alt

জাতীয়

বন কর্মকর্তা-রক্ষীদের লাগামহীন ঘুষবাণিজ্য

হুমকির মুখে সুন্দরবনের বনজসম্পদ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, খুলনা : বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫

সুন্দরবনে বনজসম্পদ বহনকারী একটি ট্রলার -সংবাদ

সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জে গোলপাতা আহরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। পদে পদে ঘুষ দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ বাওয়ালিদের। বনজীবীরা বলছেন, গোলপাতা আহরণের জন্য নৌকাপ্রতি সরকারকে যে টাকা রাজস্ব দিতে হয়, বন কর্মকর্তা-রক্ষীদের ঘুষ দিতে হচ্ছে এর কয়েকগুণ বেশি। সুন্দরবন থেকে বনজদ্রব্য আহরণ সংকুচিত, খরচ বৃদ্ধি এবং চাহিদা কমে যাওয়ায় বনজদ্রব্য সংগ্রহে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তারা।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জে গোলপাতা কাটার মৌসুম শুরু হয় ৩ ফেব্রুয়ারি। শেষ হবে ৩১ মার্চ। প্রথম দফায় ২৮ দিনের অনুমতি পেয়ে ৮৯টি নৌকায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরছেন বাওয়ালিরা।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের একটি প্রাকৃতিক অর্থকরী সম্পদ গোলপাতা। গোলপাতা আহরণ মৌসুমে একেকটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১৮৬ কুইন্টাল অর্থাৎ প্রায় ৫০০ মণ গোলপাতা বহনের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। আহরণ করা প্রতি কুইন্টাল গোলপাতার জন্য বন বিভাগকে ৬০ টাকা করে রাজস্ব দিতে হয়।

উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নামে গোল হলেও গোলপাতা আসলে গোলাকার নয়, লম্বাকৃতির। এর পাতা সবুজ বর্ণের, নারিকেল পাতার মতো। গোলপাতার ছাউনির ঘরে গরমের সময় ঠা-া এবং শীতের সময় গরমভাব অনুভূত হয়। এ পাতা দিয়ে ভালোভাবে ঘরের ছাউনি দিলে তিন-চার বছর অনায়াসে পার হয়ে যায়। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ঘর নির্মাণের উপকরণ হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে গোলপাতা ব্যবহার করে আসছে।

তবে তুলনামূলকভাবে এখন গোলপাতার চেয়ে টিনের দাম কম হওয়ায় দিন দিন এর ব্যবহার কমছে।

আর চাহিদা কমে যাওয়ায়, আগের তুলনায় গোলপাতা সংগ্রহকারী বনজীবীর সংখ্যাও কমেছে।

গোলপাতা আহরণ মৌসুমে সুন্দরবনের গোলঝাড় থেকে পাতা কাটার সময় মাঝপাতার (মাঝের কচি পাতা) পাশে ঝাড় রক্ষায় একটি পূর্ণাঙ্গ পাতা (ঠ্যাকপাতা) রেখে আহরণের নিয়ম রয়েছে) কিন্তু সেই ঠ্যাকপাতা না রেখে ঝাড়ের সব পাতা কাটা হয়েছে। পাশাপাশি বাওয়ালিরা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত গোলপাতা নৌকায় করে আনছেন।

সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাংবাদিক শুভ্র শচীন বলেন, উপকূলের প্রান্তিক মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস সুন্দরবন। এই বনকে ঘিরে কোনও না কোনেভাবে প্রায় দেড় লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। নিয়ম মেনে সম্পদ আহরণ করা না হলে বনের ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হবে।

শুভ্র শচীন বলেন, গোলপাতা আহরণ মৌসুমে নানা অপরাধের ঘটনা ঘটছে সুন্দরবনে। ৫০০ মণ ধারণক্ষমতার একেকটি নৌকায় বর্ধিত অংশ জোড়া দিয়ে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ গোলপাতাবোঝাই করে আনা হচ্ছে। গোলপাতার আড়ালে বন থেকে আনা হচ্ছে বিভিন্ন গাছের খ-। এভাবে ঝাড় ধ্বংস করে পাতা কাটার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে গোলবন। এতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়ছে সুন্দরবন।

তবে সুন্দরবনের বাওয়ালি-মহাজনরা বলছেন, সুন্দরবনের বনজসম্পদ আহরণে পদে পদে ঘুষ লাগায় ক্ষতি পোষাতে নৌকায় তারা বেশি করে গোলপাতা ও কাঠবোঝাই করতে বাধ্য হন। বন কর্মকর্তা-রক্ষীদের টাকা না দিলে বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেন। এসবের পরও জীবিকার তাগিদে পুরোনো পেশা টিকিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতোমধ্যে গোলপাতাভর্তি নৌকা সুন্দরবনের লোকালয়ে আসতে শুরু করেছে। মৌসুমের প্রথম দফায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরেছেন তারা। সরেজমিন সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড়ে বাঁধা রয়েছে গোলপাতাবোঝাই বড় বড় নৌকা। বাওয়ালিরা নদীর বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে স্তূপ আকারে কেটে আনা গোলপাতা সাজিয়ে রাখছেন। এসব নৌকায় ৫০০ মণ গোলপাতা বোঝাইয়ের মাত্রা বেঁধে দেয়া হলেও একেকটি নৌকায় ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ পাতাবোঝাই করা। নৌকার চারপাশে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা। গোলপাতার নিচে রয়েছে সুন্দরী, পশুরসহ মূল্যবান গাছের খ-।

নৌকা থেকে গোলপাতা নামানোর ফাঁকে কয়েকজন বাওয়ালি বলেন, এখন আর আগের মতো গোলপাতায় ভালো ব্যবসা নেই। বনদস্যুদের চাঁদা আর সরকারি রাজস্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা দিতে হয় বন বিভাগের কর্মকর্তাদের। চলতি গোলপাতা কাটার মৌসুমে বাওয়ালিদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার জন্য এসব কর্মকর্তা নৌকাপ্রতি আদায় করেছেন ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এতে লোকসানে পড়ছেন তারা।

আবদুস সালাম নামে একজন বাওয়ালি বলেন, ৫০০ মণ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি গোলপাতার নৌকায় সাকল্যে সরকারি রাজস্ব আসে ১২ হাজার টাকার মতো। বন অফিস থেকে অনুমতি নেয়ার সময় বন কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত টাকা বখশিশ, এরপর কুপে তল্লাশি, ঘের দেয়া, ঘাটে তল্লাশি, সিটি কাটানো (পারমিট হস্তান্তর) সহ বিভিন্ন অজুহাতে সবমিলিয়ে আরও ৩০-৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। তারপরে রয়েছে বনদস্যুদের চাঁদা। সুন্দরবনজুড়ে বেড়েছে বনদস্যুদের উৎপাত।

সালাম বলেন, এসব টাকা দিতে গিয়ে ব্যাপক লোকসানে পড়ছেন তারা। এ কারণে নৌকায় তারা বেশি করে গোলপাতা ও কাঠবোঝাই করতে বাধ্য হয়েছেন।

কয়েকজন কূপ কর্মকর্তা, ও বনরক্ষী গোলপাতা আহরণ মৌসুমে বাওয়ালি-মহাজনদের সামান্য সুযোগ করে দিয়ে টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, এ টাকা বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ-বাটোয়ারা হয়। খুলনা রেঞ্জের গোলপাতা কূপ কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন এ বিষয়ে বলেন, বাওয়ালিদের কাছে আমার কোনো দাবি-দাওয়া নেই। তারা কিছু দিলে ভালো কথা, না দিলেও কোনো দাবি নেই। গোলপাতার আড়ালে গাছ কাটার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি গোলপাতা নৌকা পাহারা দেয়া তো আমার একার পক্ষে সম্ভব হয় না।

তবে নির্ধারিত রাজস্বের বাইরে বাওয়ালিদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের বিষয় জানা নেই বলে জানিয়েছেন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ।

গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে গাছ কাটা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে কোনো গাছ কাটতে পারবেন না বাওয়ালিরা। এমনকি নৌকায় ঝুল হিসেবেও কাঠ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি।

বনদস্যুদের তৎপরতার বিষয়ে তিনি বলেন, ভুক্তভোগী এমন কোনো বনজীবী এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। তবে বিভিন্ন জনের মাধ্যমে বনদস্যুদের বেপরোয়া কর্মকা-ের কথা শুনেছি।

এ বিষয়ে কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী হাসান বলেন, ৫ আগস্টের পর সুন্দরবনসহ সংলগ্ন এলাকা থেকে ২২টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। হান্নান বাহিনীর প্রধান হান্নানকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পুলিশ-র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহায়তায় তালিকাভুক্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ছবি

আ. লীগকে নিষিদ্ধের দাবি: রাতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ সকালেও চলছে

ছবি

বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা বহাল থাকছে দুই মাস

‘উলবাকিয়া মশা’ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নতুন সম্ভাবনা: আইসিডিডিআর’বি

সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মৌন প্রতিবাদ সমাবেশ

বিএনপির সদস্য সংগ্রহ: যোগ দিতে পারে আ’লীগের ‘ক্লিন ইমেজের’ লোকও

ছবি

ববি’র ভিসির পদত্যাগ দাবি : শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন শিক্ষকরাও

ছবি

আবদুল হামিদের দেশত্যাগ: পুলিশ সুপার প্রত্যাহার, তদন্ত কমিটি গঠন

ছবি

বিচার কার্যক্রম ত্বরান্বেতে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২

ছবি

মুন্সীগঞ্জের নিমতলায় ৫ জনসহ পাঁচ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১১

রমনা বটমূলে বোমা হামলা: হাইকোর্টের রায়ের পরবর্তী অংশ ঘোষণা ১৩ মে

এবার টিউলিপকে দুদকে তলব

ছাত্রদের বাদ দিয়ে ‘দ্বি-দলীয় বন্দোবস্তে’ ফিরতে ‘এস্টাবলিশমেন্ট অপেক্ষমাণ’: তথ্য উপদেষ্টা

চট্টগ্রাম বন্দরে ৮০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে নেদারল্যান্ড: বিডা চেয়ারম্যান

প্রতিদিন নতুন নতুন সংস্কারের লিস্ট, সব জটিল হয়ে যাচ্ছে: মির্জা ফখরুল

ছবি

ভারত-পাকিস্তান: পাল্টাপাল্টি হামলা অব্যাহত, বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা

ছবি

সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারলে পদত্যাগ করবেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

পাকিস্তানে ভারতের হামলা দুঃখজনক: চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন

ছবি

ছাত্রদের বাদ দিয়ে দ্বিদলীয় বন্দোবস্তে ফিরতে চায় এস্টাবলিশমেন্ট: মাহফুজ আলম

চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

ছবি

রমনা বটমূলে বোমা হামলা: হাইকোর্টে রায় পড়া শুরু

খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা, সবাইকে ধন্যবাদ তারেক রহমানের

হত্যার তিন মাস পর কারামুক্ত হই, আদালতকে লিটন

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বেতন কমানোর নির্দেশ

সাবেক আইজিপি শহীদুল ও দুইজনকে দ্বিতীয় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি

মিথ্যা মামলা: আসামি খালাস, বাদীর সাজা

ছবি

বিশ্বকবির ১৬৪তম জন্মবার্ষিকী বৃহস্পতিবার

ছবি

দেশে প্রথম জলাভূমিনির্ভর প্রাণীদের দু’টি অভয়ারণ্য ঘোষণা

ছবি

ঘোড়াঘাটে পানির দরে আলু বিক্রি, পথে বসেছেন চাষিরা

ছবি

একযোগে বিআরটিএ’র ৩৫ কার্যালয়ে দুদকের অভিযান

ভারত যেভাবে লোকজনকে ঠেলে দিচ্ছে, তা ‘ঠিক নয়’: খলিলুর

ছবি

কুড়িগ্রামে ৩৬ রোহিঙ্গাসহ ৮ বাংলাদেশিকে পুশইন করেছে বিএসএফ

ছবি

শেখ হাসিনাকে দুদকে তলব

নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের প্রশ্ন

৬ হাজার কোটি টাকার হিসাব না দিয়েই ‘পালিয়েছেন’ সাবেক প্রকল্প পরিচালক : উপদেষ্টা

সালমান পরিবারের ৯৪ কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ

ঐকমত্যে পৌঁছাতে ছাড় দেবে নাগরিক ঐক্য

tab

জাতীয়

বন কর্মকর্তা-রক্ষীদের লাগামহীন ঘুষবাণিজ্য

হুমকির মুখে সুন্দরবনের বনজসম্পদ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, খুলনা

সুন্দরবনে বনজসম্পদ বহনকারী একটি ট্রলার -সংবাদ

বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫

সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জে গোলপাতা আহরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। পদে পদে ঘুষ দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ বাওয়ালিদের। বনজীবীরা বলছেন, গোলপাতা আহরণের জন্য নৌকাপ্রতি সরকারকে যে টাকা রাজস্ব দিতে হয়, বন কর্মকর্তা-রক্ষীদের ঘুষ দিতে হচ্ছে এর কয়েকগুণ বেশি। সুন্দরবন থেকে বনজদ্রব্য আহরণ সংকুচিত, খরচ বৃদ্ধি এবং চাহিদা কমে যাওয়ায় বনজদ্রব্য সংগ্রহে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তারা।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জে গোলপাতা কাটার মৌসুম শুরু হয় ৩ ফেব্রুয়ারি। শেষ হবে ৩১ মার্চ। প্রথম দফায় ২৮ দিনের অনুমতি পেয়ে ৮৯টি নৌকায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরছেন বাওয়ালিরা।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের একটি প্রাকৃতিক অর্থকরী সম্পদ গোলপাতা। গোলপাতা আহরণ মৌসুমে একেকটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১৮৬ কুইন্টাল অর্থাৎ প্রায় ৫০০ মণ গোলপাতা বহনের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। আহরণ করা প্রতি কুইন্টাল গোলপাতার জন্য বন বিভাগকে ৬০ টাকা করে রাজস্ব দিতে হয়।

উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নামে গোল হলেও গোলপাতা আসলে গোলাকার নয়, লম্বাকৃতির। এর পাতা সবুজ বর্ণের, নারিকেল পাতার মতো। গোলপাতার ছাউনির ঘরে গরমের সময় ঠা-া এবং শীতের সময় গরমভাব অনুভূত হয়। এ পাতা দিয়ে ভালোভাবে ঘরের ছাউনি দিলে তিন-চার বছর অনায়াসে পার হয়ে যায়। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ঘর নির্মাণের উপকরণ হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে গোলপাতা ব্যবহার করে আসছে।

তবে তুলনামূলকভাবে এখন গোলপাতার চেয়ে টিনের দাম কম হওয়ায় দিন দিন এর ব্যবহার কমছে।

আর চাহিদা কমে যাওয়ায়, আগের তুলনায় গোলপাতা সংগ্রহকারী বনজীবীর সংখ্যাও কমেছে।

গোলপাতা আহরণ মৌসুমে সুন্দরবনের গোলঝাড় থেকে পাতা কাটার সময় মাঝপাতার (মাঝের কচি পাতা) পাশে ঝাড় রক্ষায় একটি পূর্ণাঙ্গ পাতা (ঠ্যাকপাতা) রেখে আহরণের নিয়ম রয়েছে) কিন্তু সেই ঠ্যাকপাতা না রেখে ঝাড়ের সব পাতা কাটা হয়েছে। পাশাপাশি বাওয়ালিরা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত গোলপাতা নৌকায় করে আনছেন।

সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাংবাদিক শুভ্র শচীন বলেন, উপকূলের প্রান্তিক মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস সুন্দরবন। এই বনকে ঘিরে কোনও না কোনেভাবে প্রায় দেড় লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। নিয়ম মেনে সম্পদ আহরণ করা না হলে বনের ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হবে।

শুভ্র শচীন বলেন, গোলপাতা আহরণ মৌসুমে নানা অপরাধের ঘটনা ঘটছে সুন্দরবনে। ৫০০ মণ ধারণক্ষমতার একেকটি নৌকায় বর্ধিত অংশ জোড়া দিয়ে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ গোলপাতাবোঝাই করে আনা হচ্ছে। গোলপাতার আড়ালে বন থেকে আনা হচ্ছে বিভিন্ন গাছের খ-। এভাবে ঝাড় ধ্বংস করে পাতা কাটার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে গোলবন। এতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়ছে সুন্দরবন।

তবে সুন্দরবনের বাওয়ালি-মহাজনরা বলছেন, সুন্দরবনের বনজসম্পদ আহরণে পদে পদে ঘুষ লাগায় ক্ষতি পোষাতে নৌকায় তারা বেশি করে গোলপাতা ও কাঠবোঝাই করতে বাধ্য হন। বন কর্মকর্তা-রক্ষীদের টাকা না দিলে বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেন। এসবের পরও জীবিকার তাগিদে পুরোনো পেশা টিকিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতোমধ্যে গোলপাতাভর্তি নৌকা সুন্দরবনের লোকালয়ে আসতে শুরু করেছে। মৌসুমের প্রথম দফায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরেছেন তারা। সরেজমিন সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড়ে বাঁধা রয়েছে গোলপাতাবোঝাই বড় বড় নৌকা। বাওয়ালিরা নদীর বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে স্তূপ আকারে কেটে আনা গোলপাতা সাজিয়ে রাখছেন। এসব নৌকায় ৫০০ মণ গোলপাতা বোঝাইয়ের মাত্রা বেঁধে দেয়া হলেও একেকটি নৌকায় ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ পাতাবোঝাই করা। নৌকার চারপাশে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা। গোলপাতার নিচে রয়েছে সুন্দরী, পশুরসহ মূল্যবান গাছের খ-।

নৌকা থেকে গোলপাতা নামানোর ফাঁকে কয়েকজন বাওয়ালি বলেন, এখন আর আগের মতো গোলপাতায় ভালো ব্যবসা নেই। বনদস্যুদের চাঁদা আর সরকারি রাজস্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা দিতে হয় বন বিভাগের কর্মকর্তাদের। চলতি গোলপাতা কাটার মৌসুমে বাওয়ালিদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার জন্য এসব কর্মকর্তা নৌকাপ্রতি আদায় করেছেন ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এতে লোকসানে পড়ছেন তারা।

আবদুস সালাম নামে একজন বাওয়ালি বলেন, ৫০০ মণ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি গোলপাতার নৌকায় সাকল্যে সরকারি রাজস্ব আসে ১২ হাজার টাকার মতো। বন অফিস থেকে অনুমতি নেয়ার সময় বন কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত টাকা বখশিশ, এরপর কুপে তল্লাশি, ঘের দেয়া, ঘাটে তল্লাশি, সিটি কাটানো (পারমিট হস্তান্তর) সহ বিভিন্ন অজুহাতে সবমিলিয়ে আরও ৩০-৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। তারপরে রয়েছে বনদস্যুদের চাঁদা। সুন্দরবনজুড়ে বেড়েছে বনদস্যুদের উৎপাত।

সালাম বলেন, এসব টাকা দিতে গিয়ে ব্যাপক লোকসানে পড়ছেন তারা। এ কারণে নৌকায় তারা বেশি করে গোলপাতা ও কাঠবোঝাই করতে বাধ্য হয়েছেন।

কয়েকজন কূপ কর্মকর্তা, ও বনরক্ষী গোলপাতা আহরণ মৌসুমে বাওয়ালি-মহাজনদের সামান্য সুযোগ করে দিয়ে টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, এ টাকা বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ-বাটোয়ারা হয়। খুলনা রেঞ্জের গোলপাতা কূপ কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন এ বিষয়ে বলেন, বাওয়ালিদের কাছে আমার কোনো দাবি-দাওয়া নেই। তারা কিছু দিলে ভালো কথা, না দিলেও কোনো দাবি নেই। গোলপাতার আড়ালে গাছ কাটার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি গোলপাতা নৌকা পাহারা দেয়া তো আমার একার পক্ষে সম্ভব হয় না।

তবে নির্ধারিত রাজস্বের বাইরে বাওয়ালিদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের বিষয় জানা নেই বলে জানিয়েছেন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ।

গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে গাছ কাটা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে কোনো গাছ কাটতে পারবেন না বাওয়ালিরা। এমনকি নৌকায় ঝুল হিসেবেও কাঠ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি।

বনদস্যুদের তৎপরতার বিষয়ে তিনি বলেন, ভুক্তভোগী এমন কোনো বনজীবী এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। তবে বিভিন্ন জনের মাধ্যমে বনদস্যুদের বেপরোয়া কর্মকা-ের কথা শুনেছি।

এ বিষয়ে কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী হাসান বলেন, ৫ আগস্টের পর সুন্দরবনসহ সংলগ্ন এলাকা থেকে ২২টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। হান্নান বাহিনীর প্রধান হান্নানকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পুলিশ-র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহায়তায় তালিকাভুক্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

back to top