alt

জাতীয়

আন্দোলনে আহতদের জীবনের পথ পালটে যাচ্ছে

চোখের আলো হারিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম

আয়েশা জান্নাত : বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

https://sangbad.net.bd/images/2024/December/26Dec24/news/IMG-20241225-WA0011.jpg

ময়মনসিংহের আল আমিন পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি পেটের টানে। জীবিকার খোঁজে গাজীপুরের এফ বি ফুটওয়্যার গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন। জীবনের চেনা পথে চলতে থাকা আল আমিন হঠাৎই ছাত্রবৈষম্য আন্দোলনে যোগ দেয়। গত ৪ আগস্ট, আন্দোলনের সময় পুলিশের ছররা গুলিতে তার চোখ গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

https://sangbad.net.bd/images/2024/December/26Dec24/news/IMG-20241225-WA0005.jpg

আল আমিন বলেন, ‘সেদিন বেলা সাড়ে চারটার দিকে হঠাৎ করেই একটি গুলি এসে আমার চোখে লাগে। স্থানীয় ভাইয়েরা আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে আমাকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে রেফার করা হয়। প্রথমে চলাফেরা করার মতো অবস্থা ছিলাম না, কিন্তু ৭ আগস্ট ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে পরদিন অপারেশন করে।’

তার চোখের বর্তমান অবস্থার কথা বলতে গিয়ে আল আমিন জানান, "ডাক্তার বলেছেন, আমি আগের মতো দেখতে পারবো। তবে ৬০-৮০ শতাংশ দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। সানগ্লাস ব্যবহার করলে হয়তো ১০০% দৃষ্টিশক্তি ফিরতেও পারে।

আল আমিন আরও বলেন, এখানে ভর্তি হওয়া পর থেকে আমাদের কোন টাকা-পয়সা খরচ করেতে হচ্ছে না সকল খরচ সরকার বহন করছে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লক্ষ্য সাত’শ টাকা দিয়েছে। যখন রিলিজ দেওয়া হয় তখন বাড়িতে চলে যাই । আবার যখন ডেড আসে তখন সেখান থেকে খরচ করছি।

পারভীন, মানবতার ডাকে নিজের দৃষ্টি হারানো এক মা:

জুরাইনে ইট ভাঙার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন পারভীন। গত ৪ আগস্ট, যাত্রাবাড়ী যাওয়ার পথে ছাত্র আন্দোলনের সময় এক ছাত্রকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে আঘাত পান তিনি। তার দুই সন্তান, একজন নয় বছর এবং অন্যজন তিন বছরের। স্বামী রিকশাচালক, যিনি ঘটনার সময় নোয়াখালীতে ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি ঢাকায় এসে স্ত্রীর চিকিৎসার দায়িত্ব নেন।

পারভীন বলেন, ‘আমি ছাত্রটিকে কোলে তুলে আনতে গিইয়া গুলিবিদ্ধ হই। তখনই সাথে সাথে অজ্ঞান হইয়া যাই। হাসপাতালে ভর্তি হলে ডাক্তার জানান, এত দিন বলে আসছে আমার চোখ ঠিক হবে এখন বলছে, আমার বাম চোখটা আর কখনো ঠিক হইবো না ’

জুলাই ফাউন্ডেশনের দেয়া ১ লক্ষ্য টাকা দিইয়েছে জমি কিনবো তাই টাকাটা রাইখা দিয়েছি সাথে কিছু টাকা ভরে জমি কিনবো। তবে আমার দৃষ্টিশক্তি হারানো এবং চিকিৎসার খরচে আমি আর আমার স্বামী দুশ্চিন্তায় আছি। তিনি জানান, ‘প্রতি মাসে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আইসা চিকিৎসা করাতে অনেক কষ্ট হয়। তাছাড়া ঋণ নিয়া এভাবে চলা কঠিন হইয়া পড়ছে।’

দৃষ্টিহীনতার পথে সংগ্রামী রাসেল রানা:

সিরাজগঞ্জের রাসেল রানা কাজের সন্ধানে গাজীপুরে আসেন এবং একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ৪ আগস্ট, ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেন। পুলিশের ছররা গুলিতে তার চোখ গুরুতর ক্ষতি হয়।

https://sangbad.net.bd/images/2024/December/26Dec24/news/IMG-20241225-WA0007.jpg

‘ছয়জন পুলিশ কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই ছররা গুলি ছোড়া শুরু করে। আমার চোখে সরাসরি গুলি লাগে। স্থানীয় ফার্মেসিতে গেলে তারা কিছু করতে অক্ষম বলে জানান। পরে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে যাওয়ার জন্য রেফার করা হয়, কিন্তু কারফিউর কারণে তা সম্ভব হয়নি,’বলেন রাসেল।

পরবর্তীতে মির্জাপুর চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হলেও উন্নত যন্ত্রপাতি ও দক্ষ ডাক্তার না থাকায় আমার চোখের ক্ষতি পুরোপুরি রোধ করতে পারেনি। রাসেল বলেন, ‘আমার চোখে যে বুলেট লেগেছিল, সেটি সরাসরি মনিতে আঘাত করেছে। ডাক্তার বলেছেন, আমার এই চোখ দিয়ে আর কখনো কিছু দেখা সম্ভব নয়।’

https://sangbad.net.bd/images/2024/December/26Dec24/news/IMG-20241225-WA0013.jpg

কুরবান শেখ হিল্লোল: চোখে ১টি ছররা গুলির যন্ত্রণা:

কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ী কুরবান শেখ হিল্লোল আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন। তার সারা শরীর ছররা গুলিতে ঝাঁজরা হলেও চোখের আঘাতই সবচেয়ে গুরুতর। তিনি বলেন,আমার শরীরের ক্ষতগুলো সেরে উঠেছে, কিন্তু চোখের যন্ত্রণা আমাকে প্রতি মুহূর্তে কষ্ট দিচ্ছে। "

রাশেদুল ফকির: পুলিশের হেফাজতে নির্যাতন:

নরসিংদীর রাশেদুল ফকিরও পুলিশি নির্যাতন এবং চিকিৎসাহীনতার শিকার হন। এক চোখে গুলি লেগে তা চোখের ভেতরে রয়ে গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গুলি বের করতে গেলে তার পুরো দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।

https://sangbad.net.bd/images/2024/December/26Dec24/news/IMG-20241225-WA0010.jpg

রাশেদুল ফকির বলেন,‘নরসিংদীর কোনো হাসপাতাল আমাকে সঠিক চিকিৎসা দেয়নি। ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে যেতে গেলে পুলিশ আমাকে আটক করে এবং শারীরিক নির্যাতন চালায়। আমার ডান চোখে গুলি লেগেছে যা এখনো ভেতরে রয়ে গেছে। ডাক্তাররা বলছেন, গুলি বের করলে দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারাতে পারি। এক চোখে দেখতে না পেয়ে আমি এখন অসহায়।’

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ রেজওয়ানুর রহমান সোহেল জানান, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ‘১৭ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১,০০২ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে অনেকের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ছররা গুলির কারণে অনেকের চোখের গভীর ক্ষতি হয়েছে। গুলি সরাসরি রেটিনা বা কর্নিয়ায় আঘাত করায় তা অপসারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই গুলিগুলো দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।’ তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী:

চিকিৎসা নিয়েছেন: ১,০০২ জন,হাসপাতালে ভর্তি: ৮৬৪ জন,অস্ত্রোপচার: ৫০৪ জন,রেটিনা অপারেশন: ২৭৮ জন,কর্নিয়া স্থানান্তর: ২ জন,পুরো দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন: ৫১ জন,দৃষ্টি স্বাভাবিক রয়েছে: ৫৮ জন,এক চোখে দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকি: ৫০০ জন।

সংগ্রাম, কষ্ট এবং ভবিষ্যৎ :

আন্দোলনে অংশ নেওয়া মানুষেরা আজ স্থায়ী শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় ভুগছেন। তাদের এই ক্ষত শুধু শারীরিক নয়, বরং আর্থিক ও মানসিকও। প্রতিটি দিন তারা লড়াই করছে জীবনের সঙ্গে। তাদের এই কষ্ট শুধু তাদের নয়, সমাজের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন তোলে। যতই তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক, তাদের হারানো স্বাভাবিক জীবনের আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

আল আমিন, পারভীন, রাসেল রানা,কুরবান শেখ এবঙ রাশেদুল ফকিরের মতো আহতদের গল্পে ফুটে উঠেছে।

ছবি

সঠিক তথ্য উপস্থাপন গুজব ছড়ানো প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে: পররাষ্ট্র সচিব

ছবি

‘উত্তম কৃষি চর্চা’র মাধ্যমে দেশের বাজারে এলো প্রথম কৃষিপণ্য

ছবি

সচিবালয়ে আগুনের ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের কমিটি

ছবি

আগুনের সূত্রপাত তদন্তের মাধ্যমে জানা যাবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

ফায়ার সার্ভিসের সদস্যকে চাপা দেওয়া ট্রাকচালক আটক শিক্ষার্থীদের হাতে

ছবি

সচিবালয়ে আগুন: ট্রাকচাপায় ফায়ার সার্ভিসের সদস্য নিহত

ছবি

সচিবালয়ের আগুন ছড়িয়েছে ৪টি তলায়, নিয়ন্ত্রণে এসেছে ৫ ঘণ্টা পর

ছবি

সচিবালয়ের আগুন ৭ নম্বর ভবনে আগুন

উপসচিব পদোন্নতিতে আগের কোটা বহাল রাখার অনুরোধ

ছবি

রোহিঙ্গাদের সমাবেশ : শরণার্থী জীবন আর নয়, মায়ানমারে ফিরে যেতে চাই

দ্রুত নির্বাচনের জন্য এত মানুষ শহীদ হয়নি: আসিফ মাহমুদ

ছবি

জাহাজে খুন: লস্কর ইরফান ৭ দিনের রিমান্ডে ‘মাস্টারের অত্যাচারে’ এই হত্যাকাণ্ড

ছবি

সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে আইনের আওতায় আনা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

কমিশনের সুপারিশে প্রশাসনে অসন্তোষ, আন্দোলনে যাচ্ছেন কর্মকর্তারা

ছবি

কয়েদি হত্যা মামলাতেও আসামি শেখ হাসিনা

ছবি

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং বিয়াম ফাউন্ডেশন চুক্তি স্বাক্ষর: পুনর্বাসন এলাকায় নতুন স্কুল চালু

ছবি

বিশ্বশান্তি কামনা বড়দিনের প্রার্থনায়

ছবি

চাঁদপুরে জাহাজে ৭ খুন : একজন বাগেরহাটে গ্রেপ্তার

ছবি

নিউজিল্যান্ডে হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন দূতাবাস

ছবি

মানবতার বন্ধনে আবদ্ধের আমন্ত্রণে শুভ বড়দিন

ছবি

প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহারে বাড়ছে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি

ছবি

শেখ হাসিনাকে ফেরানো: চিঠির পর কী

ছবি

জাহাজে খুন: লাশ হস্তান্তর, স্বজনদের আহাজারি

ছবি

ডিএফপির নতুন মহাপরিচালক খালেদা বেগম

ছবি

সাবেক ১১৯ বঞ্চিত কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে সচিব হচ্ছেন

ছবি

শেখ হাসিনাকে ফেরাতে দিল্লির জবাবের জন্য অপেক্ষা করছে ঢাকা

ছবি

দুদকের মানিলন্ডারিং মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো সাবেক খাদ্য সচিব ইসমাইলকে

ছবি

বড়দিনের নিরাপত্তার দায়িত্বে সোয়াট-স্পেশালাইজড ইউনিট

ছবি

ভারতে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান, মহারাষ্ট্রে গ্রেফতার ৮

ছবি

শ্মশান ঘাটের ভোগঘরে চুরির ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলে ভারতীয় মিডিয়ায় অপপ্রচার

ছবি

সবাই বাড়ির পাশে স্টেশন চায়: রেল উপদেষ্টা

ছবি

প্রধান উপদেষ্টাকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোন

ছবি

রূপপুর ‘দুর্নীতি’: টিউলিপকে যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদ

শেখ হাসিনাকে ফেরাতে দিল্লিকে ঢাকার চিঠি

‘কৌশলে অনুন্নত দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলছে উন্নত দেশগুলো’

ছবি

ট্রেইনি চিকিৎসকদের কর্মবিরতি, হাসপাতালের সেবা বিঘ্ন

tab

জাতীয়

আন্দোলনে আহতদের জীবনের পথ পালটে যাচ্ছে

চোখের আলো হারিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম

আয়েশা জান্নাত

বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

https://sangbad.net.bd/images/2024/December/26Dec24/news/IMG-20241225-WA0011.jpg

ময়মনসিংহের আল আমিন পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি পেটের টানে। জীবিকার খোঁজে গাজীপুরের এফ বি ফুটওয়্যার গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন। জীবনের চেনা পথে চলতে থাকা আল আমিন হঠাৎই ছাত্রবৈষম্য আন্দোলনে যোগ দেয়। গত ৪ আগস্ট, আন্দোলনের সময় পুলিশের ছররা গুলিতে তার চোখ গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

https://sangbad.net.bd/images/2024/December/26Dec24/news/IMG-20241225-WA0005.jpg

আল আমিন বলেন, ‘সেদিন বেলা সাড়ে চারটার দিকে হঠাৎ করেই একটি গুলি এসে আমার চোখে লাগে। স্থানীয় ভাইয়েরা আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে আমাকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে রেফার করা হয়। প্রথমে চলাফেরা করার মতো অবস্থা ছিলাম না, কিন্তু ৭ আগস্ট ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে পরদিন অপারেশন করে।’

তার চোখের বর্তমান অবস্থার কথা বলতে গিয়ে আল আমিন জানান, "ডাক্তার বলেছেন, আমি আগের মতো দেখতে পারবো। তবে ৬০-৮০ শতাংশ দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। সানগ্লাস ব্যবহার করলে হয়তো ১০০% দৃষ্টিশক্তি ফিরতেও পারে।

আল আমিন আরও বলেন, এখানে ভর্তি হওয়া পর থেকে আমাদের কোন টাকা-পয়সা খরচ করেতে হচ্ছে না সকল খরচ সরকার বহন করছে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লক্ষ্য সাত’শ টাকা দিয়েছে। যখন রিলিজ দেওয়া হয় তখন বাড়িতে চলে যাই । আবার যখন ডেড আসে তখন সেখান থেকে খরচ করছি।

পারভীন, মানবতার ডাকে নিজের দৃষ্টি হারানো এক মা:

জুরাইনে ইট ভাঙার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন পারভীন। গত ৪ আগস্ট, যাত্রাবাড়ী যাওয়ার পথে ছাত্র আন্দোলনের সময় এক ছাত্রকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে আঘাত পান তিনি। তার দুই সন্তান, একজন নয় বছর এবং অন্যজন তিন বছরের। স্বামী রিকশাচালক, যিনি ঘটনার সময় নোয়াখালীতে ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি ঢাকায় এসে স্ত্রীর চিকিৎসার দায়িত্ব নেন।

পারভীন বলেন, ‘আমি ছাত্রটিকে কোলে তুলে আনতে গিইয়া গুলিবিদ্ধ হই। তখনই সাথে সাথে অজ্ঞান হইয়া যাই। হাসপাতালে ভর্তি হলে ডাক্তার জানান, এত দিন বলে আসছে আমার চোখ ঠিক হবে এখন বলছে, আমার বাম চোখটা আর কখনো ঠিক হইবো না ’

জুলাই ফাউন্ডেশনের দেয়া ১ লক্ষ্য টাকা দিইয়েছে জমি কিনবো তাই টাকাটা রাইখা দিয়েছি সাথে কিছু টাকা ভরে জমি কিনবো। তবে আমার দৃষ্টিশক্তি হারানো এবং চিকিৎসার খরচে আমি আর আমার স্বামী দুশ্চিন্তায় আছি। তিনি জানান, ‘প্রতি মাসে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আইসা চিকিৎসা করাতে অনেক কষ্ট হয়। তাছাড়া ঋণ নিয়া এভাবে চলা কঠিন হইয়া পড়ছে।’

দৃষ্টিহীনতার পথে সংগ্রামী রাসেল রানা:

সিরাজগঞ্জের রাসেল রানা কাজের সন্ধানে গাজীপুরে আসেন এবং একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ৪ আগস্ট, ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেন। পুলিশের ছররা গুলিতে তার চোখ গুরুতর ক্ষতি হয়।

https://sangbad.net.bd/images/2024/December/26Dec24/news/IMG-20241225-WA0007.jpg

‘ছয়জন পুলিশ কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই ছররা গুলি ছোড়া শুরু করে। আমার চোখে সরাসরি গুলি লাগে। স্থানীয় ফার্মেসিতে গেলে তারা কিছু করতে অক্ষম বলে জানান। পরে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে যাওয়ার জন্য রেফার করা হয়, কিন্তু কারফিউর কারণে তা সম্ভব হয়নি,’বলেন রাসেল।

পরবর্তীতে মির্জাপুর চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হলেও উন্নত যন্ত্রপাতি ও দক্ষ ডাক্তার না থাকায় আমার চোখের ক্ষতি পুরোপুরি রোধ করতে পারেনি। রাসেল বলেন, ‘আমার চোখে যে বুলেট লেগেছিল, সেটি সরাসরি মনিতে আঘাত করেছে। ডাক্তার বলেছেন, আমার এই চোখ দিয়ে আর কখনো কিছু দেখা সম্ভব নয়।’

https://sangbad.net.bd/images/2024/December/26Dec24/news/IMG-20241225-WA0013.jpg

কুরবান শেখ হিল্লোল: চোখে ১টি ছররা গুলির যন্ত্রণা:

কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ী কুরবান শেখ হিল্লোল আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন। তার সারা শরীর ছররা গুলিতে ঝাঁজরা হলেও চোখের আঘাতই সবচেয়ে গুরুতর। তিনি বলেন,আমার শরীরের ক্ষতগুলো সেরে উঠেছে, কিন্তু চোখের যন্ত্রণা আমাকে প্রতি মুহূর্তে কষ্ট দিচ্ছে। "

রাশেদুল ফকির: পুলিশের হেফাজতে নির্যাতন:

নরসিংদীর রাশেদুল ফকিরও পুলিশি নির্যাতন এবং চিকিৎসাহীনতার শিকার হন। এক চোখে গুলি লেগে তা চোখের ভেতরে রয়ে গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গুলি বের করতে গেলে তার পুরো দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।

https://sangbad.net.bd/images/2024/December/26Dec24/news/IMG-20241225-WA0010.jpg

রাশেদুল ফকির বলেন,‘নরসিংদীর কোনো হাসপাতাল আমাকে সঠিক চিকিৎসা দেয়নি। ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে যেতে গেলে পুলিশ আমাকে আটক করে এবং শারীরিক নির্যাতন চালায়। আমার ডান চোখে গুলি লেগেছে যা এখনো ভেতরে রয়ে গেছে। ডাক্তাররা বলছেন, গুলি বের করলে দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারাতে পারি। এক চোখে দেখতে না পেয়ে আমি এখন অসহায়।’

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ রেজওয়ানুর রহমান সোহেল জানান, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ‘১৭ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১,০০২ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে অনেকের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ছররা গুলির কারণে অনেকের চোখের গভীর ক্ষতি হয়েছে। গুলি সরাসরি রেটিনা বা কর্নিয়ায় আঘাত করায় তা অপসারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই গুলিগুলো দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।’ তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী:

চিকিৎসা নিয়েছেন: ১,০০২ জন,হাসপাতালে ভর্তি: ৮৬৪ জন,অস্ত্রোপচার: ৫০৪ জন,রেটিনা অপারেশন: ২৭৮ জন,কর্নিয়া স্থানান্তর: ২ জন,পুরো দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন: ৫১ জন,দৃষ্টি স্বাভাবিক রয়েছে: ৫৮ জন,এক চোখে দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকি: ৫০০ জন।

সংগ্রাম, কষ্ট এবং ভবিষ্যৎ :

আন্দোলনে অংশ নেওয়া মানুষেরা আজ স্থায়ী শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় ভুগছেন। তাদের এই ক্ষত শুধু শারীরিক নয়, বরং আর্থিক ও মানসিকও। প্রতিটি দিন তারা লড়াই করছে জীবনের সঙ্গে। তাদের এই কষ্ট শুধু তাদের নয়, সমাজের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন তোলে। যতই তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক, তাদের হারানো স্বাভাবিক জীবনের আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

আল আমিন, পারভীন, রাসেল রানা,কুরবান শেখ এবঙ রাশেদুল ফকিরের মতো আহতদের গল্পে ফুটে উঠেছে।

back to top