৪ আগষ্ট রোববার! সারাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছে। সিরাজগঞ্জের সালাঙ্গাও ব্যাতিক্রম নয়। সেখানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া সাথে শুরু হয় ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও গোলাগুলি। বাইরে গোলাগুলির শব্দ শুনে বাসা থেকে বের হন এনামুল কাওসার(৩২)।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাসার একটু সামনে, রাস্তায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডান পায়ে একটি গুলি লেগে এফোড়-ওফোড় হয়ে যায়। গুলিটি হাড়ের মধ্যে আটকে না গেলেও হাটুর জয়েন্টের হাড় গুড়ো করে ফেলে। বাধ্য হয়ে হাটুর নিচ থেকে পা কেটে ফেলতে হয়।
পুলিশের গুলিতে আহত এনামুল কাওসার। বাবা আনিসুর রহমান কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তিনি সেখানকার উল্লাপাড়ার সরকারি আকবার আলী কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর চাকুরী না পেয়ে স্টক ব্যবসা ও গরু পালন শুরু করেন।
ডান পা হারানো কাওসার দুই মেয়ে, মা, একমাত্র ভাই ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার করছিলেন। ৪ আগস্ট ডান পায়ের হাঁটুতে গুলি লাগে তার। পায়ে পচন ধরার কারণে গত ২৪ আগস্ট অর্থাৎ ২০ দিন পর তার পা কেটে ফেলতে হয়।
পায়ে গুলি লাগার দিনই এনামুলকে বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানো হয়। সেখানে সাত দিন চিকিৎসার পর তাকে সেখানকার ডাক্তার হাসপাতালে পাঠায়। পরে তাকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) নিচতলায় ক্যাজুয়ালটি-২ ইউনিটের জি-৩৪ বেডে চিকিৎসাধীন থাকার পর। এখন ওই হাসপাতালের ৪র্থ তালার ২৮ নম্বার বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
নিটোরে কথা হয় সংবাদের এ প্রতিবেদকের সাথে। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরীর আশায় কতোই না চেষ্টা করেছি। কতো পরীক্ষা দিয়েছি, কিন্ত আমার ভাগ্য সহায় হয়নি। শেষ পর্যন্তও ভাগ্য আমার সাথে এমন করলো।’
এনামুল কাওসার বলেন, ‘ওইদিন গোসল করে বাসার বাইরে দাড়িয়ে ছিলাম। দেখি ছেলারা আনন্দোলন করছে। সবাই গেছে আমিও গেছি। কতজন চলে আসছে আবার কিছু লোক ছিল, আমিও ছিলাম। পুলিশ আমাকে গুলিটা করছে ২০ থাকি ৩০ ফুট দূরে থেকে, আমি সেখানে দাড়িয়ে ছিলাম।’
তবে ছাত্রদের আন্দোলনে শরীর হতে পেরে তিনি গর্বিত। এনামুল কাওসার বলেন, ‘কোনো কিছু পাওয়ার আশায় আন্দোলনে অংশ নেইনি। দেশ থেকে স্বৈরাচার পতনের জন্য আন্দোলনে গেছি।’
তার পরের ঘটনা বর্ণনা করে এনামুল জানান, গুলিতে আহত হওয়ার পর প্রথমে সিরাজগঞ্জের আরেক উপজেলা উল্লাপাড়ায় যাই। সেখানকার একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেই। সেখানকার ডাক্তাররা অবস্থা বেগতিক দেখে বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজে যেতে বলে। বগুড়ায়ও ভালো চিকিৎসা পাইনি। পরে সেই রাতে ঢাকায় আসার ইচ্ছা থাকলেও পরিস্থিতিও ভালো ছিল না। তাছাড়া অ্যাম্বুলেন্স সংকটও ছিল চরমে। কোন গাড়িও আসতে চাইছিল না।
‘গত ১১ আগস্ট ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হই। কিন্তু ততক্ষণে পায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। হাসপাতালে ভর্তির পর টানা ১৪ দিন চিকিৎসা করার পরও পায়ের কোনো উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকরা পা কেটে ফেলতে বাধ্য হই’, বলেন তিনি।
পরিবারের অভিযোগ, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর স্থানীয় হাসাপাতাল এমনকি বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল হাসপাতালের কোনো ডাক্তার কাওসারের চিকিৎসা করাতে চাননি তার। চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ তার চিকিৎসা দিতে চাননি। যার কারণে অধিক রক্তক্ষরণ হয় তার। এমনকি, অধিক রক্তক্ষরণের কারণে তাকে ১০ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়।
কাটা পা নিয়ে কাওসারের দিনের বেশিরভাগ সময়ই চোখ দিয়ে পানি পড়ে। পরিবার নিয়ে চিন্তা, দুই মেয়ের জন্য চিন্তা। বড় মেয়ে সুন্নাতের বয়স তিন বছর, ছোট মেয়ে ছোঁয়ার বয়স এক বছর। বাবা হারানো কাওসারের বাসায় অসহায় হয়ে পড়ে আছেন বৃদ্ধা মা। ওইদিনের ঘটনা মুনে এখনো আৎকে ওঠেন তিনি।
কাওসারের ছোট ভাই নাজমুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘পঙ্গুতে (নিটোর) আমরা ২৫ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছি। ডাক্তাররা এখনই রিলিজ দিতে চায়, কিন্ত আমরা ঘা না শুকানো পর্যন্ত যাবনা।’
নাজমুল ইসলাম বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে মার্কেটিংয়ে মাস্টার্স শেষ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘বড় ভাই আমাদের একমাত্র অভিভাবক। আমিও আন্দোলনে ছিলাম। আমরা কিছু পাওয়ার আশায় আন্দোলনে যাইনি। কোনো কিছুর বিনিময়ে আমার ভাইয়ের পা পাবো না। তবে এটা সত্য আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি, কারণ একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল আমার বড় ভাই। তিনি আমার সমস্ত পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন।’
শুক্রবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৪ আগষ্ট রোববার! সারাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছে। সিরাজগঞ্জের সালাঙ্গাও ব্যাতিক্রম নয়। সেখানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া সাথে শুরু হয় ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও গোলাগুলি। বাইরে গোলাগুলির শব্দ শুনে বাসা থেকে বের হন এনামুল কাওসার(৩২)।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাসার একটু সামনে, রাস্তায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডান পায়ে একটি গুলি লেগে এফোড়-ওফোড় হয়ে যায়। গুলিটি হাড়ের মধ্যে আটকে না গেলেও হাটুর জয়েন্টের হাড় গুড়ো করে ফেলে। বাধ্য হয়ে হাটুর নিচ থেকে পা কেটে ফেলতে হয়।
পুলিশের গুলিতে আহত এনামুল কাওসার। বাবা আনিসুর রহমান কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তিনি সেখানকার উল্লাপাড়ার সরকারি আকবার আলী কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর চাকুরী না পেয়ে স্টক ব্যবসা ও গরু পালন শুরু করেন।
ডান পা হারানো কাওসার দুই মেয়ে, মা, একমাত্র ভাই ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার করছিলেন। ৪ আগস্ট ডান পায়ের হাঁটুতে গুলি লাগে তার। পায়ে পচন ধরার কারণে গত ২৪ আগস্ট অর্থাৎ ২০ দিন পর তার পা কেটে ফেলতে হয়।
পায়ে গুলি লাগার দিনই এনামুলকে বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানো হয়। সেখানে সাত দিন চিকিৎসার পর তাকে সেখানকার ডাক্তার হাসপাতালে পাঠায়। পরে তাকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) নিচতলায় ক্যাজুয়ালটি-২ ইউনিটের জি-৩৪ বেডে চিকিৎসাধীন থাকার পর। এখন ওই হাসপাতালের ৪র্থ তালার ২৮ নম্বার বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
নিটোরে কথা হয় সংবাদের এ প্রতিবেদকের সাথে। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরীর আশায় কতোই না চেষ্টা করেছি। কতো পরীক্ষা দিয়েছি, কিন্ত আমার ভাগ্য সহায় হয়নি। শেষ পর্যন্তও ভাগ্য আমার সাথে এমন করলো।’
এনামুল কাওসার বলেন, ‘ওইদিন গোসল করে বাসার বাইরে দাড়িয়ে ছিলাম। দেখি ছেলারা আনন্দোলন করছে। সবাই গেছে আমিও গেছি। কতজন চলে আসছে আবার কিছু লোক ছিল, আমিও ছিলাম। পুলিশ আমাকে গুলিটা করছে ২০ থাকি ৩০ ফুট দূরে থেকে, আমি সেখানে দাড়িয়ে ছিলাম।’
তবে ছাত্রদের আন্দোলনে শরীর হতে পেরে তিনি গর্বিত। এনামুল কাওসার বলেন, ‘কোনো কিছু পাওয়ার আশায় আন্দোলনে অংশ নেইনি। দেশ থেকে স্বৈরাচার পতনের জন্য আন্দোলনে গেছি।’
তার পরের ঘটনা বর্ণনা করে এনামুল জানান, গুলিতে আহত হওয়ার পর প্রথমে সিরাজগঞ্জের আরেক উপজেলা উল্লাপাড়ায় যাই। সেখানকার একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেই। সেখানকার ডাক্তাররা অবস্থা বেগতিক দেখে বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজে যেতে বলে। বগুড়ায়ও ভালো চিকিৎসা পাইনি। পরে সেই রাতে ঢাকায় আসার ইচ্ছা থাকলেও পরিস্থিতিও ভালো ছিল না। তাছাড়া অ্যাম্বুলেন্স সংকটও ছিল চরমে। কোন গাড়িও আসতে চাইছিল না।
‘গত ১১ আগস্ট ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হই। কিন্তু ততক্ষণে পায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। হাসপাতালে ভর্তির পর টানা ১৪ দিন চিকিৎসা করার পরও পায়ের কোনো উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকরা পা কেটে ফেলতে বাধ্য হই’, বলেন তিনি।
পরিবারের অভিযোগ, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর স্থানীয় হাসাপাতাল এমনকি বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল হাসপাতালের কোনো ডাক্তার কাওসারের চিকিৎসা করাতে চাননি তার। চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ তার চিকিৎসা দিতে চাননি। যার কারণে অধিক রক্তক্ষরণ হয় তার। এমনকি, অধিক রক্তক্ষরণের কারণে তাকে ১০ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়।
কাটা পা নিয়ে কাওসারের দিনের বেশিরভাগ সময়ই চোখ দিয়ে পানি পড়ে। পরিবার নিয়ে চিন্তা, দুই মেয়ের জন্য চিন্তা। বড় মেয়ে সুন্নাতের বয়স তিন বছর, ছোট মেয়ে ছোঁয়ার বয়স এক বছর। বাবা হারানো কাওসারের বাসায় অসহায় হয়ে পড়ে আছেন বৃদ্ধা মা। ওইদিনের ঘটনা মুনে এখনো আৎকে ওঠেন তিনি।
কাওসারের ছোট ভাই নাজমুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘পঙ্গুতে (নিটোর) আমরা ২৫ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছি। ডাক্তাররা এখনই রিলিজ দিতে চায়, কিন্ত আমরা ঘা না শুকানো পর্যন্ত যাবনা।’
নাজমুল ইসলাম বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে মার্কেটিংয়ে মাস্টার্স শেষ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘বড় ভাই আমাদের একমাত্র অভিভাবক। আমিও আন্দোলনে ছিলাম। আমরা কিছু পাওয়ার আশায় আন্দোলনে যাইনি। কোনো কিছুর বিনিময়ে আমার ভাইয়ের পা পাবো না। তবে এটা সত্য আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি, কারণ একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল আমার বড় ভাই। তিনি আমার সমস্ত পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন।’