ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার শিকার হয়েছেন মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত কয়েকজন কর্মকর্তা।
তারা রোববার কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে এসে হামলার শিকার হন বলে একাডেমির কর্মীরা জানিয়েছেন।
এছাড়া অন্তত ১৫ জন কর্মকর্তার কক্ষে তালা দিয়েছেন বিক্ষুব্ধরা। যাদের কক্ষ তালা দেওয়া হয়েছে, তারা লাকীর লোক’ হিসেবে একাডেমিতে পরিচিত। কোনো কোনো কর্মকর্তার কক্ষ ভাঙচুরেরও অভিযোগ উঠেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মহাপরিচালক লাকী আর তার দপ্তরে আসেননি। নেতৃত্বহীন অবস্থায় কাজ বন্ধ রেখেছেন একাডেমির কর্মীরা, স্থবির হয়ে পড়েছে একাডেমির দাপ্তরিক কাজ।
হামলায় শিকার কর্মকর্তাদের ভাষ্য, অফিসে দাপ্তরিক কাজ করতে এলে তাদের বাধা দেওয়া হয়। একাডেমির মাঠের পশ্চিমপাশে ঐতিহাসিক ৭মার্চ ভাষণের রিলিফ ভাস্কর্যটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে।
অন্যদিকে যাদের বিরুদ্ধে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে, তারা বিষয় অস্বীকার করে বলছেন, মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর দুর্নীতির সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করা কর্মীদের প্রতিহত করেছে ছাত্র-জনতা।
গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সারাদেশে ব্যাপক হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এই অরাজকতার মধ্যেই পরদিন মঙ্গলবার শিল্পকলা একাডেমিতে মহাপরিচালকের দপ্তরসহ অন্তত ১৫জন কর্মকর্তার কক্ষে তালা দেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষুব্ধ একটি অংশ।
মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর দুর্নীতির নথি যেন সরিয়ে ফেলা না যায়, বিক্ষুব্ধরা সেটি প্রতিহত করার কথা বলেন।
শিল্পকলা একাডেমির লাইট ডিজাইনার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, তিনটি কারণে কর্মকর্তাদের কক্ষে তালা দিয়ে মূলত শিল্পকলাকে সুরক্ষিত করা হয়েছে।
তার ভাষ্য, লিয়াকত আলী লাকীর দুর্নীতি নিয়ে জনমনে ক্ষোভ রয়েছে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা এখানে হামলা করতে পারে। একাডেমির কর্মীদের মাঝেও চাপা ক্ষোভ আছে, তারাও হামলা করতে পারে। আর লাকীর দুর্নীতির সহযোগীরা কক্ষে প্রবেশ করে দুর্নীতির প্রমাণ সরিয়ে ফেলতে পারে। সেজন্য একাডেমির দুর্নীতিবাজ কর্মীদের কক্ষ তালা দেওয়া হয়েছে। নতুন মহাপরিচালক এসে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেভাবে এগুলো খুলে দেওয়া হবে।
রোববার যা হয়েছে
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কর্মক্ষেত্রে আসেন মহাপরিচালকের দপ্তরের সহকারী পরিচালক (পি এস) আবু ছালেহ মো. আবদুল্লাহ। নিজ দপ্তরের সামনেই তার ওপর হামলা হয় বলে জানান তিনি।
আবদুল্লাহ বলেন, যে দুজন আমার ওপর হামলা করেছে, তারা কেন এটা করেছে জানি না। তবে হামলাকারী দুজনই একাডেমির শাস্তি পাওয়া কর্মকর্তা এবং একাডেমিতে তাদের কর্মসংশ্লিষ্টতা ছিল না।
আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। তাছাড়া গত কিছুদিন আমি দেশের বাইরে ছিলাম। আমার ছুটি শেষে যোগদানের বিষয় ছিল, আমি একা ছিলাম, রোববার দুপুরে নিজের কর্মক্ষেত্রে এমন হামলার শিকার হব, কল্পনাও করিনি।
নিজেকে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সমর্থক দাবি করে আবদুল্লাহ বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের পক্ষে আমার অবস্থান ছিল। একজন লেখক হিসেবে ছাত্র আন্দোলনে সমর্থনও করেছি। চাকরি করতে এসেছি, যেখানে দায়িত্ব দেবে, আমি তো সেখানেই কাজ করব।
মহাপরিচালকের দপ্তরে কাজ করার জন্য আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলাম। সরকার পরিবর্তনের পর মহাপরিচালক মহোদয় অফিসে না থাকায় সচিবের সঙ্গে কথা বলে আমি অফিসে এসে হামলার শিকার হয়েছি। এটা আমার জন্য অত্যন্ত লজ্জার এবং হতাশার।
হামলার শিকার হয়েছেন উপপরিচালক আলি আহমেদ মুকুল, উপপরিচালক এ এম মোস্তাক আহমেদ, সহকারী পরিচালক খন্দকার ফারহানা রহমান, সহকারী পরিচালক (পিএস) আবু ছালেহ মো. আবদুল্লাহ, কালচারাল অফিসার চাকলাদার মোস্তফা আল মাসউদ, অ্যাকাউন্টস অফিসার (এডি) মোহাম্মদ আল হেলাল, কালচারাল অফিসার মো. আসফ-উদ-দৌলা, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) হাসান মাহমুদ ও নৃত্যশিল্পী শেখ জাহিদ।
হামলা শিকার কয়েকজন কর্মকর্তার বলেন, বিভিন্ন সময় অসদাচরণ ও শৃঙ্খলাজনিত কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এই হামলায় জড়িত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বলদি হওয়া এহসানুর রহমান, লাইট ডিজাইনার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন, কোর্স কো-অর্ডিনেটর প্রদ্যোত কুমার দাস, ইন্সট্রাকটর (চারুকলা) সরকার জিয়াউদ্দিন আহমেদ, কম্পিউটার অপারেটর আবু সাঈদ ও আবু জাফর এবং অফিস সহায়ক সাদেকুর রহমান এই হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তারা।
তবে এহসানুর রহমান ও মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে দাবি করেছেন, এটি ‘ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ’। এতে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই।
মোহাম্মদ জসীম বলেন, শিল্পকলা একাডেমির ভেতরে তো সেনাবাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে, সেখানে হামলা করা তো সহজ নয়। বাইরে থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্র-জনতা এসে তাদের উপর এই হামলা করেছে। আমি সেখানে গিয়েছিলাম তাদের বাঁচাতে। তারা হয়ত আমাকে দেখে ভুল বুঝেছেন। আমি হামলা করিনি।
একাডেমির অন্তত শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী সেখানে ছিলেন। তারাও কি হামলা করেছেন? একাডেমির সবাই তাদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল। উত্তেজিত ছাত্র-জনতা তাদের উপর হামলা করেছে। মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর দুর্নীতি নিয়ে জনমনে ক্ষোভ ছিল। এই হামলা হয়ত ছাত্র-জনতার সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
এহসানুর রহমান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্র-জনতা শিল্পকলায় দুর্নীতিবাজ কর্মীদের প্রতিরোধ করেছে। পরে অবশ্য তাদের সঙ্গে শিল্পকলা একাডেমির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীও যুক্ত হয়েছিল।
একাডেমির অন্তত ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লিয়াকত আলী লাকী ও তার অনুসারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একাডেমিতে আসার আগে থেকেই তাদের প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিয়ে রোববার সকাল থেকে একটি অংশ জড়ো হয়েছিলেন শিল্পকলার ভেতরে। গেইটের বাইরে ছাত্র-জনতার একটি অংশও অবস্থান নিয়েছিল। একাডেমিতে সেনাসদস্যদের অবস্থান থাকার কারণে বহিরাগতরা ভেতরে প্রবেশ করেনি।
দুপুর ১২টার দিকে আলি আহমেদ মুকুল, আবু ছালেহ মো. আবদুল্লাহ, হাসান মাহমুদসহ কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের কক্ষে যেতে চাইলে বিক্ষুব্ধ অংশটির তোপের মুখে পড়েন এবং বাকবিতণ্ডায় জড়ান। এক পর্যায়ে তাদের শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করা হয়। হামলাকারীদের একটি অংশ মারমুখী হলে প্রাণ বাঁচাতে তারা দৌড়ে একাডেমি ত্যাগ করেন।
একাডেমির প্রযোজনা বিভাগের পরিচালক সোহাইলা আফসানা ইকো, চারুকলা বিভাগের উপপরিচালক খন্দকার রেজাউল হাশেম, সহকারী পরিচালক (অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনী) মাহাবুবুর রহমানের কক্ষে তালা দেওয়া হয়। পরিচালক সোহাইলা আফসানা ইকোর কক্ষে ভাঙচুর করা হয়েছে বলেও জানান একাডেমির কর্মীরা।
হামলার শিকার হওয়া একাডেমির সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) হাসান মাহমুদ বলেন, আমি সবসময় নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারি বিধিবিধান ও কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু তারপরও কেন আমার ওপর হামলা করা ও হুমকি দেওয়া হল তা বোধগম্য নয়। তবে আমি দায়িত্বপালনকালে অন্যায় ও অনিয়মকে কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তাই আমার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে থাকতে পারে।
হামলার সময় মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীও একাডেমির আশেপাশেই ছিলেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে ঘটনাস্থল বা আশপাশে লাকীর উপস্থিতির বিষয়টি একাডেমির কর্মীদের কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি।
একাধিকবার ফোন করা হলেও মহাপরিচালক লাকী তা ধরেননি। একাডেমির সচিব (উপসচিব) সালাহউদ্দিন আহাম্মদকেও একাধিকাবার ফোন ও এসএমএস করে সাড়া মেলেনি।
সাতবারের মহাপরিচালক লাকী
লিয়াকত আলী লাকী এক যুগ ধরে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদে রয়েছেন। এই পদে এতদিন থাকার নজির আর কারও নেই।
২০১১ সালের ৭ এপ্রিল তিনি প্রথম নিয়োগ পান। সবশেষ ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ সপ্তমবারের মতো পুনঃনিয়োগ পান।
দীর্ঘদিন ধরে লাকীর শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে থাকা নিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ক্ষোভ তৈরি হয়। দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল।
লাকী বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতির পদেও রয়েছেন। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনায়ও সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এর প্রতিক্রিয়ায় ফেডারেশন ছাড়ে ঢাকা থিয়েটার।
গত বছরের জুনে সাধারণ নাট্যকর্মীবৃন্দ ব্যানারে লিয়াকত আলী লাকীর অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করে সংস্কৃতিকর্মীদের একটি অংশ।
সোমবার, ১২ আগস্ট ২০২৪
ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার শিকার হয়েছেন মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত কয়েকজন কর্মকর্তা।
তারা রোববার কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে এসে হামলার শিকার হন বলে একাডেমির কর্মীরা জানিয়েছেন।
এছাড়া অন্তত ১৫ জন কর্মকর্তার কক্ষে তালা দিয়েছেন বিক্ষুব্ধরা। যাদের কক্ষ তালা দেওয়া হয়েছে, তারা লাকীর লোক’ হিসেবে একাডেমিতে পরিচিত। কোনো কোনো কর্মকর্তার কক্ষ ভাঙচুরেরও অভিযোগ উঠেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মহাপরিচালক লাকী আর তার দপ্তরে আসেননি। নেতৃত্বহীন অবস্থায় কাজ বন্ধ রেখেছেন একাডেমির কর্মীরা, স্থবির হয়ে পড়েছে একাডেমির দাপ্তরিক কাজ।
হামলায় শিকার কর্মকর্তাদের ভাষ্য, অফিসে দাপ্তরিক কাজ করতে এলে তাদের বাধা দেওয়া হয়। একাডেমির মাঠের পশ্চিমপাশে ঐতিহাসিক ৭মার্চ ভাষণের রিলিফ ভাস্কর্যটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে।
অন্যদিকে যাদের বিরুদ্ধে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে, তারা বিষয় অস্বীকার করে বলছেন, মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর দুর্নীতির সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করা কর্মীদের প্রতিহত করেছে ছাত্র-জনতা।
গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সারাদেশে ব্যাপক হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এই অরাজকতার মধ্যেই পরদিন মঙ্গলবার শিল্পকলা একাডেমিতে মহাপরিচালকের দপ্তরসহ অন্তত ১৫জন কর্মকর্তার কক্ষে তালা দেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষুব্ধ একটি অংশ।
মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর দুর্নীতির নথি যেন সরিয়ে ফেলা না যায়, বিক্ষুব্ধরা সেটি প্রতিহত করার কথা বলেন।
শিল্পকলা একাডেমির লাইট ডিজাইনার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, তিনটি কারণে কর্মকর্তাদের কক্ষে তালা দিয়ে মূলত শিল্পকলাকে সুরক্ষিত করা হয়েছে।
তার ভাষ্য, লিয়াকত আলী লাকীর দুর্নীতি নিয়ে জনমনে ক্ষোভ রয়েছে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা এখানে হামলা করতে পারে। একাডেমির কর্মীদের মাঝেও চাপা ক্ষোভ আছে, তারাও হামলা করতে পারে। আর লাকীর দুর্নীতির সহযোগীরা কক্ষে প্রবেশ করে দুর্নীতির প্রমাণ সরিয়ে ফেলতে পারে। সেজন্য একাডেমির দুর্নীতিবাজ কর্মীদের কক্ষ তালা দেওয়া হয়েছে। নতুন মহাপরিচালক এসে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেভাবে এগুলো খুলে দেওয়া হবে।
রোববার যা হয়েছে
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কর্মক্ষেত্রে আসেন মহাপরিচালকের দপ্তরের সহকারী পরিচালক (পি এস) আবু ছালেহ মো. আবদুল্লাহ। নিজ দপ্তরের সামনেই তার ওপর হামলা হয় বলে জানান তিনি।
আবদুল্লাহ বলেন, যে দুজন আমার ওপর হামলা করেছে, তারা কেন এটা করেছে জানি না। তবে হামলাকারী দুজনই একাডেমির শাস্তি পাওয়া কর্মকর্তা এবং একাডেমিতে তাদের কর্মসংশ্লিষ্টতা ছিল না।
আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। তাছাড়া গত কিছুদিন আমি দেশের বাইরে ছিলাম। আমার ছুটি শেষে যোগদানের বিষয় ছিল, আমি একা ছিলাম, রোববার দুপুরে নিজের কর্মক্ষেত্রে এমন হামলার শিকার হব, কল্পনাও করিনি।
নিজেকে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সমর্থক দাবি করে আবদুল্লাহ বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের পক্ষে আমার অবস্থান ছিল। একজন লেখক হিসেবে ছাত্র আন্দোলনে সমর্থনও করেছি। চাকরি করতে এসেছি, যেখানে দায়িত্ব দেবে, আমি তো সেখানেই কাজ করব।
মহাপরিচালকের দপ্তরে কাজ করার জন্য আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলাম। সরকার পরিবর্তনের পর মহাপরিচালক মহোদয় অফিসে না থাকায় সচিবের সঙ্গে কথা বলে আমি অফিসে এসে হামলার শিকার হয়েছি। এটা আমার জন্য অত্যন্ত লজ্জার এবং হতাশার।
হামলার শিকার হয়েছেন উপপরিচালক আলি আহমেদ মুকুল, উপপরিচালক এ এম মোস্তাক আহমেদ, সহকারী পরিচালক খন্দকার ফারহানা রহমান, সহকারী পরিচালক (পিএস) আবু ছালেহ মো. আবদুল্লাহ, কালচারাল অফিসার চাকলাদার মোস্তফা আল মাসউদ, অ্যাকাউন্টস অফিসার (এডি) মোহাম্মদ আল হেলাল, কালচারাল অফিসার মো. আসফ-উদ-দৌলা, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) হাসান মাহমুদ ও নৃত্যশিল্পী শেখ জাহিদ।
হামলা শিকার কয়েকজন কর্মকর্তার বলেন, বিভিন্ন সময় অসদাচরণ ও শৃঙ্খলাজনিত কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এই হামলায় জড়িত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বলদি হওয়া এহসানুর রহমান, লাইট ডিজাইনার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন, কোর্স কো-অর্ডিনেটর প্রদ্যোত কুমার দাস, ইন্সট্রাকটর (চারুকলা) সরকার জিয়াউদ্দিন আহমেদ, কম্পিউটার অপারেটর আবু সাঈদ ও আবু জাফর এবং অফিস সহায়ক সাদেকুর রহমান এই হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তারা।
তবে এহসানুর রহমান ও মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে দাবি করেছেন, এটি ‘ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ’। এতে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই।
মোহাম্মদ জসীম বলেন, শিল্পকলা একাডেমির ভেতরে তো সেনাবাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে, সেখানে হামলা করা তো সহজ নয়। বাইরে থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্র-জনতা এসে তাদের উপর এই হামলা করেছে। আমি সেখানে গিয়েছিলাম তাদের বাঁচাতে। তারা হয়ত আমাকে দেখে ভুল বুঝেছেন। আমি হামলা করিনি।
একাডেমির অন্তত শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী সেখানে ছিলেন। তারাও কি হামলা করেছেন? একাডেমির সবাই তাদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল। উত্তেজিত ছাত্র-জনতা তাদের উপর হামলা করেছে। মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর দুর্নীতি নিয়ে জনমনে ক্ষোভ ছিল। এই হামলা হয়ত ছাত্র-জনতার সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
এহসানুর রহমান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্র-জনতা শিল্পকলায় দুর্নীতিবাজ কর্মীদের প্রতিরোধ করেছে। পরে অবশ্য তাদের সঙ্গে শিল্পকলা একাডেমির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীও যুক্ত হয়েছিল।
একাডেমির অন্তত ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লিয়াকত আলী লাকী ও তার অনুসারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একাডেমিতে আসার আগে থেকেই তাদের প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিয়ে রোববার সকাল থেকে একটি অংশ জড়ো হয়েছিলেন শিল্পকলার ভেতরে। গেইটের বাইরে ছাত্র-জনতার একটি অংশও অবস্থান নিয়েছিল। একাডেমিতে সেনাসদস্যদের অবস্থান থাকার কারণে বহিরাগতরা ভেতরে প্রবেশ করেনি।
দুপুর ১২টার দিকে আলি আহমেদ মুকুল, আবু ছালেহ মো. আবদুল্লাহ, হাসান মাহমুদসহ কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের কক্ষে যেতে চাইলে বিক্ষুব্ধ অংশটির তোপের মুখে পড়েন এবং বাকবিতণ্ডায় জড়ান। এক পর্যায়ে তাদের শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করা হয়। হামলাকারীদের একটি অংশ মারমুখী হলে প্রাণ বাঁচাতে তারা দৌড়ে একাডেমি ত্যাগ করেন।
একাডেমির প্রযোজনা বিভাগের পরিচালক সোহাইলা আফসানা ইকো, চারুকলা বিভাগের উপপরিচালক খন্দকার রেজাউল হাশেম, সহকারী পরিচালক (অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনী) মাহাবুবুর রহমানের কক্ষে তালা দেওয়া হয়। পরিচালক সোহাইলা আফসানা ইকোর কক্ষে ভাঙচুর করা হয়েছে বলেও জানান একাডেমির কর্মীরা।
হামলার শিকার হওয়া একাডেমির সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) হাসান মাহমুদ বলেন, আমি সবসময় নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারি বিধিবিধান ও কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু তারপরও কেন আমার ওপর হামলা করা ও হুমকি দেওয়া হল তা বোধগম্য নয়। তবে আমি দায়িত্বপালনকালে অন্যায় ও অনিয়মকে কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তাই আমার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে থাকতে পারে।
হামলার সময় মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীও একাডেমির আশেপাশেই ছিলেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে ঘটনাস্থল বা আশপাশে লাকীর উপস্থিতির বিষয়টি একাডেমির কর্মীদের কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি।
একাধিকবার ফোন করা হলেও মহাপরিচালক লাকী তা ধরেননি। একাডেমির সচিব (উপসচিব) সালাহউদ্দিন আহাম্মদকেও একাধিকাবার ফোন ও এসএমএস করে সাড়া মেলেনি।
সাতবারের মহাপরিচালক লাকী
লিয়াকত আলী লাকী এক যুগ ধরে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদে রয়েছেন। এই পদে এতদিন থাকার নজির আর কারও নেই।
২০১১ সালের ৭ এপ্রিল তিনি প্রথম নিয়োগ পান। সবশেষ ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ সপ্তমবারের মতো পুনঃনিয়োগ পান।
দীর্ঘদিন ধরে লাকীর শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে থাকা নিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ক্ষোভ তৈরি হয়। দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল।
লাকী বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতির পদেও রয়েছেন। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনায়ও সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এর প্রতিক্রিয়ায় ফেডারেশন ছাড়ে ঢাকা থিয়েটার।
গত বছরের জুনে সাধারণ নাট্যকর্মীবৃন্দ ব্যানারে লিয়াকত আলী লাকীর অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করে সংস্কৃতিকর্মীদের একটি অংশ।