আবুল মাল আবদুল মুহিত
আহমদুল কবির মনু ভাই ছিলেন সুস্বাস্থ্যের যেন একখানা বিজ্ঞাপন। কথাবার্তায়-চলাফেরায় চটপট, চিন্তা-ভাবনায় আধুনিক ও প্রগতিবাদী, কাজকর্ম ও রাজনীতিতে গভীরভাবে আগ্রহী এবং ভোজনে বিলাসী এই ছিল তার সবসময়ের পরিচিতি।
আহমদুল কবির সাহেবের নাম অনেকদিন ধরে জানি, তবে তার সঙ্গে সরাসরি পরিচয় অনেক পরে। ১৯৬০ সালে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক হল প্রতিষ্ঠার পর অনেকদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ ছিল না। প্রতিনিধিদের বিষয়টির সমাধান হলে ১৯৪৫-৪৬ সালে প্রায় তিন বছর পর ছাত্র সংসদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন আহমদুল কবির, তবে নির্বাচিত হওয়ার অব্যবহিত পরে তিনি রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ায় চাকরি নিয়ে চলে যান। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই তার নাম জানতাম। তার বড় ভাইকে চিনতাম ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক খায়রুল কবির। ১৯৫১-৫৪ সময়ে ‘সংবাদ’-এর বংশাল রোডের কার্যালয়ে আনাগোনার কারণে বড় ভাই কবিরকে দেখি, তবে খুব যে আলাপচারিতা ছিল তা বলব না। ১৯৫৬ সালে বিলেতে মিসেস আহমদুল কবিরের সঙ্গে পরিচয় হয় তসদ্দুক আহমদ তসনু ভাইয়ের আসরে। মনু কবির মাঝে-মধ্যেই আলোচিত হতেন। বুদ্ধিতে দীপ্ত, কথায় সুপটু এবং কায়দা-কানুনে সাহেব। তার ব্যবসায়ী জীবনও ছিল আলোচনার বিষয়। পরিচয় হলো ঢাকায়। তিনি তখন বোধহয় একটি নির্দোষ পানীয় উৎপাদনে পথিকৃৎ শিল্পপতি। চা শিল্পেও তিনি সংযুক্ত এবং সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত। বহু বছর ধরে ব্যবস্থাপনায় একজন শীর্ষ ব্যক্তি। সম্পাদক হিসেবে তার আবির্ভাব অনেক পরে, বাংলাদেশে। তার চার ভাইয়ের সঙ্গেই তখন থেকে বেশ সখ্য, খায়রুল কবির সাহেব সাংবাদিকতা ও সরকারি গণসংযোগ পরিচালকগিরি ছেড়ে ব্যাংকার হয়েছেন। কানু কবির ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। শামীমকে চিনি ক্রিকেটের ভাল খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে আর মনু কবিরকে চিনি নানা বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনার মধ্যমণি হিসেবে। পরবর্তীকালে চা শিল্পে তার কাছ থেকে অনেক দীক্ষা পাই। কিন্তু সেটা বোধহয় বাংলাদেশে, পাকিস্তান আমলে নয়। চা বাগানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জমি চা চাষে ব্যবহৃত হয় না । এই জমিতে বর্তমানে অনেকেই কাঠ ব্যবসার সুযোগ নেন। এই জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিয়ে তার সঙ্গে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। চা শ্রমিকরা যে বংশপরম্পরায় একই ধরনের জীবনযাপন করে সেটি ছিল আর এক আলোচনার বিষয়। চা-পান একটি ভাল না মন্দ অভ্যাস সেটা নিয়ে এক সময় বিতর্ক চলতো; তবে প্রায় সাঁইত্রিশ বছর আগে চায়ে আমার আসক্তি হলে এই বিতর্ক শুধু একটি তাত্ত্বিক কচকচানিতে পরিণত হয়।
আহমদুল কবির শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস নিয়ে খুবই বিচলিত ছিলেন। নিজের ছাত্রজীবনের রাজনীতি চর্চার আলোকে তিনি কোনমতেই ছাত্রদের সন্ত্রাসী উদ্যোগ ও আগ্রহ মোটেই গ্রহণ করতে পারতেন না। ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে বয়োজ্যেষ্ঠদের যে এ বিষয়ে প্রভাব বিস্তারের দায়িত্ব রয়েছে সে বিষয়ে তিনি শুধু সচেতন ছিলেন না, বরং তিনি মনে করতেন এটি বয়োজ্যেষ্ঠদের কর্তব্য। ১৯৮০ সালে সলিমুল্লাহ হলের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রাক্তন ও নতুন ছাত্রদের মধ্যে বেশ সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। মনু কবির এই সুযোগে এই সম্পর্কটাকে আরও গভীর ও ব্যাপক করতে আগ্রহী ছিলেন। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশনার পুরোদায়িত্ব তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করেন। ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবারও মনু কবির নিজে থেকে এতে সম্পৃক্ত হন এবং আবারও ছাত্রদের সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধির বিষয়টির দিকে জোর দেন। তিনি মনে করতেন, সন্ত্রাসে লিপ্ত ছাত্ররা বিপথগামী। তারা সৎপথটি হয় জানে না, নয়তো তাতে আস্থাশীল নয়। তাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করে, আলোচনা করে সহজেই তাদের সৎপথে প্রত্যাবর্তন করা তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, ছাত্রদের এত সুন্দর ও মহৎ বিষয়ে নিবেদনের যে সুযোগ রয়েছে তাতে তারা কোনমতেই রাজনৈতিক সন্ত্রাসে লিপ্ত হতে পারে না। আমার একটি খেদ হলো যে, তিনি বিভিন্ন ছাত্রাবাসে সাবেকদের দল নিয়ে বর্তমানের সঙ্গে মতবিনিময় করতে চেয়েছিলেন। আমাকে সে ব্যাপারে দায়িত্বও দিয়েছিলেন; কিন্তু আমি সেই দায়িত্বটি সম্পাদনে ব্যর্থ হই। আমাদের রাজনৈতিক বিভক্তির কারণেই এই উদ্যোগটি সফল হতে পারেনি। অগ্রজের কাছে এই ব্যর্থতার বেদনা আমার সহজে যাবে না।
আহমদুল কবিরের বিচরণক্ষেত্র ছিল ব্যাপক ও বহুমুখী। তার একটি প্রশ্নের উত্তর আমি প্রস্তুত করতে পারিনি। এটি এখন সবার কাছে পেশ করছি। সত্তরের দশকের শেষে এবং আশির দশকের শুরুতে তার প্রশ্ন ছিল, অনবরত আমরা মুদ্রামান হ্রাস করে কি আমাদের তুলনামূলক দারিদ্র্য শুধু বৃদ্ধিই করে যাচ্ছি? প্রশ্নটি এক হিসেবে সব উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। মুদ্রামান এককালে সোনার দামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। সেই সোনার বিকল্প কিন্তু আজও হয়নি। ডলারও সেই পর্যায়ে পৌঁছেনি, আধুনিক ইউরোও সেখানে যেতে পারেনি। বর্তমানে মুদ্রার মান বাস্তবে নির্ধারিত হয় দেশজ সম্পদের ওপর ভিত্তি করে। মুরোদের অতিরিক্ত বিনিময়ে গেলেই মানের অবমূল্যায়ন হয়। তেমনি অব্যবহৃত সম্পদ ধরে রাখলে মানের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে। প্রায় দুই দশক আগে মুদ্রার মান নির্ধারণ ছিল একটি জটিল বিষয় এবং অবমূল্যায়নে থাকতো ঘোর আপত্তি। কিন্তু আশির দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে এই গোঁড়ামির অবসান হয়েছে। এখন মুদ্রামান নির্ধারণে সরকারের হাত ক্রমেই প্রত্যাহৃত হচ্ছে। তবে আমরা দেখেছি, খোলাবাজারের ওপর নির্ভর করেও মুদ্রামানে ধস নামতে পারে। অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়নের বিষয়টি তাই শুধু শুধুই অর্থনীতির সূত্র বা উপপাদ্য দিয়ে ব্যাখ্যা দেয়া চলে না। এতে অর্থনীতিতে ক্ষমতা ও সামর্থ্যের বিষয়টিও নিহিত। তাই নিশ্চিতভাবে কবির সাহেবের প্রশ্নের উত্তর আমি এখনও খুঁজেই চলেছি। সম্পাদক ও পরিচালক আহমদুল কবিরকে তিন বছর আগে, আমার একটি প্রশ্ন ছিল ‘সংবাদ’ পত্রিকাকে নিয়ে। ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকী সেই আদিকাল থেকে অতি উত্তম। ‘সংবাদ’ দেশের ও সমাজের প্রগতিতে নিরঙ্কুশভাবে নিবেদিত। ‘সংবাদ’ বাস্তবেই একটি সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত সংস্থাপন বা সংগঠন। ‘সংবাদ’-এর একটি গোষ্ঠী আছে—তারা সাংবাদিক, সংবাদপত্রকর্মী, লেখক, সাহিত্যিক এবং তারা পাঠক ও বান্ধব। কিন্তু কেন ‘সংবাদ’-এর গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে না? এই প্রতিষ্ঠান তো নিম্নগামী হওয়ার নয়। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য ছিল, বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশদ বিশ্লেষণ ও আলোচনার বিষয়। কয়েকবার তিনি এ ব্যাপারে কাবাব-পরোটার আসরে বসে আলোচনার প্রস্তাবও রাখেন। কিন্তু কেন যেন এ আলোচনাটি আমি অন্তত করতে পারিনি। আমরা আরও আলোচনা করেছি – একটি বিশেষ সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক চাই, যা হবে আধা একাডেমিক এবং আধা সংবাদ সাময়িকী। সেদিকেও সম্ভবত আগ্রহ ছিল। আমার কেন জানি মনে হয় এই অসমাপ্ত আলোচনা এখনও করা যায়। আহমদুল কবিরের অসাম্প্রদায়িক অঙ্গীকার ও রাজনৈতিক আদর্শবাদিতা ইতোমধ্যেই বিস্তর লেখা হয়েছে। অভিজাত এই ব্যক্তির জনগণের সঙ্গে আত্মীয়তার পরিচয় আমরা পাই তার নির্বাচনী কৃতিত্ব থেকে। মৃত্যুপথযাত্রীর মঙ্গায় উপদ্রুত এলাকায় একাত্মতা থেকে এবং সর্বোপরি তার তিরোধানে তার বন্ধুমহল ও এলাকায় শোকের আবহ থেকে। তার এলাকায় জনগণের সঙ্গে তার একাত্মতা নিয়ে তার ছিল। বিরাট গর্ববোধ। বাস্তবিকই বটে। মুখকাটা বলে বহুল পরিচিত এই ব্যক্তিটি ছিলেন। একান্তই সজ্জন এবং পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ, একজন গুরুজনও বটে।
১১ ডিসেম্বর, ২০০৩
দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত
আবুল মাল আবদুল মুহিত
শুক্রবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
আহমদুল কবির মনু ভাই ছিলেন সুস্বাস্থ্যের যেন একখানা বিজ্ঞাপন। কথাবার্তায়-চলাফেরায় চটপট, চিন্তা-ভাবনায় আধুনিক ও প্রগতিবাদী, কাজকর্ম ও রাজনীতিতে গভীরভাবে আগ্রহী এবং ভোজনে বিলাসী এই ছিল তার সবসময়ের পরিচিতি।
আহমদুল কবির সাহেবের নাম অনেকদিন ধরে জানি, তবে তার সঙ্গে সরাসরি পরিচয় অনেক পরে। ১৯৬০ সালে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক হল প্রতিষ্ঠার পর অনেকদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ ছিল না। প্রতিনিধিদের বিষয়টির সমাধান হলে ১৯৪৫-৪৬ সালে প্রায় তিন বছর পর ছাত্র সংসদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন আহমদুল কবির, তবে নির্বাচিত হওয়ার অব্যবহিত পরে তিনি রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ায় চাকরি নিয়ে চলে যান। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই তার নাম জানতাম। তার বড় ভাইকে চিনতাম ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক খায়রুল কবির। ১৯৫১-৫৪ সময়ে ‘সংবাদ’-এর বংশাল রোডের কার্যালয়ে আনাগোনার কারণে বড় ভাই কবিরকে দেখি, তবে খুব যে আলাপচারিতা ছিল তা বলব না। ১৯৫৬ সালে বিলেতে মিসেস আহমদুল কবিরের সঙ্গে পরিচয় হয় তসদ্দুক আহমদ তসনু ভাইয়ের আসরে। মনু কবির মাঝে-মধ্যেই আলোচিত হতেন। বুদ্ধিতে দীপ্ত, কথায় সুপটু এবং কায়দা-কানুনে সাহেব। তার ব্যবসায়ী জীবনও ছিল আলোচনার বিষয়। পরিচয় হলো ঢাকায়। তিনি তখন বোধহয় একটি নির্দোষ পানীয় উৎপাদনে পথিকৃৎ শিল্পপতি। চা শিল্পেও তিনি সংযুক্ত এবং সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত। বহু বছর ধরে ব্যবস্থাপনায় একজন শীর্ষ ব্যক্তি। সম্পাদক হিসেবে তার আবির্ভাব অনেক পরে, বাংলাদেশে। তার চার ভাইয়ের সঙ্গেই তখন থেকে বেশ সখ্য, খায়রুল কবির সাহেব সাংবাদিকতা ও সরকারি গণসংযোগ পরিচালকগিরি ছেড়ে ব্যাংকার হয়েছেন। কানু কবির ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। শামীমকে চিনি ক্রিকেটের ভাল খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে আর মনু কবিরকে চিনি নানা বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনার মধ্যমণি হিসেবে। পরবর্তীকালে চা শিল্পে তার কাছ থেকে অনেক দীক্ষা পাই। কিন্তু সেটা বোধহয় বাংলাদেশে, পাকিস্তান আমলে নয়। চা বাগানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জমি চা চাষে ব্যবহৃত হয় না । এই জমিতে বর্তমানে অনেকেই কাঠ ব্যবসার সুযোগ নেন। এই জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিয়ে তার সঙ্গে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। চা শ্রমিকরা যে বংশপরম্পরায় একই ধরনের জীবনযাপন করে সেটি ছিল আর এক আলোচনার বিষয়। চা-পান একটি ভাল না মন্দ অভ্যাস সেটা নিয়ে এক সময় বিতর্ক চলতো; তবে প্রায় সাঁইত্রিশ বছর আগে চায়ে আমার আসক্তি হলে এই বিতর্ক শুধু একটি তাত্ত্বিক কচকচানিতে পরিণত হয়।
আহমদুল কবির শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস নিয়ে খুবই বিচলিত ছিলেন। নিজের ছাত্রজীবনের রাজনীতি চর্চার আলোকে তিনি কোনমতেই ছাত্রদের সন্ত্রাসী উদ্যোগ ও আগ্রহ মোটেই গ্রহণ করতে পারতেন না। ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে বয়োজ্যেষ্ঠদের যে এ বিষয়ে প্রভাব বিস্তারের দায়িত্ব রয়েছে সে বিষয়ে তিনি শুধু সচেতন ছিলেন না, বরং তিনি মনে করতেন এটি বয়োজ্যেষ্ঠদের কর্তব্য। ১৯৮০ সালে সলিমুল্লাহ হলের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রাক্তন ও নতুন ছাত্রদের মধ্যে বেশ সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। মনু কবির এই সুযোগে এই সম্পর্কটাকে আরও গভীর ও ব্যাপক করতে আগ্রহী ছিলেন। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশনার পুরোদায়িত্ব তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করেন। ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবারও মনু কবির নিজে থেকে এতে সম্পৃক্ত হন এবং আবারও ছাত্রদের সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধির বিষয়টির দিকে জোর দেন। তিনি মনে করতেন, সন্ত্রাসে লিপ্ত ছাত্ররা বিপথগামী। তারা সৎপথটি হয় জানে না, নয়তো তাতে আস্থাশীল নয়। তাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করে, আলোচনা করে সহজেই তাদের সৎপথে প্রত্যাবর্তন করা তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, ছাত্রদের এত সুন্দর ও মহৎ বিষয়ে নিবেদনের যে সুযোগ রয়েছে তাতে তারা কোনমতেই রাজনৈতিক সন্ত্রাসে লিপ্ত হতে পারে না। আমার একটি খেদ হলো যে, তিনি বিভিন্ন ছাত্রাবাসে সাবেকদের দল নিয়ে বর্তমানের সঙ্গে মতবিনিময় করতে চেয়েছিলেন। আমাকে সে ব্যাপারে দায়িত্বও দিয়েছিলেন; কিন্তু আমি সেই দায়িত্বটি সম্পাদনে ব্যর্থ হই। আমাদের রাজনৈতিক বিভক্তির কারণেই এই উদ্যোগটি সফল হতে পারেনি। অগ্রজের কাছে এই ব্যর্থতার বেদনা আমার সহজে যাবে না।
আহমদুল কবিরের বিচরণক্ষেত্র ছিল ব্যাপক ও বহুমুখী। তার একটি প্রশ্নের উত্তর আমি প্রস্তুত করতে পারিনি। এটি এখন সবার কাছে পেশ করছি। সত্তরের দশকের শেষে এবং আশির দশকের শুরুতে তার প্রশ্ন ছিল, অনবরত আমরা মুদ্রামান হ্রাস করে কি আমাদের তুলনামূলক দারিদ্র্য শুধু বৃদ্ধিই করে যাচ্ছি? প্রশ্নটি এক হিসেবে সব উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। মুদ্রামান এককালে সোনার দামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। সেই সোনার বিকল্প কিন্তু আজও হয়নি। ডলারও সেই পর্যায়ে পৌঁছেনি, আধুনিক ইউরোও সেখানে যেতে পারেনি। বর্তমানে মুদ্রার মান বাস্তবে নির্ধারিত হয় দেশজ সম্পদের ওপর ভিত্তি করে। মুরোদের অতিরিক্ত বিনিময়ে গেলেই মানের অবমূল্যায়ন হয়। তেমনি অব্যবহৃত সম্পদ ধরে রাখলে মানের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে। প্রায় দুই দশক আগে মুদ্রার মান নির্ধারণ ছিল একটি জটিল বিষয় এবং অবমূল্যায়নে থাকতো ঘোর আপত্তি। কিন্তু আশির দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে এই গোঁড়ামির অবসান হয়েছে। এখন মুদ্রামান নির্ধারণে সরকারের হাত ক্রমেই প্রত্যাহৃত হচ্ছে। তবে আমরা দেখেছি, খোলাবাজারের ওপর নির্ভর করেও মুদ্রামানে ধস নামতে পারে। অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়নের বিষয়টি তাই শুধু শুধুই অর্থনীতির সূত্র বা উপপাদ্য দিয়ে ব্যাখ্যা দেয়া চলে না। এতে অর্থনীতিতে ক্ষমতা ও সামর্থ্যের বিষয়টিও নিহিত। তাই নিশ্চিতভাবে কবির সাহেবের প্রশ্নের উত্তর আমি এখনও খুঁজেই চলেছি। সম্পাদক ও পরিচালক আহমদুল কবিরকে তিন বছর আগে, আমার একটি প্রশ্ন ছিল ‘সংবাদ’ পত্রিকাকে নিয়ে। ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকী সেই আদিকাল থেকে অতি উত্তম। ‘সংবাদ’ দেশের ও সমাজের প্রগতিতে নিরঙ্কুশভাবে নিবেদিত। ‘সংবাদ’ বাস্তবেই একটি সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত সংস্থাপন বা সংগঠন। ‘সংবাদ’-এর একটি গোষ্ঠী আছে—তারা সাংবাদিক, সংবাদপত্রকর্মী, লেখক, সাহিত্যিক এবং তারা পাঠক ও বান্ধব। কিন্তু কেন ‘সংবাদ’-এর গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে না? এই প্রতিষ্ঠান তো নিম্নগামী হওয়ার নয়। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য ছিল, বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশদ বিশ্লেষণ ও আলোচনার বিষয়। কয়েকবার তিনি এ ব্যাপারে কাবাব-পরোটার আসরে বসে আলোচনার প্রস্তাবও রাখেন। কিন্তু কেন যেন এ আলোচনাটি আমি অন্তত করতে পারিনি। আমরা আরও আলোচনা করেছি – একটি বিশেষ সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক চাই, যা হবে আধা একাডেমিক এবং আধা সংবাদ সাময়িকী। সেদিকেও সম্ভবত আগ্রহ ছিল। আমার কেন জানি মনে হয় এই অসমাপ্ত আলোচনা এখনও করা যায়। আহমদুল কবিরের অসাম্প্রদায়িক অঙ্গীকার ও রাজনৈতিক আদর্শবাদিতা ইতোমধ্যেই বিস্তর লেখা হয়েছে। অভিজাত এই ব্যক্তির জনগণের সঙ্গে আত্মীয়তার পরিচয় আমরা পাই তার নির্বাচনী কৃতিত্ব থেকে। মৃত্যুপথযাত্রীর মঙ্গায় উপদ্রুত এলাকায় একাত্মতা থেকে এবং সর্বোপরি তার তিরোধানে তার বন্ধুমহল ও এলাকায় শোকের আবহ থেকে। তার এলাকায় জনগণের সঙ্গে তার একাত্মতা নিয়ে তার ছিল। বিরাট গর্ববোধ। বাস্তবিকই বটে। মুখকাটা বলে বহুল পরিচিত এই ব্যক্তিটি ছিলেন। একান্তই সজ্জন এবং পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ, একজন গুরুজনও বটে।
১১ ডিসেম্বর, ২০০৩
দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত