বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তে গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনের কাজ চূড়ান্ত পর্বে রয়েছে। আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে।
সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলনের ফাঁকে ২২ জানুয়ারি বুধবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এ কথা জানিয়েছেন বলে খবর বাসসের।
বাসসের প্রতিবেদনে জানা যায়, জেনিভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় থেকে প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগে তা বাংলাদেশকে দেখানো হবে বলেও প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন টুর্ক।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধ তদন্তের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের গঠিত প্রধান ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনও প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হবে। এসব প্রতিবেদন একে অপরের পরিপূরক হতে পারে।’
বৈঠকে মায়ানমার থেকে নতুন করে হাজার হাজার শরণার্থী আসার পর সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে, তা সমাধানে সহযোগিতার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানের প্রতি আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।
পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে টুর্ক জানান এ বিষয়ে জাতিসংঘের মায়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি।
এসময় রোহিঙ্গাদের নতুন করে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মায়ানমারের রাখাইন অংশে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ অঞ্চল তৈরির আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বৃহৎ পরিসরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। উচ্চ পর্যায়ের সেই সম্মেলনের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, এটি যে সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকটগুলোর একটি, ওই সম্মেলন সেদিকে বিশ্বের নজর ফেরাবে।
টুর্ক বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হারানো মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে এ ধরনের সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৈঠককালে অন্যদের মধ্যে সরকারের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সচিব লামিয়া মোরশেদ, জেনিভায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি তারেক আরিফুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
চুরি যাওয়া সম্পদ ফেরাতেও সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা
এর আগে বাংলাদেশের শত শত বিলিয়ন চুরি যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে বিদেশি নেতাদের সমর্থন চান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা বুধবার জার্মানির ফেডারেল চ্যান্সেলারির প্রধান ও বিশেষ কার্যাদির ফেডারেল মন্ত্রী উলফগ্যাং শ্মিট, বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেটংটার্ন সিনাওয়াত্রা, সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্র বিভাগের ফেডারেল কাউন্সিলর ইগনাজিও ক্যাসিস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই সংস্কৃতি ও শিল্প কর্তৃপক্ষের চেয়ারপারসন শেখ লতিফা বিনতে মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স শিসেকেদি, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রাক্তন মার্কিন বিশেষ দূত জন কেরি এবং প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারসহ অন্যান্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনামলে বাংলাদেশে কিভাবে প্রকাশ্যে ও দিবালোকে ডাকাতি সংঘটিত হয়েছিল তা খতিয়ে দেখার জন্য শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকে বাংলাদেশে পাঠাতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সচিব লামিয়া মোর্শেদ এবং জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি তারেক আরিফুল ইসলাম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
লুৎফে সিদ্দিকী জার্মান মন্ত্রী উলফগ্যাং শ্মিটকে চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে সরকারের প্রচেষ্টা সম্পর্কে অবহিত করে বলেন, ‘সরকার এই বিষয়ে একটি সম্পদ পুনরুদ্ধার কমিটি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার প্রাথমিকভাবে শীর্ষ ২০ জন অর্থ পাচারকারীকে তাদের চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে চিহ্নিত করেছে।’
দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস জার্মান মন্ত্রীকে বলেন, ‘আমরা যখন নতুন বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলি, তখন আমরা পরিষ্কার বাংলাদেশের কথাও বলি।’
প্রধান উপদেষ্টা এই বিষয়ে জার্মান সমর্থন চেয়েছেন এবং জার্মান মন্ত্রীর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। জার্মান মন্ত্রী বলেন, ‘এপ্রিলে একটি নতুন জার্মান ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ নেপালের জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা অন্বেষণের জন্য ভারত, নেপাল এবং ভুটানকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চায়। নেপাল সত্যিই বিদ্যুৎ বেচতে প্রস্তুত এবং বাংলাদেশ একটি ভালো বাজার। এটি প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে।’
প্রধান উপদেষ্টা সুইস ফেডারেল কাউন্সিলর ইগনাজিও ক্যাসিসের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং জলবায়ু অর্থায়নসহ পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি সুইজারল্যান্ডকে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে কার্বন রোধ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করেছেন। সুইজারল্যান্ডকে বাংলাদেশের যুবসমাজের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক হলো ২৭ বছরের কম বয়সী তরুণ।
প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশ্ব নেতাদের অবহিত করেন। জার্মান মন্ত্রী এবং সুইস কাউন্সিলরের সঙ্গে সাক্ষাতে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রধান উপদেষ্টা থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিনাওয়াত্রার সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট এবং জাহাজ চলাচলসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। সিনাওয়াত্রা দুই দেশের মধ্যে যুব সম্পৃক্ততা বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা থাই প্রধানমন্ত্রীকে ‘থ্রি জিরো’ ধারণা সম্পর্কে অবহিত করেন, যার লক্ষ্য দারিদ্র্য, সম্পদের ঘনত্ব, বেকারত্ব এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে একটি আত্ম-ধ্বংসী সভ্যতাকে উদ্ধার করা। অধ্যাপক ইউনূস সিনাওয়াত্রাকে বলেন, বর্তমানে বিশ্বের ৫৮টি দেশে প্রায় ৫০০০ ‘থ্রি জিরো’ ক্লাব রয়েছে। থাই প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন এই বছরের এপ্রিলে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হবে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তিনি সংগঠনের পরিকল্পিত শীর্ষ সম্মেলনের সময় বিমসটেকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশকে আসিয়ানের একটি সেক্টরাল সংলাপ অংশীদার হতে এবং ফলস্বরূপ সংস্থার পূর্ণ সদস্য হতে থাইল্যান্ডের সমর্থন চান।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহায়তা দেবে জাতিসংঘ
এদিকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্বের মনোযোগ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, অতিরিক্ত প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এসে বাংলাদেশের ওপর বোঝা বাড়িয়ে তুলেছে। অর্থনৈতিক সম্মেলনের ফাঁকে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডির সঙ্গে বৈঠকে এসব কথা বলেন তিনি।
বৈঠকে ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি জানিয়েছেন, তার সংস্থা রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে, বিশেষ করে চলতি বছরের শেষদিকে একটি বড় বৈশ্বিক সম্মেলন আয়োজনের জন্য তার সহায়তা চান। জবাবে গ্র্যান্ডি বলেন, ‘আমরা আপনাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’ পরে ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনার কণ্ঠস্বর আরও সোচ্চার হতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পরিস্থিতি ক্রমে জটিল হচ্ছে। মায়ানমার আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’ রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল তৈরির জন্য উন্নত উপকরণ ব্যবহার করার অনুমতি দেয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানান গ্র্যান্ডি।
বৈঠকে তারা রাখাইনের মানবিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেন। সেখানে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি লড়াই করছে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, রোহিঙ্গা সংকট অবসানে তিনি উচ্চ পর্যায়ের একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন এবং তিনি সব দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করছেন।
এদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে হতে যাওয়া ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়েছেন ড. ইউনূস। বৃহস্পতিবার দুবাই কালচার অ্যান্ড আর্টস অথরিটির চেয়ারপারসন শেখ লতিফা বিনতে মুহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম সম্মেলনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ আমন্ত্রণ জানান। আগামী ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিট হবে। শেখ লতিফা বিনতে মুহাম্মদ বিন রশিদ অন্তর্বর্তী সরকারের তিন তরুণ উপদেষ্টাকে নিয়ে সামিটে যোগদানে ড. ইউনূসকে অনুরোধ করেন।
বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তে গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনের কাজ চূড়ান্ত পর্বে রয়েছে। আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে।
সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলনের ফাঁকে ২২ জানুয়ারি বুধবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এ কথা জানিয়েছেন বলে খবর বাসসের।
বাসসের প্রতিবেদনে জানা যায়, জেনিভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় থেকে প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগে তা বাংলাদেশকে দেখানো হবে বলেও প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন টুর্ক।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধ তদন্তের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের গঠিত প্রধান ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনও প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হবে। এসব প্রতিবেদন একে অপরের পরিপূরক হতে পারে।’
বৈঠকে মায়ানমার থেকে নতুন করে হাজার হাজার শরণার্থী আসার পর সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে, তা সমাধানে সহযোগিতার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানের প্রতি আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।
পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে টুর্ক জানান এ বিষয়ে জাতিসংঘের মায়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি।
এসময় রোহিঙ্গাদের নতুন করে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মায়ানমারের রাখাইন অংশে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ অঞ্চল তৈরির আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বৃহৎ পরিসরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। উচ্চ পর্যায়ের সেই সম্মেলনের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, এটি যে সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকটগুলোর একটি, ওই সম্মেলন সেদিকে বিশ্বের নজর ফেরাবে।
টুর্ক বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হারানো মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে এ ধরনের সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৈঠককালে অন্যদের মধ্যে সরকারের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সচিব লামিয়া মোরশেদ, জেনিভায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি তারেক আরিফুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
চুরি যাওয়া সম্পদ ফেরাতেও সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা
এর আগে বাংলাদেশের শত শত বিলিয়ন চুরি যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে বিদেশি নেতাদের সমর্থন চান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা বুধবার জার্মানির ফেডারেল চ্যান্সেলারির প্রধান ও বিশেষ কার্যাদির ফেডারেল মন্ত্রী উলফগ্যাং শ্মিট, বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেটংটার্ন সিনাওয়াত্রা, সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্র বিভাগের ফেডারেল কাউন্সিলর ইগনাজিও ক্যাসিস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই সংস্কৃতি ও শিল্প কর্তৃপক্ষের চেয়ারপারসন শেখ লতিফা বিনতে মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স শিসেকেদি, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রাক্তন মার্কিন বিশেষ দূত জন কেরি এবং প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারসহ অন্যান্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনামলে বাংলাদেশে কিভাবে প্রকাশ্যে ও দিবালোকে ডাকাতি সংঘটিত হয়েছিল তা খতিয়ে দেখার জন্য শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকে বাংলাদেশে পাঠাতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সচিব লামিয়া মোর্শেদ এবং জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি তারেক আরিফুল ইসলাম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
লুৎফে সিদ্দিকী জার্মান মন্ত্রী উলফগ্যাং শ্মিটকে চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে সরকারের প্রচেষ্টা সম্পর্কে অবহিত করে বলেন, ‘সরকার এই বিষয়ে একটি সম্পদ পুনরুদ্ধার কমিটি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার প্রাথমিকভাবে শীর্ষ ২০ জন অর্থ পাচারকারীকে তাদের চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে চিহ্নিত করেছে।’
দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস জার্মান মন্ত্রীকে বলেন, ‘আমরা যখন নতুন বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলি, তখন আমরা পরিষ্কার বাংলাদেশের কথাও বলি।’
প্রধান উপদেষ্টা এই বিষয়ে জার্মান সমর্থন চেয়েছেন এবং জার্মান মন্ত্রীর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। জার্মান মন্ত্রী বলেন, ‘এপ্রিলে একটি নতুন জার্মান ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ নেপালের জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা অন্বেষণের জন্য ভারত, নেপাল এবং ভুটানকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চায়। নেপাল সত্যিই বিদ্যুৎ বেচতে প্রস্তুত এবং বাংলাদেশ একটি ভালো বাজার। এটি প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে।’
প্রধান উপদেষ্টা সুইস ফেডারেল কাউন্সিলর ইগনাজিও ক্যাসিসের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং জলবায়ু অর্থায়নসহ পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি সুইজারল্যান্ডকে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে কার্বন রোধ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করেছেন। সুইজারল্যান্ডকে বাংলাদেশের যুবসমাজের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক হলো ২৭ বছরের কম বয়সী তরুণ।
প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশ্ব নেতাদের অবহিত করেন। জার্মান মন্ত্রী এবং সুইস কাউন্সিলরের সঙ্গে সাক্ষাতে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রধান উপদেষ্টা থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিনাওয়াত্রার সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট এবং জাহাজ চলাচলসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। সিনাওয়াত্রা দুই দেশের মধ্যে যুব সম্পৃক্ততা বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা থাই প্রধানমন্ত্রীকে ‘থ্রি জিরো’ ধারণা সম্পর্কে অবহিত করেন, যার লক্ষ্য দারিদ্র্য, সম্পদের ঘনত্ব, বেকারত্ব এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে একটি আত্ম-ধ্বংসী সভ্যতাকে উদ্ধার করা। অধ্যাপক ইউনূস সিনাওয়াত্রাকে বলেন, বর্তমানে বিশ্বের ৫৮টি দেশে প্রায় ৫০০০ ‘থ্রি জিরো’ ক্লাব রয়েছে। থাই প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন এই বছরের এপ্রিলে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হবে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তিনি সংগঠনের পরিকল্পিত শীর্ষ সম্মেলনের সময় বিমসটেকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশকে আসিয়ানের একটি সেক্টরাল সংলাপ অংশীদার হতে এবং ফলস্বরূপ সংস্থার পূর্ণ সদস্য হতে থাইল্যান্ডের সমর্থন চান।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহায়তা দেবে জাতিসংঘ
এদিকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্বের মনোযোগ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, অতিরিক্ত প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এসে বাংলাদেশের ওপর বোঝা বাড়িয়ে তুলেছে। অর্থনৈতিক সম্মেলনের ফাঁকে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডির সঙ্গে বৈঠকে এসব কথা বলেন তিনি।
বৈঠকে ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি জানিয়েছেন, তার সংস্থা রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে, বিশেষ করে চলতি বছরের শেষদিকে একটি বড় বৈশ্বিক সম্মেলন আয়োজনের জন্য তার সহায়তা চান। জবাবে গ্র্যান্ডি বলেন, ‘আমরা আপনাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’ পরে ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনার কণ্ঠস্বর আরও সোচ্চার হতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পরিস্থিতি ক্রমে জটিল হচ্ছে। মায়ানমার আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’ রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল তৈরির জন্য উন্নত উপকরণ ব্যবহার করার অনুমতি দেয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানান গ্র্যান্ডি।
বৈঠকে তারা রাখাইনের মানবিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেন। সেখানে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি লড়াই করছে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, রোহিঙ্গা সংকট অবসানে তিনি উচ্চ পর্যায়ের একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন এবং তিনি সব দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করছেন।
এদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে হতে যাওয়া ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়েছেন ড. ইউনূস। বৃহস্পতিবার দুবাই কালচার অ্যান্ড আর্টস অথরিটির চেয়ারপারসন শেখ লতিফা বিনতে মুহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম সম্মেলনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ আমন্ত্রণ জানান। আগামী ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিট হবে। শেখ লতিফা বিনতে মুহাম্মদ বিন রশিদ অন্তর্বর্তী সরকারের তিন তরুণ উপদেষ্টাকে নিয়ে সামিটে যোগদানে ড. ইউনূসকে অনুরোধ করেন।