ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে দেশটির সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক অগ্রগতি পাচ্ছে রুশ বাহিনী। এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরেও রাশিয়ার হামলা চলছে। এ হামলা চালানো হচ্ছে গভীর রাতে ড্রোনের মাধ্যমে ইউক্রেনের শহর ও বেসামরিক স্থাপনাগুলোয়। হামলার জন্য ড্রোনের উৎপাদনও বাড়াচ্ছে মস্কো।
এসব ড্রোনের বেশির ভাগ দ্রুতগতির বা উচ্চ প্রযুক্তির নয়। বরং সেগুলো এতটাই সস্তা যে প্রতি রাতে ৭০০টির বেশি ড্রোন ছুড়তে পারছে ক্রেমলিন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিপুল পরিমাণ ড্রোন হামলার পেছনে রাশিয়ার লক্ষ্য হলো ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া এবং দেশটির নাগরিকদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ইরান থেকে শাহেদ ড্রোন কিনেছিল রাশিয়া। এখন প্রতি মাসে হাজার হাজার এ ধরনের ড্রোন তৈরি করতে বড় বড় কারখানা গড়ে তুলেছে মস্কো। রাশিয়ার এই কম দামি ড্রোন ঠেকাতে ইউক্রেনকে দামি গোলাবারুদ ব্যবহার করতে হচ্ছে। কারণ, কম দামি প্রতিরক্ষা কৌশলগুলো অতটাও কার্যকর নয়।
২০২৪ সালের তুলনায় গত মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার দৈনিক ড্রোন হামলার পরিমাণ প্রায় ১৪ গুণ বেড়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ইউক্রেনে প্রতিদিন গড়ে ১৪টি ড্রোন ছুড়েছিল রাশিয়া। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তা বেড়ে ৮০টির বেশিতে দাঁড়ায়। গত জুলাই মাসে প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে রাশিয়া। এর মধ্যে এক রাতে সর্বোচ্চ ৭২৮টি ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে।
ড্রোন হামলার এই বৃদ্ধি থেকে বোঝা যায়, কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে মনুষ্যবিহীন আকাশযানের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। নিজেদের বিমানবাহিনীর সক্ষমতার ঘাটতি পূরণে রাশিয়া ও ইউক্রেন—দুই পক্ষই নিজেদের ড্রোনগুলো আরও উন্নত করার দিকে ঝুঁকছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যৎ কোনো সংঘাতে এগিয়ে থাকার জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির ন্যাটো মিত্ররাও ড্রোন উন্নয়নে কাজ করছে।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (আরইউএসআই) গবেষক রবার্ট টলেস্ট বলেন, ‘ন্যাটোও হয়তো বড় পরিসরে ড্রোন ব্যবহারের দিকে যাবে। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মতো এত ব্যাপকহারে নয়। কারণ, আমাদের বিশাল বিমানবাহিনী রয়েছে। সেখানে আমরা বিনিয়োগ করেছি। এই বিমানবাহিনী খুব দ্রুত শক্তিশালী হামলা চালাতে পারে।’
এফপিভি ড্রোন: এফপিভি ড্রোনগুলোর বেশ কয়েকটি ধরন ব্যবহার করে রাশিয়া।এই ড্রোনগুলো সাধারণত সর্বোচ্চ ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। এফপিভি ড্রোনে করে ছোট বিস্ফোরক বহন করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ট্যাংক ধ্বংস করতে সক্ষম গ্রেনেডও। তবে মূল যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে ইউক্রেনের শহরগুলোতে হামলার জন্য বড় আকৃতির শাহেদ ড্রোন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে রাশিয়া।
শাহেদ-১৩১ ড্রোন: রাশিয়া মোট তিন ধরনের শাহেদ ড্রোন ব্যবহার করে থাকে। প্রথমেই রয়েছে শাহেদ-১৩১ বা গেরান-১ ড্রোন। এই ড্রোনগুলোর সর্বোচ্চ পাল্লা ৯০০ কিলোমিটার। ১০ থেকে ১৫ কেজি ওজনের বস্তু বা বিস্ফোরক বহন করতে পারে এটি।
শাহেদ-১৩৬ ড্রোন: এরপর রয়েছে শাহেদ-১৩৬ বা গেরান-২ ড্র্রোন। এই ড্রোনগুলো সর্বোচ্চ ১ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। শাহেদ-১৩৬ ড্রোনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার। এগুলো সর্বোচ্চ ৪০ কেজি বিস্ফোরক বহন করতে পারে। বর্তমানে রাশিয়ার আলাবুগা শহরে গোপন কারখানায় শাহেদ-১৩৬ ড্রোন তৈরি করছে মস্কো। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার লক্ষ্য ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ প্রতিদিন প্রায় ২০০টি শাহেদ-১৩৬ ড্রোন তৈরি করা।
শাহেদ-২৩৮ ড্রোন: রাশিয়ার শাহেদ-২৩৮ বা গেরান-৩ ড্রোনের আকার এই শ্রেণির ড্রোনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। এই ড্রোনগুলো সর্বোচ্চ আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬০০ কিলোমিটার। শাহেদ-২৩৮ ড্রোন ৫০ থেকে ৩০০ কেজি পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারে।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দার একটি সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে, ২০২২ সালে প্রতিটি শাহেদ ড্রোন কিনতে গড়ে দুই লাখ ডলার খরচ হতো রাশিয়ার।
খরচ কমেছে রাশিয়ার ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সিএনএনকে জানিয়েছেন, প্রতি মাসে ছয় হাজারের বেশি শাহেদ ড্রোন উৎপাদনের দিকে এগোচ্ছে রাশিয়া। যুদ্ধের শুরুর দিকে এ ধরনের ড্রোনগুলো ইরানের কাছ থেকে কিনত মস্কো। তবে রাশিয়ার অভ্যন্তরে সেগুলো উৎপাদন করতে এখন খরচ অনেক কম পড়ছে।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দার একটি সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে, ২০২২ সালে প্রতিটি শাহেদ ড্রোন কিনতে গড়ে দুই লাখ ডলার খরচ হতো রাশিয়ার। রাশিয়ার তাতারেস্তান অঞ্চলের আলাবুগা ড্রোন কারখানায় সেগুলো ব্যাপক আকারে উৎপাদনের পর এখন খরচ কমে গড়ে ৭০ হাজার ডলারে নেমে এসেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শাহেদ-১৩৬ ড্রোনগুলোর প্রতিটি তৈরি করতে রাশিয়ার ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডলার খরচ হচ্ছে। এর তুলনায় ভূমি থেকে আকাশে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধকের (ইন্টারসেপটর) দাম ৩০ লাখ ডলারের বেশি।
এই কম খরচের জন্য প্রতি রাতে ড্রোন হামলা চালানো রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি কোনো কোনো রাতে বড় পরিসরেও হামলা চালাতে পারছে তারা। যুদ্ধের শুরুর দিকে মাসে টেনেটুনে একবার বড় পরিসরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাত রাশিয়া। এখন গড়ে প্রায় প্রতি রাতেই ড্রোন দিয়ে এমন হামলা হচ্ছে বলে সিএসআইএসের বিশ্লেষণে দেখা গেছে।
সিএসআইএসের গবেষক ইয়াসিরর আতালানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে রাশিয়ার ছোড়া ড্রোন আঘাত হানার হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত এপ্রিল থেকে প্রায় ২০ শতাংশ ড্রোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ২০২৪ সালে তা ছিল গড়ে ১০ শতাংশের কম। তিনি বলেন, ‘একটি শাহেদ ড্রোন সেটির লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারছে, সেটি বিষয় নয়। ভয় ধরানো এই অস্ত্র বেসামরিক লোকজনের ওপর যে প্রভাব ফেলছে এবং আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর যে চাপ সৃষ্টি করছে, সেটিই মূল বিষয়।’
যুদ্ধের সম্মুখসারিতে এফপিভি ড্রোন ব্যবহার করে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে ইউক্রেনও। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের (আইএসডব্লিউ) রাশিয়াবিষয়ক গবেষক কাতেরিনা স্তেপানেঙ্কো বলেন, প্রযুক্তিগত প্রতিটি উদ্ভাবনের পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য দুই পক্ষই চেষ্টা করছে।
জবাবের গতি এতটাই দ্রুত যে মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই কোনো প্রযুক্তিগত সাফল্যের বিরুদ্ধে পাল্টা উদ্ভাবন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে কিছু উদ্ভাবন, যেগুলো আজ কাজে আসছে, তা আগামী মাসগুলোয় না-ও কাজে আসতে পারে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের আক্রমণাত্মক হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে ট্রাম্পের ইঙ্গিত
আইএসডব্লিউর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইউক্রেন ও রাশিয়া—দুই পক্ষই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত (এআই) ড্রোন নিয়ে কাজ করছে। এই ড্রোনগুলো এমনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেন সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একই সঙ্গে হামলা প্রতিহত করতে পারে এআই–চালিত এমন ড্রোন তৈরির চেষ্টাও করা হচ্ছে। এমন ড্রোন তৈরি করা হলে হামলা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের চেয়ে কম খরচ হবে।
গবেষক কাতেরিনা স্তেপানেঙ্কো বলেন, ‘এ ধরনের (এআইচালিত) ড্রোন নিয়ে ইউক্রেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে, তার বহু তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সেগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে মোতায়ন হতে দেখা যায়নি। ইউক্রেন যদি হামলা প্রতিহতকারী ড্রোন তৈরি করতে পারে, তাহলে তাদের সক্ষমতা বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর জন্য নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সংরক্ষণ করতে পারবে।’
শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে দেশটির সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক অগ্রগতি পাচ্ছে রুশ বাহিনী। এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরেও রাশিয়ার হামলা চলছে। এ হামলা চালানো হচ্ছে গভীর রাতে ড্রোনের মাধ্যমে ইউক্রেনের শহর ও বেসামরিক স্থাপনাগুলোয়। হামলার জন্য ড্রোনের উৎপাদনও বাড়াচ্ছে মস্কো।
এসব ড্রোনের বেশির ভাগ দ্রুতগতির বা উচ্চ প্রযুক্তির নয়। বরং সেগুলো এতটাই সস্তা যে প্রতি রাতে ৭০০টির বেশি ড্রোন ছুড়তে পারছে ক্রেমলিন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিপুল পরিমাণ ড্রোন হামলার পেছনে রাশিয়ার লক্ষ্য হলো ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া এবং দেশটির নাগরিকদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ইরান থেকে শাহেদ ড্রোন কিনেছিল রাশিয়া। এখন প্রতি মাসে হাজার হাজার এ ধরনের ড্রোন তৈরি করতে বড় বড় কারখানা গড়ে তুলেছে মস্কো। রাশিয়ার এই কম দামি ড্রোন ঠেকাতে ইউক্রেনকে দামি গোলাবারুদ ব্যবহার করতে হচ্ছে। কারণ, কম দামি প্রতিরক্ষা কৌশলগুলো অতটাও কার্যকর নয়।
২০২৪ সালের তুলনায় গত মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার দৈনিক ড্রোন হামলার পরিমাণ প্রায় ১৪ গুণ বেড়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ইউক্রেনে প্রতিদিন গড়ে ১৪টি ড্রোন ছুড়েছিল রাশিয়া। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তা বেড়ে ৮০টির বেশিতে দাঁড়ায়। গত জুলাই মাসে প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে রাশিয়া। এর মধ্যে এক রাতে সর্বোচ্চ ৭২৮টি ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে।
ড্রোন হামলার এই বৃদ্ধি থেকে বোঝা যায়, কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে মনুষ্যবিহীন আকাশযানের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। নিজেদের বিমানবাহিনীর সক্ষমতার ঘাটতি পূরণে রাশিয়া ও ইউক্রেন—দুই পক্ষই নিজেদের ড্রোনগুলো আরও উন্নত করার দিকে ঝুঁকছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যৎ কোনো সংঘাতে এগিয়ে থাকার জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির ন্যাটো মিত্ররাও ড্রোন উন্নয়নে কাজ করছে।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (আরইউএসআই) গবেষক রবার্ট টলেস্ট বলেন, ‘ন্যাটোও হয়তো বড় পরিসরে ড্রোন ব্যবহারের দিকে যাবে। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মতো এত ব্যাপকহারে নয়। কারণ, আমাদের বিশাল বিমানবাহিনী রয়েছে। সেখানে আমরা বিনিয়োগ করেছি। এই বিমানবাহিনী খুব দ্রুত শক্তিশালী হামলা চালাতে পারে।’
এফপিভি ড্রোন: এফপিভি ড্রোনগুলোর বেশ কয়েকটি ধরন ব্যবহার করে রাশিয়া।এই ড্রোনগুলো সাধারণত সর্বোচ্চ ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। এফপিভি ড্রোনে করে ছোট বিস্ফোরক বহন করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ট্যাংক ধ্বংস করতে সক্ষম গ্রেনেডও। তবে মূল যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে ইউক্রেনের শহরগুলোতে হামলার জন্য বড় আকৃতির শাহেদ ড্রোন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে রাশিয়া।
শাহেদ-১৩১ ড্রোন: রাশিয়া মোট তিন ধরনের শাহেদ ড্রোন ব্যবহার করে থাকে। প্রথমেই রয়েছে শাহেদ-১৩১ বা গেরান-১ ড্রোন। এই ড্রোনগুলোর সর্বোচ্চ পাল্লা ৯০০ কিলোমিটার। ১০ থেকে ১৫ কেজি ওজনের বস্তু বা বিস্ফোরক বহন করতে পারে এটি।
শাহেদ-১৩৬ ড্রোন: এরপর রয়েছে শাহেদ-১৩৬ বা গেরান-২ ড্র্রোন। এই ড্রোনগুলো সর্বোচ্চ ১ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। শাহেদ-১৩৬ ড্রোনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার। এগুলো সর্বোচ্চ ৪০ কেজি বিস্ফোরক বহন করতে পারে। বর্তমানে রাশিয়ার আলাবুগা শহরে গোপন কারখানায় শাহেদ-১৩৬ ড্রোন তৈরি করছে মস্কো। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার লক্ষ্য ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ প্রতিদিন প্রায় ২০০টি শাহেদ-১৩৬ ড্রোন তৈরি করা।
শাহেদ-২৩৮ ড্রোন: রাশিয়ার শাহেদ-২৩৮ বা গেরান-৩ ড্রোনের আকার এই শ্রেণির ড্রোনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। এই ড্রোনগুলো সর্বোচ্চ আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬০০ কিলোমিটার। শাহেদ-২৩৮ ড্রোন ৫০ থেকে ৩০০ কেজি পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারে।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দার একটি সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে, ২০২২ সালে প্রতিটি শাহেদ ড্রোন কিনতে গড়ে দুই লাখ ডলার খরচ হতো রাশিয়ার।
খরচ কমেছে রাশিয়ার ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সিএনএনকে জানিয়েছেন, প্রতি মাসে ছয় হাজারের বেশি শাহেদ ড্রোন উৎপাদনের দিকে এগোচ্ছে রাশিয়া। যুদ্ধের শুরুর দিকে এ ধরনের ড্রোনগুলো ইরানের কাছ থেকে কিনত মস্কো। তবে রাশিয়ার অভ্যন্তরে সেগুলো উৎপাদন করতে এখন খরচ অনেক কম পড়ছে।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দার একটি সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে, ২০২২ সালে প্রতিটি শাহেদ ড্রোন কিনতে গড়ে দুই লাখ ডলার খরচ হতো রাশিয়ার। রাশিয়ার তাতারেস্তান অঞ্চলের আলাবুগা ড্রোন কারখানায় সেগুলো ব্যাপক আকারে উৎপাদনের পর এখন খরচ কমে গড়ে ৭০ হাজার ডলারে নেমে এসেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শাহেদ-১৩৬ ড্রোনগুলোর প্রতিটি তৈরি করতে রাশিয়ার ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডলার খরচ হচ্ছে। এর তুলনায় ভূমি থেকে আকাশে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধকের (ইন্টারসেপটর) দাম ৩০ লাখ ডলারের বেশি।
এই কম খরচের জন্য প্রতি রাতে ড্রোন হামলা চালানো রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি কোনো কোনো রাতে বড় পরিসরেও হামলা চালাতে পারছে তারা। যুদ্ধের শুরুর দিকে মাসে টেনেটুনে একবার বড় পরিসরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাত রাশিয়া। এখন গড়ে প্রায় প্রতি রাতেই ড্রোন দিয়ে এমন হামলা হচ্ছে বলে সিএসআইএসের বিশ্লেষণে দেখা গেছে।
সিএসআইএসের গবেষক ইয়াসিরর আতালানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে রাশিয়ার ছোড়া ড্রোন আঘাত হানার হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত এপ্রিল থেকে প্রায় ২০ শতাংশ ড্রোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ২০২৪ সালে তা ছিল গড়ে ১০ শতাংশের কম। তিনি বলেন, ‘একটি শাহেদ ড্রোন সেটির লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারছে, সেটি বিষয় নয়। ভয় ধরানো এই অস্ত্র বেসামরিক লোকজনের ওপর যে প্রভাব ফেলছে এবং আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর যে চাপ সৃষ্টি করছে, সেটিই মূল বিষয়।’
যুদ্ধের সম্মুখসারিতে এফপিভি ড্রোন ব্যবহার করে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে ইউক্রেনও। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের (আইএসডব্লিউ) রাশিয়াবিষয়ক গবেষক কাতেরিনা স্তেপানেঙ্কো বলেন, প্রযুক্তিগত প্রতিটি উদ্ভাবনের পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য দুই পক্ষই চেষ্টা করছে।
জবাবের গতি এতটাই দ্রুত যে মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই কোনো প্রযুক্তিগত সাফল্যের বিরুদ্ধে পাল্টা উদ্ভাবন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে কিছু উদ্ভাবন, যেগুলো আজ কাজে আসছে, তা আগামী মাসগুলোয় না-ও কাজে আসতে পারে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের আক্রমণাত্মক হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে ট্রাম্পের ইঙ্গিত
আইএসডব্লিউর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইউক্রেন ও রাশিয়া—দুই পক্ষই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত (এআই) ড্রোন নিয়ে কাজ করছে। এই ড্রোনগুলো এমনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেন সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একই সঙ্গে হামলা প্রতিহত করতে পারে এআই–চালিত এমন ড্রোন তৈরির চেষ্টাও করা হচ্ছে। এমন ড্রোন তৈরি করা হলে হামলা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের চেয়ে কম খরচ হবে।
গবেষক কাতেরিনা স্তেপানেঙ্কো বলেন, ‘এ ধরনের (এআইচালিত) ড্রোন নিয়ে ইউক্রেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে, তার বহু তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সেগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে মোতায়ন হতে দেখা যায়নি। ইউক্রেন যদি হামলা প্রতিহতকারী ড্রোন তৈরি করতে পারে, তাহলে তাদের সক্ষমতা বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর জন্য নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সংরক্ষণ করতে পারবে।’