকি সাবেক ইসরায়েলি কর্মকর্তারাও। তাদের মতে, নেতানিয়াহুর কোনও স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই।

গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ বাড়ার পর এখন ইসরায়েলের লক্ষ্য ইরান। এক বিশেষজ্ঞ দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, ইরানই এখন শেষ শত্রু। তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েলের এই হামলা সফল হতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এটি আবার নেতানিয়াহু সরকারের কোনও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ওপর নির্ভরশীল নয়।

ইস্তাম্বুল মেদেনিয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ওরসামের প্রেসিডেন্ট কাদির তেমিজ বলেন, এখানে এক ধরনের দোলাচল চলছে। তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনা এবং নেতানিয়াহু ও তার মিত্রদের ‘রেজিম চেঞ্জ’ এজেন্ডার মধ্যে এই দোলাচলের কথা উল্লেখ করেন।

নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতা ধ্বংস থেকে শুরু করে সরাসরি তেহরানে সরকার পরিবর্তনের কথা বলেছেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট সমর্থন ছাড়া এই লক্ষ্য দুটোই অসম্ভব। আমেরিকার ডানপন্থি মহলে স্টিভ ব্যানন ও টাকার কার্লসনের মতো প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর ইরানের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধের বিরোধিতা করছেন। তেমিজ টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, ইরানের বর্তমান সরকারের কোনও স্পষ্ট বিকল্প নেই। এ নিয়ে উদ্বেগ আছে। ৯২ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ দেশে সরকার পরিবর্তন হলে অচলাবস্থা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।

ইরান-কানাডিয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঘনছে তাজমিনি বলেন, এমকেও বা পাহলভি পুতুল সরকার চাপিয়ে দেওয়া হবে, এটা ইরানের সব মানুষ চায় না। তিনি এমকেও (মুজাহিদিন-ই-খাল্ক সংগঠন) ও ইসরায়েলের সমর্থক নির্বাসিত রাজপুত্র রেজা পাহলভির কথা উল্লেখ করেছেন। তারা ইরানে সরকার পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন। তবে ১৯৮০-এর ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে জোট বাঁধার পর এমকেও জনসমর্থন হারিয়েছে।

তেমিজের মতে, সরকার পরিবর্তনের ঝুঁকি বিবেচনায় কূটনৈতিক সমাধানই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত। তিনি বলেন, এই ইসরায়েলি এজেন্ডায় বিনিয়োগ করতে অনেকেই রাজি নন। আমার মনে হয়, আঞ্চলিক আরব দেশগুলোর মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হবে। সম্প্রতি কিছু আরব কূটনীতিক আমেরিকার সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক আলোচনা পুনরায় শুরু করার ইচ্ছার কথা পৌঁছে দিচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও তুরস্কসহ ২০টির বেশি আরব ও মুসলিম দেশ ইসরায়েলের হামলার নিন্দা করেছে।

তবে উত্তেজনা থেকেই যাচ্ছে। জি-৭ সম্মেলন থেকে হঠাৎ চলে যাওয়ার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের একটি অস্পষ্ট যুদ্ধবিরতির কথা বলেন এবং তেহরানকে মূলত দায়ী করেন। তিনি ইঙ্গিত দেন যে যুদ্ধবিরতির চেয়ে ‘বড় কিছু’ আসছে। তার এই মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই হামলা করতে পারে বলে ধারণা বাড়ছে।

ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, আমেরিকা ফার্স্ট মানে ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র পাবে না। আমেরিকাকে আবার মহান করুন! জি৭-এর চূড়ান্ত বিবৃতিতে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পাশাপাশি ইরানকে ‘আঞ্চলিক অস্থিরতা ও সন্ত্রাসের মূল উৎস’ বলা হয়েছে এবং তেহরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

তেমিজ বলেন, ইরান নিয়ে একটি সিদ্ধান্তমূলক মুহূর্ত আসছে। তবে তিনি মনে করেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত রাখাই ইসরায়েল, আমেরিকা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জন্য ভালো হবে। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী ফতোয়ার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যা পশ্চিমা বিশ্ব ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী এই ইস্যুকে সমাধান করতে পারে। খামেনি আগেই গণবিধ্বংসী অস্ত্রকে ‘মানবতার জন্য হুমকি’ বলে উল্লেখ করে তা হারাম (নিষিদ্ধ) ঘোষণা করেছেন।

২০১২ সালে ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছিলেন যে খামেনি পারমাণবিক বোমা তৈরির বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন। তেমিজ বলেন, যদি খামেনি স্পষ্ট ফতোয়া দেন, তাহলে ইরানের বর্তমান সরকার স্থিতিশীল, এই ধারণা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বিশ্লেষকরা ইরানের কৌশল নিয়ে ভিন্নমত দিলেও অনেকেই একমত যে এটি দেশটির অভ্যন্তরীণ সমর্থন ও অর্থনৈতিক-সামরিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে।

মূল প্রশ্ন হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরান কতদিন জবাব দিতে পারবে? মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক এডওয়ার্ড এরিকসন বলেন, আমি ভবিষ্যদ্বাণী করা ছেড়ে দিয়েছি। তবে ৯২ মিলিয়ন মানুষের দেশ (ইরান) ১০ মিলিয়ন মানুষের দেশের (ইসরায়েল) বিরুদ্ধে ক্লান্তিকর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। তিনি সতর্ক করে বলেন, ইরানের সহনশীলতা অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। রাশিয়া ও চীনের সমর্থন পেলে ইরান ইসরায়েলকে ক্লান্ত করে দিতে পারে।

তাজমিনিও ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরানের সহনশীলতার উদাহরণ টানেন। তবে সিরিয়া ও লেবাননে ইরানের প্রভাব কমেছে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। অবশ্য ইসরায়েলের ভেতরে ইরানের হামলা প্রমাণ করে যে তেহরান ইসরায়েলের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিতে পারে। ইরান সম্প্রতি ইসরায়েলের তেল শোধনাগার ও জ্বালানি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এরিকসনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের মতো স্থলযুদ্ধ ছাড়া ইরানকে বোমা বানানো থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। ইরানিরা ইসরায়েলের হামলায় অবাক হলেও তারা বছরের পর বছর সম্পদ ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

তাজমিনি বলেন, পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা খুবই কম। তবে নেতানিয়াহুর সময়ে অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ ড্যান স্টেইনবক ২০২৩ সালের একটি আমেরিকান যুদ্ধ-গেমের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ইরানের ২৫টি প্রধান সামরিক লক্ষ্যে ইসরায়েল ৫০টি পারমাণবিক হামলা চালায়। তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন ও নেতানিয়াহু সরকার ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কাঠামো ধ্বংসের পরিকল্পনা করছে। এর পরিণতি ভয়াবহ হবে।

ছবি

বৈশ্বিক তেল সরবরাহে হরমুজ প্রণালী কেন গুরুত্বপূর্ণ?

মস্কোর কাছে সামরিক সহায়তা চায়নি ইরান : পুতিন

ইসরায়েল-ইরান সংঘাত, হোয়াইট হাউজের সামনে বিক্ষোভ

ছবি

হামলায় যুক্তরাষ্ট্রকে জড়াতে চায় ইসরায়েল, ইরানের হুঁশিয়ারি

বাণিজ্য-ক্রিপ্টো নিয়ে আলোচনা করলেন পাকিস্তানি সেনাপ্রধান এবং ট্রাম্প

ছবি

ইরানে হামলার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন ট্রাম্প: সিবিএস

ছবি

ইরানে বন্ধ ইন্টারনেট, সাইবার হামলায় বিপর্যস্ত ব্যাংকিং ও ক্রিপ্টো লেনদেন

ছবি

তেহরানে ফের ইসরায়েলি হামলা

ছবি

আমি কী করব, কেউ জানে না: ট্রাম্প

ছবি

মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলার হুমকি তেহরানের

ছবি

আকাশে ৩০ সেকেন্ড, তারপর মৃত্যু: এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনার ট্র্যাজেডি ঘিরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন

ছবি

“আমেরিকার হস্তক্ষেপ অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনবে”—হুঁশিয়ারি খামেনির

ছবি

ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে ফোনালাপ

হামলায় যুক্তরাষ্ট্র অংশ নিলে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে : ইরান

ছবি

সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল, থেমে নেই ইরানও

ছবি

মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান

বিশ্বকে ‘পারমাণবিক মহাবিপর্যয়ের’ দিকে ঠেলছে ইসরায়েল : রাশিয়া

ছবি

হরমুজ প্রণালীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আহ্বান ইরানের সাবেক মন্ত্রীর

ছবি

তেহরানে সেন্ট্রিফিউজ ও ক্ষেপণাস্ত্র কারখানায় ইসরায়েলের হামলার দাবি

ছবি

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার মাঝেই ট্রাম্পের সঙ্গে হবে পাকিস্তান সেনাপ্রধানের বৈঠক

ছবি

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্যে ইংল্যান্ডের মার্কিন ঘাঁটি ছেড়েছে অন্তত চারটি যুদ্ধবিমান

ছবি

খামেনিকে এখনই ‘হত্যা’ নয়: ট্রাম্প

ছবি

ইরানের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ চান ট্রাম্প

ছবি

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের ‘টেকসই সমাধান’ চায় পশ্চিম, ট্রাম্প চান ‘সত্যিকার সমাপ্তি’

ছবি

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ট্রাম্পের কৌশল: চাপ, চুক্তি না কি পিছু হটা?

ছবি

‘জি-৭ সম্মেলন ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতির কোনো সম্পর্ক নেই’

ইরানে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতি নিন্দা জানালো ওআইসি

ছবি

ইরান-ইসরায়েলের হামলার মধ্যেই গাজায় চলছে হামলা

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের আগুনে ‘ঘি ঢেলেছেন’ ট্রাম্প: চীন

চীনের আতশবাজি কারখানায় বিস্ফোরণ: নিহত ৯, আহত ২৬

ছবি

ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে হামলা: নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন জনে

ছবি

ইরানের সামরিক প্রধান সাদমানিকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের

ছবি

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে হামলা স্বীকার করল ইসরায়েল

ছবি

খামেনিকে সরিয়ে দিলেই যুদ্ধ শেষ—বিতর্কিত মন্তব্য নেতানিয়াহুর

ছবি

যুদ্ধবিরতির ‘চায়’ ইরান, ইসরায়েলকে থামাতে ট্রাম্পের কাছে আহ্বান

ছবি

ইরানে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টায় ‘কৌশলগত ভুল’: মাখোঁ

tab

আন্তর্জাতিক

মধ্যপ্রাচ্য কি না ফেরার অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে?

বিদেশী সংবাদ মাধ্যম

বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

ইসরায়েল যখন ইরানের ওপর হামলার মাত্রা ক্রমেই বাড়াচ্ছে, তখন একে এক মহাবিপর্যয়ের শুরু বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি রাষ্ট্র যদি উন্মুক্ত যুদ্ধের পথে যায়, তবে গোটা মধ্যপ্রাচ্যই ঢুকে পড়তে পারে এক অনির্দিষ্ট, ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যতের ভেতর। আন্তর্জাতিক কূটনীতি যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে এই অঞ্চলের জন্য অপেক্ষা করছে অন্ধকার ভবিষ্যৎ। টিআরটি ওয়ার্ল্ড এ খবর জানিয়েছে।

ইসরায়েলের দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গাজা থেকে লেবানন পর্যন্ত যুদ্ধে জড়ানোর আগে বারবার সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা, এমনকি সাবেক ইসরায়েলি কর্মকর্তারাও। তাদের মতে, নেতানিয়াহুর কোনও স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই।

গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ বাড়ার পর এখন ইসরায়েলের লক্ষ্য ইরান। এক বিশেষজ্ঞ দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, ইরানই এখন শেষ শত্রু। তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েলের এই হামলা সফল হতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এটি আবার নেতানিয়াহু সরকারের কোনও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ওপর নির্ভরশীল নয়।

ইস্তাম্বুল মেদেনিয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ওরসামের প্রেসিডেন্ট কাদির তেমিজ বলেন, এখানে এক ধরনের দোলাচল চলছে। তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনা এবং নেতানিয়াহু ও তার মিত্রদের ‘রেজিম চেঞ্জ’ এজেন্ডার মধ্যে এই দোলাচলের কথা উল্লেখ করেন।

নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতা ধ্বংস থেকে শুরু করে সরাসরি তেহরানে সরকার পরিবর্তনের কথা বলেছেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট সমর্থন ছাড়া এই লক্ষ্য দুটোই অসম্ভব। আমেরিকার ডানপন্থি মহলে স্টিভ ব্যানন ও টাকার কার্লসনের মতো প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর ইরানের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধের বিরোধিতা করছেন। তেমিজ টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, ইরানের বর্তমান সরকারের কোনও স্পষ্ট বিকল্প নেই। এ নিয়ে উদ্বেগ আছে। ৯২ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ দেশে সরকার পরিবর্তন হলে অচলাবস্থা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।

ইরান-কানাডিয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঘনছে তাজমিনি বলেন, এমকেও বা পাহলভি পুতুল সরকার চাপিয়ে দেওয়া হবে, এটা ইরানের সব মানুষ চায় না। তিনি এমকেও (মুজাহিদিন-ই-খাল্ক সংগঠন) ও ইসরায়েলের সমর্থক নির্বাসিত রাজপুত্র রেজা পাহলভির কথা উল্লেখ করেছেন। তারা ইরানে সরকার পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন। তবে ১৯৮০-এর ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে জোট বাঁধার পর এমকেও জনসমর্থন হারিয়েছে।

তেমিজের মতে, সরকার পরিবর্তনের ঝুঁকি বিবেচনায় কূটনৈতিক সমাধানই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত। তিনি বলেন, এই ইসরায়েলি এজেন্ডায় বিনিয়োগ করতে অনেকেই রাজি নন। আমার মনে হয়, আঞ্চলিক আরব দেশগুলোর মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হবে। সম্প্রতি কিছু আরব কূটনীতিক আমেরিকার সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক আলোচনা পুনরায় শুরু করার ইচ্ছার কথা পৌঁছে দিচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও তুরস্কসহ ২০টির বেশি আরব ও মুসলিম দেশ ইসরায়েলের হামলার নিন্দা করেছে।

তবে উত্তেজনা থেকেই যাচ্ছে। জি-৭ সম্মেলন থেকে হঠাৎ চলে যাওয়ার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের একটি অস্পষ্ট যুদ্ধবিরতির কথা বলেন এবং তেহরানকে মূলত দায়ী করেন। তিনি ইঙ্গিত দেন যে যুদ্ধবিরতির চেয়ে ‘বড় কিছু’ আসছে। তার এই মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই হামলা করতে পারে বলে ধারণা বাড়ছে।

ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, আমেরিকা ফার্স্ট মানে ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র পাবে না। আমেরিকাকে আবার মহান করুন! জি৭-এর চূড়ান্ত বিবৃতিতে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পাশাপাশি ইরানকে ‘আঞ্চলিক অস্থিরতা ও সন্ত্রাসের মূল উৎস’ বলা হয়েছে এবং তেহরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

তেমিজ বলেন, ইরান নিয়ে একটি সিদ্ধান্তমূলক মুহূর্ত আসছে। তবে তিনি মনে করেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত রাখাই ইসরায়েল, আমেরিকা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জন্য ভালো হবে। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী ফতোয়ার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যা পশ্চিমা বিশ্ব ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী এই ইস্যুকে সমাধান করতে পারে। খামেনি আগেই গণবিধ্বংসী অস্ত্রকে ‘মানবতার জন্য হুমকি’ বলে উল্লেখ করে তা হারাম (নিষিদ্ধ) ঘোষণা করেছেন।

২০১২ সালে ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছিলেন যে খামেনি পারমাণবিক বোমা তৈরির বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন। তেমিজ বলেন, যদি খামেনি স্পষ্ট ফতোয়া দেন, তাহলে ইরানের বর্তমান সরকার স্থিতিশীল, এই ধারণা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বিশ্লেষকরা ইরানের কৌশল নিয়ে ভিন্নমত দিলেও অনেকেই একমত যে এটি দেশটির অভ্যন্তরীণ সমর্থন ও অর্থনৈতিক-সামরিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে।

মূল প্রশ্ন হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরান কতদিন জবাব দিতে পারবে? মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক এডওয়ার্ড এরিকসন বলেন, আমি ভবিষ্যদ্বাণী করা ছেড়ে দিয়েছি। তবে ৯২ মিলিয়ন মানুষের দেশ (ইরান) ১০ মিলিয়ন মানুষের দেশের (ইসরায়েল) বিরুদ্ধে ক্লান্তিকর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। তিনি সতর্ক করে বলেন, ইরানের সহনশীলতা অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। রাশিয়া ও চীনের সমর্থন পেলে ইরান ইসরায়েলকে ক্লান্ত করে দিতে পারে।

তাজমিনিও ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরানের সহনশীলতার উদাহরণ টানেন। তবে সিরিয়া ও লেবাননে ইরানের প্রভাব কমেছে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। অবশ্য ইসরায়েলের ভেতরে ইরানের হামলা প্রমাণ করে যে তেহরান ইসরায়েলের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিতে পারে। ইরান সম্প্রতি ইসরায়েলের তেল শোধনাগার ও জ্বালানি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এরিকসনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের মতো স্থলযুদ্ধ ছাড়া ইরানকে বোমা বানানো থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। ইরানিরা ইসরায়েলের হামলায় অবাক হলেও তারা বছরের পর বছর সম্পদ ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

তাজমিনি বলেন, পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা খুবই কম। তবে নেতানিয়াহুর সময়ে অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ ড্যান স্টেইনবক ২০২৩ সালের একটি আমেরিকান যুদ্ধ-গেমের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ইরানের ২৫টি প্রধান সামরিক লক্ষ্যে ইসরায়েল ৫০টি পারমাণবিক হামলা চালায়। তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন ও নেতানিয়াহু সরকার ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কাঠামো ধ্বংসের পরিকল্পনা করছে। এর পরিণতি ভয়াবহ হবে।

back to top