অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
জাতিসংঘ আয়োজিত কপ সম্মেলন হল সেই স্থান যেখানে জলবায়ু পরিবর্তের প্রভাবগুলোকে তুলে ধরে বিশ্বকে সচেতন করা হয় এবং এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে ও পূর্ববর্তী ক্ষয়ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে বিপর্যস্ত দেশগুলো উন্নত দেশের কাছে তাদের দাবি উত্থাপন করে থাকে। সেই লক্ষ্যে প্রতি বছরের মতো এ বছরও আজারবাইজানের বাকুতে আয়োজিত হয়েছে কপের ২৯তম সম্মেলন। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত সংকট আজ এক সর্বগ্রাসী বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে কয়লা, তেল ও গ্যাস পোড়ানোর ফলে পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত তীব্র তাপপ্রবাহ, দীর্ঘস্থায়ী খরা, ভারী বৃষ্টিপাত এবং বিধ্বংসী বন্যা হয়েই চলেছে। প্রকৃতির এই বিরূপ প্রভাবকে আরও গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছানোর পূর্বেই তার এই পরিবর্তনকে রোধ করার জন্য, জাতিসংঘের বৈশ্বিক জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন, কপ২৯-এ ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে ২ ডি. সে. এর নিচে রাখার প্রস্তাবনা করা হয়। এই লক্ষ্য অর্জনের অর্থ হল মানব সমাজ যাতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন বন্ধ করতে পারে, এটিই বিশ্বে ‘কার্বন বাজেট’ নামে পরিচিত। উন্নত দেশগুলো তাদের কার্বন বাজেট অনেক আগেই অতিক্রম করে ফেলেছে, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনও তাদের সীমা বজায় রাখতে সক্ষম। কার্বন ডাই অক্সাইড শতাব্দী ধরে বায়ুম-লে থেকে যায়, যার ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির অতি ব্যবহার পৃথিবীর জন্য একটি ক্রমবর্ধমান ব্যয়বহুল খরচের ক্ষেত্র দিল্লি ভিত্তিক সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া - যারা বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র ১৫% ধারণ করে থাকলেও বায়ুম-লে মজুত কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি নির্গমনে অবদান রেখেছে। এই পরিসংখ্যানগুলো দেখায় যে, ধনী দেশগুলো জলবায়ু উপর যে ঋণ রেখে গেছে, তা এখন দরিদ্র দেশগুলোর কাছে বিশাল বোঝাস্বরূপ। তবে কঠিন বাস্তবতা হল, জলবায়ু রক্ষায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধে গুরুত্ব না দিয়ে এবারের কপ২৯ এর আয়োজক রাষ্ট্র আজারবাইজান তেল এবং গ্যাস উৎপাদনকারীদেরকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তেল সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলো যারা তেল উৎপাদনে বেশি ভূমিকা রাখছে ওপেকভুক্ত সংস্থাগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে এই সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তেলের বা জীবাশ্ম জ্বালানির যে নিরাপদ নেটওয়ার্ক আছে সেটি নিশ্চিত করার জন্য নানা ধরনের তদবির করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বছরের কপ সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষতিপূরণ আদায়ের সম্ভাবনা ক্রমশই ক্ষীন হয়ে আসছে। পরবর্তী বছরে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য কপ৩০ এ জলবায়ু বিপর্যয়ের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য প্রস্তাবিত লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডের জন্য ধনী রাষ্ট্রগুলো অর্থায়ন করবে কিনা সেটি এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রভাবশালী জলবায়ু নীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে জাতিসংঘের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনগুলি কেবলমাত্র সেই দেশেই অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত যারা জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কাজ করাকে স্পষ্টভাবে সমর্থন করে এবং জীবাশ্ম জ্বালানি লবিংয়ের বিষয়ে কঠোর নিয়ম মেনে চলে। বিশেষজ্ঞদের এই দলে রয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, জাতিসংঘের সাবেক জলবায়ু প্রধান ক্রিশ্চিয়ানা ফিগারেস এবং বিশিষ্ট জলবায়ু বিজ্ঞানী জোহান রকস্ট্রোম। তারা জাতিসংঘকে চিঠি দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন- প্যারিস চুক্তির মূল চুক্তি—এর অধীনে বার্ষিক কপ সম্মেলনের বর্তমান জটিল প্রক্রিয়াটিকে সুবিন্যস্ত করার এবং আরও বেশি বেশি মিটিং আয়োজন করার দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, আজারবাইজান কপ সম্মেলনের জন্য একটি বিতর্কিত আয়োজক, কারণ এটি একটি প্রধান জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ, যারা বৈশ্বিক রপ্তানির প্রায় অর্ধেক তেল এবং গ্যাস উৎপাদন করে। গত বছরের সম্মেলনটিও সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি পেট্রোস্টেটে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেই সম্মেলনের সভাপতি, সুলতান আল জাবের, দেশের জাতীয় তেল কোম্পানি অ্যাডনক এর প্রধান পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আয়োজক দেশগুলোকে অবশ্যই প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যগুােল সমুন্নত রাখার জন্য তৎপর হওয়া উচিত।
জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী এবং লবিস্টরা শুধু কপ২৯-এ অংশগ্রহণই করছেন না, বরং অন্তত ১৩২ জন জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির প্রতিনিধিকে আজারবাইজানীয় সরকার ‘অতিথি’ হিসেবে এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং হোস্ট কান্ট্রি ব্যাজ দিয়েছে। কপ২৯-এ অংশগ্রহণকারী উন্নয়নশীল দেশগুলো আয়োজক রাষ্ট্রের এই কর্মকা-ের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করেন এবং । তবে উন্নত রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যের গ্রিন পার্টি জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানি ও লবিস্টদের বাদ দেয়ার দাবি সমর্থন করেছে।
কিক বিগ পলুটারস আউট অ্যাক্টিভিস্ট কোয়ালিশন কর্তৃক বিশ্লেষিত তথ্য অনুসারে, কমপক্ষে ১,৭৭৩টি কয়লা, তেল এবং গ্যাস লবিস্টকে কপ২৯-এ অংশগ্রহণের জন্য প্রবেশাধিকার দেয়া হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জীবাশ্ম জ্বালানি-সংযুক্ত লবিস্টদের সংখ্যা বাকুতে আয়োজিত এই জলবায়ু সম্মেলনে প্রায় প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিদের চেয়ে বেশি। ১০টি জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ থেকে সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য মাত্র ১,০৩৩ জন প্রতিনিধি এসেছেন। ইন্টারন্যাশনাল ইমিশন ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লবিস্ট নিয়ে এসেছে, যেখানে টোটাল এনার্জি এবং গ্লেনকোরের মতো তেলের বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ৪৩ জন প্রতিনিধি রয়েছে। অন্যান্য অনেক দেশের লবিস্টরা জাতীয় প্রতিনিধিদলের অংশ হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। প্রধান তেল উৎপাদক শেভরন, এক্সনমোবিল, বিপি, শেল এবং এনি যাদের মধ্যে জাপান কয়লা জায়ান্ট সুমিতোমো থেকে একজন প্রতিনিধি এনেছে, কানাডা সানকর এবং টুরমালাইন থেকে প্রতিনিধি এনেছে এবং ইতালি এনি এবং এনেলের কর্মীদের নিয়ে এসেছে।
অর্থনীতিবিদরা অনুমান করছেন যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় প্রতিবছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। তবে এখন পর্যন্ত ধনী দেশগুলো থেকে যথাযথ আর্থিক সহায়তার কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। আফ্রিকার মতো মহাদেশগুলো সবুজ শিল্পায়নে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এখানে উৎপাদন অবকাঠামোর অভাব এবং কাঁচামালের সরবরাহকারীর ভূমিকা এই সংকটকে আরও তীব্রতর করেছে। যদিও উন্নত দেশগুলো সবুজ প্রযুক্তিতে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, আফ্রিকা সীমিত প্রযুক্তি স্থানান্তর, ব্যয়বহুল প্রযুক্তি এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থার মতো বাধার মুখোমুখি।
কপ২৯ এ জলবায়ু অর্থায়নের কিছু উৎস খুঁজে বের করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদগণ। প্রাক্তন ফরাসি কূটনীতিক এবং ইউরোপীয় জলবায়ু ফাউন্ডেশনের বর্তমান প্রধান লরেন্স তুবিয়ানার নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্সের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, নতুন ‘বৈশ্বিক সংহতি শুল্ক’ দরিদ্র বিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় জলবায়ু অর্থায়নের অঙ্ককে বাড়াতে পারে। লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডের অর্থের যোগানের জন্য কয়েকটি যুগাক্তকারী বিকল্প হতে পারে ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলোর উপর কর ধার্য করা, প্লাস্টিক উৎপাদন শুল্ক ধার্য করা, পুনরায় ব্যবহারযোগ্য উপাদানের পরিবর্তে পলিমার থেকে প্লাস্টিক উৎপাদন করার জন্য কর ধার্য করা হয় অর্থাৎ যদি টন প্রতি পলিমারের উপর ৬০ থেকে ৯০ ডলার কর নির্ধারণ করা হয় তবে বছরে ২৫ ৩৫ বিলিয়ন ডলার আয় হতে পারে। এর চেয়েও বেশি কার্যকর হবে ২ শতাংশ সম্পদ কর নীতি। এই নীতি ব্রাজিলে প্রচলিত রয়েছে যেটি বছরে ২০০ থেকে ২৫০ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে। বিভিন্ন ফ্লাইয়ার এবং বিজনেস ক্লাস এয়ারলাইনস টিকিটের উপর ট্যাক্স আরোপ করে স্কিমের উপর নির্ভর করে বছরে ১৬৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয় হতে পারে। এভাবে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অনুদানের পর লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডের বাকি অর্থ অর্জন করা সম্ভব।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪
জাতিসংঘ আয়োজিত কপ সম্মেলন হল সেই স্থান যেখানে জলবায়ু পরিবর্তের প্রভাবগুলোকে তুলে ধরে বিশ্বকে সচেতন করা হয় এবং এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে ও পূর্ববর্তী ক্ষয়ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে বিপর্যস্ত দেশগুলো উন্নত দেশের কাছে তাদের দাবি উত্থাপন করে থাকে। সেই লক্ষ্যে প্রতি বছরের মতো এ বছরও আজারবাইজানের বাকুতে আয়োজিত হয়েছে কপের ২৯তম সম্মেলন। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত সংকট আজ এক সর্বগ্রাসী বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে কয়লা, তেল ও গ্যাস পোড়ানোর ফলে পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত তীব্র তাপপ্রবাহ, দীর্ঘস্থায়ী খরা, ভারী বৃষ্টিপাত এবং বিধ্বংসী বন্যা হয়েই চলেছে। প্রকৃতির এই বিরূপ প্রভাবকে আরও গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছানোর পূর্বেই তার এই পরিবর্তনকে রোধ করার জন্য, জাতিসংঘের বৈশ্বিক জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন, কপ২৯-এ ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে ২ ডি. সে. এর নিচে রাখার প্রস্তাবনা করা হয়। এই লক্ষ্য অর্জনের অর্থ হল মানব সমাজ যাতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন বন্ধ করতে পারে, এটিই বিশ্বে ‘কার্বন বাজেট’ নামে পরিচিত। উন্নত দেশগুলো তাদের কার্বন বাজেট অনেক আগেই অতিক্রম করে ফেলেছে, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনও তাদের সীমা বজায় রাখতে সক্ষম। কার্বন ডাই অক্সাইড শতাব্দী ধরে বায়ুম-লে থেকে যায়, যার ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির অতি ব্যবহার পৃথিবীর জন্য একটি ক্রমবর্ধমান ব্যয়বহুল খরচের ক্ষেত্র দিল্লি ভিত্তিক সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া - যারা বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র ১৫% ধারণ করে থাকলেও বায়ুম-লে মজুত কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি নির্গমনে অবদান রেখেছে। এই পরিসংখ্যানগুলো দেখায় যে, ধনী দেশগুলো জলবায়ু উপর যে ঋণ রেখে গেছে, তা এখন দরিদ্র দেশগুলোর কাছে বিশাল বোঝাস্বরূপ। তবে কঠিন বাস্তবতা হল, জলবায়ু রক্ষায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধে গুরুত্ব না দিয়ে এবারের কপ২৯ এর আয়োজক রাষ্ট্র আজারবাইজান তেল এবং গ্যাস উৎপাদনকারীদেরকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তেল সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলো যারা তেল উৎপাদনে বেশি ভূমিকা রাখছে ওপেকভুক্ত সংস্থাগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে এই সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তেলের বা জীবাশ্ম জ্বালানির যে নিরাপদ নেটওয়ার্ক আছে সেটি নিশ্চিত করার জন্য নানা ধরনের তদবির করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বছরের কপ সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষতিপূরণ আদায়ের সম্ভাবনা ক্রমশই ক্ষীন হয়ে আসছে। পরবর্তী বছরে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য কপ৩০ এ জলবায়ু বিপর্যয়ের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য প্রস্তাবিত লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডের জন্য ধনী রাষ্ট্রগুলো অর্থায়ন করবে কিনা সেটি এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রভাবশালী জলবায়ু নীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে জাতিসংঘের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনগুলি কেবলমাত্র সেই দেশেই অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত যারা জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কাজ করাকে স্পষ্টভাবে সমর্থন করে এবং জীবাশ্ম জ্বালানি লবিংয়ের বিষয়ে কঠোর নিয়ম মেনে চলে। বিশেষজ্ঞদের এই দলে রয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, জাতিসংঘের সাবেক জলবায়ু প্রধান ক্রিশ্চিয়ানা ফিগারেস এবং বিশিষ্ট জলবায়ু বিজ্ঞানী জোহান রকস্ট্রোম। তারা জাতিসংঘকে চিঠি দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন- প্যারিস চুক্তির মূল চুক্তি—এর অধীনে বার্ষিক কপ সম্মেলনের বর্তমান জটিল প্রক্রিয়াটিকে সুবিন্যস্ত করার এবং আরও বেশি বেশি মিটিং আয়োজন করার দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, আজারবাইজান কপ সম্মেলনের জন্য একটি বিতর্কিত আয়োজক, কারণ এটি একটি প্রধান জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ, যারা বৈশ্বিক রপ্তানির প্রায় অর্ধেক তেল এবং গ্যাস উৎপাদন করে। গত বছরের সম্মেলনটিও সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি পেট্রোস্টেটে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেই সম্মেলনের সভাপতি, সুলতান আল জাবের, দেশের জাতীয় তেল কোম্পানি অ্যাডনক এর প্রধান পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আয়োজক দেশগুলোকে অবশ্যই প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যগুােল সমুন্নত রাখার জন্য তৎপর হওয়া উচিত।
জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী এবং লবিস্টরা শুধু কপ২৯-এ অংশগ্রহণই করছেন না, বরং অন্তত ১৩২ জন জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির প্রতিনিধিকে আজারবাইজানীয় সরকার ‘অতিথি’ হিসেবে এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং হোস্ট কান্ট্রি ব্যাজ দিয়েছে। কপ২৯-এ অংশগ্রহণকারী উন্নয়নশীল দেশগুলো আয়োজক রাষ্ট্রের এই কর্মকা-ের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করেন এবং । তবে উন্নত রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যের গ্রিন পার্টি জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানি ও লবিস্টদের বাদ দেয়ার দাবি সমর্থন করেছে।
কিক বিগ পলুটারস আউট অ্যাক্টিভিস্ট কোয়ালিশন কর্তৃক বিশ্লেষিত তথ্য অনুসারে, কমপক্ষে ১,৭৭৩টি কয়লা, তেল এবং গ্যাস লবিস্টকে কপ২৯-এ অংশগ্রহণের জন্য প্রবেশাধিকার দেয়া হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জীবাশ্ম জ্বালানি-সংযুক্ত লবিস্টদের সংখ্যা বাকুতে আয়োজিত এই জলবায়ু সম্মেলনে প্রায় প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিদের চেয়ে বেশি। ১০টি জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ থেকে সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য মাত্র ১,০৩৩ জন প্রতিনিধি এসেছেন। ইন্টারন্যাশনাল ইমিশন ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লবিস্ট নিয়ে এসেছে, যেখানে টোটাল এনার্জি এবং গ্লেনকোরের মতো তেলের বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ৪৩ জন প্রতিনিধি রয়েছে। অন্যান্য অনেক দেশের লবিস্টরা জাতীয় প্রতিনিধিদলের অংশ হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। প্রধান তেল উৎপাদক শেভরন, এক্সনমোবিল, বিপি, শেল এবং এনি যাদের মধ্যে জাপান কয়লা জায়ান্ট সুমিতোমো থেকে একজন প্রতিনিধি এনেছে, কানাডা সানকর এবং টুরমালাইন থেকে প্রতিনিধি এনেছে এবং ইতালি এনি এবং এনেলের কর্মীদের নিয়ে এসেছে।
অর্থনীতিবিদরা অনুমান করছেন যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় প্রতিবছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। তবে এখন পর্যন্ত ধনী দেশগুলো থেকে যথাযথ আর্থিক সহায়তার কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। আফ্রিকার মতো মহাদেশগুলো সবুজ শিল্পায়নে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এখানে উৎপাদন অবকাঠামোর অভাব এবং কাঁচামালের সরবরাহকারীর ভূমিকা এই সংকটকে আরও তীব্রতর করেছে। যদিও উন্নত দেশগুলো সবুজ প্রযুক্তিতে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, আফ্রিকা সীমিত প্রযুক্তি স্থানান্তর, ব্যয়বহুল প্রযুক্তি এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থার মতো বাধার মুখোমুখি।
কপ২৯ এ জলবায়ু অর্থায়নের কিছু উৎস খুঁজে বের করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদগণ। প্রাক্তন ফরাসি কূটনীতিক এবং ইউরোপীয় জলবায়ু ফাউন্ডেশনের বর্তমান প্রধান লরেন্স তুবিয়ানার নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্সের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, নতুন ‘বৈশ্বিক সংহতি শুল্ক’ দরিদ্র বিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় জলবায়ু অর্থায়নের অঙ্ককে বাড়াতে পারে। লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডের অর্থের যোগানের জন্য কয়েকটি যুগাক্তকারী বিকল্প হতে পারে ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলোর উপর কর ধার্য করা, প্লাস্টিক উৎপাদন শুল্ক ধার্য করা, পুনরায় ব্যবহারযোগ্য উপাদানের পরিবর্তে পলিমার থেকে প্লাস্টিক উৎপাদন করার জন্য কর ধার্য করা হয় অর্থাৎ যদি টন প্রতি পলিমারের উপর ৬০ থেকে ৯০ ডলার কর নির্ধারণ করা হয় তবে বছরে ২৫ ৩৫ বিলিয়ন ডলার আয় হতে পারে। এর চেয়েও বেশি কার্যকর হবে ২ শতাংশ সম্পদ কর নীতি। এই নীতি ব্রাজিলে প্রচলিত রয়েছে যেটি বছরে ২০০ থেকে ২৫০ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে। বিভিন্ন ফ্লাইয়ার এবং বিজনেস ক্লাস এয়ারলাইনস টিকিটের উপর ট্যাক্স আরোপ করে স্কিমের উপর নির্ভর করে বছরে ১৬৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয় হতে পারে। এভাবে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অনুদানের পর লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডের বাকি অর্থ অর্জন করা সম্ভব।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।