সরকারি নিয়োগে কোটা সংস্কার নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে সংঘর্ষ ঘটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। মঙ্গলবার রাজধানীতে মুখোমুখি দুই পক্ষ -সংবাদ
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোথাও পুলিশ আবার কোথাও ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ঘটেছে। এসব ঘটনায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেক। আহতের মধ্যে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
সংঘর্ষ চলাকালে মঙ্গলবার চট্টগ্রামে তিনজন, ঢাকায় দুইজন এবং রংপুরে একজনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে তিনজন শিক্ষার্থী ও একজন ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী। তবে বাকি দুজনের পরিচয় তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়নি। গুলিবৃদ্ধ আহতের মধ্যে তিনজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রয়েছেন বলে জানা গেছে।
দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান কোটা আন্দোলন কর্মসূচিকে ঘিরে ১৫ জুলাই সোমবারও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দফা দফায় সংঘর্ষে দুই শতাধিক আহত হয়েছিল, যাদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীও ছিল। এছাড়া সেদিন সাভার, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ অনেক স্থানে সংঘর্ষে সাংবাদিক, পুলিশ ও শিক্ষকসহ শতাধিক আহত হয়েছিলেন।
পরে ওই রাতেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা। অন্যদিকে ছাত্রলীগও সমাবেশের কর্মসূচি দেয়। ছাত্রলীগ আগে থেকেই কোটা সংস্কারে ‘একমত’ থাকার কথা জানালেও জনদুর্ভোগ মেনে নেবে না বলে আসছিল।
দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে সরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই মঙ্গলবার সকাল থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন আন্দোলনকারীরা। ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ ও কোটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিও ছিল মঙ্গলবারের কর্মসূচি পালনে।
এদিন সকালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। এতদিন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অধীনে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেশি চোখে পড়লেও মঙ্গলবার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
ঢাকায় এদিন বেলা এগারোটার দিকে শাহবাগ, সাইন্সল্যাব, আগারগাঁও, মহাখালী ও উত্তরাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে একযোগে আন্দোলনকারীরা সড়কে অবস্থান নেয়। এতে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়।
পাশাপাশি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, বগুড়াসহ দেশের প্রায় সর্বত্র শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে আসেন। কিন্তু দুপুরের পর থেকে ঢাকার সায়েন্সল্যাব ও চাঁনখারপুল এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়।
ঢাকায় দুই স্থানে সংঘর্ষে নিহত ২, অনেকে গুলিবদ্ধ
দুপুর দুইটার পর রাজধানীর সাইন্সল্যাব-নিউমার্কেট এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
ওই সময় ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে শুরু করে সায়েন্সল্যাব মোড় এবং নিউমার্কেট পর্যন্ত অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। আর ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ ও ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের কর্মীরা ঢাকা কলেজের ভেতর ও সামনে অবস্থান নেয়। এ সময় নেতাকর্মীরা হাতে রামদা, রড, লোহার পাইপ, লাঠি দেখা যায়।
এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। বিকেল সাড়ে ৫টার পর শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ সন্ধ্যায়ও চলছিল।
ওই সংঘর্ষে আহত অবস্থায় দুইজনকে ঢাকা হাসপাতালে নিয়ে গেলে একজনকে মৃত ঘোষণা করা হয় ও আরেকজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। প্রাথমিকভাবে নিহতদের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের বয়স আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ বছর।
সেখানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান থেকে গুলি করা হয়েছে বলে কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী জানিয়েছেন। এতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হওয়ারও অভিযোগ করেন তারা। তবে কারা হয়েছেন, তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এছাড়া এই সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলেও আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন। আহতদের পাশের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলেও তারা জানান।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংঘর্ষ চলাকালে বিকেলে ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে পেট্রল পাম্পের সামনে থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় এক যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন এক পথচারী। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত যুবকের কানের নিচে ও মুখের বিভিন্ন জায়গায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল।
পরে সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেক যুবকের মৃত্যু হওয়ার খবর পাওয়া যায়। তিনি আহত অবস্থায় সিটি কলেজের সামনে রাস্তায় পড়ে ছিলেন। পরে সেখান থেকে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার পরনে ছিল কালো জিনসের প্যান্ট ও কালো গেঞ্জি।
দুজন নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেন ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া। পুলিশের নিউমার্কেট অঞ্চলের সহকারী কমিশনার রেফাতুল ইসলাম বলেন, ‘সায়েন্স ল্যাব এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় দুজন মারা গেছেন।’
এদিকে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে চাঁনখারপুল এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষে তিন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শুভ, সাফিন ও রাতুল।
এ সময় আহত হয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিকেলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে সমবেত হন। সেখানে আগে থেকেই ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা চানখাঁরপুল মোড়ে অবস্থান নেন।
বিকেল ৫টার পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় শহীদুল্লাহ্ হল থেকে চাঁনখারপুল রোড রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে চাঁনখারপুল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা দখলে নেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে গুলি ও ইটপাটকেলের আঘাতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।
চট্টগ্রামে সংঘর্ষে নিহত ৩
আমাদের চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান, মঙ্গলবার বিকেল ৩টা থেকে চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট এবং ষোলশহরসহ আশপাশের এলাকায় কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এর আগে দুপুর থেকে বিভিন্ন মোড়ে অবস্থা নেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। দুই নম্বর গেট এলাকায় একটি বাস ভাঙচুর করে তারা।
দফায় দফায় চলা ওই সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আহত কয়েকজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়।
নিহতরা হলেন, ওয়াসিম, ফয়সাল আহমেদ শান্ত ও ফারুক । এর মধ্যে ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজ শিক্ষার্থী। তিনি কক্সবাজারের পেকুয়া এলাকার বাসিন্দা। ফয়সাল আহমেদ শান্ত নগরের এমইএস কলেজের ছাত্র। আর ফারুক ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী। তিনজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন।
সর্বশেষ তথ্য অনুয়ায়ী, ষোলশহর শিক্ষা বোর্ড এলাকায় কোটা আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। মুরাদপুর অংশে অবস্থান নিয়েছে কোটা আন্দোলনকারীরা। দুই নম্বর ও ষোলশহর এলাকায় অবস্থান নিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে রামদাসহ দেশীয় অস্ত্র দেখা গেছে। কোটা আন্দোলনকারীরাও লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন।
রংপুরে নিহত ১, আহত চার সাংবাদিকসহ অনেকে
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক (রংপুর) জানান, দুপুর আড়াইটার দিকে রংপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাইদ নিহত হন। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুরের বাসিন্দা মকবুল হোসেনের ছেলে। তিনি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনকারীদের একজন সমন্বয় ছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বেরোবির ইংরেজি বিভাগের প্রধান আসিফ আল মতিন।
প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা জানান, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা দুপুর ১টার দিকে রংপুর জেলা স্কুল মোড়ে থেকে মিছিল নিয়ে বের হয়। লালবাগ খামার মোড়ে শিক্ষার্থীদের আরেকটি মিছিল তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ওই মিছিল নিয়ে তারা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর ফটকের সামনে যান। তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাঁধে। শিক্ষার্থীদের ঢিলের জবাবে পুলিশ রাবার বুলেট ছোড়ে। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সঙ্গে মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যুক্ত হয়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয়। পরে আন্দোলনকারীরাও পাল্টা ধাওয়া দেয়। বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সেখানে সংঘর্ষ চলছিল।
আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে গেলে চার সাংবাদিকের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিকেলে নগরীর পার্কের মোড় এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেইটে এই হামলার ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা জানান। আহতরা হলেন- সময় টিভির রংপুর জেলার প্রতিবেদক রেদোয়ান হিমেল, আবদুর রশিদ জীবন, ক্যামেরাপার্সন তরিকুল ইসলাম ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধি আফতাবুজ্জামান হীরু।
জাবিতে শিক্ষক গুলিবিদ্ধ হওয়ার দাবি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) প্রতিনিধি জানান, আন্দোলনকারী-পুলিশ-ছাত্রলীগ ত্রিমুখী সংঘর্ষে দুই অধ্যাপকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার তথ্য পেয়েছেন।
সোমবার রাত পৌনে ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের দমাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে ‘পুলিশ গুলি’ চালালে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. খো. লুৎফুল ই এলাহী আহত হন। সন্ধ্যায় আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ থামাতে গেলে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আওলাদ হোসেন আহত হন। এছাড়া রাতভর সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিন প্লাটুন পুলিশ কাজ করছে।
সরকারি নিয়োগে কোটা সংস্কার নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে সংঘর্ষ ঘটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। মঙ্গলবার রাজধানীতে মুখোমুখি দুই পক্ষ -সংবাদ
বুধবার, ১৭ জুলাই ২০২৪
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোথাও পুলিশ আবার কোথাও ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ঘটেছে। এসব ঘটনায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেক। আহতের মধ্যে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
সংঘর্ষ চলাকালে মঙ্গলবার চট্টগ্রামে তিনজন, ঢাকায় দুইজন এবং রংপুরে একজনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে তিনজন শিক্ষার্থী ও একজন ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী। তবে বাকি দুজনের পরিচয় তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়নি। গুলিবৃদ্ধ আহতের মধ্যে তিনজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রয়েছেন বলে জানা গেছে।
দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান কোটা আন্দোলন কর্মসূচিকে ঘিরে ১৫ জুলাই সোমবারও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দফা দফায় সংঘর্ষে দুই শতাধিক আহত হয়েছিল, যাদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীও ছিল। এছাড়া সেদিন সাভার, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ অনেক স্থানে সংঘর্ষে সাংবাদিক, পুলিশ ও শিক্ষকসহ শতাধিক আহত হয়েছিলেন।
পরে ওই রাতেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা। অন্যদিকে ছাত্রলীগও সমাবেশের কর্মসূচি দেয়। ছাত্রলীগ আগে থেকেই কোটা সংস্কারে ‘একমত’ থাকার কথা জানালেও জনদুর্ভোগ মেনে নেবে না বলে আসছিল।
দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে সরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই মঙ্গলবার সকাল থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন আন্দোলনকারীরা। ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ ও কোটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিও ছিল মঙ্গলবারের কর্মসূচি পালনে।
এদিন সকালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। এতদিন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অধীনে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেশি চোখে পড়লেও মঙ্গলবার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
ঢাকায় এদিন বেলা এগারোটার দিকে শাহবাগ, সাইন্সল্যাব, আগারগাঁও, মহাখালী ও উত্তরাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে একযোগে আন্দোলনকারীরা সড়কে অবস্থান নেয়। এতে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়।
পাশাপাশি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, বগুড়াসহ দেশের প্রায় সর্বত্র শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে আসেন। কিন্তু দুপুরের পর থেকে ঢাকার সায়েন্সল্যাব ও চাঁনখারপুল এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়।
ঢাকায় দুই স্থানে সংঘর্ষে নিহত ২, অনেকে গুলিবদ্ধ
দুপুর দুইটার পর রাজধানীর সাইন্সল্যাব-নিউমার্কেট এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
ওই সময় ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে শুরু করে সায়েন্সল্যাব মোড় এবং নিউমার্কেট পর্যন্ত অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। আর ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ ও ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের কর্মীরা ঢাকা কলেজের ভেতর ও সামনে অবস্থান নেয়। এ সময় নেতাকর্মীরা হাতে রামদা, রড, লোহার পাইপ, লাঠি দেখা যায়।
এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। বিকেল সাড়ে ৫টার পর শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ সন্ধ্যায়ও চলছিল।
ওই সংঘর্ষে আহত অবস্থায় দুইজনকে ঢাকা হাসপাতালে নিয়ে গেলে একজনকে মৃত ঘোষণা করা হয় ও আরেকজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। প্রাথমিকভাবে নিহতদের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের বয়স আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ বছর।
সেখানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান থেকে গুলি করা হয়েছে বলে কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী জানিয়েছেন। এতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হওয়ারও অভিযোগ করেন তারা। তবে কারা হয়েছেন, তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এছাড়া এই সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলেও আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন। আহতদের পাশের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলেও তারা জানান।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংঘর্ষ চলাকালে বিকেলে ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে পেট্রল পাম্পের সামনে থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় এক যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন এক পথচারী। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত যুবকের কানের নিচে ও মুখের বিভিন্ন জায়গায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল।
পরে সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেক যুবকের মৃত্যু হওয়ার খবর পাওয়া যায়। তিনি আহত অবস্থায় সিটি কলেজের সামনে রাস্তায় পড়ে ছিলেন। পরে সেখান থেকে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার পরনে ছিল কালো জিনসের প্যান্ট ও কালো গেঞ্জি।
দুজন নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেন ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া। পুলিশের নিউমার্কেট অঞ্চলের সহকারী কমিশনার রেফাতুল ইসলাম বলেন, ‘সায়েন্স ল্যাব এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় দুজন মারা গেছেন।’
এদিকে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে চাঁনখারপুল এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষে তিন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শুভ, সাফিন ও রাতুল।
এ সময় আহত হয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিকেলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে সমবেত হন। সেখানে আগে থেকেই ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা চানখাঁরপুল মোড়ে অবস্থান নেন।
বিকেল ৫টার পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় শহীদুল্লাহ্ হল থেকে চাঁনখারপুল রোড রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে চাঁনখারপুল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা দখলে নেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে গুলি ও ইটপাটকেলের আঘাতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।
চট্টগ্রামে সংঘর্ষে নিহত ৩
আমাদের চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান, মঙ্গলবার বিকেল ৩টা থেকে চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট এবং ষোলশহরসহ আশপাশের এলাকায় কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এর আগে দুপুর থেকে বিভিন্ন মোড়ে অবস্থা নেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। দুই নম্বর গেট এলাকায় একটি বাস ভাঙচুর করে তারা।
দফায় দফায় চলা ওই সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আহত কয়েকজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়।
নিহতরা হলেন, ওয়াসিম, ফয়সাল আহমেদ শান্ত ও ফারুক । এর মধ্যে ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজ শিক্ষার্থী। তিনি কক্সবাজারের পেকুয়া এলাকার বাসিন্দা। ফয়সাল আহমেদ শান্ত নগরের এমইএস কলেজের ছাত্র। আর ফারুক ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী। তিনজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন।
সর্বশেষ তথ্য অনুয়ায়ী, ষোলশহর শিক্ষা বোর্ড এলাকায় কোটা আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। মুরাদপুর অংশে অবস্থান নিয়েছে কোটা আন্দোলনকারীরা। দুই নম্বর ও ষোলশহর এলাকায় অবস্থান নিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে রামদাসহ দেশীয় অস্ত্র দেখা গেছে। কোটা আন্দোলনকারীরাও লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন।
রংপুরে নিহত ১, আহত চার সাংবাদিকসহ অনেকে
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক (রংপুর) জানান, দুপুর আড়াইটার দিকে রংপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাইদ নিহত হন। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুরের বাসিন্দা মকবুল হোসেনের ছেলে। তিনি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনকারীদের একজন সমন্বয় ছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বেরোবির ইংরেজি বিভাগের প্রধান আসিফ আল মতিন।
প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা জানান, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা দুপুর ১টার দিকে রংপুর জেলা স্কুল মোড়ে থেকে মিছিল নিয়ে বের হয়। লালবাগ খামার মোড়ে শিক্ষার্থীদের আরেকটি মিছিল তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ওই মিছিল নিয়ে তারা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর ফটকের সামনে যান। তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাঁধে। শিক্ষার্থীদের ঢিলের জবাবে পুলিশ রাবার বুলেট ছোড়ে। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সঙ্গে মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যুক্ত হয়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয়। পরে আন্দোলনকারীরাও পাল্টা ধাওয়া দেয়। বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সেখানে সংঘর্ষ চলছিল।
আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে গেলে চার সাংবাদিকের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিকেলে নগরীর পার্কের মোড় এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেইটে এই হামলার ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা জানান। আহতরা হলেন- সময় টিভির রংপুর জেলার প্রতিবেদক রেদোয়ান হিমেল, আবদুর রশিদ জীবন, ক্যামেরাপার্সন তরিকুল ইসলাম ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধি আফতাবুজ্জামান হীরু।
জাবিতে শিক্ষক গুলিবিদ্ধ হওয়ার দাবি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) প্রতিনিধি জানান, আন্দোলনকারী-পুলিশ-ছাত্রলীগ ত্রিমুখী সংঘর্ষে দুই অধ্যাপকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার তথ্য পেয়েছেন।
সোমবার রাত পৌনে ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের দমাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে ‘পুলিশ গুলি’ চালালে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. খো. লুৎফুল ই এলাহী আহত হন। সন্ধ্যায় আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ থামাতে গেলে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আওলাদ হোসেন আহত হন। এছাড়া রাতভর সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিন প্লাটুন পুলিশ কাজ করছে।