কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। কনকনে শীত আর হিমেল হাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ‘সারাদেশের’ জনজীবন। সড়কে কমেছে মানুষ, যানবাহন চলছে লাইট জ্বালিয়ে আর হাসপাতালগুলোতে বেড়েই চলছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা।
দুদিন ধরে দেশের বেশিরভাগ স্থানে দেখা মেলেনি সূর্যের। আবহাওয়া অফিস বলছে, ডিসেম্বরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলেও জানুয়ারিতে শীত জেঁকে বসতে পারে। হতে পারে একাধিক তীব্র শৈত্যপ্রবাহ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে ‘সহনীয়’ পর্যায়ের শীত থাকলেও দেশের ১৩ জেলার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার খবর দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। তবে আবহাওয়া অফিস বলছে, তাপমাত্রা বেড়ে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে শীতের অনুভূতি কমে আসবে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, দেশের উত্তারাঞ্চলে শীতের প্রভাব বেশি পড়েছে। এই জেলাগুলোতে অবস্থা ‘শোচনীয়’। জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে তিস্তা ধরলার শতাধিক চরের অসহায় মানুষগুলো। তীব্র শীতে ঘর থেকে বের হতে পারছে না বলে তাদের কাজ বন্ধ। চরের একাধিক চেয়ারম্যান জানান, সরকারের কাছ থেকে যে পরিমাণ শীতবস্ত্র দেয়া হয়েছে তার পরিমাণ অতি ‘সামান্য’।
তীব্র শীতে মানুষের ভোগান্তি:
ঢাকায় শীতের প্রকোপে সকালের ভোগান্তিতে শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষ। বিশেষ করে নি¤œবিত্ত মানুষেরা শীতের তীব্র শীতের কষ্ট সয়ে বেঁচে আছেন। মোহাম্মদপুরে দেখা মেলে রংপুরের রিকশা চালক আমজাদ মিয়ার। তিনি মোটা শীতের কাপড় জড়িয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘খুব ঠা-া। দিন কাটায় যাচ্ছে না। হাড্ডিত ঠাণ্ডা নাগোচে। সাথোত বাতাস কাহিল করি ফেলাইছে হামাক। বেলা গড়ি গেইলেও সূর্যের দেখা যায়ছে না। কয়েক দিন থাকি ঠা-া বেশি। বাড়িত ঘরোত না হাইলে চুলার পাড়োত বসি থাকিবার নাগেছে।’
পাশে বসা কুড়িগ্রামের বাসিন্দা আবু আলম। রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, ‘প্যাট খায়। ঠাণ্ডা গরম পানি হইলে কি করির আছে। হামাক রিকসা ধরি না বেরাইলে পেটোত ভাত যাইবে না।’
তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন ঠা-া খুব বেশি। মানুষজন বাহিরে তেমন নেই। উপার্জনও কমে গেছে। বাড়িত ট্যাকা পাটপার পারোচিনা, সংসার চালামো কী করে, হামার কষ্ট কেউ দেখেনা।’
রাজধানীর নালন্দা স্কুলের শিক্ষার্থী আফিয়া। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সে আজ স্কুলে যায়নি। এই শিক্ষার্থীর মা জানায়, শীতের জন্য সকালে স্কুলে যেতে পারেনি। অনেক জেলায় স্কুল বন্ধ দিচ্ছে, ঢাকায় দিচ্ছে না কেন জানি না। বিশেষ করে ছোটদের তো অনেক কষ্ট হচ্ছে।’
শীত তাড়াতে সকাল বেলাতেও মিরপুরের কালশী ফ্লাইওভারের নিচে বসে আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিচ্ছিলেন ছিন্নমূল রনি বলেন, ‘আগুনের কারণে ঠা-া একটু কম লাগতেছে। একটা পাতলা সোয়েটারে তো হয় না। রাতে বেশি কষ্ট হয়, কাঁপতে থাকি, ঘুম হয় না। শীতের মোটা কাপড় পাইলে তো ভালোই হইত, কেউ তো দেয় না।’
রাজধানীতে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালকদের তীব্র শীতে নাকে-মুখে মাফলার পেঁচিয়ে, হাতে মোজা পরে কেউ কেউ মোড়গুলোতে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। তারা দাবি করছে, ঠাণ্ডায় মোটরসাইকেলে যাত্রী তেমন একটা ‘উঠছেন না’।
তবে মোড়ে মোড়ে সড়ব দেখা গেছে পিঠাপুলি ও চায়ের দোকানগুলোতে। অস্থায়ী পিঠার দোকানের চুলা ঘিরে বসে থাকতে দেখা গেছে অনেককেই। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন ফুটপাতে থাকা ভাসমান মানুষেরা।
পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা নামল ৮ ডিগ্রির ঘরে :
পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পঞ্চগড়ে নেমেছে ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি। শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ভোর ৬টায় এ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গত দিনের মতো ভোর থেকেই ঘন কুয়াশার আবরণে ঢাকা পড়েছে উত্তরের প্রান্তিক এ জেলা। কুয়াশার কারণে শহর ও গ্রামের সড়কগুলোতে হেডলাইট জ্বালিয়ে বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাসবাস, ইজিবাইক ও মোটরসাইকেলগুলোকে চলতে দেখা গেছে। হিমেল বাতাসের সঙ্গে ঝরছে হিম শিশির। এমন পরিস্থিতিতে দুর্ভোগে পড়েছেন ছিন্নমূল, খেটে খাওয়া, দিনমজুর ও নিম্নআয়ের মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, তাপমাত্রা কমার চেয়েও বেশি অসুবিধা হচ্ছে হিমশীতল বাতাসে। এর পাশাপাশি ঘন কুয়াশা থাকায় বাতাসে তা কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। ঘরে ঘরে লেপ-কাঁথা নামানো হয়েছে। তবে গত কয়েকদিন থেকেই শীতের তীব্রতা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন নিম্নআয়ের মানুষজন। গ্রামের নারীরা বলছেন, তীব্রশীতের কারণে ঘরের ফ্লোর, আসবাবপত্র, বিছানাপত্রসহ সবকিছু যেন বরফ হয়ে উঠে। ভোরে উঠে কাজ করতে খুবই অসুবিধা হয়ে উঠে।
লালমনিরহাটে শীতের তীব্রতা, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯.৫ ডিগ্রি লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানায়, দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলাটিতে কয়েকদিন ধরে ঘন কুয়াশা, হিমেল বাতাস আর কনকনে ঠাণ্ডায় জবুথবু মানুষ। গত ৩ দিন ধরে সূর্যের দেখা মিলেনি। হাটবাজারে লোকজনের উপস্থিতি কমে গেছে। ঘন কুয়াশার কারণে লালমনিরহাট বুড়িমারী মহাসড়কে যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। দূর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
রাজারহাট আবহাওয়া অফিস কর্তৃপক্ষ জানায়, শুক্রবার সকাল ৯ টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে গ্রামের শ্রমজীবী মানুষজন বিপাকে পড়েছেন।
তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে শীতার্ত দুঃস্থ মানুষের ভরসা খড়কুটোর আগুন। একসঙ্গে বসে আগুন জ্বালিয়ে শরীর তা দিচ্ছেন ঠা-ার দাপট থেকে রক্ষা পেতে।
হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা মোমেনা বলেন, ঠা-ায় সকাল সকাল কাজে যোগ দিতে কষ্ট হয়। রাতে শীতের তীব্রতায় কষ্ট বেড়েছে, সকালে কুয়াশার কারণে এ কষ্ট তীব্র হয়েছে।
রাজারহাট আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, লালমনিরহাটে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তাপমাত্রা আরও কমে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
হাতীবান্ধা উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার খিতিশ খালকো বলেন, শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমা জনিত রোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে শিশু ও বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছে। এজন্য শিশু-বৃদ্ধের খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোন প্রকার ঠা-া না লাগে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার বলেন, ঠা-ার কারণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছিন্নমূল মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি চলমান রয়েছে আমাদের।
কেন তীব্র শীত
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে সূর্যের অবস্থান অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডে। যে কারণে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডে এখন গরম। এই গরমের প্রভাবে সেখানকার বাতাস উত্তপ্ত হয়ে হালকা হয়ে উপরের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। সেখানকার বায়ুম-লের শূণ্যস্থান পূরণ করতে বাংলাদেশের এদিক থেকে বাতাস ধাবিত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া অভিমুখে। এই সময়ে বাংলাদেশে উত্তর দিক থেকে মানে হিমালয়ের বরফের ঠা-া বাতাস বাংলাদেশের বায়ুম-লে তৈরি হওয়া শূণ্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসছে। গত কয়েকদিন আগে বঙ্গোপসাগরে তাপমাত্রা বেশি ছিল বলে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছিল।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও সেন্টার ফর পিপল এন্ড এনভায়রন (সিপিই) পরিচালক মুহম্মদ আবদুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘সেই লঘুচাপ কেটে গেছে বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে। তাই উত্তর দিক থেকে প্রবাহিত বাতাসের পরিমাণ বেড়েছে। এই অতিরিক্ত বাতাস হিমালয় থেকে প্রচুর শীতল পানির বাষ্পসহ বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে অবস্থান করছে। এই জলীয় বাষ্প এবং বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে বিদ্যমান গ্যাসীয় কণা সূর্য রশ্মি ভূপৃষ্ট অবদি আসতে বাধা সৃষ্টি করছে যা শৈত্যপ্রবাহ তৈরি করছে। সম্পূর্ণ উত্তরায়ণ কার্যকর যে কারণে তাপমাত্রা একই থাকার ফলেও উত্তরের হিমশীতল বাতাস দেশে অনুভূত শীতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।’
শীতের অনুভূতি কমার আভাস:
আবহাওয়ার জানুয়ারি মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে এক থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি এবং এক থেকে দুটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা বলেন, ‘শৈত্যপ্রবাহ কমে আসবে কি না বলা যাচ্ছে না; তবে তাপমাত্রা একটু বাড়বে- এর ফলে কয়েকদিন শীতের অনুভূতি কম থাকবে।’
শুক্রবার আবহাওয়ার নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, নওগাঁ এবং কুষ্টিয়া জেলাসহ রংপুর বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এদিন দেশের সর্বনিম্ন ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়।
বড় এলাকাজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়; ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
বুলেটিনে আরও বলা হয়, সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য এবং দেশের পশ্চিমাঞ্চলে দিনের তাপমাত্রা ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। এছাড়া দেশের অন্যান্য এলাকার তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, মধ্য রাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত এ পরিস্থিতি থাকতে পারে।
ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলে।
ঘন কুয়াশায় দুর্ঘটনা এড়াতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা:
রাদেশে চলমান শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার কারণে রেলপথে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকীর পাঠানো এক বার্তায় এ কথা জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘন কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা হ্রাস পাওয়ায় রানিং স্টাফদের (ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত কর্মী) যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রেলক্রসিংয়ে দায়িত্বরত কর্মচারীদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অরক্ষিত রেলক্রসিং পারাপারে পথচারীদের সতর্কতা এবং রেললাইনে অকারণে যাতায়াত পরিহার করতে নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে।
রেল কর্মকর্তারা জানান, চলমান শৈত্যপ্রবাহে ঘন কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কমেছে। এতে যথাযথ গতি বজায় রেখে ট্রেন চলাচল বিঘিœত হওয়ার এবং রেলপথে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে রেলওয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, পথচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের জন্য নির্দেশনা ও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারী ২০২৫
কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। কনকনে শীত আর হিমেল হাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ‘সারাদেশের’ জনজীবন। সড়কে কমেছে মানুষ, যানবাহন চলছে লাইট জ্বালিয়ে আর হাসপাতালগুলোতে বেড়েই চলছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা।
দুদিন ধরে দেশের বেশিরভাগ স্থানে দেখা মেলেনি সূর্যের। আবহাওয়া অফিস বলছে, ডিসেম্বরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলেও জানুয়ারিতে শীত জেঁকে বসতে পারে। হতে পারে একাধিক তীব্র শৈত্যপ্রবাহ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে ‘সহনীয়’ পর্যায়ের শীত থাকলেও দেশের ১৩ জেলার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার খবর দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। তবে আবহাওয়া অফিস বলছে, তাপমাত্রা বেড়ে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে শীতের অনুভূতি কমে আসবে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, দেশের উত্তারাঞ্চলে শীতের প্রভাব বেশি পড়েছে। এই জেলাগুলোতে অবস্থা ‘শোচনীয়’। জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে তিস্তা ধরলার শতাধিক চরের অসহায় মানুষগুলো। তীব্র শীতে ঘর থেকে বের হতে পারছে না বলে তাদের কাজ বন্ধ। চরের একাধিক চেয়ারম্যান জানান, সরকারের কাছ থেকে যে পরিমাণ শীতবস্ত্র দেয়া হয়েছে তার পরিমাণ অতি ‘সামান্য’।
তীব্র শীতে মানুষের ভোগান্তি:
ঢাকায় শীতের প্রকোপে সকালের ভোগান্তিতে শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষ। বিশেষ করে নি¤œবিত্ত মানুষেরা শীতের তীব্র শীতের কষ্ট সয়ে বেঁচে আছেন। মোহাম্মদপুরে দেখা মেলে রংপুরের রিকশা চালক আমজাদ মিয়ার। তিনি মোটা শীতের কাপড় জড়িয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘খুব ঠা-া। দিন কাটায় যাচ্ছে না। হাড্ডিত ঠাণ্ডা নাগোচে। সাথোত বাতাস কাহিল করি ফেলাইছে হামাক। বেলা গড়ি গেইলেও সূর্যের দেখা যায়ছে না। কয়েক দিন থাকি ঠা-া বেশি। বাড়িত ঘরোত না হাইলে চুলার পাড়োত বসি থাকিবার নাগেছে।’
পাশে বসা কুড়িগ্রামের বাসিন্দা আবু আলম। রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, ‘প্যাট খায়। ঠাণ্ডা গরম পানি হইলে কি করির আছে। হামাক রিকসা ধরি না বেরাইলে পেটোত ভাত যাইবে না।’
তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন ঠা-া খুব বেশি। মানুষজন বাহিরে তেমন নেই। উপার্জনও কমে গেছে। বাড়িত ট্যাকা পাটপার পারোচিনা, সংসার চালামো কী করে, হামার কষ্ট কেউ দেখেনা।’
রাজধানীর নালন্দা স্কুলের শিক্ষার্থী আফিয়া। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সে আজ স্কুলে যায়নি। এই শিক্ষার্থীর মা জানায়, শীতের জন্য সকালে স্কুলে যেতে পারেনি। অনেক জেলায় স্কুল বন্ধ দিচ্ছে, ঢাকায় দিচ্ছে না কেন জানি না। বিশেষ করে ছোটদের তো অনেক কষ্ট হচ্ছে।’
শীত তাড়াতে সকাল বেলাতেও মিরপুরের কালশী ফ্লাইওভারের নিচে বসে আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিচ্ছিলেন ছিন্নমূল রনি বলেন, ‘আগুনের কারণে ঠা-া একটু কম লাগতেছে। একটা পাতলা সোয়েটারে তো হয় না। রাতে বেশি কষ্ট হয়, কাঁপতে থাকি, ঘুম হয় না। শীতের মোটা কাপড় পাইলে তো ভালোই হইত, কেউ তো দেয় না।’
রাজধানীতে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালকদের তীব্র শীতে নাকে-মুখে মাফলার পেঁচিয়ে, হাতে মোজা পরে কেউ কেউ মোড়গুলোতে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। তারা দাবি করছে, ঠাণ্ডায় মোটরসাইকেলে যাত্রী তেমন একটা ‘উঠছেন না’।
তবে মোড়ে মোড়ে সড়ব দেখা গেছে পিঠাপুলি ও চায়ের দোকানগুলোতে। অস্থায়ী পিঠার দোকানের চুলা ঘিরে বসে থাকতে দেখা গেছে অনেককেই। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন ফুটপাতে থাকা ভাসমান মানুষেরা।
পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা নামল ৮ ডিগ্রির ঘরে :
পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পঞ্চগড়ে নেমেছে ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি। শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ভোর ৬টায় এ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গত দিনের মতো ভোর থেকেই ঘন কুয়াশার আবরণে ঢাকা পড়েছে উত্তরের প্রান্তিক এ জেলা। কুয়াশার কারণে শহর ও গ্রামের সড়কগুলোতে হেডলাইট জ্বালিয়ে বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাসবাস, ইজিবাইক ও মোটরসাইকেলগুলোকে চলতে দেখা গেছে। হিমেল বাতাসের সঙ্গে ঝরছে হিম শিশির। এমন পরিস্থিতিতে দুর্ভোগে পড়েছেন ছিন্নমূল, খেটে খাওয়া, দিনমজুর ও নিম্নআয়ের মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, তাপমাত্রা কমার চেয়েও বেশি অসুবিধা হচ্ছে হিমশীতল বাতাসে। এর পাশাপাশি ঘন কুয়াশা থাকায় বাতাসে তা কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। ঘরে ঘরে লেপ-কাঁথা নামানো হয়েছে। তবে গত কয়েকদিন থেকেই শীতের তীব্রতা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন নিম্নআয়ের মানুষজন। গ্রামের নারীরা বলছেন, তীব্রশীতের কারণে ঘরের ফ্লোর, আসবাবপত্র, বিছানাপত্রসহ সবকিছু যেন বরফ হয়ে উঠে। ভোরে উঠে কাজ করতে খুবই অসুবিধা হয়ে উঠে।
লালমনিরহাটে শীতের তীব্রতা, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯.৫ ডিগ্রি লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানায়, দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলাটিতে কয়েকদিন ধরে ঘন কুয়াশা, হিমেল বাতাস আর কনকনে ঠাণ্ডায় জবুথবু মানুষ। গত ৩ দিন ধরে সূর্যের দেখা মিলেনি। হাটবাজারে লোকজনের উপস্থিতি কমে গেছে। ঘন কুয়াশার কারণে লালমনিরহাট বুড়িমারী মহাসড়কে যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। দূর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
রাজারহাট আবহাওয়া অফিস কর্তৃপক্ষ জানায়, শুক্রবার সকাল ৯ টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে গ্রামের শ্রমজীবী মানুষজন বিপাকে পড়েছেন।
তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে শীতার্ত দুঃস্থ মানুষের ভরসা খড়কুটোর আগুন। একসঙ্গে বসে আগুন জ্বালিয়ে শরীর তা দিচ্ছেন ঠা-ার দাপট থেকে রক্ষা পেতে।
হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা মোমেনা বলেন, ঠা-ায় সকাল সকাল কাজে যোগ দিতে কষ্ট হয়। রাতে শীতের তীব্রতায় কষ্ট বেড়েছে, সকালে কুয়াশার কারণে এ কষ্ট তীব্র হয়েছে।
রাজারহাট আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, লালমনিরহাটে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তাপমাত্রা আরও কমে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
হাতীবান্ধা উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার খিতিশ খালকো বলেন, শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমা জনিত রোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে শিশু ও বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছে। এজন্য শিশু-বৃদ্ধের খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোন প্রকার ঠা-া না লাগে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার বলেন, ঠা-ার কারণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছিন্নমূল মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি চলমান রয়েছে আমাদের।
কেন তীব্র শীত
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে সূর্যের অবস্থান অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডে। যে কারণে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডে এখন গরম। এই গরমের প্রভাবে সেখানকার বাতাস উত্তপ্ত হয়ে হালকা হয়ে উপরের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। সেখানকার বায়ুম-লের শূণ্যস্থান পূরণ করতে বাংলাদেশের এদিক থেকে বাতাস ধাবিত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া অভিমুখে। এই সময়ে বাংলাদেশে উত্তর দিক থেকে মানে হিমালয়ের বরফের ঠা-া বাতাস বাংলাদেশের বায়ুম-লে তৈরি হওয়া শূণ্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসছে। গত কয়েকদিন আগে বঙ্গোপসাগরে তাপমাত্রা বেশি ছিল বলে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছিল।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও সেন্টার ফর পিপল এন্ড এনভায়রন (সিপিই) পরিচালক মুহম্মদ আবদুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘সেই লঘুচাপ কেটে গেছে বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে। তাই উত্তর দিক থেকে প্রবাহিত বাতাসের পরিমাণ বেড়েছে। এই অতিরিক্ত বাতাস হিমালয় থেকে প্রচুর শীতল পানির বাষ্পসহ বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে অবস্থান করছে। এই জলীয় বাষ্প এবং বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে বিদ্যমান গ্যাসীয় কণা সূর্য রশ্মি ভূপৃষ্ট অবদি আসতে বাধা সৃষ্টি করছে যা শৈত্যপ্রবাহ তৈরি করছে। সম্পূর্ণ উত্তরায়ণ কার্যকর যে কারণে তাপমাত্রা একই থাকার ফলেও উত্তরের হিমশীতল বাতাস দেশে অনুভূত শীতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।’
শীতের অনুভূতি কমার আভাস:
আবহাওয়ার জানুয়ারি মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে এক থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি এবং এক থেকে দুটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা বলেন, ‘শৈত্যপ্রবাহ কমে আসবে কি না বলা যাচ্ছে না; তবে তাপমাত্রা একটু বাড়বে- এর ফলে কয়েকদিন শীতের অনুভূতি কম থাকবে।’
শুক্রবার আবহাওয়ার নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, নওগাঁ এবং কুষ্টিয়া জেলাসহ রংপুর বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এদিন দেশের সর্বনিম্ন ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়।
বড় এলাকাজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়; ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
বুলেটিনে আরও বলা হয়, সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য এবং দেশের পশ্চিমাঞ্চলে দিনের তাপমাত্রা ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। এছাড়া দেশের অন্যান্য এলাকার তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, মধ্য রাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত এ পরিস্থিতি থাকতে পারে।
ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলে।
ঘন কুয়াশায় দুর্ঘটনা এড়াতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা:
রাদেশে চলমান শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার কারণে রেলপথে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকীর পাঠানো এক বার্তায় এ কথা জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘন কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা হ্রাস পাওয়ায় রানিং স্টাফদের (ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত কর্মী) যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রেলক্রসিংয়ে দায়িত্বরত কর্মচারীদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অরক্ষিত রেলক্রসিং পারাপারে পথচারীদের সতর্কতা এবং রেললাইনে অকারণে যাতায়াত পরিহার করতে নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে।
রেল কর্মকর্তারা জানান, চলমান শৈত্যপ্রবাহে ঘন কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কমেছে। এতে যথাযথ গতি বজায় রেখে ট্রেন চলাচল বিঘিœত হওয়ার এবং রেলপথে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে রেলওয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, পথচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের জন্য নির্দেশনা ও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।