দীর্ঘ ৮১ বছর ধরে স্মৃতি জাগানিয়া বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (বিবিসি)। কেবল বাংলা নয়, আরবি, ফার্সি, চীনা, কিরগিজ, উজবেক, হিন্দি, ইন্দোনেশিয়ান, তামিল ও উর্দু ভাষার রেডিও সম্প্রচারও বন্ধ হেয়ে যাচ্ছে বিবিসিতে। কোনো ভাষা বিভাগই অবশ্য পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না। অনলাইন সংবাদমাধ্যম হিসেবে অনেকগুলো ভাষার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে বিবিসি।
১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর বাংলায় ১৫ মিনিটের সাপ্তাহিক সম্প্রচার শুরুর মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছিল বিবিসি বাংলার রেডিও কার্যক্রম। পর্যায়ক্রমে সংবাদ সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৫ সালে। ৮১ বছরের বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় রেডিওতে এখন ’সংবাদ ও দৈনন্দিন ঘটনাবলী’ নিয়ে ৩০ মিনিটের দুটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে বিবিসি বাংলা। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ’প্রবাহ’ আর রাত সাড়ে ১০টায় ’পরিক্রমা’ এখনও শুনতে পার শ্রোতারা। ১৯৫৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে আঞ্জুমান আর বিচিত্রা ছাড়া তৃতীয় একটি আধঘণ্টার সাপ্তাহিক অধিবেশন শুরু। বিষয় ছিল ব্রিটিশ পত্রিকায় উপমহাদেশ প্রসঙ্গ পর্যালোচনা ও ইংরেজি শেখার আসর। ১৯৬৫ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে দৈনিক ১৫ মিনিটের প্রভাতী অনুষ্ঠান শুরু; তাতে থাকত ১০ মিনিটের বিশ্ব সংবাদ এবং ৫ মিনিটের সংবাদভাষ্য। ১৯৬৯ সালের ১ জুন থেকে দুটি বাংলা অনুষ্ঠান একত্রিত হয়ে অভিন্ন বাংলা বিভাগ শুরু এবং প্রতি সন্ধ্যায় ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান শুরু ‘প্রবাহ’ নামে। ১৯৯৪ সালে ঢাকায় এফ এম সম্প্রচার শুরু এবং সন্ধ্যেবেলা ৪০ মিনিটের প্রবাহের পর শুধু ১০০ এফএম-এ ২০ মিনিটের বাড়তি অনুষ্ঠান চালু। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে দুপুরবেলা আধাঘণ্টার অনুষ্ঠান শুরু। ২০০৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় দুপুরের অধিবেশন। ২০০৫ সালে চালু হয় বিবিসির বাংলা ওয়েবসাইট। ২০০৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সংলাপ নামে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি শুরু হয় সকালের দ্বিতীয় আধঘণ্টার অধিবেশন প্রত্যুষা। ২০০৮ সালের মার্চে এফএম সম্প্রচার সম্প্রসারিত হয় খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর ও কুমিল্লায়। ২০১১ সালের মার্চে সকালের দুটো অধিবেশন প্রভাতী ও প্রত্যুষা লন্ডন থেকে ঢাকা স্টুডিওতে স্থানান্তর করা হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে এফএম সম্প্রচার যায় বরিশাল, কক্সবাজার ও ঠাকুরগাঁওয়ে। অর্থাৎ ঢাকার বাইরে এফএম সম্প্রচারের পরিধি বিস্তৃত হয় নয়টি শহরে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের খবর পেতে বিবিসি শোনার জন্য মানুষের একত্রিত হওয়ার অভ্যস্ততায় পাবনার পাকশীতে একটি বাজারের নামই হয়ে যায় ‘বিবিসি বাজার’।
বিবিসি জানিয়েছে, বিভিন্ন ভাষার সম্প্রচার কমানোর সঙ্গে সঙ্গে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস থেকে ৩৮২ জন কর্মী কমানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে বছরে খরচ কমবে ৩২০ কোটি টাকার বেশি।
গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিবিসি বাংলায় যেসব রেডিও অনুষ্ঠান হয়, তা এখন ওয়েবসাইটেও শোনা যায়। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এসব অনুষ্ঠান আর কোনো মাধ্যমেই শোনা যাবে না। তবে ডিজিটাল মাধ্যমে বিবিসি বাংলার অন্যান্য কন্টেন্ট উপভোগ করা যাবে। লন্ডনে বিবিসি সদরদপ্তরে যেসব বিদেশি ভাষার বিভাগ আছে, কিছু দেশের ক্ষেত্রে সেখানেও কিছু কাটছাঁট করে সেসব দেশে অফিস চালু রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে ।
আর কতদিন চলবে বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার? এ প্রশ্নের উত্তরে শুক্রবার বিবিসির প্রবাহ অনুষ্ঠানে বাংলা বিভাগের প্রধান সাবির মুস্তাফা বলেন, “আমরা কোনো সময়সূচি পাইনি, কবের মধ্যে এটা বন্ধ করা হবে। তবে এটুকু বলতে পারি, আগামী বছর মার্চের মধ্যে এটা হবে। “আর ৬ মাস... এখন এটা জানুয়ারিতে হবে না ফেব্রুয়ারিতে হবে, এটা আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না। তবে মার্চের মধ্যে হবে- এটা আমি নিশ্চিত।”
বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক-কলামিষ্ট আফসান চৌধুরী ১৯৯৩-৯৪ সালে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা এবং ১৯৯৫-২০০২ পর্যন্ত বিবিসি বাংলার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রযোজনায় যুক্ত ছিলেন ।
বিবিসি বাংলার সম্প্রচার কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বললেন, “আমার মনে হয়, বিবিসি মানুষের অনেক নিকটে পৌঁছেছিল। এখনকার গণমাধ্যম কতটা নিকটে পৌঁছেছে, আমি বলতে পারব না। দীর্ঘদিন ধরে এটা ঘটেছে। এটাতো একদিন, দুদিনে হয়নি। তিনি বলেন, “বিবিসিকে অনেকগুলি বৈতরণী পার হতে হয়েছে। ট্রাস্টের জায়গায় ছিল বিবিসি। বিবিসিতে কোনো খবর হলে মানুষ সেটাকে বিশ্বাস করত।”
বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিবিসি বাংলার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে। ষাটের দশকের শেষ থেকে একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে এ দেশের মানুষের কাছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলতে ছিল বিবিসি। এবং সেইসব দিনে বিবিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পালন করেছিল। সে কথা তুলে ধরে আফসান চৌধুরী বলেন, “…তারা সবচেয়ে বেশি সংবাদ করেছিল এবং তাদের উপর সবচেয়ে বেশি আস্থাশীল ছিল মানুষ। কারণ তাদের বাংলা সার্ভিসটা ছিল। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা সার্ভিসও ইংরেজি সার্ভিসের নিউজটা নিয়ে করত। কাজেই সবাই ওটা শুনেছে।”
আফসান চৌধুরী বলেন, আশি বা নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও যখনই দেশ কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে গেছে, মানুষ যখন রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি, তারা নব ঘুরিয়ে কান পেতেছেন বিবিসিতে। “এখনতো গত কয়েক বছরে যেটা হয়েছে যে, ইন্টারনেট প্রধান হয়ে গেছে। পত্রিকাতো এখন আর কেউ সেভাবে পড়ে না। এখন কনভার্জেন্ট মিডিয়ার কাল। সবকিছুই অনলাইনে পাওয়া যায়। তো, বিবিসিতেও এটা হয়েছে।
আফসান চৌধুরীর ধারণা, বিবিসিতে যারা কাজ করেছেন, তারা যতটা স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে পেরেছেন, অন্যরা সে রকম সুযোগ পাননি বলেই । তিনি বলেন, মানুষের কাছাকাছি পৌঁছতে পারার কারণেই বিবিসি বাংলার সাংবাদিক ও উপস্থাপকদের নাম আর কণ্ঠ প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শ্রোতাদের কাছেও অতি পরিচিত ছিল এক সময়।
১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর বাংলায় ১৫ মিনিটের সাপ্তাহিক সম্প্রচার শুরু। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েল তখন ছিলেন বিবিসির বহির্দেশীয় বিভাগের ‘টকস প্রোডিউসার’, তিনি লিখতেন বার্তালিপি। আর সুধীন ঘোষ তা বাংলায় অনুবাদ করে সম্প্রচার করতেন। ১৯৪৯ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের শ্রোতাদের জন্য সপ্তাহে আলাদা ৩০ মিনিটের অনুষ্ঠান শুরু হয় ‘আঞ্জুমান’ নামে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে যুক্ত হয় নারীদের অনুষ্ঠান আর অধ্যাপক নুরুল মোমেনের পরিচালনায় ছোটদের জন্য ‘কাকলি’। বিচিত্রা থাকে ভারতীয় শ্রোতাদের জন্য।
৮১ বছরের পথ পরিক্রমায় অনেক সাফল্য আর জনপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছিল বিবিসি বাংলা। সেসবই এখন চলে যাচ্ছে স্মৃতির পাতায়। তবে সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের জন্য বিবিসি বাংলাকে বাংলাভাষাভাষী মানুষ মনে রাখবে অনেক দিন।
শনিবার, ০১ অক্টোবর ২০২২
দীর্ঘ ৮১ বছর ধরে স্মৃতি জাগানিয়া বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (বিবিসি)। কেবল বাংলা নয়, আরবি, ফার্সি, চীনা, কিরগিজ, উজবেক, হিন্দি, ইন্দোনেশিয়ান, তামিল ও উর্দু ভাষার রেডিও সম্প্রচারও বন্ধ হেয়ে যাচ্ছে বিবিসিতে। কোনো ভাষা বিভাগই অবশ্য পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না। অনলাইন সংবাদমাধ্যম হিসেবে অনেকগুলো ভাষার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে বিবিসি।
১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর বাংলায় ১৫ মিনিটের সাপ্তাহিক সম্প্রচার শুরুর মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছিল বিবিসি বাংলার রেডিও কার্যক্রম। পর্যায়ক্রমে সংবাদ সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৫ সালে। ৮১ বছরের বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় রেডিওতে এখন ’সংবাদ ও দৈনন্দিন ঘটনাবলী’ নিয়ে ৩০ মিনিটের দুটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে বিবিসি বাংলা। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ’প্রবাহ’ আর রাত সাড়ে ১০টায় ’পরিক্রমা’ এখনও শুনতে পার শ্রোতারা। ১৯৫৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে আঞ্জুমান আর বিচিত্রা ছাড়া তৃতীয় একটি আধঘণ্টার সাপ্তাহিক অধিবেশন শুরু। বিষয় ছিল ব্রিটিশ পত্রিকায় উপমহাদেশ প্রসঙ্গ পর্যালোচনা ও ইংরেজি শেখার আসর। ১৯৬৫ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে দৈনিক ১৫ মিনিটের প্রভাতী অনুষ্ঠান শুরু; তাতে থাকত ১০ মিনিটের বিশ্ব সংবাদ এবং ৫ মিনিটের সংবাদভাষ্য। ১৯৬৯ সালের ১ জুন থেকে দুটি বাংলা অনুষ্ঠান একত্রিত হয়ে অভিন্ন বাংলা বিভাগ শুরু এবং প্রতি সন্ধ্যায় ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান শুরু ‘প্রবাহ’ নামে। ১৯৯৪ সালে ঢাকায় এফ এম সম্প্রচার শুরু এবং সন্ধ্যেবেলা ৪০ মিনিটের প্রবাহের পর শুধু ১০০ এফএম-এ ২০ মিনিটের বাড়তি অনুষ্ঠান চালু। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে দুপুরবেলা আধাঘণ্টার অনুষ্ঠান শুরু। ২০০৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় দুপুরের অধিবেশন। ২০০৫ সালে চালু হয় বিবিসির বাংলা ওয়েবসাইট। ২০০৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সংলাপ নামে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি শুরু হয় সকালের দ্বিতীয় আধঘণ্টার অধিবেশন প্রত্যুষা। ২০০৮ সালের মার্চে এফএম সম্প্রচার সম্প্রসারিত হয় খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর ও কুমিল্লায়। ২০১১ সালের মার্চে সকালের দুটো অধিবেশন প্রভাতী ও প্রত্যুষা লন্ডন থেকে ঢাকা স্টুডিওতে স্থানান্তর করা হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে এফএম সম্প্রচার যায় বরিশাল, কক্সবাজার ও ঠাকুরগাঁওয়ে। অর্থাৎ ঢাকার বাইরে এফএম সম্প্রচারের পরিধি বিস্তৃত হয় নয়টি শহরে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের খবর পেতে বিবিসি শোনার জন্য মানুষের একত্রিত হওয়ার অভ্যস্ততায় পাবনার পাকশীতে একটি বাজারের নামই হয়ে যায় ‘বিবিসি বাজার’।
বিবিসি জানিয়েছে, বিভিন্ন ভাষার সম্প্রচার কমানোর সঙ্গে সঙ্গে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস থেকে ৩৮২ জন কর্মী কমানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে বছরে খরচ কমবে ৩২০ কোটি টাকার বেশি।
গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিবিসি বাংলায় যেসব রেডিও অনুষ্ঠান হয়, তা এখন ওয়েবসাইটেও শোনা যায়। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এসব অনুষ্ঠান আর কোনো মাধ্যমেই শোনা যাবে না। তবে ডিজিটাল মাধ্যমে বিবিসি বাংলার অন্যান্য কন্টেন্ট উপভোগ করা যাবে। লন্ডনে বিবিসি সদরদপ্তরে যেসব বিদেশি ভাষার বিভাগ আছে, কিছু দেশের ক্ষেত্রে সেখানেও কিছু কাটছাঁট করে সেসব দেশে অফিস চালু রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে ।
আর কতদিন চলবে বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার? এ প্রশ্নের উত্তরে শুক্রবার বিবিসির প্রবাহ অনুষ্ঠানে বাংলা বিভাগের প্রধান সাবির মুস্তাফা বলেন, “আমরা কোনো সময়সূচি পাইনি, কবের মধ্যে এটা বন্ধ করা হবে। তবে এটুকু বলতে পারি, আগামী বছর মার্চের মধ্যে এটা হবে। “আর ৬ মাস... এখন এটা জানুয়ারিতে হবে না ফেব্রুয়ারিতে হবে, এটা আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না। তবে মার্চের মধ্যে হবে- এটা আমি নিশ্চিত।”
বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক-কলামিষ্ট আফসান চৌধুরী ১৯৯৩-৯৪ সালে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা এবং ১৯৯৫-২০০২ পর্যন্ত বিবিসি বাংলার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রযোজনায় যুক্ত ছিলেন ।
বিবিসি বাংলার সম্প্রচার কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বললেন, “আমার মনে হয়, বিবিসি মানুষের অনেক নিকটে পৌঁছেছিল। এখনকার গণমাধ্যম কতটা নিকটে পৌঁছেছে, আমি বলতে পারব না। দীর্ঘদিন ধরে এটা ঘটেছে। এটাতো একদিন, দুদিনে হয়নি। তিনি বলেন, “বিবিসিকে অনেকগুলি বৈতরণী পার হতে হয়েছে। ট্রাস্টের জায়গায় ছিল বিবিসি। বিবিসিতে কোনো খবর হলে মানুষ সেটাকে বিশ্বাস করত।”
বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিবিসি বাংলার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে। ষাটের দশকের শেষ থেকে একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে এ দেশের মানুষের কাছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলতে ছিল বিবিসি। এবং সেইসব দিনে বিবিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পালন করেছিল। সে কথা তুলে ধরে আফসান চৌধুরী বলেন, “…তারা সবচেয়ে বেশি সংবাদ করেছিল এবং তাদের উপর সবচেয়ে বেশি আস্থাশীল ছিল মানুষ। কারণ তাদের বাংলা সার্ভিসটা ছিল। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা সার্ভিসও ইংরেজি সার্ভিসের নিউজটা নিয়ে করত। কাজেই সবাই ওটা শুনেছে।”
আফসান চৌধুরী বলেন, আশি বা নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও যখনই দেশ কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে গেছে, মানুষ যখন রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি, তারা নব ঘুরিয়ে কান পেতেছেন বিবিসিতে। “এখনতো গত কয়েক বছরে যেটা হয়েছে যে, ইন্টারনেট প্রধান হয়ে গেছে। পত্রিকাতো এখন আর কেউ সেভাবে পড়ে না। এখন কনভার্জেন্ট মিডিয়ার কাল। সবকিছুই অনলাইনে পাওয়া যায়। তো, বিবিসিতেও এটা হয়েছে।
আফসান চৌধুরীর ধারণা, বিবিসিতে যারা কাজ করেছেন, তারা যতটা স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে পেরেছেন, অন্যরা সে রকম সুযোগ পাননি বলেই । তিনি বলেন, মানুষের কাছাকাছি পৌঁছতে পারার কারণেই বিবিসি বাংলার সাংবাদিক ও উপস্থাপকদের নাম আর কণ্ঠ প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শ্রোতাদের কাছেও অতি পরিচিত ছিল এক সময়।
১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর বাংলায় ১৫ মিনিটের সাপ্তাহিক সম্প্রচার শুরু। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েল তখন ছিলেন বিবিসির বহির্দেশীয় বিভাগের ‘টকস প্রোডিউসার’, তিনি লিখতেন বার্তালিপি। আর সুধীন ঘোষ তা বাংলায় অনুবাদ করে সম্প্রচার করতেন। ১৯৪৯ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের শ্রোতাদের জন্য সপ্তাহে আলাদা ৩০ মিনিটের অনুষ্ঠান শুরু হয় ‘আঞ্জুমান’ নামে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে যুক্ত হয় নারীদের অনুষ্ঠান আর অধ্যাপক নুরুল মোমেনের পরিচালনায় ছোটদের জন্য ‘কাকলি’। বিচিত্রা থাকে ভারতীয় শ্রোতাদের জন্য।
৮১ বছরের পথ পরিক্রমায় অনেক সাফল্য আর জনপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছিল বিবিসি বাংলা। সেসবই এখন চলে যাচ্ছে স্মৃতির পাতায়। তবে সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের জন্য বিবিসি বাংলাকে বাংলাভাষাভাষী মানুষ মনে রাখবে অনেক দিন।