alt

আন্তর্জাতিক

‘ভারতে এক বছরেই ৯৪৭টি ঘৃণা অপরাধ, টার্গেট মুসলিমসহ সংখ্যালঘুরা’

বিদেশী সংবাদ মাধ্যম : সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

ভারতের গুজরাটে প্রায় দুই হাজার মুসলিম পরিবারের বস্তিঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে মোদি সরকার -এএফপি

ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অপরাধ (হেট ক্রাইম) বেড়েই চলেছে। শুধু মুসলিম ও খ্রিস্টান নয়, ঘৃণা অপরাধ বেড়ে গেছে দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধেও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফার শাসনের প্রথম বছরে এ ধরনের অপরাধের হার মারাত্মকভাবে বেড়েছে। মানবাধিকার রক্ষা সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর)’-এর সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে এ প্রবণতার চিত্র উঠে এসেছে।

মোদি সরকারের তৃতীয় দফার শাসনের প্রথম বছরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি, সেসব ঘটনায় রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক মদদ, তাদের উৎসাহদান এবং সামাজিক-রাজনৈতিক আদর্শগত পরিবর্তনগুলো এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুন মাসে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফার শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৯৪৭টি ঘৃণা অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণ, বাকি ৬০২টি ঘৃণা অপরাধ, যাতে হিন্দুত্ববাদীরা সংখ্যালঘুদের জানমালের ওপর সরাসরি ভয়ানক আক্রমণ করেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ৬০২টি ঘৃণা অপরাধের ঘটনার মধ্যে ১৭৩টিতে সংখ্যালঘুরা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৫টি ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিহত হয়েছেন। তাঁদের সবাই মুসলিম। এই এক বছরে ঘৃণা অপরাধে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫ জন হিন্দুও আছেন। অবশ্য তাঁরা আক্রমণের মূল নিশানা ছিলেন না। ঘটনাস্থলে থাকার কারণে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি।

এপিসিআর সংগঠনটি তৈরি হয়েছিল ২০০৬ সালে। তাদের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ভারতে দিন দিন ঘৃণা ভাষণ ও ঘৃণা অপরাধ বাড়লেও এবং তাতে প্রধানত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এসব অপরাধ রেকর্ড বা নথিভুক্ত করার কোনো পদ্ধতিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা নেই। দলিত হিন্দুদের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও অপরাধ নথিভুক্ত করা হয় ১৯৮৯ সালের তফসিল জাতি ও উপজাতি (অত্যাচার নিরোধ) আইন মোতাবেক।

এ আইনে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার বিশেষ বিধান রয়েছে; কিন্তু সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অপরাধ মোকাবেলায় এ ধরনের কোনো আইনি ব্যবস্থা এখনো তৈরি করা হয়নি। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, সামাজিক পরিচয়ের দরুন কোনো ব্যক্তি যখন আক্রান্ত হন, তাঁর জীবন বিপন্ন ও সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তা ঘৃণা অপরাধের আওতায় পড়ে। ঘৃণা ভাষণ মানুষকে হিংসাত্মক করে তোলে। সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি নষ্ট করে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। ঘৃণা ভাষণ হলো সেসব আপত্তিকর কথা, যার লক্ষ্য ব্যক্তির সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচয়।

এপিসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে সারা দেশে যে ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেসব ভাষণের ১৭৮টিই দিয়েছেন শাসক দল বিজেপির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু তা–ই নয়, ঘৃণা অপরাধ সবচেয়ে বেশি ঘটেছে বিজেপি–শাসিত রাজ্যগুলোতে। ঘৃণা ভাষণ ও অপরাধের প্রবণতাও এসব রাজ্যে বেশি। আরো দেখা গেছে, যে রাজ্যে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে নির্বাচনী প্রচারে ঘৃণা ভাষণ বেশি হচ্ছে। লোকসভা বা বিধানসভা ভোটেই শুধু নয়, স্থানীয় নির্বাচনেও ঘৃণা ভাষণ ও অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এক বছরের এই সময়কালে উত্তরাখন্ডের পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচন তার প্রমাণ।

এই প্রতিবেদনে আরো এক গুরুত্বপূর্ণ দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপির জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা ঘৃণা ভাষণ দিচ্ছেন। শুধু দিয়েই ক্ষান্ত নন তাঁরা, ঘৃণা অপরাধ ও অপরাধীদের সমর্থন ও মদদ দিচ্ছেন। এক বছরের ঘটনাবলির বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণের মধ্যে ১৭৮টি দিয়েছেন বিজেপি দলের সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে পাঁচটি ঘৃণা ভাষণ দিয়েছেন। ৬৩টি ভাষণ দিয়েছেন বিজেপির বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রীরা, ৭১টি ভাষণ দিয়েছেন অন্য নির্বাচিত ব্যক্তিরা। সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য, দুজন বিচারপতি এবং একজন রাজ্যপালও ঘৃণা ভাষণ দিয়েছেন।

শুধু এপিসিআরের প্রতিবেদনই নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী প্রচারের মূল বিষয় ছিল ঘৃণা ভাষণ। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের শীর্ষ নেতারা বারবার প্রান্তিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্য, শত্রুতা ও হিংসা উদ্রেক করার মতো ভাষণ দিয়েছেন।

সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে ১১০টি নির্বাচনী ভাষণে ইসলামবিরোধী বক্তব্য পেশ করেছিলেন। এপিসিআরের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিজেপি নেতাদের ঘৃণা ভাষণ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর হিংসাত্মক হয়ে ওঠার বড় কারণ। গত এক বছরের ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণের মধ্যে বিজেপি নেতাদের ১৭৮টি ছাড়া বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ও বজরং দলের নেতারা দিয়েছেন যথাক্রমে ২১ ও ২০টি।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের ৭ জুন থেকে চলতি বছরের ৭ জুন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ৯৪৭টি ঘৃণা অপরাধের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বিজেপি–শাসিত উত্তর প্রদেশ। শুধু এই রাজ্যেই ঘটেছে ২১৭টি ঘৃণা অপরাধের ঘটনা। বিজেপি–শাসিত মহারাষ্ট্র (১০১) সেই তালিকায় দ্বিতীয়। তৃতীয় স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ (১০০), চতুর্থ স্থানে উত্তরাখন্ড (৮৪)। এ ছাড়া বিজেপিশাসিত রাজস্থান (৬০), বিহার (৩৬), গুজরাট (২৩), হরিয়ানা (২৩), আসাম (২০) উল্লেখযোগ্য।

প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, দিল্লিতে এমন ঘটনা ঘটেছে ৪২টি ও ঝাড়খন্ডে ৫২টি। রাজনৈতিক ঘৃণা ভাষণ ও ঘৃণা অপরাধের ঘটনা সবচেয়ে কম ঘটেছে মণিপুরে (১), কাশ্মীরে (১), কেরালায় (২), তামিলনাড়ুতে (২), অন্ধ্র প্রদেশে (৩) এবং গোয়াতে (৩), কংগ্রেসশাসিত হিমাচল প্রদেশে (৩১), কর্ণাটকে (৩১), তৃণমূল কংগ্রেস–শাসিত পশ্চিমবঙ্গে (১৮) তুলনামূলকভাবে কম হলেও ঘৃণা ভাষণ ও ঘৃণা অপরাধপ্রবণতামুক্ত নয়।

এপিসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা ও তারপর ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অপরাধ বেড়ে যায়। গত ২৩ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত ঘৃণা অপরাধের আধিক্য দেখা দেয়, যদিও ঘৃণা ভাষণ বন্ধ হয় গত ১ জুন। এ সময়ের মধ্যে দেশে ৮৭টি ঘৃণা অপরাধ ঘটে, যার মধ্যে ৫১টি সরাসরি পেহেলগামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। এ সময়ের মধ্যে ১৩৬ জন মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।

ছবি

নেতানিয়াহুর অনড় অবস্থান, ট্রাম্প চান দ্রুত চুক্তি

গাজায় ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের মধ্যেই শুরু হচ্ছে যুদ্ধবিরতি আলোচনা

ছবি

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে খামেনি

পুতিনের পাশে কিম, জেলেনস্কিকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন ট্রাম্প

ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা ‘ফলপ্রসূ’ হয়েছে : জেলেনস্কি

যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিলেন ইলন মাস্ক

ছবি

মাস্কের নতুন দল গঠনের উদ্যোগ ‘হাস্যকর’: ট্রাম্প

ছবি

টেক্সাসে বন্যায় ৭৮ জনের মৃত্যু, শিশুই ২৮

ছবি

ইয়েমেনের ৩ বন্দর ও ১ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইসরায়েলের হামলা

ছবি

হামাসের শর্ত ‘অগ্রহণযোগ্য’ বললেও আলোচনা চালিয়ে যাবে ইসরায়েল

ছবি

৯ জুলাইয়ের পর কী হবে, পরিষ্কার নয়; শুল্ক বাড়ানোর হুমকি ট্রাম্পের

ছবি

ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের পর প্রথমবার প্রকাশ্যে এলেন খামেনি

ছবি

যুক্তরাষ্ট্রে ‘আমেরিকা পার্টি’ গঠনের ঘোষণা ইলন মাস্কের

ছবি

টেক্সাসে আকস্মিক বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৩, নিখোঁজ ২৭ শিশু

ছবি

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৬৪ ফিলিস্তিনি নিহত, ত্রাণ কেন্দ্রের কাছেও হামলা

ছবি

তুরস্কের একদিনে তুষারপাত, অন্যদিকে দাবানল

রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধে হারতে দিতে পারি না : ইইউকে চীন

ছবি

গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিল হামাস

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধে রাজি নয় ইরান : ট্রাম্প

ছবি

সিরিয়া কি ‘ইসরায়েলের’ সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে?

যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙে লেবাননে হামলা করল ইসরায়েল

ছবি

‘আগামী সপ্তাহেই’ গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির আশাবাদ ট্রাম্পের

ছবি

গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির পথে সম্ভাবনা, যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত প্রস্তাবে সম্মতি হামাসের

ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে হড়কা বানে ২৪ জনের মৃত্যু

শিকাগোতে বন্দুকধারীর হামলায় নিহত ৪

ছবি

তালেবান সরকারকে প্রথম দেশ হিসেবে রাশিয়ার স্বীকৃতি

ছবি

চীনের হামলা মোকাবিলায় ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতি তাইওয়ানের

গুপ্তচর সন্দেহ, হাজার হাজার আফগানকে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে ইরান

গাজার মানুষ নিরাপদে থাকুক, এটাই চাই : ট্রাম্প

ছবি

গাজায় গণহত্যা চালাতে ‘ক্ষুধা’কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল

ছবি

ট্রাম্পের ‘বিগ বিউটিফুল বিল’-এ কী আছে

ছবি

কংগ্রেসে উতরে গেল ট্রাম্পের ‘বিগ, বিউটিফুল বিল’

ছবি

তালেবান সরকারকে প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিল রাশিয়া

ছবি

র‌্যাপারের অ্যালবাম রিলিজ অনুষ্ঠানে রক্তক্ষয়ী হামলা, পালালো হামলাকারীরা

ছবি

ট্রাম্পের ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ যে প্রভাব ফেলবে যুক্তরাষ্ট্রে

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ২ বছর পিছিয়ে গেছে : পেন্টাগন

tab

আন্তর্জাতিক

‘ভারতে এক বছরেই ৯৪৭টি ঘৃণা অপরাধ, টার্গেট মুসলিমসহ সংখ্যালঘুরা’

বিদেশী সংবাদ মাধ্যম

ভারতের গুজরাটে প্রায় দুই হাজার মুসলিম পরিবারের বস্তিঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে মোদি সরকার -এএফপি

সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অপরাধ (হেট ক্রাইম) বেড়েই চলেছে। শুধু মুসলিম ও খ্রিস্টান নয়, ঘৃণা অপরাধ বেড়ে গেছে দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধেও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফার শাসনের প্রথম বছরে এ ধরনের অপরাধের হার মারাত্মকভাবে বেড়েছে। মানবাধিকার রক্ষা সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর)’-এর সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে এ প্রবণতার চিত্র উঠে এসেছে।

মোদি সরকারের তৃতীয় দফার শাসনের প্রথম বছরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি, সেসব ঘটনায় রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক মদদ, তাদের উৎসাহদান এবং সামাজিক-রাজনৈতিক আদর্শগত পরিবর্তনগুলো এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুন মাসে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফার শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৯৪৭টি ঘৃণা অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণ, বাকি ৬০২টি ঘৃণা অপরাধ, যাতে হিন্দুত্ববাদীরা সংখ্যালঘুদের জানমালের ওপর সরাসরি ভয়ানক আক্রমণ করেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ৬০২টি ঘৃণা অপরাধের ঘটনার মধ্যে ১৭৩টিতে সংখ্যালঘুরা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৫টি ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিহত হয়েছেন। তাঁদের সবাই মুসলিম। এই এক বছরে ঘৃণা অপরাধে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫ জন হিন্দুও আছেন। অবশ্য তাঁরা আক্রমণের মূল নিশানা ছিলেন না। ঘটনাস্থলে থাকার কারণে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি।

এপিসিআর সংগঠনটি তৈরি হয়েছিল ২০০৬ সালে। তাদের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ভারতে দিন দিন ঘৃণা ভাষণ ও ঘৃণা অপরাধ বাড়লেও এবং তাতে প্রধানত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এসব অপরাধ রেকর্ড বা নথিভুক্ত করার কোনো পদ্ধতিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা নেই। দলিত হিন্দুদের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও অপরাধ নথিভুক্ত করা হয় ১৯৮৯ সালের তফসিল জাতি ও উপজাতি (অত্যাচার নিরোধ) আইন মোতাবেক।

এ আইনে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার বিশেষ বিধান রয়েছে; কিন্তু সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অপরাধ মোকাবেলায় এ ধরনের কোনো আইনি ব্যবস্থা এখনো তৈরি করা হয়নি। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, সামাজিক পরিচয়ের দরুন কোনো ব্যক্তি যখন আক্রান্ত হন, তাঁর জীবন বিপন্ন ও সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তা ঘৃণা অপরাধের আওতায় পড়ে। ঘৃণা ভাষণ মানুষকে হিংসাত্মক করে তোলে। সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি নষ্ট করে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। ঘৃণা ভাষণ হলো সেসব আপত্তিকর কথা, যার লক্ষ্য ব্যক্তির সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচয়।

এপিসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে সারা দেশে যে ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেসব ভাষণের ১৭৮টিই দিয়েছেন শাসক দল বিজেপির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু তা–ই নয়, ঘৃণা অপরাধ সবচেয়ে বেশি ঘটেছে বিজেপি–শাসিত রাজ্যগুলোতে। ঘৃণা ভাষণ ও অপরাধের প্রবণতাও এসব রাজ্যে বেশি। আরো দেখা গেছে, যে রাজ্যে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে নির্বাচনী প্রচারে ঘৃণা ভাষণ বেশি হচ্ছে। লোকসভা বা বিধানসভা ভোটেই শুধু নয়, স্থানীয় নির্বাচনেও ঘৃণা ভাষণ ও অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এক বছরের এই সময়কালে উত্তরাখন্ডের পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচন তার প্রমাণ।

এই প্রতিবেদনে আরো এক গুরুত্বপূর্ণ দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপির জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা ঘৃণা ভাষণ দিচ্ছেন। শুধু দিয়েই ক্ষান্ত নন তাঁরা, ঘৃণা অপরাধ ও অপরাধীদের সমর্থন ও মদদ দিচ্ছেন। এক বছরের ঘটনাবলির বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণের মধ্যে ১৭৮টি দিয়েছেন বিজেপি দলের সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে পাঁচটি ঘৃণা ভাষণ দিয়েছেন। ৬৩টি ভাষণ দিয়েছেন বিজেপির বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রীরা, ৭১টি ভাষণ দিয়েছেন অন্য নির্বাচিত ব্যক্তিরা। সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য, দুজন বিচারপতি এবং একজন রাজ্যপালও ঘৃণা ভাষণ দিয়েছেন।

শুধু এপিসিআরের প্রতিবেদনই নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী প্রচারের মূল বিষয় ছিল ঘৃণা ভাষণ। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের শীর্ষ নেতারা বারবার প্রান্তিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্য, শত্রুতা ও হিংসা উদ্রেক করার মতো ভাষণ দিয়েছেন।

সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে ১১০টি নির্বাচনী ভাষণে ইসলামবিরোধী বক্তব্য পেশ করেছিলেন। এপিসিআরের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিজেপি নেতাদের ঘৃণা ভাষণ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর হিংসাত্মক হয়ে ওঠার বড় কারণ। গত এক বছরের ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণের মধ্যে বিজেপি নেতাদের ১৭৮টি ছাড়া বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ও বজরং দলের নেতারা দিয়েছেন যথাক্রমে ২১ ও ২০টি।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের ৭ জুন থেকে চলতি বছরের ৭ জুন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ৯৪৭টি ঘৃণা অপরাধের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বিজেপি–শাসিত উত্তর প্রদেশ। শুধু এই রাজ্যেই ঘটেছে ২১৭টি ঘৃণা অপরাধের ঘটনা। বিজেপি–শাসিত মহারাষ্ট্র (১০১) সেই তালিকায় দ্বিতীয়। তৃতীয় স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ (১০০), চতুর্থ স্থানে উত্তরাখন্ড (৮৪)। এ ছাড়া বিজেপিশাসিত রাজস্থান (৬০), বিহার (৩৬), গুজরাট (২৩), হরিয়ানা (২৩), আসাম (২০) উল্লেখযোগ্য।

প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, দিল্লিতে এমন ঘটনা ঘটেছে ৪২টি ও ঝাড়খন্ডে ৫২টি। রাজনৈতিক ঘৃণা ভাষণ ও ঘৃণা অপরাধের ঘটনা সবচেয়ে কম ঘটেছে মণিপুরে (১), কাশ্মীরে (১), কেরালায় (২), তামিলনাড়ুতে (২), অন্ধ্র প্রদেশে (৩) এবং গোয়াতে (৩), কংগ্রেসশাসিত হিমাচল প্রদেশে (৩১), কর্ণাটকে (৩১), তৃণমূল কংগ্রেস–শাসিত পশ্চিমবঙ্গে (১৮) তুলনামূলকভাবে কম হলেও ঘৃণা ভাষণ ও ঘৃণা অপরাধপ্রবণতামুক্ত নয়।

এপিসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা ও তারপর ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অপরাধ বেড়ে যায়। গত ২৩ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত ঘৃণা অপরাধের আধিক্য দেখা দেয়, যদিও ঘৃণা ভাষণ বন্ধ হয় গত ১ জুন। এ সময়ের মধ্যে দেশে ৮৭টি ঘৃণা অপরাধ ঘটে, যার মধ্যে ৫১টি সরাসরি পেহেলগামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। এ সময়ের মধ্যে ১৩৬ জন মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।

back to top